মূল হিন্দিঃ হরি প্রকাশ শর্মা
(লেখকের সম্পর্কেঃ হিন্দি সাহিত্যের এক খ্যাত নামা কবি গল্পকার লেখক ও সমাজ কর্মী হরি প্রসাদ শর্মার জন্ম ১৯৩৪এর নভেম্বরের ৯ তারিখে উত্তর প্রদেশের দাদ্রিতে। যদিও তাঁর বাবার মুল বাড়ি হারিয়ানাতে। তাঁর বাবা ভারতীয় রেলের এক মধ্যবিত্ত কর্মী ছিলেন। এখানে ওখানে বদলি হতেই হতো। যেমন এই গল্পের রাজীবের বাবা। তাই কোনো এক জায়গাতে তাঁর শৈশব কাটেনি। আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন। ষাটের দশকেই কানাডাতে যান উচ্চ শিক্ষার জন্যে পরে সেখানেও অধ্যাপনার কাজে লেগে পড়েন। ভ্যাঙ্কুবারের সিমন ফ্রেসার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সমাজতত্ব পড়াতেন। নেশার মধ্যে ছবি আঁকা, কবিতা গল্প লেখা তাঁর ছিলই। কিন্তু, সঙ্গে ছিল এক রেল কর্মীর পরিবারে জন্মাবার স্মৃতি আর দেশের মাটির টান। তিনি কোনোদিনই ভুলেন নি এই দেশ আর তার মানুষের কথা। তাই বিদেশে থেকেই অচিরেই জড়িয়ে পড়েন দেশের রাজনীতিতে । মাওএর চিন তাঁকে উদবুদ্ধ করেছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধ তাঁকে পথে নামিয়েছিল। সেই যুদ্ধের মাঝেই যখন দেশে নক্সালবড়ির বিদ্রোহ হয়, তিনি সেই আদর্শের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন এবং বিদেশের মাটিতে গড়ে তুলেন Indian People’s Association in North America (IPANA). দীর্ঘদিন এই সংগঠনের ছায়াতলে তিনি দেশের আন্দোলনগুলোর পক্ষে জনমত গড়া, সমর্থণ জোটানো, প্রচার করবার কাজ করে গেছেন। পরে তেমন আরো অনেক আন্তর্জাতিক সংঠনের হয়ে কাজ করেছেন, যে সংগঠনগুলো ভারত সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর হয়ে কাজ করত আর স্বপ্ন দেখত সাম্রাজ্যবাদি বিশ্বের পতনের, তা সে হোক সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ, কিম্বা মার্কিনী। জরুরী অবস্থার সময়ে ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে বিশ্বের জনমত গঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিলে ভারত সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়। ফলে আমৃত্যু তাঁকে বিদেশের মাটিতেই কাটাতে হয়। এ বছর ১৭ মার্চ বহু ভারতীয়ের অজ্ঞাতেই বিদেশের মাটিতে যখন দীর্ঘদিন কর্কট রোগে ভোগে তিনি মারা যান তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫। তাঁর আগেই দেশে বিদেশে ছড়ানো তাঁর বন্ধুরা তাঁর সম্মানে ছেপে বের করেন বই Celebrating Life in Struggle: A Tribute to Hari Sharma (Daanish Books,2009) । এছাড়াও গেল বছর বন্ধু আর অনুরাগীরা তাঁর জন্মদিনে যে বক্তৃতাগুলো পরিবেশণ করেন সেগুলোও ছেপেছে Critical Asian Stydies . বাংলা, অসমিয়া সহ সহ ভারতীয় বেশ কিছু ভাষাতে অনুদিত হয়েছে তাঁর গল্প কবিতা। আমাদের বর্তমান গল্পটিকে নিয়ে দূরদর্শন ইতিমধ্যে এক ধারাবাহকও করেছে, নাম ছিল ‘ওয়াপসি।’ তাঁর সম্পর্কে আরো জানা এমন কিছু সাইটেঃ
এখানে মাত্র মিনিট দুয়ের জন্যে গাড়িটা রাখে।
সে দরজাটা খোলা মাত্র ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা ওকে ঘিরে ফেলল। কান অব্দি কলারটাকে তুলে ধরে, টেনেটুনে তল্পিতল্পা নামিয়ে তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নেমে গেল সে ।
লম্বা একটা বাঁশি বাজল আর ট্রেন চলতে শুরু করল। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একে একে বগিগুলোর পেরিয়ে যাওয়াটা উপভোগ করল। আর তারপরেই সে একা হয়ে গেল। একেবারেই নির্জন। যেদিকে চোখ যায় অন্ধকার। না, ওখানে ওদিকটাতে সামান্য আলো রয়েছে। রেলের অফিস, বোধ হয়। একটা বাঁকানো থামের উপর ছোট্ট কেরোসিনের বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। তার আলোর ছোট্ট রেখাধরে একটি লোক ভেতরে গেল আবার বেরুলো । তারপরেই আবার সব থমথমে।
চিঠিটা বোধহয় সময়মতো এসে পৌঁছোয় নি। কিন্তু সে এটা সপ্তাখানিক আগেই ‘এক্সপ্রেসে’ পোস্ট করেছিল । ভুল স্টেশনে নেমে পড়েনি তো? নিশ্চয়ই সে স্টেশনের নামটা ঠিক করে দেখেনি। এটুকুই সে জানত যে তাকে উন্নাও থেকে তিন স্টেশন পরে নামতে হবে। এও হতে পারে যে স্টেশনগুলো ঠিকমতো গুনেনি। তার ঘড়িটি আঁধারেও দেখা যাবার মতো উজ্জ্বল। চারটে বাজে। এখন তাহলে কী করে? না সে এই ঠান্ডা আর অন্ধকারের মাঝে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, না লটবহরগুলো এখানে ফেলে রেখে কোথাও যেতে পারে। সুটকেস আর হোল্ডওলটা ধরে সে ঐ আলোর রেখা ধরে এগুতে শুরু করল।
কেউ একজন এদিকটাতে এগিয়ে আসছে। হাতে ধরা বাতিটা ছন্দের তালে একবার সামনে একবার পেছনে দুলছে। আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আস্তে আস্তে সে বাতি কাছে এলো এবং শেষে ওর মুখে পড়ল এসে।
“ কে? রাজি?”
“হ্যাঁ, বাবা,” সে বলল। হাতের জিনিসগুলো মাটিতে নামিয়ে রেখে সে তার বাবার পা ছোঁবার জন্যে নোয়ালো।
“ বেঁচে থাকো, বাবা,” বাবা ওকে টেনে তুলে ধরলেন। নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন।
চাপা স্বরে বললেন, “বড় ভালো লাগছে যে তুই এলি!”
“তোর সঙ্গে জিনিসপত্র রয়েছে না?” চট করে স্বর পালটে বাবা জিজ্ঞেস করলেন। “ রেখে দে! রেখে দে এখানে, এগুলো নিয়ে যাবে।” জোরে আদেশের স্বরে তিনি অফিসের দিকে তাকিয়ে ডাকলেন,” এই শম্ভু! এদিকে আয়! তাড়াতাড়ি! এই বেগগুলো বাড়ি নিয়ে যা!”
একটি লোক দৌড়ে এসে বেগদুটো তুলে নিল।
“আমি আরো ভাবছিলাম তুমি আমার চিঠি পেলে কিনা।” অফিসের দিকে এগুতে এগুতে রাজীব বলল।
“ ও হ্যাঁ, চিঠি আমি পেয়েছিলাম। চারদিন আগে...কানপুরে গাড়ি পাল্টাতে কোনো অসুবিধে হয়েছিল? আমি আরো কাউকে সেখানে পাঠাবো ভাবছিলাম...।”
একটামাত্র ঘর আর সামনে ছোট্ট বারান্দা নিয়ে অফিস ঘরটি। বাইরে দেয়াল ঘেঁসে সম্ভবত একটা কলা গাছ, অল্প আলোতে ভালো দেখা যাচ্ছিল না। বারান্দায় ওজন করবার মেশিনটার উপর গা ছড়িয়ে একটা কালো কুকুর শুয়ে রয়েছে।
বাবার পেছনে পেছনে রাজীব অফিসে গিয়ে ঢুকলো। এখানে আলো রয়েছে। একটা বড় টেবিলে ডিম্বাকার চিমনির ভেতরে কেরোসিনের বাতি রাখা রয়েছে। টেবিলের উপার ভারি, বালুর মতো বাদামি কাগজের স্তূপ। কাঠের একটা কালির দোয়াত, কালিতে একেবারে কালচে হয়ে পড়েছে। ঘরের একপাশে টিকিট বুকিঙের জানালা। কাছেই টিকিটে ভরা এক বড় আলমিরা । পায়ের দিকে বড় এক ছিটকিনি লাগানো। আরেক কোনে টেলিগ্রাফ মেশিনটি রাখা, অনবরত সেই চেনা শব্দ শুনিয়ে যাচ্ছেঃ গ্যাট-গ্যার-গার- গ্যাট...
