আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Tuesday, 22 January 2013

সুভাষ চন্দ্রঃ মৃত্যু নিয়ে এক ধ্রুপদি শিল্পের স্রষ্টা

( লেখাটি বেরিয়েছিল আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে গোপাল বসু সম্পাদিত তিনসুকিয়ার ছোট কাগজ 'দৃষ্টি'র সুভাষ জন্মদিনে বিশেষ ক্রোড়পত্র হিসেবে। আজো লেখাটি সমান প্রাসঙ্গিক ভেবে এখানে তুলে দিলাম। মূল লেখাটিও ছবিতে রইল। বানান এবং ছাপার ভুল ছাড়া আর কিছুই পালটানো হয় নি)

[লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হলো ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৮, গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত  'সুভাষ স্মরণ' স্মরণিকাতে।]      
      কটা লোকের  জন্মের মধ্যে তার নিজের কি কৃতিত্ব থাকে? কবে, কোথায়, কোন ঘরে জন্ম নেবে সে ঠিক করে? এখানে তার নিজেরও স্বাধীনতা কই? সে তো ঠিক করে জীবনটাকে। নির্মাণ করে তার মৃত্যুটাকে। আর যাঁরা অসাধারণ , যাঁদের মহান বলতে পারলে আমাদের আত্মা তৃপ্তবোধ করে তাঁরা রীতিমত সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে তাঁর মৃত্যুটাকে। যে মৃত্যুর নামে সাধারণের আত্মা আঁৎকে উঠে, অসাধারণেরা তারই নামে গেয়ে উঠেন, “মরণরে তুহুঁ মম শ্যাম সমান।” আর সে শ্যামের জন্যেঃ
“মন্দির বাহির কঠিন কপাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।” তুচ্ছ করে করে এসে যাঁরা অভিসার করেন স্বাধীনতার তাঁরাইতো মূর্ত প্রতীক।
              সুভাষ চন্দ্র বসু এমনই এক মৃত্যু সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর নিজের জন্যে। ভারত মায়ানমার সীমান্ত যুদ্ধে বৃটিশের গোলাবারুদের ঘায়ে তাঁর মৃত্যু হতে পারত। হলো তাইহোকু বিমান বন্দর ছাড়ার মুহূর্তখানিক পরে, দুর্ঘটনায়। তাতেই বা কি? কি সুন্দর সে মৃত্যু! দুশো বছরের পরাধীনতাকে উপড়ে ফেলে দেশ আর দেশের মানুষকে মুক্ত করতে গিয়েইতো? প্রথমে জাতীয় কংগ্রেস ও পরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বোচ্চ সংগঠক হবার যোগ্যতা অর্জন করতে করতে জীবনটাকে গড়েছিলেন বলেই তো?
             এমন সুন্দর মৃত্যু কবে কোন সাধু সৃষ্টি করেছিল? অথচ আমরা একে স্বীকারই করলাম না। আমরা বিশ্বাস করি সুভাষ বসুর মত এত সুন্দর মানুষটা এতো সুন্দর মৃত্যু বরণ করতেই পারেন না! শৌলমারি না কোথাকার সাধুর ভেক ধরে কাপুরুষের মতো পালিয়ে বেড়াতে পারেন।          

