আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Saturday, 22 December 2012

বিশ শতকের অনন্য সম্পাদক মোহম্মদ নাসিরুদ্দীন এবং বাংলা সাহিত্যের ‘সওগাত যুগ’

(লেখাটি বেরিয়েছে শিলচর থেকে প্রকাশিত 'মানবী' কাগজের কার্তিক-পৌষ, মাঘ-চৈত্র, ১৪১৯ যৌথ সংখ্যাতে)
[লেখাটি আবার বেরুলো দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গের ঈদ ক্রোড়পত্রে, ২৮ জুলাই , ২০১৪]

 
মোহম্মদ নাসিরুদ্দীন

প্রত্যাখ্যানের অন্য এক রাজনীতির কথাঃ
             “সংস্কৃতায়ন আর আরবি-ফার্সির দিকে ভাষাকে ধাবিত করবার রাজনীতি আমাদের বহু প্রাচীন, কিন্তু একে অতিক্রম করবার একমাত্র পথ কি মিলনের সরকারি বাঁধা বুলি আওড়ানো? পারস্পারিক অপরিচয়ের সমূদ্র কি কেবল কথা আর মিলনের গান গেয়েই অতিক্রম করে যেতে পারব আমরা? নাকি এর মাধ্যমে অসচেতন ভাবে নিজেরাই এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছি আমি, আমরা? মিলনের তত্ব কি এই স্থিতাবস্থাকেই, সামাজিক ভাবে আরো বৈধ করে তুলছে না? সামাজিক ভাবে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ এবং ডিভোর্সও যদি সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, তাহলে একই ভাষার দুটি সত্তার পারস্পরিক বিচ্ছেদ এবং সেই বিচ্ছেদকে মেনে নিয়েই পারস্পরিক সহাবস্থান কেন গ্রহণযোগ্য হবে না? একজন রবীন্দ্রনাথের যদি অধিকার থাকে বৈষ্ণব পদাবলীর এবং উপনিষদের ঘরানাকে প্রেরণার উৎস হিসাবে গ্রহণ করবার, তাহলে একজন মুসলমান কবিরও অধিকার আছে কোরানকে তাঁর লেখার অন্তহীন অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করবার। তাঁকে পাঠ করতে গেলে আমাদের পাঠকদেরও অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত কোরান।” কথাগুলো লিখেছিলেন কবি-প্রবন্ধিক অমিতাভ দেব চৌধুরী তাঁর ‘কবির বাড়ি’ বইতে ‘পরিচয়হীনতার আর্ত হাওয়া’ । বরাক উপত্যকা তথা সাধারণ ভাবে বাংলা সাহিত্যে অবহেলিত মুসলমান জীবন, সাহিত্যকৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে। ভালো ‘সাহিত্য’ স্থান-কালের ঊর্ধে চলে যায় বটে, কিন্তু সাহিত্যিক যে পাঠক, সাহিত্যতাত্বিকের মতোই এই সমাজেরই রোগ-শোক নিয়ে এক জীবন্ত মানুষ এবং ‘এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে’ যেতে দক্ষ আমরা এটা প্রায় স্বীকারই করতে চাইনা।

             
 
সৌজন্য সাময়িক প্রসঙ্গ
  দীনেশ চন্দ্র সেনের সাহিত্যের ইতিহাসের বই পত্তর আজকাল সুলভ নয়। কিন্তু তাঁকে নাকচ করে গালগল্প বেশ চালু আছে । আমার কাছে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদিত ‘ময়মনি সিংহ গীতিকা’ আছে। অনেকের ধারণা দীনেশ সেন শুধু ওই জেলা থেকেই গীতিকাব্যগুলো জুটিয়েছিলেন। আসলে তিনি জুটিয়েছিলেন গোটা পূব বাংলা থেকেই। তাতে সিলেট কাছাড়েরও অনেক গীত আছে এবং এই বহু পরিচিত বইটি ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র ছোট সংস্করণ মাত্র। সুখময় সম্পাদিত বইটির কোথাও এর প্রথম প্রকাশক –সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র সেনের একটিও বাক্য নেই। অথচ নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন এই লিখে, “ময়মন সিংহ গীতিকাকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত করা যায় কিনা, সে সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ আছে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের সময়সীমা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এই গীতিকাগুলি যে তার মধ্যেই রচিত হয়েছিল, তার কোন প্রমাণ নেই।” তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি ‘নদ্যার চান’ ইত্যাদি নামের উল্লেখ করেছেন এবং দুই একটিতে সুকুমার সেন উদ্ধৃত করে ‘মেঘনাদ বধে’র ভাষার ছাপ পড়েছে উল্লেখ করেছেন এবং শেষে ক্ষিতিশ চন্দ্র মৌলিকের সম্পাদিত আরেকখানা ‘প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র জালিয়াতির নথিপত্র দিয়ে শেষে লিখে দিয়েছেন, “ সুতরাং আমরা এদের সাহিত্যরস আস্বাদন করে পরিতৃপ্ত হতে পারি, এদের নিয়ে অন্য কোনভাবে গবেষণা করবার উপায় বর্তমানে নেই ।” বইটি যখন ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম আমাদের মুগ্ধ করলেও তাঁর এই অভিমতের জন্যে সমস্ত জিজ্ঞাসাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। অনেক পরে যখন প্রশ্ন করতে শিখেছি তখনই ভেবেছি কই এইকথাগুলোতো এই পণ্ডিতেরা কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল নিয়ে বলেন না। খনার বচনের কথাতো আম জনতাও জানেন। ভাষা দেখে কি কেউ দাবি করে এগুলো বিশ শতকের বলে? দুষ্টামিটা এইখানেই। জনপ্রিয় সাহিত্যে গায়কের মুখে মুখে লিপিকারের , সংগ্রাহকের সম্পাদকের কলমে কালের আঁচ পড়েই যায়। আর ঠিক তাই এগুলো নিয়ে গবেষণার দরকারটা বাড়ে বই কমে না। দীনেশ সেন স্পষ্ট বলেছিলেন, এই সাহিত্যগুলো বাংলাদেশে বৌদ্ধবিস্তারের সময় থেকে লেখা, গাওয়া এবং শোনা হচ্ছিল। সেন ব্রাহ্মণ্যবাদ বাংলার পশ্চিমের যেখানে যেখানে জাঁকিয়ে বসেছিল সেখানেই এই ধারা শুকিয়ে যাচ্ছিল। এগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তার বাইরের পূবের লোকেরা। বিশেষ করে পরের কালের মুসলমানেরা। কেননা তারা এসছিলেন ব্রাত্য সমাজ থেকে আর এগুলো ব্রাত্য সমাজের গান।“নব্য –ব্রাহ্মণ্য যেসকল স্থানে সেন রাজত্বে প্রবেশ করিতে পারে নাই, সেই খানেই ইহাদের প্রাচুর্য, যেহেতু এই সকল পল্লীগীতিকা সেই সকল স্থানে বহুদিন রাজত্ব করিয়াছে।” ( প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান; পৃঃ ৯৪) পশ্চিমের লোকেদের অবজ্ঞা-উপেক্ষার আঁচ তিনি জীবৎকালেই প্রবলভাবে অনুভব করেছিলেন । এবং বহুবার সেই অনুভব ব্যক্ত করেছিলেন। তার একটি এই “এই সাহিত্যের নানাদিক হিতে বিচার করিলে দেখা যাইবে যে , তাহা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সর্ব্ব-সম্প্রদায়ের অতীব উপভোগ্য।শুধু তাহাই নহে, এই নিরক্ষর চাষাদের সাহিত্য এতো বড় যে , তাহার চূড়া বড় বড় শিক্ষিত কবিদের মাথা ছাপাইয়া উঠিয়াছে, আমি লিখিয়াছি পশ্চিম বঙ্গের লোকেদের মধ্যে অনেকেই এই সাহিত্যের গুণে ও অপরাজেয় কাব্য-সৌন্দর্যে মুগ্ধ। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ আমার প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জন্যে, কেহ কেহ বা পূর্ববঙ্গের প্রতি বিরূপতার দরুণ এই সাহিত্যকে তাদৃশ্য আদর করেন নাই। বিদ্বিষ্ট ব্যক্তিদের কথা ছাড়িয়া দিলেও এই গীতি সাহিত্যের ভাষা তাহাদের নিকট কতকটা দুর্ব্বোধ এবং শ্রুতিকঠোর । তজ্জন্য তাঁহারা সকলে ইহার রসাস্বাদনের অধিকারী হইতে পারেন নাই।” (ঐ;পৃঃ ৯০) এই সাহিত্যগুলোতে সেকালের হিন্দু মুসলমানের যুগলমূর্তির যে ধর্মবিশ্বাস সম্পর্করহিত চরিত্র দেখে দীনেশ সেন মুগ্ধ ছিলেন সেগুলোকে ব্রাহ্মণ্যপরম্পরা কোনোকালেই সহজভাবে নেয় নি। তিনি লিখছেন,“ এক শতাব্দী পূর্ব হইতে নব্য-ব্রাহ্মণ্য ধীরে ধীরে ভৈরব নদ পার হইয়া কংশ, ধনু এবং ফুলেশ্বরীর তীরদেশে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান একত্র হইয়া যে সাহিত্যের রসাস্বাদন করিয়াছে তাহা তাহাদের মনঃপূত হয় নাই। এই গাথা সংগ্রাহকগণ আমাকে জানাইয়াছেন, ‘এই সকল গীতিকথা এবং পালাগান উচ্চশ্রেণীর হিন্দুগণ অনুমোদন করেন নাঃ তাঁহারা তাহাদের বাড়ীতে এই সকল গান গাহিতে দেন না। ইহাতে প্রাপ্ত-বয়স্কা কুমারীগণের স্বেচ্ছাবর গ্রহণের কথা আছে । ব্রাহ্মণ ও ঠাকুর দেবতার প্রতি ভক্তির কথা নাই, ইহাতে ইতর জাতির নায়কদের প্রসঙ্গ আছে। এবং জাতি নির্বিশেষে নির্বিচার বিবাহ প্রথার কথা আছে।” ( ঐ; ৮০)


           
       এর পরে কি আর আমাদের নতুন করে কোন আধুনিকতার তত্ব বিলেত থেকে আমদানী করবার দরকার ছিল? সে আধুনিকতা হোক প্রাক-রাবীন্দ্রিক কিম্বা ‘কল্লোলীয়’ উত্তর-রাবীন্দ্রিক! আমরা লিখব বিশ শতকের একটি বিখ্যাত কিন্তু ভারতে উপেক্ষিত কাগজ ‘সওগাত’ নিয়ে যেটি অবিভক্ত বাংলার সাহিত্যের ‘আধুনিকতা’র ধারক ছিল। আমাদের কথা বলতে হবে সাহিত্যের ‘আধুনিকতা’ নিয়ে। কিন্তু সে কোন আধুনিকতা? কল্লোল –কালিকলম বাদ দিন, মাইকেলের যে কাব্য-নাটকগুলো পড়ে আমরা বললাম, আধুনিক সাহিত্যের কেন্দ্রে থাকবে না ঈশ্বর কিম্বা ধর্ম ---থাকবে মানুষ, থাকবে না বিশ্বাসের কুসংস্কার বরং তার বিরোধিতা---‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র গল্প জানবার পর সেই আধুনিকতা দাঁড়ায় কিসের জোরে? হয়তো কাব্যগুণে মাইকেলের ‘সোমের প্রতি তারা’ অনেক বেশি উজ্জ্বল কিন্তু ভাববস্তুর দিকে ‘মঞ্জুর মা’ পালা কোন অংশেই হেয় ছিল কিসে? কিন্তু বিলেতিরা আমাদের শেখালেন তাঁরা আসবার আগে ইতিহাসের ধর্মান্ধতার একটা যুগ দেখতেই হবে চোখে আর বিলেতি ধাঁচে তার নাম দিতে হবে ‘মধ্যযুগ’ যার থেকে আমাদের মুক্ত করেছে বিলেতি শিক্ষা। ঈশ্বরের বদলে এবারে আমাদের আস্থা জানাতে হবে সেই শিক্ষার প্রতি। তাই আমাদের সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরাও মোটের উপর তাদের বিশ্বাস ভরসাকে সারপানি যোগায় এমন সব গ্রন্থকে নিয়ে ব্যস্ত হলেন আমাদের ইতিহাসটাকে দাঁড় করাতে। এবং ধর্মান্ধতাকে প্রতিস্থাপন করল আরো বিপজ্জকনক বিষয়--- সাম্প্রদায়িকতা। আমরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে সংগত ভাবেই তার প্রাপ্য মর্যাদা দিলাম , কিন্তু শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জুলেখা’কে নিয়ে সন্দিহান হলাম। পূর্ব বঙ্গের সাহিত্য নিয়ে প্রথম গবেষক দীনেশ চন্দ্র সেন যাই বলুন না, আমাদের আধুনিক গবেষককে লিখতেই হবে, “... ‘রূপবতী’তে হিন্দু নারীর প্রতি মুসলমান রাজপুরুষের কুদৃষ্টি এবং তার সাংঘাতিক পরিণাম বর্ণিত হয়েছে। এই পালাগুলি মুসলিম আমলের একটি তিক্ত বিষয়ের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।”( সুখময় মুখোপাধ্যায়;ভূমিকা; ময়মন সিংহ গীতিকা;পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ; ১৯৮২; প্রকাশক ভারতী বুক স্টল) এই মুসলিম আমলেরই অন্যনাম ‘মধ্যযুগ’ কে না জানেন? দীনেশ সেন সেই সেকালেই এই যুগবিভাজন নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, “এই অবজ্ঞাত সাহিত্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দ্বারা উপেক্ষিত। আমরা জনাকতক শিক্ষাভিমানী লোক ইংরাজির শিক্ষানবিশী করিয়া গত অর্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে যে একটি অর্দ্ধ-পক্ক সাহিত্যের সৃষ্টি পূর্বক তাহারই স্পর্দ্ধায় গগন-মেদিনী কাঁপাইতেছি, তাহাতেই বঙ্গ সাহিত্যের আদিযুগ ও মধ্যযুগ পরিকল্পনা করিয়া তৃপ্তিলাভ করিতেছি, অথচ এই সাহিত্যকে কেহ কেহ ফিরিঙ্গিয়ানা দুষ্ট বিকৃত সাহিত্য মনে করিয়াছেন। ( ঐঃপৃঃ ১০০)

                    সাহেবদের অনুমোদন না পেলে কোনো কথা গ্রহণ করে না বাঙালি—এই সত্য জেনে তিনি তাঁর পক্ষে প্রচুর প্রমাণ পত্র যোগাড় করেছিলেন সাহেবদের থেকে। এমন কি র‍্যোঁমা রোলা-র থেকেও। আমাদের পূর্বোত্তরেও কোন কথা ততক্ষণ না দাঁড়ায় যদি ‘আধুনিক’ পশ্চিমের মহানাগরিক বাঙালি তাত্বিকেরা সমর্থন না যোগান। সাধারণত আমি এই ‘পশ্চিমা’দের প্রতি ভক্তির বিরোধিতা করতে গিয়েই তাদের এড়িয়ে চলি। আমাদের যে সাহিত্য-কর্মীকে নতুন জিজ্ঞসা বিব্রত করে তাদের তুলে আনি। এখানেও তাই করেছি শুরুতেই। তবু, জাতে উঠতে গেলেতো কখনো প্রথার অনুগমন করতেই হয়। দীনেশ সেনের প্রতিধ্বনী এখন সর্বত্র শোনা যাচ্ছে সজোরে নতুন করে। আমারা দেবেশ রায়ের থেকে পড়াচ্ছি তার কতকটা, “...আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে ধ্বংস করে দিয়ে সম্পূর্ণ বিদেশী একটি ইতিহাসের কার্যকারণের শৃঙ্খলা সেই ধারাবাহিকতার ওপর অস্ত্রের জোরে চাপিয়ে দেয়া হলে আমরা তাকেও সাহিত্যের ইতিহাসে ও অন্যান্য ইতিহাসে আমাদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যকারণের সঙ্গেই মানিয়ে নিই। যেন বা ইংরেজের ভারত জয়টাও ঘটেছে সেই মহেঞ্জদড়ীয় ও আর্য বৌদ্ধ মৌর্য ভারতের ইতিহাসেরই নিজস্ব গতিতত্বে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চৈতন্য-উদ্দীপিত বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাসের পর ইংরেজ প্ররোচিত সাহিত্যের নানা ধরণের ইতিহাসের মধ্যে যেন কোন বিচ্ছেদ নেই। যেন চৈতন্য যে মানবীয় সাহিত্যের বাস্তব অবলম্বন তাই বিকশিত হয়ে উঠল উনিশ শতকে কবিতা, নাটক, উপন্যাসের নানা নতুনত্বে। ইতিহাসের ভেতর ধারাবাহিকতা আবিষ্কারের ঝোঁকে আমরা এ কথা ভুলে যেতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে ভারত বর্ষে ইতিপূর্বে যত বিদেশি শক্তি সামরিক দাপটে এসেছে সেগুলির অব্যবহিত সাংস্কৃতিক উপাদান ভারতীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে কয়েক শ বছর ধরে আত্তীকরণের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। মাতৃগর্ভে ভ্রুণের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে তার হয়তো কিছুটা তুলনা চলে। কিন্তু ইংরেজের কাছে সংস্কৃতির কোন আলাদা উপকরণ ছিল না। ইংরেজের সংস্কৃতি ছিল তার সাম্রায্যনীতির অপরিহার্য অংশ আর সে কারণেই ইংরেজের পক্ষে সম্ভব ছিল না শতাব্দীব্যাপী গর্ভাধান। ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর ইংরেক সংস্কৃতির সেই আরোপকে তুলনা করা যায় ধর্ষণের সঙ্গেই মাত্র—সে ধর্ষণের ফলেও গর্ভাধান হতে পারে বটে কিন্তু সে ভ্রূণ মানবিক শারীরিক নিয়মেই কেবল বড় হয়ে উঠে না, শরীরের বিকারের নিয়মেও বেড়ে ওঠে।“ ( দেবেশ রায়; বাংলা উপন্যাস;উপন্যাস নিয়ে;দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০৩, দে’জ পাবলিশিং; পৃঃ১৫)

           জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’কে নিয়ে রসিকতা করা আজকাল খুব কম বাঙালি পাঠক সহ্য করবেন। অনেকে মনে করেন তিনিই নাগরিক বাংলার মুখ ফিরিয়েছেন ‘ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে’। তিনিও পুরো বাংলার মুখ দেখেননি , দেখেছেন যা নগর দেখিয়েছে--এই কথাতো হজমই হবে না অনেকের। দীপেন্দু চক্রবর্তী সেই রসিকতাও করে রেখেছেন বছর কয় আগে। “ বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি;--তিনি আপন মনে আওড়াচ্ছিলেন। আমি বললাম, ‘বাংলার মুখ আমিও দেখিয়াছি। তবে সে অন্যমুখ।’ তিনি অবাক হলেন, ‘বাংলার কটা মুখ?’—বলুনতো কটা হতে পারে?—আমিতো একটাই জানি।–এ জন্যেইতো সর্বনাশটি হয়েছে। বাংলার কোনো মুখই নেই। জীবনানন্দ প্রায় মুর্ছা যাচ্ছিলেন। আমি শুধরে নিয়ে বললাম, ‘মানে মুখ থাকলেও তার কোন অবেজেকটিভ অস্তিত্ব নেই। ওটা Cultural Construct ---মানে যে যেমন ভাবে পারে বাংলার মুখ বানাতে পারে। ঠিক এই অর্থেই বাংলার মুখ একটা নয় একাধিক।” ( ফুকোমুখো বাংলা” উত্তর আধুনিক আবোল-তাবোল; অনুষ্টুপ;শারদীয় ১৪০৮)

সেই ‘সংবাদ প্রভাকরে’র দি ন থেকে বেরোনো অচেনা যত কাগজের কথাঃ

    
       মোহম্মদ নাসিরুদ্দীনের স্বপ্ন বেশি কিছু ছিলনা। ঐ ধর্ষণ-জাত আধুনিকতারই শরিক হবারই ইচ্ছে ছিল। এবং ইচ্ছে ছিল নতুন ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্তকে সেই দিকে আকৃষ্ট করবেন। তিনি ‘সওগাত’ কাগজ করেছিলেন। তাঁর মতে এটি সূচনা করেছিল বাংলা সাহিত্যে ‘সওগাত যুগে’র। নজরুলের জীবনী পড়তে গিয়ে আমরা ‘সওগাত’ কাগজের নাম শুনেছি স্কুল জীবনেই। কিন্তু সেটি আবার কোন ‘যুগে’র প্রবর্তন করেছিল তাও আবার কল্লোল-কালিকলম-কবিতা-র মতো শুনলে আমাদের ‘আধুনিকতা’ এখনো ভীরমী খাবে! কে সে নাসিরুদ্দীন! আমরা নামই শুনিনি! তাঁর বই ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগে’ তিনি লিখছেন, আধুনিকতা যেমন করে শুনতে চায় তেমন করে, “বাঙালি মুসলিম সমাজের এক অন্ধকার যুগে—যখন অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতায় আমাদের সমাজ ছিল আচ্ছন্ন; মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত; ধর্ম ও সমাজের নামে কতকগুলি বাধা নিষেধের বেড়া জালে জড়িয়ে ছিল বাংলার মুসলমান; যে কালে অধঃপতিত বাংলার মুসলমান সভ্য সমাজে আত্ম-পরিচয় দিতেও দ্বিধাবোধ করতো—সেই অন্ধকার যুগে সাহিত্যিক বা বিত্তশালী নয় এমন একটি অখ্যাত ও অজ্ঞাত মুসলিম যুবকের আধুনিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে চাঞ্চল্যকর অভিযানের ঘটনাবলী প্রকাশ করার ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলে মনে করি” ‘আধুনিকে’দের যেমন দোষ –পূর্বতন সবাইকে হেলায় উড়িয়ে দেয়া --নাসিরুদ্দীনও তাই করেছেন এই লিখে, “মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত...” তাঁর কাগজটি প্রথম বেরোয় ১৯১৮র নভেম্বর ডিসেম্বরে, ১৩২৫এর অগ্রহায়ণে। তার প্রায় এক শতক আগে থেকেই সেই ‘সংবাদ প্রভাকরে’র দিন থেকেই বেরুচ্ছে মুসলমান সম্পাদিত বাংলা কাগজ। ১৮৩১এ প্রকাশিত’ সামাচার সভারাজেন্দ্র’, যার নামে চেনা ‘মুসলমান গন্ধে’র ছিঁটেফোটাও নেই, ছিল কোনো মুসলমান সম্পাদিত প্রথম কাগজ। ফারসি-বাংলা দ্বিভাষিক ছিল। দ্বিতীয়-তৃতীয় কাগজের নাম ‘জগদ্দুদ্দীপক ভাস্কর’ ( ১৮৪৬), ফরিদপুর দর্পণ ( ১৮৬১) পারিল বার্তাবহ (১৮৭৩)। প্রথম যে আরবি নামের কাগজটি মেলে সেটি প্রখ্যাত মীর মুসারফ হুসেনের স্ত্রীর নামে, তাঁরই সম্পাদিত, ‘আজীজন নেহার’ ( ১৮৭৪)। এর পরেরটি আবার ‘সুধাকর’ (১৮৮৯)। সম্পাদক শেখ আবদুর রহিম। এনার পৌত্র পরের কালের প্রখ্যাত লেখক আনিসুজ্জামান। এনার সঙ্গে ছিলেন সেকালের আরো তিন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব মেয়রাজ উদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন, এবং আলিয়া মাদ্রাসার সংস্কৃতের পণ্ডিত লেখক চিন্তক রেয়াজ-অল-দীন আহমদ মাশহাদী। পরে কাগজটি মিহিরের ( ১৮৯২) সঙ্গে মিলে হয়ে যায় মিহির ও সুধাকর( ১৮৯৫)। এছাড়াও রহিম সেকালে অনেক গুলো কাগজে হয় সম্পাদক নতুবা সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে জড়িয়েছিলেন। সেগুলো ছিল হাফেজ ( ১৮৯৭), মোসলেম প্রতিভা, মোসলেম হিতৈষী (১৯১১) এবং ইসলাম দর্শন ( ১৯১৬)। এগুলো যে হিন্দুদের বিরুদ্ধাচরণ করবার জন্যেই বেরুচ্ছিল তা নয়। এরকম ‘হিন্দু হিতৈষী( ১৮৬৪) নামে কাগজও বেশ পুরোনো ছিল। এবং সেকালের লেখা লেখি পড়লে দেখা যাবে হিন্দু কিম্বা মুসলমান কোন পক্ষই পরস্পরের ধর্ম দর্শন নিয়ে কম মেতেছিলেন , বেশি চিন্তা ছিল ক্ষমতাধর খৃষ্টান মিশনারীদের প্রচারের বিপক্ষে আত্মপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা। এই যে প্রতিবেশি ধর্ম-দর্শন নিয়ে আলোচনার স্বল্পতা সেগুলো বরং অন্য সমস্যা দাঁড় করাচ্ছিল। দু’পক্ষই তখন ধর্মের নতুন প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিচ্ছিলেন আর নিজেদের পরস্পরকে চেনাজগতের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। মীর মোসারফ হোসেন গো-হত্যা বিরোধী প্রচারে যোগ দিলে ‘সুধাকর’ তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সেরকম ব্যাপার ঘটছে কম। আবার মিশনারীদের প্রচারের বিরুদ্ধে কলম ধরবার সবটা তাদের সংগে কাজিয়া করবার জন্যেও নয়, গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্যেও বটে। ১৮৯৮ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত থেমে থেকে কুষ্ঠিয়া থেকে বেরুতো ‘মাসিক কোহিনুর’। এর সম্পাদনা মণ্ডলিতে অনেক হিন্দুও ছিলেন। এবং কাগজটি সম্প্রীতির পক্ষে সওয়াল করত।এরকম আরেকটি কাগজ ‘ছোলতান’ ১৯০১ থেকে বেরিয়ে থেমে থেমে অনেক দুই দশকের বেশি বেরিয়েছিল। ১৯০৩ থেকে যাত্রা শুরু করে মাসিক ‘নবনূর’ এবং ‘মোহাম্মদী’। ‘মোহাম্মদী’ আহলে হাদিস পন্থী কাগজ ছিল, কিন্তু অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছেপেছিল এবং এই ‘নবনূরে’ই আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বেগম রোকেয়া হোসেনের। ‘নবনূর’ ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধাচরণে, নারী অধিকার এবং সাধারণ শিক্ষা বিস্তার এবং বাংলাভাষার মর্যাদার প্রশ্নে গুরুত্ব আরোপ করত। ‘মোহাম্মদী’ দীর্ঘজীবি ছিল এবং বেশ বিখ্যাত হয়েছিল। ‘সওগাতে’র মতোই কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে মাঝে মধ্যে থেমে থেমে বেরোতে থাকে। দেশভাগের পর ঢাকাতে চলে যায়। এবং মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বেরোতে থাকে।

           রোকেয়া হোসেনের নামে আমাদের প্রগতিশীল হৃদয় স্পন্দিত হয় এখনো। কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হয় যেন, ইনিতো একক চন্দ্রমা ধর্মান্ধকার আকাশে। বাকিরা ভীষণ গোঁড়া। এই নিয়ে আমরা অন্যত্র লিখব। আমরা তাঁর বড় বোনের কথাটি পর্যন্ত ভুলে যাই। যাকে তিনি তাঁর ‘মতিচূর’ গ্রন্থের ২য় খণ্ড উৎসর্গ করেছিলেন। মীর মশাররাফ হোসেন তাঁর জমিদারিতেই ম্যানেজার ছিলেন এবং ‘বিষাদ সিন্ধু’র প্রথম সংস্করণ উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর অনুদানে প্রকাশ পেত ‘আহমদী’ (১৯২৩) নামে একটি কাগজ। সম্পদনা করতেন আব্দুল হামিদখান ইউসুফজয়ী। প্রথম মহিলা সম্পাদক বেগম সুফিয়া খাতুন এর দু’বছর আগেই চট্টগ্রাম থেকে বের করতেন কাগজ ‘আন নেছা’ ( ১৯২১)। নারী কল্যাণ এদের উদ্দেশ্য ছিল। সুতরাং রোকেয়া হোসেনও হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েন নি, যেমনটা ভাবা হয়। কিন্তু এই দশকেই বেরিয়ে ১৯৫২ অব্দি টিকে ছিল মহিলা সম্পাদিত যে কাগজ তার নাম ‘বর্ষবাণী’। সম্পাদনা করতেন জাহানারা বেগম চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুধীন্দ্রনাথ, লীলা মজুমদার থেকে শুরু করে আশাপূর্ণা দেবী তাঁর সেই কাগজে নিয়মিত লিখে গেছেন। সমকালের কোন প্রখ্যাত লেখকই বাদ পড়েন নি প্রায় তাঁর কাগজের লেখক তালিকা থেকে। বছরে একবার বেরুতো ঢাউস সাইজে। পূজা বার্ষিকী যেমন হয়। আমাদের ইতিহাস তাঁর সম্পর্কে একেবারেই নীরব। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ বেরিয়েছিল ১৯১৮র এপ্রিলে ‘সওগাতে’র বেশ কয়েক মাস আগে। মুজজফর আহমদ, মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ সেকালের বাঘা বাঘা পণ্ডিত সমাজ কর্মীরা এর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রচুর হিন্দু লেখকেরাও লিখতেন সেই কাগজে। আরেকটি কাগজ ছিল মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় ‘মুসলিম ভারত’। এই কাগজের প্রচ্ছদে লেখা থাকত রবীন্দ্রনাথের একটি আশীর্বাণী, “ মানব সংসারে জ্ঞানালোকের দিয়ালি উৎসব চলিতেছে। প্রত্যেক জাতি আপনার আলোটিকে বড় করিয়া জ্বালাইলে তবে সকলে মিলিয়া এই উৎসব সমাধা হইবে।” এগুলোতে হিন্দু লেখকেরা লিখতেন বটে। পড়তেনও হয়তো। কিন্তু সাধারণ হিন্দুমধ্যবিত্তদের মধ্যে মুসলমান সম্পাদকের কাগজ পাঠক পেত না। নামে ‘মুসলমান’ না থাকলেও। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এই কাগজের এক প্রধান লেখক, যিনি পরে ‘সওগাতে’ গিয়েও তাই হবেন।

         
    সুতরাং নাসিরুদ্দীনের এই দাবি সত্য নয় বোঝা গেল, “মাতৃভাষা, সাহিত্য ও শিল্প –সংস্কৃতি ছিল অবজ্ঞাত।” আসলে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন একেবারেই অসাহিত্যিক এক প্রেরণা থেকে। স্কুলে পড়া বয়স থেকেই বই পত্তর পড়বার প্রতি তাঁর দারুণ আগ্রহ। কিন্তু মুসলমানের সম্পাদিত কোন কাগজে ছবিছাপা না দেখে তিনি বিব্রত বোধ করতেন। তাঁর পাড়া প্রতিবেশেও গান-নাটকের উপর নিষেধাজ্ঞা তাঁকে ভাবাতো। ছবিসহ কাগজ ছাপবেন এমন একটা আগ্রহ তাঁতে চেপে বসেছিল। এই ছবিটাও আসলে আম মুসলমান জীবনের ছবি নয়। যে স্কুলে তিনি পড়তেন সেটির নাম বলে দেবে, তাঁর এই প্রেরণার কারণটি কীঃ এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন । এগুলো আসলে ধর্মসংস্কারোন্মুখ, আসরাফ –আতরাফে ঐক্যস্থাপনে উন্মুখ নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছবি। তাতে তীতুমীরের 'তরিকা-ই-মুহম্মদীয়া' এবং হাজী শরীয়তউল্লাহের 'ফারায়েজী আন্দোলন' চাপ এবং তাপ কিছুটা থেকে থাকবে। নতুন করে তখন মধ্যবিত্তদের মধ্যে আহলে হাদিস পন্থাও জনপ্রিয় হচ্ছে। টুকটাক ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে তীতুমীর বা শরীয়তউল্লাহেরা যখন অনৈশ্লামিক সংস্কার ছাড়িয়ে মুসলমান জনতাকে এবং হিন্দু নিম্নবর্ণের কৃষকদের ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের বাইরে বের করে নিয়ে যেতে চাইছেন তখন শুধু যে সামন্তশ্রেণি বা বৃটিশ প্রশাসনই এদের বিরুদ্ধে নেমে পড়েন তাই নয়, যেকোন সংস্কারকের মতোই আম মুসলমানেরও নানা প্রশ্নকে মোকাবিলা করে তাদের এগুতে হচ্ছিল। নইলে মুসলমানেরা খুব গান করতেন, বাজনা বাজাতেন, যাত্রা পালাতে যোগ দিতেন। এমন কি ছবি ছাপানো বইপত্তরেও মুসলমানরা পিছিয়ে ছিলেন না কিছুতেই। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ছিল বটতলার বই আর বটতলাই যদিও বই ব্যাবসার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল নতুন মধ্যবিত্ত সেগুলোকে লুকিয়ে পড়লেও, প্রকাশ্যে ফিরেও তাকাতেন না। বিস্তৃত এখানে লিখবার সুযোগ নেই। আমরা সেরকম একটি বইএর ছবি এখনে তুলে দিচ্ছি। মুসলমান বড় মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধ ছিল এই ধারণাকে নাকচ করবার জন্যে এই ছবিই যথেষ্ট। এই দেবতাকে চেনা আজকের যেকোন নব্য শিক্ষিত আধুনিক সংস্কারকের পক্ষেও বড়ই কঠিন।