রাজীব চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সেই পুরোনো চেনা দৃশ্য। যে বয়স থেকে চারপাশের জগতকে চিনতে শুরু করেছে তখন থেকেই দেখে আসছে। অনেকগুলো স্টেশনে, একের পর এক সেই একই জিনিসের সমাবেশ , বারে বারে কতবার সে দেখেছে এগুলো...
“দাঁড়া আমি গাড়ি ছাড়ার খবরটা পাঠিয়ে দিই,” টেলিগ্রাফের দিকে এগুতে গিয়ে বাবা বললেন।
গ্যাট-গ্যার- গ্যার- গ্যার- গ্যার- গ্যাট- গ্যাট-গার- গার...
তাঁর হাতের মধ্যমা দ্রুত ছুটছিল আর খবরটি পাঠাচ্ছিল। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রাজীব বাবাকে দেখছিলঃ একটা কম্বল তার মাথা থেকে হাঁটু অব্দি ঢেকে রেখেছে, এক কোন পায়ের প্রায় গোড়া অব্দি নেমে গেছে। পায়ে উলের মোজা রয়েছে আর খোলা চপ্পল। এই ক’মাসে, মনে হলো , তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এতো বয়সে এতো শীতের রাতে কাজ করতে হয় !
সে টেবিলের কাছে রাখা কাঠের চেয়ারটাতে বসল। বাবা সেটি দেখতে পেলেন। “ঘুম পেয়েছে?” জিজ্ঞেস করলেন। জবাবের অপেক্ষা না করেই তিনি ডাক দিলেন ,”শম্ভু!”
“ ওতো সেই বেগগুলো নিয়ে গেছে!” রাজীব মনে করিয়ে দিল।
গ্যাট-গ্যার- গ্যার- গ্যার- গ্যার- গ্যাট- গ্যাট-গার- গার...
তিনটি ধ্বনির সেই একই আওয়াজ। অনেক আগে, সে যখন স্কুলে পড়ত, এগুলোতে যদি কিছু কাজ করতে পারে কত চেষ্টা করত! বাবা তাকে শিখবার জন্য চাপ দিতেন। যদি খানিকটাও শিখতে পারে, বাবা বলতেন, মেট্রিক দিয়ে দিলেই রেলে সে একটা চাকরি যোগাড় করে নিতে পারবে।কিন্তু...
খবরটা পাঠানো হয়ে গেছে। “আমার মনে হচ্ছে না রেলে তুই খুব একটা ঘুমোতে পেরেছিস বলে,” টেবিলের ওপাশে আরেকটা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন বাবা।
“ না, ওই খানিকটা। কানপুরে মাঝরাতে ট্রেন পাল্টাতে হলো কিনা।”
বাবা চশমা পরে ওর সামনে রেজিস্টারে এন্ট্রি দিতে শুরু করলেন। বাইরে ঘন অন্ধকার! হাড় হিম করা কুয়াশা। কোটের পকেট থেকে রাজীব হাত বের করতে পারছিল না। ডান পকেটে রাখা সিগেরেটের প্যাকেটে গিয়ে ওর আঙুলের চোঁয়া লাগল। হঠাৎই ওর সিগেরেট খাবার ইচ্ছে জাগল। কিন্তু, না, বাবার সামনে নয়...
“ দিল্লিতে আর সব ঠিকঠাক চলছে? পাপু তুন্নিরা কেমন আছে?”
“ভালোই আছে। সবাই ভালো।”
তার মনে পড়ল এই সামান্য আগেই সে বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। পারেনি। কেন পারেনি? তারই কারণ খোঁজতে শুরু করল। এখনই কি জিজ্ঞেস করা উচিৎ হবে?... ওর নিজেকে নিয়েই হাসি পেল। কী যে অদ্ভূৎ ব্যাপারগুলো! এ এমন কোনো বড় বিষয় নয়, যা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। উনি কি রোজই এতো রাত অব্দি কাজ করেন, এই মাত্র। এক ধরণের আনুষ্ঠানিকতা। তা সত্ত্বেও সে দ্বিধায় ছিল জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না... এ রকমই হয় সব সময়। যখনই সে বাবার সঙ্গে একা হয় কথা বলবার বিষয় খোঁজে পায় না। যে কোনো একটা বিষয় মনে এলেই সে ভাবতে থাকবে , কথাটা বলবে কি বলবে না।কী করে বলবে সে, কেমন স্বরে বলবে--এই সব। এরই মধ্যে হয় বাবা নিজেই কিছু একটা বলবেন, নাইবা অন্য কোনো বাধা আসবে আর তার নিজের চিন্তাটা যাবে হারিয়ে। এমনও নয় যে এ তার স্বভাব। ব্যস, বাবার সঙ্গেই এটা হয়...
“মুন্নিকে সঙ্গে নিয়ে এলি না কেন?”
“বলিছিলাম। ও বলছিল ওর লেখাপড়া হয়ে উঠবে না। এপ্রিলে ওর ফাইনাল।”
“ কেন হবে না? ওই ক’দিনে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত? আসতে পারত, আমাদের দেখে যেতে পারত।“
রাজীব উত্তর করল না। ও বাবার কপালে স্পষ্ট ভাঁজ দেখতে পেল। তাঁর মুখ গম্ভীর দেখাচ্ছিল। যখনই তার অপছন্দের কিছু একট ঘটে কপালে ওমন ভাঁজ পড়ে। ওর ছেলেবেলা থেকেই রাজীব এটা দেখেছে। সে জানে মুন্নিকে স্কুলে পাঠানো বাবা পছন্দ করেন নি। ওর বয়স ইতিমধ্যে ষোল পেরিয়েছে। ওদের উচিৎ ওর বিয়ের কথা ভাবা। স্কুলে পাঠিয়ে ওর কোন ভালোটা হবে! হ্যাঁ, এই এখনই কথাটা জিজ্ঞেস করবার মোক্ষম সময়।
“আপনি কি আজকাল রাতের শিফটে কাজ করছেন?”
কপাল আবারো স্বাভাবিক হয়ে এলো,”হ্যাঁ।”
“ ভীষণ কষ্ট হয় নিশ্চয়, এই এতো শীতে...”
“না, তা হবে কেন?” হঠাৎই আবারো তাঁর মুখের চেহারা পালটে গেল—যেন তাঁর কষ্টের কথাতে তাঁকে খাটো করবার কোনো সুযোগ তিনি রাজীবকে দিতে চাইছেন না।
“ এতো ঐ... শুধু যে করে হোক সময় পার করবার এক আছিলা মাত্র ...”
রাজীব ওর বাবার মুখের দিকে তাকালো। একটা বেদনারিক্ত মন ছায়া ফেলেছে। তাঁর চোখ দুটো এখনো নিচের ওই রেজিস্ট্রিতে সেঁটে আছে, কিন্তু মন পড়ে রয়েছে অন্য কোথাও।
সামান্য ব্যাপার। কিন্তু বুকে বড় করে বাজলো। অনুষঙ্গটা ওর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠতেই একটা লজ্জা আর অপরাধ বোধ ওকে পেয়ে বসল। হঠাৎই তার বাবার জন্যে সে গভীর বেদনা আর সহমর্মিতা বোধ করল । এই দুঃখ, এই কষ্ট ধুয়ে ফেলতে কি সে কিচ্ছু করতে পারে না? একটি শিশুর প্রতি যেমন লোকে করে ,তার মনে হলো সে ইচ্ছে করলেই কাজটা করতে পারে---স্নেহে, যত্নে দিতে পারে একটা নিশ্চয়তা...
বাইরে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। শম্ভু।
“ এসছিস? ঠিক আছে। রাজি কে বাড়ি নিয়ে যা। কিরে যাবি?” যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।“ বাড়ি যা , বাবা । বাড়িতে গিয়ে ঘুমোগে যা। ক্লান্ত হয়ে এসছিস... সুটকেস টুটকেস খোলার চিন্তা করবি না । আমার বিছানা নিশ্চয়ই এখনো পাতাই আছে।”
“ঠিক আছে।” রাজীব ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো।
“এই শম্ভু, বাতি নিয়ে যেতে ভুলিস না আবার। বাইরে যা অন্ধকার!”