         সুভাষচন্দ্রের দুর্ভাগ্য এই তিনি সফল হলেন না তাঁর লক্ষ্যে। তাই আমাদের কাপুরুষ, ভয় –বিহ্বল, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন পাল্টালো না। সে রইল কুৎসিত আগের মতো। সে আমদের কৌৎসিত্য যে আমরা সুভাষের জীবন ও মৃত্যুর সৌন্দর্য বুঝলাম না। সেনানায়ক সুভাষ নয় সাধু সুভাষের কল্পনা আমাদের বেশি প্রিয়। কেন ফকির বা পাদ্রীও নয় কেন? তাঁকে হিন্দুর একার সম্পদ বলে ভাবি বলে তো? তাঁকে শরীরে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে তিলে তিলে চেতনায় তাঁকে মেরে ফেলার সাধনায় আমাদের ক্লান্তি নেই!
          চে গুয়েভারা ছিলেন আর্জেন্টিনার লোক, কিউবার বিপ্লবে সফল নেতৃত্ব দিয়ে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। পরে বলিভিয়া গেলেন যেখান থেকে মার্কিনী ভাড়াটে শাসকদের তাড়াতে বলিভিয়ার জঙ্গলেই প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় সংঘর্ষেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু নিয়েও কম রহস্যের জলঘোলা হয় নি। অথচ তাঁর অনুগামীরা সে মৃত্যুকে বিশ্বাস করেছে। তাতে লাভ হয়েছে এই যে শুধু বলিভিয়াতে নয়, শুধু কিউবা বা আর্জেন্টিনাতে নয়, সারা লাতিন আমেরিকাতে হাজারো তরুণ সেই তখন থেকে প্রতিদিন স্বপ্ন দেখছে সাধনা করছে সৃষ্টি করবে মৃত্যু—চে গুয়েভারার মতো। যেমন কোন বাঙালি তরুণ বা তরুণী প্রথম কবিতা লেখে রবীন্দ্রনাথের মতোঃ কিম্বা নজরুলের মতো। এও তেমনি।
        চে’কে নিয়েও ভক্তির বাড়াবাড়ি আছে। চে’র ছবি বা মূর্তি ঘরে রাখা, তাঁর জন্ম মৃত্যুদিন পালনতো তুচ্ছ। চে’র মতো চুল দাড়ি রাখা, পোষাক পরা, পোষাকে চে’র ছবি এঁকে তৃপ্তি হয় না—শরীরে খোদাই করে টাট্টু করা। সুভাষ বসুর লেখা কেউ পড়ে না, পড়ে ‘ শৌলমারির সাধু কি নেতাজী ছিলেন?’ জাতীয় পয়সা রোজগারের ধান্দায় লেখা পাতি বই। চে’র রচনা সবাই হজম করে; মুখে মুখে ফেরে তাঁর কবিতা। এসবে প্রশংসনীয় তেমন কিছু নেই। কিন্তু এ হচ্ছে চে’কে প্রচার করার নমুনা।
      
  চে যে তাঁর ধ্রুপদি শিল্প কর্ম—তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে কি দারুণ ভাবে বেঁচে আছেন সে আঁচ করা যায় যখন দেখি সারা লাতিন আমেরিকাতে মার্কিনী নেতৃত্বাধীন বিশ্বায়ন বিরোধিতাটা ফুটবলের মতো, লোকের জাতীয় ধর্ম হয়ে গেছে। আর পেলে-মারাদোনার মতো সে ধর্মের দেবতা চে গুয়েভারা। স্বাধীনতার যে কোন সংগ্রাম, যে কোন মিছিলে  ছবির চেহারাতেও চে থাকেন সবার আগে, সবার সামনে। সারা বিশ্ব কান পেতে শোনে চে’র হৃদস্পন্দন।
         এবার কল্পনা করুন সুভাষ থাকেন কই? এ হীনতা আমাদের। সুভাষ বসুর নয়। স্বাধীন ভারতের কোন সংগ্রামের ময়দানে, লড়াইর ময়দানে—বিশ্বায়ন বিরোধী লড়াই নয় বাদই দিলাম—সুভাষ বসুর নাম নিতে কখনো কাউকে দেখব? অনশনে বসলে গান্দির ছবি মালা দিয়ে সাজিয়ে রাখার সংস্কৃতি অসমেও আছে। মৃত্যুর শিল্পীদের সম্মান জানাবার এর চেয়ে বেশি যোগ্যতা আমরা অর্জন করিনি। আমরা তেইশ জানুয়ারি করি। ওখানে একটু গানবাজনা করি আর খেলাধুলা করি। ক্যারাম খেলি। সুভাষ বসু ক্যারাম খেলার প্রতীক!!?
         সুভাষ বসু কি ছিলেন তা যার গরজ আছে তিনি নিজের অধ্যয়ন অনুশীলনে আবিষ্কার করেন। আর এ নিয়ে লেখাটা খউব জরুরি নয়।
          এখন সময় বোধহয় আত্মসমালোচনা করার । আমাদের চেতনার গভীরে বৃটিশ-মার্কিনীদের সেবাদাসদের বিরুদ্ধে লড়াই করার। মনে রাখতে হবে, শুধু কমিউনিষ্টরা তাঁকে ‘কুইসলিঙ্ক’ বলেছিল বলে, আমরা আসলে নিজেদের অপরাধ আড়ালই করি। বরং ঐ জনযুদ্ধের বছর কয় বাদ দিলে কমিউনিষ্টরা সুভাষ বসুর সহযোগীই ছিল। জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরে সুভাষও বামপন্থী বলেই পরিচিত ছিলেন। চীন দেশের ডাঃ সান ইয়েৎ সেন-এর মতো রুশ বিপ্লবের প্রতি সুভাষচন্দ্রের ছিল অপার শ্রদ্ধা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে কেন যাঁরা সুভাষকে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকতে দিলেন না তাঁরা কমিউনিষ্ট ছিলেন না। ভুললে চলবে কেন কংগ্রেস ছেড়ে ফরোয়ার্ড ব্লক গড়লে আমাদের অকমিউনিষ্ট পূর্বসূরীরা দলে দলে অনুগামী হন নি। এবং যখন তিনি মায়ানমার সীমান্তে যুদ্ধ করেছিলেন তখন তাঁর আশামত তাঁর সমর্থনে দেশে গণ-অভ্যুত্থান আমরা গরে তুলিনি। যা হবার হয়েছিল বিমান দুর্ঘটনার পর বন্দি মুক্তির আন্দোলনে। ঐ দুর্ঘটনার পরই হয় আমাদের ঘুম ভেঙ্গেছে কিম্বা ভোল পাল্টেছে। আমরা সুভাষদ্রোহী থেকে ভক্ত হয়েছি। তাও কোন সুভাষের? সেনানায়ক নয় রহস্যবাদী সাধু সুভাষের।
      
