মুল ইংরেজিঃ বিদ্যাভূষণ রাওত
রামলীলা ময়দানে যেখানে বাবা রামদেব এবং তাঁর পঞ্চাশ হাজার অনুগামীরা বিদেশ থেকে ‘কালোটাকা’ দেশে ফিরিয়ে আনবার দাবিতে অনশন করছিলেন দিল্লি পুলিশ সেখানে মাঝরাত্তিরে গিয়ে জোর করে তাদের উচ্ছেদ করে দিয়েছে। বাবা একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, সেদিন অব্দি তিনি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে বসবেন না, যে দিন অব্দি সারা ভারতের সব্বাই একটি করে শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যাবস্থা পেয়ে না যায়। তাঁর একটি লেণ্ডরোভার গাড়ি ছিল, পরে স্কোরপিও নিয়ে নেন। আশা করছি তিনি এটা বলতে যাবেন না যে তিনি লেণ্ডরোভার বা স্কোরপিও গাড়িতে তদ্দিন বসবেন না যদ্দিন না প্রতিজন ভারতীয় সেরকম করে একটি গাড়ি পেয়ে যান। বাবার অমন বক্তিমো প্রচুর আছে। এক সময় লালু এরকম ভাষণ দিতেন। কিন্তু তিনি যেমন ভালো বক্তা তেমনি তিনি বাবার থেকে বহু গভীরে গিয়েই ভারতীয়দের বুঝতে পারেন। বাবা এটা ভালো করেই জানেন যে তাঁর গ্রাহকরা হচ্ছেন মূলত স্থানীয় মাড়োয়াড়ি আর উচ্চবর্ণের লোকেরা যারা উজাড় করে তাঁর এই বিশাল প্রচারের পেছনে টাকা ঢেলেছেন। তাঁরা সবাই চান দেশের টাকা দেশে ফিরে আসুক। বাবাকে এই কথাটা কারো বুঝিয়ে দেয়া উচিত যে এই দেশের ভেতরেই সমান্তরাল অর্থনীতির অস্তিত্ব রয়েছে আর যারা বাবাকে দান দক্ষিণা করছেন তাদের সবার হাত ততটা পরিচ্ছন্ন নাও হতে পারে যতটা তিনি ভাবছেন। তবুও যা কিছু বাবার কাছে আসছে তাই যেভাবে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে দেখে এটা মনে হতেই পারে যে বাবা যা করেন তাই পূত পবিত্র।
শুরু থেকেই আমার বিশ্বাস ছিল যে সঙ্ঘপরিবার আর তাদের হিন্দুত্ববাদি গুণ্ডাদের নেতৃত্বাধীন বর্ণবাদি শক্তি বাবার পেছনে রয়েছে। মানবেন্দ্রনাথ রায় বহু আগেই লিখে গেছেন যে ভারতে ফ্যাসিবাদটা তত হিংস্র নাও হতে পারে, এ হবে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ। আমরা আজকাল চারদিকে কোরপোরেট ফ্যাসিবাদ দেখছি, আমাদের চাষিরা তাদের জমি দখলের বিরোধীতা করবার দায়ে বেধড়ে মার খাচ্ছেন, ছাত্ররা মার খাচ্ছে যখন তারা তাদের অধিকার এবং সংরক্ষণের জন্যে লড়াই করছে। কিন্তু এগুলো বাবার জন্যে কোনো সমস্যাই নয়। তিনি চাষাদের জন্যে ন্যায় চান , কিন্তু ভুলেও কখনো অন্যায় জমি দখলের বিরুদ্ধে অনশনে বসবেন না। বাবা রামদেব আমাদের কিছু সমস্যাকে ইচ্ছে করলেই জাতীয় চরিত্র দিতে পারতেন। আমাদের বন্ধু উদিত রাজ যখন চাকরিতে সংরক্ষণের জন্যে আমৃত্যু অনশন করছিলেন বেশির ভাগ লোকই আমরা একে বিশুদ্ধ রাজনীতি বলে উড়িয়ে দিয়েছি এবং তাঁর সমর্থণে এগিয়ে আসিনি। বাবা রামদেব দলিত এবং অবিসিদের সমস্যাগুলো নিয়ে নীরব কেন? কারণ তিনি জানেন এগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেই তিনি আর অশোক সিঙ্ঘল, স্বাধ্বী ঋতম্ভরাদের তাঁর মঞ্চে ডেকে আনতে পারবেন না। এদের মুখ দেখেই লোকের মনে প্রশ্ন জাগে দুর্নীতি নিয়ে এতো হৈ হল্লা করবার পেছনে রহস্যটা কী?
