আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Thursday 7 May 2009

মালিনী বিল ও কৈবর্তদের ইতিকথা


                                                     
আশির দশকের শুরুতে সরকারের থেকে মালিনী বিল কিনে নেয় শিলচর ডেভেলপমেণ্ট অথরিটি / অথরিটির লক্ষ্য ছিল এখানে ইণ্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেণ্ট স্কিম অব স্মল আ্যণ্ড মিডিয়াম টাউনশিপ (আই ডি এস এম টি) গড়ে তোলা । সস্তায় শ্রেণি নির্বিশেষে সবাইকে মাথা গোঁজার ঠাই যোগান দেয়া ছিল উদ্দেশ্য । ফলে তখন অনেকেই ওখানে জমি কেনেন। কিস্তিতে টাকা জমা দেবার ব্যবস্থা ছিল। এতে স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষকও ওখানে জমি কিনে বাড়ি তৈরির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। শিলচর শিশু মন্দিরও ওখানে গড়ে উঠে । কিন্ত   জমা জলের উৎপাতে ওখানে অচিরেই বাস করবার স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করে । সরকার বদল আরো অন্যান্য কারণে ধীরে ধীরে অথরিটিও ধীরে চলো নীতি নিতে শুরু করে । ফাইলের উপর ধুলো জমতে শুরু করে
        এই সুযোগে ওখানে শনবিল, চাতলা, কাটিগড়ার থকে কৈবর্ত মৎসজীবীরা এসে এখানে ভীড় করতে শুরু করেন। এখানে ওরা আসেন গ্রামে ওদের কাজের ক্ষেত্র কমে আসাতে। মাছের চাষের ফলন কমে যাওয়াতে। এখানে ওদের পরম্পরাগত ব্যবসাও পালটে  যেতে থাকে । ওরা দিনমজুর, রিক্সাওয়ালা, ঠেলা চালকের বৃত্তি গ্রহণ করতে শুরু করেন । এ অবশ্য কেবল মালিনী বিল নয়, সারা শহরের চার ধারে গড়ে উঠা কৈবর্ত বসতিগুলোর একই ইতিকথা । সুবীর দত্ত ৪মে,০৯ তারিখের যুগশঙ্খে লিখেছেন, প্রথম দিকে ভদ্রলোকেরা এদের তেমন আমল দেননি । বরং শহর সংলগ্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করতে এদের ব্যবহার করেন ঢাল হিসেবেই । ডাকাবুকো হিসেবে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের খ্যাতি সর্বজনবিদিত।
        ইতিমধ্যে গেল একদশকে পূর্বোত্তর ভারতের নানা জায়গা থেকে মূলত উগ্রপন্থার চাপ এড়াতে বাঙালি ( ও কিছু বিহারীদেরও)  শিলচরে এসে ভীড় করার হার প্রচুর বেড়ে গেছে।   জনসংখ্যার চাপে শহরে জমির চাহিদা আবার বাড়তে শুরু করেছে। এই নতুন জনসংখ্যার অনেকেই এসছেন চাকরি থেকে অবসর নিয়ে। কিন্তু তারো থেকে বেশি এসছেন ব্যবসা গুটিয়ে বা ব্যবসার সম্প্রসারণের বাসনা নিয়ে । শান্তির দ্বীপের এটিই মাহাত্ম্য । এরা এসছেন প্রচুর জমানো টাকা নিয়ে । ফলে  প্রমোটারি বা রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাও রমরমিয়ে চলছে এখন । কসমিক গ্রুপ বা রোজভ্যালি মতো সংস্থাও এগিয়ে এসে মালিনী বিলে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। গুয়াহাটির পর পূর্বোত্তরের আর কোনো শহরে ফ্ল্যাট ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত বোধহয় আর কোনো শহরে নেই। আর কোনো শহরের এতো দ্রুত বিস্তারও নেই । মালিনী বিলের বিরোধ মূলতঃ এই গ্রাম থেকে উঠে আসা দরিদ্র নিম্ন বর্ণের কৃষক-মজুর ও পাহাড় থেকে নেমে আসা উচ্চ-বর্ণের উচ্চবিত্ত আমলা ও ব্যবসায়ীদের বিরোধ ।