               সিনেমা মানুষকে ধ্বংস করে এই বোধ টিভি আসবার আগেও ব্যাপক ছিল, দুই দশক আগেও উপন্যাসের বিরুদ্ধে কানাঘুসো শোনা যেত। মেয়েরা ‘থেটার’ করলে ভ্রষ্টা হয় এই সংস্কার দেশভাগের আগেও ব্যাপক ছিল সাধারণ হিন্দু উচ্চবিত্ত সমাজেও। মুসলমানদের মধ্যেও সমস্যা ছিল তারা সংস্কার পরবর্তী সমাজকে আরব্য ওয়াহাবী ধাঁচে গড়ে তুলবেন না সাহেবী বিলেতি ধাচে, অথবা দুটোই মিশিয়ে তৃতীয় কিছু । রামমোহনীয় বেদান্ত কিম্বা বিবেকানন্দের হিন্দুপুনরুত্থানবাদ শুরু থেকেই রাজনৈতিক ভাবে বিলেতি ধাচের সংগে একটা আপস করে নিয়েছিল, ঈদকে প্রতিস্থাপিত করে বড়দিন তাই হিন্দুদের কাছে গৃহীত প্রিয় উৎসব হয়ে উঠে , --—তাতেই বেশ কিছু গুণগত ভিন্নতা দেখা গেছিল, অন্যথা ব্যাপারগুলো মুলগত ভাবে একই ছিল । ইসলামের কোন সংস্কার যে বাংলানবজাগরণের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা পায়নি তার একটি কারণ অবশ্যই ছিল শ্রেণিগত। এই যেমন নববর্ষের দিনটিই ছিল খাজনা আদায়ের জন্যে নির্ধারিত। সেদিন জমিদারেরা রীতিমত উৎসব তথা মেলার আয়োজন করতেন। সেই উৎসবে বিচিত্র পুজা পার্বন গীত বাদ্য মদ জুয়া ইত্যাদি হতো। একে বলা হতো ‘পুণ্যাহ’ উৎসব। যাতে হিন্দু-মুসলমান প্রজা নির্বিশেষে যোগ দিতেন। স্বাভাবিক ভাবেই খাজনা প্রশ্নে যে কৃষকেরা বিদ্রোহ গড়ে তুলবেন তাদের এই উৎসবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এবং এক বৃহত্তর ধর্মদর্শনের মোড়ক ছাড়া এগুলো সম্ভব হতো না। তীতুমীর বা শরীয়তউল্লাহেরা এগুলোই করেছিলেন। ফলে একদিকে যেমন খাজনার চাপে অতিষ্ট হিন্দু দলিত জনতাও তাদের সঙ্গ দিল, জমিদার মাত্রেই তাদের বিরুদ্ধে গেল। এবং ধর্মান্ধ বলে দেগে দিল। যা পরের কালে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাকেও সবল করে ফেলে। এই ভাবনাগুলোই পরে উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্তদের মধ্যেও ছড়িয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক ছিল। এদিকে যখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদে হিন্দু মোড়ক পরানো হচ্ছে, মুসলমান তার সঙ্গে মিশে যাবেন এটা আশা করাইতো ছিল অস্বাভাবিক। যে মীর মশাররাফ হোসেন প্রথম জীবনে ‘গোজীবন’ লিখে গো-হত্যা বিরোধী প্রচারে নামছেন, তিনিও পরের জীবনে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদে’ হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। এসব কারণেই ‘মিহির এবং সুধাকরে’ যখন নাটকের বিজ্ঞাপন এবং আলোচনা বেরুচ্ছে ‘ইসলাম প্রচারক’ তার প্রবল বিরোধিতা করে আশঙ্কা করছে এরা মুসলমান পাঠককে ঘোর ‘নরকে’ নিক্ষেপ করতে চাইছে।

চাঁদপুর থেকে কলকাতাঃ 'সওগাত যুগে'র শুরুর কথাঃ

          মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের সমস্যা দেখা দিচ্ছিল এই নব্য-মুসলমানদের নিয়ে এটা আমরা শুরুতেই বুঝে নিলে ভালো। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়াতে লেখা পড়া আধাতে ছেড়েই তাঁকে কাজের সন্ধানে বেরুতে হয়। স্টিমার ঘাটে কিছুদিন স্টেশন মাস্টারের চাকরি করে, বিমার ব্যবসাতে যোগ দেন। সামাজিক আপত্তি ছিল বিমা ব্যবসাতে। সেগুলো অতিক্রম করেই বেশ টাকার মুখ দেখছিলেন। বিয়েও সেরে ফেলেছিলেন তখনই। এগুলো ছিল প্রস্তুতি পর্ব। কিছু টাকা জমিয়ে নিজের বাড়ির কাছে চাঁদপুরে বইএর দোকান খুলে বসেন। তাঁর মানসিকতা বুঝতে নামটি গুরুত্বপূর্ণ-- ‘ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরী’। কিন্তু মুসলমানের লেখা বই পত্তরের অভাব তাঁকে ভাবালো খুব। ‘ভালো’ বই পত্তর কিচ্ছু নেই। যা আছে সবই বটতলার পুথি পাঁজি। ব্যবসা তিন বছরের বেশি চলল না, লোকসানে বন্ধ হয়ে গেল।

              কিন্তু এই লোকসান তাঁকে আরো জেদী করে তুলল। তিনি পূব বাংলার চাঁদপুর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে গেলেনে কলকাতাতে ‘ভালো’ কাগজ করবেন বলে।এবারে, ভালো কাগজ মানে, শুরুতেই যেটি হবে সচিত্র। অনেকেই হতাশ করলেন তাঁকে ‘গুনাহ’ হবে বলে। অনেকে সঙ্গও দিলেন। তার মধ্যে ছিলেন এক মৌলানাও। ইনি আগে থেকেই ‘দ্য মুসলমানস’ নামে একটি কাগজ সম্পাদনা করতেন। শুরুতেই একটি কোম্পানি খুলে কাজ শুরু করবেন ভাবলেন। নাম দিলেন ‘মোসলেম প্রিন্টিং এণ্ড পাব্লিশিং কোং’ কিন্তু জমবার আগেই এটি ডুবে গেল। টাকা লগ্নি করবার লোক বেশি পাওয়া গেল না। ফলে কোম্পানি উঠে গেল। সোজা ব্যক্তিগত মালিকানাতে ‘সওগাত’ নামে কাগজে হাত দিলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল পুরো মুসলমান লেখকদের কাগজ হবে, কিন্ত পাঠক হবেন হিন্দুরাও। শুরুতেই ছবির চিন্তা। মুসলমান চিত্রশিল্পী পেলেন না, যাঁকে দিয়ে ছবি আঁকাবেন। গণেশ ব্যানার্জি বলে এক শিল্পীকে দিয়ে আঁকালেন। যেমন লেখা চাইছিলেন মুসলমানদের মধ্যে তেমন বেশি পাচ্ছিলেন না। হিন্দুদের দ্বারস্থ হতে হলো। সেকালের খ্যাত নামা অনেকেই লিখলেন, তারমধ্যে ‘ভারতবর্ষে’র সম্পাদক জলধর সেন, ঐতিহাসিক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মানকুমারী বসু, কুমুদ রঞ্জন মল্লিকের মতো কবিরাও। বেগম রাকেয়া সেই প্রথম সংখ্যাতেই লিখলেন কবিতা ‘সওগাত’। প্রবন্ধ লিখলেন, ‘সিসিম ফাক’। কায়কোবাদ, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী এমন বেশ কজন মুসলমান লেখকেররাও লিখলেন। কিন্তু এহ বাহ্য, এই কাগজ হৈচৈ ফেলল ১৮ খানা ছবি আর কার্টুনের জন্যে। তার মধ্যে বেশ কতকগুলো মানুষের ছিল। ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখলেন অনেকে। তার মধ্যে একটি ছিল ফরিদপুরের ফরায়েজী নেতা বাদশা মিয়ার লেখা। বাদশা মিয়াকে তিনি সহজেই ‘সওগাতে’র গ্রাহক করে ফেলেন। বাদশা মিয়া লিখেছিলেন ছবি ওয়ালা কাগজ ঘরে রাখলে নামাজ পড়া যাবে না। নাশিরুদ্দীন তাঁকে চিঠি লেখেন, যদি ইংল্যাণ্ড রাজার ছবি ওয়ালা টাকা রাখা ঘরে থাকতে পারে তবে ‘সওগাত’ নয় কেন? বাদাশা মিয়া হার মানেন। প্রথম সংখ্যা আমরা আগেই লিখেছি বেরিয়েছিল ১৯১৮র নভেম্বরে। ভারতীয় চিত্রকলার মোঘল ঘরানার কথা কি তিনি জানতেন না, নজির দিলেন না কেন, আমরা জানি না।

                  কিন্তু যে সম্মানে মুসলমান পাঠক এবং সমাজ তাকে বরণ করে নিল তার তুলনাতে প্রতিরোধ ছিল সামান্যই। পরের মাসেই ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র তৃতীয় অধিবেশন বসে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি আমন্ত্রিত হন। এই সমিতির সম্মেলনে গিয়ে তিনি এক ছবি তোলার লোক ভাড়া করলেন। কিন্তু অধিকাংশি রাজি হন না ছবি তুলতে। বলে কয়ে কয়েকজনকে রাজি করলেন। নিজেও উঠলেন শেরওয়ানি-পাজামা পরে। পরের সংখ্যা ‘সওগাতে’ সম্মেলনের প্রতিবেদন বেরুলো সেই সব ছবি সহ। এই প্রতিবেদনই তাঁর প্রথম মূদ্রিত লেখা। এমনিতে খুব একটা তিনি লিখতেন না। কাগজের সম্পাদক হিসেবেও নিজের নাম জাহির করতেন না। প্রথম দু’চারটি সংখ্যাতে সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের। নিজের পরিচয় দিতেন জেনারেল ম্যানেজার বলে। পরে সাহিত্যবিশারদ তাঁকে বলে কয়ে সম্পাদক হিসেবে নাম লেখাতে রাজি করান। দ্বিতীয় সংখ্যাতে ২৭টি লেখার মধ্যে ২২টিই ছিল হিন্দু লেখকদের। রবীন্দ্রনাথও লিখলেন একটি কবিতা। সঙ্গে ‘সওগাত’ নামে একটি গদ্য। তখন টাকা নিতেন রবীন্দ্রনাথ লেখা দিলে। কিন্তু তাঁকে উৎসাহীত করতে শুরুতে টাকা দেবার কথা বললেও পরে বিনে পয়সাতে পাঠিয়ে দেন। পরেও স্বেচ্ছাতেই লেখা পাঠিয়েছিলেন বেশ ক’বার।

           
          দু’বছর চলবার পর ১৯২১এর মার্চ-এপ্রিল সংখ্যা বেরিয়ে দেনা আর পাওনাদারদের মামলার দায়ে কাগজটি বন্ধ হয় দিন কতক। আবার বীমা ব্যবসাতে নেমে তিনি দেনা শোধ করেন, বেশ কিছু টাকাও জমিয়ে ফেলেন। আবার বেরুতে থাকে ১৯২৬এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর তথা ১৩৩৩এর আশ্বিন থেকে। এই সময়ের মধ্যে একই চিন্তার আরো বেশ কিছু কাগজ বেরিয়ে পড়ে। তাঁর মধ্যে ১৯২২এর আগষ্টে বেরুনো নজরুলের ‘ধূমকেতু’ও রয়েছে। এবারে এবারে বেশ কিছু মুসলমান লেখক তিনি জুটিয়ে নিলেন। এর মধ্যে এস ওয়াজেদ আলিও ছিলেন যিনি ১৯১৯এ ইংরেজিতে Bulletin of the Indian Rationalistic Society নামে জার্নাল বের করেছিলেন। এ ছাড়াও মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ শাহাদাৎ হোসেন প্রমুখ ছিলেন। মাস কয় পরেই ১৯২৭এর নববর্ষে বের করেন ‘বার্ষিক সওগাত’। এর প্রথম সংস্করণ দু সপ্তাহেই ফুরিয়ে যায়। তিনটি সংস্করণ বের করে পাঠক চাহিদা মেটাতে হয়েছিল। এই সময়ে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তারের প্রসঙ্গ নিয়ে ‘মোহম্মদী’ আর ‘সওগাতে’ বেশ একটা বিতর্ক কমে উঠেছিল। ধীরে ধীরে ‘সওগাত সাহিত্য মজলিশ’ নামে এক আড্ডাও গড়ে তুললেন। বসত প্রথমে ৮২ কলুটোলা স্ট্রিটে পত্রিকা দপ্তরেই প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা। ১৩টি সংখ্যা কাগজ বেরুবার পর যে দপ্তর উঠে যায় ১১ ওয়েলসলি স্ট্রিটে। সেখানে তিনি পরিবার নিয়েও উঠে আসেন। দোতলা বাড়ির নিচেই নিজস্ব ছাপাখানা খোলেন।

                     কাজি নজরুল প্রথম বছরেই জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ সংখ্যাতে ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামে গল্প লিখেছিলেন । দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম সংখ্যা থেকে নজরুলই হয়ে উঠেন ‘সওগাতে’র প্রধান লেখক। সে সংখ্যাতে বেরোয় নজরুলের বিখ্যাত ‘সর্বহারা’ কবিতাটি। ইতিমধ্যে তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে পরিচিত হয়ে উঠলেও আর্থিক সমস্যার সুরাহা করতে পারছিলেন না। স্থায়ী আবাস বলতেও ছিল না কিছু। ১৯২৭এর মার্চে এলবার্ট হলে ‘নজরুল সাহায্য রজনী’র আয়োজন করেন নাসিরুদ্দীন। তাতেও সুরাহা না হলে মাসিক দেড়শ টাকা মাইনেতে তাঁকে ‘সওগাতে’ কাজ দেন। কাজ বলতে ছিল প্রতি সংখ্যাতে লেখা এবং বিকেলে আড্ডা দেয়া। নজরুল থাকতেন নলিনী কান্ত সরকারের বাড়িতে। সেখানে থাকার অসুবিধে হলে ‘সওগাত’ দপ্তরের উপরের দুটো কামরাতে বিনা ভাড়াতে নজরুলকে থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। নজরুলের কবিতাতে আরবি ফারসি শব্দাবলীর বাহুল্যে মনে হয় নাসিরুদ্দীনের একটি ভূমিকা আছে। নজরুলকে তিনি মুসলমান সমাজে প্রচলিত শব্দ-বাগ্বিধি ব্যবহার করে মুসলিম সমাজ এবং বিষয় নিয়েই লিখতে বলেছিলেন। নজরুল তাতে ক্ষেপে গেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কোনো জাতি-ধর্ম নিয়ে লিখলে তা আর যাই হোক কাব্য হবে না। নাসিরুদ্দীনের পালটা যুক্তি, মুসলমানের সমাজচিত্র এবং মুখের ভাষা বাদ দিলে বাংলার গণসাহিত্য গড়ে উঠবে না কোনদিন। নজরুল রাজি হলেন, কিন্তু জানিয়ে দিলেন ধর্মের নামে কোনো ভণ্ডামী চলবে না। নাসিরুদ্দীনের তাতে আপত্তি করবার কিছু ছিল না, উলটে তিনি এই ব্যাপারে নজরুলকে নেতৃত্ব দিতেই অনুরোধ জানালেন। ধর্মের নামে ভণ্ডামী আর একটি ধর্মীয় সমাজে প্রচলিত সমাজের ভাষা-বিষয়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি আমাদের ‘আধুনিক’ মন এখনো বুঝে উঠতে দ্বিধান্বিত বহু সময়। নাসিরুদ্দীন বুঝতেন, কেননা তাঁর সামাজিক এবং ( ব্যবসায়িক বলতেও অসুবিধে নেই) বাধ্যবাধকতা ছিল। নাসিরুদ্দীন মুসলমান সমাজের উত্থান চাইতেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার দায় তাঁকে কোন শত্রুও দিতে পারেন না। একেতো ‘সওগাত’এর হিন্দু লেখকের তালিকা সবসময়েই দীর্ঘ ছিল। নজরুল ছাড়াও প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকেরাও চাকরি করেছিলেন ‘সওগাতে’। নজরুলের জোরে এমন লেখকদের আড্ডাতে আসাটাও সহজ হয়ে গেছিল অনেকটাই। নজরুল অনেক সময় লেখা না দিয়ে পালাবার ধান্দা করতেন। একবার তাঁকে কামরাতে তালাবন্দি করে লেখা আদায় করবার সরস ঘটনাও ঘটেছিল। দু’জনের সম্পর্কই এমন গভীরতার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ১৫ ডিসেম্বর , ১৯২৯এ সেই আলবার্ট হলে নজরুলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেই সভাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ‘কল্লোলে’র সঙ্গেও যে ‘সওগাতে’র সম্পর্ক ঘনিষ্ট ছিল তার নজির হলো সেই সভার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন ‘কল্লোল’ সম্পাদক দীনেশ চন্দ্র দাস। নেতাজি সুভাষ বসুও সেই সভাতে বক্তৃতা করেছিলেন। নজরুল আসার পরেই এপ্রিল-মে ১৯২৮থেকে ‘সওগাত’ সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। সাপ্তাহিক কাগজটিও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবসায়িক এবং ভাবপ্রস্থানের প্রতিদ্বন্দ্বিরাও বসে ছিলেন না। নজরুল বিরোধী একটি শিবির ছিলই এরা তখন ‘মোহাম্মদী’র কে কেন্দ্র করে সরব হতে থাকে। নজরুল এবং ‘সওগাত’কে ইসলাম বিরোধী বলে চিহ্নিত করে আক্রমণ শানায়। নজরুলের যোগ দেবার মাস কয় পরেই ১৯২৮এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যাতে ‘সওগাতে’ সম্পাদকীয় লিখে জানানো হয় তাঁরা সংস্কার আনতে চান মুসলমান সমাজে , ইসলাম ধর্মে নয়। এবং ‘মোহম্মদী’কে এই কাজে সহযোগী বলেই বর্ণনা করেন। কিন্তু ‘মোহম্মদী’ পক্ষ তাতে শান্ত হয় নি , বরং চড়া এবং প্রচুর মিথ্যা স্বরে আক্রমণ চালাতে থাকে। কয়েক সংখ্যা ধরে দুই কাগজের মধ্যে উত্তর-প্রত্যুত্তরের পালা চলেছিল। নজরুল আসার আগে অব্দি দুই কাগজ পরস্পরের বিজ্ঞাপন ছাপাত বিনামূল্যে। কিন্তু সম্পর্ক খারাপ হলে ‘মোহম্মদী’ বিজ্ঞাপনের টাকা চেয়ে মামলা করে বসে আদালতে। আদালত একতরফা ডিক্রি জারি করলে আকরম খাঁ ছেলেকে নিয়ে ‘সওগাত’ অফিসে এসে পড়েন মেশিন ক্রোক করবেন বলে। সে যাত্রা তৎক্ষণাত ধার করে টাকা দিয়ে মান বাঁচাতে হয় নাসিরুদ্দীনকে। কিন্তু এই পুরো ঘটনা ‘সওগাত’এর খ্যাতি বরং বাড়িয়েই দেয়। নজরুলের আসন ‘সওগাতে’ আরো পাকা হয়। ইনি বেশিদিন কোথাও কোনোদিনই পাকা হতেন না। ‘সওগাতে’ পাঁচ বছর চাকরি করেন। পরে রেকর্ড কোম্পানিতে যোগ দিলে চাকরিটি ছাড়েন বটে কিন্তু লিখে গেছেন এই কাগজে অসুস্থ হবার আগে অব্দি। এ কাগজে শেষ কবিতা তাঁর বেরিয়েছিল মার্চ-এপ্রিল ১৯৪২ সংখ্যাতে। মুজফফর আহমেদকে বাদ দিলে নজরুলের সবচে’ ভালো বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী ছিলেন এই নাসিরুদ্দীনই। ১৯৭৬এ নজরুল যখন মারা যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত শোক সভাতে সংগত কারণেই সভাপতিত্ব করবার ডাক পড়েছিল মোহম্মদ নাসিরুদ্দীনের।

