(সৌ) মেঘ অদিতি |
বছর দুই আগে একটা হলিউড ছবি বাজারে চালাতে গিয়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে জানিয়ে দেয়া হলো যে দুনিয়াটা আর থাকবে না ডিসেম্বর বারোর পর। এমনিতে যে মায়া সভ্যতার উত্তরসুরী লাল-ভারতীয়দের আমরা মার্কিনিদের দেখা দেখি মানুষ বলে ভাবতে শিখিনি হঠাৎ তাদের পুরোনো ধাঁচের জ্যামিতি আর জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা উপচে পড়ল যেন। কেন, না হলিউডে টাকার গাছের কারবার করেন যারা সেই সাহেবেরা আমাদের বলেছেন সে কথা। আমাদের বিশ্বাস না হয়ে যায় কোথায়! সাহেবদের কথা বেদের বাক্য। সাহেব না বললে আমরা রবীন্দ্রনাথ- বিবেকানন্দকেও জাতে তুলিনি। তাদের অমান্যি করলে পাপ হয়। কলেজে অধ্যাপকেরা যখন ছাত্রদের জানিয়েছেন এসব মিথ্যাচার—--ছাত্র নাক কুঁচকে তার বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছে, স্যর বড্ড সেকেলে মানুষ। ‘বিজ্ঞানী’রাও বলছে দুনিয়া ধ্বসে যাবে ! স্যর মানেনই না। আজ সেই মৃত্যু ভয় উবে গেছে। যারা সেই ভয় জাগিয়েছিল তারা সব চুপ মেরে গেছে । এখন তারা বিয়ে আর ভ্রমণের বাজার গরম করেছে নতুন হুজুগে। সেই হুজুগ বারোর হুজুগ। এমন দিনটি বুঝি আর আসবেই না। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, শেষ বারোর আগেতো একখানা বিশ( ২০) আছে রে বাবা! বাজার জানিয়ে দেবে আপনার কণ্ঠে বিষ। মানুষের ভালো কিছুই দেখেন না। সত্যিই বিষ! এই বারোতো আর আসবে না। কিন্তু আমাদের বারো? বলছি দাঁড়ান। তাকে ছেয়ে ফেলা হয়েছে, ঢেকে ফেলা হয়েছে...একটুতো পশ্চিমী মেঘের বিষ সরাতেই হবে।
তস্মিন্নদ্রোকতিচিদবলাবিপ্রযুক্ত স কামী
নীত্বামাসাঙ্কবলয়ম্ভশরিরক্ত প্রকোষ্ঠঃ
আষাঢ়স্যপ্রথমদিবসে মেঘমাশিলষ্ট সানু
বপ্রক্রীড়া পরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ম দদর্শ।।
মেঘদূতের একেবারে শুরুর দিকের দ্বিতীয় স্তবক এটি। স্ত্রী বিরহে কামনা তাড়িত যক্ষ ঐ পর্বতে মাস কয় কাটিয়ে দিল। আষাঢ়ের প্রথম দিনেই পাহাড়ের চূড়োতে ঝুকে পড়া মেঘকে ও যখন, দেখল মনে হলো যেন প্রেমোন্মত্ত হাতি শূঁড়ে তার প্রেয়সীর গা ধাক্কা দিচ্ছে।
মোটামোটি অনুবাদটা এমনি। আষাড়-শ্রাবণের কাব্য এটি। স্মরণ করুন এর দুই ভাগের নাম পূর্বমেঘ এবং উত্তর মেঘ। অনেকে তাই বলেন একে ‘বর্ষাকাব্য।’ তার মানে পুরো এক ঋতুর কথা। ঋতুর কথাতে পরিপূর্ণ কালিদাস এবং সংস্কৃতের কাব্য যত। ঋতু কিম্বা প্রকৃতি নইলে যেন অলঙ্করণ পূর্ণ হতো না তখনকার কাব্যকথার। তাই কালিদাসের একটি পুরো কাব্যের নামই হলো ‘ঋতু সংহার’। কোন কাহিনি নেই। আছে বিরহী পুরুষের চোখে নারী আর প্রকৃতির বিচিত্র সব রূপ বর্ণনা আর আছে অবশ্যই বিরহের কথা। এখানে সবটার পরিচয় দেয়া স্বস্তিকর হবে না, আমাদের আধুনিক রুচিবোধে আটকাতে পারে। কিন্তু এখন যখন এই বারোর হুজুগে মেতেছে বিশ্ব তখনকার ঋতু হেমন্ত বলে আমরা হেমন্তের কথা বলতে গিয়ে লেখা প্রথম স্তবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি নির্বিরোধ।
নবপ্রবালোদ্গমসস্যরম্যঃ
প্রফুল্ললোধ্রঃ পরিপক্বশালিঃ
বিলীনপদ্মঃ প্রপতত্তুষারো।
হেমন্তকালঃ সমুপাগতঃ প্রিয়ে।।
হেমন্ত এসেছে প্রিয়ে। নতুন পাতা দিয়েছে দেখা, শষ্যেরা উঠেছে সেজে। লোধফুল ফুটেছে দেখো,শালিধান পেকেছে মাঠে, নিস্প্রভ হয়েছে পদ্ম আর তাতে ঝরছে তুষার।
