ওভার টাইম
মূল অসমিয়াঃ অজন্তা
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর
(গল্পটি অসমিয়া সাময়িকী ‘প্রান্তিকে’র ১৬মার্চ,০৯ সংখ্যাতে বেরিয়েছে)
ড০ যতীন মেহতার মাংসল কঠোর হাতখানার ভেতরে ঢুকে আমার নরম, রোগা হাতখানা মচকে যাবার উপক্রম হলো । তাঁর হাতখানা যেন দমবন্ধ করে দেবে এমন একখানা খাঁচা । সেই খাঁচাতে বন্দী হয়ে অসহায় পাখি একটার মতো আমার হাতখানা ছটফটাতে শুরু করলো । করমর্দন করেই তিনি আমার হাতাখানা ছেড়ে দেন নি। অনর্গল কথা বলে গেছেন—
“হাই অভিলাষা, হোয়াই আর য়্যু সো লেট ? য়্যু লুক ভেরি নাইস এ্যাণ্ড স্মার্ট ইন দিস ড্রেস !”
ড্রেসের অজুহাতে কামনা লুলুপ দৃষ্টিতে তিনি আমার আনখশির দেখে নিলেন ।
“উইল য়্যু হ্যাভ এ্যা ড্রিংস, অভিলাষা ?”
“নো,থেংক্স স্যর,আই জাস্ট হেড এ্যা কাপ অব টি।”
যতীন মেহতার নির্দেশে ওয়েটার একটা রঙিন গ্লাসে ভরা ট্রে নিয়ে এগিয়ে এলো । যতীন মেহতা নিজের হাতে রঙিন গ্লাস একখানা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। অলস হাতখানা এগিয়ে নিয়ে আমি কোনোক্রমে গ্লাসটা তুলে নিয়ে বললাম—
“থেংক্স এ্যা লট স্যর।”
লোকের ভীড়ে আমার চোখ দু’টো সহকর্মী প্রিয়াংকা, ঋতু, রূপমদের খোঁজতে শুরু করলো। হটাৎই আমার মনে হলো ---লোকগুলো যেন আমাকেই লক্ষ্য করছে। বোধহয় ড০ যতীন মেহতা আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে রঙিন গ্লাস এগিয়ে দিয়েছেন দেখেই । ড০ যতীন মেহতার জন্যেই আমাদের রিলিফ এ্যাণ্ড রিহেবিলিটেশ্যন ডিপার্টমেণ্ট এই পার্টির আয়োজন করেছে। তাঁকে সম্মান আর সম্বর্ধণা জানাবার জন্যে। তিনি আমাদের রাজ্যের অতিথি। ষ্টেট গেষ্ট । সেই মানুষটি আমার মতো এক সামান্য পি এ অর্থাৎ পার্সোনাল এ্যাসিষ্টেন্টকে গ্লাস এগিয়ে দিয়েছেন ---অবশ্যই দেখবার মতো দৃশ্য ।
“দেন কাম অন অভিলাষা । লেটস্ সিট এ্যাণ্ড টক্ কমফর্টেবলি ।” যতীন মেহেতা বললেন ।
এইরে! যতীন মেহেতা আমার সঙ্গে আবার কী কথা বলবে ? তিনি যে অনেক বড় মানুষ ! অনিচ্ছা সত্বেও আমি তাঁর পেছন পেছন এলাম। তিনি আমাকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর বেশির ভাগ কথার জবাবে আমাকে শুধু ইয়েস স্যর-নো স্যর বলে যেতে হলো । হঠাৎই যতীন মেহেতা জিজ্ঞেস করলেন---
“আরন্ট য়্যু হ্যাপি হিয়ার অভিলাষা ?”
“অফকোর্স, অফকোর্স আই এম স্যর!”
আমি কিছুটা উঁচু স্বরে বলে উঠলাম ।
“দেন হোয়াটস দ্য মেটার উইথ য়্যু অভিলাশা ? য়্যু লুকস্ ভেরি ডিপ্রেসড।”
“নাথিং স্যর।”
“আর য়্যু টেরিবলি টায়ার্ড ?”