দুর্নীতি এই দেশে শুধু টাকার বেশ ধরে নেই, এ আমাদের মূল্যবোধের ভেতরে ঢুকে বসে আছে। আমাদের আধ্যাত্মিকতা আমাদের ব্রাহ্মণ্য ব্যাবস্থা এক অত্যুগ্র অত্যুচ্চ কাঠামোকে দাঁড় করিয়েছে যার নাম ব্রাহ্মণ্যবাদি সামাজিক অনুশাসন। কাকে বলে দুর্নীতি বাবাজী? আপনি জন্মসূত্রে শূদ্র হলেন বলেই তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলবার অনুমতিপত্র আপনার মিলে যায় না। বস্তুত, আপনি এই অধিকারবোধে সমুন্নত মস্তক নতুন শূদ্রদের আবারো ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছে মাথা নত করতে উদ্বুব্দ করতে চাইছেন , যা ঐ হিন্দুত্ববাদি শক্তিগুলোরো ইচ্ছে। তারা ঐ শূদ্র শক্তি দিয়ে দলিতদের একেবারে গোড়া মেরে ধ্বংস করে দিতে চায়। তারা চায় শূদ্ররা ব্রাহ্মণ্যবাদি ব্যবস্থার দ্বার রক্ষক হয়ে থাক—যে কথাগুলো বহু আগেই সঠিকভাবেই বলে গেছেন আম্বেদকার। বাবার চারপাশের মানুষগুলো কারা, কী চায় তারা? তারা সবাই দলিত, আদিবাসি, পশ্চাদপদ তথা সংখ্যালঘুদের জন্যে সংরক্ষণের কথা শুনলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। হ্যা, বাবা আমদের সংবিধান পালটে দিতে চান। তিনি চান আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ধাঁচের সরকারের মতো সরাসরি নির্বাচিত হোন। আমরা সবাই জানি ইন্দিরা গান্ধি, এবং পরে আদবানিও এটা চাইতেন। তারা সবাই এই সন্মিলিত সরকারের ধারাবাহিকতা দেখে আতঙ্কিত। স্থায়ী সরকারের অনস্তিত্ব দেখে তারা ভয়ার্ত। কাশিরাম সবসময় বলতেন সন্মিলিত সরকার দলিত স্বার্থের সুরক্ষার জন্যে সবচে মানানসই। একমাত্র তখনি তারা দলিত কন্ঠ শুনতে পাবে। রাষ্ট্রপতি ধাঁচের সরকারে সেই সব রাজনীতিকেরাই নির্বাচনে বিজয়ী হবে যাদের আছে অর্থ, গণমাধ্যম আর মাফিয়া। ( media, mafia and money)। আমরা সবাই জানি এগুলো আছে কাদের সঙ্গে। বাবাতো আর এস এসের হয়েই কাজ করছেন যাদের একটাই উদ্দেশ্য, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা।
গেল দিন বাবা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন তিনি মহিলাদের উপর বলাৎকারের তীব্র বিরোধীতা করেন। তিনি বলেছেন, তিনি হরিজন, বাল্মিকিদের ঘরে খাবার খান।কী মহানই না তিনি! প্রশ্নটি যে তাঁকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল এই সত্যই তিনি আড়াল করতে পারছিলেন না। তিনি ভুলে গেছেন হরিজন এক নিষিদ্ধ শব্দ আর তাদের কোনো দরকার নেই তাদের ঘরে আহার করবার বাবার কোনো ‘মহত্বে’র। তাঁর জানা উচিত যে অন্যায় ভাবে পাওয়া টাকা কালো হতে পারে না, কারণ এগুলো তাদেরই টাকা যারা তাকে তুলে ধরছে। তাঁর জানা উচিত যে আমাদের মঠ মন্দিরগুলো দুর্নীতির সবচে বড় আড্ডা। এই ভারতে গড়পড়তা প্রতিজন মানুষের ছয় হেক্টর করে জমি আছে, দলিতদের কিচ্ছু নেই। কিন্তু আপনি গরু কিম্বা পাথুরে দেবতার জন্যে বিশাল আয়তনের জমি পেয়েই যাবেন। সিলিং আইন বলে একটা আইন আছে, যার দৌলতে আপনি আঠারো একরের বেশি জমি রাখতে পারবেন না। একেক রাজ্যে এই আইন একেক রকম, কিন্তু এটা ঠিক যে আপনি ১৮ থেকে ২০ একরের বেশি জমি রাখতে পারবেন না। কিন্তু বিচিত্র সব ভগবানের জন্যে আপনি হাজার হাজার একর জমি পেয়েই যাবেন।এভাবে এই দেশে সমস্ত দুর্নীতি অঙ্কুরিত হয় ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থার ভেতর থেকে। এই মন্দিরগুলোর কাছে যেসব বেআইনী ধন রয়েছে সেগুলো প্রকাশ্য হওয়া উচিত। মঠ মন্দিরগুলোর সমস্ত আয়ের উপর কর বসানো উচিত। একটা আইন করে পাঞ্জাবের শিরোমণি গুরদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটি থেকে শুরু করে দেশের সমস্ত মঠ মন্দিরকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে আসা উচিত।