কিন্তু ঋতুতো ছয়ের হিসেব। আমাদের কাজ বারোকে নিয়ে। চান্দ্রপঞ্জিকাতে বারোমাস থাকলেও সে নিয়ে তত মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না তখনকার কবিদের।মেঘদূতের 'আষাঢ়স্যপ্রথমদিবসে'র মতো নজির বেশি মেলে না তেমন। প্রেম আর প্রকৃতিকে মেলাতে পারলেই কাজ চলে যেতো তখন। তাই মেঘদূতের আগে পরে, দূত কাব্যের এক জনপ্রিয় ধারা ছিল, যেমন পবনদূত, পদাঙ্কদূত, হংসদূত, ভ্রমরদূত, বাতদূত, কোকিলদূত ইত্যাদি নামে একগাদা কাব্য থাকলেও বারোমাস্যা জাতীয় কিছু নেই। হয়তো কবিরা রাজসভার কবি ছিলেন বলেই এক একটা মাস যে সময়ের হিসেবে অনেক সে যন্ত্রণা তাদের পোহাতে হয় নি।
যারা রাজসভার কবি ছিলেন না তারাও মাসটাস নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। হাজার বছর আগে বাংলা যখন ভাষা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে তখন কিছু কিছু বাঙালি কবি অবহট্টে কিছু কবিতা লিখেছিলেন। এই যেমনঃ সো মঝু কন্তা/ দূর দিগন্তা/ পাউস আএ / চেলু দুলায়ে। এর বাংলাটা মোটা মোটি এরকম। প্রিয়তম দূর দেশে/ দিগন্ত পার/ ওড়না ওড়ালো এসে মেঘ বরষার। কিম্বা ধরুনঃ গজ্জই মেহ কি অম্বর সামর/ ফুল্লই ণীপ কি বুল্লই ভামর/ এক্কল জীঅ পরাহিণ অস্মহ/কীলউ পাউস কীলউ বম্মহ।। এর বাংলাটা কাব্য অনুবাদে মোটামোটি এরকমঃ মেঘে ডাকছে কি? আকাশ কি হয়েছে কালো? কদম ফুটেছে কি? ভোমরা কি গাইছে ভালো? পরের অধীন আমার এই একলা জীবন,/ নাচুক বর্ষা, নাচুক নাহয় মত্ত মদন।
ঠিক ওই সময়েই বাংলাতে খনার বচন বেশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। ইনি যে কবেকার মহিলা, কেউ ভালো জানেন না। সিংহলের মেয়ে বলে বলেন অনেকে। অনেকে বলেন চব্বিশ পরগনার বারাসতের দেউলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। ওড়িয়া ঐতিহ্যে খনার নাম লীলাবতী। কেউ কেউ অতি উৎসাহে একে কালিদাসের কালের রাজা বিক্রমাদিত্যে নবরত্নদের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহের ছেলে মিহিরের বৌ ভাবেন। বিপরীত পক্ষ বলেন সেরকম হলে তাঁর উল্লেখ কালিদাসেও থাকত, আর বাংলা ওড়িষার বাইরেও তাঁর পুরনো প্রভাব পাওয়া যেত। তাই খনার বচন আসলে বাংলার কৃষকদের সন্মিলিত এক আবিষ্ক্রিয়ার নাম। সে যাই হোক, খনার জনপ্রিয়তা এখনো বাংলার গ্রামে গঞ্জে এতো প্রবল যে সেকালের ভাষাতে তাঁর বচন পাবার উপায় নেই। তাঁর বচনে একেবারেই অকাব্যিক বৈষয়িক দরকারে বারোমাস মেলে। এই যেমনঃ দাতার নারিকেল, বখিলের বাঁশ/কমে না বাড়ে বারো মাস। কিম্বা ধরুনঃ বারো মাসে বারো ফল/না খেলে যায় রসাতল।মাসগুলোর উল্লেখ বা ইঙ্গিত পাবেনঃ এই যেমনঃ গাছে গাছে আগুন জ্বলে/বৃষ্টি হবে খনায় বলে। কিম্বাঃ চৈত্রেতে খর খর।/বৈশাখেতে ঝড় পাথর।।/জ্যেষ্ঠেতে তার ফুটে।/তবে জানবে বর্ষা বটে। কিম্বাঃ আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো/ধান লাগাও যত পারো। কিম্বাঃ তিন শাওনে পান/এক আশ্বিনে ধান। কিম্বা ধরুনঃ পটল বুনলে ফাগুনে/ফলন বাড়ে দ্বিগুণে। কিম্বাঃ ফাগুনে আগুন, চৈতে মাটি/বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি। ( সৌজন্যঃ somewhereinblog)
আমাদের চাষাভূষাদের আধুনিক মধ্যবিত্তরা মুর্খ ভাবেন। কিন্তু ওমন সুন্দর অলঙ্কার এবং নিখুৎ ছন্দজ্ঞান বহু বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকেও দুর্লভ। এমন নয় যে যারা এই বচনের স্রষ্টা তারা সবাই নিরক্ষর, স্বাক্ষরও ছিলেন অনেকে। কিন্তু এগুলো তৈরি হয়েছে কিন্তু মুখে মুখে। লেখা হয়েছে পরে। মনে হয় না বটতলার পঞ্জিকা চালু হবার আগে।