“ নো স্যর, নো । আই এ্যাম অল রাইট স্যর।”
“ অভিলাষা, ইফ য়্যু ডোন্ট মাইন্ড য়্যু কেন টেক রেষ্ট হিয়ার টুনাইট । আই মিন ইন মাই রুম।”
আমার কান দু’টো গরম হয়ে এলো। রেষ্ট হেয়ার টুনাইট ! এ কিসের প্রস্তাব দিচ্ছে মেহতা আমাকে। আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম।
“নো স্যর—ইটস্ ইম্পসিবল!”
পারিনি । তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বোঝাবার সুরে বললেন---
“ স্টপ ওরিং। দেয়ার ইজ নাথিং টু ফিয়ার । ডন্ট ওরি এবাউট ইয়োর স্টাফ, ইয়োর ডাইরেক্টর।”
“সরি স্যর. . .মাই চিলড্রেন উইল ওয়েট ফর মি।”
“হোয়াই ডোন্ট য়্যু কাম টু মাই রুম ফর ব্রেকফাস্ট টুমোরো?”
“সরি স্যর—আই এ্যাম টেরিবলি সরি....।”
যতীন মেহতা আর বেশি সময় আমার কাছে বসে রইলেন না। তিনি হেসে হেসে বলে ফেললেন “ইউ আর টোটালি চ্চিল !” আমার কাছের থেকে যতীন মেহতা উঠে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পার্টিতে আসা অন্য অফিসারেরা তাঁর কাছ চাপলেন। একবারের জন্যেও ঠোঁটের কাছে নিইনি যে রঙিন পানীয়ের গ্লাসটি সেটি উদ্বেগের সঙ্গে টেবিলে পড়ে রইল । অরিন্দম চক্রবর্তী কি জানেন এই পার্টিতে কাকে কাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো ? নিমন্ত্রণের চিঠিটা আমিই ডিজাইন করে বের করেছিলাম। প্রিন্ট করেছিলাম, খামের উপর যত্ন করে গোটা গোটা অক্ষরে আমন্ত্রিত উঁচু পদের আধিকারিকদের নাম ঠিকানা লিখেছিলাম। আর এই ডিনার পার্টির আয়োজনের ফাইলটা । স্টার হোটেল অরুণে পার্টি আয়োজন করার থেকে শুরু করে সবই আমি করলাম। নীরবে । আমি শুধু আমার ডাইরেক্টর অরিন্দম চক্রবর্তীকে একবার করে ড্রাফট লেটারগুলো দেখিয়েছিলাম আর ফেয়ার কপিগুলোতে সৈ করবার জন্যে এগিয়ে দিয়েছিলাম।
অরিন্দম চক্রবর্তীর চেম্বারে বসে ড০ যতিন মেহতা তখন আমাকে তাঁর দু’চোখে গিলছিলেন। তিনি অরিন্দম চক্রবর্তীকে বারে বারে বলছিলেন—“সি ইজ ভেরি স্মার্ট । সি টেকস্ অল রেসপন্সিবিলিটিজ্ ।” –সমর্থন করে অরিন্দম চক্রবর্তীও বলছিলেন, “ইয়েস ইয়েস।”
দিনের বেলার সেই রেসপন্সিবল মেয়েটি হটাৎই ‘চ্চিল’ হয়ে পড়লাম—আমার হাসি পাবে না বুঝি ?
