মূল ইংরাজি: দীপ হালদার
বাংলা অনুবাদ: সুশান্ত কর
(দ্বীপ হালদার ইণ্ডিয়া টুডে কাগজের কার্যবাহী সম্পাদক। তাঁর Blood Inland---An Oral History of The Marichjhapi Massacre’ বইটি বছর তিনেক আগে ২০১৯-শে প্রকাশ করে হারপারকলিন্স পাবলিশার্স। এর বাংলা অনুবাদ করলাম আমি । নয় অধ্যায়ের এই বইটির অনুবাদ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে উত্তর বাংলার কাগজ শাঙ্খিকে। )
কেউ জানে না, কেউ কখনো জানতে পারে না, এমন কি স্মৃতিতেও না, কারণ কিছু মুহূর্ত রয়েছে যেগুলো দুর্জ্ঞেয়।
-- অমিতাভ ঘোষের উপন্যাস ‘The Shadow Lines’.
ম |
রিচঝাঁপি কলকাতার পুবে সুন্দরবনের একটি দ্বীপ। ১৯৭৮-এর মাঝামাঝি প্রায় দেড়লাখ হিন্দু উদ্বাস্তু, অধিকাংশই দলিত তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষ মধ্যভারত থেকে এখানে আসেন বসত করতে আসেন। কিছু মানুষকে মাঝপথ থেকেই ফেরানো হয়েছিল, বাকিরা পুলিশের ঘেরাওর মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হন এবং মরিচঝাঁপি পৌঁছোন।
এক বছরের মধ্যে তাঁরা জনশূন্য ভূমিকে কর্মমুখর গ্রামে পরিণত করেন।সারিবদ্ধ কুঁড়েঘর,মাছের সমবায়,একটি ঈশকুল,লবণ চাষের জমি,একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র,একটি নৌকা তৈরির কারখানা,একটি বিড়ি তৈরির কারখানা,আর একটি বেকারি। এই সব তৈরি করতে টাকা জোগাড় করেন তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মীদের থেকে। পশ্চিম বাংলা সরকার কিছুই করে নি।
১৯৭৯-র মে মাসে বামফ্রণ্ট সরকার তাদের সবাইকে দ্বীপ থেকে উচ্ছেদ করে ফেলেন। অধিকাংশকেই মধ্যভারতের সেই সব উদ্বাস্তু শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যেখান থেকে তাঁরা এসেছিলেন। এক সময়পর্বে প্রচুর করুণ মৃত্যু হয় অপুষ্টিতে, রোগে এবং সরকারের নির্দেশে পুলিশের নামানো হিংসাতে। যারা রক্ষা পেয়ে গেছিলেন তাঁদের অনেকে বলেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ তখন মারা গেছিলেন। মরিচঝাঁপি হতে পারত বাঙালি দলিতদের ক্ষুদ্র ব্যবসা ও উদ্যোগের উজ্জ্বল নজির। তার বদলে এটি কিনা হল স্বাধীন ভারতের সবচাইতে নিকৃষ্ট গণহত্যার নজির।হিংসার মাত্রা,মৃত্যু আর ধর্ষণের নজিরে এটি ছিল ১৯৮৪তে দিল্লির শিখ বিরোধী এবং ২০০২তে গুজরাটে মুসলমান বিরোধী হত্যার থেকেও বড় গণহত্যার ঘটনা।
এই সব ঘটল কেন? আমরা সেই কারণগুলোই জানার চেষ্টা করেছি মরিচঝাঁপি ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে ছিলেন—এমন সব মানুষজনের নিজেদের মুখে বলা কথার থেকে। কিন্তু মরিচঝাঁপিতে যাবার আগে,চলুন আমরা শুরুতে যাই --- দেশভাগের সেই দিনগুলোতে যার জন্যে পুব বাংলার বিভিন্ন জেলার থেকে মানুষজন কলকাতা আসেন, এবং এখান থেকে মধ্যভারতের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে ধরে বেঁধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলার বিঘ্ন
