...... আমার উঠোন জুড়ে আমার সতর্কপদ বিকেলের রোদের ক্রমণ,--
চৈত্রের বিবর্ণদিন ; বিশীর্ণ প্রপাত ঘিরে ঝরঝর জলের পতন;
অদূরে বিচিত্র-সাজ পার্বতী-রমণীর ভারনত শিলাবতরণ—
মেঘে মেঘে বেলা যায়, আমার অপূর্ণ ঘট ভরা তবু হয়েতো ওঠেনি!_
সম্মুখে আঁধার রাত, দুর্গম চড়াই –পথ হেঁটে তবে তোমার সীমানা—
মা, তুমি নিশ্চিত জেনো, সোনালী সূর্যোদয়ে পৌঁছবো ঘরের ঠিকানা।।
।। ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ।।
(C)Image:ছবি |
|
২১ জুলাই এলেই আমার কেবল ১৯৮৬-র জগন যিশুর কথা মনে পড়ে না। ২০১০-এর বরপেটার আমসুর চার তরুণ সদস্য মাজম আলি,মাইদুল ইসলাম মোল্লা,সিরাজুল হক এবং মতলেব আলিদের কথাও মনে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে অনেকেরই কথাটিকে উদ্ভট বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সে আমরা বেশি ভাবি না বলে। ভাবলেও স্বস্তিদায়ক সীমারেখাগুলো মেনে চলি।খানিক ভাবলেই দেখা যাবে এরা সবাই একই শেকলে বাঁধা, দিন দুটি একই শেকলের দুই ভিন্ন কড়া।আর সেই শেকল হচ্ছে অসমের উগ্রজাতীয়তাবাদী শাসকশ্রেণি। যে কারণে বাংলাকে অসমের সহযোগী ভাষা করতে অস্বীকার করা হয়েছিল,যে কারণে অষ্টম-শ্রেণি থেকে অসমিয়াকে বাড়তি বিষয় করে পড়বার ফরমান এসেছিল ১৯৮৬তে, সেই একই কারণে বিদেশি বাছাই হচ্ছে, ডি ভোটার –ডিটেনশন ক্যাম্প এসেছে,এন আর সি এসেছে। আর ২০১০-এ বরপেটাতে চারজন তরুণকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
যে কারণে আমরা সিলেট গণভোটের রাজনীতিতে পরাজিত হয়েছি, রাজ্য পুনর্গঠন আয়োগের সামনে আমাদের কথা টেকাতে পারিনি,কাছাড়ের ভাষা বাংলাতেই সন্তুষ্ট থেকেছি,অসম চুক্তিকে হজম করেছি, এবং তিন দশকের বেশি সময় ধরে নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছি,সেই একই কারণে আমরা ২১শে জুলাই এলে এখনো করিমগঞ্জের কথা মনে রাখি, বরপেটাকে মনে রাখবার কারণ দেখি না। অথবা, উল্টোটা। বরপেটাতে করিমগঞ্জকে মনে রাখবার কারণ দেখি না।
ভাষা শহিদ দিবস এলে আমার প্রথা মেনে শ্রদ্ধা জানাবার বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আমি বেশি এই নিয়ে লেখালেখিও করি না। নিতান্ত ‘অপিনিয়ন মুভার্সে’র চাপে পড়ে দুই কথা লিখছি। দীপক সেনগুপ্ত ছিয়াশির আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে পথ হেঁটেছিলেন,তাঁর মনে হয়েছে---সেই আন্দোলন নিয়ে এখনো বিশেষ লেখা হয় নি।লেখা দরকার, বলা দরকার। সেগুলো নথিবদ্ধ হওয়া দরকার। আমার প্রশ্ন ওখানেই। সনৎ কৈরির বইটি বাদ দিলে ষাটের ভাষা আন্দোলন নিয়ে যা কিছু কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ এবং গবেষণাদি হয়েছে –তার অধিকাংশই ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের পরে। এমন কি পাড়ায় পাড়ায় শহিদ বেদি বানাবার ধুমটাও এর পরের ঘটনা। ১৯শে মে-র ২৫ বছর পার করবার পরে।