এরমক প্রায় প্রতিটি মাসের কথা খনাতে পাবেন। এ বোধ করি এর জন্যেও যে তাঁর বচন স্পষ্টতই কৃষক জনতার জন্যে আর তাঁরা বাংলার চর্চা করতেন। যারা সংস্কৃতের চর্চা করতেন তাঁরা কৃষি কাজ করতেন না সরাসরি। এই খনা, প্রাকৃতপৈঙ্গল এবং আমাদের বিখ্যাত চর্যাগীতিকোষ প্রায় একই সময়ের রচনা। এগুলো বা পরবর্তী কালেও কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা পদ্মাবতী কাব্যের মতো কিছু রচনা বাদ দিলে প্রায় কোনটাই রাজসভার কাব্য নয়। এগুলোতে চিত্রিত চরিত্রদের কেউ কেউ রাজপরিবারের বলে বর্ণিত হলেও কৃষিজীবনের সঙ্গে এদের দূরত্ব খুবই কম। এরা নিতান্তই স্থানীয় দেওয়ান যাদের রাজা বলা হতো তেমন কিছু হয়ে থাকবেন। অন্যথা সতীনের ষড়যন্ত্রে খুল্লনা ছাগল চরাতে যাবেন কেন, কিম্বা মৃত স্বামী নিয়ে বেহুলা কলার ভাসানেই ভাসবেন কেন। আর ব্যাধ কালকেতু পরে এতো সহজে গুজরাট নগরের রাজা হবেন কী করে? পূর্ববঙ্গ গীতিকার রাজাতে আর প্রজাতে এই প্রভেদবিহীনতা অনেক বেশি স্পষ্ট। সম্ভবত তাই, ঐ দূতকাব্যের মতো ‘বারোবাস্যা’ বলে বাংলাতে এক কাব্যধারাই গড়ে উঠেছিল। কখনোবা কবিরা এগুলো বড় আখ্যান কাব্যেই জুড়ে দিতেন। তাতেই কবিকঙ্কনের চণ্ডীর ফুল্ল্রার বারোমাস্যা আমাদের খুব পরিচিত। সতীন ভয় দূর করতে ফুল্লরা ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁর বারোমাসের বড় দুঃখের কথা বর্ণনা করছে চণ্ডীর কাছে । হয়েছিল এই, সারা দিনমান ঘুরে শিকার টিকার না পেয়ে কালকেতু ব্যাধ এক সাপকেই পথে পেয়ে ধরে আনে। ফুল্লরাকে ঘরে না পেয়ে সেই সাপকে রেখে বেরিয়ে যায়। হাটে গিয়ে তাকে পেয়ে সেই সাপের কথা জানায়। ফেরার পথে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে খুদ লবন কিছু ধার করে নিয়ে যেতে বলে। সেই সাপ ততক্ষণে ষোড়শি সুন্দরী সেজে বসে আছে। শুধুই কি তাই ! বিশ্বকর্মাকে ডেকে এনে সেই সাজের ষোল কলা পুরো করে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ি ফিরে এই মেয়েকে দেখে ফুল্লরার মাথাতে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। খিদে তৃষ্ণা সব ছুটে পালায়। কে সে মেয়ে, কোত্থেকে এসছে ইত্যা্দি হাজারো প্রশ্ন আর বাড়ি ফিরে যাবার অনুরোধে জেরাবার করে। সে চাপে হার না মেনে মেয়ে বলে কিনা’ মোরে এতো জিজ্ঞাসায় তোর কিবা কাজ।/ থাকিব দু’জনে যদি না বাসহ লাজ।”। তখন ওকে ভয় দেখাতে ফুল্লরা ‘বারোমাস্যার’ ফন্দি ধরেঃ
পাশের বসিয়া রামা কহে দুঃখবানী।
ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি পত্রের ছাওনী।।
ভেরেণ্ডার খাম তার আছে মধ্য ঘরে।
প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।
অনল সমান পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞার বসন।
বৈশাখ হৈল আগো মোরে বড় বিষ।
মাংস নাহী খায় সর্বলোকে নিরামিষ।।
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস প্রচণ্ড তপন।
খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ।।
পসরা এড়িয়া জল খাত্যে যাত্যে নারি।
দেখিতে দেখিতে চিলে লয় আধা সারি।।
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস।
বেঙচের ফল খায়্যা করি উপবাস।
এমনি করে করে ফুল্লরা যখন এসে চৈত্রে পৌঁছোয় শুনে মনে হবে গোটা বছর সে না খেয়েই থাকে। শুধু কি তাই?
