(জন্মদিনে সুকান্ত স্মরণে তিনসুকিয়ার ইউ সই টিভি চ্যানেলের জন্যে প্রস্তুত বক্ততা)
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান:
এই গেল সপ্তাহে অসমের প্রায় সমস্ত কাগজে গুয়াহাটি শহরের একটি সংবাদ ছিল এরকম। মরিয়ম বেগম বলে এক শ্রমিক পত্নী সন্তান প্রসব সম্ভাবনা নিয়েই বাসে চেপে মফসসলের বাড়ি থেকে গুয়াহাটিতে স্বামীর কাছে আসছিলেন। বাসের ভেতরেই প্রসব বেদনা শুরু হওয়াতে বাসটি তাকে গুয়াহাটি কমার্স কলেজের সামনে নামিয়ে রেখে চলে যায়। সভ্রান্ত-শিক্ষিত মানুষের ভীড়ে সেই মহিলার একটুকুও স্বচ্ছন্দ আশ্রয় মেলেনি। সেই পথের ‘পরেই পথচলতি কিছু মানুষ একটু আড়াল তৈরি করে দেন। সেখানেই ভদ্রমহিলা দুটি যমজ সন্তানের জন্ম দেন। পরে অবশ্যি খবর দিলে ‘মৃত্যুঞ্জয়’ এসে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেই প্রতিকূল পরিবেশে জন্ম নিতে গিয়ে একটি সন্তান জন্মেই আহত হয়। এবং পরে মারা যায়। স্বাধীনতার ছ’টি দশক অতিক্রান্ত করেও যখন এমন ঘটনা আমাদের সমাজে আকছার ঘটে তখন কি মনে হয় না সুকান্তের সেই অঙ্গীকার এখনো কেমন জ্বলজ্যান্ত ভাবে প্রাসঙ্গিক। মনে পড়ে? যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুমঃ
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা ‘ছাড়পত্রে’ সুকান্ত লিখছেনঃ
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনাঃ
সুকান্ত লিখেছিলেন ওই একই কবিতার শেষেঃ অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।।
সশরীরে এই কবি আজ আর নেই আমাদের কাছে। এমন কি ৪৭এর ১৫ আগষ্ট যেটুকু স্বাধীনতা আমাদের জুটেছে তার ক’মাস আগেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি, তাঁর কবিতা এখনো বর্তমান। ইতিহাসের সামগ্রী হতে তাঁর এখনো অনেক বাকি মনে হয় না কি?
আমাদের স্বাধীনতার বছরটির সঙ্গে এই কবির জন্ম মৃত্যু দিনটির এক আশ্চর্য সংযোগ রয়েছে। ১৫ আগষ্ট তাঁর জন্ম দিন। বছর ১৯২৬। ১৯৪৭ তাঁর মৃত্যুর বছর। রবীন্দ্র জন্ম জয়ন্তীর মাত্র ক’দিন পর ১৩মে। এই বিশ বছর ন’মাস দিনেই তিনি ছাড়পত্র ( ১৩৫৭), ঘুমনেই ( ১৩৫৭), পূর্বাভাস (১৩৫৭), মিঠেকড়া ( ১৩৫৮), অভিযান (১৩৬০), হরতাল ( ১৩৬৯), গীতিগুচ্ছ ( ১৩৭২), কবিতালিপি ( ১৯৮৩) ইত্যাদি আটটিরও বেশি গ্রন্থে ছড়ানো ছিটানো গান,কবিতা, গল্প,নাটক, প্রবন্ধের রচয়িতা। পথে পথে মিছিলে মিছিলে শোনা যাচ্ছে তাঁর অঙ্গীকার ,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
কিম্বা ,
বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
তের চৌদ্দ বছরের কবির কবিতা পড়ে মুগ্ধ তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ‘পদাতিকে’র কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর বন্ধু হয়ে যাচ্ছেন। পরে তিনিই তাঁর বেশির ভাগ গ্রন্থের সম্পাদনা করছেন ও ভূমিকা লিখছেন। ‘পরিচয়’, ‘কবিতা’র মতো সেকালের সেরা কবিতা পত্রিকাতে তাঁর কবিতা বেরুচ্ছে।