বাবা রামদেব, আমরা শুধু জানতে চাই আপনার এতো এতো জমি কিসের জন্যে দরকার? মানুষের কাছে পৌঁছোবার জন্যে আপনার হেলিকপ্টারের কী দরকার? আপনারতো দরকার রামায়ণ মহাভারতের যুগের বিমান। আপনার আধ্যাত্মিকতার প্রচারে জন্যে আধুনিক যন্ত্রের দরকারটা কী? আপনি আপনার বক্তৃতার রেকর্ড বাজিয়েই চলেন। আমরা সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে চাই। এ এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আপনার শব্দশৈলী আর অতিসরলীকরণ দিয়ে এর গুরুত্বটাকে এতোটা নিচে নামিয়ে আনবেন না। বেআইনি টাকাশুধু মরিশাস বা সুইজারল্যাণ্ডে নেই, ভারতের ভেতরেও আছে, সেগুলো নিয়ে আপনার দাতাদের মধ্যে কোনো গোপন আগ্রহ থাকতে পারে। দেশের ভেতরে থাকা বেআইনি টাকা নিয়ে আপনি কিছু বলছেন না কেন? দলিতবহুজনদের এমন টাকা নেই। এমন কি দলিতদের তথাকথিত দুর্নীতিবাজ নেতাদেরো অতো টাকা নেই যে সুইস বেঙ্কে গিয়ে জমা করে। বেআইনি টাকা কে কালো টাকা বলতে আমি নারাজ। কালোর শক্তিকে আমি শ্রদ্ধা করি, কালো রঙকে আমি শ্রদ্ধা করি। বেআইনি জিনিসকে কালো দিয়ে চিহ্নিত করবার আমি প্রবল বিরোধী। কালো হচ্ছে বিদ্রোহের প্রতীক, এ হচ্ছে দলিত বহুজনের রঙ। আমাদের বর্ণকে আক্রমণ করবেন না। যারা আপনাকে এতো এতো টাকা যোগাচ্ছে তাদের জিজ্ঞেস করুন কোত্থেকে আসছে এতো এতো টাকা? এ আমি সজোরেই বলতে পারি যে দলিত বহুজনের আপনার যোগের দরকার নেই , কারণ তারা কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। আপনার যতটা দানের দরকার ততটা দেবার সামর্থ্যও তাদের নেই বাবা।
কতো মহাত্মা এলেন আর গেলেন, গান্ধির অনশন নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন আম্বেদকার। তিনি এই বলে গান্ধির নিন্দে করেছিলেন যে , আর প্রায় সমস্ত বিষয় নিয়ে গান্ধি অনশন করলেন, কিন্তু দলিত উত্থানের জন্যে একটিবারও না। দকবারই দলিত সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে অনশনে বসলেন যদিও সেটিও ছিল দলিতদের জন্যে পৃথক নির্বাচনী বিধির বিরোধীতা করবার জন্যে। অনেক বছর পর যখন দলিতেরা আর অবিসিরা প্রত্যাহ্বান জানাবার মতো জায়গায় এসছে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের নিজেদের ভূমিকা দাবি করছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করছে বাবা রামদেবের বিপদ হলো তিনি তাদের সে জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন এবং সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনকে চাইছেন ক্ষয় করতে। রামলীলা ময়দানে পুলিশের হিংস্রতার আমরা নিন্দে করি। কিন্তু আমরা কি জানি না আমাদের পুলিশ করেটা কী আর কেমন করে? জানি না কি আমাদের সরকার কেমন ব্যবহার করে? একই পুলিশ যখন মুসলিম ছেলেকে ধরে পেটায়, তাদের নিয়ে গল্প বাঁধে, মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেয় আমরা সেগুলোকেই বেদবাক্য ধরে নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকি। ওরা যখন ছত্রিশগড় আর ঝাড়খণ্ডের আদিবাসিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে আমরা চুপটি করে থাকি, বলি তাদের তাই প্রাপ্য। আমরা এতো রেগে গেলাম কেন? এর জন্যে কি যে বশির ভাগ ভক্তেরাই আসলে উচ্চবর্ণের মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক?