সহজে শীতল ঋতু ফাগুন যে মাসে।
পোড়ায়ে রমণিগণ বসন্ত বাতাসে।।
মধুমাসে মলয় মারুত বহে মন্দ।
মালতীর মধুকর দিয়ে মকরন্দ।।
বনিতা-পুরুষ যত পীড়য়ে মদনে।
ফুল্লরার অঙ্গ পুড়ে উদর দহনে।।
দারুণ দৈব দোষে গো দারুণ দৈব দোষে।।
একত্র শয়নে স্বামী যেন ষোল ক্রোশে...
এর পর অন্তত ফুল্লরা আশা করতেই পারত বেহায়া মেয়ে তার বাড়ি ছেড়ে উঠে চলে যাবে। বলে কিনা, “আজি হইতে মোর ধনে আছে তোর অংশ।” বেচারি ফুল্লরা আর করে কী? চোখের জলে কাজল গলিয়ে মুখ কালো করতে করতে হাটে গেল স্বামীকে ধরে একটা বোঝাপড়া করে নিতে। সেই বোঝাপড়ার পরিণাম কী হয়েছিল আপনারা জানেন, কালকেতু রাজা হয়েছিল, আর ফুল্লরা রাণি।
তেমনি একখানা কাব্য আছে ‘দেওয়ানা মদিনা’ । পূর্ববঙ্গগীতিকাতে সংকলিত হয়েছিল। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে এই গীতিকাগুলোই আসলে বাংলা সাহিত্যের প্রধান স্রোত। এগুলোতে ধর্ম কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। দেব মহীমাতে ভাগ্যের ফের পাল্টায় না চরিত্রগুলোর । ভাতৃপ্রেমের টানে আলালের ভাই দুলাল যখন ছেলে সুরুজ সহ স্ত্রী মদিনাকে ফেলে রেখে যায় বৌ একদিন কেঁদে কেঁদে স্মৃতিচারণ করেঃ
লক্ষী না আগন মাস বাওয়ার ধান মারি।
খসম মোর আনে ধান আমি ধান লাড়ি।।
দুইজনে বইসা শেষে ধানে দেই উনা।
টাইল ভইরা রাখি ধান করি বেচাকিনা।।
হায়রে পরানের খসম এমন করিয়া।
কোন পরানে রইলা তুমি আমারে ছাড়িয়া।।
খ্যাতনামা কাব্যগুলো যখন গতানুগতিকতার অনুসরণ করে বৈশাখ মাসে বারোমাস্যার শুরু করত, ‘দেওয়ানা মদীনা’র কবি সেখানে অনেক বেশি বাস্তবোচিত বলে দীনেশ সেন প্রশংসা করেছিলেন। অগ্রহায়ণে নবান্ন। সুতরাং বিরহিনীর সেই দিনগুলোর কথাই আগে মনে পড়েছে।
এখন অঘ্রান মাস। বাংলা সন মাসের কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। অথচ যদি তা না করতাম তবে বর্ষোৎযাপন করতে গিয়ে আমাদের নিজের গোলাভরা এই ‘বারোমাস্যা’ গীতের সোনার ধান তথা পরম্পরার থেকে মণিরত্ন তুলে আনবার কথা আমাদের মনে থাকত।বারো বারো বারোর ( ১২-১২-১২) বাজারের তৈরি হুজুগে মাততাম না আমরা। সেগুলোকে ভুলে থাকা সত্যি আমাদের কঠিন হতো। হয়তো, আমরা নিজেরাই সেগুলোর একালের সংস্করণে মন দিতাম। শুধু কি বাংলাতে? অভিভক্ত বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষাগুষ্ঠী যেমন চাকমা, হাজং, ত্রিপুরি, রাজবংশীদের মধ্যেও এই পরম্পরা সমানে জনপ্রিয় ছিল। খুঁজতে গেলে হয়তো দেখা যাবে ওই সব কোন জনগোষ্ঠী থেকেই এই বারোমাস্যার এই রীতি বাংলাগানে সাহিত্যে এসে ঢুকেছিল। এই যেমন একটি হাজং গানঃ
সাধুরে, পৌষ মাসনি সাধুরে ময় পুজি অধিকারী।
ভাতার ভুকতি করে যারা ভাগ্যবতী নারী।।
ভাতার ধন, ভাতার মন, ভাতার সকল সার।
ভাতার বিনে নাইরে গতি এ ভব সংসার।।
সাধুরে সিয়ুমাস ফলে সাধুরে মোলা ইয়ুমাস ফলে।
কান্দে গাবুর কইন্যা হাত দে কপালে।।
সাধুরে- পৌষ মাসেগো সাধু পুজি অধিকারী।
পতিভক্তি করে যারা ভাগ্যবতী নারী।।
পতিধন, পতিধন, পতি সকল সার ।
পতি বিনে নাইরে গতি এ ভব সংসারে।। (সৌজন্যঃ shapludu)
