(লেখাটি 'প্রজ্ঞান' নবম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০১১তে বেরিয়েছিল। এছাড়াই দৈনিক সংবাদ লহরির রবিবাসর পত্রিকারে ১৭ মার্চ, ২০১৩ থেকে পর পর ছ'টি সংখ্যাতে ধারাবাহিক বেরোয়।)
চিনা - জাপানিরা যা পারে আমরা না পারব কেন ?
‘এখন কম্পিউটারের যুগ । সুতরাং ইংরেজি নইলে চলবে না’ –এই কুসংস্কারের শুরু দুই দশক আগে । নব্বুইর দশকে । নতুন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনই বলুন আর দুষ্কৃতীই বলুন এটি এসছে বিশ্বায়নের হাত ধরে । বিশ্বায়ন, কেবল টিভি, মোবাইল, ইণ্টারনেট এবং ইংরেজি ভাষাকে যেন এক সূত্রে গাঁথা হলো নতুন করে। শব্দগুলোর নতুন চিহ্নায়িত হয়ে গেল বিজ্ঞান, আধুনিকতা এবং আভিজাত্য। বিশ শতকের প্রায় পুরোটাই বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা তাঁর কালের আরো লেখক বুদ্ধিজীবিদের ইংরেজিতে লিখে বড়লোক হবার দুস্বপ্নের গল্প পড়ে হাসতে হাসতে আমরা যারা মানুষ হয়েছিলাম, শতাব্দী পার করতে না করতেই সেই আমরাই আমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে পাঠালাম সেই ইংরেজি মাধ্যমেরই স্কুলগুলোতেই।
বিজ্ঞান আর আধুনিকতাটা আড়ম্বর মাত্র, আঁতের কথাটা হলো আভিজাত্য। আর আভিজাত্যের সঙ্গে দিনবদলের কোনো সংযোগ নেই। পরিবর্তনের রথের চাকাকে ততটাই সে এগুতে দেয় যতটা তার আভিজাত্যের সঙ্গে মানায় ভালো । এর বেশি তার কোনো কৌতুহল নেই, নেই কোনো সংশয়। তার উপর দেশটা যদি হয় দেবতা মানা আধা সামন্তবাদী ভারতবর্ষ তবেতো আর কোনো কথাই নেই। সেই কম্পিউটারে ইংরেজি ভাষাতে রাশি বিচার করা হয় বিজ্ঞাপন দিলেও হুমড়ি খেয়ে পড়বার লোকের অভাব হয় নি কোনো কালে, হবেও না অচিরে। কেউ এই সামান্য প্রশ্নটাও করবে না যে, আচ্ছা! পৃথিবী গ্রহটা আমাদের ভাগ্যে ভালো মন্দ কোনো প্রভাব ফেলে না কেন? এর কোনো প্রতিকার-বিকার কিছু নেই কেন? কিম্বা নিদেন পক্ষে এই প্রশ্নটাও নয় যে জ্যোতিষশাস্ত্র কি আকাশে রাহু কেতুর সন্ধান নিতে কোনো গ্রহটহ পাঠালো আকাশে, যে ঐ বিধঘুটে রাহুকেতুর কীর্তিকলাপের খবর নিতে কম্পিউটারের দ্বারস্থ হতে হবে! অথচ বিজ্ঞানের গোড়ার কথাটাই হলো কৌতুহল।
সম্প্রতি জাপান ঘুরে এলেন অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ অধ্যাপক হিমাদ্রি শেখর দাস। এসেই দৈনিক যুগশঙ্খে এক দারুণ ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন, 'জাপান যাত্রার ডায়েরি'। লেখাটা বিশুদ্ধ বাংলা ভাষাতে বাংলা হরফে ইন্টারনেটে তাঁর ব্লগেও আছে। দেখুনঃhttp://himsekhar.blogspot.com । তাতে লিখেছেন,“ এখানে আসার পর থেকে ভাষা নিয়ে একটা সমস্যা ছিল । জাপানের খুব কম মানুষই ইংরেজি বুঝতে পারেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ভাষা আমাদের কাছে আবেগ বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়ায়নি । ইশারায় উভয় পক্ষই জেনে গেছি নিজেদের বক্তব্যের বিষয় বা প্রয়োজনীয়তার কথা । রাস্তায় হোক কিংবা ট্রেনেই হোক যখনই প্রয়োজন পড়েছে সাহায্যের জন্য সবাই প্রস্তুত । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও সেই অর্থে ইংরেজিতে দক্ষ নয় । ওদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম জাপানে সবকাজই জাপানী ভাষাতেই হয় । পি এচ ডি থিসিসও এর ব্যতিক্রম নয় । নিজ ভাষার প্রতি এতটাই তাদের সম্মান ও ভালবাসা । বিশেষ কোন প্রয়োজন না পড়লে অন্য ভাষা শিখতে তার আগ্রহী হয়ে ওঠেনা । ইউরোপীয় ভাষাচর্চা না করার দরুণ সভ্যতার অগ্রগতির পথযাত্রায় খুব একটা অসুবিধে হয়েছে, দেখে তা মনে হলনা” আমরা এমন আরো অজস্র নজির দিয়ে দেখাতে পারি আমাদের ইংরেজি প্রীতিটা আসলে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রতি চাপা প্রেমের নজিরও বটে। বাকি এর পক্ষে যত্ত সব যুক্তি সবই, এক্কেবারে ফালতু। বিলেতিদের উপনিবেশ ছিল না, এমন যে কোনো দেশেই ইংরেজি যে একটা ভাষা এই সত্যই জানে খুব কম লোকে। ইংরেজির থেকে জনপ্রিয় ইউরোপীয় ভাষা আসলে স্পেনিশ, তাও ঐ উপনিবেশের ফল। আর কিচ্ছু না! চিনা জাপানি লিপি আমাদের থেকে শতগুণে জটিল। কী মনে হয়, হিমাদ্রি যে জাপানিদের কথা লিখলেন তারা কেউ কম্পিউটার ব্যবহার করেন না! আর করলে কি সেখানে জাপানি চলে না! টিভির বাণিজ্য সংবাদে , বিশেষ করে বিবিসি বা সিএনএন যে কেউ জাপানের ষ্টক মার্কেটের কাজকর্মের ছবি দেখে নিলেই জবাব স্পষ্ট পেয়ে যাবেন। সেই একই ছবি দেখা যাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে চলা চিন দেশেও। চিনা-জাপানিরা যা পারে আমরা না পারব কেন?