সত্যি যদি বাবা রাজনীতি করতে চান, তিনি সরাসরিই তাতে যোগ দিন আর ঘোষণা করুন। তাঁর কর্মসূচী স্পষ্ট করুন। প্রত্যকেরই নিজের পক্ষে প্রচারে নামবার অধিকার রয়েছে। তাই বলে আপনার ‘যোগ আর বন্দেমাতরম’কে রাজনীতির জন্যে ব্যবহার করবে না। এ সম্পূর্ণই পর্দার আড়াল থেকে এক সাম্প্রদায়িক কর্মসূচী। আবার ব্রাহ্মণ্য কর্মসূচিকে সবার উপরে তুলে আনতে চায়। আমাদের সবার সতর্ক থাকতে হবে।
রামলীলা ময়দানে যেখানে বাবা রামদেব এবং তাঁর পঞ্চাশ হাজার অনুগামীরা বিদেশ থেকে ‘কালোটাকা’ দেশে ফিরিয়ে আনবার দাবিতে অনশন করছিলেন দিল্লি পুলিশ সেখানে মাঝরাত্তিরে গিয়ে জোর করে তাদের উচ্ছেদ করে দিয়েছে। বাবা একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, সেদিন অব্দি তিনি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে বসবেন না, যে দিন অব্দি সারা ভারতের সব্বাই একটি করে শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যাবস্থা পেয়ে না যায়। তাঁর একটি লেণ্ডরোভার গাড়ি ছিল, পরে স্কোরপিও নিয়ে নেন। আশা করছি তিনি এটা বলতে যাবেন না যে তিনি লেণ্ডরোভার বা স্কোরপিও গাড়িতে তদ্দিন বসবেন না যদ্দিন না প্রতিজন ভারতীয় সেরকম করে একটি গাড়ি পেয়ে যান। বাবার অমন বক্তিমো প্রচুর আছে। এক সময় লালু এরকম ভাষণ দিতেন। কিন্তু তিনি যেমন ভালো বক্তা তেমনি তিনি বাবার থেকে বহু গভীরে গিয়েই ভারতীয়দের বুঝতে পারেন। বাবা এটা ভালো করেই জানেন যে তাঁর গ্রাহকরা হচ্ছেন মূলত স্থানীয় মাড়োয়াড়ি আর উচ্চবর্ণের লোকেরা যারা উজাড় করে তাঁর এই বিশাল প্রচারের পেছনে টাকা ঢেলেছেন। তাঁরা সবাই চান দেশের টাকা দেশে ফিরে আসুক। বাবাকে এই কথাটা কারো বুঝিয়ে দেয়া উচিত যে এই দেশের ভেতরেই সমান্তরাল অর্থনীতির অস্তিত্ব রয়েছে আর যারা বাবাকে দান দক্ষিণা করছেন তাদের সবার হাত ততটা পরিচ্ছন্ন নাও হতে পারে যতটা তিনি ভাবছেন। তবুও যা কিছু বাবার কাছে আসছে তাই যেভাবে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে দেখে এটা মনে হতেই পারে যে বাবা যা করেন তাই পূত পবিত্র।
শুরু থেকেই আমার বিশ্বাস ছিল যে সঙ্ঘপরিবার আর তাদের হিন্দুত্ববাদি গুণ্ডাদের নেতৃত্বাধীন বর্ণবাদি শক্তি বাবার পেছনে রয়েছে। মানবেন্দ্রনাথ রায় বহু আগেই লিখে গেছেন যে ভারতে ফ্যাসিবাদটা তত হিংস্র নাও হতে পারে, এ হবে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ। আমরা আজকাল চারদিকে কোরপোরেট ফ্যাসিবাদ দেখছি, আমাদের চাষিরা তাদের জমি দখলের বিরোধীতা করবার দায়ে বেধড়ে মার খাচ্ছেন, ছাত্ররা মার খাচ্ছে যখন তারা তাদের অধিকার এবং সংরক্ষণের জন্যে লড়াই করছে। কিন্তু এগুলো বাবার জন্যে কোনো সমস্যাই নয়। তিনি চাষাদের জন্যে ন্যায় চান , কিন্তু ভুলেও