সারা বাংলা কিশোর বাহিনীর তিনি উদ্যোক্তা ও নেতা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বীরেরা জেলথেকে ছাড়া পেয়েই কলকাতার যক্ষা হাসপাতালে আসছেন কবির সঙ্গে দেখা করতে আর তাঁকে অভিনন্দন জানাতে। তাদেরই কেউ তাঁকে জানাচ্ছেন তখনই এই বিশবছরের কবির জীবনী বেরুতে যাচ্ছে আমেরিকা আর ফ্রান্সে! এই সম্মান তাঁর জুটছে কেবল কবি হবার জন্যে নয়। কেবলি কাগজে লিখে ‘অঙ্গীকার’ জানাবার লোকতো তিনি ছিলেন না। ছিলেন একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপোসহীন সংগ্রামী। কমুনিষ্ট পার্টির সারাক্ষণের কর্মী। সেই কাজে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করলেন তাতেই না তাঁর শরীরে প্রথম ম্যালেরিয়া ও পরে যক্ষা বাসা বাঁধে এবং অকালেই তাঁর প্রাণটি কেড়ে নেয়।
তাঁর রচনার সংখ্যা এমনিতে খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু যদি তাঁর বয়সটির কথা মনে রাখি, তবে সেই সংখ্যা অবিশ্বাস্য। তাঁকে আমরা কবি হিসেবেই জানি। কিশোর কবি। কিন্তু যেমন রবীন্দ্রনাথ কেবল কবি ছিলেন না । সুকান্তও ঐ বয়সেই লিখেছিলেন কবিতা ছাড়াও, গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠেই বেশ বোঝা যায় ঐ বয়সেই তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটিই শুধু আয়ত্বে আনেন নি, সে নিয়ে ভালো তাত্বিক দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন। অথচ ১৯৪৫এ প্রবেশিকা পরীক্ষাতে তিনি অকৃতকার্য হয়েছেন। স্কুলের ছাত্র হিসেবে ভালো মার্ক্স পাওয়া মেধাবী ছাত্র হবার নজির তাঁর নেই তেমন। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ঝিমিয়ে গেলে আবার স্কুলে যেতে হচ্ছে বলে তিনি বেশ হতাশই হয়েছিলেন।
নিবারণ ভট্টাচার্য ও সুনীতি দেবী্র এই ক্ষণজন্মা সন্তান সুকান্ত জন্মেছিলেন এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা জ্যাঠাদের পূব বাংলার ফরিদপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে কলকাতা এসে বহু সংঘাত সংঘর্ষের মধ্যি দিয়ে থিতু হতে হয়েছিল। একান্নবর্তী পরিবারটিকে ধরে রেখেছিলেন তাঁরা।
তাঁদের বাড়িতে সাহিত্যের এক ভাল পরিবেশ ছিল। মনীন্দ্রলাল বসুর ‘রমলা’উপন্যাসের নায়ক সুকান্তের নামেই আদরের ভাইটির নাম রেখেছিলেন জ্যাঠতুতু দিদি রানি। রানিদিদির উৎসাহেই লেখালেখিতে সুকান্তের হাতে খড়ি। মনীন্দ্র বসুর উপন্যাসের সুকান্তকেও অকালেই যক্ষা রোগে চলে যেতে হয়েছিল। কবি সুকান্তেরও সেই একই গতি হবে রানিদি নিশ্চয়ই স্বপ্নেও ভাবেন নি। এই সংযোগ দেখতে পাবার বহু আগেই সেই রানিদির হঠাৎ মৃত্যু হয়েছিল। সুকান্তের বয়স তখন মাত্র সাত বা আট। তার পরেই বাবা জ্যাঠাদের পরিবার আলাদা হয়ে যায়।
সেই আট ন’ বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। এটি পরে তাঁর ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন যখন তখন বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তাঁর আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন।
১৯৪১ পর্যন্ত এসে কলকাতা রেডিওর গল্পদাদুর আসরের নিয়মিত যোগদাতা ছিলেন সুকান্ত। সেখানে প্রথমে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। গল্পদাদুর আসরের জন্য সেই বয়সেই তাঁর লেখা গান মনোনীত হয়েছিল আর সুর দিয়ে গেয়েছিলেন আর কেউ নন সেকালের অন্যতম সেরা গায়ক পঙ্কজ মল্লিক। স্কুলের লেখাপড়াতে খুব ভালো ছিলেন সে খবর তেমন মেলেনা। কিন্তু তাঁর প্রতিভা যে ছিল প্রশ্নাতীত তা এই সব সম্মান আর স্বীকৃতিতেই প্রমাণ মেলে।
আমার ঠিকানা খোঁজ ক’রো শুধু সূর্যোদয়ের পথেঃ