“ঠিক আছে , বাবু।“
বাইরে ঠান্ডা বাতাস। বারান্দা থেকে নেমে রাজীব একটা সিগেরেট জ্বালালো।মায়ের সামনে সিগেরেট খাওয়া যায়। পায়ে হাঁটা এক চিলতে পথের দু’পাশে ঘন ঝোপ জঙ্গল। শম্ভুর পেছনে পেছনে দেখে দেখে প্রতিটি পা ফেলছিল , তবু রাজীবের পায়ে কিছু না কিছু ঠেকছিল।
সামনে ওইটাই বাড়ি হবে বোধহয়। একটা খোলা দরজার থেকে আলো দেখা যাচ্ছিল, সঙ্গে এক লম্বা মেয়ে মানুষের কালো ছায়া। মা কি? নিশ্চয়ই ! আর কেই বা হবে...
“ কিরে, তুই একা এলি, তাই না? আমি তোর বাবাকে বলছিলামই, আর কেউ আসছে না।” দূরে থাকতেই মায়ের গলা গিয়ে পৌঁছুলো রাজীবের কানে।
“ রাম রাম মা” কাছে এসে নুয়ে পা ছুঁতে ছুঁতে রাজীব বলল।
“ বেঁচে থাকো বাবা।“ মা তার কপালে হাত ছোঁয়ালেন। তাঁর গলা ভেজা আর চাপা।
“ গোটা রাত ধরে জেগে আছি। বার বার গিয়ে ঘড়ি দেখছি। ট্রেনটাও খুব দেরি করেছে আজ আসতে।”
ট্রেন আসতে আদৌ দেরি করে নি । এটি মায়ের অভ্যেস । কেউ আসবার হলে তিনি এভাবে বলবেনই।
বর্গাকার এক কোঠা । ছাদটা বেশ উঁচুতে। এক কোনে এক পেরেকে ঝোলানো কিছু কাপড় বাদ দিলে দেয়ালগুলো শূন্য আর সাদা। পুরোনো দিনের সেই সব ছবিগুলো গেল কোথায়? পারিবারিক ছবি, নইলে দেবদেবতাদের ছবি । ভেলভেটের কাপড়ে এম্ব্রয়ডারি করা ছবিগুলো? সবগুলো ফ্রেমে বাঁধানো ছিল । রাজীবের মনে পরল ছেলেবেলা যখনই বাবা নতুন স্টেশনে বদলি হয়ে পরিবার নিয়ে নতুন কোয়ার্টারে গিয়ে উঠতেন কী আনন্দ আর উত্তেজনাতে ওরা ভাইয়েরা মিলে সেই ছবিগুলো দেয়ালে টাঙ্গাতো। চার দেয়ালে সমান করে এক রেখা ধরে ওরা সেগুলো সাজাতো। হবে , কোনো ট্রাঙ্কে পড়ে আছে। এখন আর এগুলো ওমন করে ঝুলিয়ে সাজাবে কে?
এক দরজার মাঝামাঝি একটা পেরেকে লণ্ঠনটা ঝুলানো ছিল যাতে আলোটা পাশের ঘরেও গিয়ে পৌঁছোয়।
“ এই বাড়িটা সুন্দর। এই ঘরের মতো তিনটা ঘর। রান্নাঘর , বাথরুম আলাদা। সামনে একটা বড় উঠোন...” মা শিশুসুলভ আনন্দে কথাগুলো জানাচ্ছিলেন।
ঘরের এক কোনে রাখা ফোল্ডিং খাটে বাবার বিছানা পাতা আছে। অগোছালো, একটা কম্বল তার উপরে গুটিয়ে রাখা। খাটের উপর বসে জুতো খুলতে গেলে ক্যাঁক করে একটা শব্দ করে উঠল। পাশে রাখা খানিকটা গোলাকার বেতের চেয়ারে বসে মা দিল্লির সবার খোঁজ খবর জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন।
ওর ভীষন ঘুম পাচ্ছিল। ট্রেনে ও সারা রাত বসে বসে এসছে। এখন পাজামা বের করা এক ঝক্কির ব্যাপার । সে তাই ওই গেঞ্জি জাঙ্গিয়া পরেই কম্বলের নিচে চলে গেল। আহ! কী দারুণ! পা মেলতে মেলতে ওর এক দারুণ আমেজে মন ভরে গেল।
মা দেখলেন উনি পুরো উত্তর পাচ্ছেন না। চেয়ারে ফেলে দেয়া রাজীবের জামা কাপড়গুলো তুলে তিনি দেয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে রাখতে গেলেন।
“ তুই এলি , ভালোই হলো, রাজীব! লোকজনকে এখন কিছু একটা দেখাতে পারব। লোকে এনিয়ে কথা বলে, জানিস? চার চারটে ছেলে। ছ’মাস হয়ে গেল, কারো দেখা নেই!লোকের মুখ তুই বন্ধ করবি কিসে?”
হঠাৎই যেন ঘরের বাতাস ভারী হয়ে এলো। এখনই মা এসব বলছেন কেন? ওর এখন বড্ড ঘুম পাচ্ছে যে!
“ একটাও হ্যাঙার নেই। দিল্লি থেকে একটাই কিনে এনেছিলাম। তাতে তোর বাবার কোট আর পেন্টটা রাখা। এখন এই তোর পেন্টটা রাখি কৈ?”
“ পেরেক একটাতে রেখে দাও না, তাতেই হবে।“ রাজীব ছাড়ান চাইল। কিন্তু মা বলে গেলেন, “উনি এখন কারো সঙ্গে তেমন কথা বলেন না। কোনোমতে দিনগুলো পার করছেন। কাকে দোষ দেব? কারো উপর রাগ করবেন, এখানে আছেটা কে? ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছেন। ওর শরীর যা ছিল, এখন আদ্ধেকটা হয়ে গেছে। একটা মানুষের নিজের ছেলেরাই পর হয়ে গেছে। তাঁর আর আশা করবার মতো আছেই বা কী!”
এগুলো বড্ড বিরক্তিকর। এখন না। রাজীবের ইচ্ছে সে এখন ঘুমিয়ে পড়ুক।
“ মা, তুমি ঐ লন্ঠনটা সরিয়ে দিতে পারবে? চোখে লাগছে।“ মা এক দীর্ঘ শ্বাস টানলেন। ফিতেটা নামিয়ে তিনি লণ্ঠনটা মেঝেতে নামিয়ে রাখলেন।
“ঘুমিয়ে পড় , বাবা।” বলে তিনি পাশের ঘরে চলে গেলেন।
সেইসব বিরক্তিকর ব্যাপারগুলো রাজীব মনে রাখতে চায় না। অতীতের ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে থাকাতা কি খুব জরুরি?
দারুণ এক সুন্দর সকাল। চড়া রোদ উঠেছে। ভোরের কুয়াশা নেমে গেছে। মাইলের পর মাইল মাঠ ঘাট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, প্রাণময় বাতাস। বহু বহু দিন রাজীব এমন সুন্দর সকাল দেখেনি। প্রকৃতির বিশুদ্ধ আর স্বাভাবিক রূপে এসে হাজির । বিশুদ্ধ সূর্যের আলো। নর্মল বাতাস। না, বাতাস ততটা নির্মল নয়। সক্কালবেলার শিশিরে সে বাতাস খানিকটা ভিজে রয়েছে। নিজের শরীরে সে বাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে দিগন্ত ছড়ানো রেলের লাইন পার করেও বহু দূর অব্দি ছড়ানো মাঠের সোঁদা গন্ধ । মাঠের এখানে ওখানে আমের গাছও রয়েছে বেশ কিছু, তার গন্ধ। পাকা আখের, সর্ষে ফুলের , মটর শুঁটির খোসার গন্ধ । গন্ধ গমের মঞ্জরির , যে মঞ্জরি পাকেনি এখনো। টিপলে দুধের মতো রস বেরুবে। এগুলোতো রয়েইছে, এছাড়াও যে আরো কত কিসে ভরে আছে আকাশ বাতাস। নেই কোনো ধুলির কণা, ধোঁয়া, শ্বাসরোধ করবার জন্যে কোনো বিষ...রাজীবের ইচ্ছে হলো যদি সে শীতের পুরো বন্ধটা এখানে কাটিয়ে যেতে পারত। কিন্তু কী করে? তাকে যে লক্ষ্ণৌ , এলাহাবাদেও যেতে হবে। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে যাবে বলে অনেকদিন ধরে কথা দিয়ে রেখেছে।
সকালের ট্রেন এলো, খানিকক্ষণের জন্যে থামল, আবার চলে গেল। কিছু সময়ের জন্যে এখানকার সবকিছু নড়েচড়ে উঠেছিল। রাজীব যেখানে বসেছিল ওখান থেকেই দেখতে পাচ্ছিল বাবা খুব দ্রুত পায়ে গার্ডের কামরার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।এখন সব শান্ত। প্ল্যাটফর্মে যে দু’একজন মানুষ ছিল তারাও চলে গেছে। শব্দ একটা , যদিও, রয়ে গেছে -—ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের শব্দ—-- ক্রমেই দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সত্যি কি সেই শব্দটি রয়েছে? না, সেটি রয়েছে তার ভাবনাতে! হতে পারে, এ শুধু এক প্রতিধ্বনির রেশ যা তার কানে থেকে গেছে।
“ দুপুরে কী খাবিরে?” খোলা দরজার সামনে মা দাঁড়িয়ে।
“এই মাত্র তুমি যা খাওয়ালে তারপরে আবার দুপুরের খাবার?”