       
      ‘মোহম্মদী’ টাকা পেয়ে সাময়িক সন্ধি করে নিলেও শত্রুতা ছাড়েনি কোনদিন। প্রখ্যাত মুসলমান সংস্কারক, ‘হিস্ট্রি অব দ্য স্যারসিন্সে’র লেখক বিচারপতি আমীর আলীর মৃত্যুতে শোকসভা আয়োজন করলেও ‘মোহম্মদী’ আমন্ত্রিতদের ভয় দেখায়। ‘সওগাত’, ‘শিখা’ ইত্যাদি কাগজের লেখিকা ফজিলতুন্নেসা প্রথম মুসলমান ছাত্রী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম হয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি বিলেত যেতে চাইলে নাসিরুদ্দীন টাকাও যোগান, ‘সওগাত’ কার্যালয়ে তাঁর সংবর্ধনা সভারও আয়োজন করেন। সেখানে ‘মোহম্মদী’ গোষ্ঠী রীতিমত গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়। পরে আবার কুৎসা রটিয়ে সেই সংবাদ ছাপে নিজেদের কাগজে। সম্ভবত এই ঘটনা তাঁকে একটি নারী সংখ্যা বের করতে প্ররোচিত করে। লেখিকারা লিখতেনই সওগাতে। বেগম রাকেয়াতো ছিলেন ই, পরের কালের বিখ্যাত লেখিকা বেগম সুফিয়া কামালকে ‘সওগাতে’র সন্তান বললে ভুল বলা হবে না। আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৯২৯এ বেরোয় সেই নারী সংখ্যা। নাসিরুদ্দীন তাঁর বইতে দাবি করেছেন, এটি ভারতের প্রথম কোন কাগজের মহিলা সংখ্যা। এই সংখ্যাতে ৮৩টি ছবি ছিল। তার মধ্যে অনেকগুলো নারীর। লেখিকাদের এতোটাই উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন নাসিরুদ্দীন যে দেশ ভাগের ঠিক আগেই ২০ জুলাই , ১৯৪৭এ আরেকটি আলাদা এবং ঐতিহাসিক কাগজ ‘বেগম’ বের করতে শুরু করেন। কাগজটি শুরু থেকেই ছিল সাপ্তহিক। শুরুতে সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল , পরে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নাসিরুদ্দীনের মেয়ে নূরজাহান বেগম। তার আগে আরো একটি বিশাল উদ্যোগ নিয়েছিলেন নাসিরুদ্দীন। ১৩৪৪এর মাঘ মাসে, ১৯৩৮এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ‘শিশু সওগাত’ বলেও আরেকখানা কাগজ বের করেন। এটিও ব্যাপক ব্যবসা সফল কাগজ ছিল। এর গ্রাহক সংখ্যা বাইশ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছিল। কিন্তু শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে এর আজ নামটুকুও উচ্চারিত হয় না। দেশ ছেড়ে যাবার আগে অব্দি কাগজটি বের করেছিলেন নাসিরুদ্দীন। কিন্তু এর পরে আর বেরোয় নি।

কলকাতা থেকে ঢাকাঃ 'সওগাত যুগে'র বাকি ইতিহাস এবং 'বেগমে'র ইতিকথাঃ

         
 
সৌজন্য সাময়িক প্রসঙ্গ
      দেশভাগ কেন অবিভক্ত বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বৌদ্ধিক নেতৃত্বকে পূর্বপাকিস্তান নিয়ে গেলো সে নিয়ে আলাদা আলোচনা করবার এখানে সুযোগ নেই। নজরুলকেও যেতে হয়েছিল, যেতে হয়েছিল নাসিরুদ্দীনকেও। তবে কিনা এমনিতেও তিনি পূর্ববাংলারই লোক ছিলেন। সুতরাং তাঁর পক্ষে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। ঢাকার পাটুয়াটুলির বিজয়া প্রেসের মালিকের প্রেস এবং বাড়ির সঙ্গে নিজের প্রেস এবং বাড়ি বিনিময় করেন তিনি। ১৯৫০এর মে মাসে তিনি সেখানে চলে গেলেন। কিন্তু সেখানে ঊর্দু জাতীয়তাবাদের চাপে তাঁর কাজ অনেক কঠিন হলো। দিন কতক কাগজের কাজ বন্ধ রাখলেন। বাংলা সাহিত্যের জন্যে আরো বড়ো লড়াইএর জন্যে তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হলো। এবং তিনি নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন। ১৯৫২তে ‘সওগাত’ বেরুবে বেরুবে এমন সময় ঢাকাতে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চলল। ‘সওগাত’ অফিসকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠিত হলো 'পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ'। ঢাকার সাহিত্য মহলের তিনি হয়ে উঠলেন মধ্যমণি।সংসদের সভাপতি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহ্‌মদ।এটি অনেকটাই দেশভাগের আগেকার 'প্রগতি লেখক সঙ্ঘে'র মতো ব্যাপার ছিল। সম্পাদকের পরিচয় দিলেই স্পষ্ট হবে। ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে কলকাতা থাকতেই আলাপ হয়েছিল নাসিরুদ্দীনের। পাকিস্তান আমলে তিনি বামপন্থা আশ্রয়ের দায়ে বছর সাতেক জেলও খেটেছিলেন। ষাটের দশকে একসময় বিপ্লোবত্তর চীনে গিয়েও বেশ ক’বছর কাটিয়েছিলেন। মাও ৎসে তুঙের চিন্তাধারাতেও প্রভাবিত হয়েছিলেন অনেকটা। বেইজিং বেতারে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচলনেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন । ফয়েজ আহমদে মারা যান ২০১২র ফেবুয়ারীতে। সেই সংসদের যেকোন সভাতে তখন দুই আড়াইশজনের উপস্থিতি ছিল সাধারণ কথা। বেগম সুফিয়া কামালরাতো ছিলেনই, সেকালে যাদের হাতে বাংলা ভাষা সাহিত্য এবং আন্দোলন দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশে তাদের প্রায় সবাই সমবেত হতেন সেই সংসদে। যেতেন শামসুর রহমান, শওকত ওসমান,বদরুদ্দীন ওমর, আনিসুজ্জামান, মুনীর চৌধুরী, আশরাফ সিদ্দিকী, আল মাহমুদ, আবদুল হাই প্রমুখ অনেকে।


             ১৯৫০এর ডিসেম্বর থেকে ‘বেগম’ কাগজটি বের করতে শুরু করেন। ঠিক চার বছরের মাথাতে মহিলাদের নিয়ে একটি সংস্থা ‘বেগম ক্লাব’ও গড়ে তোলেন ১৯৫৪তে। ‘সওগাত’ আবার বেরুতে শুরু করে ১৯৫৩র নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে। স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ব-পাকিস্তানের নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে সমস্ত প্রতিবাদী প্রগতিশীল লেখকদের মুখপত্র হয়ে উঠে ‘সওগাত’। বিখ্যাত

                'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি ...', গানটির লেখক সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা ‘সওগাতে’এরই লেখক গোষ্ঠীর অন্যতম। তিনি ‘বেগমে’ চাকরি করতেন সেই সঙ্গে চালিয়ে যেতেন পড়াশোনা। ৫২র লড়াইতে লাঠির ঘায়ে আহত হয়ে বেশ কিছুদিন হাসপাতালেও ছিলেন। তখন বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমানকে পাঠান নাসিরুদ্দীনের কাছে। এই হাসান হাফিজুর ঢাকাতে যেন কাজি নজরুলের বিকল্প হয়ে উঠলেন। হাসান হাফিজুর লেখকদের টেনে আনতেও বেশ উদ্যোগী হয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪তে 'পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ' ঢাকার কার্জন হলে প্রথম সম্মেলন আয়োজন করতে সমর্থ হয়। ‘মোহম্মদী’ সেখানেও ‘সওগাতে’র পিছু ছাড়ে নি। এবারে তাদের সঙ্গ দিল ‘আজাদ’ বলে আরো একটি কাগজ। আর লড়াইর বিষয় হলো, বাংলা ভাষা, বাংলা হরফ, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং কাজি নজরুলের উপর দখলীস্বত্ব। এবারেও মামলা হলো। অভিযোগ গুরুতর। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ধর্মদ্রোহিতা এবং কমিউনিষ্ট হবার অভিযোগ। একরাতে পুলিশ নাসিরুদ্দীনকে তুলেও নিয়ে যায়। বাড়িতে তল্লাসী চলে। পরে হতাশ হয়ে মুক্ত করে দেয়।

                   এ পর্যন্ত এসে পাঠক নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন যে বিপুল ব্যবসা সফল এই উদ্যমী ব্যক্তিত্ব , যিনি কাগজের সম্পাদক হিসেবেও নিজের নাম ছাপতে কুণ্ঠিত ছিলেন নিছক ব্যবসায়ী ছিলেন না। নিছক ‘আধুনিকতাবাদে’র তাত্বিক বিলাসীও ছিলেন না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বাঘা-বাঘা সব কাগজ যেমন কল্লোল-কালিকলম-কবিতা-কৃত্তিবাসের কীর্তিগাঁথাতে সরব থাকতে পারে, কিন্তু এই মেঘনা পারের এই অসম উদ্যমী ব্যক্তিত্ব যেখানেই গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পুরো সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিজে বিশেষ লেখেন নি, কিন্তু এই ত্যাগের বিনিময়ে এক বিশাল লেখক এবং পাঠককুল তিনি গড়ে তুলেছিলেন। মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজে এবং পরের কালে বাংলাদেশের বৌদ্ধিক উত্থানে গোটা বিশ শতক জুড়ে তিনি রীতিমত নেতৃত্ব দিয়ে গেছিলেন মঞ্চের পেছনে থেকে।

               স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁকে সম্মান জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। যদিও যে শহরে তিনি জীবন শুরু করে তিনটি দশক কাটিয়ে গেছিলেন সেখানকার ‘প্রগতিশীল’ বৌদ্ধিক মহলও তাঁকে মনে রাখার সামান্য দায়ও স্বীকার করে নি কোনদিন, বাকিদের আর কী কথা। স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭৫এ তাঁকে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯৭৭এ অর্পণ করে একুশে পদক এবং সেদেশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিবস রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। এছাড়াও নানা সম্মানে তিনি ভূষিত হন । ১৯৭৯র ১৬ নভেম্বর তারিখে, তাঁর ৯২তম জন্মদিনের দু’দিন আগে তাঁকে জাতীয় স্তরে সংবর্ধনা দেয়া হয়। জীবিতাবস্থাতে কাউকে সংবর্ধনা দেয়ার এটিই ছিল সেদেশে প্রথম ঘটনা। পরের বছরেও জন্মদিনের দিন কতক আগে ৩ নভেম্বর 'বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ' সহ ৩৩টি মহিলা সংগঠন তাঁকে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে ‘নারীজাগরণের অগ্রদূত’ বলে সম্মানিত করে। ১৯৮৯ সনে তাঁর জীবিতাবস্থাতেই শতবার্ষিকী পালন করে বাংলাদেশ। সেবারেও তাঁকে জাতীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। তিনি বেঁচেছিলেন সক্রিয় ছিলেন গোটা বাংলা চতুর্দশ শতক। মারা গেছিলেন ১৯৯৪ সালের ২১শে মে,৭ই জ্যৈষ্ঠ ১৪০১। ঢাকায় । তাঁর বয়স তখন ১০৬।

এবং এক নতুন শুরুর কথাঃ

      
নূরজাহান বেগম
       যিনি গোটা জীবন মঞ্চের পেছনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন, ১৯৭৬এ তিনি চালু করেন ‘নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক’। উদ্দেশ্য একটাই--- মৃত্যুর পরেও যেন বাংলাভাষা –সাহিত্যের প্রতি তাঁর সেবা স্তব্ধ না হয়ে যায়। নিজে পাওয়া পুরস্কারগুলোর অর্থমূল্যেই চালু হয় এই পদক। 'শিরি-ফরহাদ', 'আল্লার নবী মুহম্মদ (সা.)' , 'সওগাত যুগে নজরুল ইসলাম' ইত্যাদি নামে গুটি কয় বই তিনি লিখেছিলেন। ১৯৮৫তে যখন তাঁর বয়স ৯৭ তখন গিয়ে লেখেন ১৬০৩ পৃষ্ঠার বিশালবপু গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ’। হয়তো ‘বেগম’ তখনো বেরুচ্ছে বলেই নামে ‘বেগম যুগ’ কথাটা জুড়েন নি। তাঁর মৃত্যুর পর তিনখণ্ডে বেরিয়েছে ‘নির্বাচিত বেগমঃ অর্ধশতাব্দীর সমাজচিত্র ১৯৪৭-২০০০’। ‘বেগম’ এখনো বেরোয় । সম্পাদনা এখনো করেন তাঁর কন্যা নূরজাহান বেগম। যার জীবনও কম উপন্যাসোপম নয়। বাংলাদেশের ‘নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্র’ আমাদের অসমে পরিচিত সংগঠন, তার মুখপত্র ‘বরাক নন্দিনী’ এক দশকে বেশি সময় ধরে শিলচর থেকে বেরুচ্ছে । তাই উল্লেখ করা ভালো, সেই সংগঠন ১৯৯৬ তাঁকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ব্যাক্তিত্বের সন্মান জানায়। মনে হয় না নাসিরুদ্দীন কিম্বা তাঁর অতিবৃদ্ধা সুযোগ্যা কন্যা নূরজাহান বেগমকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য মঞ্চে এতো এতো লেখিকা এবং পাঠিকাদের উত্থান সম্ভব ছিল। ভারতে তাঁকে নিয়ে খুব কম হলেও লেখালেখি হয়েছে। মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায় ১৯৯৭এর মার্চে তাঁর ‘দেবাঞ্জলি’র প্রথম সংখ্যাতে ছেপেছিলেন নাসিরুদ্দীনের একটি সাক্ষাৎকার। শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত তাঁর একটি ছোট্ট পুস্তিকাতে ‘সওগাত’কে স্মরণ করেছেন। আর জাহিরুল হাসান তাঁর ‘বাংলায় মুসলমানের আটশো বছর’ বইতে “ ‘সওগাত’ পত্রিকাই শুধু নয়, একটি আন্দোলনের নাম” নামে একটি প্রবন্ধ রেখেছেন। আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের তথ্যপাতির বেশিটাই জাহিরুল হাসানের বই থেকে নেয়া, বাকিগুলোর উৎস নানা আন্তর্জালিক সূত্র। আন্তর্জালে ঘেটে দেখলাম ড০ দিলীপ মজুমদার ‘সওগাত, রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলিম মানস’ নামে একখানা গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন সম্প্রতি ২০১০এ। আমাদের বর্তমান রচনা তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বাড়াবার পথে একেবারেই প্রাথমিক সংযোজন মাত্র। যদি অন্যেরাও হাত বাড়ান তবে এক স্বতন্ত্র মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচিত হবে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য। বিশেষ করে আমরা যারা প্রান্তীয় পূর্বোত্তরের বসে কাজ করি , আমাদের জন্যে এগুলো জরুরী বিষয়। প্রেরণার স্রোত। আধুনিকতার পশ্চিমা স্রোতে অবগাহন অনেক হলো, অনেক হলো অমিতাভ যেমন লিখেছিলেন ‘এক অন্যরাজনীতি চালিয়ে’ যাওয়া, এবারে না হয় হোক ‘ঘরে ফেরার গান’।

