‘জাতি’ শব্দটির বিচিত্র সব অর্থের সঙ্গে আমরা ভারতীয়েরা সেই আবহমান কাল থেকে পারিচিত । কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে তার আরো তিনটি অর্থের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তার একটি ‘ভারতীয় জাতি’, দ্বিতীয়টি ‘হিন্দু জাতি’ আর তৃতীয়টি ‘মুসলমান জাতি’। এই শব্দগুলো জন্মালো স্পষ্টতই ‘ব্রিটিশ জাতি’কে নকল করবার প্রেরণার থেকে। সেই ব্রিটিশ , যারা নিজের দেশে মূলত ইংরেজদের আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে স্কাটিশ,আইরিশদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা ছাড়াও পৃথিবীর যেখানে গেছে সেখানেই চেষ্টা করেছে আদিবাসিদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। আমিরিকা, অস্ট্রেলিয়া তার দুট বড় নিদর্শন। ১৯০৫এর বাংলাভাগের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পর থেকে ‘জাতি’ শব্দটি ভারতে রাজনৈতিক বাদানুবাদের কেন্দ্রে চলে এলো। দুই বিশ্বযুদ্ধের বাতাবরণও তাতে ইন্ধন যোগালো। হিটলারের ফাসিবাদের পেছনেও ছিল সেই জাতীয়তাবাদের প্রেরণা। তার উল্টো পিঠে আরো অনেকের সঙ্গে প্রবল হল ইহুদি জাতীয়তাবাদ।
বিলেতিদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলেও ওদের মতো হবার এবং সম্ভব হলে ওদের টেক্কা দেবার ঔপনিবেশিক ঝোঁকটা আমাদের ছিল বরাবরই। সুতরাং আমরাও এক ‘ভারতীয় জাতি’র স্বপ্ন দেখলাম। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধাবার লোক আমাদের ঘরেই ছিল। ‘হিন্দু এবং মুসলমান’ জাতীয়তাবাদ সেরকম দুটো প্রত্যাহ্বান। ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা বলতে চাইল ধর্ম কখনো জাতীয়তাবাদের আধার হতে পারে না। এক্কেবারে মিথ্যে বলছিলেন তাঁরা। অরবিন্দ থেকে গান্ধী সব্বার জাতীয়তাবাদের আধার ছিল এক নম্র হিন্দুত্ব। ১৯৪৭এর বাংলাভাগের পক্ষে দাঁড়িয়ে অরবিন্দ তাঁর খোলস ঝেড়েও ফেলেছিলেন। কিন্তু এহ বাহ্য। গোটা বিশ্বের কোনো জাতিরাষ্ট্রই প্রকৃতার্থে ধর্ম সম্পর্ক শূণ্য হতেই পারে নি। মায়, বারাক অবামাকেও মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদে জিতে আসতে তাঁর মুসলমানমূলীয় হবার বাস্তবতাকে আড়াল করবার জন্যে যথাসাধ্য করতে হয়েছিল। ইসলামী মৌলবাদের কথা যারা বলেন, তাঁরা ভুলে যান কী করে যে বিশ শতকের দুই বিধ্বংসী জাতীয়তাবাদ জার্মান ও ইহুদি জাতীয়তাবাদের অন্যতম আধার স্পষ্টতই ধর্ম?