      বৃটিশের অর্ধ সমাপ্ত কাজের ভার আমরা নিয়েছি ভক্তের বেশে। আমরা তাঁকে ক্যারাম খেলার প্রতীক করে তুলেছি। করে তুলেছি বাঙালিয়ানার প্রতীক। লক্ষ্য করুন চে কিন্তু সারা লাতিন আমেরিকার সম্পদ। আমরা ২৩ জানুয়ারি বলে তাঁর নামে আরো এক তিথি বের করেছি, বুদ্ধ পূর্ণিমা বা কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর মতো। অবতারদের যেমন তাঁদের জন্মের উপরও একটা কর্তৃত্ব থাকে, সুভাষ বসুরও ছিল বলে আমরা কল্পনা করে নিয়েছি। অবতারেরাও পরলোকে গেলে মরদেহ ধরে রাখিনি আমরা। সুভাষ বসুকে পরলোকে যেতে দিতে তৈরিই নই। মনে করি তিনি কোথাও  কারারুদ্ধ আছেন আর পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিন লাদেনকে ধরার চাইতেও ঐকমত্য আছে সুভাষ বসুকে কারাগারে রাখার পক্ষে। তাই কোথায় কি ভাবে আছেন তা নিয়ে কেউ টু শব্দটি করে না। লাদেন সাদ্দামের চেয়েও ওদের ভয় বেশি সুভাষকে?!
   
লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হলো ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৮,
গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত  'সুভাষ স্মরণ' স্মরণিকাতে।
         আমরা মনে করি সুভাষ কোথাও লুকিয়ে আছেন সাধুর বেশে। সময় হলে বেরিয়ে আসবেন। তা লুকিয়ে তো বিন লাদেনো আছেন। এ সত্বেও তাঁকে নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিনদের কী ভয়। তা সুভাষ বসুর কোনো গোপন সক্রিয়তাও দেখিনা, না দেখি তাঁকে নিয়ে কারো কোনো ভয়!
            সুভাষ কারাগারে আছেন অথচ জেল ভাঙার পরিকল্পনা করছেন না? আজকের হাইটেক যুগের কোনো সুযোগ নিতে পারছেন না? জেলের ভেতরে একটাও বিশ্বস্ত লোক তৈরি করতে পারছেন না, যে বাইরে খবর পাঠাবে? বাইরে তাঁর একজনও অনুচর নেই, যে নিশ্চিত খবর দিতে পয়ারে সুভাষ আছেন কোথায়? অথচ আজকের মানুষ সন্ধান করছে পৃথিবীতুল্য দ্বিতীয় গ্রহটি আছে মহাবিশ্বের কোন ছায়াপথে, কতদূরে?
            সুভাষ সাধু হয়ে আছেন! যতদূর জানি স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনায় দারুণ ভাবে প্রভাবিত ছিলেন তিনি। সুভাষের এ দীর্ঘ আত্মগোপন বিবেকানন্দের দর্শনের কোন ব্যাখ্যায় সমর্থন মিলবে? অথবা বিবেকানন্দের দর্শনে সেই দুর্ঘটনার পর আস্থা হারালেন তিনি? কার দর্শন, কোন দর্শন সমর্থন করবে এ দীর্ঘ আত্মগোপন?
         