কখনো অন্যায় জমি দখলের বিরুদ্ধে অনশনে বসবেন না। বাবা রামদেব আমাদের কিছু সমস্যাকে ইচ্ছে করলেই জাতীয় চরিত্র দিতে পারতেন। আমাদের বন্ধু উদিত রাজ যখন চাকরিতে সংরক্ষণের জন্যে আমৃত্যু অনশন করছিলেন বেশির ভাগ লোকই আমরা একে বিশুদ্ধ রাজনীতি বলে উড়িয়ে দিয়েছি এবং তাঁর সমর্থণে এগিয়ে আসিনি। বাবা রামদেব দলিত এবং অবিসিদের সমস্যাগুলো নিয়ে নীরব কেন? কারণ তিনি জানেন এগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেই তিনি আর অশোক সিঙ্ঘল, স্বাধ্বী ঋতম্ভরাদের তাঁর মঞ্চে ডেকে আনতে পারবেন না। এদের মুখ দেখেই লোকের মনে প্রশ্ন জাগে দুর্নীতি নিয়ে এতো হৈ হল্লা করবার পেছনে রহস্যটা কী?
দুর্নীতি এই দেশে শুধু টাকার বেশ ধরে নেই, এ আমাদের মূল্যবোধের ভেতরে ঢুকে বসে আছে। আমাদের আধ্যাত্মিকতা আমাদের ব্রাহ্মণ্য ব্যাবস্থা এক অত্যুগ্র অত্যুচ্চ কাঠামোকে দাঁড় করিয়েছে যার নাম ব্রাহ্মণ্যবাদি সামাজিক অনুশাসন। কাকে বলে দুর্নীতি বাবাজী? আপনি জন্মসূত্রে শূদ্র হলেন বলেই তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলবার অনুমতিপত্র আপনার মিলে যায় না। বস্তুত, আপনি এই অধিকারবোধে সমুন্নত মস্তক নতুন শূদ্রদের আবারো ব্রাহ্মণ্যবাদের কাছে মাথা নত করতে উদ্বুব্দ করতে চাইছেন , যা ঐ হিন্দুত্ববাদি শক্তিগুলোরো ইচ্ছে। তারা ঐ শূদ্র শক্তি দিয়ে দলিতদের একেবারে গোড়া মেরে ধ্বংস করে দিতে চায়। তারা চায় শূদ্ররা ব্রাহ্মণ্যবাদি ব্যবস্থার দ্বার রক্ষক হয়ে থাক—যে কথাগুলো বহু আগেই সঠিকভাবেই বলে গেছেন আম্বেদকার। বাবার চারপাশের মানুষগুলো কারা, কী চায় তারা? তারা সবাই দলিত, আদিবাসি, পশ্চাদপদ তথা সংখ্যালঘুদের জন্যে সংরক্ষণের কথা শুনলেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। হ্যা, বাবা আমদের সংবিধান পালটে দিতে চান। তিনি চান আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ধাঁচের সরকারের মতো সরাসরি নির্বাচিত হোন। আমরা সবাই জানি ইন্দিরা গান্ধি, এবং পরে আদবানিও এটা চাইতেন। তারা সবাই এই সন্মিলিত সরকারের ধারাবাহিকতা দেখে আতঙ্কিত। স্থায়ী সরকারের অনস্তিত্ব দেখে তারা ভয়ার্ত। কাশিরাম সবসময় বলতেন সন্মিলিত সরকার দলিত স্বার্থের সুরক্ষার জন্যে সবচে মানানসই। একমাত্র তখনি তারা দলিত কন্ঠ শুনতে পাবে। রাষ্ট্রপতি ধাঁচের সরকারে সেই সব রাজনীতিকেরাই নির্বাচনে বিজয়ী হবে যাদের আছে অর্থ, গণমাধ্যম আর মাফিয়া। ( media, mafia and money)। আমরা সবাই জানি এগুলো আছে কাদের সঙ্গে। বাবাতো আর এস এসের হয়েই কাজ করছেন যাদের একটাই উদ্দেশ্য, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ছিঁড়ে ফেলা।
