"হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে,—এ দেশে চিত্ত তাহার নাই। যাহা নাই তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াই বা লাভ কি, এবং তাহাদের বিমুখ কর্ণের পিছু পিছু ভারতের জলবায়ু ও খানিকটা মাটির দোহাই পাড়িয়াই বা কি হইবে! আজ এই কথাটাই একান্ত করিয়া বুঝিবার প্রয়োজন হইয়াছে যে, এ কাজ শুধু হিন্দুর,—আর কাহারও নয়। " --এই কথা যিনি লিখেছিলেন , তিনি কে ?তিনিকি মৌলবাদী? তিনি রেডিক্যাল? তাঁর বিরুদ্ধে যারা দিনের পর দিন নীরব রইলেন তারা কারা ? রেডিক্যাল? তাঁর এব্ং তাঁর মতো শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে দ্বিজাতি তত্বের প্রবক্তা হবার অভিযোগ উঠল না কেন? এই ভদ্রলোক কি রাজনীতির লোক? তিনি কি অন্যের দ্বারা বিভ্রান্ত? ......হ্যা, আছে র্যাডিক্যাল দু'পক্ষেই । কিন্তু স্থান কাল পাত্র নিরপেক্ষ ভাবে দু'পক্ষই সমান ক্ষমতা ভোগ করে না।আমি যে উদ্ধৃতি দিয়েছি এটা আর কারো নয়! অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্যি যে এটা সেই মহান লেখকের যিনি 'মহেশ'এর মতো গল্প লিখেছিলেন। যখন তিনি গল্প লেখেন তখনতো সত্য তাঁর কাছে ধরা পড়ে। তিনি দেখান কী করে গাঁয়ের বর্ণহিন্দু বামুন এবং জমিদার -জোট ধর্ম এবং শাস্ত্রকে ব্যবহার করে শ্রেণি শোষণকে বৈধতা দিচ্ছে। এবং গফুর মিঞার মতো মহেশ নামের অবলা গো-জীবটির পালক পিতার ঘাড়েই গো-হত্যার দায় চাপিয়ে তাকে ভিটে ছাড়া করেছিল। অর্থাৎ, ধর্ম শুধু এদের কাছে এক বিশ্বাস নয়, শোষনের সামাজিকভাবে শক্তিশালী এক হাতিয়ার। আমার মতে দেশের সাম্প্রদায়িকতার অন্তর্বস্তুকে বুঝতে হলে এই গল্পটিকেই আমাদের বারে বারে পড়া উচিত। অথচ, সেই শরৎ চন্দ্র যখন বক্তৃতা করেন,( তাও হিন্দু সঙ্ঘের সভাতে গিয়ে) তখন তিনি সত্যের থেকে দূরে সরে যান এবং গফুর মিঞাকে যারা গ্রাম ছাড়া করেছিল ঠিক তাদের প্রতিভূ হয়ে তিনি মুসলমান বিদ্বেষ উগরে দেন। এরকম বিদ্বেষ ভরা গল্প প্রবন্ধ লিখে গেছেন, বক্তৃতা দিয়ে গেছেন আমাদের দেশের নামজাদা সব 'মহান' সাহিত্যিকেরা, ইতিহাসবেত্ত্বারা। ভাবুন টডের 'রাজস্থান' নামের এক ইতিবৃত্তের বই ধরে শুরু হয়েছিল মুসলমান খলনায়ক বানিয়ে বাংলা কাব্য উপন্যাস নাটকের ইতিহাস। সেগুলোই পড়ে পড়ে বিশ্বাস করে করে আমরা বড় হয়েছি। আমাদের মুসলমান সহপাঠিরা সেগুলোই পড়ে পড়ে মন খারাপ করে করে বিনা প্রতিবাদে হজম করে করে বড় হয়েছেন। এই সব শিখে শিখে বড় হয়েই আমরা সাংবাদিক হচ্ছি, লেখক হচ্ছি, বৌদ্ধিক সমস্ত প্রতিষ্ঠান দখল করেছি। সেই আমরা কি নিত্যদিন ছড়াই না সাম্প্রদায়িকতা? এগুলো কি শুধু রাজনীতির লোকের কাজ? রাজনীতির লোকের গায়ে দায় চাপিয়ে আমরা যারা আধিপত্যের রাজনীতির সমস্ত সামাজিক সুখ ভোগ করি তারা নিজের পাপ আড়াল করি। আজ দেশে এমন অবস্থা হয়েছে যে গফুর মিঞাদের নিত্যদিন যে সামাজিক অত্যচার হয় , কোত্থাও যদি তারা তার প্রতিবাদ করেন, গরুর মিঞার মতো মহেশের ঘাড়ে লাঙলের কোপ বসিয়েও দেন আমরা সেই অধিকারও তাদের থেকে কেড়ে নিতে ব্যস্ত। কল্পনা করুন, আজ লালার যে দুটো ছেলে মারা গেল ( আতিকুর রহমান এবং সইবুর রহমান) , সব্বাই আশা করবেন 'শান্তি'র স্বার্থে এই হত্যার যেন কোনো প্রতিবাদ না হয়। অথচ এই ঘটনাই যদি উলটো হতো, দেশ জুড়ে একে জেহাদী ষড়যন্ত্র বলে প্রচার দেয়া হতো। অনুসন্ধান করে দেখুন, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে, দক্ষিণ পূব এশিয়ার দেশে, মধ্যেপ্রাচ্যে, আফ্রিকাতে, আমেরিকাতে, লাতিন আমেরিকাতে অনুপ্রবেশকারী এক সমস্যা। এরাই সবচে দলিত পীড়িত অসংগঠিত সস্তা শ্রমিক দেশে দেশে। এদের মেয়েরাই সব চে সস্তা বেশ্যা ( দেশের পতিতা পল্লীতে সন্ধান পাবেন 'বাংলাদেশী' বেশ্যাদের) । কিন্তু আজ আমরা যারা মানবতাবাদী বলে দাবি করি, যারা দাবি করি নিজেরা অসাম্প্রদায়িক তাদেরও ভয়ে ভয়ে ভয়ে মেনে নিতে হচ্ছে , হ্যা দেশে অনুপ্রবেশকারী আছে বটে। আর তাদের না তাড়ালে দেশে শান্তি নামছে না! আমরা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছি, শরণার্থীদের নাগরিত্বের প্রমাণ দিতে হবে বাড়ি ফিরবার আগে!
এখনো 'মহেশে'রা মরছে নীরবে আর নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ ফিরিয়ে গফুর মিঞা প্রার্থণা জানাচ্ছে, "আল্লা ! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চ'রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক'রো না।" আমিনার হাত ধরে বেরিয়ে যাবে যে গফুর মিঞা তার জন্যে কোনো 'ফুলবেড়ের চটকল'ও আমরা আর নিরাপদ রাখিনি!
No comments:
Post a Comment