আমি অরুণাচল প্রদেশ সরকারের রিলিফ এ্যাণ্ড রিহেবিলিটেশ্যন বিভাগের ডাইরেক্টর অরিন্দম চক্রবর্তীর পি এ অর্থাৎ পার্সোনাল এ্যাসিস্টেন্ট । অরিন্দম চক্রবর্তী এই ডিপার্টমেন্টে বদলি হয়ে আসার মাত্র বছর খানিকই হয়েছে । প্রথম দিনটিতে বেজবরুয়া স্যরের সঙ্গে চার্জ হেণ্ডিং-টেকিং যখন হচ্ছিল, আমাকে বার বার তাঁর কোঠাতে যেতে আসতে হয়েছিল। তিনি অফিসে প্রথম পা রাখবার দিনেই আমিই প্রথম গিয়ে আমার ডান হাতখানা তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলাম।
“গুড মর্নিং স্যর, আমি আপনার পি এ অভিলাষা চৌধুরী।”
সারাদিনে কত যে ডিক্টেশ্যন কপি, নোট বুক, ফাইল তুলে জড়িয়ে ধরে আমাকে তাঁর ঘরে গিয়ে ঢুকতে হয় তার কোনো হিসেব থাকে না। একের পরে এক ডিক্টেশ্যন নিই । একটা নোটের টাইপিং আধাতেই রেখে দৌড়ে যেতে হয়ে আরো একটা ডিক্টেশ্যনের জন্যে । বেশ ক’ পৃষ্ঠা জুড়ে টাইপ করে দেবার পরেও প্রায় সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছেন । কখনোবা অফিসের ভাষাতে ‘ভীষণ ইম্পোর্টেন্ট’ ড্রাফ্ট একটা টাইপ করে দেবার পরেও দিনের পর দিন টেবিলে পড়েই থেকেছে। ডিক্টেশ্যন নেবার জন্যে ডেকে কখনোবা আমাকে ঘণ্টাখানিক এমনি বসিয়ে রাখেন। সে বিরতি বড় বিরক্তিকর হয়ে উঠে । বিরক্তি দূর করতে আমি বসে বসেই জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি । বাইরে হালকা বাতাস নরম গোল রোদ্দুরকে নিয়ে খেলা করে। জানালার পর্দাটি বাতাসে নেচে বেড়ায় । কাঁপে কি কাঁপেনা করতে করতে আমার চুলগুলোও বাতাসে কাঁপে । ডাইরেক্টর অরিন্দম চক্রবর্তীর কোঠা থেকে বাইরেটা বড় সুন্দর দেখায়। পাহাড়ি জায়গা । এমনিতেই সুন্দর । এই যেন খসে পড়বে বলে মনে হয় এমন হেলানো পাহাড়ের বুক ভরে কিছু অনামা ফুল ফোটে । পাহাড়ি মেয়েরা ঝুম বেঁধে মাথায় আটকানো পিঠে চাপানো ঝুড়ি নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসে। খোলা জায়গাটিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সারাবেলা খেলা করে । পাহাড়ের নিচটাতে সুবিধেজনক জায়গা দেখে বসে দু’এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা নিবিড় ক’য়েকটা মুহূর্তে নিজেদের ভরিয়ে তোলে। রোদই হোক আর বর্ষা, অরিন্দম চক্রবর্তীর ঘরেরে থেকে বাইরেটা দারুণ দেখায়। সৌন্দর্য দেখার দৃষ্টি থাকলেও আমার ঘরটায় কিন্তু কোনো জানালা নেই । আমার ঘর আর কী, অরিন্দম চক্রবর্তীর বিশাল ঘরের চার ভাগের এক ভাগ । তাও পার্টিশ্যন দিয়ে দু’ভাগ করা হয়েছে। ঘরটিতে কিছু মেশিনের মাঝখানে আমি বসে থাকি । ফ্যাক্স, জেরক্স, কম্প্যুটার, বেশ ক’টি টেলিফোন, ইন্টারকম ইত্যাদি অনেক কিছু। মেশিনগুলোর মাঝে নিজেকেও আমার কখনো মেশিন বলেই মনে হয়। আমার নির্দেশে যেমন এই মেশিনগুলো চলতে থাকে আমাকেও অরিন্দম চক্রবর্তীর নির্দেশে ন্যায় অন্যায় বিচার না করে সচল থাকতে হয় । পার্থক্য শুধু এইটুকুই ---মেশিন ক’টির প্রতি আমার যত্ন আছে, আছে সহানুভূতি । আমি আলতো করে বোতাম টিপি । সময় বুঝে নিয়ে এদের বিশ্রাম নিতে দিই । নিজের হাতে মোছে টোছে রাখি। কিন্তু অরিন্দম চক্রবর্তী যখন আমাকে চালান আমি প্রায়ই কষ্ট পাই। হৃদয়ে ।