সেই হীনমন্যতার বিরুদ্ধেই এই লেখা। কী করে বাংলা লিখতে পড়তে হয় কম্পিউটারে তা নয়, আপাতত আমরা চাইব যারা নেটে রোমান হরফে বাংলা লেখার অভ্যেস ধরে রেখেছেন তাদের আধুনিকতার ভ্রান্তিটাকে ধরিয়ে দেয়া। আজ যখন ইউনিকোড এসে গেছে,নেটে বাংলা লিখবার জন্যে ‘অভ্রে’র মতো এতো সুন্দর ব্যবহার বান্ধব কীবোর্ড রয়েছে, রয়েছে অজস্র বাংলা ফন্ট, যখন জি-মেইল, ফেসবুক নিজেই আপনি বাংলাতে লিখবার মতো ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যখন ফায়ারফক্সের মতো বহুভাষিক ব্রাউজার এসে গেছে,যখন অপেরা ব্যবহার করে মোবাইলেও বাংলা লিখতে পারেন, যখন উবুণ্টু লিনাক্স, মাইক্রোসফট সেভেনে আপনি পুরো কম্পিউটারকেই বাংলাতে সাজিয়ে নিতে পারেন, যখন কম্পিউটারের আপনার সৃষ্টিশীল লেখাগুলো লিখতে পারেন, সম্পাদনা করতে পারেন, প্রকাশ করে দূরদেশের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন, এমন কি আপনার পড়ার টেবিল থেকেও ভালো আস্তানাতে তাকে সংরক্ষিত করতে পারেন নেটে/ ব্লগে, তখনও যারা রোমান হরফের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন তাদের রোমান হরফ প্রীতির বিরুদ্ধে, তাদের আভিজাত্যসুলভ অজ্ঞতার বিরুদ্ধে বর্তমান নিবন্ধ।
যথাপ্রাপ্ত অবস্থার কাছে যারা দাসত্ব করতে চান নিঃ
পোর্তুগীজ পাদ্রি মনোএল দ্য আসসুম্পসাউর ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ’ (Crepar Xaxtrer Orth, Bhed)’ আধুনিক বাংলা ভাষার প্রথম গদ্য গ্রন্থ। লিখেছিলেন ১৭৩৫এ। ঐ একই সময়ে তিনি (১৭৩৪-৪২) আরো একটি বই লেখেন - ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পোর্তুগিজঃ দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস’ দুটো বইই ১৭৪৩এ পোর্তুগালের রাজধানী থেকে ছেপে বেরোয়। বাংলা ভাষাতে এ দুটিই প্রথম ছাপা বই। এবং দ্বিতীয়টি বাংলা ভাষাচিন্তারও প্রথম বই। বাংলাভাষা নিয়ে আমরা নিজেরা এর আগে বৌদ্ধিক প্রয়াসের চিহ্নই রাখিনি । আজকের পরিচিত মান বাংলাভাষাতে লেখা নয় বইদুটো । বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার অদূরে বর্তমানে গাজীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত, তৎকালীন ভাওয়াল পরগণার বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করেই মনোএল লিখেছিলেন এদুটো বই। কিন্তু লিখবার জন্যে যে হরফের ব্যবহার করেছিলেন , সেটি বাংলা ছিল না। ছিল রোমান। তাঁর কাছে রোমানে লেখাটা ছিল এক বাধ্যবাধকতা । কারণ ছাপা বইয়ের জন্যে উপযোগী যে প্রায়োগিক হরফের দরকার ছিল সেটি কী হবে, কেমন হবে-- তা স্থির করতে আমাদের অপেক্ষা করত হয়েছিল আরো চার দশক। ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত ইংরেজিতে লেখা নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের‘A Grammar of the Bengal Language’ বইতেই বাংলা হরফ প্রথম ব্যবহৃত হয়। চার্লস উইলকিন্সনস এবং তার সহকারী পঞ্চানন কর্মকার গুটেনবার্গের উদ্ভাবিত মূদ্রণ প্রযুক্তিটিকে বাংলার উপযোগী করে তুলেন এবং প্রথমবারের মত প্রয়োগসম্ভব করেন। ধাতুর ব্লকে ঢালাই করা একই আকৃতি একই হরফের জন্য একাধিক পাতাতে ব্যবহার করা যায় বলে বাংলা ছাপা হরফে একটা স্থায়ী, বৈষম্যহীন রূপ এসেছিল।
হ্যালহাডের বইয়ের নামটা দেখুন ‘Bengali’ নয় কিন্তু, ‘Bengal Language’। এই সেদিন অব্দি সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লার মতো বিশাল মাপের ভাষা ব্যক্তিত্বরাও ‘বাংলা’ কথাটা ব্যবহার করতেন না, লিখতেন ‘বাঙ্গালা’। আমরা যাকে বাংলা ভাষা এবং লিপি বলে আজকাল জানি তার ইতিবৃত্ত বহু প্রাচীন হলেও এর নাম ‘বাংলা’ ছিল না, আর সবাই লিখবার বেলা ঐ এক হরফ ব্যবহার করতেন না। জায়গায় জায়গায় ঐ লিপির বৈচিত্র যেমন ছিল, তেমনি আরবি, সিলেটি নাগরি,মায়ানমারের মন-খেমের ইত্যাদি লিপিতেও বাংলা লেখা হতো। পঞ্চানন কর্মকারেরা যে ব্রাহ্মি-কুটিল হয়ে আসা যে লিপিটিকে ছাপা বইতে তুলে ধরেন সেটিই ক্রমে বিকশিত হয়ে আজকের বাংলা হরফ বা বর্ণমালার চেহারা নিয়েছে বা নিচ্ছে ।
হ্যালহেডের বইতে বাংলা হরফের প্রয়োগ হলেও তার ব্যাপক প্রচলন হতে লেগেছিল আরো শিকি শতাব্দি। তাঁরা শুরু করেছিলেন মাত্র । পঞ্চানন কর্মকার কোনো পূর্বনজির ছাড়াই যেটুকু কাজ করেছিলেন তা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু সম্ভবত তিনি বা উইল্কিন্সন প্রযুক্তিটাকে ভালো বুঝতেন না । তাই এর পরের শিকি শতাব্দী এমন কি বিখ্যাত শ্রীরামপুর মিশনের শুরুর দিনগুলোতেও বাংলা বইপত্তর ছাপা হতো রোমান হরফে । কেউ কেউ এই রোমান হরফকেই একটা স্থায়ী রূপ দেবার প্রয়াস তখন থেকেই করছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের জনক স্যর উইলিয়াম জোনস ১৭৮৮তে একবার এরকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চার্লস ট্রিবিল্যান, পার্শ্ব, টামাস প্রমুখ অনেক সাহেব তাঁর সমর্থণে তখন দাঁড়িয়েওছিলেন । কিন্তু পাশাপাশি অন্যদের হাতে তখন আজকের বাংলা হরফের বিকাশের কাজও চলছিল।তখন অব্দি বাংলা হরফে যে পরিবর্তনগুলো এসছিল সেগুলো ছিল মূলত এরকমঃ ‘র’ হরফটি ছিল দুরকমই ‘ব’-এর পেটে দাগ কেটে এবং নিচে বিন্দু দিয়ে । নিচে বিন্দু দেয়া ‘ব’ অর্থাৎ ‘র’ এর আগে অসমিয়া এবং মৈথেলীতে অন্তস্থ-ৱ লিখতে ব্যবহৃত হতো। পেটকাটা ব অর্থাৎ ৰ এখন অসমিয়াতে প্রচলিত হলেও বাংলায় আর নেই।
শ্রীরামপুর মিশন থেকে আঠারো শতকে তিনখানা মাত্র আইনের বইয়ের সংবাদ মেলে যেগুলো বাংলা হরফে ছাপা হয়েছিল। ১৮০০তে বাইবেলের অনুবাদ দিয়ে বাংলা হরফে বই ছাপার ইতিহাসের শুরু । ততদিনে পঞ্চানন কর্মকারকেও সেখানে চাকরি দিয়ে বহাল করেছেন উইলিয়াম কেরি । পঞ্চানন কর্মকার বেশিদিন জীবিত ছিলেননা । ১৮০৪এ তিনি মারা গেলে তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছিলেন তাঁর মেয়ের জামাই মনোহর মিস্ত্রি, ও মনোহরের ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র মিস্ত্রি । বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা হরফে ছাপা বই রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্যচরিত্র।’। শ্রীরামপুর মিশনের প্রয়াসগুলোর সমকালেই খুব শীঘ্রই আরো অনেকে অনেকে বাংলা প্রকাশনার জগতে চলে আসেন। আমরা রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বই পত্রিকার জগতে আত্মপ্রকাশের কথাগুলো জানি। এরা ছাড়াও ছিলেন আরো অনেকে । ততদিনে মুদ্রণযন্ত্রের সঙ্গে ঢালাই করা বাংলা হরফও বাজারে এসে গেছে । এবং এগুলোর মধ্যে বাজারের টানেই একটা সামঞ্জস্যও আসতে শুরু করে । তখন যে পরিবর্তনগুলো হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিলঃ অনুস্বরের নিচের দাগটি ছিল না। ছিল কেবল গোল চিহ্নটি । ব্যঞ্জনের খাড়া দাগের সাথে য-ফলা মিলে বাঁকিয়ে কমলার কোয়ার মত একটা চেহারা ছিল। এগুলি আজও কখনো কখনো দেখতে পাওয়া যায় । অনেকটা স্য-তে যেমন। কিন্তু এখানে নিচে জুড়ে যায়নি । তখন নিচের দিকে জুড়ে যেত।
