আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Monday, 22 August 2011

অসমের বাঙালির রাজনীতিঃ বহমান বয়ান স্রোতে খানিক অবগাহন ০১

                       [গুয়াহাটির পুরোনো ছোট কাগজ 'একা এবং কয়েকজনে'র এবারের শারদ সংখ্যাতে প্রকাশিত]
               
          দেশজুড়ে চারদিকে যখন অরাজনৈতিকতার জোয়ার, মানুষ ব্যাপক এবং বিশাল গণআন্দোলনে যোগ দিতে দিতে জানান দিচ্ছেন যে তারা রাজনীতি করছেন না, তখন একটি কাগজ ‘অসমের বাঙালির রাজনৈতিক ভাবনা’ এরকম একটা বিষয় বেছে নেয়াতে মনেই হয় তারা স্রোতের বিরুদ্ধে পা ফেলতে চাইছেন। কিন্তু স্রোতের বিরুদ্ধেও একটা স্রোত রয়েছে--- বলিউড পরিচালকেরাও প্রায়ই উচ্চারণ করে থাকেন ‘জরা হটকে’। বাঙালির রাজনৈতিক ভাবনা নিয়েও কিন্তু এই ‘জরা হটকের’ বড় জটিল জাল ছড়ানো রয়েছে । একে ‘রাজনীতি’, তায় ‘এই জাল’—কথা বলতে বেশ ভয় করেই বটে। তথাপি স্রোতেতো লাশ ভেসে যায়, বিরুদ্ধে দাঁড়ালে অন্তত বোঝা যায় প্রাণটি টিকে আছে। তাই পরিকল্পকেরা ধন্যবাদার্হ । 
          মুস্কিল হচ্ছে, অসমের মাটিতে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে কথা বলতে গেলে খড়কুটো যত সাহায্য করে, তৈরি নৌকো ততটা মোটেও নয়। অর্থাৎ, চর্চা এতো অল্প যে দু’মলাটের বাঁধা বইয়ে পূর্বসূরি পণ্ডিতদের বাড়ানো হাতের সন্ধান খুব অল্প মেলে। অবশ্যি জ্ঞানার্জনে বই পত্তরই একমাত্র সাহায্য করে—এই বিশ্বাস এই লেখকের বহু আগেই উড়ে গেছে । তার বাস্তব কারণ বোধ করি এই যে অসমের অসমিয়া ভিন্ন বাঙালি বা অন্যান্য জনগোষ্ঠী নিয়ে বইয়ের সংখ্যা যেমন অপ্রতুল, যেগুলো আছে সেগুলোও কোনো বই বাজারে সাজানো গুছানো করে পাওয়া বড় কঠিন কাজ। শিলচর গুয়াহাটির মতো নগরে যদিও বা কিছু সুবিধে রয়েছে, অন্যান্য শহরে বা গাঁয়ে তাও নেই বিশেষ। সুতরাং আমার বিশ্বাস সেই মাও-ৎসে-তুঙে। জনগণের কাছে যাও, জনগণের থেকে শেখো, জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দাও। এই না করে যত আলাপই করি না কেন, সবই শেষ বিচারে প্রলাপ হতে বাধ্য।
         সুজিৎ চৌধুরী সম্ভবত এই সমস্যাগুলো খুব করে অনুভব করতেন, তাই তিনি একটা কথা বারে বারে লিখতেন, “শূন্য স্লেটে দাগ কেটে’ যাবার কথা। ‘স্লেট’ শব্দটা এর জন্যে কি ব্যবহার করতেন , ইচ্ছে করলেই মুছে নতুন দাগ দেয়া যাবে বলে? হবেও বা! আমিও ওই দাগ কেটে যাবার বেশি কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না, তা হবে তাঁর মত বিদগ্ধ জনের থেকে অনেক খাটো। তর্ক উঠতেই পারে, তিনি বা তাঁর মতো অনেকে, যেমন অমলেন্দু গুহ বা আরো অনেকে যাদের নামের তালিকা খুব একটা খাটো হবে না, যেটুকু দাগ কেটে গেছেন আমরা কি ওখান থেকে শুরু করব? না তাঁর সমান্তরালে? এইখানে, আমি কিছু শিবের গীত গাইব। কথা যখন স্রোত নিয়েই শুরু হচ্ছিল, সেতো সরল রেখাতে এগোয় না। আমাদের জ্ঞান সরল রেখাতে এগোয়—এই বিশ্বাস হচ্ছে আমাদের সব বিশ্বাসের বাড়া । ষোড়শকোনের একটা বইয়ের মধ্যে তাঁকে আবার স্থায়ীভাবে বেঁধে ফেলা যায় এটা আমার কাছে কেমন ঈশ্বরের বিশ্বাসের মতোই অসম্ভব এক বিশ্বাস বলেই মনে হয়। সুতরাং ফাঁক এবং ফাঁকি আমাতেও থাকবেই। এবারে, নাস্তিক মন্দিরে পা ফেলতে বাধ্য হলেই যেমন দুরু দুরু বুকে বড় সতর্ক হয়ে যায়, আমার কাছেও বিদ্বজ্জন সমাবেশ তেমনি বড় এক আতঙ্কের বিষয়, তা কোনো সেমিনারেই কথা বলাই হোক , কিম্বা লিটিল মেগে গদ্য