________________
কিছু দরকারি সংযোগঃ

Wednesday, 12 December 2012

বারোর হুজুগ এবং আমাদের ‘বারোমাস্যা’

(সৌ) মেঘ অদিতি
 বছর দুই আগে একটা হলিউড ছবি বাজারে চালাতে গিয়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে জানিয়ে দেয়া হলো যে দুনিয়াটা আর থাকবে না ডিসেম্বর বারোর পর। এমনিতে যে মায়া সভ্যতার উত্তরসুরী লাল-ভারতীয়দের আমরা মার্কিনিদের দেখা দেখি মানুষ বলে ভাবতে শিখিনি হঠাৎ তাদের পুরোনো ধাঁচের জ্যামিতি আর জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা উপচে পড়ল যেন। কেন, না হলিউডে টাকার গাছের কারবার করেন  যারা সেই  সাহেবেরা আমাদের বলেছেন সে কথা। আমাদের বিশ্বাস না হয়ে যায় কোথায়! সাহেবদের কথা বেদের বাক্য। সাহেব না বললে আমরা রবীন্দ্রনাথ- বিবেকানন্দকেও জাতে তুলিনি। তাদের  অমান্যি করলে পাপ হয়। কলেজে অধ্যাপকেরা যখন ছাত্রদের জানিয়েছেন এসব মিথ্যাচার—--ছাত্র নাক কুঁচকে তার বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছে, স্যর বড্ড সেকেলে মানুষ। ‘বিজ্ঞানী’রাও বলছে দুনিয়া ধ্বসে যাবে ! স্যর মানেনই না। আজ সেই মৃত্যু ভয় উবে গেছে। যারা সেই ভয় জাগিয়েছিল তারা সব চুপ মেরে গেছে । এখন তারা বিয়ে আর ভ্রমণের বাজার গরম করেছে নতুন হুজুগে। সেই হুজুগ বারোর হুজুগ। এমন দিনটি বুঝি আর আসবেই না। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, শেষ বারোর আগেতো একখানা বিশ( ২০) আছে রে বাবা! বাজার জানিয়ে দেবে আপনার কণ্ঠে বিষ। মানুষের ভালো কিছুই দেখেন না। সত্যিই বিষ! এই বারোতো আর আসবে না। কিন্তু আমাদের বারো? বলছি দাঁড়ান। তাকে ছেয়ে ফেলা হয়েছে, ঢেকে ফেলা হয়েছে...একটুতো পশ্চিমী মেঘের বিষ সরাতেই হবে।  

                              তস্মিন্নদ্রোকতিচিদবলাবিপ্রযুক্ত স কামী
                              নীত্বামাসাঙ্কবলয়ম্ভশরিরক্ত প্রকোষ্ঠঃ
                              আষাঢ়স্যপ্রথমদিবসে মেঘমাশিলষ্ট সানু
                             বপ্রক্রীড়া পরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ম দদর্শ।।

                মেঘদূতের একেবারে শুরুর দিকের দ্বিতীয় স্তবক এটি। স্ত্রী বিরহে কামনা তাড়িত যক্ষ ঐ পর্বতে মাস কয় কাটিয়ে দিল। আষাঢ়ের প্রথম দিনেই পাহাড়ের চূড়োতে ঝুকে পড়া মেঘকে ও যখন, দেখল মনে হলো যেন প্রেমোন্মত্ত হাতি শূঁড়ে তার প্রেয়সীর গা ধাক্কা দিচ্ছে।
           মোটামোটি অনুবাদটা এমনি। আষাড়-শ্রাবণের কাব্য এটি। স্মরণ করুন এর দুই ভাগের নাম পূর্বমেঘ এবং উত্তর মেঘ। অনেকে তাই বলেন একে ‘বর্ষাকাব্য।’ তার মানে পুরো এক ঋতুর কথা। ঋতুর কথাতে পরিপূর্ণ কালিদাস এবং সংস্কৃতের কাব্য যত। ঋতু কিম্বা প্রকৃতি নইলে যেন অলঙ্করণ পূর্ণ হতো না তখনকার কাব্যকথার।  তাই কালিদাসের একটি পুরো কাব্যের নামই হলো ‘ঋতু সংহার’। কোন কাহিনি নেই। আছে বিরহী পুরুষের চোখে নারী আর প্রকৃতির বিচিত্র সব রূপ বর্ণনা আর আছে অবশ্যই বিরহের কথা। এখানে সবটার পরিচয় দেয়া স্বস্তিকর হবে না, আমাদের আধুনিক রুচিবোধে আটকাতে পারে। কিন্তু এখন যখন এই বারোর হুজুগে মেতেছে বিশ্ব তখনকার ঋতু হেমন্ত বলে আমরা হেমন্তের কথা বলতে গিয়ে লেখা প্রথম স্তবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি নির্বিরোধ।
                                  নবপ্রবালোদ্গমসস্যরম্যঃ
                                 প্রফুল্ললোধ্রঃ পরিপক্বশালিঃ
                                বিলীনপদ্মঃ প্রপতত্তুষারো।
                                হেমন্তকালঃ সমুপাগতঃ প্রিয়ে।।

হেমন্ত এসেছে প্রিয়ে। নতুন পাতা দিয়েছে দেখা, শষ্যেরা  উঠেছে  সেজে। লোধফুল ফুটেছে দেখো,শালিধান পেকেছে মাঠে, নিস্প্রভ হয়েছে পদ্ম আর তাতে ঝরছে তুষার।
                কিন্তু ঋতুতো ছয়ের হিসেব। আমাদের কাজ বারোকে নিয়ে।  চান্দ্রপঞ্জিকাতে বারোমাস থাকলেও সে নিয়ে তত মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না  তখনকার কবিদের।মেঘদূতের 'আষাঢ়স্যপ্রথমদিবসে'র মতো নজির বেশি মেলে না তেমন। প্রেম আর প্রকৃতিকে মেলাতে পারলেই কাজ চলে যেতো তখন। তাই মেঘদূতের আগে পরে, দূত কাব্যের এক জনপ্রিয় ধারা ছিল, যেমন পবনদূত, পদাঙ্কদূত, হংসদূত, ভ্রমরদূত, বাতদূত, কোকিলদূত ইত্যাদি নামে একগাদা কাব্য থাকলেও বারোমাস্যা জাতীয় কিছু নেই। হয়তো কবিরা রাজসভার কবি ছিলেন বলেই এক একটা মাস যে সময়ের হিসেবে অনেক সে যন্ত্রণা তাদের পোহাতে হয় নি।
         যারা রাজসভার কবি ছিলেন না তারাও মাসটাস নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। হাজার বছর আগে বাংলা যখন ভাষা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে তখন কিছু কিছু বাঙালি কবি অবহট্টে কিছু কবিতা লিখেছিলেন।   এই যেমনঃ সো মঝু কন্তা/ দূর দিগন্তা/ পাউস আএ / চেলু দুলায়ে। এর বাংলাটা মোটা মোটি এরকম। প্রিয়তম দূর দেশে/ দিগন্ত পার/ ওড়না ওড়ালো এসে মেঘ বরষার। কিম্বা ধরুনঃ গজ্জই মেহ কি অম্বর সামর/ ফুল্লই ণীপ কি বুল্লই ভামর/ এক্কল জীঅ পরাহিণ অস্মহ/কীলউ পাউস কীলউ বম্মহ।। এর বাংলাটা কাব্য অনুবাদে  মোটামোটি এরকমঃ মেঘে ডাকছে কি?  আকাশ কি হয়েছে  কালো?  কদম ফুটেছে কি?    ভোমরা কি গাইছে ভালো? পরের অধীন আমার এই একলা জীবন,/  নাচুক বর্ষা, নাচুক নাহয় মত্ত মদন।
             ঠিক ওই সময়েই বাংলাতে খনার বচন বেশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। ইনি যে কবেকার মহিলা, কেউ ভালো জানেন না। সিংহলের মেয়ে বলে বলেন অনেকে। অনেকে বলেন চব্বিশ পরগনার বারাসতের দেউলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম।  ওড়িয়া ঐতিহ্যে খনার নাম লীলাবতী।  কেউ কেউ অতি উৎসাহে একে কালিদাসের কালের রাজা বিক্রমাদিত্যে নবরত্নদের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহের ছেলে মিহিরের বৌ ভাবেন। বিপরীত পক্ষ বলেন সেরকম হলে তাঁর উল্লেখ কালিদাসেও থাকত, আর বাংলা ওড়িষার বাইরেও তাঁর পুরনো প্রভাব পাওয়া যেত। তাই খনার বচন আসলে বাংলার কৃষকদের সন্মিলিত এক আবিষ্ক্রিয়ার নাম। সে যাই হোক,  খনার জনপ্রিয়তা এখনো বাংলার গ্রামে গঞ্জে এতো প্রবল যে সেকালের ভাষাতে তাঁর বচন পাবার উপায় নেই। তাঁর বচনে একেবারেই অকাব্যিক বৈষয়িক দরকারে বারোমাস মেলে। এই যেমনঃ  দাতার নারিকেল, বখিলের বাঁশ/কমে না বাড়ে বারো মাস। কিম্বা ধরুনঃ  বারো মাসে বারো ফল/না খেলে যায় রসাতল।মাসগুলোর উল্লেখ বা ইঙ্গিত পাবেনঃ এই যেমনঃ গাছে গাছে আগুন জ্বলে/বৃষ্টি হবে খনায় বলে। কিম্বাঃ চৈত্রেতে খর খর।/বৈশাখেতে ঝড় পাথর।।/জ্যেষ্ঠেতে তার ফুটে।/তবে জানবে বর্ষা বটে। কিম্বাঃ আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো/ধান লাগাও যত পারো। কিম্বাঃ  তিন শাওনে পান/এক আশ্বিনে ধান। কিম্বা ধরুনঃ  পটল বুনলে ফাগুনে/ফলন বাড়ে দ্বিগুণে। কিম্বাঃ  ফাগুনে আগুন, চৈতে মাটি/বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি।       ( সৌজন্যঃ somewhereinblog)
            আমাদের চাষাভূষাদের আধুনিক মধ্যবিত্তরা মুর্খ  ভাবেন। কিন্তু ওমন সুন্দর অলঙ্কার এবং নিখুৎ ছন্দজ্ঞান বহু বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকেও দুর্লভ। এমন নয় যে যারা এই বচনের স্রষ্টা তারা সবাই নিরক্ষর, স্বাক্ষরও ছিলেন অনেকে। কিন্তু এগুলো তৈরি হয়েছে কিন্তু মুখে মুখে। লেখা হয়েছে পরে। মনে হয় না বটতলার পঞ্জিকা চালু হবার আগে।
              এরমক প্রায় প্রতিটি মাসের কথা খনাতে পাবেন।  এ বোধ করি এর জন্যেও যে তাঁর বচন স্পষ্টতই কৃষক জনতার জন্যে আর তাঁরা বাংলার চর্চা করতেন। যারা সংস্কৃতের চর্চা করতেন তাঁরা কৃষি কাজ করতেন না সরাসরি। এই খনা, প্রাকৃতপৈঙ্গল এবং আমাদের বিখ্যাত চর্যাগীতিকোষ  প্রায় একই সময়ের রচনা। এগুলো  বা পরবর্তী কালেও কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা পদ্মাবতী কাব্যের মতো কিছু রচনা বাদ দিলে  প্রায় কোনটাই রাজসভার কাব্য নয়। এগুলোতে চিত্রিত চরিত্রদের কেউ কেউ রাজপরিবারের বলে বর্ণিত হলেও কৃষিজীবনের সঙ্গে এদের দূরত্ব খুবই কম। এরা নিতান্তই স্থানীয় দেওয়ান যাদের রাজা বলা হতো তেমন কিছু  হয়ে থাকবেন।  অন্যথা সতীনের ষড়যন্ত্রে খুল্লনা ছাগল চরাতে যাবেন কেন, কিম্বা মৃত স্বামী নিয়ে বেহুলা কলার ভাসানেই ভাসবেন কেন। আর ব্যাধ কালকেতু পরে এতো সহজে গুজরাট নগরের রাজা হবেন  কী করে? পূর্ববঙ্গ গীতিকার রাজাতে আর প্রজাতে এই প্রভেদবিহীনতা অনেক বেশি স্পষ্ট। সম্ভবত তাই, ঐ দূতকাব্যের মতো ‘বারোবাস্যা’ বলে বাংলাতে এক কাব্যধারাই গড়ে উঠেছিল। কখনোবা কবিরা এগুলো বড় আখ্যান কাব্যেই জুড়ে দিতেন। তাতেই কবিকঙ্কনের চণ্ডীর ফুল্ল্রার বারোমাস্যা আমাদের খুব পরিচিত। সতীন ভয় দূর করতে ফুল্লরা ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁর বারোমাসের বড় দুঃখের কথা বর্ণনা করছে চণ্ডীর কাছে । হয়েছিল এই, সারা দিনমান ঘুরে শিকার টিকার না পেয়ে কালকেতু ব্যাধ এক সাপকেই পথে পেয়ে ধরে আনে। ফুল্লরাকে ঘরে না পেয়ে সেই সাপকে রেখে  বেরিয়ে যায়। হাটে গিয়ে তাকে পেয়ে  সেই সাপের কথা জানায়। ফেরার পথে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে খুদ লবন কিছু ধার করে নিয়ে যেতে বলে। সেই সাপ ততক্ষণে ষোড়শি সুন্দরী সেজে বসে আছে। শুধুই কি তাই ! বিশ্বকর্মাকে ডেকে এনে সেই সাজের ষোল কলা পুরো করে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ি ফিরে এই মেয়েকে দেখে ফুল্লরার মাথাতে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। খিদে তৃষ্ণা সব ছুটে পালায়।  কে সে মেয়ে,  কোত্থেকে এসছে ইত্যা্দি হাজারো প্রশ্ন আর বাড়ি ফিরে যাবার অনুরোধে জেরাবার করে। সে চাপে  হার না মেনে মেয়ে বলে কিনা’ মোরে এতো জিজ্ঞাসায় তোর কিবা কাজ।/ থাকিব দু’জনে যদি না বাসহ লাজ।”। তখন  ওকে ভয় দেখাতে  ফুল্লরা ‘বারোমাস্যার’ ফন্দি ধরেঃ
                            পাশের বসিয়া রামা কহে দুঃখবানী।
                            ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি পত্রের ছাওনী।।
                            ভেরেণ্ডার খাম তার আছে মধ্য ঘরে।
                            প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।
                           অনল সমান পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
                            শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞার বসন।
                            বৈশাখ হৈল আগো মোরে বড় বিষ।
                            মাংস নাহী খায় সর্বলোকে নিরামিষ।।
                           পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস প্রচণ্ড তপন।
                           খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ।।
                           পসরা এড়িয়া জল খাত্যে যাত্যে নারি।
                           দেখিতে দেখিতে চিলে লয় আধা সারি।।
                           পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস।
                             বেঙচের ফল খায়্যা করি উপবাস।
এমনি করে করে ফুল্লরা যখন এসে চৈত্রে পৌঁছোয় শুনে মনে হবে গোটা বছর সে না খেয়েই থাকে। শুধু কি তাই?
                           সহজে শীতল ঋতু ফাগুন যে মাসে।
                          পোড়ায়ে রমণিগণ বসন্ত বাতাসে।।
                          মধুমাসে মলয় মারুত বহে মন্দ।
                          মালতীর মধুকর দিয়ে মকরন্দ।।
                          বনিতা-পুরুষ যত পীড়য়ে মদনে।
                           ফুল্লরার অঙ্গ পুড়ে উদর দহনে।।
                           দারুণ দৈব দোষে গো দারুণ দৈব দোষে।।
                           একত্র শয়নে স্বামী যেন ষোল ক্রোশে...