'তু' যুক্তাক্ষরটি বর্তমান চেহারা পায়। অর্থাৎ ত-এর নিচে ু বসিয়ে। স্থ (স+থ) যুক্তবর্ণটি হ্যালহেডের সময়ে, অর্থাৎ ১৮শ শতকে স-এর নিচে পরিষ্কার থ লিখে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি স-এর নিচে ছোট হ-এর মত অক্ষর বসিয়ে নির্দেশ করা হয়। হ্যালহেড এমন অনেক যুক্তাক্ষরেই পরের ব্যঞ্জনকে অক্ষত রেখেছিলেন। সেগুলো আর না থাকাতে যুক্তাক্ষরগুলো অস্বচ্ছ রূপ ধারণ করে। এখনও এই অস্বচ্ছ রূপই ব্যবহার করা হয় । এরকম আরও বহু যুক্তাক্ষরের অস্বচ্ছ রূপ ১৯শ শতকের শুরুর এই পর্বে নির্দিষ্ট হয়ে যায় ।
পেট কাটা ব অর্থাৎ ৰ এই সময় বাংলা বর্ণমালা থেকে বিদেয় নেয়। ১৮শ শতকের মাঝামাঝিতে এই পর্বের শেষে এসে বর্তমান নিচে বিন্দু দেয়া রূপটিই সর্বত্র চালু হয়ে যায় । (ঐ) এর পরের বাংলা গদ্যের বিকাশের ইতিবৃত্তটা আমরা মোটামোটি সবাই জানি যারাই টুকটাক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাটিয়েছি। বাংলা গদ্যের বা সাহিত্যের বিকাশের ইতিহাসে ছাপা যন্ত্রের ভূমিকার কথাটাও আমরা পড়েছি । কিন্তু যেটি কম জানি তাহলো, আড়ালে আবডালে থেকে ছাপা যন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা হরফ তথা বর্ণমালার বিকাশের কঠিন জটিল ইতিবৃত্তের কথা। ভাষাটাকে ভালোবেসে যারা তাকে ছাপা বইতে প্রকাশের যোগ্য করে তুলবার শ্রম স্বীকার করেছিলেন তাদের ত্যাগ আর তিতিক্ষার কথা । ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়ে’র কথা আমরা সব্বাই জানি, অনেকে ছেলেবেলা ঐ বই থেকেই বাংলা বর্ণমালা শিখেছি। কিন্তু যেটি জানি না, তা এই যে বর্ণপরিচয়ের লেখক বিশুদ্ধ অধ্যাপক বিদ্যাসাগর নন। সংস্কৃত কলেজের চাকরি ছেড়ে জীবিকার জন্যে তিনি এক ছাপাখানা খুলেছিলেন। মূলত সেখানেই তাঁর বর্ণমালা সংক্রান্ত ভাবনাগুলো বিকশিত হয়। সংস্কৃতের এই অধ্যাপকের উদ্দেশ্য ছিল সংস্কৃতের অধীনতার থেকে বাংলাকে মুক্ত করা । তিনি যে বদলগুলো নিয়ে আসেন সেগুলো ছিল এরকমঃ নিচে ফুটকি দিয়ে নতুন "য়" বর্ণটি ব্যবহারের প্রস্তাব করেছিলেন। একইভাবে ড ও ঢ-এর নীচে ফুটকি দিয়ে ড় ও ঢ় হরফ দুইটির প্রচলন করেছিলেন। এর আগে এগুলো বাংলাবর্ণমালাতে ছিল না । তিনি বাদ দিয়েছিলেন, দীর্ঘ-ৠ ও দীর্ঘ-ৡ । ‘৯’ বর্ণটিরও ব্যবহার না থাকলেও কেন যে তিনি রেখে দিলেন সেটি স্পষ্ট নয়। এছাড়া সংস্কৃত স্বরবর্ণমালার অন্তর্গত অনুস্বার (ং), বিসর্গ (ঃ), এবং চন্দ্রবিন্দু (ঁ) যেহেতু প্রকৃতপক্ষে ব্যঞ্জনবর্ণ সেহেতু বিদ্যাসাগর এই বর্ণগুলিকে ব্যঞ্জনবর্ণমালার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এগুলোর স্বতন্ত্র ব্যবহার নেই বলে আজ অব্দি কোনো বাংলা অভিধানই বিদ্যাসাগরপ্রণীত এই বর্ণক্রমটি গ্রহণ করেনি।
বিদ্যাসাগর ণ-ন এবং শ-ষ-স-এর মধ্যে উচ্চারণের সমতা সম্ভবত লক্ষ্য করলেও এর কোন সংস্কার করেন নি। বাংলা হরফের স্বচ্ছতা ও সমতা নিয়ে আসার জন্যও তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি য-ফলাকে ব্যাঞ্জনের সাথে জুড়ে দিয়ে কমলার কোয়ার মতো না লিখে আলাদা করে লেখার ধারা চালু করেন। ফলে সর্বত্র য-ফলার আকার একই রূপ পেয়ে গেল। ঋ-কার ব্যঞ্জনের নিচে নানান চেহারাতে বসত। বিদ্যসাগরই প্রথম ব্যঞ্জনের নিচে পরিস্কারভাবে ৃ চিহ্নটি বসিয়ে লেখা চালু করেন। একইভাবে হ্রস্ব-উ কারের জন্য ু লেখা চালু করেন।
কিন্তু বিদ্যাসাগরের সংস্কারগুলি সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। অনেকগুলি অস্বচ্ছ যুক্তব্যঞ্জনের চিহ্ন অস্বচ্ছই থেকে গিয়েছিল। যেমন - তু ত-এর নিচে উ-কার দিয়ে লেখা হলেও ন্তু, স্তু যুক্তাক্ষরগুলিতে পুরনো অস্বচ্ছ রূপটিই থেকে গেল। ছাপাখানাতে ইংরেজি ধাতুঢালাই হরফগুলো একটি ডালায় দুই খোপে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সাজানো থাকত। কিন্তু বাংলায় এ নিয়ে তেমন কোন চিন্তা হয় নি । বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা হরফের জন্য ডালার একটি নকশা এবং কোন হরফের পর কোন হরফ বসবে তার নিয়ম স্থির করে দেন। তাঁর এই নকশাই ক্রমে সমস্ত হরফ ব্যবহারকারী বাংলা ছাপাখানাতে গৃহীত হয়। বাংলা মুদ্রণশিল্পে প্রতিষ্ঠিত হয় সমতা ।
বিদ্যাসাগর বাংলা মুদ্রণশিল্পকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। মূলত তার বেঁধে দেয়া নিয়মনীতি অনুসারেই পরবর্তী একশো বছর, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলা হরফ মুদ্রিত হয়। সময়ের সাথে বিদ্যাসাগরীয় হরফের সামান্য কিছু পরিমার্জনের চেষ্টাও করা হয়েছে । বিদ্যাসাগর নিজে বর্ণপরিচয়-এর ৬০তম সংস্করণ থেকে শব্দের শেষে অন্তর্নিহিত ও উচ্চারণযুক্ত ব্যঞ্জন, যেমন- 'বিগত', 'কত' শব্দের শেষের ত-টা, যেন ৎ-এর মত উচ্চারণ না হয়, সেজন্য এগুলোর উপর তারাচিহ্ন দেয়া প্রবর্তন করেন। বিশ শতকে অনেক লেখক একই কাজে ঊর্ধ্বকমা (') ব্যবহার করেছেন,রবীন্দ্ররচনাবলীর জন্যে এই নীতি নির্ধারিত হয়েছিল। প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ একে লিখেছেন ইলেক চিহ্ন । যেমন- একশ', ইত্যাদি। তবে এই সংস্কারটিও সর্বজনগৃহীত হয়নি । ( ঐ)