শুনে কি মনে হয় যে এ কোনো একক বিরহিণী সতীর কান্না! মনেকি হয় না, কোনো এক দূর অতীতের দিকে ক্রমেই পশ্চাদধাবমান আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি , তার হয়তো নাম ‘বাংলা’, আমাদেরই মতো বিশ্বাসঘাতক উত্তরপুরুষদের ডেকে ডেকে আকুতি করছে, ফিরে দাঁড়াতে। রবীন্দ্রগীতে যেমন ছিল ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয় ।/ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়…কোন সে নাটকে জুড়েছিলেন গানটা মনে করুন। রক্তকরবী। আর আমরা শুনেও না শোনার ভান করে কোন এক হঠাৎ নবাব আলালের জালের জড়াচ্ছি এর নাম দিয়েছি ‘প্রগতি’ , নাম দিয়েছি ‘আধুনিকতাবাদ’।
তস্মিন্নদ্রোকতিচিদবলাবিপ্রযুক্ত স কামী
নীত্বামাসাঙ্কবলয়ম্ভশরিরক্ত প্রকোষ্ঠঃ
আষাঢ়স্যপ্রথমদিবসে মেঘমাশিলষ্ট সানু
বপ্রক্রীড়া পরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ম দদর্শ।।
মেঘদূতের একেবারে শুরুর দিকের দ্বিতীয় স্তবক এটি। স্ত্রী বিরহে কামনা তাড়িত যক্ষ ঐ পর্বতে মাস কয় কাটিয়ে দিল। আষাঢ়ের প্রথম দিনেই পাহাড়ের চূড়োতে ঝুকে পড়া মেঘকে ও যখন, দেখল মনে হলো যেন প্রেমোন্মত্ত হাতি শূঁড়ে তার প্রেয়সীর গা ধাক্কা দিচ্ছে।
মোটামোটি অনুবাদটা এমনি। আষাড়-শ্রাবণের কাব্য এটি। স্মরণ করুন এর দুই ভাগের নাম পূর্বমেঘ এবং উত্তর মেঘ। অনেকে তাই বলেন একে ‘বর্ষাকাব্য।’ তার মানে পুরো এক ঋতুর কথা। ঋতুর কথাতে পরিপূর্ণ কালিদাস এবং সংস্কৃতের কাব্য যত। ঋতু কিম্বা প্রকৃতি নইলে যেন অলঙ্করণ পূর্ণ হতো না তখনকার কাব্যকথার। তাই কালিদাসের একটি পুরো কাব্যের নামই হলো ‘ঋতু সংহার’। কোন কাহিনি নেই। আছে বিরহী পুরুষের চোখে নারী আর প্রকৃতির বিচিত্র সব রূপ বর্ণনা আর আছে অবশ্যই বিরহের কথা। এখানে সবটার পরিচয় দেয়া স্বস্তিকর হবে না, আমাদের আধুনিক রুচিবোধে আটকাতে পারে। কিন্তু এখন যখন এই বারোর হুজুগে মেতেছে বিশ্ব তখনকার ঋতু হেমন্ত বলে আমরা হেমন্তের কথা বলতে গিয়ে লেখা প্রথম স্তবকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি নির্বিরোধ।
নবপ্রবালোদ্গমসস্যরম্যঃ
প্রফুল্ললোধ্রঃ পরিপক্বশালিঃ
বিলীনপদ্মঃ প্রপতত্তুষারো।
হেমন্তকালঃ সমুপাগতঃ প্রিয়ে।।
হেমন্ত এসেছে প্রিয়ে। নতুন পাতা দিয়েছে দেখা, শষ্যেরা উঠেছে সেজে। লোধফুল ফুটেছে দেখো,শালিধান পেকেছে মাঠে, নিস্প্রভ হয়েছে পদ্ম আর তাতে ঝরছে তুষার।
কিন্তু ঋতুতো ছয়ের হিসেব। আমাদের কাজ বারোকে নিয়ে। চান্দ্রপঞ্জিকাতে বারোমাস থাকলেও সে নিয়ে তত মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না তখনকার কবিদের।মেঘদূতের 'আষাঢ়স্যপ্রথমদিবসে'র মতো নজির বেশি মেলে না তেমন। প্রেম আর প্রকৃতিকে মেলাতে পারলেই কাজ চলে যেতো তখন। তাই মেঘদূতের আগে পরে, দূত কাব্যের এক জনপ্রিয় ধারা ছিল, যেমন পবনদূত, পদাঙ্কদূত, হংসদূত, ভ্রমরদূত, বাতদূত, কোকিলদূত ইত্যাদি নামে একগাদা কাব্য থাকলেও বারোমাস্যা জাতীয় কিছু নেই। হয়তো কবিরা রাজসভার কবি ছিলেন বলেই এক একটা মাস যে সময়ের হিসেবে অনেক সে যন্ত্রণা তাদের পোহাতে হয় নি।