সুভাষ এখন শুধু একটি রাস্তার নাম এবং হিন্দু বাঙালি এবং অসমিয়ার কাজিয়ার নাম
 সমর্থন করে শুধু ভীরুতার দর্শন আমাদের যে ভিরুতা ভয় পায় এমন কি রাজনীতির ‘র’ উচ্চারণে। ভালোবাসে শুধু গাইতে আর খেলতে? সে সুভাষের মতো বীর পূজাতে আত্মগ্লানি মুক্ত হবার প্রয়াস করে আর দীর্ঘজীবি কাপুরুষ কিম্বা সাধু বানিয়ে সুভাষকেও নামিয়ে আনে নিজের সারিতে। এভাবে সে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে সুভাষের শিল্পকে ধ্বংস করে। মারে সুভাষকে।
            
 চিতাভস্মকে পেছনে ফেলে নেতাজি কন্যা
            বাইরে ২৩ জানুয়ারি জন্মদিন বটে- কিন্তু এদিনেই তাঁকে আটকে মেরে ফেলবার দিনও বটে। কোনোদিন যদি কেউ তাঁর সত্যিকারের মৃত্যুদিন পালনে সাহসী হয় বোধকরি সেদিনই সে মৃত্যুর ঔজ্জ্বল্য আমাদের পথা দেখাবে। নতুবা আমাদের মনও শত্রুর কাছে বন্ধক রেখে দিতে, কিম্বা সাধু হয়ে পালিয়ে বেড়াতে আমাদেরই বা বাধা কিসে? তাইতো করছেন আমাদের কল্পনার icon. সুতরাং সুভাষ হবেন না চে গুয়েভারা। মার্কিনিরা বা বৃটিশেরাও তাঁকে ভয় পাবে না—তারা করে করে খাবে। প্রেত নৃত্য নাচবে আমাদের বুকের উপর। সেই নৃত্যেই আমরা হব আহ্লাদে আটখানা। জর্জ বুশ আর টনি ব্লেয়ারদের আমরা আজকাল এতো ভালোবাসি সে এমনি এমনি? অথচ চে’র দেহ আর্জেন্টিনায় আমেরিকানরা কী মারই না আজ খাচ্ছে। চাভেজ-এর ভেনেজুয়েলা, লুলার ব্রাজিল মার্কিনীদের ঘাড় ধরে বাইরের দরজা দেখাচ্ছে। এইতো চে। আমাদের সুভাষ ঠিক এভাবেই আমার বেঁচে উঠবেন তো? চাভেজ কিম্বা লুলার চেহারা নিয়ে এই দেশে এই ভারতে আমাদেরই কেউ মাথা তুলে দাঁড়াবে তো? কেউ দাঁড়ালেই আমরা তাঁর সাথী হব তো?