লেখা। এই কথাটা আমি আত্মরক্ষার্থে লিখছি মাত্র, কারো বিশ্বাসের সম্মানহানি করা আমার উদ্দেশ্য নয় মোটেও। কেন, কথাটা খুলে বলি। আজকাল ‘ডিকন্সট্রাকশনে’র কথা হচ্ছে, ‘লেখকের মৃত্যু’ ঘোষিত হয়ে গেছে। আমার কথাগুলোতে সেরকম কিছু কিছু ইঙ্গিত আপনারা পেয়ে থাকবেন। আমি ওই সব ফরাসি পণ্ডিতদের ভক্তও নই। কারণ ওদেশে ঢেউ উঠল তো এখানে এই দেশে হাওয়া বইল—এও একরম অপ্রাকৃতিক এবং একরৈখিক জ্ঞানের ধারণা। আলোও শেষ বিচারে সেরকম আচরণ করে না, জল কিম্বা হাওয়াতো মোটেও নয়। এরা, দেখতেই দেখা যায় বড় বিশৃঙ্খল, কিন্তু শেষে গিয়ে ওদেরকেও একটা শৃঙ্খলা না মেনে নিলে কাজ চলে না। কথা হচ্ছে, আপনি কখন, কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন আর কোন দিকে তাকাচ্ছেন। সেই ‘আপনি’ হতে পারেন ব্যক্তি কিম্বা সমাজ, অঞ্চল, জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায়, বর্ণ, প্রদেশ, রাষ্ট্র, লিঙ্গ ইত্যাদি যা কিছু অগুনতি পরিচিতি আপনি ধারণ করেন তার সম্মিলিত প্রতিনিধিও। মানুষ যখন কথা বলে, কিম্বা কাজ করে তখন সে কেবল একা করে না, তার সঙ্গে করে তার সমগ্র সমাজের স্মৃতি-সত্তা-স্বপ্ন, সে যখন খুবই ব্যক্তিকেন্দ্রিক তখনো।
        
     এবারে আমি মোটামোটি আমার কথা বলবার মতো জায়গাতে এসে গেছি। আমিও যে মাওয়ের নির্দেশে জনগণের থেকে শিখে এসে বলছি তা নয়। তবে জনগণের একটা বিশাল অংশ আজকাল কথা বলেন দৈনিক কাগজে । আরেকটা বিশাল অংশ সেখানে বলেনও না । প্রতাপের নিচে ঢাকা পড়ে যাওয়া সেই নীরবতাগুলোও কান পাতলে খানিকটা শোনা যায় বটে, কিন্তু না শোনা অংশটাই বেশি। এই সীমাবদ্ধতার কথা শুরুতেই জানিয়ে নিই। বস্তুত, অসমে বাংলা সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রচার প্রসার সাম্প্রতিক কালে  বাঙালির রাজনৈতিক ভাবনার জগতে এক নতুন মাত্রা নিয়ে এসছে। কেবল এই নিয়েই একটা নিবন্ধ দাঁড় করানো যায়।
প্রসঙ্গঃ  অসমের  দুই  উপত্যকা  এবং  বাঙালি
             একটা সময় ছিল যখন, বাঙালিকে নিয়ে বৌদ্ধিক চর্চাতে বরাক উপত্যকার অনেকটা একাধিপত্য ছিল। মনে করা হতো যে অসমিয়া উগ্র-জাতীয়তাবাদের চাপে এবং তাপে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। একটা সহানুভূতির হাওয়া বইত। কিন্তু এখন একাধিক বাংলা দৈনিক এবং সাময়িকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা যখন তাঁর বৌদ্ধিক অস্তিত্বের জানান দিতে শুরু করেছে তখন সেই সহানুভূতি নিজের প্রতিষ্ঠা রক্ষার দায়ে তার চেহারা বদল করতে শুরু করেছে । সেটা এতোটাই যে জনপ্রিয় সাংবাদিক এবং সম্পাদক সুকুমার বাগচিকে গেল ১০ এপ্রিল,১১ র দৈনিক যুগশঙ্খে উত্তর সম্পাদকীয়তে কলম ধরতে হয়। তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল , “প্রসঙ্গঃ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি—সাধু উদ্দেশ্যই যথেষ্ট নয়, সহানুভূতির সঙ্গে সত্য নিষ্ঠাও কাম্য” সেখানে তিনিও নাম না করে তাঁর পরিচিত এক লেখকের একটি লেখার সূত্র ধরে আলোচনাকে টেনেছেন। সেই অনামা লেখকের সঙ্গে দুটো বিষয়ে তাঁর দ্বিমতের কথা তিনি জানিয়েছেন শুরুতেই, “ উক্ত নিবন্ধ রচয়িতার একটি সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ: ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অধিকাংশ বাঙালিই বাড়ির বাইরে ...