দাদা সুশীল ভট্টাচার্যের বন্ধু বারীন্দ্রনাথ ঘোষের সংস্পর্শে এসে সুকান্ত সাম্যবাদী চেতনাতে উব্দুদ্ধ হন এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তিনিতো আর শুধু স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখতেন না। তিনি যে ‘নতুন চিঠি আসন্ন যুগের’ পেয়েছিলেন সে ছিল সাম্যবাদের। তিনি যখন পার্টিতে যোগ দেন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বিয়াল্লিশের 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের দামামা বাজছে। আর ওদিকে বাংলার ভয়ঙ্কর পঞ্চাশের মন্বন্তর। নিজের শেষ জীবনের সেরা রচনাটি ‘সভ্যতার সংকট’ লিখে রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হয়েছেন। সব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের উপর সমস্ত বিশ্বাস হারিয়েও লিখে গেছেন , 'মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ লিখে গেছেন ‘জন্মদিনে’ কবিতায় তাঁর উইল পত্র ঃ
‘আমার কবিতা , জানি আমি ,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী ।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন ,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন ,
যে আছে মাটির কাছাকাছি ,
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।"
বলা হয়ে থাকে সুকান্ত সেই কবি। এ একটু বাড়াবাড়ি। কেননা এ কবিতা রবীন্দ্রনাথের বিনয় মাত্র। তিনি নিজেই চিরদিন সেই জনটি ছিলেন , কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন ,/কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন’ । মনে পড়ে জীবনের প্রথম ভাগেই সেই চিত্রা কাব্যগ্রন্থের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতাতে রবীন্দ্রনাথ আর একবার কোনো এক কবিকে সম্বোধন করে লিখছেনঃ
“কবি , তবে উঠে এসো — যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লহো সাথে , তবে তাই করো আজি দান ।
বড়ো দুঃখ , বড়ো ব্যথা — সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়োই দরিদ্র , শূন্য , বড়ো ক্ষুদ্র , বদ্ধ , অন্ধকার ।
অন্ন চাই , প্রাণ চাই , আলো চাই , চাই মুক্ত বায়ু ,
চাই বল , চাই স্বাস্থ্য , আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু ,
সাহসবিস্তৃত বক্ষপট । এ দৈন্যমাঝারে , কবি ,
একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি ।”
সে ছিল রবীন্দ্রনাথের বাকি জীবনের কাজের ইস্তাহার। তার তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ‘শ্রীনিকেতন’। হ্যাঁ, সুকান্তদের মতো তিনি সরাসরি বিদ্রোহের পথে হাঁটেননি বটে। সম্ভবত তাই জীবনের শেষে ওমন আরেক কবির ‘বাণী-লাগি কান পেতে’ ছিলেন। কিন্তু সেরকম কবি তখন আরো অনেক ছিলেন। একা সুকান্তকে সে দায় দিলে তাঁর গৌরব বাড়ে হয়তো, কিন্তু তাঁর সমকালের পরিবেশটিকে বোঝা যায় না। সুকান্তের বন্ধু , তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থের সম্পাদক ‘পদাতিকে’র লেখক সুভাষ মুখপাধ্যায়ের কথা ভুলা যাবে কী করে? যাঁর ‘পদাতিকে’র প্রথম কবিতার পংক্তিগুলোই ছিল এরকমঃ
“প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন আত্মা।“
কাস্তের কবি দিনেশ দাশকে ভুলি কী করে, যার সেই কবিতার পংক্তি এক সময় মুখে মুখে ফিরতঃ
নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালবাসতে?
চাঁদের শতক আজ নহে তো
এ-যুগের চাঁদ হ'লো কাস্তে!