অরিন্দম চক্রবর্তী ট্যুরে যেতে হলে তাঁর ট্যুর এ্যাপ্রোভেলের ফাইলটা নিয়ে আমার কাজ বেড়ে যায় । কী কী কাজে যাবেন তার এক দীর্ঘ তালিকা তৈরি করতে হয় । তিনি যখন থাকবেন না সেই সময়টুকুতে দায়িত্ব নেবেন বলে জয়েন্ট ডাইরেক্টরের জন্যে একটা অর্ডার তৈরি করতে হয়। সময় বেঁধে দেয়া তথা নথি পত্রগুলো সৈ করিয়ে নেয়া ইত্যাদি অনেক কাজ । ফাইলগুলোর উপরে ‘মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট’ কার্ড লাগিয়ে আমাকে ভীষণ দৌড়াদৌড়ির মধ্যে ব্যস্ত থাকতে হয় । অথচ আমি জানি, অফিসিয়েল কাজের বাহানা দেখিয়ে তিনি প্রায়ই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কাজেই যান । তিনি ফিরে আসার পর ট্র্যাভেলিং এ্যালাউন্সেস বিল বা ভ্রমণ ভাতা তৈরি করা ইত্যাদি আরো অনেক কাজ আমার বেড়ে যায় । তিনি কেমন ব্যক্তিগত কাজে যান তাও আমি জানি । আমার থেকে লুকোনো যায় না---তাঁর নানা ব্যক্তিগত নথি পত্তরের টাইপিং, ফ্যাক্স ইত্যাদি করতে গিয়েই আমার সব জানা হয়ে যায় ।
আমার এমন লাগে যেন ---জীবনের এই কর্মঠ সময়গুলো আমি কিছু ভুয়া কাজ করে পার করে দিচ্ছি । অরিন্দম চক্রবর্তীর নির্দেশ মানবার জন্যে সরকার আমাকে কাজ দিয়ে রেখেছে । তবু এই মেশিনে ভরা ঘরটিতে বসে কম্প্যুটারের কী-বোর্ডে আঙুল ফুরাতে গিয়ে আমি কখনো স্মৃতি হয়ে যাওয়া দিনগুলোতে ফিরে ফিরে যাই । আমার কলেজ—আমার বন্ধু---আমার প্রিয় বিষয়—ফিলোসফি । এখন কোথায় ফিলোসফি আর কোথায় আমার ষ্টেনোগ্রাফি !
ক’দিন ধরে আমি লক্ষ্য করছি—একজন উচ্চ পদস্থ আধিকারিক আর পি এ-র মাঝখানে যেটুকু ব্যবধান থাকা উচিত তিনি তা রাখতে চান না। হাসি ঠাট্টা করতে চান । ফাইল একটা, লেটার একটা আমার হাতে তুলে দেবার বেলা, আমার হাতের থেকে টেলিফোনের রিসিভারটা, কলমটা নেবার বেলা তাঁর আঙ্গুল ক’টি প্রায়ই আমার হাত স্পর্শ করে । বেজবরুয়া স্যরের সঙ্গে তিনটা বছর আমি কাজ করেছি। নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে কখনোবা অফিস ছুটির পরেও অনেক দেরি অব্দি। পিতৃসুলভ আবিভাবকের মতো তিনি আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন । নিজেকে আমার তখন সরকারের এক দায়িত্বশীল কর্মী বলে মনে হতো । কখনোবা হঠাৎ আমার ঘরে চলে আসতে হলে , আমাকে কিছু বোঝাতে হলে--- আমি চমকে উঠি -- এতোটা কাছে কখনোই ঘেঁসতেন না । কিছুদিন ধরে আমি লক্ষ্য করেছি---তিনি প্রায় লাষ্ট আওয়ারে আমাকে ফাইল একটা এগিয়ে দিয়ে বলেন---“ অভিলাষা, কাল তাড়াতাড়ি এসে এই ফাইলটার কাজ পুরো করবে ।“