বাংলায় কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন আর সেই কারণেই নাকি বরাক উপত্যকার বাঙালিদের সঙ্গে প্রথমোক্তদের দূরত্ব প্রায় চরমে পৌঁছে গেছে।তাঁর আরো বক্তব্য এই যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি বাঙালিদের উদাসীনতা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। সেখানে অনেক ক্ষেত্রে বাঙালিরাও নাকি বাঙালিদের সঙ্গে অসমিয়া ভাষাতেই কথাবার্তা বলেন। দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে উক্ত লেখক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করেছেন তা হলো বরাক উপত্যকায় ভাষা শহীদের রক্তস্নাত উনিশে মে । তাঁর আপত্তির কারণ কলকাতার বাঙালিরা যথাযথ মর্যাদায় এই দিনটি পালন করে থাকেন, বরাকের ১৯মের আত্মত্যাগের কথা পশ্চিম বঙ্গ, বাংলাদেশ, ঝাড়খণ্ড ও ত্রিপুরার বাঙালিরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙ্গালিরা দিনটি উদযাপন করেন না।” স্বভাবতই শ্রীবাগচি, এর পর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে নানা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অসমীয়া বাঙালি পাশাপাশি বাস করেন। নানা সময়ে পারস্পারিক তিক্ততার সৃষ্টি হলেও সদ্ভাবের অভাবটাও যে নেই সেই কথার সঙ্গে বিদেশি বাছাইয়ের নামে, ডি-ভোটার করিয়ে হেনস্তা ইত্যাদির উল্লেখ করেও লিখেছেন বাড়ির বাইরে এরা বাংলাতে কথা বলেন না বা বাংলা চর্চা করেন না এ ডাহা মিথ্যে প্রচার। তিনি, এই উপত্যকাতে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের ক্রম-সম্প্রসারণের এক লম্বা তালিকা দিয়েছেন। আমাদের তার পুনরুল্লেখ করবার দরকার দেখি না । ১৯মে পালিত হয় না, এই তথ্যটাও সত্য নয় বলেই তিনি লিখেছেন।
           তর্কটা এখানেই ফুরিয়ে গেলে কোনো কথা ছিল না। দিন কতক পরে অধ্যাপক লেখক জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত দৈনিক সকালবেলাতে লিখলেন আরেকটি উত্তর-সম্পাদকীয়। শিরোনামঃ “ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ”। তাঁর শুরুটিই ছিল এরকম—“একটা পরিস্থিতির কথা ভাবা যাক। ধরা যাক, দু-হাজার কুড়ি সাল নাগাদ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বাংলা ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেল। অর্থাৎ এই ভূখণ্ডে একজন বাঙালিও আর রইলেন না । তখন কী হবে ? উদাসীন বলবেন, যা হবার তা হবে। অন্তত 'গেল' 'গেল' এই রবটা আর থাকবে না। যা যাবেই তা কি ধরে রাখবার জিনিস ? অন্যদল বলবেন, এমনটা যে হবে তা অনেকদিন আগেই জানতাম -- ভবিষ্যদ্বাণী তো করেই রেখেছিলাম। তিন নম্বর সম্ভাবনা হল, বরাক বা পশ্চিমবঙ্গের গবেষককুল আকুল হয়ে উঠবেন এর কারণ অনুসন্ধানী গবেষণাপত্র তৈরি করতে। জ্ঞানরাজ্যের ফলন বেশ ভালোই হবে । জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলো সরগরম হবে। যাঁরা এখনকার ভবিষ্যদ্বক্তা, তাঁদের চাহিদা তখন তুঙ্গে। কারণ তাঁরাই তো এমন একটা পরিস্থিতির প্রধান ব্যাখ্যাতা এবং উপাদান সংগ্রাহকের ভূমিকা গ্রহণ করবেন !” স্পষ্টতই এটা বোঝা গেল, ব্যক্তি যখন কথা বলেন তিনি এখন একা বলেন না। এখানে একটি ভাষিক সম্প্রদায় কথা বলছে । জ্যোতির্ময়েই পাচ্ছি, “অথচ দৈনিক সংবাদপত্র বা অন্যান্য সাময়িক পত্রাদিতে আমরা কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে বেশ কিছু সুষম (balanced) লেখা পড়েছি। সেগুলোতে সমস্যার উত্স ও সমাধানসূচক কিছু সম্ভাবনাময় প্রস্তাব