এমন তখন আরো অনেক ছিলেন। অরুণ মিত্র, সরোজ দত্ত, বীরেন্দ্র চট্টপাধ্যায়, সমর সেন এমন আরো কত! ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা না হয় ভুলে থাকাই গেল, তখন সময়টাই এমন ছিল যে ‘পথের পাঁচালী’র আনন্দ যাত্রার পাঁচালীকার আপাত উদাসীন লেখক বিভূতি বন্ধোপাধ্যায়ের কন্ঠেও সেদিন শোনা গেছিল ‘অশনি সংকেত’। পঞ্চাশের আকালের উপর লেখা উপন্যাস। তখনকার বহু কবি লেখক গোটা ভারতেই হয় সরাসরি কমিউনিষ্ট পার্টিতে নাম লিখিয়েছেন, না লেখালেও ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘে’ ছিলেন না এমন কবি লেখক শিল্পীদের নাম করা মুস্কিল! বুদ্ধদেব বসুর মতো ‘কবিতা’ নিবেদিত প্রাণও দূরে সরে থাকতে পারেন নি।
| ||
From Sukanta Kar |
যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে
এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর আকর্ষণ এতোটাই ছিল যে তিনি রীতিমত সাধনা করে নিজের হাতের লেখাকেও রবীন্দ্রনাথের মতো করে তুলেছিলেন। দু’জনের হাতের লেখা পান্ডুলিপি দেখলে চট করে অনেকে ধরতে পারবেননা কোনটা কার লেখা।
| ||
From Sukanta Kar |
তাই বলে তাঁর লেখাগুলো হারিয়ে যায় নি। তাঁর বন্ধুরা , অনুগতরা তাঁর সেই লেখালেখিগুলোর অনেকটাই সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এবং সেগুলো ছেপে সংরক্ষিত করতে পেরেছেন। ভাগ্যিস, এখানে ওখানে প্রচুর প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লেখা। পার্টির কাগজ ‘স্বাধীনতা’র কিশোর বিভাগ তিনি নিজেই সম্পাদনা করতেন। আকালের দিনগুলোতে ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। বাংলার কিশোর বাহিনী থেকে তাঁর ও অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্যের সম্পাদনাতে বেরিয়েছিল ‘অপরাজেয়’ , যেখানে তাঁর ‘অভিযান’ কাব্যনাট্যটি প্রকাশ পেয়েছিল। সেসব গ্রন্থও তাঁর লেখা সংগ্রহে সাহায্য করেছিল অনেক। এমনিতে নিজের জীবিতাবস্থাতে তিনি নিজের কোনো কাব্য বা গদ্য গ্রন্থের প্রকাশিত সংকলন দেখে যেতে পারেন নি। তিনি যখন রোগ শয্যাতে তখন ‘ছাড়পত্র’ প্রকাশের উদ্যোগ চলছে। বন্ধু অরুণাচল তাঁকে কিছু ছাপা পৃষ্ঠা দেখিয়েছিলেন মাত্র। একে একে তাঁরাই তাঁর সব লেখা উদ্ধার করে গ্রন্থবদ্ধ করেন। এ পর্যন্ত দু’ই বাংলা থেকেই তাঁর অজস্র রচনা সংকলন বেরিয়েছে।
তাঁর জনপ্রিয়তা এমনই যে আজো বাংলা কিম্বা বাঙালি প্রধান এলাকার যেকোনো গণআন্দোলনে তাঁর কবিতার থেকে পংক্তি বাছাই করে দেয়াল লিখতে কিম্বা শ্লোগান দিতে শোনা যায়। ইতিহাসের কী পরিহাস তাঁরই ভ্রাতুষ্পুত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন সেখানে সংঘটিত হচ্ছে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আর লালগড় ! আর আজকের কবির কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছেঃ
হে কবি সুকান্ত!
তুমি কি জানতে যে
তোমাদেরই বংশে আসবে
এই বাংলার ধ্বংসকর্তা?
তুমি কি জানতে যে
তোমাদেরই বংশে আসবে সে
যে "গরীব মানুষকে চাপা দিয়ে
বড়লোকের মোটরগাড়ী" বানাবার
সব আয়োজন পাকা করবে?