যারা রাজসভার কবি ছিলেন না তারাও মাসটাস নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। হাজার বছর আগে বাংলা যখন ভাষা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে তখন কিছু কিছু বাঙালি কবি অবহট্টে কিছু কবিতা লিখেছিলেন। এই যেমনঃ সো মঝু কন্তা/ দূর দিগন্তা/ পাউস আএ / চেলু দুলায়ে। এর বাংলাটা মোটা মোটি এরকম। প্রিয়তম দূর দেশে/ দিগন্ত পার/ ওড়না ওড়ালো এসে মেঘ বরষার। কিম্বা ধরুনঃ গজ্জই মেহ কি অম্বর সামর/ ফুল্লই ণীপ কি বুল্লই ভামর/ এক্কল জীঅ পরাহিণ অস্মহ/কীলউ পাউস কীলউ বম্মহ।। এর বাংলাটা কাব্য অনুবাদে মোটামোটি এরকমঃ মেঘে ডাকছে কি? আকাশ কি হয়েছে কালো? কদম ফুটেছে কি? ভোমরা কি গাইছে ভালো? পরের অধীন আমার এই একলা জীবন,/ নাচুক বর্ষা, নাচুক নাহয় মত্ত মদন।
ঠিক ওই সময়েই বাংলাতে খনার বচন বেশ জনপ্রিয় হচ্ছিল। ইনি যে কবেকার মহিলা, কেউ ভালো জানেন না। সিংহলের মেয়ে বলে বলেন অনেকে। অনেকে বলেন চব্বিশ পরগনার বারাসতের দেউলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। ওড়িয়া ঐতিহ্যে খনার নাম লীলাবতী। কেউ কেউ অতি উৎসাহে একে কালিদাসের কালের রাজা বিক্রমাদিত্যে নবরত্নদের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহের ছেলে মিহিরের বৌ ভাবেন। বিপরীত পক্ষ বলেন সেরকম হলে তাঁর উল্লেখ কালিদাসেও থাকত, আর বাংলা ওড়িষার বাইরেও তাঁর পুরনো প্রভাব পাওয়া যেত। তাই খনার বচন আসলে বাংলার কৃষকদের সন্মিলিত এক আবিষ্ক্রিয়ার নাম। সে যাই হোক, খনার জনপ্রিয়তা এখনো বাংলার গ্রামে গঞ্জে এতো প্রবল যে সেকালের ভাষাতে তাঁর বচন পাবার উপায় নেই। তাঁর বচনে একেবারেই অকাব্যিক বৈষয়িক দরকারে বারোমাস মেলে। এই যেমনঃ দাতার নারিকেল, বখিলের বাঁশ/কমে না বাড়ে বারো মাস। কিম্বা ধরুনঃ বারো মাসে বারো ফল/না খেলে যায় রসাতল।মাসগুলোর উল্লেখ বা ইঙ্গিত পাবেনঃ এই যেমনঃ গাছে গাছে আগুন জ্বলে/বৃষ্টি হবে খনায় বলে। কিম্বাঃ চৈত্রেতে খর খর।/বৈশাখেতে ঝড় পাথর।।/জ্যেষ্ঠেতে তার ফুটে।/তবে জানবে বর্ষা বটে। কিম্বাঃ আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো/ধান লাগাও যত পারো। কিম্বাঃ তিন শাওনে পান/এক আশ্বিনে ধান। কিম্বা ধরুনঃ পটল বুনলে ফাগুনে/ফলন বাড়ে দ্বিগুণে। কিম্বাঃ ফাগুনে আগুন, চৈতে মাটি/বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি। ( সৌজন্যঃ somewhereinblog)
আমাদের চাষাভূষাদের আধুনিক মধ্যবিত্তরা মুর্খ ভাবেন। কিন্তু ওমন সুন্দর অলঙ্কার এবং নিখুৎ ছন্দজ্ঞান বহু বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকেও দুর্লভ। এমন নয় যে যারা এই বচনের স্রষ্টা তারা সবাই নিরক্ষর, স্বাক্ষরও ছিলেন অনেকে। কিন্তু এগুলো তৈরি হয়েছে কিন্তু মুখে মুখে। লেখা হয়েছে পরে। মনে হয় না বটতলার পঞ্জিকা চালু হবার আগে।
