ভারতীয় রাজনীতিতে যেমন একদিকে
প্রবল মার্কিন প্রীতি অন্যদিকে দুর্বল মার্কিন বিরোধিতার লড়াই চলছে,
বাংলাদেশ সহ সমস্ত ভারতীয় উপমহাদেশগুলোর ছোট দেশে ভারত প্রেম এবং ভারত
বিরোধীতা রাজনীতির এক বাস্তবতা। একে অস্বীকার করা যাবে না। ভারতবর্ষ
সীমান্ত দিয়ে সাধারণ মানুষের,
চোরাকারবারিদের, সন্দেহভাজন সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রেবেশ নিয়েই আতঙ্কে থাকে।
তাই কাঁটাতারের বেড়া। সীমান্তে অত্যচার খুন ইত্যাদি। কিন্তু কাঁটাতারের
বাইরেও ভারতে বাংলাদেশের আরো বহু ব্যাপারেরই আইনত বা আইন বহির্ভূত ভাবে
প্রবেশ নিষেধ। আইন বহির্ভূত ভাবে বলছি মানে, আম-ভারতীয়ের বাংলাদেশের বহু
পণ্যের প্রতি এক সাধারণ অবজ্ঞা বোধ। যেমন ভারতে বাংলাদেশের বা
পাকিস্তানের টিভি চেনেলগুলোর প্রবেশ অবাধ নয়, সাহিত্য সঙ্গীতের বা
চলচ্চিত্রের সেরকম বাজার নেই। এটা সক্রিয় কোনো প্রতিরোধের জন্যে সব সময় হয়
তার জন্যে নয়, এর পেছনে এক সাধারণ অবজ্ঞা বোধও কাজ করে। তার কিছু বাস্তব
কারণ আছে, বাকিটা অবজ্ঞা এবং অজ্ঞতা। এই যেমন বাংলাদেশের মাটিতে ক'দিন আগে
'আনন্দ বাজারে'র কপি পুড়তে দেখে অনেক ভারতীয় নিশ্চয় ক্ষুব্ধ হয়েছি। কিন্তু এই
প্রশ্ন করেছি কি ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের কোনো কাগজ পুড়িয়ে দেবার জন্যেও
পাচ্ছি না কেন? অথচ এই লেখাতে কত কত ভারতীয় পণ্যের বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছে দেখুন। তার মানে ভারতীয় পণ্য আইনী উপায়েই কী ব্যাপক ভাবে বাংলাদেশের
বাজারে অনুপ্রবেশ করেছে । তার মানে, ভারতীয় পণ্য উৎপাদকদের কাছে
বাংলাদেশ একটা ক্রেতা সমাবেশ মাত্র। এর কিছু পণ্য নিশ্চয়ই সেদেশেই তৈরিও
হয়, যেমন ভারতে তৈরি হয় বহু মার্কিনি বা জার্মান বা কোরীয় পণ্য। এবারে
উৎপাদন কেন্দ্র তখনি স্থানান্তরিত হয় যখন সহজে ও সস্তায় জমি মেলে, মেলে
কাঁচামাল, এবং অতি অবশ্যই সস্তা শ্রম।
সস্তা শ্রমের বাজার আর ক্রেতার
বাইরের উদ্বৃত্ত জনতাকে বাজার গরুছাগলের বেশি কোনো মূল্য দেয় না। তারা
থাকলেই কি না থাকলেই কি? সীমান্ত তারাই অতিক্রম করে। পুঁজি যেদিকে ঘনীভূত
হয় উদ্বৃত্ত জনতা সেদিকেই যাত্রা করে এক মায়াময় স্বপ্নের সন্ধানে। তাই
কাঁটাতারের পক্ষে বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে তেমন সমর্থণ ভিত্তি থাকবে না,
একে পার করে যাওয়াটাকে কেউ তেমন অপরাধ হিসেবে দেখবেনও না, এটা খুবই
স্বাভাবিক। পৃথিবী জুড়ে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের তাই আজ একটাই স্বপ্নের দেশ