আমরা বানান নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর অনেক সময়। কিন্তু এই ভাবনা সাধারণত কারো মাথাতেই আসে না যে বানানের কিম্বা বর্ণমালার শুদ্ধি/ অশুদ্ধি কোনোটাই নিয়ন্ত্রণের দায়ভার কোনো মাষ্টারমশাইর হাতে নেইতো বটেই। নেই কোনো একক ভাষাতাত্বিকেরও হাতে । থাকলে সুনীতি চট্টপাধ্যায়েরা যেমন লিখতেন ‘বাঙ্গালা’ আমরাও তাই লিখতাম। কিন্তু আমরা লিখি ‘বাংলা’ –রবীন্দ্রনাথ এটা শুরু করেছিলেন। এবং রবীন্দ্রনাথের লিপি তথা বানান সংস্কার ভাবনার সঙ্গে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে’র আন্দোলনের যেমন একটা ভূমিকা ছিল তেমনি ছিল বিশ্বভারতী যখন তাঁর রচনাবলী ছাপার স্বত্ব পায় তখন তাদেরকেও এক বানান নীতি দাঁড় করাতে হয়। সেই নীতিই ক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং বাংলাদেশ বাংলা একাডেমীকেও বানান তথা বর্ণমালা বিধি তৈরিতে প্রভাবিত করে।কিন্তু এই প্রতিটি সংস্কার প্রয়াসের পেছনে রয়েছে ছাপাযন্ত্রের বিবর্তনের চাপা পড়া ইতিকথা । আনন্দবাজার পত্রিকাকেও আমরা যে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলা লিপি এবং বানান রীতিকে শাসন করতে দেখি তা এরই জন্যে । যথাপ্রাপ্ত অবস্থার কাছে যারা দাসত্ব করতে চান নি বা পারেন নি তাদের সৃজনী হাতেই এগিয়ে গেছে বাংলা লিপি, বর্ণমালা, বানান রীতি এবং ভাষা । যারা হতাশ হয়েছেন তাঁরা রোমান হরফে ফিরে যেতে চেয়েছেন; দাসত্ব যারা করে গেছেন তাদের হাতেই হয়েছে ভাষাটির যত বিড়ম্বনা। সেই দাসত্বের সবটা নয় কেবল যন্ত্রের কাছে । সাম্রায্যবাদী এবং উগ্রজাতীয়তাবাদী স্বার্থও এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ।
দাসত্বের ডাকে , যারা হতাশ হয়েছেন তাঁরা রোমান হরফে ফিরে যেতে চেয়েছে ন ঃ
বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ যখন বাংলাদেশের পাঠশালাগুলোকে শাসন করছে, বঙ্কিম যখন ‘বঙ্গদর্শনে’ সজোরে বাঙালিকে তার ইতিহাস লিখতে উদ্বুদ্ধ করছেন তখন আবার ঐ রোমান হরফকে ফিরিয়ে আনাবার এক প্রয়াস শুরু হয়েছিল দেশজুড়ে। নেতৃত্বে অবশ্যই সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষক বিলেতিরা । সম্প্রতি হুমায়ুন আজাদ তাঁর দু’খণ্ডের বিশাল সংকলন ‘বাংলা ভাষা’তে উনিশ শতকের এক অজ্ঞাতনামা লেখকের লেখা উদ্ধার করেছেন। ‘বাঙ্গালা বর্ণমালা সংস্কার’। লেখকের নাম না জানাটা বাংলা ভাষাতত্বের ইতিহাসে এক দারুণ ক্ষতি । কবেকার লেখক-- সেই তথ্যেরও কোনো সন্ধান দেননি হুমায়ুন আজাদ। তবে ১৮৬৪র আগে নয়, কেননা তখনকার Asiatic societyর Journal থেকে নেয়া ঋণ স্বীকারোক্তি আছে প্রবন্ধের শেষে। এই লেখকের বাংলা বর্ণ সংস্কারে তাঁর অনেক প্রস্তাব পরের সময়ে গৃহীত হয়েছে, আবার অনেকগুলো হয়ও নি। যেমন তিনি লিখেছিলেন, ‘অ’ ছাড়া আর সব স্বরবর্ণগুলো তুলে দিয়ে তাদের -কার চিহ্নগুলো রেখে দিতে। অর্থাৎ া,ি,ী,ু,ূ,ৃ,ে,ৈ,ো,ৌ এইও চিহ্নগুলো থাকবে আ, ই, ঈ ইত্যাদি নয়। এখন পড়তে গিয়ে আমাদের হাসি পাবে । কিন্তু তিনি তখন বাংলা হরফ উঠিয়ে দিয়ে রোমান প্রচলনের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন এটা আমাদের মনে রাখতে হবে । তাঁর সেই প্রবন্ধেই দেশজুড়া সেই রোমান বলবৎ করবার সাহেবী প্রয়াসের সংবাদ আছে । সেদিক থেকে তাঁকে বাংলাভাষা এবং লিপির স্বার্থে প্রথম লড়াকুর সম্মান দেয়া যেতেই পারে । সুতরাং বাংলাতে যে হরফ সংখ্যা কমিয়ে এনে জটিলতা কমানো যেতেই পারে এটি তাঁকে দেখাতে হয়েছিল। হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবন্ধ সম্পর্কে লিখেছেন, “একজন দক্ষ মূদ্রাকরের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান প্রকাশ পেয়েছে প্রবন্ধটিতে।” সংস্কার প্রস্তাব সম্পর্কে ভদ্রলোক লিখেছেন, “আমাদের বর্ণমালা সংস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য মুদ্রাঙ্কনের সৌলভ্যসাধন। অর্থাৎ ভাষার উচ্চারণের কোনো হানি না হয় অথচ মুদ্রাঙ্কনের সৌলভ্য হয় ইহাই আমাদের অভিপ্রেত।”
তিনি শুরুতেই দুটো প্রচলিত প্রবাদের উল্লেখ করেছেন। শুনলে হাসি পায় বটে । কিন্তু বাংলা হরফ নিয়ে বাস্তব সমস্যার দিকেও চোখ টেনে নিয়েও যায়। প্রথমটি হচ্ছে, “দধীতিকার রঘুনাথ শিরোমণি যখন গুরু মহাশয়ের পাঠশালায়, ক, খ শিখিতে আরম্ভ করেন তখন গুরু মহাশয়ের শ্রীমুখ হইতে সমুদয় ব্যঞ্জণবর্ণের একবার উচ্চারণ শ্রবণ করিবামাত্র রঘুনাথ বর্ণমালার সংস্কারে প্রবৃত্ত হইলেন। বলিয়া উঠিলেন “হ্যাঁগো, দুটা ‘জ’ দুটা ‘ব’ তিনটা ‘শ’ রাখিবার প্রয়োজন কি?” দ্বিতীয়টি, “ বঙ্গদেশীয় কোন কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব একদিন কলেজের পন্ডিতকে স্বীয় কামরায় ডাকাইয়া বলিলেন ‘ওএল পণ্ডিট টোমাডের বর্ণমালার টৃটীয় এবং চটুর্ঠ বর্গের কিছু ভিন্নটা ডেকাইটে পার? আমি ট অনেক পরিশ্রম করিয়া ডেকিয়াছি ডুইরই একরূপ উচ্চারণ।”
রঘুনাথ শিরোমনির মতো প্রশ্ন পরেও অনেক বিদগ্ধজনেরা করেছেন । কিন্তু জন্মেই, আর কোনো ভাষাতাত্বিক জ্ঞান ছাড়া কেউ মালার থেকে বর্ণ ছিঁড়ে ফেলবার প্রস্তাব দিলে কতটা গ্রহণ করা যাবে সেই প্রশ্নে আপাতত আমাদের আগ্রহ নেই। কিন্তু সাহেব প্রিন্সিপাল যদি বাংলা ধ্বনি তথা বর্ণের সংস্কারের প্রস্তাব দেন তবে কী বিপত্তি হতে পারে আমরা আঁচ করতেই পারি । রোমান হরফে বাংলা তথা ভারতীয় ভাষাগুলো লেখার প্রস্তাবের একটা বড় কারণই ছিল-- এতে বিদেশিদের বাংলা শিখতে সহজ হবে। চাকরি পেতে কিম্বা পদোন্নতির জন্যে সাহেবদের এ দেশের ভাষাতে পরীক্ষা দিতে হতো । সেই স্বার্থেই অধ্যাপক ড্রু নামে এক সাহেব রোমান লিপির প্রস্তাব দেন । রোমান হরফের পক্ষে অধ্যাপক ড্রু সাহেবের প্রথম যুক্তিটি যা ছিল,তা আজো অনেকে দেন-- রোমান বর্ণামালার অক্ষর অতি অল্প। এবং সবগুলোই আলাদা আলাদা । সংযুক্ত বর্ণ নেই। ঊর্দুর মতো এতো বিন্দুও নেই। এতে ইউরোপের এতো এতো ভাষা লেখা হচ্ছে । ভারতীয় ভাষাই যাবে না কেন? দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে, রোমান হরফে ছাপার খরচ কম পড়ে । সুতরাং এতে ভারতীয় বই ছেপে জ্ঞানের প্রচার প্রসার সহজ হবে । তাছাড়া অশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত মুদ্রকেরা ভারতীয় হরফগুলোর বৈচিত্রের জন্যে একের জায়গায় অন্য বসিয়ে বিড়ম্বনার এক শেষ করে । তৃতীয় যুক্তিটি হলো, আদালতে সেসব হস্তলিপি চলে তাকে বলে ভাঙ্গা বা সিকস্তা। সেগুলো এতো কদর্য যে অন্য কেউ পড়তেই পারেনা । হাকিম দূরে থাক মুহুরিরাও পড়তে পায় না । ফলে অনেক অবিচার হয়ে থাকে । রোমান হরফে সেসব অসুবিধে হবে না । চতুর্থ যুক্তি হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষাগুলো যদি রোমান হরফে রোমান নামে না থেকে অনুবাদ হয়ে যায় তবে মূল পদার্থজ্ঞান তলিয়ে যাবে। রোমান হরফে ওষুধের নাম লেখা থাকলে কম্পাউণ্ডারদের বড় সুবিধে হয়। পঞ্চম যুক্তিটি একেবারে মোক্ষম। ভাষাবিদেরা ঠিক করেছেন রোমান বর্ণমালা প্রাচ্য বর্ণমালার সগোত্র তথা একই বংশজাত । সুতরাং রোমান বর্ণমালাতে প্রাচ্যভাষাগুলো লেখা হলে ভাষার বিশুদ্ধতা মার যাবে না কিছুতেই ।বোঝাই যাচ্ছে এতে সেই শতাব্দি প্রাচীন উইলিয়াম জোনসের ভূত ভর করেছে ।