এরমক প্রায় প্রতিটি মাসের কথা খনাতে পাবেন। এ বোধ করি এর জন্যেও যে তাঁর বচন স্পষ্টতই কৃষক জনতার জন্যে আর তাঁরা বাংলার চর্চা করতেন। যারা সংস্কৃতের চর্চা করতেন তাঁরা কৃষি কাজ করতেন না সরাসরি। এই খনা, প্রাকৃতপৈঙ্গল এবং আমাদের বিখ্যাত চর্যাগীতিকোষ প্রায় একই সময়ের রচনা। এগুলো বা পরবর্তী কালেও কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা পদ্মাবতী কাব্যের মতো কিছু রচনা বাদ দিলে প্রায় কোনটাই রাজসভার কাব্য নয়। এগুলোতে চিত্রিত চরিত্রদের কেউ কেউ রাজপরিবারের বলে বর্ণিত হলেও কৃষিজীবনের সঙ্গে এদের দূরত্ব খুবই কম। এরা নিতান্তই স্থানীয় দেওয়ান যাদের রাজা বলা হতো তেমন কিছু হয়ে থাকবেন। অন্যথা সতীনের ষড়যন্ত্রে খুল্লনা ছাগল চরাতে যাবেন কেন, কিম্বা মৃত স্বামী নিয়ে বেহুলা কলার ভাসানেই ভাসবেন কেন। আর ব্যাধ কালকেতু পরে এতো সহজে গুজরাট নগরের রাজা হবেন কী করে? পূর্ববঙ্গ গীতিকার রাজাতে আর প্রজাতে এই প্রভেদবিহীনতা অনেক বেশি স্পষ্ট। সম্ভবত তাই, ঐ দূতকাব্যের মতো ‘বারোবাস্যা’ বলে বাংলাতে এক কাব্যধারাই গড়ে উঠেছিল। কখনোবা কবিরা এগুলো বড় আখ্যান কাব্যেই জুড়ে দিতেন। তাতেই কবিকঙ্কনের চণ্ডীর ফুল্ল্রার বারোমাস্যা আমাদের খুব পরিচিত। সতীন ভয় দূর করতে ফুল্লরা ইনিয়ে বিনিয়ে তাঁর বারোমাসের বড় দুঃখের কথা বর্ণনা করছে চণ্ডীর কাছে । হয়েছিল এই, সারা দিনমান ঘুরে শিকার টিকার না পেয়ে কালকেতু ব্যাধ এক সাপকেই পথে পেয়ে ধরে আনে। ফুল্লরাকে ঘরে না পেয়ে সেই সাপকে রেখে বেরিয়ে যায়। হাটে গিয়ে তাকে পেয়ে সেই সাপের কথা জানায়। ফেরার পথে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে খুদ লবন কিছু ধার করে নিয়ে যেতে বলে। সেই সাপ ততক্ষণে ষোড়শি সুন্দরী সেজে বসে আছে। শুধুই কি তাই ! বিশ্বকর্মাকে ডেকে এনে সেই সাজের ষোল কলা পুরো করে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ি ফিরে এই মেয়েকে দেখে ফুল্লরার মাথাতে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। খিদে তৃষ্ণা সব ছুটে পালায়। কে সে মেয়ে, কোত্থেকে এসছে ইত্যা্দি হাজারো প্রশ্ন আর বাড়ি ফিরে যাবার অনুরোধে জেরাবার করে। সে চাপে হার না মেনে মেয়ে বলে কিনা’ মোরে এতো জিজ্ঞাসায় তোর কিবা কাজ।/ থাকিব দু’জনে যদি না বাসহ লাজ।”। তখন ওকে ভয় দেখাতে ফুল্লরা ‘বারোমাস্যার’ ফন্দি ধরেঃ
পাশের বসিয়া রামা কহে দুঃখবানী।
ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি পত্রের ছাওনী।।
ভেরেণ্ডার খাম তার আছে মধ্য ঘরে।
প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।
অনল সমান পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞার বসন।
বৈশাখ হৈল আগো মোরে বড় বিষ।
মাংস নাহী খায় সর্বলোকে নিরামিষ।।
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস প্রচণ্ড তপন।
খরতর পোড়ে অঙ্গ রবির কিরণ।।
পসরা এড়িয়া জল খাত্যে যাত্যে নারি।
দেখিতে দেখিতে চিলে লয় আধা সারি।।
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস।
বেঙচের ফল খায়্যা করি উপবাস।
এমনি করে করে ফুল্লরা যখন এসে চৈত্রে পৌঁছোয় শুনে মনে হবে গোটা বছর সে না খেয়েই থাকে। শুধু কি তাই?
সহজে শীতল ঋতু ফাগুন যে মাসে।
পোড়ায়ে রমণিগণ বসন্ত বাতাসে।।
মধুমাসে মলয় মারুত বহে মন্দ।
মালতীর মধুকর দিয়ে মকরন্দ।।
বনিতা-পুরুষ যত পীড়য়ে মদনে।
ফুল্লরার অঙ্গ পুড়ে উদর দহনে।।
দারুণ দৈব দোষে গো দারুণ দৈব দোষে।।
একত্র শয়নে স্বামী যেন ষোল ক্রোশে...