        পার্থ চক্রবর্তীর বাড়ির পেছনেই কসমিক গ্রুপ জমি কিনে রেখেছে। মার্কেট কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে। তারাত ট্র্যাভালস্ও ওখানে জমি কিনেছে।  এদের পক্ষ নিয়ে ডেভেলপমেণ্ট অথরিটী এবারে নিদ্রা ভেঙে উঠে আসে। জোর করে কৈবর্তদের উচ্ছেদ করতে শুরু করে । তাদের পুনর্বাসন দেবার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল , লোভ দেখানো হয়েছিল স্থায়ী পাট্টাও দেয়া হবে বলে । গেল বিধান সভা নির্বাচনে এই ইস্যুতেই ভোট লড়ে কংগ্রেস এখানে । ভোট পেয়েও যায় । কিন্তু তার পরেই শুরু হয় পার্থ চক্রবর্তী ও তাঁর বাহিনীর জোর জবরদস্তি । ওরা সন্তোষ মোহন দেব , বিথিকা দেব সবার কাছে গেছিলেন ন্যায় বিচারের জন্যে । কিন্তু কেউ কথা রাখে নি । কেউ কথা শোনেনি । বরং মিছে আশ্বাস দিয়ে এবারো এই লোকসভাতে  ভোট নিয়েছে কংগ্রেস। ভোট পর্ব শেষ হতেই তার গোপন দাঁত কটা দেখাতে শুরু করেছে।
        এই বিলের মাটি নিয়ে ডেভেলপমেন্ট অথরিটির কথার খেলাপের নাটকের শুরু সেই দুদশক আগের থেকে।  কর্ণেন্দু ভট্টাচার্য যখন চেয়ারমেন ছিলেন , সেই ১৯৯১ সনে তখনি লটারি করে ৫৮ বিঘা মাটির অনেকটা বিলি বণ্টন করে দেন। ৪১৫/সেল।মালিনী/৯১ মেমো নম্বরে ১৮ মার্চ ,১৯৯১ তারিখে এক বিজ্ঞপ্তি যোগে জানিয়ে দেয়া হয় কাকে কত কিস্তির টাকা শোধ করতে হবে । কিন্তু অনেকেই কোনো কিস্তি জমা না দেয়া সত্বেও ১৯৯৭ সনের ৩মে তারিখে জমির দখলি স্বত্ব দিয়ে দেয়া হয় । জমি ভরাট করে প্লট তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল তখনই , সেই বছর বিশেক আগে। কিন্তু কত মাটি ভরানো হলো, কাকে কিভাবে সে কাজের বরাদ্দ দেয়া হলো এসবের কোনো নথি বা হিসেব কচ্ছুই নেই । জল বিদ্যুৎ সড়ক কোনো কিছুরই ব্যবস্থা হয়নি সেই টাউনশিপে । কেন , তারও কোনো জবাব  নেই । 
        এই সম্প্রতি ২০০৮ সনের ২৮ ফেব্রুয়ারীতে এসডিএ/৪১৫/সেল/মালিনী/৯৬-৯৭ পি III নম্বরের চিঠিতে জমি প্রাপকদের সুদ সহ জমির বাকি কিস্তি জমা দেবার নির্দেশ দেয় অথরিটি । সময়মতো জমা না দিলে এ্যালটমেণ্ট বাতিল হবে বলেও হুমকী দেয়া   হয় । ভয়ে অনেকে জমি না পেয়েও টাকা জমা দিয়ে দিয়েছেন। অনেকে দেনও নি। এই দশ বছর বা তারো বেশি সময় ধরে এই জমি রেজেস্ট্রি না হয়ে থাকল কী করে তারও কোনো সদুত্তর জানবার উপায় নেই ।