অধ্যাপক ড্রুর প্রস্তাবগুলোও নতুন ছিলনা কিছুতেই। আমরা আগেই লিখেছি স্যর উইলিয়াম জোনসের কথা । কিন্তু তখন বাংলা হরফে ছাপার কাজ শুরুই করা যায়নি । অঙ্কুর মেলছিল মাত্র । তবু জোনসদের সেই প্রয়াস ব্যর্থ করে দেয় শ্রীরামপুর মিশন এবং পরবর্তী উদ্যোগগুলো।যদিও জোনসের সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার যে, সংস্কৃত এবং লাতিন সহ ইউরোপীয় ভাষাগুলো এক মূল উৎস থেকে এসছে-- আধুনিক তুলনামূলক ভাষাতত্বের দ্বার খুলে দেয়, সেই সঙ্গে কিন্তু বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত করে ফেলবার এক হুজুগে উদ্যোগও শুরু করিয়ে দেয়। এবং সেটি হয়েছিল উইলিয়াম কেরির হাত ধরেই। সেই হুজুগ থেমেছিল এসে রবীন্দ্রনাথ, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ে। সে যাই হোক, কিন্তু ড্রু সাহেবের উদ্যোগ এক শতাব্দি পরে গোটা দেশেই তখন আবার নতুন করে বেশ সাড়া ফেলেছিল। পাঞ্জাবে উর্দূ ভাষাতে এটি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। লাহোরে ‘রোমান উর্দু’ নামে একটি সংগঠনও শুরু হয়েছিল এবং তাঁরা একখানা মাসিক কাগজও শুরু করেছিলেন।
অধ্যাপক ড্রুর পক্ষে কলম ধরেছিলেন জর্জ কাম্বেল নামে এক ভদ্রলোক। তাঁর যুক্তিগুলো দারুণ ছিল। সমস্ত দুর্বলতা জেনেও এক্কেবারে গায়ের জোরে চাপাতে চাইছিলেন তিনি । লিখছিলেন, “ প্রায়ই ভাষার উচ্চারণ অনুসারে তদীয় বর্ণমালার প্রবৃত্তি হইয়াছে। প্রত্যেক ভাষার উচ্চারণ ভিন্নপ্রকার, সুতরাং ইহা দৃষ্ট হয় যে, এক ভাষার বর্ণমালা অপর ভাষায় ব্যবহার করিলে একপ্রকার অসামঞ্জস্য উৎপন্ন হয়। ইহার উদাহরণ-ইংরেজি ভাষায় রোমান বর্ণমালার ব্যবহার। ইংরেজি উচ্চারণের সহিত বর্ণবিন্যাসের কিছু মাত্র সম্বন্ধ নাই” (পৃঃ৬১২,অজ্ঞাতনাম; বাংলা ভাষা ১ম খন্ড, সম্পাঃ হুমায়ুন আজাদ।) একেবারেই সেই বার্নার্ডশের উচ্চারণ। বার্নার্ডশ বুঝি একবার লিখেছিলেন, “ In English you can as well write the word “fish’ as GHOTI; take the pronunciation of ‘gh’ from ‘cough’, ‘o’ from the word ‘women’ and ‘ti’ from the word ‘nation’” কিন্তু তারপরেও সেই বর্ণমালাই ভারতীয় ভাষাগুলোর জন্যে ব্যবহার করবার পরামর্শ দিতে চান জর্জ কাম্বলে। কেন ? কারণটি একেবারেই স্পষ্ট । ভাষাগুলোর প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই, “ যতদিন ভাষার রূপ শুদ্ধ থাকে, ততদিন তাহাদিগকে নিজ নিজ বর্ণমালা দ্বারা প্রকাশ করা উচিত, কিন্তু এক্ষণে ভারতবর্ষে যে সকল ভাষা প্রচলিত, তাহাদের মধ্যে একটিরও রূপ বিশুদ্ধ নাই। এখনকার বাঙ্গালা ভাষায় শতকরা ৫টা হিন্দি, দশটা ঊর্দ্দূ এবং পঞ্চাশটা ইংরেজি কথা ব্যবহৃত হয়; হিন্দি, ঊর্দ্দূ প্রভৃতি অপরাপর ভাষারও এইরূপ খিচুড়ী হইয়াছে। এরূপ স্থলে ইহাদের সকলের নিমিত্ত একটী রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করা অনুচিত নহে।”( পৃঃ ৬১৩;ঐ)
নামোল্লেখ না করে আরো এক সাহেবের বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে এরকম , “...এক্ষণে সামান্য কেরাণী বাবুর স্ত্রী তাঁহার স্বামীকে বলেন, “এখন কি অফিস যাবার টাইম হয় নি?” ইহাতে অনুমান হইতেছে যে যেরূপ আঙ্গলোসাকসন (Anglo-Saxon) ভাষা নরম্যান (Norman ) ভাষার সহিত মিলিত হইয়া ইংরেজি ভাষায় পরিণত হইয়াছে , ক্রমশঃ এদেশী ভাষা সকলের পরিণামও সেইরূপ হইবে। এমন স্থলে রোমান বর্ণমালা ব্যবহারের যে উৎকৃষ্ট ফল, তাহা বলা বাহুল্য।” এতো স্পষ্ট ইংরেজি উগ্রজাতীয়তাবাদ এবং আগ্রাসন ধান্ধা । শেষপর্যন্ত ‘উৎকৃষ্ট ফল’টি হলো সমস্ত ভারতীয় ভাষার অস্তিত্ব বিলোপ, যেমনটি তারা করতে সফল হয়েছিল আমেরিকা –অষ্ট্রেলিয়ায়। এক ব্যক্তিতো আরো এগিয়ে গেছেন। স্পষ্টই স্বপ্ন দেখছেন যে এদেশে বিলেতি শাসন পাকা হচ্ছে, এবং আমাদের উচিত রাজার ভাষা এবং হরফ অনুরসরণ করে সেই শাসনের অনুগত হওয়া, “ যাঁহারা রোমান বর্ণমালা ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন, তাঁহাদের যুক্তিসকল সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তাঁহারা বলেন, সপ্ততি বা ততোধিক বর্ণমালার পরিবর্ত্তে একটি পঠনোপযোগী বর্ণমালা সংস্থাপন করা সম্ভাবিত নহে। কিন্তু এতাদৃশ বর্ণমালার অভাবে তাঁহারা অনেকস্থলে ইংরেজির ব্যবহার করেন, যাহার তাৎপর্য্য সুস্পষ্ট অক্ষরে লিখিত দেশী ভাষায় প্রকাশ করিলে নিঃসন্দেহে অনেক উপযোগী হইত। প্রতিবাদীরা বলেন, কতকগুলি ইউরোপীয়দিগের সুবিধার নিমিত্ত ভারতবর্ষের চিরসমাদৃত বর্ণমালাস্থলে রোমান বর্ণমালার ব্যবহার উচিত নহে। সত্য,...।” এ পর্যন্ত তিনি যুক্তিতে টিকছেন না । নিজেই লিখছেন ‘দেশী ভাষায় প্রকাশ করিলে...উপযোগী হইত।” কিন্তু এর পরেই সেই মোক্ষম যুক্তি, “... বিবেচনা কর ইউরোপীয়েরা যখন ভারতবর্ষ শাসন করিতেছেন, তখন তাঁহাদের যে অত্রত্য প্রচলিত এবং অপ্রচলিত ভাষা সমূহে ব্যুৎপত্তি লাভ করা উচিত, এ বিষয়ে বোধহয় কাহারও দ্বিধা নাই। এবং এই প্রতিজ্ঞা সিদ্ধ হইলে ইহার অনুমান স্বরূপ ইহাও স্থির বুঝিতে হইবে যে, যাহাতে ইউরোপীয়গণ সহজে ভারতবর্ষীয় ভাষা সকল অভ্যাস করিতে পারেন, প্রত্যেক হিতৈষী ব্যক্তির তাদৃশ উপায় উদ্ভাবন করা উচিত।” শুধু ভাষাই নয়, ভারতীয় ধর্মসংস্কৃতির প্রতি প্রবল ঘৃণা থেকেও যে এমন অদ্ভূৎ প্রস্তাব এসছিল তাও গোপন ছিল না। এক সাহেব লিখছেন, “ আমরা ফারসী তুর্কী প্রভৃতি যে সকল মুসলমান রাজ্যের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, সেই সকল স্থানের লোকদিগকে অসভ্য, অশিক্ষিত, নিরুৎসাহী, দুর্ব্বল এবং ধর্মনীতিশূন্য দেখিতে পাই। অর্থাৎ খৃষ্টানদিগের সহিত তুলনা করিলে মুসলমানেরা অনেক হীন বলিয়া বোধ হয়। খৃষ্টানদিগের মধ্যে যে এতাদৃশ সভ্যতাদির উন্নতি হইয়াছে ইহার কারণ কেবল মুদ্রাযন্ত্র । যে পর্যন্ত মুসলমানদিগের মধ্যে মুদ্রাযন্ত্র প্রচলিত না হইবে, ততদিন তাহাদের উন্নতিও হইবে না; আর রোমান অক্ষরের ব্যবহার ব্যতীত মুদ্রাযন্ত্রের প্রচলিত হওয়া না হওয়া তুল্য।” বাংলাতে এদের প্রচার তেমন আমল না পেলেও পাঞ্জাবে বুঝি তা ‘‘ ...দুর্ভিক্ষ বা এপিডেমিকের ন্যায় দেখিতে দেখিতে দেশময় বিস্তৃত হইয়া পড়ে।” (পৃঃ৬১৪, অজ্ঞাতনাম) আর সত্যি তাই, ‘রোমান ঊর্দু’ নামের সেই সভাটির অস্তিত্ব আজ এই একুশ শতকেও রয়েছে বহাল তবিয়তে। এবং দিনে দিনে এর স্বাস্থ্য বাড়ছে বই কমছে না ।