বিশেষ করে ইতিহাস গ্রন্থগুলো।সেগুলোতে ৭২এর মাধ্যম আন্দোলন, ৮৬র সেবা সার্কুলার বিরোধী আন্দোলনের কথা এলো না কেন? বাধাটি কীসের? যারা লেখালেখি করেছেন,সত্যি বলতে চোখের সামনে দেখেছি... তাঁরা মিছিলে পথ হাঁটতে ভয় পেয়েছেন।কবি গল্পকারদের মধ্যে অধিকাংশই।বিজয় কুমার ভট্টাচার্য,বা জলাল উদ্দিন লস্কর,জসীম উদ্দিন লস্করের মতো অতি সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে। আমরা যখন সার্কুলার স্থগিত হলে ডেকে আর লোক পাচ্ছিলাম না তখন দেখেছি, লেখকদের মধ্যে কে কত বেশি বই করতে পারেন ১৯ নিয়ে –সেই নিয়ে রীতিমত বিতিকিচ্ছিরি প্রতিযোগিতা। যেন, ১৯ নিয়ে না লিখলে কবি হওয়া যাবে না।আর কী বলব,সেই অভিযোগ তো শক্তিপদ ব্রহ্মচারী সহ অতন্দ্র গোষ্ঠীর প্রায় সব কবিদের বিরুদ্ধে উঠেইছিল।আমরা তখন তারুণ্য আর কৈশোরের সন্ধিতে ছিলাম।সব কথা বুঝতামও না।নিজেও ভেবেছি,নিশ্চয় অতন্দ্র গোষ্ঠী ‘অন্যায়’ করেছিলেন। কিন্তু যে অভিমানের কথা বললাম, সেই অভিমানে যখন নিজেও কবিতা লিখেছি, দুই চারটির বেশি কবিতা লিখিনি---স্রেফ এই মিছিলে পথ হাঁটতে ভীত প্রতিযোগীদের শরিক হবো না বলেই।অথচ,আজ শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সম্ভবত ৮৬-র আন্দোলনের পরে লেখা ১৯শের কবিতাটির কথাই সারা দেশে বিদেশে উনিশ এলে সবাই আগে উল্লেখ করেন।বিজয় ভট্টাচার্য বাদ,করুণা রঞ্জন ভট্টাচার্য,অনুরূপা বিশ্বাস,আবুল হুসেইন মজুমদার মায় অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের কবিতাও সামান্য লোকেই মনে রাখেন।বাদ বাকিদের কথা নাই বা লিখলাম।এখনো বহু কবি ভাবেন,১৯ এলে একখানা কবিতা লেখা তাঁর ধর্মীয় কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে বুঝিবা।
অভিমান আরো বহু আছে। এর মধ্যে এও আছে---আমরা তো একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতেও লড়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় যখন এলো,শুধুই আন্দোলনের চাপে আসে নি।কাছাড়ের সাংসদের নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে এটি প্রায় বাধ্যবাধকতাতেই দাঁড়িয়েছিল।ভাষা আন্দোলনগুলোর পেছনে কি নির্বাচনী কোনো বাধ্যবাধকতা কাজ করে নি? অধিকাংশ গবেষকেরা দেখেছি—সেই পথে ভাবেনই নি। কেবল বিমলা প্রসাদ চলিহার বদরপুর থেকে বিধায়ক হবার প্রসঙ্গটি টানা ছাড়া। বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্যিক বা কেন্দ্রীয় হবে সেই নিয়ে আমরা অনেক রাজনীতি করেছি। কেন্দ্রীয় হলেই কোন সে সোনার পাথরবাটি আমরা হাতে পেয়েছি, সেই নিয়ে সম্প্রতি বেশ অন্তর্তদন্ত হচ্ছে।হচ্ছে, কেন না বিশ্ববিদ্যালয়টি জাতীয় র্যাঙ্কিঙে আসে নি। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়,শিলচর তার যমজ প্রতিষ্ঠান তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারেকাছে দাঁড়ায় না।এমন কি বাকি রাজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও বহু পেছনে।অথচ,আমরা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি যেই জানিয়েছে তাঁকে বাঙালির শত্রু ভেবে তুষ্ট ছিলাম সেই কালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে লাঠিবাড়ি খেয়ে, হাজতে গিয়ে, এমন কি উদ্বোধনের দিনেও অবিশ্বাসের বশে জেলা-বন্ধে সামিল হয়েও নিজে সেখান থেকে স্নাতকোত্তর করতে পারি নি। করেছি গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই ব্যক্তিগত অভিমান না হয় মিটে গেছে বাংলা,অসমিয়া ভাষা ও সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করে সেখান থেকে। কিন্তু একটি অভিমান তো আছেই। আমাদের ৭২-এ মাধ্যম আন্দোলনেরও শহিদ আছেন।বাচ্চু চক্রবর্তী। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বহু ঘরহারা নরনারীও রয়েছেন। অথচ,রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো--- সেখানে এখনো স্নাতক স্তর অব্দি বাংলা মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। এই নিয়ে কিন্তু ১৯ -২১শের কবি, লেখক গবেষক ও সাংবাদিকদের কোনো হেলদোল নেই। এখানে অসমিয়া প্রতিদ্বন্দ্বি বা প্রতিপক্ষ মুখোমুখী নেই বলেই কি? আমাদের কি লড়তে হলে অবশ্যই এক জবরদস্ত প্রতিপক্ষ চাইই চাই? এই কাজটি হলে যে শিলচরকে কেন্দ্র করে অসমে একটি বড় বাংলা প্রকাশনা শিল্পও দাঁড়িয়ে যেতে পারত সেরকম ভাবনাই কারো মাথাতে এলোই না।আমাদের লড়াই কি সত্যিই ছিল মাতৃভাষার অধিকার ও বৈচিত্র্য নিয়ে? সত্যি বলতে,ভাষা বিদ্যা নিয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের অধ্যয়নটাই খুব বেশি শ্লাঘার বিষয় নয়।নিজে গবেষণা করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এর থেকে বেশি বাংলা ভাষা নিয়ে মৌলিক কাজ বেশি হয়েছে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।সেই সব কথাও ভবিষ্যতে বড় করে আনব না হয়।ভাষার বড় সমস্যাটা যে বানান নয়,তারও চাইতে বেশি কিছু—এই বোধটাই আমাদের ‘ভাষাবিদ’দের নেই। আমাদের শিক্ষকদের সম্পাদিত বাংলা বইতে কেবল বানানেরই ভুল থাকে না---থাকে সমাজ ইতিহাসের আরো বেশি বেশি বড় বড় ভুল।
এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাঘা-বাঘা বিদ্বানেরা এই সেদিনও আন্তর্জালকে বাংলা ভাষা সাহিত্যের শত্রু জ্ঞান করছিলেন, লিটিল ম্যাগাজিনগুলোর অনেকে ধ্বসে যাবে ভেবে হাহাকার করছিলেন। আমরা এখনো কল্পনাই করতে পারি না যে এই একটি মাধ্যমে আমাদের সরকারি রাজ্যভাষার কোনো চাপ নেই। ফলে দৈনিক কাগজ বা লিটিল ম্যাগাজিন যে পরিসর দিতে পারে নি বাংলা ভাষাকে,দিতে পারে নি রেডিও,বা দূরদর্শন--আন্তর্জাল তা দিতে শুরু করেছে দুই দশক আগেই।