অফিস ইমার্জেন্সিটা আমি বুঝি । দুর্যোগের সময় বন্ধের দিনে,অফিস ছুটির পর আমরা অনেক রাত অব্দি কাজ করি । পাহাড়ি রাজ্যটিতে প্রতি বছরই বর্ষায় ভূমিস্খলন, বন্যা ইত্যাদি আর শীতে খরা অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি হয় । প্রতি বছর শত শত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় । কিন্তু তিনি যেসব ফাইল আমাকে দেন সেগুলো আদৌ জরুরি নয় । আমার ফার্ষ্ট আওয়ার, লাষ্ট আওয়ারগুলো ক্রমেই দীর্ঘ হতে শুরু করল । বিশাল বিশাল ডিক্টেশ্যনগুলো প্রায়ই লাষ্ট আওয়ারে হয় । একবার ড্রাফ্ট টাইপ করে দ্বিতীয়বার ফেয়ার কপি করে টেবিলে দিয়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যে হয়ে যায় । প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের জন্যে লাখ লাখ তাকা অনুদান দেবার ফাইলে আমাকে কাজ করতে হয় । প্রতিটি বছর উন্নয়নের নামে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা অঞ্চলগুলই আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় । আমি ভালো করে জানি আমার সুদীর্ঘ লাষ্ট আওয়ারগুলো আর অরিন্দম চক্রবর্তীর লোলুপ দৃষ্টির বিনিময়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকগুলো কতটা লাভবান হবে । তবুও এই লাষ্ট আওয়ারগুলো আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। কৌশলে ম্যানেজ করতে হয় । প্রায়ই আমার সহকর্মী তথা প্রতিবেশী রিনিয়া নামের আপাতানি মেয়েটিকে আমার সঙ্গে বসে থাকবার জন্যে অনুরোধ করতে হয় । সবসময় সেটা সম্ভব হয়ে উঠে না । প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এতো দীর্ঘ এক একটা তালিকা আসে যে সন্দেহ হয়--- হালকা জনবসতির রাজ্য এই অরুণাচলের একটা জেলাতে এতো জনবসতি আদৌ আছে কি নেই । তেমনি আসে শস্য নষ্ট হবার বিশাল বিশাল তালিকা । ডাইরেক্ট্র অরিন্দম চক্রবর্তী যান স্পট ভেরিফিকেশ্যনে । এতোসবের পরেও কিছু নিরক্ষর জনজাতি লোক আসতেই থাকে । অভিযোগ করে—রিলিফের নামে তারা একেবারে কিছুই পায় নি।
এমনি এক লাষ্ট আওয়ারে আমি একদিন অরিন্দম চক্রবর্তীর টেবিলে ডিক্টেশ্যন নিতে গেলাম । তাঁর ডিক্টেশ্যনের সঙ্গে সঙ্গে আমার কাঠপেন্সিল নোটবুকে ষ্ট্রোক এঁকে গেল । মাঝখানে তিনি দাঁড়ালেন। আমার কাঠপেন্সিলও থেমে রইলো । সেই ফাঁকে আমি লেখাগুলো একবার পড়ে ফেললাম । অনুমান করলাম বিরতিটা কিছু দীর্ঘ হবে । হঠাৎই তাঁর দিকে আমার চোখ পড়তেই আমি শিউরে উঠলাম । তাঁর চোখ ফাইলে ছিল না। পলক না ফেলে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন । আমি ঢোক গিলে কোনোক্রমে জিজ্ঞেস করলাম ---
“স্যর, আমি তাহলে পরে আসব ?”
তিনি কিছুক্ষণ কিছুই বললেন না । আমি মাথা নুইয়ে বসে রইলাম । তিনি বললেন ---
“কেন, বসোতো দেখি অভিলাষা । একচ্যুয়ালি এই কেসটা বড় কমপ্লিকেটেড । ফাইলটা ভালো করে ষ্টাডি করতে হবে । সময় লাগবে ।“ সেদিনই তিনি আমাকে বললেন ---
“তোমার কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে অভিলাষা । যতটা পারি দেখে দেবো ।ছোট ছোট সন্তান দুটো নিয়ে একা একা তোমার নিশ্চয় কষ্ট হয় !”