Sunday, 6 January 2013

এন্টি-গল্প', আধুনিকতা এবং তার প্রতিবয়ান

দুপুর মিত্রের গল্পগুলো পড়ে ফেললাম। একটানে পড়া যায়। বেশ হাসলামও। কিন্তু 'এন্টি-গল্প' যে ধারণা দেয় আমি নিজে যে তাঁর বিরোধী। মানে সাহিত্য নিয়ে 'বিলেতি নাম আর ধারণা'র আমি প্রবল বিরোধী শুধু নই , রীতি মত তাঁর বিরুদ্ধে জেহাদী। আপনারা আমার যে কোন লেখাতে সেটি পাবেন। এমন কি 'সওগাত' কাগজ নিয়ে লেখা শেষ লেখাতেও। ধারণাটি আমার দু'দশকের প্রাচীন। এমনকি রাজনীতিতে আমি মার্ক্সবাদী। কিন্তু মার্ক্সবাদী সাহিত্য তত্বেও আমার দারুণ এলার্জি। অটিকে আমার এক জঘন্য শিল্প তত্ব বলে মনে হয়, যেটি গড়ে উঠেছিল স্তালিনের রাশিয়াতে। যে শিল্পতত্বের সঙ্গে আমি এমনকি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কোন সংযোগ পাইনা, গোটা ব্যাপারটিই আমার কাছে মনে হয় পোষাকী। আমি মাটির সাহিত্য তত্বে বিশ্বাসী। সংক্ষেপে ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলি। 'আধুনিকতা' ব্যাপারটিই আমরা সবাই জানি ঔপনিবেশিকদের দান। আমরা তাঁদের তাড়িয়েছি বটে, কিন্তু রাজনীতি-অর্থনীতিতেও ঠিক ততটাই যতটা তারা চেয়েছে। আমাদের চাহিদাটুকুরও তাঁরা বিলেতিকরণ করে ফেলেছে তিন শতকে। আমাদের শৃঙ্খল ওদের থেকে আসা বটে,কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস সমস্ত মুক্তির ধারণাও ওদের থেকেই পাওয়া। মুক্তি পেয়ে আমরা চিরদিনই ওদের মতো হতে চেয়েছি। আমাদের মতো হওয়াটাকে জেনেছি, মধ্যযুগের অন্ধকারে ফিরে যাওয়া। যে মধ্যযুগ আসলে আমাদের কোনদিনই ছিল না। ওটা আমাদের ধারণাতে ওদের দেয়া। আমাদের মতো না হতে চাওয়ার বিপদ হলো, ওরা যে তত্ব্বগুলো তৈরি করে সেতো ওদের মাটিতে উঠে আসে, কিন্তু আমাদের কাছে সেগুলো ধার করা। আমাদের মাটিতে মেশেনা, খাপ খায়না। অনেক সময়েই আমরা পারিনা। কারণ, অনেক পথ হেঁটে আসতে আসতে সেই তত্বগুলো স্বরূপে থাকেও না, আর যেটুকু থাকে সহজ চোখে সেগুলো ধরাও পড়েনা। এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথই লিখে গেছিলেন। আমি এই লেখা থেকে নজির দিই, এই যেমন ধরুন একে যদি মার্ক্সীয় তত্ব্ব হিসেবে দেখিঃ"দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমস্ত বস্তুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের মধ্যেই সম্পর্কযুক্ত।" তা হলে কিন্তু এটা আর মার্ক্সবাদ রইল না। গল্পে এই সব চলতে পারে। কিন্তু তত্ব হিসেবে এটি মার্ক্সবাদকে মেরে ফেলে। কারণ মার্ক্সবাদের গোড়ার কথা, জগতের ব্যাখ্যা নয় , তাকে পালটে ফেলা। আর সম্পর্ক যুক্ত বললে আসলে কিছুই বলা হলো না। গতির কথা কই, বিকাশের কথা কই? আসলে কথাটা ছিল, বস্তুর বিকাশের মূলে দ্বন্দ্ব।
              তেমনি আদিম সাম্যবাদ- থেকে পুঁজিবাদের যে ক্রম--এটা বাংলা ভাষাতে খুব চলে। এগুলো আসলে মার্ক্স ইউরোপ সম্পর্কে লিখেছিলেন। আমরা ইংরেজি অনুবাদে পড়ে মজে গেছি। কিন্তু কিছুতেই মার্ক্স এগুলো ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে বলেন নি, এই নিয়ে তাঁর আলাদা সূত্রায়ন আছে, আমরা সেগুলো খুব ঘাটাই নি। দরকারও বোধ করিনি। কারণ আমাদের ধারটাই দরকার আত্মস্থ করা নয়। ইনি লিখেছেন বলে লিখছি না, এগুলো আমরা পড়তে পাই এখানে , ওখানে। মনে হবে যেন ইতিহাসের গতি বড় সরলরৈখিক। অথচ পোষ্ট মডার্ণরা আসবার বহু আগে থেকেই মার্ক্সীয় স্থানকালের ধারণা আসলে কিন্তু অগ্রমুখী বর্তুলাকার। ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি হয়, কিন্তু কখনোই তা আগেকার মতো হবে না, এগুলো নিয়ে মার্ক্সের এঙ্গেলসের ভালো ভালো লেখা আছে। নইলে আর তাঁরা স্বপ্ন দ্রষ্টা কিসের। বিলেতি ভাবনাকে অনুসরণ করবার বিপদ নিয়ে বলতে গিয়ে আমি এগুলো নজির দিলাম মাত্র। এমন সাহিত্য তত্বগুলো নিয়েও আমার ভাবনা দুই দশকের প্রাচীন। এমন কি , আমি কিন্তু লাকা -ফুকো-বাখতিন পড়ে অনেকটাই হজম করে রেখেছি। কিন্তু দেখবেন কোত্থাও ওদের কোট অব্দি করি না। আজকালতো কলকাত্তাইদেরও কোট করি না। কারণ ওরাই আমাদের এই সব শিখিয়েছেন। ......যদি এন্টি-গল্পকে গল্প বলতে হয়, তবে কমলাকান্তের দপ্তর বা পঞ্চভূতের ডায়েরিকে বলব না কেন? এগুলোই কি আমাদের ঐতিহ্যগুলোর আদি নয়? আমরা কিন্তু বলিনি। আমি দুপুর মিত্রের লেখাটিকে সেই সারিতে বসাতে পারি। অন্য সারিতে বসাবার যুক্তি ভেবে পাচ্ছি না। এর মানে কিন্তু এই নয় যে , আমি এগুলোকে নিরর্থক লেখা বলছি। কিন্তু গল্পের রসমূল্যকে আমি কোনভাবেই হেয় করতে রাজি নই, এন্টি-গল্পের যে বিলেতি ঐতিহ্য সে কিন্তু অস্বীকার করে...।