তাই প্রতিবাদটাও পাঞ্জাবেই ব্যাপক হয়েছিল। লাহোর গভর্ণমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ ড০ লাইটনার এবং আরো দু’একজন ইংরেজই এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। কিছু উর্দু লেখকও ছিলেন প্রতিবাদকারীদের মধ্যে । কিন্তু আপাতত আমরা তাঁদের কথা তুলব না । কারণ সেখানে উর্দু ভাষা প্রসঙ্গ টেনে লেখাকে দীর্ঘ করে যেতে হবে, নতুবা কিছু বোঝানো যাবে না। লাইটনার মোটেও মানেন নি যে ভারতীয় বর্ণমালার থেকে রোমান বর্ণমালা শেখা এবং পড়া খুব সহজ হবে । তিনি বিলেতিদের ফরাসী সহ অন্যান্য ভাষা শিক্ষার প্রসঙ্গ টেনে প্রশ্ন তুলেছেন, “ কয়জন ইংরেজ রীতিমত শিক্ষকের নিকট অধ্যয়ন না করিয়া কেবল পুস্তক পাঠ করিয়া সেই সকল ভাষার বুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন?” সুতরাং অধ্যাপক ড্রুর সৌলভ্যের যুক্তি ধোপে টেকে না, একদিককার সাশ্রয় অন্যদিকে চলে যাবে। ভারতীয় ভাষা এবং বর্ণমালার প্রতি ভারতীয়দের ভালোবাসার জন্যেও তারা তা ছাড়তে রাজি হবেন না, আর তিনি নিজেও মনে করেন, “ দেশীয় লোকেরা স্বদেশ প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিকে অনেক উৎকৃষ্ট বোধ করেন, বাস্তবিকও তাহা উৎকৃষ্ট।” তাঁর মতে রোমান হরফে ভারতীয় ভাষাগুলোকে প্রকাশ করা যাবে না । যদি যেতেই হয় তবে নতুন কতকগুলো ‘বিশেষ সংকেত সংযোগ’ করতে হবে । আর তা করলে সেই বর্ণমালা আর পরিচিত রোমান বর্ণমালা থাকবে না । রোমান হরফে এমন কি ইংরেজি পড়াটাও খুব সহজ নয়। বহুকালের অভ্যাসের ফলেই শুধু ইংরেজরা নিজেদের ভাষা শুদ্ধ করে পড়তে পারেন। নতুবা light কে তারা নির্ঘাৎ ‘লাইঘট’ পড়তেন। যে অভ্যেসের ফলে তারা ‘লাইট’ পড়েন, “ সেইরূপ অভ্যাস করিলে তাঁহারা সিকস্তা পাঠ করিতেও সমর্থ হইবেন।” দেশীয়রা রোমান হরফে শুধু একটাই কারণে আগ্রহ দেখাতে পারে বলে তিনি মনে করেন, “ইহাদ্বারা ইংরেজী লেখা সহজ হইয়া যাইবে” আর ইংরেজী শিখলে কেরানি হওয়া সহজ হয়ে যায়, “কেননা দেশীলোকেরা কেবল চাকরী পাইবার প্রত্যাশায় স্কুলে বা কলেজে শিখিতে প্রবিষ্ট হয়।” কিন্তু তিনি আবার মনে করেন তখনি কেরানির সংখ্যা এতো বেড়ে গেছে যে সাত আট টাকা মাইনেতে ভালো কেরানি পাওয়া যায়, এদের সংখ্যা আরো বাড়ানো মানে শুধু শুধু এই শিক্ষিতদের অসন্তোষ ডেকে আনা। তার মানে আমরা যেটুকু বুঝেছি , তারা লেখাপড়াতো শিখবেন কিন্তু চাকরি পাবেন না। বিলেতিদের ভারতীয় ভাষা শেখা দরকার। তাই বলে পুরো শিক্ষানীতিটাকেই তাদের অনুকুলে ঢেলে সাজানোটা কাঙ্খিত হতে পারে না । দেশের পরাধীনতার মানেটাও তিনি বুঝতেন। প্রশাসক যেমন ইচ্ছে আইন করতে পারেন, “এখানকার লোক নির্বাক। রাজপ্রদর্শিত শিক্ষা পদ্ধতি সম্পূর্ণ অনুপযোগী হইলেও ইহারা তাহার প্রতিকূল একটী কথা কহিতে পারে না ।” সাহেবের ইচ্ছেতে এদেশের হরফ পাল্টাবার প্রস্তাবের সঙ্গের ক্ষমতার রাজনীতিটাকে এই অধ্যাপক অত্যন্ত সহজ এক উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরেছিলেন। কিছু ব্রিটিশ আমলা ঠিক করলেন যে আগে দেশীয় শব্দগুলো রোমান হরফে লিখবার সময় যেখানে যেখানে ‘u’ ব্যবহার করা হতো তা ভুল ছিল, হওয়া উচিত ছিল ‘a’ । ব্যস, আর যায় কোথায়! সর্বত্র ‘u’ হটিয়ে ‘a’র প্রয়োগ শুরু হলে । ফলে Mussulman হয়ে দাঁড়ালো Massalman! লাইটনার অবশ্যি একা ছিলেন না, তখনই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে কলম ধরেছিলেন আরো বেশ কিছু সাহেব বিদ্বজ্জন। এদের মধ্যে ছিলেন রেভারেণ্ড জেমস লঙ,ড০ ডফ, পার্সন ইত্যাদি। এদের মধ্যে প্রথম দু’জন জীবনের প্রথমটা দীর্ঘদিন রোমান হরফে বাংলা সহ ভারতীয় ভাষাতে কাজ করে করে হতাশ হয়ে নিজেদের মত পাল্টেছিলেন।
সেই প্রয়াস ওখানে থেমে গেলে ভাববার কিছু ছিলনা। আমাদের যেটি অবাক করে তা, এই যে স্বয়ং ভাষাচার্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায় মতো ব্যক্তিত্বও যখন ভাষাতত্বের বাইরে গিয়ে শ্রেণিরাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তখন এই রোমান হরফের প্রেমে পড়েছিলেন। প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন তিনি তাঁর প্রথম ইংরেজিতে লেখা গবেষণা গ্রন্থ অডিবিএল-এ, তখন অব্দি তাঁর বাংলা লেখালেখির সংখ্যা ছিলনা খুব একটা বেশি। তাঁর যুক্তিটির পেছনেও প্রথম কারণটি ছিল তাঁর জানা একটি সত্য যে বাংলা লিপি আর বাংলা ভাষা এক নয়। আমরা আগেই লিখেছি, পঞ্চানন কর্মকারের আগেও কোনোদিন এক লিপিতে বাংলা লেখা হয় নি। তিনি লিখেছেন, “ The use of these various characters is a relic of the past, and the prestige of the native alphabet of Bengali has never been seriously assailed. The language has become intimately associated with it, and Bengali speakers, like people everywhere, consider the alphabet as part of their language.” (page 235; ODBL; Rupa & Co;1993) তাঁর প্রস্তাবের দ্বিতীয় কারণটিই ছিল যেমন সমস্ত মধ্যবিত্ত ভেবে থাকেন, “While admitting and appreciating all the arguments in favour of the Indian system of writing, I remain a believer in the Roman Script for all Indian Languages, because of the simplicity of the symbols of which is consists, because of its true alphabetical nature is not subordinating the vowels, because of its manifold advantages in teaching, and in printing, and because of its wide use in the civilized world. The Roman alphabet, modified, supplemented and arranged according to the scientific scheme of the Indian one, would be a desideratum for India.” (ঐ) শুরুতে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে রোমান হরফ বৈজ্ঞানিক এবং বিদ্যায়তনিক ব্যবহারের জন্যে থাকবে। অন্তত পরের পঞ্চাশ বছর যে থাকবে এ নিয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। তারপরেও যদি একে ছাড়তেই হয়, তবে, “ I would strongly advocate the unity of our country in the matter of script through that truly national script of all India—The Deva-nagari, as the next best thing.” (ঐ) এই দেবনাগরীর প্রস্তাব থেকে বোঝা যায় , তিনি গোটা দেশের জাতীয় ঐক্য নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। এমন চিন্তাতে তিনি একক ছিলেন। হিন্দিকে যারা রাষ্ট্রভাষা করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম ছিলেন।