বাংলা দুবার ভাগ হয়। ১৬ অক্টোবর,১৯০৫-এ মুসলমান প্রধান পূর্ব ভাগ হিন্দু প্রধান পশ্চিম থেকে আলগা করা হয়। যদিও তখনকার বড়লাট লর্ড কার্জন প্রকাশ্যে বলেছিলেন বাংলা শাসনের দক্ষতা বাড়াতেই এই বিভাজন,আড়ালে এই সিদ্ধান্তের পেছনে ‘ভাগ করে শাসন করবার’ ঔপনিবেশিক নীতিই প্রয়োগ করা হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক পথে বাংলা ভাগ হয়েছিল।
হিন্দুরা (যাদের অধিকাংশই ছিলেন ব্যবসা ও জমির মালিক) অভিযোগ করেন যে তারা এমন একটি প্রদেশে সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন যার অংশ হয়ে আছে বিহার ওড়িশাও,মুসলমানেরা সাধারণভাবে এই বিভাজনের সমর্থন করেছিলেন, কারণ তারা বর্ণহিন্দুদের দ্বারা নিজেদের ব্যবহৃত এবং অবহেলিত ভাবতেন। তারউপরে অধিকাংশ কল-কারখানাই গড়ে উঠেছিল কলকাতার চারপাশে,যেগুলোর জন্যে কাঁচামাল আসত পুববাংলার মুসলমান চাষির জমি থেকে।
১৯০৬-এ ঢাকাতে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক কণ্ঠ হিসেবে মুসলিম লীগ গড়ে উঠল। বিভাজন ব্যাপক রাজনৈতিক সংকট নিয়ে এল।ভারতের জাতীয় কংগ্রেস স্বদেশী আন্দোলন শুরু কর, বিলেতি পণ্য ও প্রতিষ্ঠান বর্জন শুরু হল। সেই সব রাজনৈতিক প্রতিবাদের ফলে ১২ ডিসেম্বর,১৯১১তে দুই বাংলা আবার এক হল।
এর পরে এল আরেক বিভাজন।এবারে ধর্মের লাইনে নয়,ভাষার ভিত্তিতে। হিন্দি,ওড়িয়া, অসমিয়া এলাকাগুলো বাংলার থেকে আলগা করে নিয়ে আরো পশ্চিমে বিহার ও ওড়িশা, পুবে অসম নামে কয়েকটি প্রদেশ তৈরি করা হল। ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনিক রাজধানীও কলকাতা থেকে নিয়ে চলে যাওয়া হল নয়া দিল্লিতে।
প্রথম বিভাজনের ঘা কখনোই পুরো শুকোয় নি,সেই ঘা-তে হিংস্র পচন ধরল যখন দ্বিতীয় বিভাজনের কথা শুরু হল। ১৯৪৭এ দেশ ভাগ হল।
আগস্ট ১৯৪৭-এ তিন শতাব্দী পরে ব্রিটিশ যখন দেশ ছেড়ে গেল শেষঅব্দি উপমহাদেশ আবারও ধর্মের ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্রে বিভাজিত হয়ে গেল।হিন্দু প্রধান ভারতবর্ষ আর মুসলমান প্রধান পাকিস্তান।এইভাবে শুরু হল ইতিহাসের সবচাইতে বড় মানবিক প্রব্রজন।লাখো মুসলমান চলে গেলেন (অথবা বলপ্রয়োগে যেতে বাধ্য করা হল) পশ্চিম আর পুব পাকিস্তানে (এখনকার বাংলাদেশ)।লাখো হিন্দু এবং শিখ এর বিপরীতে যাত্রা করলেন।
পশ্চিম বাংলাতে প্রথম শরণার্থীর তরঙ্গটি ছিল বর্ণহিন্দুদের,দলিতদের নয়।দলিতেরা জীবন জীবীকার জন্যে তাদের জমি বাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাঁধনে বাঁধা ছিলেন। বর্ণহিন্দুদের সেরকম ছিল না। ফলে দলিতরা এত দ্রুত দেশ বদল করেন নি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মুসলমান আর তপশিলী সম্প্রদায়ের মানুষের নিজেদের মধ্যে সামান্যই বিরোধ ছিল। কারণ এই দুই গোষ্ঠীর মানুষকেই উচ্চশ্রেণির মানুষের একই আর্থিক শোষণের মুখে পড়তে হত। তাঁরা শুধু যে একই জীবিকায় ছিলেন তাই না, জীবন যাপনের শৈলী, ভাষা এবং সংস্কৃতি ছিল একই। বর্ণহিন্দুদের কাছে মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু দুইই ছিলেন অস্পৃশ্য।
০০০