এতই কল্পনাবিহীন আমাদের সৃজনী ব্যক্তিত্বদেরও মন। এখনো ‘প্রযুক্তি জানিনা’ বলবার মধ্যে আমাদের বিদ্বানদের মধ্যে একটা বড়াই কাজ করে, যেমন বহু মায়ের এই কথা বলাতে গৌরব বোধ কাজ করে, ‘আমার সন্তান এক্কেবারে বাংলাটা জানেই না’। যখন গুয়াহাটি,ডিব্রুগড়,তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুয়াহাটি আই আই টি লড়াই করেছিল অসমিয়া ইউনিকোডকে স্বতন্ত্র পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা দিতে।অসমিয়া লেখার জন্যে বাংলার বাইরে নিজস্ব সফটওয়ার বানাতে।এখন, করোনাকালে তাদের বহুকেই ফেসবুক লাইভে নিত্যদিন সক্রিয় দেখছি—সেই সব সুসংবাদ। কিন্তু এখনো তাঁদের বহু স্রোতের বাইরে বেরোতে আগ্রহী কিনা সংশয় আছে। আচ্ছা,কেউ কি ভেবেছেন,শিলচর এন আই টি-র কি আন্তর্জালে বাংলা ভাষার বিস্তারে কিছু করবার আছে বলে কোনো প্রস্তাব দেবেন? এমনিতেও সেই সব করতে প্রযুক্তিবিদ হবার দরকার পড়ে না। আন্তর্জাল যুগের ‘বিদ্যাসাগর’, অভ্র কী বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের মেহেদি হাসান কিংবা প্রথম অসমিয়া ফন্ট কুঁহিপাতের নির্মাতা বনজিত পাঠক—দু’জনেই কিন্তু স্ত্রীরোগের চিকিৎসক।
এই সব দেখি। তাই অভিমান আছে। কী হবে, ২১শের সংগ্রামে নিজে কোন বীরত্বটা দেখিয়েছি সেই সব লোকজনকে জানিয়ে। ১৯ এলে দেখি,সেইসব জানানোই বহু প্রবীণের ধর্মীয় কর্তব্যে পরিণত হয়েছিল। অথচ, আপোসের গল্পটি, পরাজয়ের গল্পটি দিব্বি চেপে যাচ্ছেন। সেই সব নাহয় কোনো গবেষক করেছেন বা করবেন,যার তাতে আগ্রহ হবে। কিন্তু নিজে জানাব কেন? জানাবার জন্যে কষ্ট করে মনেই রাখব কেন? জাতীয়তাবাদের ‘বেদিমূলে’ অর্ঘ্য দেব বলে? আমাদের সংগ্রাম তো চলমান, এখনো বহমান।ফলে,মনে রাখি নি।যেমন ‘জাতি’(?) রাখে নি বরপেটা বা নেলি বা শিলাপাথারের সংবাদ।রেখেছে শুধু বাংলাদেশে মার খাবার সংবাদ।স্মৃতিরও আছে এক নির্মাণের রাজনীতি। হতে পারে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অসমিয়া জাতীয়তাবাদের মতো কখনোই সেরকম আক্রামক নয়।আক্রমণের প্রতিরোধও বহু সময় পালটা জাতীয়তাবাদের চেহারা নেয়। বহু অসমিয়া বন্ধুরাও আমাকে তাই বেশি বাংলা বাংলা করি বলে জাতীয়তাবাদীই মনে করেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদ শেষ পর্যন্ত একটি ব্যামোই। সে কখনো নিজের সীমাবদ্ধতা,নিজের ভুল-ব্যর্থতা দেখতে অস্বীকার করে। রবীন্দ্রনাথ তা বহুবার উল্লেখ করেছেন। এবং এক সময় লিখেছেন, “স্বাজাত্যের অহমিকার থেকে মুক্তি দানের শিক্ষাই আজকের দিনের প্রধান শিক্ষা।” আমাদের সেই শিক্ষাতে শিক্ষিত হওয়া চাই।