যদিও স্বাধীনতার পর তাঁর সেই হিন্দি মোহতে ভাটা পড়ে, হিন্দি উগ্রজাতীয়তাবাদ তাঁকে আশাহত করে ফেলে। বাংলা ভাষা নিয়ে উপমহাদেশে সবচে’ বেশি রাজনীতি হয়েছে যে দেশে সেই বাংলাদেশের ভাষাবিদ অধ্যাপক মোফাজ্জ্বল হায়দার চৌধুরী লিখেছেন, “ মনে রাখা দরকার যে , ভাষা বা বানান সংস্কার এ সব প্রশ্নে উত্তেজনাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এগুলি রাজনৈতিক বিষয় নয়—ভাষা বিজ্ঞানের ও কিছুটা সামাজিক অর্থনৈতিক (Sociao-economic) সমস্যা।” তখন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মতো ভারতীয় ভাষাতত্বের আদিগুরু কেন এই ফাঁদে জড়ালেন ভাবলে আমাদের অবাক হতেই হয়। অথচ তিনি ছিলেন ১৯০৩এ রবীন্দ্রনাথ , রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ আন্দোলনের এক অত্যুজ্ব্বল পরিণাম। যে আন্দোলনের মূল প্রয়াসই ছিল ইংরেজি এবং মূলত সংস্কৃতের দাসত্ব থেকে বাংলাকে মুক্ত এবং স্বাধীন ভাষা হিসেবে দাঁড় করানো। ছাপার সমস্যার উল্লেখ সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও লিখছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি যখন লেখেন, “because of its manifold advantages in ... the civilized world” তখন বোঝা যায় তিনি সেই তাঁর মধ্যবিত্ত শ্রেণি মোহ থেকে কথাগুলো লিখছেন। অন্যথা তিনি দরকারে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের প্রস্তাব দিতেন, যেটি তিনি পরে দিয়েও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বইপত্তর ছাপতে গিয়ে। কারণ যেকোনো লেখার পাঠোদ্ধার এবং , ছাপা যন্ত্রে যেকোনো ভাষার হরফ সজ্জা চিরদিনই একটা সমস্যা ছিল। ইংরেজিতেও। লাইটনার এবং বার্নার্ডশ’র দেয়া নজির থেকে আমরা তা আগে দেখিয়েওছি ।
সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শ ভারতে সর্বত্র সরকারি ভাবে গৃহীত হয় নি। বাংলা, হিন্দির মতো বড়ো বড়ো ভাষাতে না হবার বাস্তব কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। কিন্তু বহু ছোটছোট, বিশেষ করে জনজাতিদের ভাষাতে তা অনুসৃত হতে আমরা আজো দেখছি হামেশাই। পাঞ্জাবিতে যেমন গুরুমুখি, দেবনাগরি, নাস্তালিক তিনটি লিপিই ব্যবহৃত হয়, তেমনি কোঙ্কনিতেও কণ্ণড়, দেবনাগরির সঙ্গে রোমান লিপিও ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশভাগের পর বাংলাদেশে কিন্তু কেবল ঐ উর্দুর বিরুদ্ধেই লড়তে হয় নি । বাংলাকে উর্দুর মতো পার্শি বা নাস্তালিক লিপিতে লিখবার প্রস্তাবতো ছিলই, সেরকম অভ্যেসও ছিল কারো কারো কয়েক শতাব্দীর। কিন্তু নতুন ছিল রোমান লিপিতে লিখবার প্রস্তাব। ১৯৫৭তে আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেই পাকিস্তানের সমস্ত ভাষার জন্যে রোমান লিপির ফরমান জারি করেন । তিনি যে শিক্ষা কমিশন বসিয়েছিলেন তারা ১৯৫৯এ জমা দেয়া তাদের প্রতিবেদনেও তার সমর্থণ যুগিয়েছিল। দুই ড০ কুদরৎ-ই খোদা এবং অধ্যক্ষ সুফিয়ানের মতো দুই একজন বাঙালি ভাষাবিদও সেই প্রস্তাবে সমর্থণ যুগিয়েছিলেন। আয়ুব খানের উদ্দেশ্য ছিল গায়ের জোরে পাকিস্তানের ‘জাতীয় ঐক্য’ রক্ষা করা । কিন্তু ভাষাতাত্বিকদের তরফে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয় ফেরদাউস খান তার একটা তালিকা ধরে আলোচনা করেছিলেন। সেগুলো ছিল এরকম। কিন্তু শুরুতে বলে নিই এর প্রথমটি শুনে আবেগিক হবার কিছু নেই। এটি মিথ্যেও নয় , আর সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও সে জন্যেই এটিকে ধরে রাখবার পক্ষে খুব একটা প্রবল যুক্তি পান নি। ১) বাংলা আমাদের জাতীয় লিপি নয়। ২) বর্তমান বাংলা হরফের অনেক দোষ ত্রুটি রয়েছে; যেমন অতিরিক্ত অক্ষর সংখ্যা, দীর্ঘস্বর, তিন ‘শ’, দুই ‘ব’, দুই ‘জ’, দুই ‘ন’, যুক্তাক্ষর ইত্যাদি। এই হরফ সমূদ্রের মধ্যে শিশুর উৎসাহ তলিয়ে যায়। ৩) রোমান হরফে অক্ষর-সংখ্যা কম হবে এবং নতুন শিক্ষার্থীর পক্ষে সহজ হবে। এতে অতি অল্প সময়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণ সম্ভব হবে । রোমান গ্রহণের ফলে তুরষ্কে নব জাগরণ দেখা দিয়েছিল। ৪) টাইপ রাইটিঙে সুবিধে হবে। ৫) রোমান হরফে লিখন-দ্রুতি ও পঠন- দ্রুতি বাংলার চেয়ে বেশী। ৬) আমাদের পক্ষে ইংরেজী শেখা সহজ হবে। ৭) বিদেশীদের পক্ষে বাংলা শেখা সহজ হবে। ( পৃঃ ৬৯৪,হরফ সমস্যা, ফেরদাউস খান,বাংলা ভাষা ১ম খন্ড, সম্পাঃ হুমায়ুন আজাদ।)
এই প্রতিটি যুক্তিকে এই লেখক বিস্তৃত নজির দিয়ে দিয়ে খণ্ডন করেছেন। সে বিবরণ অন্যত্র দেয়া যাবে । আপাতত আমরা যা লিখতে চাই, প্রথমে অবিভক্ত বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের উত্থান, পরে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং ৭১এর মুক্তি যুদ্ধের পরে ভাবা গেছিল যে সেই উৎপাত দমে গেল বোধহয়। বাংলা ভাষা, লিপি, বর্ণমালা, এবং বানানে একটা স্থৈর্য এবং ধৈর্য এলো বোধহয়। কিন্তু শতাব্দীর শেষে বিশ্বায়ন আর সেই সঙ্গে কম্পিউটার এসে সেই শোয়ানো ভূতকে আবার জাগিয়ে দিল। বিশেষ করে ভারতে । বাংলাদেশে বোধহয় মাত্র দুই দশকের স্বাধীনতার আবেগকে দাবিয়ে দেয়া সম্ভব ছিলনা নব্বুই দশকের বিশ্বায়েনের । তাই সেদেশেই বাংলার ব্যবহারে অনাগ্রহী লোকের কথা তেমন জানি নে । যোগাযোগতো আছে প্রচুর। ‘অভ্রে’র মতো ব্যবহার বান্ধব কীবোর্ডও সেদেশেই তৈরি। এমন সুন্দর একটিও নেই ভারতে, কোনো ভাষাতেই। সমস্যাটা বোধকরি ভারতেই প্রবল,বিশেষ করে আমাদের এই পূর্বোত্তরে। কম্পিউটার ব্যক্তির ঘরের ভেতর, উরুর উপর থাকে বলেইতো আর সে মুদ্রণ যন্ত্রের মতো বিচ্ছিন্ন নয়; তারে/বেতারে সে সংযুক্ত হয়ে আছে বিশ্বের অগণন সহযন্ত্রের সঙ্গে। সেই সংযুক্তিরই নাম ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল। সেখানেও আজ বাংলা কেন, পৃথিবীর প্রায় সব ভাষা লেখা এবং পড়াই যায়। সেগুলো আজ বাঙালি হয়েই গেছে, দিনে দিনে আরো হবে। তা এমন যে পুরোনো ছাপাবই/ পত্রিকার যুগকেও সে ছাড়িয়ে যাচ্ছে আর যাবে অকল্পনীয় দ্রুতিতে। বহু হারিয়ে যেতে বসা ভাষা সরব হয়ে উঠেছে কম্পিউটারে, নেটে, মোবাইলে। আমাদের গভীর বিশ্বাস, সেই দিন দূরে নেই যখন কম্পিঊটারের জন্যেই ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর ভেতরে ‘বাতি জ্বলবে’ আবার।
“bhaarat ki pragatike liye roman lipi!” এবং ভারতের বিড়ম্বনা !