আমি কিছু বলিনি । তিনিই বললেন---“ এ মাসে তোমার ওভার টাইম একতা পুট করবে । আমি এ্যাপ্রোভ করে দেবো।” তিনি ইন্টারকমে ফোন করে দু’কাপ চা আনালেন । বললেন---“চা নাও,অভিলাষা । আজ আর কাজ করবার ইচ্ছে নেই । আজ চলো,আমরা বরং কথাই বলি । আচ্ছা, তোমার হ্যাজবেণ্ড যেন এখন কোথায় থাকে অভিলাষা ? বিবাহ বিচ্ছেদ সত্যি বড় ভয়ানক।”
তিনি বহুবার বলার পরেও আমি ওভার টাইম ক্লেম করিনি । তিনি বহুবার বলার পরেও কোনো অসুবিধের কথা বলিনি। সাহায্যও চাইনি । এতে তিনি বেশ নারাজ হয়েছিলেন । আমার প্রভিডেণ্ড ফাণ্ড এডভান্সের ফাইলটা,মেডিক্যাল রি-ইম্বারসমেন্ট,চিলড্রেন এ্যাডুকেশ্যন এ্যালাউন্সেস ইত্যাদি যে ক’টা ফাইলই এসছিল,অরিন্দম চক্রবর্তীর সময়ের অভাবে নীরবে তাঁর টেবিলে ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
সবারই সরকারি বাসভবন মেরামত করানো হলো । সুন্দর রং দেয়া হলো । শুধু আমারই বাসভবনখানা রঙের অভাবে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে রইল । বাসভবন মেরামত করার আনন্দে অন্য সব স্টাফেরা মিলে টি পার্টে করল । সেদিন আমার পথ চেয়ে থাকে যে আদরের ঘরখানা তার গেটের সামনে আমি কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ালাম । আমার ছোট্ট মেয়ে দুটিকে সারাদিন বুকের ভেতরে ধরে রাখে যে ঘর—তার উপরেরে টিনে কয়েকটি ফুটো বেরিয়ে গেছে। জানালার কাঁচগুলো যে কত জায়গাতে ভাঙা। খসখসে মেঝেটাও অনেক জায়গাতে ফেটে গেছে---ঠিক আমার এই কলজেটার মতো । আমরা দু’জনে একই রকম । আমিও পড়ে যাইনি । বাচ্চা দুটোকে বুকে জড়িয়ে আমিও স্থির খাড়া আছি।
আমি ফার্ষ্ট আওয়ার, লাষ্ট আওয়ারগুলো আর ম্যানেজ করে উঠতে পারছিলাম না। ওভার টাইম ক্লেম করবার মতো কাজ আমার বেড়ে যাচ্ছিল । ভারত সরকারের উচ্চ পদস্থ আধিকারিক রিহেবিলিটেশ্যনের ডাইরেক্টর ড০ যতিন মেহতার ভিজিট সম্পর্কিত কাজে অরিন্দম চক্রবর্তীর সঙ্গে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্য সচিব তথা রাজ্যপালের সঙ্গে বেশ ক’টি মিটিঙে তিনি অংশ নেবেন । সবগুলো রাজ্যিক পর্যায়ের মিটিং।
ড০ যতিন মেহতা যে ক’দিন ছিলেন সব ক’টা দিন আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। বহুবার টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে । ফাইল তুলে নিয়ে একবার যতীন মেহতার আবাস সার্কিট হাউসের ঘরটাতে তো আরেকবার অরিন্দম চক্রবর্তীর টেবিলে দৌড়োতে হয়েছে । দু’জনেরই আলোচনার মধ্যে থেকে নোট তৈরি করেছি । ডিক্টেশ্যন নিয়েছি। যতিন মেহতা আমাকে অভিলাষা অভিলাষা বলে ডেকেছেন । আমার কাজের উদ্যম দেখে বার বার করে বলেছেন---
“গুড । ইয়োর ওয়ার্ক ইজ প্রেইজওয়োর্দি।”
সেই প্রেইজঅয়োর্দি অভিলাষা কাম শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ‘চ্চিল্’ হয়ে পড়লাম । তার জন্যে আমার কোনো আক্ষেপ নেই । বাড়তি কাজ করবার জন্যে আমার ওভার টাইমটুকু পেলেই কাজ চলে যাবে । অরিন্দম চক্রবর্তী এমনিতেও আমাকে ওভার টাইম একটা দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এখন যখন আমি কাজ করেছি, না দেবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। প্রিয়াঙ্কা , ঋতুদের মতো স্মার্ট হলে অবশ্য কাজ অনেক কমে যায় । নোট একটা, ড্রাফ্ট একটা লিখতে না পারলেও ঋতু , প্রিয়াঙ্কারা কিন্তু ওভার টাইম এলাউন্সেস ঠিকই পেয়ে যাচ্ছে । এ ধরণের পার্টি আমাদের বিভাগে বছরে দু’তিনটা হয় । সবাই জানে পার্টিগুলোতে ঋতু প্রিয়াঙ্কাদের উপস্থিতি নিশ্চিত । যদ্দূর পারি আমি এই সন্ধ্যেবেলার পার্টিগুলোতে থাকি না । এবারে ডাইরেক্টর অরিন্দম চক্রবর্তীর থেকে সোজাসুজি মৌখিক অনুরোধ এলো –
“অভিলাষা, যতীন মেহতা তোমার কাজ খুব পছন্দ করেছেন । তোমাকে কিন্তু ডিনার পার্টিতে থাকতেই হবে। আর দেখবে যেন যতীন মেহতা কিছুতেই অসন্তুষ্ট না হন।”
ভাবলাম,রক্ষা করবার মতো অনুরোধ যখন রাখাই ভালো। তার উপর সহকর্মীরাও অনুরোধ করেছে। অরিন্দম চক্রবর্তীর ডাকে চমকে উঠলাম।
“ অভিলাষা...অভিলাষা...”