এই চালাকিগুলো ভারতের মার্ক্সবাদিরা শুরু থেকেই ধরে ফেলেছিলেন। তাই তারা যেমন বলছিলেন , ধর্ম জাতীয়তাবাদের আধার হতে পারে না, তেমনি বলছিলেন ভারতীয় বলে কোনো জাতি গড়ে উঠবার দিল্লী এখনো অনেক ‘দূর অস্ত!’ এমন কি , বাঙালি, তেলেগু, তামিল, অসমিয়া এই জাতিগুলোই এখনো গড়ে উঠতে পারে নি ঠিক মতো। এরা গড়ে উঠবার প্রক্রিয়াতে আছে মাত্র! বেশ! আর যায় কোথায়! জাতি গঠনের মাদকতার থেকে এরাও মুক্ত হতে পারলেন না! এরা ‘জাতি’র এক নতুন সংজ্ঞা জোগাড় করলেন! যোগালেন যোসেফ স্তালিন। স্তালিন জানালেন, “জাতি হচ্ছে একই ভাষা, একই বাসভূমি, একই অর্থনৈতিক জীবন এবং একই মনস্তাত্বিক কাঠামো—সাধারণভাবে এই চারটা বৈশিষ্ট সম্পন্নতার উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠা এক সুস্থির জনসমষ্টি।” ভারতীয় মন বলে কথা । বিলেতিদের মতো হও, পারলে ওদের টেক্কা দাও। সেই রোগ থেকে বামেরাও মুক্ত হলেন কৈ! বিনা প্রশ্নে , সেই থেকে ভারতীয় বামপন্থার এটিই মূল মন্ত্র! অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের পরিভাষাগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখলে সবাই দেখবেন এগুলো বামপন্থীদের থেকে ধার করা। তার মধ্যে জনপ্রিয়তমটি হচ্ছে ‘অসমিয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া’। প্রতিষ্ঠিত সমস্ত অসমিয়া বুদ্ধিজীবিদেরকে সেই প্রক্রিয়ার ভেতরেই পাওয়া যাবে। কারো সাধ্য নেই সেই প্রক্রিয়ার বাইরে দাঁড়িয়ে কোনো কথা বলেন! ইসমাইল হোসেন, যিনি নতুন সাহিত্য পরিষদের সদস্য এবং সুযোগ পেলেই বরাক উপত্যকার বাঙালিদের গালি গালাজ করে থাকেন, সেই বামপন্থার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। তেমন আরো অনেক আছেন। আপনি নাম করুন, তাঁকে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই পেয়ে যাবেন! হীরেন গোঁহাই সম্প্রতি এক জাতীয় অভিবর্তনের আয়োজন করলেন, সেই জাতীয়তার বাইরে রাখলেন বাঙালি –বিহারি শ্রমিকদেরও! তিনি কিন্তু শ্রমিক দরদি বামপন্থী!
পশ্চিম বাংলার সরকারি বামদেরে আপনি সবসময়েই বাঙালি জাতীয়তার পক্ষে পাবেন। ওদের রাজ্যেও যে ভাষিক সংখ্যালঘুদের দশা অসমের থেকে একচুলও ভালো নয় তা নিয়ে কোনো বামপন্থীদের কখনো উচ্চবাচ্য করতে দেখবেন না! এই প্রশ্ন কাউকে ওঠাতে দেখবেন না যে যোসেফ স্তালিনের সেই আদর্শ জাতিটি ছিল কোন দেশে? কোত্থাও না!
স্তালিন এবং তাঁর উত্তরসূরিরা বরং সেরকম এক আদর্শ রাষ্ট্র পরে গড়ে তুলতে চাইছিলেন। তাই করতে গিয়ে ওরা ‘জাতিগুলোর মুক্ত সম্মেলন’ সোভিয়েতের অন্য রাষ্ট্রগুলোর উপর রুশি আধিপত্য কায়েম করতে গেছিলেন। নব্বুইর দশকগুলোতে সোভিয়েত ভেঙ্গে যাবার অন্যতম কারকগুলোর একটি এও ছিল। ভেঙে যাওয়া রাষ্ট্রগুলোও যে আদর্শ জাতি রাষ্ট্র নয় তার অতি সাম্প্রতিক নজির জাতি দাঙ্গা জর্জরিত কিরঘিজস্তান। আর আমাদের পাশের চিন দেশটি যে কেমন বর্বর জাতিরাষ্ট্র সেতো আমরা তিব্বতী, উইঘুরদের আন্দোলনের দিকে তাকালেই টের পাচ্ছি !
২১ জুলাই ভাষা শহিদদিবসকে সামনে রেখে কথাগুলো বলছি কেবল এরজন্যে যে, বরাক উপত্যকাতেও প্রতিষ্ঠিত ধারার দলীয় কিম্বা দল বহির্ভূত বামপন্থী বুদ্ধিজীবিরা অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের নিদান দিতে গিয়ে বাংলা ভাষা ভিত্তিক এক জাতীয়তাবাদের কথা বলে থাকেন। এবং বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে সে জাতীয়তাবাদ ক্রমশই প্রবল হচ্ছে। সম্প্রতি এক বুদ্ধিজীবিতো আরেকটু এগিয়ে গিয়ে লিখেছেন, “...রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক অধিকারের জায়গা থেকে অনেক বেশি জরুরি গুয়াহাটি, নগাঁও, লামডিং কিংবা ডিব্রুগড় , বিজনি ধুবড়ি, গোসাইগাঁও, বঙাইগাওয়ে উনিশে উদযাপিত হওয়া।” এ পর্যন্ত প্রস্তাবটি সাধু। সেটা আজকাল কিছু কিছু হয়েও থাকে। তাতে আপত্তির কিছু নেই। তারপরেই লিখেছেন, “তখনই বুঝব সংগঠিত হচ্ছে বাঙালি। এই প্রচেষ্টাই শুরু হওয়া প্রয়োজন। বদরুদ্দিন আজমল এবং চিত্ত পালদের ফতোয়াবাজিকে প্রতিহত করতে গেলেও ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধে অখণ্ড অভিবাজ্য বাঙালি জাতিসত্বা নির্মাণের প্রক্রিয়া এখনই শুরু হওয়া দরকার। উনিশে মের পঞ্চাশ বছরে এটাই হোক থিম।” ( উনিশ নিয়ে অন্য কথা; জয়দীপ বিশ্বাস; দৈনিক যুগশঙ্খ, ১৯ মে, ২০১০) । এই হচ্ছে বামপন্থা! একটি প্রাকৃতিক ঘটমান সামাজিক প্রক্রিয়া নিয়েও সে ‘শুরু হওয়া দরকার’ ভাবতে পারে! উপরের উদ্ধৃতিটিতে নিম্নরেখ আমাদের। এমন অসমিয়া বাক্যও এঁদের অসমীয়া সতীর্থরাও আকছার লিখে থাকেন! বদরুদ্দিন আজমল এবং চিত্ত পালেরা কোনো ধর্মীয় ফতোয়াবাজি করেন নি। বরং সেই অসমিয়া জাতিসত্তা নির্মাণের ধ্বজা তুলে ধরেছেন, যা বামপন্থীরাও সগৌরবে বয়ে বেড়ান। এখানে অসমিয়া মূলধারার বামপন্থীদের কোনো বিরোধ নেই! ‘নতুন পৃথিবী’র মতো কাগজ পড়লেই যে কেউ আমাদের পক্ষের সমর্থন পেয়ে যাবেন! এই ‘নির্মাণ প্রক্রিয়া’র মোদ্দা কথা হচ্ছে, ভাষার নামে সব্বাইকে এক করো, আর সমস্ত পরিচিতির বৈচিত্রকে বিলোপ করো! সেই ভারতীয় বৈচিত্রকে ওরা বিলোপ করতে চান যার গৌরব রবীন্দ্রনাথই প্রথম তুলে ধরেছিলেন ইঊরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে নস্যাৎ করে!
এবারে, যারা ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভয়াবহতাকে জানেন তারা এই ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মধ্যে মুক্তিপথের দিশা পেয়ে থাকবেন। চট করে ধরতে পারেন না এতে গলদ কোথায়! বরঞ্চ বর্তমান লেখকের বিরুদ্ধে বেশ চটেও যাবেন! গলদ এই যে, ভয়াবহতাতে এই জাতীয়তাবাদ যে কম কিছু নয় তা ঐ লেখকের পুরো রচনা, যেটি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বহু পাঠকও পড়েছেন, তার প্রথমাংশ জুড়েই রয়েছে। এওতো এমনই হলো--- ইসলামী জাতীয়তাবাদ থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ ভালো, অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদ থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভালো! এই জাতীয়তাবাদিদের এক অন্ধ বিশ্বাস আছে যে হিন্দু বাঙালিরা এক্ষেত্রে বেশ উদার হয়! বাকিরাই যত নষ্টের মূল!
বাঙালি হলেও ব্রহ্মপুত্রের বাঙালির যে এক স্বাতন্ত্র্যের জায়গা রয়েছে তার উল্লেখ করতে লেখক ভুল করেন নি। কিন্তু তাকে মেনে নিতে অস্বীকার করবার প্রবণতা এই জাতীয়তাবাদের মধ্যেও প্রবল। জাতীয়তাবাদ মাত্রেই যেরকমটি ঐক্যনীতির উপর ভিত্তি করে দাঁড়াবার চেষ্টা করে তাকে রবীন্দ্রনাথই কেবল খুব ভালো চিনতে পেরেছিলেন, সেই ঐক্যনীতিকে তিনি বলেছিলেন ‘অজগর সাপের ঐক্যনীতি।’ যে ‘অভিবাজ্য বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণের প্রক্রিয়া’র কথা বলা হচ্ছে তাতে পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা বা বাংলাদেশের বাঙালিরা জড়াবে কিনা, জড়ালে কতটা আর কী ভাবে, আমরা নিশ্চিত, সেসব প্রশ্নের উত্তর লেখক দিতে যাবেন না। কারণ কোনো জাতীয়তাবাদের তত বিস্তৃত কোনো লক্ষ্য বা কর্মসূচী থাকেই না! ঐক্যের স্লোগানের আড়ালে জাতীয়তাবাদ যে কেমন জাতিকে ভেঙ্গে ফেলে তার ভূরিভূরি প্রমাণ অসমিয়াদের থেকে দেয়াতো যাবেই, কিন্তু শুরুর নজিরটি দেয়া যাবে সেই বঙ্গভঙ্গের রাজনীতি থেকেই!