,তার নাম আমেরিকা। সেখানেতো রীতিমতো 'নো বর্ডার আন্দোলন' জোরদার। তাই,
বাংলাদেশে ভারত বিরোধী যে ক্ষোভ তা কেবল দুই দেশের লড়াই নয়, এক রকম শ্রেণি
সংগ্রামও বটে।এবং ভারতের দিক থেকে তাদের
লড়াইকে আমাদের বিরোধিতা করাটা অনেকটা শাসক শ্রেণির পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলবার
মতো।
ভারতের বাজার বাংলাদেশে টিকে আছে বাংলাদেশেরই মধ্যবিত্তদের এক বড় এবং
ক্ষমতাশালী পক্ষের সমর্থণে। তাই ভারত বিরোধী জিগির আসলে দেশটির ভেতরের শ্রেণিদ্বন্দ্বকেও
প্রকাশ করে। জরুরি নয় যে , এর সবটাই সর্বৈব ভারত বিদ্বেষ। এবং আমাদের
ভারতীয়দের এসব কথাবার্তা শুনলেই গা পুড়িয়ে তেড়ে যেতে হবে। কিন্তু মুস্কিল
হলো মধ্যবিত্ত মুখে যতটা গর্জায় তত বর্ষায় না। এবং অনেক সময়েই সে তার
গণভিত্তিকে ধরে রাখবার বা গড়ে তুলবার জন্যে মুখেই জগৎ মারে। এবং দিশাহীন
বকুনি ঝাড়ে। স্মরণ করুন, 'ঘরেবাইরে'র সন্দীপ বিদেশি সিগারেট খেত। এবং তাদের
প্রয়াসের ফলে মুসলমান প্রজা বিপন্ন হয়। ওই উদ্বৃত্ত জনতার স্বাধিকার
রক্ষার লড়াই, সস্তা শ্রমিকের এবং বিপন্ন কৃষকের স্বাধিকার রক্ষার লড়াই এবং
ভারতে তাদের শ্রেণি মিত্রদের সঙ্গে আঁতাত গড়বার কথা মাথায় রেখে যখন কেউ কথা
বলবেন তখন তাদের বয়ানটাই আলাদা হবে। এবং হবে অনেক বেশি কার্যকরী। এই
হুজুগে মধ্যবিত্ত জানেনই না, যেমন আমেরিকাতে বহু মানুষ ইরাক, আফগানিস্তান,
পালেস্টাইন, ভারত, পাকিস্তানের হয়ে লড়াই করেন, তেমনি ভারতে বহু বহু মানুষ
আছেন যারা নিত্যদিন উপমহাদেশে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
মধ্যবিত্ত দামী কাগজে পড়ে অরুন্ধতী রায়ের কথা জানেন। কিন্তু সেরকম মানুষ১২৫
কোটির ভারতে ওই একজন আছেন--শুনলেই আমার ভীষণ হাসি পায়। পেটে খিল ধরে।
2 comments:
বাংলাদেশের জনগণ দিল্লির আধিপত্তবাদের বিরুদ্ধেও লড়ছে। ১৫৭৫ সাল থেকে ১৭৫৭, ২০০ বছর বাংলা দিল্লির অধীন ছিল। সেই ২০০ বছরের ইতিহাস বাংলাকে শোষণেরই ইতিহাস।
১৭৫৭এর আগে শোষণ ছিল, কিন্তু সেকি আর আধুনিক ঔপনিবেশিক শোষণ? ওই তারিখের আগের আর পরেরটাকে গুলিয়ে ফেললে মুস্কিল আছে। কারণ তাতে আধুনিক ঔপনিবেশিক শক্তি যার অধীনে স্বয়ং দিল্লি রয়েছে তাকে আড়াল করা হবে, আর প্রা-আধুনিক শোষকদের যাই বলুন তাদের আজ আর অস্তিত্ব নেই। সুতরাং পরিণাম দাঁড়াবে এই যে এই লড়াই হবে শত্রুপক্ষ ছাড়াই। শেষ অব্দি নিজেদের ভেতরে লড়াই। মালদ্বীপের ঘটনা অনুসরণ করুন। খুবই স্পষ্ট ভারত যা করছে তার পেছনে মার্কিনিদের কলকাঠি রয়েছে।
Post a Comment