মজা হলো, যারা কৌতুহল নিয়ে সেই সংবাদ রাখেন না, রাখলেও অভ্যেসটা করেন না, লেখেন রোমানে বাংলা, পড়েন রোমানে বাংলা বা ইংরেজি, সেরকম ‘চিন্তাবিদ-শিক্ষাবিদে’রাই ভাষণ দিয়ে বেড়ান , “গেল! বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে খেলো কম্পিউটার!” তারা যে কোনো প্রগতিশীল নতুন প্রজন্ম নন,আড়াইশ বছরের রক্ষণশীলতার ধারাবাহিক ঐতিহ্যকেই বহন করে চলেছেন, আশা করছি , এ পর্যন্ত এসে আমরা সেই মতটি দাঁড় করাতে পেরেছি। সেই আদ্দিকালের গুটেনবার্গীয় ছাপা যন্ত্রের যুগে , গেল শতকের টাইপ রাইটার মেশিনের যুগে তাদের পূর্বসুসী রক্ষণশীলেরা ছিলেন প্রবলভাবে সক্রিয়। ভাষা এবং লিপির পথ রেখেছিলেন তারা আটকে । শুধু কি তাই! কম্পিউটারের দৌলতে সাংস্কৃতিক অধঃপতনেও তাঁরা খুব খুব চিন্তিত। তাঁরা কি জানেন তাদের দ্বিশতাব্দী আগের পূর্বপুরুষেরা সেই একই অধঃপতনের ভয়ে ছাপা বই ছুঁয়েও দেখতেন না। ভাবতেন এতে তাদের জাত যাবে! কোথাকার জলে, কোন জাতের লোক ছাপার কালি তৈরি করেছে কে জানে! তাই বহু বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদে বেচারা জাত না মানা বেয়াড়া প্রকাশককে লিখে দিতে হতো, “ আমাদের মূদ্রণালয়ের কালি গঙ্গাজলে শুদ্ধ করিয়া লওয়া হইয়াছে!” বই পড়লে যে জাত যায়, সেই কথাটা সম্ভবত তাঁরা ভাঙা ইংরেজিতেও বলতেন। কারণ সেখানে ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার ছিলনা অথচ বিলেতিদের প্রিয় হবার সুযোগ ছিল অপার, অঢেল।
ভাষাকে বিপন্ন করছে কম্পিউটার নয়, নেটও নয় । করছে ব্যবহারকারীদের রক্ষণশীল অভিজাত্যবোধ । অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও জানেন না কোন পথে বিপদ ডেকে আনতে পারেন তাঁরা । সেই উনিশ শতকের ‘রোমান উর্দু’ দল এখনো রয়েছেন। সমগ্র আরব বিশ্ব তথা মধ্যএশিয়া এখন নেটে তাদের লিপি ব্যবহার করেন। মিশরের বিপ্লবীরা তাদের বিপ্লবের বার্তা পাঠান আরবি লিপিতে । মিশরের ‘৬ এপ্রিল আন্দোলনে’র ফেসবুক গ্রুপ যে কেউ খুলে দেখতে পারেন। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের ‘রোমান উর্দু’দের এই অবিশ্বাস যায় না যে, আরবি-পার্সি তথা নাস্তালিক লিপিতে আজ আর কোনো কাজ করা যায়। “"Roman Urdu is strongly opposed by the traditional Arabic script lovers. Despite this opposition it is still used by most on the internet and computers due to limitations of most technologies as they do not have the Urdu script. Although, this script is under development and thus the net users are using the Roman script in their own ways. Popular websites like Jang Group have devised their own schemes for Roman Urdu. This is of great advantage for those who are not able to read the Arabic script. MSN, Yahoo and some desi-chat-rooms are working as laboratories for the evolving new script and language (Roman Urdu)."—এই বক্তব্য পাকিস্তানের উর্দু চিন্তাবিদ এবং সাংবাদিক হাবিব সুলেমানির (http://en.wikipedia.org/wiki/Roman_Urdu) এক্কেবারেই তরল যুক্তি। আসল কথা হলো এদের সঙ্গে এখন জড়িয়ে গেছে খৃষ্টীয় ধর্মীয় আবেগ। ভারতেও ১৯৮৪ থেকে মুম্বাইতে কাজ করে যাচ্ছে ‘রোমান লিপি পরিষদ’। (http://www.mngogate.com/e04.htm) মধুকর এন গোগাতে এর প্রতিষ্ঠাতা। যুক্তিগুলো নতুন কিছু নয়, স্লোগান আছে ‘bhaarat ki pragatike liye roman lipi!’ এই স্লোগানটাই আমরা শুরুতে লিখতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছিলাম। লিখেছিলাম ‘progoti’; ‘ভারত’ লিখতে গিয়ে লিখে ফেলেছিলাম, ‘bharat’--যেমন লিখতে অভ্যস্ত আরকি। পরে দেখি যে না, তাতে আরো একটা ‘a’ বসবে। নইলে ভারতের সমূহ বিড়ম্বনা! ওমন বিড়ম্বিত ভারতের বিড়ম্বিত সংগঠনের সদস্য হয়তো বেশি নেই, কিন্তু অনুগত শিষ্য যে রয়েছেন প্রচুর সংখ্যাতে এবং মার্কিনি দয়াতে তারা দিনে দিনে বাড়ছেন, সেটিতো নিশ্চিত। ভাষার বিপদ তাদের হাতেই। তাদের দীক্ষান্তর ঘটিয়ে দিতে যদি এই লেখা সামান্যও সফল হয় তবেই আমাদের শ্রম সার্থক। শুনেছি সাঁইবাবা দীক্ষা দেবার আগে শূন্য থেকে ফুল বেলপাতা কী সব কীসব নিয়ে আসতেন। তাতে তাঁর উপর আস্থা বাড়ত। আমরা সেরকম কিছু পারব না । তবু নেটে বিশুদ্ধ বাংলা হরফে , বাংলা ভাষাতে লেখা যায় বলে অবিশ্বাস যদি যেতেই না চায়, তবে ঘুরে আসতে পারেন আমার ব্লগঃ http://ishankonerkotha.blohspot.com. এই লেখা সেখানেও পেয়ে যাবেন।
5 comments:
This comment has been removed by a blog administrator.
hi, susantoda! kamon achen...apnr post e comnd ki vabe debo, vabei pachelm na:D
দিলেনইতো মন্তব্য। বলুন, কেমন লাগল লেখাটা। তথ্যের সংশোধনে সংযজনে সাহায্য পেলে ভালো লাগবে। আমি ভালোই আছি, আপনি?
Hello there! This post could not be written any better!
Reading through this post reminds me of my good
old room mate! He always kept talking about this.
I will forward this post to him. Pretty sure he will have a
good read. Thank you for sharing!
Thank you for reading it.
Post a Comment