আপনি বারে বারে পরীক্ষাতে বসছেন। আর বলে যাচ্ছেন,আপনাকে ইচ্ছে করে ফেল করে দেওয়া হয়েছে।আপনি বলে যাচ্ছেন,আপনাকে পক্ষপাত করে শিক্ষক নম্বর বেশি দেন নি।আপনি বলে যাচ্ছেন, পাশের ছেলেটি নকল করে পাশ দিয়েছে। আপনি বলে যাচ্ছেন,স্কুলটি ভালো না। আপনি বলে যাচ্ছেন,আমার বাড়িতে অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছেন না। সেগুলো সত্যও হতে পারে,আপনার দেখার দোষও হতে পারে। দেখার দোষ যদি স্বীকারই না করতে চান, আপনি কখনো পরীক্ষাতে পাস করবেন? কোনো সম্ভাবনা আছে? পাস করতে হলে আপনাকে নিজের দোষ ত্রুটিটাও দেখতে হবে, নিজেকে পাল্টাতে গিয়েই শুধু আপনি অপরকে পাল্টাতে পারেন। অপরের পাল্টানোটা আরো কঠিন কাজ। সে না পাল্টাবে কোনোদিন আর আপনি পরীক্ষাতে পাস দেবেন বলে বসেই যদি থাকেন, তবে তো ‘ঠাকুর’ই আপনার সহায়। সে আপনি যতই নিজেকে ক্ষুদিরাম, সুভাষ চন্দ্রের উত্তরাধিকারী বলে দাবি করুন।সুভাষের জন্মদিনে আপনি কোনো প্রতিবাদী সভা করবেন না, ক্যারাম খেলা বা লজেন্স দৌড়ের আয়োজনই করবেন।আর সেরকম অদৃষ্টবাদই বাঙালিকে ধর্মীয় রাজনীতিতে বেঁধে রেখেছে কিনা সেই কথাটিও ভালো করে ভাবা দরকার।
পরীক্ষাতে নিজেরও কোনো দোষ ত্রুটি আছে কিনা সে অসমিয়া জাতীয়তাবাদেরও দেখা দরকার।অসমিয়া জাতীয়তাবাদ বর-অসমের স্বপ্ন হাজির করেছিল রাজ্যপুনর্গঠন আয়োগের সামনে। তাঁরা চেয়েছিলেন, উত্তরবাংলাটাও এসে যাক অসমে। বাঙালি চেয়েছিলেন, গোয়ালপাড়া, দক্ষিণ জয়ন্তীয়া, উত্তর-দক্ষিণ কাছাড়, ত্রিপুরার সবটাই চলে যাক পশ্চিম বাংলাতে। কোনোটাই হয় নি। অসমিয়া জাতীয়তাবাদ চেয়েছিল,ভাষা আইনে গোটা পূর্বোত্তরভারতের ভাষা হবে অসমিয়া। পারে নি। স্বাধীন অসম চেয়েও আদায় করতে পারে নি। আর এখন তো অখিল গগৈ ও তাঁর সঙ্গী সাথিরাও ঠিক সেরকমই জেল বন্দি যেরকম এক একজন ডি ভোটার। প্রতিবাদে পথে লোক নেই বলতে গেলেই হয়। সেখানে ভাবাটা তো সবারই দরকার। তারপরেও, পরীক্ষাতে অসমিয়া জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে নম্বর চিরদিনই বেশি আদায় করে রেখেছে।তাঁরা যে বলেন, অসমে অসমিয়া বা খিলঞ্জিয়ার প্রভুত্বই থাকতে হবে, সেই প্রভুত্বও তাঁরা টিকিয়ে রেখেছেন। ঠিক সেই জন্যে বহু তর্জন গর্জনে কুখ্যাত বা বিখ্যাত শিলাদিত্য দেবকেও এখন বলতে হচ্ছে,তাঁকে রাজনৈতিকভাবে ‘হত্যা’ করা হবে। সেই ‘হত্যা’ কি তাঁকেই করেছে? না বাঙালির একটি অংশ তথা হিন্দু সমাজকে করে রাখা হয়েছে। যে বাঙালি নিজেকে স্বাধীনতার বীর সেনানীর উত্তরাধিকারী বলে এখনো দম্ভ করেন, মনে কি হয় না---তাঁকে খাঁচা বন্দি ‘বাঘ’ করে রাখা হয়েছে? বাঘের হিংস্র হবার বদনাম আছে। কিন্তু মানুষ যখন বাঘকে খাঁচাবন্দি করে তখন তাঁর বলই শুধু না, সুকৌশলী বুদ্ধিটাও নজরে পড়ে।এবারে ভেবে নিন,খাঁচাবন্দি বাঙালি বাঘের বুদ্ধি কতটা। যার বড়াই করেই তার জীবন যায়। সম্প্রতি আমি সুকুমার বিশ্বাসের সদ্য প্রকাশিত ‘আসামে ভাষা আন্দোলনে ও বাঙালি প্রসঙ্গ : ১৯৪৭-১৯৬১’ বইটি পড়ছিলাম। সেখানে দেখছিলাম, ষাটের ভাষা আন্দোলনের দিনে পূর্বোত্তর জুড়া বাঙালিদের অধিবেশনে বিদগ্ধজনেরা বলছিলেন, ‘জয় আমাদের হবেই। কেননা সত্য আমাদের সঙ্গে।’ জয় হয় নি। তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধি তথা দূরদৃষ্টি নিয়েও কেউ প্রশ্ন করে নি। বইটি পড়তে পড়তে দেখছিলাম, ১৯৬১র ডিসেম্বরে পরিতোষ পাল চৌধুরী সারা অসমের রাজ্যভাষার দাবিতে দিল্লি অব্দি পদযাত্রা করছিলেন। তিনি বুঝি সংগ্রাম পরিষদের শিলচর মহকুমার ‘ডিকটেটর’। আমাদের লজ্জাও হয় না, এক সংগ্রামী নেতাকে ‘ডিকটেটর’ অভিধাতে ভূষিত করতে। সেই ডিকটেটরের ডাকে সেদিন খুব কম লোকেই সাড়া দিয়েছিলেন। আমাদেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১৯৮৬তে। রাজ্যের জনজাতি সংগঠনগুলোর হুমকিতে যখন ২১ জুলাইর এক মাস পেরোবার আগেই, ১৫ আগস্ট ১৯৮৬তে সেবা সার্কুলার স্থগিত ঘোষণা করলেন রাজ্য সরকার--- বরাক উপত্যকা সংগ্রাম সমন্বয় সমিতির সভাগুলোতে আর লোকজন আসছিলেন না। আমরা এর পরেও টেনেটুনে নিয়ে গেছিলাম আরো দুই আড়াই বছর।সার্কুলারটি তখনো পুরো বাতিল হয় নি।বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তো রইলই। আর রইল করিমগঞ্জে হাজারো পুলিশী আক্রমণের শিকার সতীর্থরা। অনেকেই তখনো হাসপাতালে বা হাজতে। কিন্তু মধ্যবিত্ত তো আপোস করেই নিয়েছে।ধরেই নিয়েছে,বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আসা তো প্রতাপশালী সাংসদের কাজ। তাঁর হয়ে কাজ করছিল পরোক্ষে তখন আকসা বলে আরেকটি সংগঠন।যাদের গ্রামাঞ্চলে কোনো সংগঠনই ছিল না।পরে আমরা জানলাম,বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এসেছে তাঁরাই।এখনো আকসা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বঘোষিত অভিভাবক বলে মনে করে। আমাদের তো যেন কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
আচ্ছা, ১৯৬১র ভাষা আন্দোলনের আগে পরে নির্বাচনে কী হয়েছিল? আন্দোলনের দিনগুলোতে যে বিধায়কেরা পদত্যাগ করেছিলেন,তাঁরা কি দল ছেড়েছিলেন? তাঁরা কি পরের নির্বাচনে শাসকদলকে প্রত্যাহ্বান জানিয়েছিলেন? না দলেই ফিরে গিয়ে নানা ভাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন? সুকুমার বিশ্বাসের বইতে নেই কিন্তু। সুবীর করের বইটিও আমি পড়েছি, সেখানেও কি আছে? নেই। কেন নেই? সমাজনেতারা অসন্তুষ্ট হবেন বলে? এর মধ্যে কি কোনো বৌদ্ধিক রাজনীতি নেই? মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদী রাজনীতি?বরাক উপত্যকা সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি গড়ে উঠেছিল মূলত অসম চুক্তি বাতিলের দাবিতে। সেবা সার্কুলার আসবার আগেই আমরা দেখেছি,বাঙালি মাত্রেই চুক্তির কারিগরদের এবং অসম আন্দোলনের সমর্থকদের পুরস্কৃত করেছিলেন গেরুয়া দল তখন থেকেই বরাক উপত্যকা দিয়েই অসমে প্রবেশ করে।