‘ভাষার নামে জাতি গড়ে আর ধর্মের নামে জাতি ভাঙ্গে’—এই কুসংস্কার আমাদের যত তাড়াতাড়ি বিদেয় হয় ততই মঙ্গল! ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার হিন্দু বাঙালিরা দেখছি হিন্দু পরিচয়েই গৌরব বোধ করে। ‘হিন্দু বাঙালি’ নামে একাধিক সংগঠনও আছে! ‘হিন্দু’ শব্দটির মধ্যি দিয়ে সে আসলে সর্বভারতীয় হিন্দু সত্তার সঙ্গে একত্ব অনুভব করে! ‘খিলঞ্জিয়া’ না হবার বেদনার থেকে অনুভব করে এক কাল্পনিক মুক্তি! বরাকউপত্যকার রাজনীতিতেও যখন কোনো বাঙালি বা মনিপুরি ‘হিন্দু’ নামের আড়ালে সংগঠিত হয় সে তখন আরো বড় ঐক্যের অংশ বলে নিজেকে ভেবে নিয়ে নিরাপদ বোধ করে। ‘হিন্দু’ কিম্বা ‘মুসলমান’ –শব্দদুটো সবসময় কোনো এক ধর্মবিশ্বাসকে বোঝায় না, ঐতিহাসিক ভাবে গড়ে ওঠা এক সম্প্রদায় পরিচয়কেও তুলে ধরে। এই সম্প্রদায় পরিচয় যখন প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে থাকে তখন সে ঐ অতি ক্ষুদ্র ‘বরাকের বাঙালি সত্তাকেই তার একমাত্র পরিচয় বলে তুলে ধরে নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে যাবে কেন ? মুসলমান পরিচয়তো কাউকে বিশ্ব জুড়া আরো বড় সত্তার অংশ করে! তাতে আমাদের সমস্যা হবার কথা নয়! আমাদের সমস্যা হয় তখন যখন কেউ নিজের পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে অন্যের পরিচয়কে অবমাননার আশ্রয় নেয়! সেই সমস্যা শুধু ধর্মের ধ্বজাধারিরাই তৈরি করে না। ভাষার ধ্বজাধারীরাও করে। তাই লেখক সঠিকভাবেই লিখেছেন, “ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে একজন বাঙালিকে “প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য লক্ষণরেখা মেনে চলতে হয়।” কিন্তু এই তিনিও যে ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিদের কথা বলতে গিয়ে অহিন্দুদের কথা ভুলে গেছেন তার নজির এই বাক্যটি , “বর্তমানে বাঙালি হবার অপরাধে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শারীরিক বা মানসিক হেনস্তার শিকার হতে হয় না...।” হিন্দুরাও প্রচুর পরিমাণে বিদেশি নোটিশ পাচ্ছেন, ভোটার তালিকাতে ডাউটফুল হয়ে আছেন সে না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু তিনি সেই সব বাংলা ভাষী মুসলমানেদের কথা ভুলে গেলেন কী করে যাদের প্রতিবার ভোট এলেই বাংলাদেশি সন্দেহে উজান থেকে ভাটি ব্রহ্মপুত্রের দিকে গরুখেদা খেদানো হয়! ভাষা জাতীয়তাবাদের এই হচ্ছে আঁতের কথা, আসল মুখ ।
‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এই বাস্তবতার থেকে চোখ মুদে থাকে মাত্র! সে নিজেকে হিন্দু সত্তার থেকে স্বতন্ত্র করে বটে , কিন্তু মুসলমান বা অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংকটের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করে না! ভাষা জাতীয়তাবাদ নিজে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হানে না, কিন্তু সে রকম কোনো আক্রমণের অস্তিত্বকেও অনেক সময় অস্বীকার করে কার্যত সে পরোক্ষে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়ায়। অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদ তাই ‘নেলি’র আগুনে কলঙ্কিত হয়েছিল । আর গুজরাটের কলঙ্ক গায়ে না লাগালেও সাচার কমিটির প্রতিবেদন দেখিয়েছে ‘বাম প্রগতিশীলদের’ রাজ্য পশ্চিমবাংলাতে মুসলমানদের হালত কেমন! সেই অপরাধের কলঙ্ক ঘুচাতে বাম সরকার যখন সে রাজ্যে মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষণের কথা বলছেন, তখন তাদের সরকারে থাকা দলিত মন্ত্রীরাই বলছেন সে রাজ্যের দলিতরাও খুব ভালো নেই! আর আদিবাসিরা কেমন আছেন জানতে মহাশ্বেতা-কবীর সুমনদের কণ্ঠে কান পাতাই যথেষ্ঠ! ‘ভাষা জাতীয়তাবাদ’ বাঙালির ভেতরে বাইরের এই সব ছোট ছোট অন্যান্য জাতি-বর্ণ-সম্প্রদায় পরিচিতির অস্তিত্ব এবং সম্মানকে নির্বিকার অস্বীকার করে! তাই সে কোথাও গিয়ে পৌঁছুতে পারে না! অসমিয়া জাতীয়তাবাদ আজ প্রায় কোনঠাসা! বাঙালি জাতীয়তাবাদের বরাক উপত্যকাতে আজ অব্দি কোনো অর্জন নেই! আর বাংলাদেশ ! সে আজ অব্দি নিজেকে পাকিস্তানের চরেদের থেকে মুক্ত করতে পারে নি!আমেরিকার থেকেতো দূর অস্ত! অমুসলমানেরা, অবাঙালিরা মোটেই নিরাপদে নেই সে দেশেও! আমরা কি কোনো নতুন পথে পা বাড়াতে রাজি আছি? মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে আমাদের প্রতিষ্ঠাকে বিপন্ন করবার ঝুঁকি নিতে রাজি আছি তো? এই না হয় হোক, ২১শের জিজ্ঞাসা!