সম্পর্কেও জেনেছি । এর মধ্যে নিজেরও কয়েকটা নিবন্ধ রয়েছে । এছাড়া ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা ভাষাচর্চার ইতিবাচক নানা দিকের খবরও সংবাদপত্রে পেয়েছি । সেগুলো কেন যে নেতিবাচক সমালোচকদের চোখ এড়িয়ে যায় তা বুঝি না । তাই না জেনেশুনে কিছু বিরূপ উক্তি বা হা-হুতাশ যখন করতে দেখি তখন লেখাগুলোকে মনে হয় বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অথবা গড্ডলিকাপ্রবাহে ভাসমান প্রলাপ। ” তদুপরি স্থান পালটালে বয়ান      ( narrative) পাল্টায় তাও দেখা গেল, তাতেই বরাক ব্রহ্মপুত্র পশ্চিম বাংলা-কথাগুলো আসছে।  আমরা যে ‘জ্ঞানবিশ্বের প্রতাপে’র আতঙ্কের কথা বলছিলাম, জ্যোতির্ময়ের ইঙ্গিতও অনেকটাই সেদিকেই।“জ্ঞানরাজ্যের ফলন বেশ ভালোই হবে । জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলো সরগরম হবে।”
       
         জ্যোতির্ময় বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গেই লিখছেন, “আত্মীকরণ মানে কিন্তু আপোষ নয়, আত্ম-বিনষ্টিও নয়। অন্যকে জানার মাধ্যমেই আত্ম-বিস্তার ঘটে -- বাঙালি এ-ভাবেই জগতের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ পেয়েছিল। নিজেকে কূপমণ্ডূক করে রেখে নয়। অসম সাহিত্য সভার সাম্প্রতিক ক্রিয়াকর্মের দিকে চোখ রাখতে অনুরোধ করছি । শুভকাজ যত ছোটই হোক, যত ত্রুটিই থাকুক আয়োজনে -- তার প্রভাব ও ব্যাপ্তি সুদূরপ্রসারী। এখানে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাবন্ধিকেরা সাহিত্য সভার কাজকর্মগুলোকে যদি সমর্থন করতে পারেন তবে আখেরে বাংলা ভাষারই লাভ। বলা বাহুল্য, এতে অসমিয়া বা বাঙালি জাতিসত্তার কোনও রকম হানি হচ্ছে না। এছাড়া অসম ও বাংলাকে কেন্দ্রে রেখে সাহিত্য অকাদেমি যে কাজগুলো করছেন সে-সম্পর্কে সদর্থক বিশ্লেষণেও লেখকেরা এগিয়ে আসতে পারেন। গুয়াহাটির 'সাতসরী' সাময়িক পত্রিকাটি অসমিয়া ও বাঙালিদের সম্পর্ক নিয়ে যে দুটি অসাধারণ সংখ্যা করেছিল বা স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে অসমিয়া ছাত্র-ছাত্রীরা যে বাংলা সাহিত্য পড়েন (অনেক কলেজে বাংলার অধ্যাপকেরাই সেগুলো পড়ান), সে-সম্পর্কে দু-কলম প্রশংসাসূচক মন্তব্য যদি এই প্রাবন্ধিকেরা লিখতে পারেন তবে আশা করি তাঁদের মনে হবে না যে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকারে।”
             ১৯শমে পালন করা না করা নিয়ে তিনি লিখছেন, “আমি আগেও বলেছি, যা দূরতর ইতিহাস, সে-সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র চেতনা বর্তমান প্রজন্মের নেই। তবু এখানে নিয়ম করে উনিশে মে বা একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। অথচ ভালো করেই জানি, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় যাঁরা শহিদ হয়েছেন (সংখ্যাটা এগারোর চেয়ে বেশি হলেও), তাঁদের জন্য উপত্যকার বাইরে বাংলা ভাষার শুভচিন্তকেরা কখনও কোনও সভা আয়োজন করেননি। করে থাকলে আমাকে পরিসংখ্যান জানাবেন, আমি মন্তব্য তুলে নেব। বর্তমান সময়ে বাঙালিরা পরস্পর অসমিয়াতে কথা বলেন -- এই অভিযোগও অবান্তর। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে সাধারণ ভাবেই ইংরেজিতে নয়, অসমিয়াতে কথা বলাই এখানকার রীতি। যস্মিন দেশে যদাচারঃ। এতে বোঝায় না যে এখানকার বাঙালিদের জন্যই বাংলা ভাষার নাভিশ্বাস উঠেছে। ” আমরা কেবল ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলব না । কিন্তু যদি ‘বাঙালি’ পরিচিতিটাকেই ধরতে হয় তবে ভাষা এবং তাকে নিয়ে চিন্তাটাই হিসেবের কেন্দ্রে আসে বটে । আর সেখানেই যে দুই উপত্যকার ভেদরেখাটি দেখা দিচ্ছে তা এ অব্দি এসে স্পষ্ট হয়ে আসছে । বাকি প্রদেশগুলো বা স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের কথা না হয় উহ্যই রইল।