“ কী যে বলিস, এই একটু পরেই তোর আবার খিদে পাবে...এই এক বড় বাজে ব্যাপার এখানে । তাজা সবজির বাজার নেই। এক দু’দিন পরে পরেই কাউকে উন্নাও পাঠাতে হয়। কাল থেকে একটা ফুলকপি পড়ে আছে। সেটিই রেঁধে দিই? আর ভাত তড়কা।?
রেলের অফিস থেকে একটা লোক আসছিল। শম্ভু।
“ নমস্কার দাদা!” রাজীবকে সম্মোধন করে সে মায়ের হাতে একটা বেগ তুলে দিল।
“বাবু বললেন, তিনি শিগগিরই বাড়ি আসছেন।“
“ এই শম্ভু, কেউ কি উন্নাও গেল কি না? ওবেলার জন্যে যে ঘরে একটাও আনাজ নেই,” শম্ভুকে মা জিজ্ঞেস করলেন , ইতিমধ্যে যে আদ্ধেকটা পথ ফিরে গেছে।
“ হ্যাঁ, মাসিমা, মাইকু গেছে।“
শম্ভুর রেখে যাওয়া বেগ থেকে একে একে জিনিসগুলো বের করতে শুরু করলেন মা। তাতে একটা স্থানীয় মদের বোতলও ছিল।
রাজীব মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের ঠোঁট বেঁকেছে। কপালে ভাঁজ পড়েছে।
“এখানেও তাহলে এসব চলছে?” সে জিজ্ঞেস করল।
“তোর কী মনে হয়? একটা দিনও বাদ যায় না...কিন্তু এখন অনেকটা কমিয়েছেন। রোজ রাতে আমিই একটা পেগ সাজিয়ে দিই। ওইটুকুনই।“ রাজীবের মুখের দিকে একটু তাকিয়ে তিনি বলে গেলেন, “ ইনি এটা ছাড়তে পারবেন না। ডাক্তারও বলেছে, পুরো যদি ছেড়ে দেন তাতে তার ক্ষতি হবে...এ আর আগের মতো নেই রে। আগের মতোতো না ই। কারো সঙ্গে কোনো ঝগড়া নেই। চেঁচামেচি নেই। যা কিছু বলবার তিনি আমাকেই বলবেন।“
“তোমাকে বিরক্ত করেন না?“
“ আমি বিরক্ত হলে, তবে না। এ উনার সাধ্যের বাইরে। আমি যদি তাঁকে ভয় করতামরে তবে কি আর তোদের এতো বড় করতে পারতাম?”
রান্নাঘরে বাসন নড়ার শব্দ হলো। মায়ের মনযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
“ ইসরে! সেই বেড়ালটা! ঠাকুর জানেন কবে আমি এই বিড়ালের থেকে রক্ষে পাব!” বলে মা দৌড়ে গেলেন সেদিকে।
স্মৃতি। কত কী ছবি আঁকা আছে জীবনের এই বিশাল দীর্ঘ ক্যানভাসে। সেই সব স্মৃতিগুলো ফিরে এসে আবারো মনে জীবন্ত হোক রাজীব কক্ষনোই চায় না... ছোট্ট দুটো ভাই মাঝে একটা লণ্ঠন নিয়ে মুখোমুখি এক টেবিলে বসে পড়ত। চোখের সামনে তাদের খোলা বই, কিন্তু তারা পড়তে পারে না। অন্য ঘরে তখন বাবা খেতে বসে জোরে জোরে চেঁচাচ্ছেন...ঝন্ ন্ ন্ ঝন্ ন্ ...মাখা ভাত সহ কাশার থালা ছিটকে পড়ছে। ছোট পেতলের বাটি গড়িয়ে যাচ্ছে। দুজোড়া ছোট চোখ পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে। সে চোখগুলোতে ভীষণ ভয়। চোখগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট জলের বিন্দু...দেয়ালে মাথা ঠুকে, কিম্বা আকাশে দিকে মুখ করে মা শাপশাপান্ত করছেন। সে শাপশাপান্ত থেকে কোনো কিছুই বাদ পড়ছে না...তার পরেই কিল, লাথি। অনেকগুলো ছোট ছোট হাত বাবাকে পেছনে টেনে আটকাবার চেষ্টা করছে। ছোট্টটি কাঁদছে বিছানাতে শুয়ে। তাদের কান্নার চাপে বাড়ির ছাঁদ চৌচির হয়ে যাচ্ছে। বাইরে পারার লোকের ভিড়। কিন্তু কেউ নাক গলাতে সাহস করছে না। যে তা করবে সেই বাবার ক্রোধের বলি হবে...। রাত্রি দুপুর। গোটা ষ্টেশনের কর্মীরা তাঁকে হন্যি হয়ে খুঁজছে। শেষে তাঁকে রেললাইনের ধারে একেবারে শেষ সিগানালের কাছে খুঁজে পাওয়া গেল। আত্মহত্যা করবার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। হায় রাম! অল্পের জন্যে রক্ষে। এই ষ্টেশনে থামবে না , এমন একটা ট্রেন মিনিট ক’য়ের মধ্যে আসবার কথা ছিল। ধরে এনে তাঁকে দড়ি দিয়ে একটা খাটে বেঁধে ফেলা হলো। মা তখনো কাঁদছেন আর শাপশাপান্ত করছেন। জোরে জোরে। বাবাকে, নিজের ভাগ্যকে, ঠাকুরকে, ছেলেদের, এমন কি সেই সব পড়শিদের যারা বাবাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসছে। কতকগুলো ছোট ছোট হাত তখন ব্যস্ত বাবার মুখের ফেনাগুলো মুছে ফেলতে। অন্যগুলো তখন মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে তাঁকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে... রাতের পর রাত। একটা না একটা বিষয় নিয়ে লেগেই আছে। সন্ধ্যে হতেই হৃদকম্পন বেড়ে যেত। রাত বাড়তেই ছোট ছোট হাতগুলো প্রার্থণার জন্যে উপরে উঠত। তোমাকে মিনতি করি ঠাকুর ! আজ না। আজ রাতে যেন কিছু না হয় ভগবান! যে রাতে সে প্রার্থণা মঞ্জুর হতো সেই ছোট ছোট বুকগুলোতে ফুল ফুটে বেরুতো। ছোট ছোট মুখগুলোতে বসন্ত তার রঙ ছড়াতো। কিন্তু সেরকম রাত কত কম ছিল... স্কুলে, খেলার মাঠে, শহরের ছোট্ট বাজারে যেখানেই ওরা যেত লোকে তাকিয়ে বলাবলি করতঃ “ ঐ যে ওরা।____র ছেলেরা...” কেউ হাসত। কেউ জানাতো সহানুভূতি।
অভিশপ্ত, ভূতে পাওয়া শৈশব। বার বার রাজীবের মন বিদ্রোহ করেছে। তার ইচ্ছে হতো সে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে নিজেকে মুক্ত করে। কতবার সে ভেবেছে যদি সে আর কারো ছেলে হতো! ইচ্ছে হতো বলে তারা জাহান্নমে যান, তার কিচ্ছু করবার নেই। কিন্তু নিজের মা-বাবাকে অস্বীকার করা, রক্তের সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলা কি চাট্টিখানি কথা! ধীরে ধীরে ক্রমেই তারা বড় হয়ে উঠল। স্কুলে গেল, গেল কলেজে। মানিয়ে নেবার কি অসীম ক্ষমতা মানুষের, যে কোনো পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকবার শক্তি! জীবনের দিনগুলো কেটে গেল। বছরগুলো গেল গড়িয়ে। বাবা পাল্টালেন না। কিন্তু অন্য অনেক কিছু বদলে গেল। প্রথমে দাদা, বড় দাদা---বেরিয়ে গেল। বিএ পাশ করল । দিল্লিতে চাকরি পেয়ে চলে গেল। তার পরেই রাজীব গেল। তারপর সঞ্জীব, তারপর প্রদীপ। সবার পরে মুন্নিও দিল্লি চলে এলো। এখন ওরা সবাই দিল্লি থাকে। দশ বছর হয়ে গেল দাদা বেরিয়ে যাবার। দশটি ...ই... ই... ব...ছর! দশ টাকা ভাড়ার ঘর দিয়ে শুরু করেছিল। তাদের এখন পাঁচটা বিশাল ঘরের বাড়ি রয়েছে। দাদা এখন এক বিশাল বিদেশি কোম্পেনির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। রাজীব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ায়। সে দু’বছর স্কলারশিপ নিয়ে গিয়ে অক্সফোর্ডেও কাটিয়ে এসছে। সঞ্জীব একটি বড় মিলে ইঞ্জিনিয়ার । প্রদীপ ডাক্তারি পড়ছে। মুন্নিও কলেজে উঠে গেছে। সম্পূর্ণ, ভরা সংসার। দাদা অনেকদিন আগে বিয়ে করেছে। রাজীব সঞ্জীবেরও বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন। সবাই ওরা ওখানে এক সঙ্গে থাকে।