        টাউনশিপের ৫৮ বিঘা জমির বাইরেও মালিনী বিলে জমি আছে । এর ৮ বিঘা নিজস্ব পড়ে আছে। ৫ বিঘাতে কসমিক গ্রুপ নিজেদের টাউনশিপ গড়ে তুলবে, অর্থাৎ ফ্ল্যাট বাড়ি।    আরো ৩ বিঘাতে মার্কেট কমপ্লেক্স গড়ে  দিয়েছে এই গ্রুপ । তারাত ট্র্যাভেলসকে যে জমি দেয়া হয়েছে ওখানে ডেভেলপমেণ্ট অথরিটির কর্মীদের আবাসন প্রকল্প হবার কথা ছিল, হয় নি । এভাবেই বেড়ালের রুটির ভাগ চলছে পার্থ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন ডেভেলপমেন্ট অথরিটির জমানায়। সব জমির রাঘব বোয়ালদের ওখানে এখন শ্যেন দৃষ্টি । কৈবর্তদের সঙ্গে তাই এই শত্রুতা । এদেরকে তাই এখন গুণ্ডা, সমাজবিরোধী সাজাতেই হবে । নিজের পক্ষে ভদ্রলোকদের জোটাতেই হবে। কী  আশ্চর্য ! মাতৃভাষার প্রশ্নে আন্দোলনের শির্ষে থাকা প্রগাতিশীল এককালের বাম ছাত্রনেতা, এখনকার সুশীল সমাজের চূড়ামনি দুএকজনকেও এই সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা গেছে।  এই ভদ্রজনেরা মাসের পর মাস ধরে বছর ধরে তাদের শ্রেণিভ্রাতৃদের গুণ্ডামো-বাদমায়েসী যেন দেখেও না দেখার ভান করছেন।
        ইতিমধ্যে এনিয়ে গেল রোববারে ( ২মে,০৯) তপোবন নগর এল পি স্কুলে সারা বরাকের কৈবর্তদের এক সভাতে ৩১ মে,০৯ তারিখে কৈবর্তদের মহাসম্মেলনের ডক দেয়া হয়ে গেছে। চাতলা, শনবিল, কাটিগড়া, বাউলা নানা দিক থেকে এর বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে। কেউ কেঊ একে ছোট্ট সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সঙ্গেও তুলনা করতে শুরু করেছেন ।
আইন হয়তো  কৈবর্তদের সঙ্গে খুব একটা নেই, কারণ তাঁরা বাস করছিলেন পাট্টাহীন দখলীকৃত খাস জমিতে।  এখানেইতো প্রশ্ন উঠে আইন তাদের সঙ্গে নেই   কেন ? তাদের জমির পাট্টা নেই কেন ? যেখানেই তাদের বাস সেখানে জল বিদ্যুৎ-সড়ক নেই কেন ?  অথচ সারা শিলচরে  বাবুদের ঘরে ঘরে মাছের কথাতো বাদই দিলাম, রিক্সা ঠেলে, ঠেলা ঠেলে , পাথর ভেঙে, মাটি কেটে , বাঁশ কেটে , ভার বয়ে, ঘর মোছে, বাসন ধুয়ে  সমস্ত আয়েস পৌঁছে দেবার কাজ কিন্তু ওরাই করেন । আর সামাণ্য কাজে অবহেলা হলে চড়-থাপ্পড়-কিল ওদের কপালে লেখা আছে। এদের মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ আছে যৌন লাঞ্ছনা । এই আপাত ছোট্ট ঘটনা সেই যুগান্তরের বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দাবানলের আগুন জ্বালতে পারে কিনা এখন সেটিই দেখার।
কিন্তু মুস্কিল হলো বাবুদের শাসন আর শোষন টিকিয়ে রাখে এদেরই ভেতরে  তৈরি দালালগুলো। এরা ভেতর থেকেই যে কখন জল ঢালে কেউ জানে না । নীচের তলার সাধারণ মানুষগুলো  ঐ দালাল-ফড়েদের কবে চিনেতে পারবে আর অন্য নিপীড়িত শ্রেণি-বর্ণ-সম্প্রদায়ের  সঙ্গে মিলে এদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে সেদিনটির জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে । দিন গুণতেই হবে । ততদিন পার্থ চক্রবর্তী আর কসমিক গ্রুপের লোকেদের  ভদ্র রাজত্ব চলতেই থাকবে । 
---------
লিখে শেষ ০৬-০৫-০৯/ অরুণোদয়ের জন্যে 