          সুকুমার বাগচি বা জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত ঠিক কোন লেখক বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন সৌজন্যবশত স্পষ্ট করেন নি। কিন্তু আমাদের কাছে এমন কিছু রচনার সন্ধান রয়েছে । ২০১০এর উনিশে মে তারিখে জয়দীপ বিশ্বাস দৈনিক যুগশঙ্খে এক উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছেন, “উনিশ নিয়ে অন্য কথা” । সুকুমার বাগচির উদ্দিষ্ট লেখকের মতো, জয়দীপও লিখেছেন, “বরাক উপত্যকা নিয়ে যে উপত্যকা বিভাজন, তখন তা বোঝানো হতো অসমিয়া বাঙালি বিভাজনের উপমা হিসেবে। কিন্তু ইদানীং আমার মনে হয়, অসমের বাঙালিরাও এই উপত্যকা বিভাজনের মধ্যে চলে এসছেন।” আমরা জয়দীপের লেখাটিকে একটি বিশ্লেষণের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেব, কারণ এতে গোটা অসমের বাঙ্গালির ভাবনাকে ধরবার এবং দুই উপত্যকার সম্পর্কসূত্র নির্ণয়ের প্রয়াস আছে। তাই এর উল্লেখ ঘুরে ফিরেই আসবে ।
           নিবন্ধের পূর্বভাগে জয়দীপ ছেলেবেলার লামডিঙের বাঙালি পরিবেশ, সেই পরিবেশ নষ্ট করতে অসম আন্দোলনের ভূমিকার স্মৃতিচারণ করেছেন। নেলির গণহত্যার কথাটাও লিখেছেন। ১৯৭৯-৮০র অসমেই স্বাধীনতার পর সবচাইতে বেশি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস  হয়েছে এবং এই নিয়ে জ্যোতির্ময়ের মতো তিনিও ইতিহাসের মৌনতা নিয়ে আক্ষেপ জানিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবাদী অবস্থানে তিনি কেবল পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, লামডিঙের সিপিএম বিধায়ক বীরেশ মিশ্রের কথাই জেনেছেন, উল্লেখ করেছেন। তাতে অসুবিধে কিছু নেই। কেননা , তিনি স্মৃতিচারণ করছিলেন, ইতিহাস লিখছিলেন না এই স্বীকৃতি রয়েইছে। সুতরাং ১৯৮৬র ভাষা আন্দোলনের , “সময়েও লামডিঙে বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অন্যত্রও কোনো উত্তাপই সঞ্চারিত হয়নি।” এরকম সরলোক্তিও করেছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বড় হওয়া একজন সুসন্তান যখন কোনো এরকম সরলোক্তি করেন, তখন বোঝা যায় এর পরের চিহ্নায়নরেখাটি কোন খাতে বইবে। আমরা শুধু উল্লেখ করে চলে যেতে চাই যে, মাত্র চার বছর আগে নেলি গোহপুর হয়ে গেছে আর এক বছর আগে সেই অসম আন্দোলনের নেতৃত্ব সরকারে বসেছে । আতঙ্ক, গ্রাসকরে রাখাটাই স্বাভাবিক তখন। কিন্তু, রাজ্যের সমস্ত জানজাতীয় সংগঠনগুলো তখন আটসুর নেতৃত্বে সেবা সার্কুলারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল। গুয়াহাটি, হাফলঙে বড় বড় সম্মেলনও হয়ে গেছিল এই নিয়ে। ২১ জুলাইর পর মূলত তাদের দেয়া চরমপত্রের ফলেই ১৫ আগষ্ট সেই সার্কুলার স্তগিত করেছিল সরকার। তখন ওদের পাশে চাপা স্বরে হলেও আমসু এবং বাঙালি যুবছাত্র ফেডারেশনও ছিল। বিধানসভাতে ইউ এম এফের ভূমিকাও সদর্থক ছিল। জয়দীপ সেটি দেখেন নি , কেন না, সিপিএমের বাইরে তাঁর চোখ যাচ্ছিল না তখন। তিনি বরাকেও কোনো উত্তাপ ইচ্ছে করলেই না দেখলেও দেখতে পারতেন কারণ সিপিএমের ছাত্র সংগঠন সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন না । ছিল সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি এবং আকসা । সমন্বয় সমিতিতে এস ইউ সি আই এবং সিপি আই (এম-এল)-এর ছাত্র সংগঠনগুলোও ছিল । কিন্তু তাই বলে বরাকে আন্দোলন হয় নি এটাতো বলা যাবে না । ২১ জুলাই চিহ্ন রেখে গেছে । তিনি সততার সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন, “ ...