বাবা আর মা একা পড়ে রইলেন। মাঝে দুস্তর ব্যবধান। সে ব্যবধান যত দিন গেল বেড়েই যেতে থাকল। ছুটিছাটাতে ওরা দিল্লীতে বেড়াতে যান। কিন্তু তাদের মনে হয়ে যেন অতিথি হয়ে গেছেন, অচেনা মানুষ, অচেনা জায়গা।
তারপর একদিন এলো যখন বাবা চাকরি থেকে অবসর নিলেন। সব কিছু বেঁধে টেধে মাকে নিয়ে দিল্লিতে গিয়ে ওঠা এক কথা আর ওখানকার জীবনের অঙ্গ হওয়া আরেক। রাজীবের মনে পড়ে দিল্লিতে সবাই কেমন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন ওদের যাবার কথাতে। যদিও আর কোনো বিকল্পও ছিল না। একটু এদিক ওদিক করে মা বাবার জন্যে একটা ঘর খালি করা গেলো। কিন্তু তারাতো আর আসবাবপত্র ছিলেন না যে যেখানে রেখে দেয়া হবে ওখানেই থাকবেন। একটা ঘরের চেয়েও বেশি কিছু তাদের দরকার ছিল। এটাই দেয়া যাচ্ছিল না। সব্বাই ব্যস্ত। সারাদিন বাড়ির বাইরে। ঘরে থাকলে যে যার ঘরে কাজে ব্যস্ত। বসে দুটো সুখ দুঃখের কথা বলে আড্ডা দেবার সময় কারো ছিল না। বাড়ির মেয়েরাও ব্যস্ত । মুন্নির পড়াশোনা আছে। রাজীবের স্ত্রী একটি কলেজে পড়ায়। সঞ্জীবের স্ত্রী এম এ ফাইনাল দেবে। একা ঐ বৌদি--- বড়দাদার স্ত্রী---বাড়িতে থাকে। কিন্তু এতো বড়ো বাড়ি আর তার সঙ্গে নিজের দুটো সন্তানকে সামাল দেয়াই তার কাছে অনেক।
এক সময় বাবা উপলব্ধি করলেন, তাঁর দিল্লি আসা উচিত হয়নি। নিজেকে উপেক্ষিত বোধ হলো, অবহেলিত। আরো বিরক্তি হতো যখন দেখতেন মা ছেলেদের পক্ষ নিচ্ছেন। গোটা দিন তিনি বাবার সঙ্গে কাটাবেন। ছেলে, ছেলেবৌদের নিয়ে এটা ওটা কথা বলবেন। সন্ধ্যেবেলা ওরা একে একে বাড়ি এলেই তিনি ওদের কাছে চলে যাবেন।
অবসর নেবার পর বাবা ঠিক করেছিলেন তিনি মদ খাওয়া ছেড়ে দেবেন। সে শপথ দু’সপ্তাহও টেকেনি। মদের দোকানে যাতায়াত শুরু হলো। কিন্তু এতো আর ষ্টেশনমাস্টারের সেই পুরোনো দিনগুলো নয়, যখন বোতলগুলো আপনি এসে তাঁর কাছে জড়ো হতো। এখন যখনই তিনি দোকানে যাবেন তাঁর নগদ টাকা চাই। টাকা নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হলো। পেনসনের হাতে গুনা টাকাগুলোতো আর এভাবে জলে ফেলা যেতে পারে না। কিন্তু এ কেবল টাকার প্রশ্ন ছিল না। সন্ধ্যেগুলো সরব হতে শুরু করল। গোটা একটা নীরব দিনের ক্ষোভ রাতে বেরুবার পথ খোঁজতে শুরু করল। এক সকালে, কাজে বেরুতে যাবার বেলা বড়দাদা কথাটা সোজাসুজি পাড়ল। এটা দিল্লি, এখানে ভদ্রলোকেরা থাকে। কেউ এখানে এভাবে চেঁচামেচি করে যাবে এটা হতে পারে না। সে রাতে তাঁর গলা আরো অনেক বেশি চড়ল। বাবা যেন দু’রাতের মদ একদিনেই খেয়ে ফেলেছেন।
“ ও! এখানে যারা থাকে তারা ভদ্র? আর আমরা অভদ্র, ছোটলোক! এই আমরাই তোদের জন্ম দিয়েছি বে...!” একটা বিস্ফোরণ, মনে হচ্ছিল না তাড়াতাড়ি থামবে। পাড়া প্রতিবেশিদের জানালা একে একে খুলে যেতে শুরু করল। কৌতুহলী, উদ্বিগ্ন মুখগুলো বাইরে উঁকি দিতে শুরু করল। আর তার পরেই ভদ্রতার সমস্ত গণ্ডী ভেঙ্গে গেল। সে রাতের ঘটনাক্রম রাজীব আর মনে আনতে চাইল না। সবাই মিলে চেঁচাচ্ছিল। পরদিন সকালে ওরা সব্বাই মিলে চরম সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল। আর একটা দিনও নয়। যাও, তোমার যেখানে যাবার আছে। এখানে আর তুমি থাকতে পারবে না। বাবা আর মা চলে এলেন। কেউ জানত না তাঁরা কোথায় গেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পর একটা চিঠি এলো। অনেক ধরাধরি করে বাবা আর তিন বছরের জন্যে রেলের চাকরি বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন । এখন এই উন্নাওর কাছে এই ছোট্ট ব্রাঞ্চ লাইনের স্টেশনে এসে যোগ দিয়েছেন। তাদের যা কিছু জিনিস রেখে এসছিলেন, পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সে মাস ছয় আগের কথা। মাঝে গুটি কয় চিঠির আদান প্রদান হয়েছিল। এখন এই রাজীব ওর শীতের ছুটির কিছুটা ওদের সঙ্গে কাটাতে এসছে।
একটু বিব্রত হয়ে সে সিগেরেটের টুকরোটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কতক্ষণ হয়েছে বাবা এসে কাছে দাঁড়িয়েছেন।
“ ভালো ঘুম হলো?”
“ এই খানিকটা। আটটাতে উঠলাম... এ কি আজকের কাগজ? এখানে কাগজ পাওয়া যায়?”
“ হ্যাঁ, সকালেড় ট্রেনে আসে। আমি নিজের জন্যে উর্দুটা রাখি। ইংরেজিটা আজ তোর জন্যে রেখে দিলাম।“ বলে তিনি রাজীবের হাতে ‘পাইওনিয়ার’টা (Pioneer) এগিয়ে দিলেন।
“আমার জন্যে!”
“হ্যা , কাল লোকটাকে বলে রেখেছিলাম। জানি যে আজ সকালে তুই আসবি।”
হঠাৎ রাজীবের মনে পড়ল সে বাবার জন্যে উর্দু বই কিনে এনেছে। অবসর সময়ে তিনি গল্প উপন্যাসের বই পড়তে দারুণ ভালো বাসেন। সে ভেতরে গেল বই আনতে। সঙ্গে একজোড়া উলের মোজা আর একটা সোয়েটার । মায়ের জন্যে একখানা নতুন শালও।
বাবা একটা খাট টেনে কাগজটা নিয়ে রোদে গিয়ে বসলেন।
“তোমার জন্যে এই বইগুলো এনেছিলাম। আর এইগুলো...”
“ ও! হ্যাঁ, বাব্বা!” তাঁর মুখে অবর্ণনীয় আনন্দের আভাস ফুটে উঠল তা তিনি গোপন করতেও চাইলেন না। চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। তিনি আলতো করে সোয়েটারের উপর , মোজার উপর হাত বুলালেন, যেন খুব দুর্মূল্য কোনো জিনিস। কয়েকবার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।
“এগুলো কে বুনেছে?”
“সবাই মিলে হাত লাগিয়েছে।” বাবা তাঁর গায়েরখানা খুলে নতুন সোয়েটার পরলেন। রাজীব পেছন থেকে তাঁকে একটু সাহায্য করল। মা এসে দরজার কাছে দাঁড়ালেন।
“ কী দেখছো? আমার বৌএরা আমার জন্যে বুনে পাঠিয়েছে!”