অথচ, আন্দোলনের পুরোভাগেই এদের প্রাদেশিক ও দেশীয় নেতৃত্ব ছিলেন। নেলি গহপুর শিলাপাথারের সংঘর্ষেও সঙ্ঘ পরিবারের হাত এখন তথ্য সহ প্রমাণিত। তাহলে চুক্তি বাতিলের দাবিতে লড়াই কী করে হয়? আমরা তুষ্ট থেকেছি আন্দোলনের মূল নায়কদের দ্বারা গঠিত দল অসম গণপরিষদকে বরাক উপত্যকাতে অনাত্মীয় ভেবে।অথচ প্রতিপক্ষ আমাদের ঘরের ভেতরেই ছিলেন।অগপকে অনাত্মীয় করতে গিয়ে আমরা নম্র-ভাবে হলেও খানিক মুসলমান এবং স্থানীয় অবাঙালি বিদ্বেষও পোষণ করেছি।ভেবেছি,এদেরই জন্যে আমাদের কিছু হচ্ছে না। তারউপরে যুক্ত হয়েছিল, দলটির নেতৃত্ব দ্বারা আলগাপুরে ১৯৮৭তে অসম সাহিত্য সভার অধিবেশন আয়োজন এবং সেখান থেকে “‘বরাকী ভাষা’ বাংলা ভাষা না!” –এমন ঘোষণা। পরকে দোষ দিয়ে গা ঝাড়বার এর চাইতে ভালো যুক্তি আর কই মেলে? আমরা কখনোই প্রশ্ন করি নি বাড়ির ভেতর থেকে এহেন প্রশ্ন উঠেই কেন? কোন দুর্বলতার সুযোগে?
সেই দুর্বলতার সুযোগেই তো আমরা মনে করেছি, নিজেদের যারা অসমিয়া বলেন, বরপেটার সেই ছাত্ররা যদি এন আর সি-র পাইলট প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন, ২০১০-এ তবে নিশ্চয় তারা বাংলাদেশিদের হয়ে কাজই করছেন। অসমিয়া সংবাদ মাধ্যম নিশ্চয় ঠিকই বলছে। ষাটের ভাষা আন্দোলনের বিরোধীদেরও আমরা ‘পাকিস্তানী’ বলে গেছি নির্বিঘ্নে। পাঁচ বছর আগে পুব পাকিস্তান থেকে আসা ব্যক্তিটিও পাঁচশত বছর আগেকার মুসলমানকে ভেবেছেন ‘পাকিস্তানী’। সেই ট্র্যাডিশন আমাদের সমানে চলছে। চালাতে গিয়ে আমরা খেয়ালই করিনি,এখনো ভালো করে করছি না, বরপেটার তরুণেরা প্রাণ দিলেন বলেই পরে এন আর সি প্রক্রিয়াতে ১৯৫১র নাগরিক পঞ্জি, এবং ১৯৭১এর আগে অব্দি (পড়ুন শুধুই ১৯৬৬-র) ভোটার তালিকা ছাড়াও আরো এগারোটি নথি স্বীকৃত হয়েছিল। তাতে শরণার্থী প্রমাণপত্রও ছিল। তাতেই মাত্র ১৯ লাখ মানুষের নামই চূড়ান্ত তালিকার থেকে বাদ গেছে। অন্যথা সংখ্যাটি, ১ কোটি ১৯ লাখ হলেও হতে পারত। আমরা আটকে আছি, এই কথাতে যে হিন্দু মুসলমান বাঙালিকে ভাষার ভিত্তিতে এক না হলে অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা দাঁড় করাতে পারব না। বরপেটা প্রমাণ করে -- আমরা মিথ্যার বেসাতি করি। দুলাল পালের মৃত্যুর পরে আমসু এবং বাঙালি ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ প্রতিরোধ দেখিয়েছে,আমরা সত্যের ধারেকাছেও নেই।দুলাল পালের পরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা পরে করেছেন, হিন্দুত্ববাদী নেতৃত্ব এবং ফেডারেশনের একাংশ। কোনো মুসলমান সহ-সংগ্রামী তাঁর মাতৃভাষা বাংলা বলে স্বীকার করে কি না, তাতে কোনো সমস্যা হয় নি। আমাদের নজর সেইসব দিকে নেই। আমরা এখনো সেই সব ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে প্রস্তুত যার জন্যে অসমের ভাষা