উনিশে মে যে আসলে যে কোনো মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার এই সত্যটি সম্ভবত ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিদের মাঝে প্রচারিত হয়নি।” কিন্তু এই বয়ানকে পালটে নিলেই সম্ভবত অধিক সত্য হয়ে উঠে । প্রচার করবার কী আছে? ব্রহ্মপুত্র সহ এখনকার প্রতিবেশি রাজ্যগুলোর বহু জনগোষ্ঠিইতো সেই আন্দোলনে ছিল। জয়দীপ তা লিখেওছেন। তাদেরতো সেই ইতিবৃত্ত জানা থাকবারই কথা। কিন্তু জ্যোতির্ময় যেমন লিখেছেন, “সময়ের প্রবাহে পঞ্চাশটা বছর কম নয়। বাংলাদেশের ভাষা-সংগ্রাম আটচল্লিশ বছরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই হিসাবে উনিশের বলিদান বিশেষ কিছুই লাভ করেনি । শুধু উনিশ কেন, পরবর্তীতেও বরাক উপত্যকায় ভাষা-মায়ের পায়ে যে সমস্ত প্রাণ নিবেদিত হয়েছে, জনমানসে তার স্বীকৃতির পরিসর সীমিত। অবশ্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপত্যকার সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে প্রাপ্তি বলেই স্বীকার করতে হবে । আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, উপত্যকাভিত্তিক ভাষা ব্যবহারের এই সরকারি নীতি শেষ পর্যন্ত সেখানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। একটি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছিল এভাবেই। তবে এই সাফল্য এবং হাল আমলে দিল্লী, কলকাতা বা অন্যত্র কয়েকটি স্মৃতিচারণমূলক সভাকে যদি উনিশের স্বীকৃতিমূলক বিস্তার বলে ধরে নেওয়া হয় তবে তা হবে একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবির গ্রন্থনা। বছরের পর বছর সেই অ্যালবামে ছবি জমা হচ্ছে।”(উনিশের ভাবনাঃউনিশের গণ্ডি -- উনিশের মুক্তি, উত্তর সম্পাদকীয়, দৈনিক সকালবেলা, ১৯ মে, ২০১১) সেই এলবামে ব্রহ্মপুত্র যোগ দিচ্ছে না মাত্র। এখানে এসে বয়ান পালটে যাচ্ছে । যারা দিল্লী-কলকাতা-ত্রিপুরা-বাংলাদেশে ১৯কে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা একে মোটেও ‘আসলে যে কোনো মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার’ বলে নিয়ে যাচ্ছেন না, নিয়ে যাচ্ছেন বাঙালির সম্পত্তি করেই । নতুবা তারা মণিপুর, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরামেও পাড়ি জমাতেন। এবং ১৯৬১র আন্দোলনে ব্রহ্মপুত্রের দাবিগুলোর সঙ্গে যে আপস করা হয়েছিল, এবং যেগুলো এখনো যে অনায়ত্ব থেকে গেছে-- এই সত্যটা তাঁদের অনুভবে নেই। বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনও যে তাদের সম্মেলনগুলোতে বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা এবং বহির্বঙ্গ থেকে লোক ডেকে আনলেও ব্রহ্মপুত্রের কাউকে ডেকে আনেন না, এই আক্ষেপ জয়দীপও করেছেন। আমরা এর সঙ্গে জুড়তে চাই, হোমেন বরগোঁহাইকে আশির দশকে কাটিগড়া সম্মেলনে বা লক্ষ্মীনাথ পাঙিঙকে হাইলাকান্দি বিশেষ অধিবেশনে ডেকে নিয়ে যাবার মতো দু’একটি ব্যতিক্রমকেও এরা নিয়মে পরিণত করতে পারার মতো প্রয়াস নেন নি।