কিন্তু এও ঠিক যে, স্কুল পাঠ্য বইতে এখনো সংকলয়িতারা তাঁর কবিতাকে বাদ দিতে না পারলেও উঁচু ক্লাসের সাহিত্যের ইতিহাস লেখকেরা বা তাত্বিকেরা তাঁর কবিতার জন্যে বেশি পৃষ্ঠা বরাদ্দ করেন নি। বাংলা কবিতার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের পর কে ----এই প্রশ্ন এলেই নির্দ্বিধায় তাঁরা আজ জীবনানন্দের নাম নিয়ে থাকেন । আর কারো কারো নাম যোগ দিতে হলে সেখানে বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু , সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তীর নাম চলে আসে, সুকান্তের আসে না। এমন তাত্বিকতা যে পক্ষপাত মুক্ত তা বলা যাবে না। কেন না, সমর সেন , সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিণত কবির নাম না নেয়াটাও আমাদের কৌতুহলী করে। তাই বলে সুকান্তকে বিনা প্রশ্নে কবি হিসেবে গ্রহণ করাটাও হবে আরেক ধরণের পক্ষপাত। এটি ঘটনা যে সুকান্ত চর্চা আজকাল কমেছে। গণআন্দোলন বিহীন পরিবেশে তাঁর কবিতা তেমন পাঠক টানে না। তাঁর, কিম্বা নজরুলের কিম্বা বীরেন্দ্র চট্টপাধ্যাদের কবিতার আবেদনের স্থান কালের পরিসর স্বল্প। বিদ্রোহী –বিপ্লবী কবি হিসেবে তাঁরা নিজেদের পরিচয় গড়েছেন। সে তাঁরা ছিলেন আছেন এবং থাকবেন। কিন্তু বিশুদ্ধ সাহিত্যিক বা কবি হিসেবে কোনো প্রতিষ্ঠা তাঁরা আকাঙ্খাও করেন নি, নেইও। নজরুলত লিখেইছেনঃ
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
সুকান্তও কি ওই কথাই বলতে চাননি যখন লেখেনঃ
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা–
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি।।
সুকান্তের বেলা বয়স একটা সীমা বেঁধে দিয়েছিল। নজরুলের বেলাও কথাটা সত্যি। কেননা বেশিদিন নজরুলও সুস্থ শরীরে লিখে যেতে পারেন নি। কিন্তু তাঁদের গানগুলো দেখায় কোথাও তাঁরা দিক বদল করওছিলেন। রূপ রঙের বৈচিত্র নিয়ে শিল্পী হিসেবে তাঁদের স্থান পাকা করবার সম্ভাবনা পুরো মাত্রাতে ছিল। এবং সেদিকে তাঁর ঝুঁকছিলেনও। কিন্তু সময় বিদ্রোহী-বিপ্লবী সত্বার মধ্যে তাঁদেরকে সবদিক দিয়েই বেঁধে ফেলেছিল।
যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজেঃ
ছন্দ-অলঙ্কারের মতো কবিতার ঔপকরণিক বিষয়গুলোতে সুকান্তের দক্ষতা ঈর্ষণীয় ছিল। সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, রাজনৈতিক বা আদর্শগত বোধ তখনো পরিপক্ক হবার বয়স ছিল না। রবীন্দ্রনাথকেও সেই পরিপক্কতার জন্যে জীবনের নিদেন পক্ষে তিনটি দশক ব্যয় করতে হয়েছিল। তাই তাঁর ‘বিয়েবাড়ির মজা’ কবিতাটির রাজনৈতিক আবেদন আজ আমাদের হাসির উদ্রেক করে। তিনি লেখেনঃ
বললে পুলিশঃ এই কি কর্তা, ক্ষুদ্র আয়োজন?
পঞ্চাশ জন কোথায়? এ যে দেখছি হাজার জন!
এমনি ক’রে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে?
আমরা যারা সেই দুর্ভিক্ষের ইতিহাস জানি তারা জানি যে, “এমনি ক’রে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে?” এই প্রশ্ন করবার অধিকার ব্রিটিশের অধীনস্থ কোনো পুলিশের ছিল না। কবিতার এমন বিচারে যদি কেউ আপত্তি করেন তবে সে দোষ আমাদের নয়। রাজনীতির বার্তা দেয়াকেই যারা কবিতার আসল উদ্দেশ্য মনে করেন তাঁরা নিজেরাই এমন সম্ভাবনার বীজ উৎপাদন করে কবিতাতে বা উপন্যাসে বপন করে রেখে দেন। বিখ্যাত আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা তাঁকে যখন সুকান্তের কবিতা আবৃত্তি করতে ডাকছেন তখন আগে থেকেই জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি যেন ‘প্রিয়তমাসু’ কবিতাটি না পড়েন। কেননা সে কবিতার একজায়গাতে রয়েছেঃ
যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;
পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়
আর সামনে নয়,
এবার পেছনে ফেরার পালা।
এই ‘পেছনে ফেরার’ কথা থেকে আয়োজকদের মনে হয়েছে কবির রাজনৈতিক বিচ্যুতি হয়েছে! তার মানে দাঁড়ালো এই যে রাজনীতির বাতাবরণ পাল্টালেই এমন কবিতার আবেদন পালটে যায়। সযত্ন সংরক্ষণ করতেন না বলে সুকান্তের বহু কবিতা পুনরাবৃত্তির দোষেও দুষ্ট হয়েছে। পড়তে পড়তে মনে হয়, একই কথা বার বার বলছেন, যেমনটি রাজনীতি বা সমাজকর্মের মাঠের কর্মীরা বলে থাকেন। তাঁর বৈষয়িক দরকার থাকলেও শৈল্পিক দরকার একেবারেই নেই। কোথাও কোথাওতো পংক্তিগুলো হুবহু এক প্রায়। যেমন ‘সিগেরেট’ এবং ‘ দিয়াশলাই কাঠি’ কবিতা দুটো।
সিগেরেট’ কবিতাতে লিখছেনঃ
তাই, আর নয়;
আর আমরা বন্দী থাকব না
কৌটোয় আর প্যাকেটে;
আঙুলে আর পকেটে
সোনা-বাঁধানো ‘কেসে’ আমাদের নিঃশ্বাস হবে না রুদ্ধ।
আমরা বেরিয়ে পড়ব,
সবাই একজোটে, একত্রে–
তারপর তোমাদের অসতর্ক মুহূর্তে
জ্বলন্ত আমরা ছিট্কে পড়ব তোমাদের হাত থেকে
বিছানায় অথবা কাপড়ে;
নিঃশব্দে হঠাৎ জ্বলে উঠে
বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে মারব তোমাদের
যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল।।
দিয়াশলাই কাঠি’ কবিতাতে আবারো লিখছেন প্রায় ঐ একই কথাঃ
আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে , গ্রামে–দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়–
তা তো তোমরা জানোই!