“ ওহো ! অবাক কাণ্ডতো! সব আদর ঐ বূড়ো মানুষটার জন্যে। সব আদর যেন উনারই প্রাপ্য আরকি।”
“ ঐ শুরু করল ওর গান। তোমার মুখে কোনো লাগাম নেই বুঝি? কী অন্যায়টি করেছে আমার বৌএরা?”
“ ইস ! এখন দেখছি আদর গড়িয়ে পড়ছে। এমনিতেতো রোজ ওদের নামে যা নয় তা বলে বলে ক্লান্ত হওনা দেখি।“
“ আমি?আমি কখন োদের গালি দিই? এমনটি বলতে তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ। আমার দোষ দেয়া হচ্ছে! আমি যা বলি সব ওই তোমার দোষে।”
“ নিশ্চয়! সেতো সবই আমার জন্যে! আমিইতো রোজ মদ গিলি। আমিই রোজ রাতে পাড়া চেঁচিয়ে নরক করে তুলি!”
“ আহা! কী হলো তোমাদের...? ” রাজীব হস্তক্ষেপ করল।“ এই শালটা দেখো মা, দেখিতো তোমাকে কেমন দেখায়।”
“তুই দেখলিতো রে, দেখলি না? যা কিছু বাজে বাজে বকেন, করবার নয় করেন তার সব দায় বুঝি আমার। আমার দোষেই এতো সব হয়।”
“ ঠিকা আছে মা ...এসব ছাড়ো এখন... দেখো... পছন্দ হয়েছেতো তোমার?”
“ নিশ্চইয়! দারুণ হয়েছে...খুব দামী হবে নিশ্চয়।”
“ সে নিয়ে তুমি কী করবে? তোমার পছন্দ হলো কিনা সে বলো।”
“ এই রঙটা...”
“ইস! যেন তুমি খুব চেনো আরকি রঙ,” বাবা বললেন। “কিছু একটা পেলেই হলো। এদিকে আনো। তোমার যদি পছন্দ না হয় এদিকে আনো। আমি পরব।”
“ তুমি ওখানেই দাঁড়াও। বুড়ো ভাম। তোমাকেতো দিলই দেখি সোয়েটার একটা।”
“ হ্যাঁ, আমার বৌয়েরা বুনে পাঠিয়েছে।”
“তো! আমার ছেলে আমার জন্যে শাল এনেছে”।
“ ও কি শুধু তোমার ছেলে? আমার নয়?”
এতো আনন্দ ধরে রাখে কিসে রাজীব! ওর রক্তে একটা শিহরণ খেলে গেল। চোখের কোনে জল। এমন এক মূহূর্তের জন্যে সে সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ ধুলায় লুটাতে পারে। সে ভাবছিল যা কিছু ঘটে গেল সেসব ঘটে যাওয়াটা কি খুব জরুরি ছিল? ঠিক আছে, ঘটেছে। সেগুলো এখন ভুলে যাওয়া যেতে পারে না? চিরদিনের জন্যে? এখানে এখন সব কিছু কত আনন্দের , কত মধুর, কত সুখের! রোজকার মতো এমন হতে পারে না?
কাকে দোষ দেয়া যাবে? এই যিনি ওদের বাবা, যিনি এতো সরল যে ছেলের থেকে সামান্য আদরের ছোঁয়া পেতেই আনন্দে ভেসে বেড়ান? এইটুকুই তো তাঁর চাই। এই বয়সে এইটুকুন চাওয়া কি খুব একটা বেশি? রাজীবের মনে হলো এ ওদের ভাইদের ব্যর্থতা। তারা সবাই মিলে তাঁকে অবজ্ঞা করেছে। মাতলামো? কিন্তু এ দুনিয়াতে কেই বা কোনো দুর্বলতা থেকে মুক্ত? যদি তারা একটু মনযোগ দিত, একটু ভালোবাসা...কিন্তু সে কি সত্যি খুব সোজা ছিল...
“বলছি তোমাকে , এখন বন্ধ কর। এক পেগে কি যথেষ্ট হয় না তোমার?” মায়ের গলা ভরা বিরক্তি।
“ সে তোমার দেখবার ব্যাপার নয়। এক পেগ! তুমি কে সে কথা মনে করিয়ে দেবার? বোতলটা বের করে আনো বলছি!” বাবার গলাতে কড়া আদেশ।
পেছনের অন্ধকার ঘরে রাজীব বিছানাতে উঠে বসল। ওর পা কম্বলে ঢাকা। দরজা দিয়ে একটা আলোর রেখা এসে এই ঘরে ঢুকেছে, মেঝেতে সেটি ত্রিভূজের মতো দেখাচ্ছে। ওর চারপাশে অন্ধকার, কিন্তু ওঘরের সবই সে দেখতে পাচ্ছে। বাবা পায়ের উপর পা তুলে খাটে বসে আছেন, সামনে ঝুঁকে । গায়ে তার নতুন সোয়েটার। একটা কম্বলে পা ঢাকা। মাথাতে একটা উলের স্কার্ফ। তার সামনে একটা ছোট স্টুলে বড় গোল বাতি রাখা। পেছনে দেয়াল ঢেকে তার এক বিশাল কালো ছায়া পড়েছে। তাঁর দেহের সামান্য দোলা দেয়ালে বড়সড় এক ঢেউ তৈরি করে।যেখানে সে বসে আছে সেখান থেকে রাজীব মাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু সে জানে তিনি ওখানে আছেন। বাবার সামনেই। বারান্দার দিকে । তাঁর পেছনেই রান্নাঘর।
বাইরে গভীর অন্ধকার। বাতাসও ভারী। মাটি আর আকাশের মাঝখানটা কুয়াশাতে ভরে আছে। রাজীব জানে দরজার সামনে , জানালার বাইরে কুয়াশা দাঁড়িয়ে আছে সুযোগ পেলেই ভেতরে ঢুকবে বলে। ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল। সে খেয়ে ফেলেছে । এখন ঘুমোতে চাইছে।
“ শুনছ না নি কি? কোথায় সে বোতল?” বাবা আবারো গর্জে উঠলেন। আধ ঘন্টাতেই তিনি একপেগ শেষ করে ফেলেছেন। গলার স্বর ইতিমধ্যে চড়া হতে আর জড়িয়ে যেতে শুরু করেছে।
“ না , এখন থেমে যাওনা!” মায়ের কণ্ঠে মিনতি। “অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি কি ভাবো আর কতক্ষণ আমি এই চুলোটা জ্বালিয়ে রাখব? আবারও এটা নিভে যাচ্ছে।”
“যেতে দাও। রুটি বানাও আর সরিয়ে রাখো।”
“ ও! আচ্ছা, তার পর আমার উপর ঐ ঠান্ডা রুটি গুলো কে ছূঁড়ে ফেলবে, শুনি?”
“ খালি বাজে তর্ক করে...” বাবা এবারে নিজেই খাট থেকে উঠে গেলেন।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি ওখানে বসে থাকো। আমি বোতল পেয়ে যাব।”
মা ভেতরে এলেন যে ঘরে রাজীব ছিল। রাজীবের বিছানার পেছনে একটা ট্রাঙ্ক থেকে তিনি বোতল টেনে বের করলেন। রাজীবকে অন্ধকারে বসে থাকতে দেখে বললেন, “তুই শুয়ে পড় রাজি। উনাকে নিয়ে ভাবিস না। এ রোজকার কাহিনি।”
বাবার কাছে গিয়ে উনি বলে গেলেন, “তাড়াতাড়ি খেয়ে শেষ করো না কেন, করে শুতে যাও। সারা বাড়িটাকে মাথায় তুলে রেখেছো। এর মধ্যে রাজি ঘুমোয় কী করে?”
“ আমি কি ওকে ঘুমোতে মানা করেছি বুঝি? ও ঘুমোয় না কেন?” মায়ের হাত থেকে বোতলটা টেনে নিয়ে বাবা জবাব দিলেন। তিনি তাঁর ছোট্ট বোতলে মদ ঢালতে শুরু করলেন।
“ ঠিক আছে। ঠিক আছে। থামো এখন...আর কত গিলবে?...দেখ, দেখ রাজি, তিনি আবার নিচ্ছেন।”
“ওকে কী বলছ? আমি ওকে ডরাই না কি? এটা দিল্লি নয়। আমি খাই আমার টাকায়...নিয়ে যাও। নিয়ে যাও এই বোতলটা।”
রাজীব দেখেও যেন কিছু দেখল না। উদাসীন। যেন এই বিশাল দুনিয়ায় অবিরত ঘটতে থাকা ঘটনাপ্রবাহের এও একটা---এ তার সঙ্গে কোনোভাবে সম্পর্কিত নয়। বাবা মুখটা উপরের দিকে তুলে মদে মুখ ভরে ফেললেন। অনেকটা এক সঙ্গে গিলেও ফেললেন। ঝাঁঝে সারা মুখ কুঁচকে গেল। চোখজোড়া শক্ত করে বন্ধ হলো। যেন কেউ চামড়াগুলোকে নানা দিক থেকে টেনে ধরেছে। কিন্তু সে খানিকক্ষণের জন্যে। চোখজোড়া আবার যখন খুলল তাতে তখন অপার তৃপ্তি।
কর্ক দিয়ে বোতল বন্ধ করে সেটিকে স্টুলের উপরে রাখলেন।
“ ওর কিনে আনা এই সস্তা শালটিতে কী আছে এমন, পরে বসে আছ যেন মহারানি! তোমার কি কোনো দিন মান সম্মান বোধ হবে না? কী এমন মধু পেলে যে চাটছ?”