                     কিন্তু, বরাকের বাঙালির অপ্রান্তে যে ‘অপর’ যারা এই অসম এবং পূর্বোত্তরেই ছড়িয়ে আছেন তাদের কথা স্মরণ করে জ্যোতির্ময় আরো সরব উচ্চারণ করে লিখেছেন, “আধুনিক বিশ্বে যখন আমরা প্রগতির কথা ভাবি তখন এই 'অপর'এর অস্তিত্বটা আর নেহাত পরিপূরক বা প্রেরণাদাতার সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে না। অন্তত আমরা যতদিন না আধিপত্যহীন সমাজব্যবস্থার জন্ম দিতে পারছি ততদিন এই 'অপর' থাকবে এবং তাকে নানাভাবে গ্রাস করবার চেষ্টাও থাকবে অব্যাহত। সুতরাং যখনই 'উনিশ' সাংস্কৃতিক বহুত্বের মাঝে সমন্বয়ের একক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইবে তখনই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। কারণ 'উনিশ' ভাষা আন্দোলন-মুদ্রার একটি পিঠ। সেই পিঠে যেমন বরাকপারের এগারো শহিদের ছাপ রয়েছে, তেমনই মুদ্রার অন্য পিঠে আছে ব্রহ্মপুত্রতীরের র়ঞ্জিত বরপূজারি সহ বহু ভাষাপ্রেমিক ও অস্তিত্ব সচেতন যুবকের রক্তচিহ্ন। কোনও কোনও ভাষাপ্রেমীর চিন্তায় তাই বরাকপারের মানুষ তাঁদের ভৌগোলিক পরিসর সহ ভাষিক পরিচয়ে কখনও কখনও অসমেরই আপনজন হয়ে ওঠেন। অথচ বরাকপারের মানুষ বা বাংলা ভাষার ইতিহাস যে একথা মেনে নিতে পারে, তেমন কোনও সম্ভাবনা এখনও তৈরি হয়নি। এই চরম দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে আঞ্চলিকতার বোধকে দূরে সরিয়ে রাখার কথাটা যত উন্নত চিন্তাঋদ্ধ হোক, আসলে বাস্তবতার সম্পর্কহীন এক প্রকল্প মাত্র।” বিভাজন রেখাটি রয়েছে তাই দেখানোই জয়দীপের নিবন্ধের উদ্দেশ্য, জ্যোতির্ময়ও এর বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে চাইছেন না কিছুতেই।
                জয়দীপ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকারই সন্তান। লামডিঙে তাঁর জন্ম এবং লামডিং তাঁর নিশ্চিন্দিপুর। কলেজ পড়তে শিলচর যাওয়া, এখন শিলচরেই এক কলেজে পড়ান। সুতরাং দুই উপত্যকার বিভাজনটা তাঁকে ব্যথিত করবে এই স্বভাবিক। এমনটা বর্তমান লেখকের ক্ষেত্রেও উল্টোভাবে সত্য । অর্থাৎ আমার নিশ্চিন্দিপুরটাই শিলচর, এখন কর্মসূত্রে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাস। সুতরাং দুই উপত্যকাকে দেখবার সুবিধেটা তাঁর মতোই আমারও রয়েছে । দুজ’নের কারো পক্ষেই এই বিভাজনের কোনো পক্ষে দাঁড়িয়ে পড়াটা এক স্বাভাবিক সমস্যা । কিন্তু জয়দীপ সম্ভবত সেই নৈরাসক্তি অটুট রাখতে পারেন নি । স্পষ্টতই, দক্ষিণ (অসমের) পক্ষ নিয়েছেন। একেবারে শেষে তিনি আপাত নির্দোষ উচ্চারণ করেছেন। লিখেছেন, “অসমের বাঙালিদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার যদি সুরক্ষিত করতে হয় , তাহলে বরাক ব্রহ্মপুত্র দুই উপত্যকার মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।উনিশ চেতনা এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সর্বৈব ব্যর্থ...বদরুদ্দিন আজমল এবং চিত্তপালদের ফতোয়াবাজিকে প্রতিহত করতে গেলেও ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্দ্ধে অখন্ড অবিভাজ্য বাঙালি জাতিসত্বা নির্মাণের প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা দরকার। উনিশ মে’র পঞ্চাশ বছরে এটাই হোক থিম।” ধর্মীয় বিভাজনের উর্দ্ধে কতটা উঠা যাবে, বদরুদ্দিন আজমলদের ফতোয়ার বিরোধীতা করতা করা দরকার আমরা সে নিয়ে পরে বলব। কিন্তু তাঁর আগে দেখে নেব, উপত্যকা বিভাজনের উর্দ্ধ্বে জয়দীপ কতটা উঠতে পেরেছেন।