ঐ লেখাতে জয়দীপ অর্ধ সত্য লিখেছেন, “ ১৯৮৬র ২১শে জুলাই যখন দিব্যেন্দু-জগন্ময় করিমগঞ্জে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিলেন, তখন ...সেবা সার্কুলারের বিরোধিতায় বরাক উপত্যকা উত্তাল। কিন্তু কী আশ্চর্য সেই সময়েও লামডিং বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অন্যত্র কোনোও উত্তাপই সঞ্চারিত হয় নি।” আমার মনে আছে বরাক উপত্যকা সংগ্রাম সমন্বয় সমিতির সেন্ট্রেল রোডের কার্যালয়ে এক সন্ধ্যে বেলা ‘সারা অসম বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশনে’র নেতৃত্ব গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারা এসছিলেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার থেকে আন্দোলনের গতিবিধি বুঝতে। এরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও সেদিন এমন বেশ কিছু উদ্যোগের সঙ্গী ছিলেন। বাঙালিদের তারা সেদিন তেমন সংগঠিত করতে না পারলেও সেই আন্দোলন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও সেদিন প্রবল ঢেউ তুলেছিল। ১৯শের পঁচিশ বছর উদযাপনের দিনে সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি গান্ধী বাগে যে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল তাতে প্রধান অতিথি ছিলেন আটসুর তখনকার সভাপতি ড০রণোজ পেগু। এই আটসু ও রনোজ পেগুর নেতৃত্বে সেদিন অসমের সমস্ত জনজাতীয় সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল । পাশের জেলা উত্তর কাছাড়েও সেরকম দু’দুটো সারা অসম ভিত্তিক সম্মেলন হয়েছিল । যেখানে সমন্বয় সমিতি ছাড়াও ‘আকসা’র নেতৃবৃন্দও যোগ দিয়েছিল! সেই ঐ জনজাতীয় সংগঠন গুলো ২১শের গুলি চালনার পরে পরেই হুমকি দেয় ১৫ আগষ্টের মধ্য সেবা সার্কুলার প্রত্যাহার করতে হবে! সেই হুমকিতে সরকার পিছু হটে। সার্কুলারটি সরকার ১৫তারিখেই স্তগিত করে। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি, এর পরে পরেই বডোল্যাণ্ড আর কার্বি স্বায়ত্ব শাসিত রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন অন্য মোড় নিয়ে নেয়। আটসুর নেতৃত্বে গড়ে উঠে আর্মকা, আর আর্মকা আলফার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক গণযুদ্ধ শুরু করে! ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হন সৌরভ বরা! বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদকে দাঁড় করাতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙ্গালি আর দুই উপত্যকার অবাঙালিদের এই গৌরবময় সত্যকে আড়াল না করলেই কি নয় ! নয়! কারণ এরই নাম “জাতি গঠন প্রক্রিয়া!” এই প্রক্রিয়া অন্যের অস্তিত্ব, অবদান সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে, অবনমন করে, বিলোপ করে।
সেরকম সমস্ত প্রক্রিয়ার বাইরে বেরিয়ে সমস্ত অপমানিত জনগোষ্ঠি আর পরিচিতির পক্ষে দাঁড়ানোই হোক ২১শের প্রতিজ্ঞা!
No comments:
Post a Comment