আমি উঠে তাঁর দিকে গেলাম। তিনি বললেন—“ অভিলাষা, আমি অল্প আসছি । তুমি অতিথিদের দিকে একটু নজর রেখো।”
লেডিজ এ্যাণ্ড জেণ্টেলম্যানদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে ড০ মেহতাও বেরিয়ে গেলেন । হঠাৎই জরুরি কাজ এসে পড়েছে। আমি অতিথিদের দিকে তাকিয়ে এমনি এমনি একটু হাসলাম । প্রায় সব্বাইকেই কিছু অসুবিধে হলে বলতে অনুরোধ করলাম । যাদের হাতে রঙিন গ্লাস নেই তাদের নিতে অনুরোধ করলাম। নতুন করে আসা অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলতে হলো---হঠাৎ এক জরুরি কাজ এসে পড়াতে ড০ মেহতা আর অরিন্দম চক্রবর্তী কিছু সময়ের জন্যে বেরিয়ে গেছেন। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি প্রিয়াঙ্কা আর ঋতুও নেই । হয়তো জরুরি কাজ । খানিক পরে অরিন্দম চক্রবর্তী ফিরে এসে আর কেউ যেন না শোনে সেভাবে আমাকে বললেন---
“ এ আমি কী শুনছি অভিলাষা ? ড০ মেহতা তোমার উপর ক্ষেপে আছেন । তুমি কি জানো এই ভি আই পি-র ক্ষমতা ? ভারত সরকারের খুব উঁচু স্তরের মানুষ তিনি । তাঁর উপর আমাদের কত কি নির্ভর করে তা কি তুমি জানো ? আরে ইনি তোমার ফিউচার বানিয়ে ছেড়ে দিতেন! কিন্তু..তোমরা যে কি মানুষ না ! যেখানে আছো সেখানেই পড়ে থাকবে সারা জীবন। থার্ড ক্লাস—পি এ !”
এক সময় প্রিয়াঙ্কা ঋতুদের সঙ্গে আমি ডিনার টেবিলে বসলাম । নীরবে। আমার কচি মেয়ে দু’টোর মুখ দু’টো বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠল। এতো রাত অব্দি নিশ্চয়ই ওরা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে । ওদের দেখবার জন্যে যে মেয়েটা আছে সে তাদের ভাত ক’টা খাওয়াতে পারল কি না !