এ বড্ড বেশি হয়ে গেছে। মাও উলটে আগুন ঝরাতে শুরু করলেন , “আমি মধু চাটছি! নিজের দিকে তাকাও না কেন? সোয়েটারটা দেখি পরে বসে রয়েছো!”
“ লাগে না আমার এই সোয়েটার। তুমি কি ভাবছ আমি এটা রেখে দেব? আমি এর কানা কড়িও দাম দিই না। এর উপর আমি মুতি। তুমি আমাকে কী ভাবছ?”
“ঠিক আছে। ঠিক আছে। এখন থামবে? রাজি কী ভাবছে বলো দেখি...?”
“ যা ইচ্ছে ভাবুক গে। তোমার ভয়ে মরতে হয় মরো। আমার বয়েই গেছে... আর এই যে তুমি...এখন যে বড় ওর পক্ষ নিচ্ছ? ভুলে গেছ, ওরা যে তোমাকে লাথি মেরে বাড়ি থেক বের করে দিয়েছিল?”
“ তো? যাও না , যারা তা করেছিল তাদের বলো গে। ওকে দোষ দিচ্ছ কেন?
“ ই ! ও যেন ধোয়া তুলসি পাতা! ওরা সব ক’টা মিলে করেছে। তুমি ওকে সাধু ভাবতে পারো। আমার চোখে ওরা সবাই সমান।”
রাজীবের চোখে পলক পড়ছে না। । শব্দগুলো গিয়ে একটার পর একটা ওর কানে পড়ছে। এগুলোর কি কোনো অর্থ আছে? সে ভাববার চেষ্টা করছে । কিন্তু পারছে না। তার কি ঘুম পাচ্ছে? না, এখনতো একেবারেই না। সে তার সামনে চড়ানো বাতির পাশে বসা ভদ্রলোককে দেখছে। তাঁর শরীরের রেখাচিত্রটি সোনা দিয়ে আঁকা হয়েছে। নাকের ডগার উজ্বলতা ঠিকরে পড়ছে যেন, কিন্তু এর ছায়া মুখের তিন ভাগের এক ভাগ অন্ধকার করে ঢেকে রেখেছে। তাঁর একটা চোখ দেখতে পায় না। পেছনটায় ছায়াটাকে এমনটাই দেখাচ্ছে--- এক বিশাল দৈত্যের মতো, যেন নিচে নেমে ছোঁ মারবার জন্যে তৈরি । এই দৃশ্য কি তাঁকে অনেক আগে পড়া কোনো উপন্যাসের কোনো দৃশ্যকে মনে করিয়ে দিচ্ছে?
বাবা সেই ছোট বোতল থেকে আরো কয়েক ঢোক গিললেন।
“ নির্লজ্জ ! অসৎ! ওরা ভাবে ওরা খুব বড়লোক হয়ে গেছে। কী বড়লোকরে তোরা, জানিস না মা-বাবাকে কী করে সম্মান জানাতে হয়? বৌদের গোলাম! কখনো কি ভাবিস যে বাড়িতে তোদের বুড়ো মা-বাবাও রয়েছেন ? বাড়ি এলি আর বৌকে জড়িয়ে ধরলি। আর ওদিকে দেখ , ছিল এক ভীষ্ম! শুধু বাবার জন্যে গোটা জীবন বিয়েই করল না। আর এদিকে আমাদের সন্তান !
এ বন্ধ হওয়া উচিৎ ! ধীরে ধীরে হলেও একটা ব্যবস্থা নেবার ইচ্ছে রাজীবের মনে প্রবল হয়ে উঠল। তার পক্ষে মুখ বন্ধ করে রাখা, উদাসীন হয়ে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। বাবা চালিয়েই যাচ্ছেন, নির্বিরোধ । তাঁর গলা ক্রমে চড়েই যাচ্ছে।
“ তোরা ভাবিস এই দুনিয়াতে তোরা এমনি এমনি এসে গেছিস! মুর্খ কতকগুলো! আমরা এনেছি তোদের! আমরা! আমরা তোদের স্রষ্টা। ভগবানের থেকেও বড়। যখন জন্ম নিয়েছিলি আমার পুরো হাতের সমানও ছিলি না তোরা কেউ। আমাদের সঙ্গে তোরা এটা কী করলি? ঠিক করলি? কী করে করলি তোরা? এই রে, তোরা তো নিজে নিজে পেচ্ছাব করতেও পারতি না। আমরা তদের বড় করে তুলেছি। আমরা লালন করেছি তোদের, আমাদের নিজেদের শরীরের রক্ত দিয়ে। নিজেদের পেটে গামছা বেঁধে তোদের স্কুলে পাঠিয়েছি। মানুষ বানিয়েছি। আর আজ কিনা তোরা আমাদেরকেই অপমান করিস! আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিস? এর জন্যেই কি তোদের বড় করেছিলাম?” এতো চড়া স্বর যে পাড়া প্রতিবেশিরাও নিশ্চয়ই তা শুনতে পাচ্ছিল।
“ তাই বলে এখন তুমি থামছ না কেন? আর কতক্ষণ এভাবে চালিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছ তুমি ?” মা আবারো বাধা দিলেন।
“ তুমি চুপ থাকো! ভোৎলা বুড়ো কুকুরের বাচ্চি! এই সব হয়েছে তোমার জন্যে। ‘চলো, চলো দিল্লী চলো’ বলে বলে আমার কান খাচ্ছিলে তখন । গেলেতো, কী পেলে ওখানে?”
“ ঠিক আছে , এ সবই আমার জন্যে... এখনতো থামো। বেচারা রাজি, সেই কতদূর থেকে এসছে...।”
“ এসছে কেন?” গর্জন করে উঠলেন বাবা। চোখজোড়া যেন বেরিয়ে আসবে। “ এখন কেন এসছে? এখন আর কী চায় ও...?”
রাজীবের আর সহ্য হলো না। স্পষ্ট গলায়, রাগের সুরে সে বলল , “আর একটা কথা বলবে না । তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি কাল চলে যাব।”
“ যা । এখন চলে যা। শুয়র! আমাকে ভয় দেখাস? আমার উপর গলা চড়াবার অধিকারটা তোকে কে দিয়েছে ,শুনি ? এটা দিল্লি নয়, বুঝলি ! এটা আমার বাড়ি। আমার রাজত্ব এখান! চেঁচাবি, যদি আমরা তোদের বাড়ির দরজাতে গিয়ে পা রাখি তবে । ‘আমি চলে যাব!’ যাস না কেন? কেউ তোকে এখানে আসতে বলেছিল ? আমাদের এখানে কাউকে চাই না। যা! সোজা চলে যা! ভাবছিস তোর চীৎকারে আমি ভয় পেয়ে যাব? আমি কাউকে ভয় পাই না। কাউকে না। এখনো আমি রোজগার করি। আমার বোতল আমি কিনি...।”
দেয়ালের দত্যটি তখন ভয়ঙ্কর রকম কাঁপছিল। প্রচণ্ড ক্ষোভে আর ঘৃণাতে রাজীবের মন ভরে ফেলল। না, এই মানুষটিকে সে আর কোনো সহানুভূতি জানাতে পারবে না। না, এই ব্যক্তি কক্ষনোই তার বাবা হতে পারেন না।
মা রাজীবের পাশে এসে বসেছেন। তাকে ঠাণ্ডা করবার চেষ্টা করছেন। এ তার রাগকে আরো চড়িয়ে দিল। বিরক্তি মাথায় চড়ল। আবার কী এমন হয়ে গেল ? সে এখানে কোনো ঝগড়া করতে আসে নি। কিন্তু কেন? কেন সব সময় এমনটাই হয় ?