গেল দিন বাবা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন তিনি মহিলাদের উপর বলাৎকারের তীব্র বিরোধীতা করেন। তিনি বলেছেন, তিনি হরিজন, বাল্মিকিদের ঘরে খাবার খান।কী মহানই না তিনি! প্রশ্নটি যে তাঁকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল এই সত্যই তিনি আড়াল করতে পারছিলেন না। তিনি ভুলে গেছেন হরিজন এক নিষিদ্ধ শব্দ আর তাদের কোনো দরকার নেই তাদের ঘরে আহার করবার বাবার কোনো ‘মহত্বে’র। তাঁর জানা উচিত যে অন্যায় ভাবে পাওয়া টাকা কালো হতে পারে না, কারণ এগুলো তাদেরই টাকা যারা তাকে তুলে ধরছে। তাঁর জানা উচিত যে আমাদের মঠ মন্দিরগুলো দুর্নীতির সবচে বড় আড্ডা। এই ভারতে গড়পড়তা প্রতিজন মানুষের ছয় হেক্টর করে জমি আছে, দলিতদের কিচ্ছু নেই। কিন্তু আপনি গরু কিম্বা পাথুরে দেবতার জন্যে বিশাল আয়তনের জমি পেয়েই যাবেন। সিলিং আইন বলে একটা আইন আছে, যার দৌলতে আপনি আঠারো একরের বেশি জমি রাখতে পারবেন না। একেক রাজ্যে এই আইন একেক রকম, কিন্তু এটা ঠিক যে আপনি ১৮ থেকে ২০ একরের বেশি জমি রাখতে পারবেন না। কিন্তু বিচিত্র সব ভগবানের জন্যে আপনি হাজার হাজার একর জমি পেয়েই যাবেন।এভাবে এই দেশে সমস্ত দুর্নীতি অঙ্কুরিত হয় ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থার ভেতর থেকে। এই মন্দিরগুলোর কাছে যেসব বেআইনী ধন রয়েছে সেগুলো প্রকাশ্য হওয়া উচিত। মঠ মন্দিরগুলোর সমস্ত আয়ের উপর কর বসানো উচিত। একটা আইন করে পাঞ্জাবের শিরোমণি গুরদোয়ারা প্রবন্ধক কমিটি থেকে শুরু করে দেশের সমস্ত মঠ মন্দিরকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে আসা উচিত।
বাবা রামদেব, আমরা শুধু জানতে চাই আপনার এতো এতো জমি কিসের জন্যে দরকার? মানুষের কাছে পৌঁছোবার জন্যে আপনার হেলিকপ্টারের কী দরকার? আপনারতো দরকার রামায়ণ মহাভারতের যুগের বিমান। আপনার আধ্যাত্মিকতার প্রচারে জন্যে আধুনিক যন্ত্রের দরকারটা কী? আপনি আপনার বক্তৃতার রেকর্ড বাজিয়েই চলেন। আমরা সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে চাই। এ এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আপনার শব্দশৈলী আর অতিসরলীকরণ দিয়ে এর গুরুত্বটাকে এতোটা নিচে নামিয়ে আনবেন না। বেআইনি টাকাশুধু মরিশাস বা সুইজারল্যাণ্ডে নেই, ভারতের ভেতরেও আছে, সেগুলো নিয়ে আপনার দাতাদের মধ্যে কোনো গোপন আগ্রহ থাকতে পারে। দেশের ভেতরে থাকা বেআইনি টাকা নিয়ে আপনি কিছু বলছেন না কেন? দলিতবহুজনদের এমন টাকা নেই। এমন কি দলিতদের তথাকথিত দুর্নীতিবাজ নেতাদেরো অতো টাকা নেই যে সুইস বেঙ্কে গিয়ে জমা করে। বেআইনি টাকা কে কালো টাকা বলতে আমি নারাজ। কালোর শক্তিকে আমি শ্রদ্ধা করি, কালো রঙকে আমি শ্রদ্ধা করি। বেআইনি জিনিসকে কালো দিয়ে চিহ্নিত করবার আমি প্রবল বিরোধী। কালো হচ্ছে বিদ্রোহের প্রতীক, এ হচ্ছে দলিত বহুজনের রঙ। আমাদের বর্ণকে আক্রমণ করবেন না। যারা আপনাকে এতো এতো টাকা যোগাচ্ছে তাদের জিজ্ঞেস করুন কোত্থেকে আসছে এতো এতো টাকা? এ আমি সজোরেই বলতে পারি যে দলিত বহুজনের আপনার যোগের দরকার নেই , কারণ তারা কঠোর পরিশ্রমী মানুষ। আপনার যতটা দানের দরকার ততটা দেবার সামর্থ্যও তাদের নেই বাবা।