শেষ রাত অব্দি আমার ঘুম এলো না। বিছানার যে টুকরোতে আমার স্বামী আকাশ শুতো সেখানে ছোট্ট সোনা আশার হাত একটা শুয়ে আছে। সে জায়গাতে আমি হাত বুলিয়ে দিলাম। সামান্য বিছানার ঠাই নয়, যে পুরো আকাশখানাই ! শূণ্যতা আমার বুকখানা খামচে ধরল । আকাশের সঙ্গে যে ক’দিন ঘর করেছি প্রতি পদক্ষেপে আমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছে। আমি নির্যাতিত হয়েছিলাম, হয়েছিলাম উপেক্ষিত। আমাকে পরাধীনতার শেকল পরানো হয়েছিল। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম । আমি চেয়েছিলাম সসম্মানে বেঁচে থাকতে । শান্তিতে । আমি চাই স্বাধীন হয়ে বেঁচে থাকতে । শুধু এক পুরুষের সম্ভোগের পাত্র হয়ে, তার বিনোদনের নিমিত্ত হয়ে, সন্তান জন্ম দেবার এক মেশিন হয়ে নীরবে ঘরের কোণে পড়ে থাকতে চাই না। একদিন আমাদের সম্পর্কের বাঁধন ছিঁড়ে গেল । কিন্তু, সত্যি কি আজ আমি স্বাধীন ? আমার আত্মমর্যাদার কিছু কি আর বাকি আছে ? যে দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভুক্তভোগী নিরীহ গরীব মানুষ এক মুঠো ভাতের জন্যে হাহাকার করে অথচ প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিদর্শন করতে এসে উচ্চ পদস্থ আধীকারিক হাজার হাজার টাকার মদ মাংস খায়, স্ফূর্তী করে সে দেশে আমার মতো নারী কি আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে ? আমাকে দেখছি সারা জীবন অরিন্দম চক্রবর্তীর মতো মানুষের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হবে । অরিন্দম চক্রবর্তীর নির্দেশে আমি বিশাল বিশাল ভুয়ো তালিকা টাইপ করে বের করব । যতীন মেহতার মতো মানুষ –নির্দ্বিধায় আমাকে বলবে---য়্যূ কেন টেক রেষ্ট হেয়ার ।
ক্যাশিয়ার রুপম সরকার ফার্ষ্ট আওয়ারে ওভার টাইমের ফাইলটা পুট আপ করে ডাইরেক্টর অরিন্দম চক্রবর্তীর টেবিলে দিয়ে গেল । খান দু’এক ফাইল দেখে অরিন্দম চক্রবর্তী বেরিয়ে গেলেন। যাবার বেলা আমাকে বলে গেলেন---
“অভিলাষা, আমি ড০ যতীন মেহতাকে সী অফ করতে যাচ্ছি।”
তিনি বেরিয়ে যাবার পর ক্যাশিয়ার রুপম সরকার ফাইলের খবর নিতে এলেন। পিয়ন ফাইল ক’টা ডাইরেক্টরেরে টেবিল থেকে এনে আমার টেবিলে রাখল । আমি রুপম সরকারকে বললাম---“ রুপমদা, অভার টাইমের বিলটা আজই ট্রেজারিতে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেনতো। আমার টাকার খুব দরকার । আমার কোয়ার্টারটার রঙ চঙ বাজেভাবে উঠে গেছে। চূণ তেল দেওয়াব বলে ভাবছি।”
“ কিন্তু তোমার ওভার টাইমতো এ্যাপ্রোভ করেন নি অভিলাষা !”
ফাইলটা খুলে দেখে রুপম সরকার বললেন। কম্প্যুটারের কী-বোর্ডে দৌড়োতে দৌড়োতে আমার আঙুলগুলো থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎই আমার এই আঙুলগুলো আর আমাকে ভীষণ ক্লান্তিতে পেয়ে বসল। কী অজুহাতে আমার ওভার টাইম এ্যাপ্রোভ হলো না, ফাইলে অরিন্দম চক্রবর্তী কী লিখলেন তা জানার আমার কোনো আগ্রহ রইল না।
এই ক্লান্তি দূর করবার জন্যে আমাকে অরিন্দম চক্রবর্তীরই ঘরের জানালার কাছে যেতে হবে । দূরের Dedeদেখার মতো পাহাড়টি---বন্য ফুল—পিঠে ঝুড়ি বয়ে ফেরা পাহাড়ী মেয়েরা---কিন্তু...কিন্তু ...এতো কুয়াশা যে ! কুয়াশাতে ঢেকে রাখায় দেখছি কিছুই আর পরিষ্কার করে দেখতে পাচ্ছি না!
--------
PA to Director, Industries, Govt. of Arunachal Pradesh, Itanagar—791111, phone:94362-53342, 0360-2290768; e-mail:ajantadotc@yahoo.in
অনুবাদ শুরুঃ ২৬-০৫-০৯ ::::শেষঃ ৩০-০৫-০৯