             এর পর অন্তত ফুল্লরা আশা করতেই পারত বেহায়া মেয়ে তার বাড়ি ছেড়ে উঠে চলে যাবে। বলে কিনা, “আজি হইতে মোর ধনে আছে তোর অংশ।” বেচারি ফুল্লরা আর করে কী? চোখের জলে কাজল গলিয়ে মুখ কালো করতে করতে হাটে গেল স্বামীকে ধরে একটা বোঝাপড়া করে নিতে।   সেই বোঝাপড়ার পরিণাম কী হয়েছিল আপনারা জানেন, কালকেতু রাজা হয়েছিল, আর ফুল্লরা রাণি।
            তেমনি একখানা কাব্য আছে ‘দেওয়ানা মদিনা’ । পূর্ববঙ্গগীতিকাতে সংকলিত হয়েছিল। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে এই গীতিকাগুলোই আসলে বাংলা সাহিত্যের প্রধান স্রোত। এগুলোতে ধর্ম কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। দেব মহীমাতে ভাগ্যের ফের পাল্টায় না চরিত্রগুলোর ।  ভাতৃপ্রেমের টানে আলালের ভাই  দুলাল যখন ছেলে সুরুজ  সহ স্ত্রী মদিনাকে ফেলে রেখে যায় বৌ একদিন কেঁদে কেঁদে স্মৃতিচারণ করেঃ
                                    লক্ষী না আগন মাস বাওয়ার ধান মারি।
                                    খসম মোর আনে ধান আমি ধান লাড়ি।।
                                    দুইজনে বইসা শেষে ধানে দেই উনা।
                                    টাইল ভইরা রাখি ধান করি বেচাকিনা।।
                                    হায়রে পরানের খসম এমন করিয়া।
                                  কোন পরানে রইলা তুমি আমারে ছাড়িয়া।।
            খ্যাতনামা কাব্যগুলো যখন গতানুগতিকতার অনুসরণ করে বৈশাখ মাসে বারোমাস্যার শুরু করত, ‘দেওয়ানা মদীনা’র কবি সেখানে অনেক বেশি বাস্তবোচিত বলে দীনেশ সেন প্রশংসা করেছিলেন। অগ্রহায়ণে নবান্ন। সুতরাং বিরহিনীর সেই দিনগুলোর কথাই আগে মনে পড়েছে।
        এখন অঘ্রান মাস। বাংলা সন মাসের কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। অথচ যদি তা না করতাম তবে বর্ষোৎযাপন  করতে গিয়ে আমাদের নিজের গোলাভরা  এই ‘বারোমাস্যা’ গীতের সোনার ধান তথা পরম্পরার থেকে মণিরত্ন তুলে আনবার কথা আমাদের মনে থাকত।বারো বারো বারোর ( ১২-১২-১২) বাজারের তৈরি হুজুগে মাততাম না আমরা।  সেগুলোকে ভুলে থাকা সত্যি আমাদের কঠিন হতো।  হয়তো, আমরা নিজেরাই সেগুলোর একালের সংস্করণে মন দিতাম। শুধু কি বাংলাতে? অভিভক্ত বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষাগুষ্ঠী যেমন চাকমা, হাজং, ত্রিপুরি, রাজবংশীদের মধ্যেও এই পরম্পরা সমানে জনপ্রিয় ছিল। খুঁজতে গেলে হয়তো দেখা যাবে ওই সব কোন জনগোষ্ঠী থেকেই এই বারোমাস্যার এই রীতি বাংলাগানে সাহিত্যে এসে ঢুকেছিল। এই যেমন একটি হাজং গানঃ
                          সাধুরে, পৌষ মাসনি সাধুরে ময় পুজি অধিকারী।
                          ভাতার ভুকতি করে যারা ভাগ্যবতী নারী।।
                          ভাতার ধন, ভাতার মন, ভাতার সকল সার।
                          ভাতার বিনে নাইরে গতি এ ভব সংসার।।
                          সাধুরে সিয়ুমাস ফলে সাধুরে মোলা ইয়ুমাস ফলে।
                           কান্দে গাবুর কইন্যা হাত দে কপালে।।
                            সাধুরে- পৌষ মাসেগো সাধু পুজি অধিকারী।
                          পতিভক্তি করে যারা ভাগ্যবতী নারী।।
                           পতিধন, পতিধন, পতি সকল সার ।
                            পতি বিনে নাইরে গতি এ ভব সংসারে।। (সৌজন্যঃ shapludu)
           শুনে কি মনে হয় যে এ কোনো একক বিরহিণী সতীর কান্না! মনেকি হয় না,  কোনো এক দূর অতীতের দিকে ক্রমেই পশ্চাদধাবমান আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি , তার হয়তো নাম ‘বাংলা’, আমাদেরই মতো বিশ্বাসঘাতক উত্তরপুরুষদের ডেকে ডেকে আকুতি করছে, ফিরে দাঁড়াতে। রবীন্দ্রগীতে যেমন ছিল ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে,   আ য় আ য় আয় ।/ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,   মরি   হায়   হায়   হায়…কোন সে নাটকে জুড়েছিলেন  গানটা মনে করুন। রক্তকরবী।  আর আমরা শুনেও না শোনার ভান করে কোন এক হঠাৎ নবাব আলালের জালের  জড়াচ্ছি এর নাম দিয়েছি ‘প্রগতি’ , নাম দিয়েছি ‘আধুনিকতাবাদ’।