এর পর অন্তত ফুল্লরা আশা করতেই পারত বেহায়া মেয়ে তার বাড়ি ছেড়ে উঠে চলে যাবে। বলে কিনা, “আজি হইতে মোর ধনে আছে তোর অংশ।” বেচারি ফুল্লরা আর করে কী? চোখের জলে কাজল গলিয়ে মুখ কালো করতে করতে হাটে গেল স্বামীকে ধরে একটা বোঝাপড়া করে নিতে। সেই বোঝাপড়ার পরিণাম কী হয়েছিল আপনারা জানেন, কালকেতু রাজা হয়েছিল, আর ফুল্লরা রাণি।
তেমনি একখানা কাব্য আছে ‘দেওয়ানা মদিনা’ । পূর্ববঙ্গগীতিকাতে সংকলিত হয়েছিল। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে এই গীতিকাগুলোই আসলে বাংলা সাহিত্যের প্রধান স্রোত। এগুলোতে ধর্ম কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। দেব মহীমাতে ভাগ্যের ফের পাল্টায় না চরিত্রগুলোর । ভাতৃপ্রেমের টানে আলালের ভাই দুলাল যখন ছেলে সুরুজ সহ স্ত্রী মদিনাকে ফেলে রেখে যায় বৌ একদিন কেঁদে কেঁদে স্মৃতিচারণ করেঃ
লক্ষী না আগন মাস বাওয়ার ধান মারি।
খসম মোর আনে ধান আমি ধান লাড়ি।।
দুইজনে বইসা শেষে ধানে দেই উনা।
টাইল ভইরা রাখি ধান করি বেচাকিনা।।
হায়রে পরানের খসম এমন করিয়া।
কোন পরানে রইলা তুমি আমারে ছাড়িয়া।।
খ্যাতনামা কাব্যগুলো যখন গতানুগতিকতার অনুসরণ করে বৈশাখ মাসে বারোমাস্যার শুরু করত, ‘দেওয়ানা মদীনা’র কবি সেখানে অনেক বেশি বাস্তবোচিত বলে দীনেশ সেন প্রশংসা করেছিলেন। অগ্রহায়ণে নবান্ন। সুতরাং বিরহিনীর সেই দিনগুলোর কথাই আগে মনে পড়েছে।
এখন অঘ্রান মাস। বাংলা সন মাসের কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। অথচ যদি তা না করতাম তবে বর্ষোৎযাপন করতে গিয়ে আমাদের নিজের গোলাভরা এই ‘বারোমাস্যা’ গীতের সোনার ধান তথা পরম্পরার থেকে মণিরত্ন তুলে আনবার কথা আমাদের মনে থাকত।বারো বারো বারোর ( ১২-১২-১২) বাজারের তৈরি হুজুগে মাততাম না আমরা। সেগুলোকে ভুলে থাকা সত্যি আমাদের কঠিন হতো। হয়তো, আমরা নিজেরাই সেগুলোর একালের সংস্করণে মন দিতাম। শুধু কি বাংলাতে? অভিভক্ত বাংলাদেশের অন্যান্য ভাষাগুষ্ঠী যেমন চাকমা, হাজং, ত্রিপুরি, রাজবংশীদের মধ্যেও এই পরম্পরা সমানে জনপ্রিয় ছিল। খুঁজতে গেলে হয়তো দেখা যাবে ওই সব কোন জনগোষ্ঠী থেকেই এই বারোমাস্যার এই রীতি বাংলাগানে সাহিত্যে এসে ঢুকেছিল। এই যেমন একটি হাজং গানঃ
সাধুরে, পৌষ মাসনি সাধুরে ময় পুজি অধিকারী।
ভাতার ভুকতি করে যারা ভাগ্যবতী নারী।।
ভাতার ধন, ভাতার মন, ভাতার সকল সার।
ভাতার বিনে নাইরে গতি এ ভব সংসার।।
সাধুরে সিয়ুমাস ফলে সাধুরে মোলা ইয়ুমাস ফলে।
কান্দে গাবুর কইন্যা হাত দে কপালে।।
সাধুরে- পৌষ মাসেগো সাধু পুজি অধিকারী।
পতিভক্তি করে যারা ভাগ্যবতী নারী।।
পতিধন, পতিধন, পতি সকল সার ।
পতি বিনে নাইরে গতি এ ভব সংসারে।। (সৌজন্যঃ shapludu)
শুনে কি মনে হয় যে এ কোনো একক বিরহিণী সতীর কান্না! মনেকি হয় না, কোনো এক দূর অতীতের দিকে ক্রমেই পশ্চাদধাবমান আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি , তার হয়তো নাম ‘বাংলা’, আমাদেরই মতো বিশ্বাসঘাতক উত্তরপুরুষদের ডেকে ডেকে আকুতি করছে, ফিরে দাঁড়াতে। রবীন্দ্রগীতে যেমন ছিল ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আ য় আ য় আয় ।/ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়…কোন সে নাটকে জুড়েছিলেন গানটা মনে করুন। রক্তকরবী। আর আমরা শুনেও না শোনার ভান করে কোন এক হঠাৎ নবাব আলালের জালের জড়াচ্ছি এর নাম দিয়েছি ‘প্রগতি’ , নাম দিয়েছি ‘আধুনিকতাবাদ’।
2 comments:
লেখাটা অসাধারণ লাগলো স্যার। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বারোবারোবারো এর হুজুগের মধ্যে খনার বচন আর কালকেতু-ফুল্লরার কড়চা পুরোপুরি অন্য স্বাদ এনে দিলো। এমন লেখা আরও আরও চাই।
ধন্যবাদ শুভজিৎ, অন্তত হুজুগের উলটো স্রোতে কাউকে তো সঙ্গী পাওয়া গেল।
Post a Comment