বাংলার দাবিতে শুরু করে আমরা কাছাড়ের ভাষা বাংলাতে সন্ধি করে নিয়েছিলাম। এখনো আমরা সন্ধিতে আছি। আছি স্থিতাবস্থাতে। খেয়াল করুন, অসম আন্দোলনের একটি বিজয় দিবস আছে। ১৫ আগস্ট, ১৯৮৫। আমাদের কোনো কোনো বিজয় দিবস নেই। আছে শহিদ দিবসই শুধু। তাই আমার কোনো সংগ্রামে অংশ নেবার অহমিকাও নেই। এমনিতেও আমাদের ভাষার নামে সংগ্রামগুলোর গরিমা যাই থাক, তার একটিও সাম্প্রতিক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কা-বিরোধী সংগ্রামের থেকেও আকারে প্রকারে বড় না,ছোটই। অসম আন্দোলনের থেকে বহু ছোট। বরপেটার সংগ্রামের আকার আরো ছোট। বড় হতে পারত, তবে এন আর সি প্রক্রিয়াতে যে বিপর্যয়গুলোর মধ্যে আমদের যেতে হয়েছে বা হচ্ছে –তাও হতো না । ফলে, আমাদের সংগ্রাম চলছে,চলবে।অসমিয়াতে বললে,এই জুই জ্বলিছে! জ্বলিব!বাইরে তো বটেই। ঘরের ভেতরেও।ঘরের ভেতরের সংগ্রাম কম কিছু না।বাইরে থেকে মুরগি এসে বসে পাথরে তা দিয়ে তো আর বাচ্চা ফুটাতে পারে না। যাতে সে তা দেবে, সে কোন পদার্থে তৈরি এও এক বড় প্রশ্ন।
তবু আমাদের বিজয় কিছু নেই নয়। আছে। ১৯৮৬তে ভাষা সার্কুলার স্থগিত হয়েছিল। ২০১৯ শে সেটিই আবার ফিরে এসেছে নয়া চেহারাতে।এবারে বরাকে বাংলা,আর ব্রহ্মপুত্রে অসমিয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সেই অষ্টম শ্রেণি থেকেই। এবারে আর প্রতিবাদ নেই। যদিও এর ফল কারো জন্যেই খুব ভালো হবে না। সে টের পেতে আমাদের বাকি আছে। বর্তমান সরকার, সংস্কৃতকে বাধ্যতামূলক করতে চাইছিলেন। মূলত অসমিয়ারাই প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলে এই প্রশ্ন করেছিলেন, আর কত ভাষার চাপ ছাত্রদের নিতে হবে? একই প্রশ্ন বাংলা বা অসমিয়া চাপাবার বেলাও উঠা দরকার। ভবিষ্যৎ তুলবে। আর আমাদের বিজয় আছে বরপেটার সংগ্রামে। লিখলামই, তিনের বদলে চৌদ্দটি নথি স্বীকৃতি পেয়েছিল। তবু এখনো ঝুলে আছে, ১৯ লাখের ভাগ্য। আর তারা সবাই বাঙালি নন। মুসলমানের এক বিশাল অংশ অসমিয়া এবং বিহারিও। আছেন নেপালি, আছেন রাজবংশী।অন্যান্য জনজাতিরা তো আছেনই। যদিও প্রচার আছে তারা সবাই মুসলমান বা বাঙালি। আমরা কি এখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ বলে ভেবে বসে আছি? এদের অধিকাংশ তো দরিদ্র শ্রমজীবী। বাঙালি মধ্যবিত্তদের কি আসলেই কিছু যায় আসে,এই সব শ্রমজীবীদের কী হচ্ছে জেনে বোঝে? তারা তো জানেও না ভালো করে। জানাবার কোনো মাধ্যমও নেই। না রাজনৈতিক, না বৌদ্ধিক। সেই সব মাধ্যম আবিষ্কারের কথাও ভাবা দরকার, ভাবার অনুশীলন দরকার। তার জন্যে প্রথম যে কাজটি করা দরকার, জগন যিশুর সাথে সিরাজুল, মাইদুল,মাজম এবং মতলেব দের নাম একত্রের নেওয়া দরকার। বাঙালি বলে নয়। অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের শহিদ বলে।
No comments:
Post a Comment