Friday, 23 November 2012

কার শরীরে কবি স্নেহাংকর ঝরিয়ে চলেন শ্রাবণের প্রথম বৃষ্টি জল


মূল অসমিয়া লেখাটি বেরিয়েছে সাহিত্য ডট অর্গের নভেম্বর ,১২ সংখ্যাতে
স্নেহাংকর নবীন অসমিয়া কবি । ‘উশাহ’ তাঁর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ। প্রথমটির নাম ছিল, ‘মোৰ শূন্যতাখিনিক চুই চাবলৈ চেষ্টা কৰিবা...চুলোঁ বুলি নক’বা।’ ২০১০এ তিনসুকিয়া শহরে অনুষ্ঠিত জ্ঞানমেলাতে কিনে রেখেছিলাম। পড়ব বলে টেবিলে রেখেছিলাম । এমনি করি, যেগুলো পরে  কাজে এলে পড়া যাবে বলে ভাবি সেগুলো আলমারিতে ভরিয়ে রাখি। কিন্তু টেবিলে ‘উশাহ’ পড়ে রইল। প্রায় এক বছর পড়া হয়ে উঠল না । তবু রইল । কেন না পড়ব । স্নেহাংকর যদিও লিখেছেন, “পোহৰৰ সিপাৰে শুই থাকে সময়/ অসময়ৰ কঁপনিত দৃষ্টি বৰ উকা/ তাতে কাৰ কি”( আলোর ওপারে শুয়ে থাকে সময়/ অসময়ের কাঁপনে দৃষ্টি বড় ফাঁকা/ তাতে কার কী)। আমার বেলা বোধ করি, ‘তাতে কাৰ কি’ কথাটা খাটে না । হয়তো সময়ের জেগে উঠার জন্যে দিন গুনছিলাম। পড়লাম একদিন। নিজে শুয়ে শুয়ে। কিন্তু শুতে পারিনি। পড়ে শেষ করেই স্নেহাংকরকে ফোন করলাম। আমি দুঃখিত। আমার দেরি হয়ে গেল। আরো আগে পড়া উচিত ছিল। এ বইয়ের কয়েকটি কবিতা আমি সময় পেলে অনুবাদ করব।
তথ্যগুলো বাহুল্য লে ভাবতে পারেন কেউ কেউ । কিন্তু আমার ভালোলাগাটুকু এভাবেই বোধ করি সবচে’ ভালো বুঝাতে পারলাম। সেই ভালোলাগাটুকু বাংলা কবিতার পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নেবার কারণ হলো, আমরা যারা অসমিয়া কবিতা পড়ি তাদের আগ্রহ যদি কবি স্নেহাংকর এবং সাধারণ ভাবে অসমিয়া কবিতার সম্পর্কে আরো একটু নাড়িয়ে দেয়া যায়। । সেদিনই অনুবাদ করেছিলাম শেষ কবিতা, ‘কবিতা আপোনাৰ বাবে নহয়।’ দীর্ঘ কবিতা, ক’লাইন উল্লেখ করলেই আপনারা ধরতে পারবেন , স্নেহাংকরের সময়ের কবিদের উপলব্ধি কী? “ আমেৰিকা- শব্দটো এটা ভিলেইনৰ নাম/ হিৰ’ই ভিলেইনক গালি পাৰিলে/ বলীউড মার্কা আৱেগেৰে উথলি উঠা শ্রোতা –দর্শকৰ/ চেতনাৰ (?) জোৱাৰ উঠে...ফেন (fan)-এৰে ফুলি উঠে/ আপোনাৰ সৃষ্টি ঔদ্ধত্য/ বুজি পোৱাৰ অধিকাৰ অবাধ বুলি/ অৰণ্যৰোদন কৰোঁতে আপুনি পাহৰিলে /কবিতা কিমান স্বাধীন/ তাতেই আপোনাৰ/ আপোনালোকৰ বিপদ...”(আমেরিকা—শব্দটি এক ভিলেনের নাম/হিরো যদি ভিলেনকে গালি পাড়ে/বলিউড মার্কা আবেগে উথলে উঠা স্রোতা দর্শকের/চেতনার (?) জোয়ার উঠে...ফেন (fan)-এতে ফুলে উঠে/আপনার সৃষ্টি ঔদ্ধত্য/বুঝে নেবার অধিকার অবাধ বলে/অরণ্য রোদন করতে গিয়ে আপনি ভুলেই গেলেন/কবিতা কতটা স্বাধীন/সেখানেই আপনার/ আপনাদের বিপদ...) । এখন পড়ে দেখুন, কবি তোষপ্রভা কলিতার ‘কবিতা’ নামের কবিতার ক’টি লাইন, “ এমুঠি বোদ্ধাৰ বাবে/ এনেকৈয়ে হেনো তাই হ’ব চিৰন্তন।/ এতিয়া কবিতা হ’ল/ দু’ৰূহ দুর্বোধ্য এক/ কঠোৰ হৃদয়হীন নির্দয়া ৰমণী/ নাজানো হঠাতে তাইক কোনে দিলে আনি/ কোনো এক মিছনেৰী ‘মাদাৰ’ৰ অনন্য হৃদয়;/ যাক পাই কবিতাৰ পুনর্জন্ম হ’ল,/ ধন্য হ’ল পূর্ণ হ’ল।/ ঋজু অকপট হ’ল/ কবিতা সর্বত্রগামী হ’ল/ এতিয়া কবিতা হ’ল/ শীত আৰু বসন্তৰ/ দুখ আৰু আনন্দৰ/ অস্ত্র আৰু ফুল;/ কবিতা নহয় আৰু বতৰৰ ফুল।/ কবিতাৰ নাই দিন নাই ৰাতি/সময় অসময়, কবিতা নহয় আৰু সুখী মানুহৰ ক্রীতদাস/ কবিতা নহয় আৰু পন্ডিতৰ অলস বিলাস...”(গুটিকয় বোদ্ধার জন্যে/ এমনি করেই বুঝি সে হবে চিরন্তন/ এখন কবিতা হলো/ দুরূহ দুর্বোধ্য এক/ কঠোর হৃদয়হীন নির্দয়া রমণী/ জানিনে হঠাৎ কে তাকে এনে দিলে/ কোন এক মিশনারী ‘মাদার’এর অনন্য হৃদয়;/ যাকে পেয়ে কবিতার পুনর্জন্ম হলো/ ঋজু অকপট হলো/ কবিতা সর্বত্রগামী হলো/ এখন কবিতা হলো/ শীত আর বসন্তের/ দুঃখ আর আনন্দের/ অস্ত্র আর ফুল;/ কবিতা নয় আর ঋতুর কুসুম।/ কবিতার নেই দিন আর রাত/ সময় অসময়, কবিতা নয় আর সুখী মানুষের ক্রীতদাস/ কবিতা নয় পণ্ডিতের অলস বিলাস...) সবই বুঝা গেলো । কিন্তু হঠাৎ এই ‘মিছনেৰী মাদাৰ’টি কোত্থেকে এলেন?আর এলেনই যদি, তাঁর সঙ্গে ‘অস্ত্র’-এর কী সম্বন্ধ? আমার মনে পড়ছে অতি সম্প্রতি পড়া পূর্বোত্তর ভারতের এক শক্তিশালী বাঙালি কবি-গল্পকাৰ পল্লব ভট্টাচার্যের ‘কমলিনী উপাখ্যান’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিপ্রের মনে দেখা দেয়া কেয়েকটি প্রশ্ন , “নিজের জীবন কি সত্যই রচনা করিতে পারিতেছে? পারা যায়?! পূর্বে রচিত না হইলেও, পারিপার্শ্বিক দ্বারা রচিত হইবার নানা সম্ভাবনা লইয়া, জীবন রচিত হইয়া চলিতেছে। ইহাতে হয় স্রোতে ভাসিতে হইবে, নয় প্রতিস্রোতে। প্রায় সকলেই বলে, সে প্রতিস্রোতে ভাসিতেছে, কিন্তু ইহা যে আদতে স্রোত নয়, একথাই বা কে নিশ্চিত বলিবে?” আমার মনে হলো, একই জিজ্ঞাসা স্নেহাংকরেরো, প্রতিস্রোতই যে স্রোত নয় কে বলবে? নইলে কি আর তিনি লিখবেন, “ অহংবোধক চূর্ণ-বিচূর্ণ কৰি কবিতাই / আপোনাকো শিকাব পাৰে আঙুলিত ধৰি / বাটৰ বুকুতে শুই থকা বাটৰ দিশ...” (অহংবোধকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে কবিতা/ আঙুলে ধরে আপনাকেও শেখাতে পারে/ পথের বুকে শুয়ে থাকা পথের দিক...)। শেষে গিয়ে স্নেহাংকরের অমোঘ উচ্চারণ, কবিতা “ অহৰহ বিচাৰে আপোনাৰ সমর্পিত সাধনা।”   (অহরহ চায় আপনার সমর্পিত সাধনা)        
স্নেহাংকরের কবিতার সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু আমি যে লিখব, সে কাজটি অত্যন্ত কঠিন করে রেখেছে সমূদ্র কাজল শইকীয়ালেখা এক অনন্য ভূমিকা। ‘ভূমিকা’ বলে শিরোনামটিই নেই । ‘যেতিয়া কবিয়ে কয়ঃ তুমি নজনাকৈ নাইকিয়া হৈ যাম।’  (যখন কবি বলেন, তুমি টেরটি পাবেনা, আমি হারিয়ে যাবো)এর পর কিছু লেখা আসলে এক বাহুল্য মাত্র। এ এক ভূমিকামাত্র নয়, কবিতা বইটির সঙ্গে এক অতিরিক্ত প্রাপ্তি। কবি, কবিতা, পাঠক সম্পর্কিত এক স্বতন্ত্র গভীর তত্বচিন্তার প্রবন্ধ এটি। কিন্তু জটিল নতুবা কঠিন –কোনটাই নয় । বরং এ এক সাহিত্যিক গদ্য। আমি একটি ছোট উদাহরণ দিই, “ কবিতা কাৰ বাবে লিখোঁ, কোনে পঢ়ে, কোনে পড়াটো আমি আচলতে বিচাৰিছোঁ? কাৰ সন্মুখত নো আমি নাটক কৰি আছোঁ বা কৰিবলৈ বিচাৰোঁ, আমাৰ নাটকখননো কোনে চাই আছে? দর্শকজনৰ পৰা আমাৰ মানসিক তথা স্থানিক দূৰত্বই বা কিমান--- এনেধৰণৰ প্রশ্নই সদায় আমাক বিচলিত কৰি ৰাখে। স্নেহাংকৰ এজন নতুন কবি। সকলো কবিয়েই নতুন আৰু সদায়েই নতুন সেয়েহে অলপ শুধৰাই ক’লে এনেকৈ ক’ব লাগিব--- স্নেহাঙ্কৰ এজন নতুন প্রজন্মৰ কবি। এইজন কবিয়ে এদিন লিখিলেঃ তুমি নজনাকৈয়ে নাইকিয়া হৈ যাম...”    (কবিতা কার জন্যে লিখি, কে পড়ে, কার পড়াটা আমরা আসলে চাই? কার সামনে নাটক করছি, বা করতে চাই, আমদের নাটক দেখে কে? দর্শকের থেকে আমাদের মানসিক বা স্থানিক দূরত্বই বা কদ্দূর? –এমন প্রশ্ন আমাদের সবসময় বিচলিত করে রাখে। স্নেহাংকর একজন নতুন প্রজন্মের কবি। এই কবিটি একদিন লিখলেন, তুমি টেরটি পাবেনা, আমি হারিয়ে যাবো...)  এই ‘হারিয়ে যাবো’ কথাটির সূত্র ধরে  শেষে গিয়ে  তিনি জিজ্ঞেস করছেন, “ স্নেহাংকৰে কি বিচাৰিছে? নাম , যশ নে ধন? যিহককেই নিবিচাৰক কিয় সেয়া তেওঁৰ অধিকাৰ আৰু সেয়া তেওঁ কৰা উচিত। আমাৰ পৰম্পৰাগত প্রথাই কিন্তু সদায় ইয়াক বিৰোধিতা কৰি আহিছে –সেয়া আমাৰ বিচাৰত হাস্যস্পদ। কবিয়ে নাম-যশ নিবিচাৰিব কিয়? নাম –যশৰ জরিয়তেই দেখোন এজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিয়ে তেওঁৰ আকাংক্ষিত পাঠক বা দর্শকৰ সৈতে যোগাযোগ সাব্যস্ত কৰে, সঁহাৰি বিচাৰি পায়, ভালো পোৱা বিচাৰিয়েইতো লেখকে লিখে। আৰু ধন? কবিয়ে অর্থৰ প্রত্যাশা কৰাত আপত্তি কিয়?”   ( স্নেহাংকর কী চাইছেন? নাম , যশ না ধন? যাই চান না কেন এ তাঁর অধিকার এবং এ তার দাবি করা উচিত। আমাদের পরম্পরাগত প্রথা কিন্তু সবসময় একে বিরোধিতা করে এসছে –এ আমাদের বিচারে হাস্যাস্পদ। কবি নাম-যশ চাইবেন না কেন? নাম –যশের মধ্যি দিয়েই দেখি একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তি তাঁর আকাংক্ষিত পাঠক বা দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ সাব্যস্ত করেন, প্রেরণা খুঁজে পান, ভালোবাসার সন্ধানেইতো লেখক লেখেন। আর অর্থ? কবি অর্থের প্রত্যাশা করলে আপত্তিটা কিসের ? ) এই যে প্রশ্ন উত্থাপন করলেন তিনি এটি চিন্তা করবার মতো বিষয় । আমরা মনে করি, সস্তা যশ এবং ধনের লোভ যে বহু প্রতিভাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় সেই কথা মনে রেখেই সমুদ্র কাজল এগুলো লিখেছেন । এর এই কথাগুলো একা কবি স্নেহাংকর নয় সমস্ত লেখক এবং পাঠক জনতাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন। অসমে অর্থ সাহিত্যের সত্যিকার কতটা কী ভালো মন্দ করতে পারে এ কথাও ভাববার মতো। এখানে নেই আনন্দ পাব্লিশার্স, নেই পেঙ্গুইন অথবা অক্সফোর্ড প্রেস।
সে যাই হোক , সমূদ্র কাজল ‘তুমি নেদেখাকৈয়ে এদিন নাইকিয়া হৈ যাম’ কবিতাটিকে নিয়ে এভাবে ভেবেছেন, আর করার কারণটাও কবি দিয়ে রেখেছেন । শুরুতেই তিনি পঞ্চদশ শতিকা জাপানি কবি মাৎশো বাশো (Matsuo Bashō)র একটি হাইকুর উদ্ধৃতি দিয়ে রেখেছেন ‘Come see real flowers of this painful world’ বাশো মৃতপ্রায় হাউকু ধারাটিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। জাপানি এবং চিনা ধ্রূপদী সাহিত্যিকদের সারিতে তাঁকে গণ্য করা হয়। কিন্তু তাঁর জীবন ছিল দারিদ্র্য, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তাতে ভরা। তাঁর বাবা ছিলেন এক সাধারণ সামুরাই। আশা করেছিলেন ছেলেকে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে এক সম্মানজনক জীবন দেয়াতে পারবেন । পারেননি । দীর্ঘদিন বাশো কবি টাডো যোশিটাডার বাড়িতে রাঁধুনীর কাজ করতে থাকলেন । কিন্তু সেখানেই তিনি কাব্যের যে পরিবেশ পেলেন, সেই তাঁর জীবন পালটে দিল। শেষে গিয়ে জাপানের সবচে’ সম্মানিত কবিদের একজন করে তুলল। বন্ধু হয়ে ওঠা যোশিটাডার আকস্মিক মৃত্যুর পর বহুদিন বাড়ি ছেড়ে বাশো কই যে গেছিলেন এ এক রহস্য হয়ে রইল । পরের জীবনে বাশোর নিজে দেয়া বিবরণ এবং গবেষকদের এখনকার আবিষ্কৃত উপকরণগুলোও পরস্পর বিরোধিতাপূর্ণ। মনে হয় বাশোর জীবনের এইসমস্ত সত্যই স্নেহাংকরকে অনুপ্রাণিত করেছে এই কবিতা লেখার জন্যে । লিখেছেন কী সুন্দর করে দেখুন , “শীতল এন্ধাৰত নিতাল মাৰিলে তেজৰ সোঁত/পোষাক সলোৱা সুৰে/অগা- দেৱা কৰিছে দিনে নিশাই/অথচ/গমকে নেপাবা/কেতিয়া তোমাৰ পোহৰতে হেৰাম”     (শীতল আঁধারে চুপ মেরে গেছে শোণিত স্রোত/ জামা পাল্টাবার সুরে/ সামনা দিয়ে পথ কেটে যাচ্ছে দিন রাত/অথচ/টেরটি পাবে না/ কখন হারিয়ে যাবো তোমার আলোয়...)। নতুবা “চকু পিৰপিৰাই থাকিবা/ক’তো নেদখা পোহৰ/ভাল পোৱা/তোমাৰ যে এন্ধাৰ ময়েই   (চোখ পিরপির করতে থাকবে/ কোথাও না দেখা আলো/ আমিই যে তোমার অন্ধকার)।
কিন্তু বাশো সম্পর্কে এই কথাগুলো যদি আমরা না জানি? কবি রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা কি কারো মনে পড়বে না?আমার কিন্তু মনে পড়ল,“যত চাও তত লও তরণী-পরে।/আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে॥/ এতকাল নদীকূলে/ যাহা লয়ে ছিনু ভুলে/ সকলি দিলাম তুলে/থরে বিথরে—/এখন আমারে লহো করুণা ক’রে॥/ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী/আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।/ শ্রাবণগগন ঘিরে/ ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,/ শূন্য নদীর তীরে/রহিনু পড়ি—/যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।” কবির সৃষ্টি কবিতা থেকে যাবে , কবি হারিয়ে যাবেন ; নতুবা কবিতাগুলো স্থানান্তরের -কালান্তরের পাঠক সমাজে যেতে থাকবে , কবি থাকবেন দাঁড়িয়ে এক নির্জন স্থির স্থান-কালেই। আমরা কি ভাবতে পারি না? না পারলেও কিছু যায় আসে না। পাঠক নিজের মনের  স্থিতি অনুযায়ীই কবিতা পড়েন।
বাশোর একটা কবিতা আছে, if I took it in hand,/it would melt in my hot tears— /heavy autumn frostস্নেহাংকর লিখছেন দেখুন , “ বৰ নিমখ, নিমখ হ’ল অ’ আই /চকু মোৰ/ চাই থাকিলে মঙহৰ মানুহো গেলি যায়/ নুসধিবি একোকে” (বড় নোনা , নোনা হলোগো মা/আমার চোখ / তাকিয়ে রইলে মাংসের মানুষও গলে পচে যায়/ আর জিজ্ঞেস করো না কিছু .../কবিতার নামঃআই জানো)। না, স্নেহাংকর হাইকু লেখেন নি । তাঁর কবিতা সাধারণ অসমিয়া কবিতার মতোই প্রয়োজন অনুযায়ী দীর্ঘ অথবা ছোট। কিন্তু আমরা ভারতীয়দের সাধারণত ইংরাজি বা ফরাসি কবিতা পড়বারই অভ্যাস থাকে। সম্ভবত আমাদের  এক ঔপবেশিক মন আছে বলেই ইউরোপের সাহিত্যধারারা অনুগামী হতে পারলে বা তার থেকে অনুপ্রেরণা পেলেই আমরা শ্লাঘাবোধ করি।সেদিক থেকে স্নেহাংকর কিন্তু ব্যতিক্রম। তাঁর আছে এক আন্তর্জাতিক কবিতা পাঠকের মন। আর যেখানেই যে কথাটি তাঁকে চিন্তা করতে সুবিধা দিয়েছে তিনি সেভাবেই লিখেছেন। কবিতাক’টির শুরুতে কথাগুলোর উল্লেখ করে আমাদের বুঝে উঠতেও সুবিধা করে দিয়েছেন। যেমন ‘টেলিফ’নিক’ কবিতার শুরুতেই আবার আছে বাশো, Now cat’s done/mewing, bedroom’s/touched by moonlight.” কিন্ত এটি আবার প্রেমের কবিতা । এই বিড়ালটিকে পাওয়া যাবে ‘ম্যা...য়া...ওঁ’ কবিতাতে। “হোটেল নৰকৰ দুৱাৰডলিত /চে’লফ’ন লৈ এজনী তপস্বী মেকুৰী / তাইৰ চকুত মোৰ চকুৰে অলেখ চকুৰ প্রতিবিম্ব...” (হোটেল নরকের দোয়ারে /সেলফোন নিয়ে একজন তপস্বী বেড়ালি / তার চোখে আমার চোখেতে অনেক চোখের প্রতিবিম্ব...)অবশ্যে এই বেড়ালি বাংলা বাগ্বিধির ‘বেড়াল তপস্বী’ হতে অসুবিধে নেই। দীর্ঘ কবিতাটি শেষ হয়েছে এই কথাতে, “ সাৰ পায়েই জানিলোঁ/ মেকুৰী ভাল পাব নোৱাৰী।”  (জেগে উঠেই জানলাম/ বেড়ালিকে বাসতে নারি ভালো)আশা করছি এর বেশি বলতে হবে না। ‘আপোনাৰ জলছবি’র শুরুতেই আছে লালন ফকিরে গানের ক’টি লাইন, “ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।/ ধরতে পারলে মন- বেড়ি দিতাম পাখির পায়/ আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা/ তার উপরে সদর কোঠা আয়না মহল তায়।” সম্পূর্ণ গানের আরো দুটো স্তবক হলো, “কপালের ফের নইলে কি আর পাখিটির এমন ব্যবহার।/খাঁচা ছেড়ে পাখি আমার কোনখানে পলায় ।।/ মন, তুই রৈলি খাঁচার আশে খাঁচা যে তোর তৈরি কাঁচা বাঁশে।/কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে ফকির লালন কেঁদে কয়” একই কবিতার পুনসৃজন করেছেন কেমন স্নেহাংকর দেখুন । আমরা সম্পূর্ণটা তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না।
আইনাৰ সন্মুখত থিয় হৈ চালোঁ
নিৰাভৰণ ঘৰখনৰ দুৱাৰ খিৰকী

অনাদিৰ পৰা অনন্তলৈ জুই লগা
চৌকাটোলৈ চকু গ’ল

থাউনিচোন পোৱাই না যায়

এসাগৰ এন্ধাৰৰ মাজত
হঠাৎ
দেখিলোঁ এচমকা  ভাসমান
গভীৰ ...উজ্জ্বল জুই

ঘৰৰ চৌকা আৰু গৰাকী...
ভিতৰ কোঠাত জ্বলি থকা চাকি
আৰু মূল দুৱাৰৰে আয়াসতে
অহা-যোৱা কৰিলেহে