কুয়াশা ঘেরা বিবর্ণ এক সকাল। ভারি কুয়াশা তখনো একটা চাদরের মত ঝুলে আছে। ন’টা বাজে, কিন্তু তখনো রোদের দেখা নেই। চারদিকে সব কিছু কেমন স্থির আর শান্ত। একটা পাতাও নড়ছে না। কখনো দু’একটা শিশিরের ফোটা গাছের পাতা ঠেকে টপকে পড়ছে।
প্লেটফর্মে জনা কয় লোক। ট্রেনের অপেক্ষা করছে। দুই হাত কোটের পকেটে ঢুকিয়ে রাজীব অফিসের দিকে এগিয়ে গেল। বাবা তার টেবিলে কাজ করছেন। রাতে যা কিছু ঘটে গেছে তার মুখে কোত্থাও কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। রাজীবকে আসতে দেখে তিনি বরং একটু অবাকই হলেন।
“ আমি এই ট্রেনে ফিরে যাচ্ছি।”
“ অ্যা ...কী?” বাবা মুখ হা করে তাকিয়ে রইলেন।
রাজীব সামান্য দ্বিধার মুখে পড়ল, কিন্তু সামলে নিয়ে বলল, “ আমাকে যেতে হবে। মাত্র ক’দিনইতো বন্ধ । এলাহাবাদ লক্ষ্ণৌতেও যেতে হবে।”
বাবার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তিনি তখনো অবাক। “ আর দু’টো দিন থেকে যেতে পারিস না? এই তো মাত্র কাল তুই এলি।”
“তোমাদের দেখতে এলাম। দেখা হলো...।” রাজীবের পক্ষে বুঝিয়ে বলাতা কঠিন হয়ে আসছিল। “ তাছাড়া আমি এরই মধ্যে জিনিসপত্রও বেঁধে ফেলেছি।”
কী আর বলবেন। বাবা চুপ করে মাথা নামিয়ে নিলেন।
খানিকক্ষণ গেল। রাজীব পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল , “ আমাকে লক্ষ্ণৌ অব্দি একটা টিকিট দিতে পার?”
বাবা মুহূর্তে তার দিকে তাকালেন। রাজীব সোজা তাকাতে পারল না। বাবার চোখ বেদনাতে ভারী । সে চোখে এক সুগভীর আন্তরিক নিবেদন। কেউ কি পারে এভাবে এতোটা চাইতে, এতো নম্রতার সঙ্গে, শুধু চোখের চাউনিতে?
“ তুই আমার উপর রেগে আছিস, বাবা?”
“ না , না... ওভাবে বলছ কেন... আমাকে সত্যি যেতে হবে...।” এখন এই মুহূর্তে সে কী করছে ওর বাবার সঙ্গে? তার শরীরে সমস্ত বোঝা যেন বুকে এসে ভিড় করছে ...
“ তুই জানিস এ আমার স্বভাব। আমি পান করি আর যা বলবার নয় বলে যাই। তখন কী বলেছি তাতে তোর রাগ করা উচিৎ নয়, বাবা।”
কিন্তু সেই কি তোমার আসল স্বরূপ নয়? সত্যিকারের চেহারা। যা কিছু তুমি ভাবো, তোমার সত্যিকারের ভাবনা। যা কিছু তোমার গর্বের কথা কোনো ভান না করে লোক শুনিয়ে জোরে বলতে চাও। রাজীবের ইচ্ছে হলো কথাগুলো বলে। কিন্তু সে জানে এই কথাগুলো সে বলতে পারবে না।
“ বিশ্বাস করো আমি সত্যি বলছি। ভেবো না । আমি কিছু মনে করিনি ।“
ট্রেন এলো। বেগ তাতে তোলা হয়ে গেছে। রাজীব বাবাকে প্রণাম করাবার জন্যে মাথা নোয়ালো। বাবা তাকে জোরে জড়িয়ে ধরলেন। সমস্ত বাধা মুহূর্তে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল।
“ তুই তোর বাবাকে ক্ষমা করতে পারবি , রাজি?... আমি একটা অপদার্থ, ঘৃণ্য মানুষ। একটি দিনের জন্যেও তোদের কোনো সুখ দিই নি...।” গলা ধরে এলো তাঁর।
রাজীবেরও ইচ্ছে হলো তেমনি করে কিছু বলে । কিন্তু পারে নি। তাঁর গলা আটকে গেছে। ট্রেন চলতে শুরু করলে সে তাতে লাফিয়ে চড়ে গেল।
ধীরে ধীরে বাবাকে পেছনে রেখে ট্রেন এগিয়ে গেল। বাবা ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। মাথা থেকে হাঁটু অব্দি তাঁর কম্বলে ঢাকা। উলের মোজা আর সামনেটা খোলা চপ্পল।
ট্রেন যখন ওদের বাড়ি পার করে যাচ্ছিল রাজীব দেখতে পেল মা দরজার মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে আছেন। শাড়ির আঁচল দাঁতে ধরে রেখেছেন। সে ঐ গাড়ি থেকে ‘প্রণাম’ বলবার জন্যে হাত জোড় করল যখন, মনে হলো মা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন।
ট্রেনের গতি বেড়ে গেল। দুটো মানুষ পেছনে পড়ে রইলেন। শীঘ্রই কুয়াশা তাদের সঙ্গে সব কিছুকে ঢেকে ফেলল। রাজীব অনুভব করল, এভাবে বাড়ি এসে সে আরেকটা ভুল করে গেল।
------
2 comments:
ভালো। তবে আরো অনেক ভালো গল্প রয়েগেছে এর আগে আমার প্রিয় গল্পের তালিকার জন্য। এই বিষয়ের উপর, কাছাকাছির মধ্যে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধায়ের অসংখ্য অসাধারন গল্প রয়েছে।আর 'বিষয়' নয় , তার চেয়েও বেশী উপস্থাপনা আমাকে আকৃষ্ট করে যেমন বলেছেন রবার্ট ফ্রস্ট তাঁর The Mountain কবিতার শেষেঃ"I don't suppose the water's changed at all./You and I know enough to know it's warm/Compared with cold, and cold compared with warm./But all the fun's in how you say a thing." ঐ "But all the fun's in how you say a thing...' ই আমার শিল্প বিচারের মূল কথা। মূল লেখকের প্রকাশভঙ্গী অনুবাদ থেকে আন্দাজ করাযায়। তবে অনুবাদ থেকে 'অনুবাদ' গন্ধটা কিন্তু যায়নি পুরো।
একটা মারাত্মক ছাপার ভুল চোখে পড়লঃ"যখনই তার পছন্দের কিছু একট ঘটে কপালে ওমন ভাঁজ পড়ে।" অপছন্দের থেকে 'অ' উঠেগেছে।
আরেকটা কথা সুশান্তদা, মন্তব্য কিন্তু আমি নিজেথেকে করিনি। প্রথমবার পড়েও। তুমি বল্লে, তাই করলাম এবার।
"আরেকটা কথা সুশান্তদা, মন্তব্য কিন্তু আমি নিজেথেকে করিনি। প্রথমবার পড়েও। তুমি বল্লে, তাই করলাম এবার। " এতো আত্মরক্ষাত্মক কেন?
ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে বেশ উপকার করেছো। এর জন্যে ধন্যবাদ। এটি করিমগঞ্জের অপর্ণা দেবের সম্পাদিত সেবা কগজে ছাপবার জন্যে চলে গেছে। ওরা ভুল্টা ধরতে পেরে ঠিক করে দিলেই হয়।
বাকি যা বলেছো, তাতে আমার দ্বিরুক্তি করা সাজে না। এটাইতো চাই। তাতে ভাবতে সুবিধে হয়। গল্প কবিতার পাঠক হিসেবে ( গল্প কবিতার লেখক হিসেবেও) আমি যে তোমার চে' বহু পেছনে আছি সে অস্বীকার করি কী করে? তোমার মন্তব্য আমাকে ভাবতে সাহায্য করবে মাত্র। তাই তোমার মত চেয়েছি। শুধু দারুণ হয়চছে বললেতো কিছুই বলা হলো না।
হ্যাঁ , অনেকে বিষয় পছন্দ হলে বড়ো করে তুলে ধরে সেতো এক দেশদর্শিতা। সেদিক থেকে বিচার করলে সমরেশের সেই উপন্যাসও (ছায়ার শরীর) দারুণ। কিন্তু কী ভাবে বলল বলতে যদি তুমি বোঝাতে চাও সামগ্রিক সামঞ্জস্য আমার কোনো বিরোধ নেই। সমরেশের উপন্যাসে সামঞ্জস্যও নেই। কেউ কেউ শুধু আকারের বা স্টাইলের কথা বোঝায় এবং শেষে স্টাইলের সার্কাসে পরিণত করে। সেরকম নিশ্চয়ই তুমি বোঝাতে চাওনি। আমার অনুবাদের গন্ধ থাকতেই পারে। আমি কি আর এতো যত্ন করে করি? কোথায় ধরিয়ে দিলে সুবিধে হতো।
Post a Comment