‘On the Margins of Citizenship: Cooper’s Camp in Nadia’ নামে একটি বিদ্যায়তনিক গবেষণা নিবন্ধে ঈশিতা দে লিখেছেন,পূর্বভারতে (পুব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম বাংলাতে) শরণার্থী প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো হচ্ছে ১৯৪৭,১৯৪৮,১৯৫০,১৯৬০,১৯৬২,১৯৬৪,১৯৭০ যখন কিনা পশ্চিম ভারতে (পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উত্তর ভারতে) ১৯৪৭-এই তা সম্পূর্ণ হয়েছিল। তিনি লিখেছেন,“পশ্চিম বাংলা সরকারের তথ্য মতে ১৯৫৩তে ২৫ লাখ লোককে বল প্রয়োগ করে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬১ তে সেরকম বড় অনুপ্রবেশ ঘটেনি কিন্তু ১৯৫৮ অব্দি সংখ্যাটি ৩১-৩২ লাখে পৌঁছে গেছিল। পরে ১৯৬২তে পাবনা ও রাজশাহীতে সংখ্যালঘু নিধনের ফলে ৫৫ হাজার মানুষ চলে আসেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১এর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ মানুষ সীমা পার করে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সংঘাতে ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে,প্রায় ৭১ লক্ষ। কেন্দ্রীয় যোগান এবং পুনর্বাসন মন্ত্রী শ্রী রামনিবাস মির্ধা ১৯৭৬-এ লোকসভাতে এক বিতর্কে এই তথ্য দিয়েছিলেন যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ অব্দি পুব বাংলা থেকে ভারতে ৫২.৩১ লক্ষ মানুষ প্রবেশ করেন।
এই ব্যাপক অনুপ্রবেশ বস্তুতই পশ্চিমবাংলার প্রশাসনিক যন্ত্রকে ভেঙে দিয়েছিল। পশ্চিম বাংলার তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় ১৯৫০এর ২৮ সেপ্টেম্বর বিধানসভাতে এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন যে শরণার্থীদের নিতান্ত আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থাটাই যথেষ্ট নয়। তাঁর সরকার যে কথাতে বারে বারে গুরুত্ব দিচ্ছিল তা হচ্ছে স্থানের অভাব,সম্পদের অভাব আর শরণার্থীদের তরফে নতুন অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেবার মানসিকতার অভাব।
১৯৫২র ১৪ অক্টোবরে পাসপোর্ট ব্যবস্থা শুরু হয়। এর ঘোষণা হতেই শরণার্থীর বন্যা বয়।
সরকারি তথ্যমতে,পশ্চিম বাংলাতে সংখ্যাটি ছিল ৩,১৬, ০০০ এবং অসম ত্রিপুরা মিলিয়ে তিন বছরেই সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ৫,৮৭,০০তে। এই শরণার্থীদের ৯৯%ই ছিলেন নমশূদ্র ও অন্যান্য তপশিলী সম্প্রদায়ের হিন্দু মানুষজন।
৩১ মার্চ ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩র ডিসেম্বর পর্যন্ত যে শরণার্থীরা ভারতে আসেন তাদের একটি লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হত যে তাঁরা কোনো সরকারি সাহায্য দাবি করবেন না। সেই সঙ্গে কোনো এক ভারতীয় নাগরিককেও লিখিত দায়িত্ব নিয়ে জানাতে হত যে তিনি শরণার্থীর অশন-বসনের ভার নেবেন। তবেই শরণার্থী প্রমাণপত্র দেওয়া হত। সে যাই হোক,তাতে লোকের চলে আসা থামে নি।
এর পরে যা শুরু হয় তা হল ভারতের মাটিতে অবৈধ প্রবেশ। একটি বেসরকারি সূত্রের মতে সংখ্যাটি খুব কম করেও ৩ লাখে পৌঁছেছিল।
কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদে সুরক্ষিত হজরত মুহম্মদের চুল হারিয়ে গেলে পুব পাকিস্তানে ব্যাপক হিংসা ছড়ায়, তাতে আরেক বড় অনুপ্রবেশ হয় ১৯৬৩র ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৪র ফেব্রুয়ারির মধ্যে।খুলনা,ঢাকা,যশোর,ফরিদপুর, ময়মনসিংহ,নোয়াখালি এবং চট্টগ্রামে ব্যাপক খুন, ধর্ষণ, লুটপাটের ঘটনা ঘটে।তাতে প্রায় ২লক্ষের মতো শরণার্থী ভারতে এসে প্রবেশ করেন।এদের মধ্যে ১ লক্ষের মতো মানুষ আসেন পশ্চিম বাংলাতে,৭৫ হাজার যান অসমে, ২৫ হাজার ত্রিপুরাতে। (যুগান্তর, ৭ এপ্রিল, ১৯৬৪)
এই যাত্রা কতটা বেদনাদায়ক ছিল, আবেগিক এবং বিষয়গতভাবে তাই এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে নথিবদ্ধ করা হয়েছে। পুব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসবার স্মৃতিকাতর বর্ণনা দিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী জ্যোতির্ময় মণ্ডল।
দণ্ডকারণ্যের ঠিকানাতে
শরণার্থীদের এই নয়া দলকে,যাদের অধিকাংশই নমঃশূদ্র,পশ্চিমবাংলার অস্থায়ী শিবিরগুলো থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মধ্যভারতের দণ্ডকারণ্যে। দণ্ডকারণ্য বিশাল এলাকা। ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় এবং মহারাষ্ট্রের অরণ্যঘেরা এলাকা। কেন্দ্র সরকার দণ্ডকারণ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(DDA) তৈরি করে এই রুখাশুখা ভূমিতে এই উদ্বাস্তুদের কাজে লাগিয়ে পথঘাটের এবং কৃষিভূমি উন্নত করবার প্রকল্প হাতে নেয়।
হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণে এই এলাকার কথা আছে,রাম সীতা ও লক্ষণ এখানেই চৌদ্দ বছরের বনবাসে গেছিলেন। সেই প্রাচীন মহাকাব্যে লেখা আছে,এখানকারই কোথাও রাজা রাবণের বোন শূর্পণখা লক্ষণকে দেখে প্রেমে পড়েছিলেন। লক্ষণ তাঁকে উপেক্ষা করেছিলেন,এবং নাক কেটে দিয়েছিলেন।যার থেকে শুরু হয় এক দীর্ঘ যুদ্ধ।সেই যুদ্ধে রাম রাবণকে হত্যা করেন।
লাখো বাঙালি উদ্বাস্তুদের ওখানে পাঠানো হল আরেক কঠিন লড়াই লড়তে। সেই লড়াই গ্রীষ্মের অসহনীয় তাপ আর হাড় কাঁপানো শীতের সঙ্গে। চাষ অযোগ্য জমি, আর ওখানকার স্থানীয় মানুষ যারা তাঁদের ভাষা বোঝেন না।
অনেকেই সময়ের সঙ্গে প্রতিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন এবং নিবাসস্থল বানিয়ে নিয়েছিলেন।যেমন ৬৪ বছরের কালাচাঁদ দাস।তাঁকে পাঠানো হয়েছিল রায়পুরের মানা শিবিরে।তিনি সেখানেই থেকে গেছিলেন। কখনোই সেই জায়গা ছেড়ে বেরোন নি। তাঁর মতে মরিচঝাঁপি একটি ভ্রান্ত অভিযান ছিল। (অধ্যায় ৬)
বাকিরা পশ্চিমবাংলাতে ফিরে আসবার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন,যেখানকার বাকি বাঙালিদের সঙ্গে তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি মেলে। কেউ কেউ শিবিরের আধিকারিকদের এবং প্রতিবেশী স্থানীয়দের দুর্ব্যবহারের কথা বলেছেন। শিবিরগুলোতে বসবাসের প্রতিকুল পরিবেশ তো ছিলই। (অধ্যায় ৬)
বাম বিশ্বাসঘাতকতা
শরণার্থীদের যখন ধরে বেঁধে দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হচ্ছিল,বিরোধী বামদলগুলো তখন দাবি জানাচ্ছিলেন তাঁদের বাংলাতেই থাকতে দেওয়া হোক। আমি সাক্ষাৎকার নিতে গেলে অনেকেই বলছিলেন,জ্যোতি বসু,যিনি পরে লাগাতার ২৩ বছরের (১৯৭৭-২০০০) জন্যে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন—নিজের বক্তৃতাতে সরকারের কাছে এই দাবি জানিয়েছিলেন।বেশ কিছু বাম নেতা,বিশেষ করে রাম চ্যাটার্জি দণ্ডকারণ্যেও গেছিলেন শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন,বামেরা ক্ষমতাতে এলে তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে (অধ্যায় ৮)।স্বাভাবিকভাবেই উদ্বাস্তুরা ভেবেছিলেন বামেরা হচ্ছেন তাঁদের মিত্র।