আইনাত ভাহি উঠে
আপোনাৰ জলছবি

ছবিৰ ভিতৰতো ছবি
পানীতেই
আপোনাৰ ভিতৰতো আপুনি
(আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি /নিরাভরণ ঘরখানার দোয়ার খিড়কি/অনাদির থেকে অনন্তঅব্দি লেগেছে আগুন /চুলোটার দিকে চোখ গেল/তলানিতো দেখি ঠেকেই না পায়ে /এক সমূদ্র অন্ধকারের  মধ্যে /হঠাৎ/দেখি একবিঘৎ ভাসমান/গভীর ...উজ্জ্বল আগুন/ঘরের চুলো আর গৃহস্থ .../ভেতর ঘরে জ্বলন্ত বাতি /আর মূল দোয়ার দিয়ে  আয়াসে/আসা যাওয়া  করলেই/আয়নাতে  ভেসে উঠে/আপনার  জলছবি/ছবির ভেতরেও ছবি /পানিতেই/আপোনার ভিতরেও আপনি)
৯ ডিসেম্বর, ২০১২ সাময়িক প্রসঙ্গে
তেমনি আরেক কবিতার নাম ‘জ়াহির’। হ্যা, ‘জ’ বর্ণের নিচে বিন্দু  একটা দিয়ে তিনি মূল আরবি উচ্চারণে রাখতে চাইছেন  শব্দটিকে। সঙ্গে এর  সম্পর্কে একটা টীকাও লিখে দিয়েছেন শুরুতেই , according to the writer Jorge Luis Borges, the idea of the Zahir comes from Islamic tradition and is thought to have arisen at some point in the eighteenth century. Zahir, in Arabic, means visible, present, incapable of going unnoticed. It is someone or something which, once we have come into contact with them or it, gradually occupies our every thought, until we can think of nothing else. This can be considered either a state of holiness or of madness.” Faubourg Saint-Peres, Enclopedia of the Fantastic (1953)  টীকাটির দরকার ছিল, নইলে আমরা যদিও বা বুঝতে পারতাম, “ হেজাৰ নিশা/ ইকাটি-সিকাটিৰে বাগৰে/ টোপনি হেৰাল / দুখত সৰা তেজৰ শব্দত......”; (সহস্র নিশি / একাতে-ওকাতে গড়ায় / হারালো ঘুম / দুঃখে ঝরা শোণিতের  শব্দে......)কিন্তু পুরো  কবিতাটি বুঝাটা কঠিন হতো। বিশেষ করে এই ক’টি লাইন, “ দুঃস্বপ্নৰ দৰে সহস্র নিশাবোৰ/ হেৰাব/ পলকতে/ ‘জ়াহিৰ’ হ’বা/ ভাল পোৱা”(দুঃস্বপ্নের মতো সহস্র নিশি/ হারিয়ে যাবে/ পলকে / ‘জ়াহির’ হবে / ভালোবাসা)।  এমনিতে শুরুতেই  এই টীকা দেখতে বিসদৃশ যেন মনে হয়, শেষে দিতে পারতেন। হয়তো তিনি পাঠককে ধন্ধে রাখতে চাননি। কিন্তু আমার মতে অসমিয়াতেও লিখতে পারতেন ।
তিনি যেটুকু লেখা বাহুল্য বলে ভেবেছেন, সেইটুকু আমরা খানিক অনুসন্ধান করলাম। তাতে আমাদের স্নেহাংকরের কবিতা চিন্তার সূত্র খুঁজে পেতে সুবিধে হলো । এটুকু দরকার। ‘দ্য জ়াহির’ নামে একটি বিখ্যাত স্পেনীয় ছোট গল্প আছে। লেখক জর্জ লুই বোর্জ । জন্মসূত্রে তিনি একজন আর্জেন্টাইন। তাঁর গল্পের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে একই নামে আরো একখানা বিখ্যাত উপন্যাস লিখেছিলেন ব্রাজিলের পোর্তুগীজ ঔপন্যাসিক পাওলো কোয়েলো । কোয়েলোর উপন্যাস ‘দ্য এলকেমিস্ট’ আমরা অনেকেই পড়েছি বা নাম শুনেছি। দুই  দশকে বইটি ৭১টি ভাষাতে অনুদিত হয়ে গিনিজ বুকে  তালিকাবদ্ধ হয়েছে ইতিমধ্যে। অনেকে তাঁদের উত্তরাধুনিক লেখক বলে চিহ্নিত করতে চান। আমরা জানিনা , তাঁরা নিজেরা কী ভাবেন। লুই বোর্জ প্রথম জীবনে কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পরে  নিজেকে স্বৈরতন্ত্রের বিরোধী বলে পার্টির থেকে বেরিয়ে এলেন । কিন্তু দেখা গেল আমেরিকা সমর্থিত সেনা সরকারকে একটা সময়ে তিনি  সমর্থন দিলেন। যাই হোক,  আমরা  এগুলোর ভেতরে যাবো না। এগুলোকে সাহিত্য বিচারের অনিবার্য উপকরণ ভেবে নিতে আমাদের আপত্তি আছে। ‘জ়াহির’  গল্পটি আমরা  পড়েছি। যিনিই পড়ুন  এক নতুন ধরণের গল্পের  স্বাদ পাবেন। কিন্তু আমরা  বুঝলাম যে কোথাও না কোথাও  কবি স্নেহাংকর নতুন জনপ্রিয় সাহিত্য চিন্তা ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অন্তত সাহিত্যের ‘আধুনিকতাবাদ’ বলে জিনিসটিকে  যে তিনি  নিজেও ভালোচোখে দেখেন নি, প্রতিটি কবিতাতেই এটি স্পষ্ট।  পূর্বোক্ত, ‘কবিতা আপোনাৰ বাবে নহয়’ কবিতার মূল কথা এটাই। সমূদ্র কাজল শইকিয়ার ভূমিকাতেও দেখলাম, ‘আধুনিকতাবাদে’র কথা উল্লেখ করে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ সমালোচনা । এমন তাত্বিক অবস্থান আমাদের আবার এক নতুন ধরণের ইউরোকেন্দ্রিকতার দিকে নিয়ে যাবে না তো? ‘আধুনিকতার’ বিরুদ্ধে কিন্তু এমন অভিযোগ অনেক  পুরোনো হলো। আমাদের মতো এককালের  ঔপনিবেশিক দেশের মানুষের  মনে ইংরেজি ভাষা এবং ইউরোপীয় সভ্যতার সবই ভালো- এমন এক ধারণা  কাজ করে। এখানকার বাজারে  নতুন যে জিনিসই বেরোক , কাল আমাদের লাগবেই। তা সে নতুন মোবাইল সেট বা কবিতা  লেখাৰ শৈলী যাই হোক। এমন বিপদ আমাদের  থাকেই। আমরা কখনোবা আমাদের  নিজের সংস্কৃতির পরম্পরাকেই ভুলে যাই। তাই,  ‘মিছনেৰী মাদাৰ’কে নইলে আমাদের ‘প্রগতিবাদী’ কবিতাও  লিখা হয় নি । তাই আমি  নিজে এমন সাহিত্য তত্বের সম্পর্কে সতর্ক। সমালোচনা করতে গিয়ে নিশ্চয় এর কোনো  মূল্য থাকে, লেখকের ব্যক্তিজীবনেরো একটা কিছু দর্শন থাকবে যদিও,  লেখার সময়ে সেই দর্শনকে নিয়ন্তার দায়িত্ব দিতেই নেই।  আর দিলেও লাভ কিছু নেই। সাহিত্যক যতই শিবির একটা গড়ুন না কেন , সাহিত্য শিবিরে থাকে না। শেষে গিয়ে সমস্ত সাহিত্য এক একটা সমগ্র ভাষাগোষ্ঠীর এবং কোনো ভাষাতে যদি অনুদিত হয় তবে  সেই ভাষার পরম্পরার নিজের সম্পদ হয়ে  যায় গিয়ে। নিজের তাত্বিক অবস্থানের সঙ্গে সাহিত্যিকজনো কেউ ‘নজনাকৈ নাইকিয়া হৈ’ যান। লেখকও মনে মনে সেইটাই চান। মনে হয় কবি স্নেহাংকএ এই কথা জানেন এবং মেনে চলেন । নইলে  কেনই বা লিখবেন, “মোৰ এখন চিলা আছে/চিলাত আছে মোৰ দুচকু” (আমার একটি ঘুড়ি আছে/ ঘুড়িতে আছে আমার দুটি চোখ/কবিতার নামঃচিলা উৰে আকাশত)।
অবশ্য ‘উত্তরাধুনিক’ চিন্তার অনেক এলোমেলো ব্যাপারের মধ্যেও , কিছু চিন্তা আছে আমাদের কাজে আসবার মতো। আমরা যে দু’জন লেখকের  নাম উল্লেখ করলাম তাঁদের দুজনেই ছিলেন বহু ভাষিক এবং এঁদের গল্প উপন্যাসের একটা লক্ষণ চোখে না পড়ে থাকে না যে  তাঁরা  নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে  বিশ্ব ইতিহাসের, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এক সকম মানস ভ্রমণ করে নিজের মতো  সত্যের  সন্ধান করেন। ‘দ্য এলকেমিষ্টে’র কেন্দ্রীয় চরিত্র মেষপালক ছেলে সান্তিয়াগো যেমন গোপন ঐশ্বর্যের সন্ধানে  মিশরের পিরামিডে  যায়।  আমরা আশা করছি, পাঠক ইতিমধ্যে স্নেহাংকরের মাৎশো বাশো, নতুবা লালন ফকিরের প্রতি আগ্রহের কারণ খুঁজে পেলেন।সোজা   কথাতে বলতে গেলে  বিশ্বায়নের যুগে যখন  আমাদের  একাংশ সংবেদনশীল মধ্যবিত্ত মন পুঁজিবাদী আধুনিকতার চাকচিক্যে  ক্লান্ত, অথচ চোভিয়েত পতনের পর সেদিকে কোনো নতুন আন্তর্জাতিক বিকল্প পথের সন্ধানও দেখা দেয় নি তখন এ এক বিশ্বপ্রবণতা হয়েছে যে লেখকরা  নিজ উদ্যমে পুরোনো মত এবং পথ পরিত্যাগ করেছেন। বিশেষকরে ইউরোকেন্দ্রিক সমস্ত চিন্তা চর্চাকে ছেড়ে ,  বর্তমানকে ছেড়ে এক নতুন ভবিষ্যত নির্মাণের আশাতে ইউরোপের বাইরে এবং   অতীতের দিকে যাত্রা করছেন ।   স্থান-কাল সম্পর্কীয় এক স্বতন্ত্র চিন্তাচর্চার মধ্যে  এঁরা ঢুকে পড়েছেন।  ইউরোকেন্দ্রিকতার মধ্যে, আমি যেভাবে বুঝেছি, উপনিবেশের যুগে গড়ে ওঠা  আমাদের ধর্ম নতুবা জাতি চিন্তাও ঢোকে থাকে।তাই দেখব,   স্নেহাংকর কবিতা লেখার সময় মান্য অসমীয়া ভাষার সীমা অতিক্রম করে যান । বাংলাভাষাতে এমন  অতিক্রম আজকাল প্রায় সাধারণ কথা হয়ে গেছে । যেমন প্রবীন কবি গৌতম চৌধুরীর কবিতার ক’টি লাইন দেখুন, “কিতারে সত্য কই হে গজবিড়ালি/ মুখ থিকা মৎস নামাও, আর কইয়া দাও প্রকৃত সত্য কিতা?/ দূর ? না নিকট? কিতা সত্য ?/ আলো আঁধারির মিল ক্ষণিকের? না কি চিরধাবমান বিপরীতগামীতা?/ কারে আমি আমি কই, কে আমার তুমি?/ রুদ্ধকমলদল কার বুকে আন্ধার ঘনায়? কারবুক আলো করে কমলা সুন্দরী?” ( বিরহ মিলন লইয়া এক পরস্তাব)। ‘কমলাসুন্দরী’কে  চিনলেনতো? কবি যেই কলকাতার  মান বাংলার থেকে সরে এলেন গোয়াপাড়ার  লোকগীতের ‘কমলাসুন্দরী’কে এসে ছুঁয়ে ফেললেন । মান বাংলাতে লিখলে এমন হতো না বলে বলব না,  কিন্তু সম্ভাবনা অনেক কম থাকত।    স্নেহাংকরও অসমিয়া সামাজিক উপভাষা(?) সাদ্রিতে  লিখেছেন, “ তদেৰ নাই জানিহি/ হামদেৰ ছানাগিলাকেৰ চকুমে/ আজিকালি হৰিয়ালি জাগামে ছবটা লালে –লাল আহে” ( হামদেৰ ত’ কন রং নেইখে) ।   কবি যখন লেখেন, ‘‘জ়াহিৰ’ হ’বা/ ভাল পোৱা” আমরা যেন সুফি কবিতাগুলো নতুন করে অসমিয়া ভাষাতে পড়ে ফেললাম । অথবা, লালনগীতি সম্পর্কিত যে কবিতার উল্লেখ করলাম ,এ কেবল প্রতিবেশী বাংলাদেশের বা বাংলা ভাষাজগতের কথা নয়, ‘কেলীয়া নাম’ বা ‘টোকারী গীত’ পরম্পরাকে মনে করুন যেখানে কবি লেখেন, “মাঝ সাগৰতে এডাল বিৰিখ। তাতে নানা পখীৰ কায়া/ ৰজনী পুৱালে পক্ষী উৰি গলে/এৰিলে বিৰিখৰ মায়া।” (মাঝ সাগরে একটা বিরিকখো । তাতে নানা পাখির কায়া/ রজনী পোহালে পক্ষী উড়ে গেলো/ছেড়ে দিল  বিরিকখের মায়া।/ টোকাৰী গীত, সংগ্রাহক প্রতাপ হাজৰিকা। সৌজন্যঃঅসমীয়া লোকসংগীত আৰু অন্যান্যগীত-মাত –ফেচবুক গ্রুপ,অভিজিৎ কলিতা)   ‘অসুখ’ নামের কবিতাতে এই প্রজন্মের  কবি কি লেখেন দেখুন, “ ‘এয়া লোৱা’—বুলি ঈশ্বৰে তোমাৰ হাতত অগাধ সম্পদ তুলি দিলে/ আপোন পাহৰা হ’লা ছাঁটোলৈকে লাজ-লাজ/ দেহী ঐ লাজুকি লতা/ কুঁৱাৰ বেৰত কুমজেলেকুৱা বগালে/ ঈশ্বৰৰ খেয়াল খুচিৰ কিবা ঠিকনা আছেনে/ টিলিকতে দিনবো  নিশা হয়/ ৰাতিৰ আকাশত তৰাই চাই থাকোঁতেই/ তেওঁ সোণৰ জখলাৰে নামি আহে......ঈশ্বৰৰ প্রলম্বিত বৰষুণৰ টোপালবোৰ স্ফটিক যেন উজ্জ্বল/ তীখাৰ  দৰে তেজাল পাৰাৰ নিচিনা গধুৰ/ নদীত পানীৰ টোপাল পৰে/ঢৌত উটি যোৱা তুমি/দুচকুৰ এন্ধাৰত/ দুলি থাকে ভাল পোৱাৰ সুখ/ অসুখ”। (‘এই নাও’—বলে ঈশ্বর তোমার হাতে অগাধ সম্পদ তুলে দিলেন/ আত্মভোলা হলে ছায়াটি দেখেও লাজ-লাজ/ দেহধারী ঐ লাজুকি লতা/কুয়োর বেড়াতে কেঞ্জুলিকা বেয়ে উঠল/ ঈশ্বরের খেয়াল খুশির কি আর কোনো  ঠিকানা আছে/ টিক করে  দিনগুলো রাত হয়/ রাতের আকাশে তারাগুলো তাকিয়ে থাকতেই/ তিনি সোনার সিঁড়িতে নেমে আসেন......ঈশ্বরের প্রলম্বিত বৃষ্টিফোটাগুলো স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল/ ইস্পাতের মতো ধারালো পারদের মতো ভারী / নদীতে পানির বিন্দু পড়ে /ঢেউতে ভেসে যাওয়া  তুমি/দুচোখের আঁধারে / দুলতে থাকে ভালো বাসার  সুখ/ অসুখ)আধুনিক অসমিয়া কবিতাতে আমরা বৈষ্ণব ঐতিহ্যের থেকে  ঈশ্বরের কথা পাইনি নয়।পেয়েছি এরকমঃ  বৈকুণ্ঠৰে পৰা হৰিয়ে সুধিলে—/“কোন কোন আহিবৰ হ’ল”/ নাম-লোৱা ভকতে সাদি বুলিলে—/“নামতে গৈ আছো তল।” (বৈকুণ্ঠ থেকে  হরি সুধোলেন—/“ কার আসার হলো বেলা  ”/ নামে মত্ত- ভক্ত জানালো—/“ভাসিয়েছি যে তোমার নামের ভেলা।/ ঈশ্বৰ আৰু ভকত; লক্ষ্মীনাথ বেজবৰুৱা) কিন্তু তিনি আবার  ভক্তের ঈশ্বর। কিন্তু কবি স্নেহাংকর ভক্ত নন, তাঁর ঈশ্বর ঈশ্বর নইলেও সমস্যা নেই। এ যেন জীবনের নশ্বরতাকে স্মরণ করিয়ে আধুনিক জীবনের ভোগবাদের সুখ এবং বিষন্নতার সমালোচনাহে। “ তেওঁৰ আঙুলিত ঠাঁৰত হিল্লোলিত হয়/ ৰত্নভাণ্ডাৰত তোমাৰ / পোহৰ বৰষুণ বতাহ আৰু জুইৰ মৃণ্ময় গীত।” (তাঁর আঙুলের দোলায়  হিল্লোলিত হয়/ রত্নভাণ্ডারে তোমার / আলো বৃষ্টি বাতাস আর আগুনের  মৃণ্ময় গীত।) ‘নামকীর্তন’ নয়, কবির আগ্রহ ‘মৃণ্ময় গীতে’ই শুধু ! আমার মতে এটি অসমিয়া কবিতার নতুন উচ্চারণ। এবং নতুন চিত্র। এক ধরণের  বর্তুলাকার অগ্রপদক্ষেপ।
১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ সাময়িক প্রসঙ্গে
আমরা এতোক্ষণ  কবিতার দর্শনের কথা বললাম, স্নেহাঙ্করের কবিতার জগতটিকে চিনিয়ে দিলাম ।বলবার মতো আরো অনেক কথাই রইল। সাধারণত সমালোচনা লিখতে আমরা এতোটা লিখি না । দৈনিক কাগজ আমাদের সমালোচনার আদর্শকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু একটা কথা বলতেই পারি, উদ্ধৃত সারিগুলোতে তাঁর  ছবি আঁকার দক্ষতাটুকু লক্ষ্য করেছেন? দার্শনিকতা সেই ছবিগুলোকে উজ্জ্বলহে করেছে, ঢেকে ফেলেনি ।সে  কবি যতই লিখুন , “ বৰষুণত আবুৰ হ’লেও দেখিবা/ স্খলিত হতাশ এই কংক্রীট মহানগৰীকো/ শীর্ণ আৰু খুব বুদ্ধু যেন লাগে/ ফুচকা খোৱা আবেলিবোৰ/ এন্ধাৰ সনা হৈ আহিলে দেখিবা/ মহানাগৰিক শুকান বালিৰ তৰপে তৰপে । শেলুৱৈ সাবটা প্রেমৰ কবিতা”(বৃষ্টিতে ঢাকা হলেও দেখবে / স্খলিত হতাশ এই কংক্রীট মহানগরীকে/ শীর্ণ এবং খুব বুদ্ধু যেন মনে হয়/ ফুচকা খাওয়া বিকেলগুলো /আঁধার মাখানো হয়ে এলে দেখবে / মহানাগরিক শুকনো বালির থাকে থাকে  ।শেওলা জড়ানো প্রেমের কবিতা) এই কবিতা আরম্ভ হয়েছে এরকম, “ তোমাৰ শৰীৰলৈ শাওণৰ /প্রথমজাক বৰষুণ বাকি দিওঁ/ এতিয়াও দুখৰ দিনত গুপুতে গুপুতে পৰাগ বিয়পাওঁ”  (তোমার শরীরে শ্রাবণের /প্রথম বৃষ্টিজল ঝরিয়ে দিই/ এখনো  দুঃখের  দিনে চুপি চুপি পরাগ ছড়াই) এর  প্রথম দুটো সারি আসলে কবিতাটির নাম।আমি  এই সারি দুটোকে বাংলা ভাষাত অনুবাদ করতে পারিনি ভালো।  ‘বাকি’ শব্দটির  প্রয়োগ এতোটাই সুন্দর হয়ে উঠল যে এর বাইরে  আসলে অন্য  কোনো শব্দ কল্পনাই করতে পারব না। আমরা ‘ঝরা’শব্দটি ব্যবহার করলাম বটে, কিন্তু তাতে কাপে চা কিম্বা সুরা ঢেলে দেবার অনুষঙ্গ এলো কি আর?   বাংলা ভাষাতে অন্য অনেক সুন্দর  শব্দ থাকলেও ‘বাকি’র কোন বিকল্প নেই। আমরা জানি না কার শরীরে স্নেহাংকর ‘বাকি দিয়ে’(ঝরিয়ে যান)  শ্রাবণের প্রথম বৃষ্টিজল , কোথায় বা  চুপি চুপি  ছড়ান পরাগ । কিন্তু  তিনি এই কাজগুলো করে গেলে  যে আমরা আরো অনেক সুন্দর  কবিতা পাবো সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই কোনো।
                                       **************************