4 comments:

Satyajit said...

অপেক্ষা চলছে চলবে। পার্থ গেলেও স্বার্থ থাকবে। নিকট ভবিষ্বতে আওয়াজ উঠবে, এবার কৈবর্ত পার্টি বানাও, সরকার গড়, আর বাবু শোষন কর, হিষাব বরাবর- এইত আমাদের সমাজতন্ত্র।

কৈবর্ত প্রথমে একটি ব্যক্তি, আইন যতদিন প্রত্যেক্টি ব্যাক্তির পাশে প্রাচির হয়ে নাদাড়াবে, দালালরা আইনের ইঞ্জেকশন দিয়ে চুষতেই থাকবে।

Sushanta Kar said...

একদম ঠিক । রবীন্দ্রনাথ সেই কথাটাই লিখেছেন 'রথের রশি' নাটকে। কিন্দতু তার আগে শুদ্রদের টানেই রথ ছুটেছে। তার পর 'কবি' বলে এক দূরদ্রষ্টা চরিত্র এশে বলছে, হুবহু বক্যটা আমি ভুলে গেছি, এবারে সবাই মিলে তান্তে হবে। কেবল কৈবর্ত পর্টি বানালে যে চলবে না, তাদের মধ্যেও যে দালাল আছে সে কথা আমার লেখাতে আছে। কথা হ'ল তুমি যে আইনের কথা বলছ, সেটি পার্থ চক্রবর্তী ও তার শ্রেণির লোক ও তাদের দালাল নেতারা ক্ষমতাতে থাকা অব্দি হতে দেবে না। এর জন্যেই নিপীড়িতদের জোটবদ্ধ প্রতিবাদ চাই ।

Sushanta Kar said...

ও হ্যাঁ, নেপালে দেখছ, ওরা দু'পা এগুচ্ছে, এক পা পিছুচ্ছে। কিন্তু হাঁটছে রাষ্ট্রকে দুর্বল করবার লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে । ইচ্ছে করলেই ওরা পুরোনো সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করতে পারত আর মাওসেনাদের অন্যত্র নিজুক্তি দিতে পারত । গদিও আঁকড়ে থাকতে পপারত। করেনি। এমন পরীক্ষা পৃথিবীর কোথাও এর আগে হয়নি । সমাজতন্ত্রের এই চেহারা দেখেছো ? অবশ্য বিশ্বাস ঘাতকতা ওদের মধ্যেও হবে না এ কথা হলফ করে এখনি বলা যাবে না।

Satyajit said...

নিপীড়িত কে? এটাই হচ্ছে আশল প্রশ্ন।এইবার কৈবর্ত, ওইবার মুশল্মান। ঠিক বীপরিতে কোনো গুষ্টি সমপরিমাণে লাভমান।এইত গুষ্টিতন্ত্রের খেলা।রাষ্ট্রযন্ত্র যে গুষ্টির দখলে ওরা দুর্বলকে রাষ্ট্র শক্তি দিয়ে শোষণ করবে।

নিপীড়িত কৈবর্ত না- প্রত্যেক্টি সেই ব্যক্তি যাদের বিশ্বাষের খুন হল, এবং যারা পরবর্তী শিকার হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষায়।

মজার খেলা হচ্ছে, লাভমান এবং ক্ষতিগ্রস্ত দুই দলে ভাগ করে, তলে তলে ডাইলের মজা উধাও আর ধীরে ধীরে সবাই নিস্ব- শুধু নেতা ব্যেতিক্রম।