১৯৭৭-এর জুনে সেই বামেরা ক্ষমতাতে এলেন।কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে কাউকেই তাঁদের আগেকার পশ্চিম বাংলাতে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সম্পর্কে দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে কিছু ভাবতে বা করতে আগ্রহী দেখা গেল না।কিছু দিন অপেক্ষা করবার পরে বহু মরিয়া উদ্বাস্তু ১৯৭৭-এর ১২ জুলাই তারিখে বামফ্রণ্ট সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী রাধিকা চক্রবর্তীকে একটি স্মারকপত্র দেন।তাঁরা জানালেন যদি সরকার তাঁদের দণ্ডকারণ্য থেকে নিয়ে আসতে কিছু না করেন, তবে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের দায়িত্বে ফিরে আসবেন।
মরিচঝাঁপি এবং অতি জঘন্য হত্যাকাণ্ড
হতাশ হয়ে ১৯৭৮-এর মার্চের কোনো এক সময় দেড়লাখের বেশি উদ্বাস্তু দণ্ডকারণ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পশ্চিম বাংলার হাসনাবাদ রেলস্টেশনের দিকে রওয়ানা দেন। তাঁরা বাংলাতে এসে পৌঁছুতে না পৌঁছুতে পুলিশ তাঁদের আটকায়, জোর করে ট্রেন থেকে নামায় এবং দণ্ডকারণ্যে ফিরিয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা নেয়। যদিও সেই চেষ্টা পুরোটা সফল হল না।
বাধা ডিঙিয়ে হাজারো পুরুষ,মহিলা ও শিশু ১৯৭৮-এর ১৮ এপ্রিলে এসে মরিচঝাঁপি পৌঁছুলেন। পরের মাসগুলোতে আরো বহু মানুষ এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
বাংলার দক্ষিণে এই দূর সুন্দরবনের ভেতরে মানববসতি বিহীন এই দ্বীপের কথা তাঁরা জানলেন কী করে? কেউ কেউ জানালেন বাম নেতারা যখন বিরোধী ছিলেন তখন নিজেরাই এই এলাকার খবর দণ্ডকারণ্যের শরণার্থীদের দেন। অন্যেরা জানান উদ্বাস্তু নেতারা নিজেরাই জায়গাটি আবিষ্কার করেন এবং নিজেদের আবাসভূমি বানাবার পরিকল্পনা করেন। সুন্দরবনের একটি টুকরো বাংলাদেশেরও অংশ। সেই টানেই এরা এখানে চলে আসবার কথা ভাবতে শুরু করেন (অধ্যায় ৬)
লোকচক্ষুর আড়ালে গঙ্গার মোহনাতে সুন্দরবন হচ্ছে দুনিয়ার সবচাইতে বড় ভারত বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা গরান অরণ্য ঢাকা ভূমি।একে ইউনেস্কো ইতিমধ্যে জীব-বৈচিত্র্যের জন্যে সংরক্ষিত ভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছে।এই অনন্য বাস্তুসংস্থান (ecosystem) কে আরো বিশেষ করছে,জায়গাটি হচ্ছে গঙ্গা,পদ্মা,মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র --এই চারটি নদীর মিলনস্থল।