কিন্তু তোমরা তো জানো না:
কবে আমরা জ্বলে উঠব–
সবাই শেষবারের মতো!
তেমনি ‘জাগবার দিন আজ’ কবিতাতে আছেঃ
আজকের দিন নয় কাব্যের -
আজকের সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের;
তেমনি আছে ‘মৃত পৃথিবী’তেঃ
আজকের দিন নয় কাব্যের
পরিণাম আর সম্ভাব্যের...
এরকম কিছু ত্রুটি আর সীমাবদ্ধতা সত্বেও আমাদের বিশ্বাস সুকান্ত কোনোদিন ফুরিয়ে যাবেন না। সাহিত্যের ইতিহাসের লেখকেরা বা তাত্বিকেরা তাঁর জন্যে বেশি পৃষ্ঠা বরাদ্দ না করলেও যখনই যেখানে আম ‘জনতার মুখে ফোটে’ উঠবে ‘বিদ্যুৎবাণী’ সুকান্ত সেখানে উচ্চারিত হবেন সে সত্য আমাদের দেখিয়েছে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম। তিনি লিখেছিলেনঃ
যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে
তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে,
বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা
শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা।
আমরাও মনে করি তাঁর সিগারেট, একটি মোরগের কাহিনী, দেশলাই কাঠি, প্রিয়তমাসু, রবীন্দ্রনাথের প্রতি,আঠার বছর বয়স, রানার , অনুভব, লেনিন ইত্যাদি কিছু কবিতা ক্রমেই বাংলার মুষ্ঠিমেয় কিছু ধ্রুপদী কবিতার সারিতে নাম লেখাবে এবং আরো বহু বহু দিন আবৃত্তি তথা পাঠ করা হবে কবিতাগুলো। স্বাধীনতার এতোটা বছর পরেও যে শিশু আগামী কাল জন্ম নেবে তার জন্যে স্থান ছেড়ে দেবার, প্রাণপণে জঞ্জাল সরাবার কাজ এখনো সম্পন্ন হয়ে ওঠেনি। এখনো এ বিশ্বকে তার জন্যে বাসযোগ্য করে তুলা যায় নি। যে মানুষ তাতে হতাশ হয়ে সুকান্তের অঙ্গীকার ভুলে যায় তার মানবতাবোধ, তাঁর শিল্পবোধ আর সভ্যরুচিকে নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি। তাই বলে সুকান্তের মহত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবার মত অশিক্ষা যেন আমাদের আচ্ছন্ন না করে । নবজাতকের কাছে এখনো অম্লান থাকুক আর থাকবে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
6 comments:
Apurbo sir....share karar jonno dhannobad...ami share korchi ar save korchi...
ধন্যবাদ! কিন্তু নাম জানা গেল না যে?
অনেক তথ্য জানা গেল। আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে কবির জন্মদিন নিরবেই। আমারো একজন প্রিয় কবি সুকান্ত। ধন্যবাদ।
সুকান্তের ঢেঊ থেকে থেকে উঠবে সৈকৎ! কখনো উঠবে, কখনো নাববে!
পড়লাম। ভালো লিখেছেন।
ধন্যবাদ সুশান্ত !
Post a Comment