কতো মহাত্মা এলেন আর গেলেন, গান্ধির অনশন নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন আম্বেদকার। তিনি এই বলে গান্ধির নিন্দে করেছিলেন যে , আর প্রায় সমস্ত বিষয় নিয়ে গান্ধি অনশন করলেন, কিন্তু দলিত উত্থানের জন্যে একটিবারও না। দকবারই দলিত সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে অনশনে বসলেন যদিও সেটিও ছিল দলিতদের জন্যে পৃথক নির্বাচনী বিধির বিরোধীতা করবার জন্যে। অনেক বছর পর যখন দলিতেরা আর অবিসিরা প্রত্যাহ্বান জানাবার মতো জায়গায় এসছে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের নিজেদের ভূমিকা দাবি করছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করছে বাবা রামদেবের বিপদ হলো তিনি তাদের সে জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন এবং সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনকে চাইছেন ক্ষয় করতে। রামলীলা ময়দানে পুলিশের হিংস্রতার আমরা নিন্দে করি। কিন্তু আমরা কি জানি না আমাদের পুলিশ করেটা কী আর কেমন করে? জানি না কি আমাদের সরকার কেমন ব্যবহার করে? একই পুলিশ যখন মুসলিম ছেলেকে ধরে পেটায়, তাদের নিয়ে গল্প বাঁধে, মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেয় আমরা সেগুলোকেই বেদবাক্য ধরে নিয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকি। ওরা যখন ছত্রিশগড় আর ঝাড়খণ্ডের আদিবাসিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে আমরা চুপটি করে থাকি, বলি তাদের তাই প্রাপ্য। আমরা এতো রেগে গেলাম কেন? এর জন্যে কি যে বশির ভাগ ভক্তেরাই আসলে উচ্চবর্ণের মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক?
সত্যি যদি বাবা রাজনীতি করতে চান, তিনি সরাসরিই তাতে যোগ দিন আর ঘোষণা করুন। তাঁর কর্মসূচী স্পষ্ট করুন। প্রত্যকেরই নিজের পক্ষে প্রচারে নামবার অধিকার রয়েছে। তাই বলে আপনার ‘যোগ আর বন্দেমাতরম’কে রাজনীতির জন্যে ব্যবহার করবে না। এ সম্পূর্ণই পর্দার আড়াল থেকে এক সাম্প্রদায়িক কর্মসূচী। আবার ব্রাহ্মণ্য কর্মসূচিকে সবার উপরে তুলে আনতে চায়। আমাদের সবার সতর্ক থাকতে হবে।
2 comments:
কলি কালে ওহে রাম
মাতায়েছ ধূমধাম
ঝুলি ভরা মালকড়ি
ছেড়ে যতো মাড়োয়ারি
কালোটাকা সাদা করে ফিকিরে
আর কিছু সোজা লোক
ওহে গৃহ-বলী-ভুক
ভেসেযায় তোমার এই জিগীরে
বাহ! দারুণ লিখেছো তো সপ্তর্ষি!
Post a Comment