সরকার থেকে কোনো সাহায্য না পেয়েও এই শরণার্থীরা একটি সভ্যতার কাছে প্রায় অস্তিত্বহীন এই ভূমিকে একটি সজীব বাস্তুতন্ত্রে পরিণত করেন।কিন্তু পরের বছরে ১৯৭৯-র মে মাস আসতে না আসতে পুলিশ তাঁদের সবাইকে এই দ্বীপ থেকে তাড়িয়ে দেয়।অভিযোগ আছে যে প্রায় ৬ হাজার কুড়েঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।কেউ জানে না ঠিক ক’জন রক্ষা পেয়েছিলেন। এরই মধ্যে জানুয়ারির শেষদিকে অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু হয়। এবং সেই সময়েও বাম সরকারের নির্দেশে পুলিশ বার বার দ্বীপবাসীকে আক্রমণ করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
আমরা যখন কান্তি গাঙুলির সঙ্গে কথা বলেছিলাম (অধ্যায় ৮) এবং স্টেটসম্যান কাগজে তখনকার সুন্দরবনের পুলিশ অধীক্ষক,যার নেতৃত্বে মরিচঝাঁপি সাফাই অভিযান চলেছিল,অমিয় কুমার সামন্তের দেয়া তথ্য পড়তে পেলাম তাতে জানতে পারলাম যে ‘দশজন থেকেও কম’ লোক তখন সেই দ্বীপে মারা গেছিলেন। কিন্তু আমি যখন সেই দ্বীপে বেঁচে যাওয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম,তাঁরা জানালেন সংখ্যাটি ৫ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে। কেউ কেউ এর থেকেও বেশি বলে বললেন। এত বিশাল তফাৎ কেন? একটি কারণ হল সংবাদ মাধ্যম তখন খুব কমই মরিচঝাঁপির ঘটনাকে সংবাদ করেছিল।দ্বীপটি মূল স্রোতের কেন্দ্র কলকাতা থেকে এত দূর আর সেখানে যাওয়া এত কঠিন ছিল যে মরিচঝাঁপিতে কী ঘটেছিল তা কেবল মৌখিক ইতিহাসেই পুনর্গঠন করা সম্ভব।১৯৭৯-এর ১৭ মে তারিখে,তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাইটার্স বিল্ডিঙে ঘোষণা করেন যে মরিচঝাঁপিকে উদ্বাস্তুদের দখলমুক্ত করা গেছে।
গণহত্যার কারণ
জ্যোতি বসু সরকার বল প্রয়োগ করে এই মরিচঝাঁপির মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করলেন কেন? সরকারি বয়ন হচ্ছে এই যে মরিচঝাঁপি সুরক্ষিত দ্বীপ আর উদ্বাস্তুরা সেখানকার গাছগুলোকে কেটে বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করছিলেন। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগও রয়েছে,কেননা উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই দলিত।কেউ বলেন,এ হচ্ছে বাংলার ভদ্রলোক মার্ক্সবাদীদের চেহারা-- যারা আলোচনাচক্রে,রাজনৈতিক বক্তৃতাতে তো শ্রেণিহীন,বর্ণহীন সমাজের কথা বলেন—কিন্তু ভেতরের বর্ণ সংস্কার এহেন ঘটনাতে বেরিয়ে আসে (মনোরঞ্জন ব্যাপারী, অধ্যায় ৯)। অন্যেরা বলেন, বামফ্রণ্ট সরকার ভেবেছিল নিজেরা যেহেতু উদ্বাস্তুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছিলেন, তাই ভেবেছিলেন এরা বামেদের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন পশ্চিম বাংলাতে।
কিন্তু এর কোনোটাই মরিচঝাঁপির বাসিন্দাদের উপরে সেই ভয়ানক বলপ্রয়োগকে কোনো বৈধতা দিতে পারে না।
মরিচঝাঁপির সত্যিকার গল্প তৈরি করা মিথ্যে আর আবেগিক কান্নার মাঝামাঝি কোথাও চাপা পড়ে গেছিল। আমি সেরকম বহুর সঙ্গে দেখা করলাম যাঁদের আমি বহু বছর ধরে জানতাম, বহু নতুন মানুষজনের সঙ্গেও কথা হল যারা পুরোনো ঘা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন। সাংবাদিকের নোটবইতে কলম বসিয়ে আমি লিখে গেলাম সেই সব নর-নারীর টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা যাদের জীবন বিপন্ন করেছিল মরিচঝাঁপির গল্প ।
No comments:
Post a Comment