            এই প্রসঙ্গে বলে নিই যে মার্ক্সবাদের প্রতি জয়দীপের সমর্থণ এই লেখাতেও লুকিয়ে নেই। সেই মার্ক্সবাদীরা যখন অসমিয়া কিম্বা বাঙালি জাতিসত্বা নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করবার দায়িত্বটা নিজেদের কাঁধে তুলে নেন তখন একটু অবাক হতে হয় বৈকি । যেন এক পবিত্র কর্ম , না করলেই নয়। জাতি জাতীয়তা নিয়ে মার্ক্স থেকে মাও, প্রায় সব্বাই সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্রজাতিসত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন বটে, কিন্তু জাতি গঠনের দায়িত্ব তুলে নেবার কাজে কেউ আহবান জানিয়েছিলেন বলে শুনিনি। বরং এ যে জাতিগুলোর ভেতরে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের এবং আন্তর্জাতিক ( একে ভারতে ‘আন্তর্জাতীয়’ বলেও বোঝা যেতে পারে।) শ্রমিক ঐক্যের বিরুদ্ধে যেতে পারে এই নিয়ে বারে বারে সতর্ক করে দিয়েছেন। ‘মার্ক্সবাদ এবং জাতীয় প্রশ্ন’ নামে ১৯১৩তে লেখা স্তালিনের একটি বই এই সম্পর্কে প্রায় ‘বেদে’র মর্যাদা পেয়ে থাকে। তাতে এবং সাম্প্রতিক কালে জনপ্রিয় হওয়া গ্রামসিতেও আমরা অন্যরকম আহ্বান পাচ্ছিনা । স্তালিন বাহুজাতীয় রাশিয়ার বিচিত্র জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, আবার অনেকের ক্ষেত্রে কেবল ভাষা-ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা দিয়ে দিতেই বলছেন, তবেই বুঝি,তাদের সমস্ত অসন্তোষ দূর হয়ে যাবে। আমরা বলছি না যে স্তালিন বা মার্ক্সের পুথি অনুসরণ করলেই মার্ক্সবাদ হয়ে গেল। বরং তাকে সব সময়েই দেশকালের প্রেক্ষাপটে বিচার করা এবং বিস্তার ঘটানো উচিৎ, ওমন কথা স্বয়ং তাঁরাই লিখে গেছেন। স্তালিনের ‘জাতি’ সম্পর্কিত সংজ্ঞাটিও সেকালের রাশিয়া এবং ইউরোপের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করানো, এটির সম্পূর্ণতা নিয়েও আজ এবং ভারতেতো বটেই প্রশ্ন তোলাই যায়। তাই বলে, ‘জাতি’র শাসক শ্রেণির মর্মবস্তু এবং পরজাতি বিদ্বেষে পরিণত হবার সম্ভাবনাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলাতো যায়ই না, বরং অসমের প্রেক্ষাপটে এইসব সতর্কবাণীকে সত্য বলেই প্রমাণ করা যায়।
          
       এই প্রসঙ্গেতো রবীন্দ্রনাথকে বহুবেশি খাটি মার্ক্সবাদী বলেই মনে হয়, যিনি ১৯০৫এর পর আজীবন জাতীয়তাবাদকে বিলেত থেকে এক ধার করা তত্ব বলে বিরোধীতা করে গেছেন। অথচ অসমে দেখা যায়, স্তালিনকে শিরোধার্য করে যে বামেরা জাতিগঠনের কর্তব্য কাঁধে তুলে নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাঁরা নিজেরাই অসমীয়া-অনসমীয়া, বাঙালি-অবাঙালি শিবিরে বিভাজিত হয়ে যাচ্ছেন। স্তালিন অস্ট্রিয়ার পার্টি থেকে অমন নজির বেশ বিস্তৃতই তুলে দিয়েছেন। স্তালিনের ‘জাতি’ সঙ্গাতে ধর্ম বিশেষ গুরুত্ব পায়নি । কিন্তু পড়লেই বোঝা যায় , তাঁর এটি কোনো চূড়ান্ত নির্মাণ ছিল না। গ্রামসিতেই এসে দেখছি তিনি যখন ‘সাংস্কতিক আধিপত্য’ নিয়ে লিখছেন তখন রাষ্ট্রের এবং আধিপত্যে থাকা শ্রেণিটির ধর্মের কথাটাও তুলছেন। তিনি এক পালটা বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আধিপত্য গড়ে তোলবার আহবান জানাচ্ছেন কিন্তু ‘জাতীয় বা ধর্মীয় প্রশ্নে এগুলো নেহাৎই আত্মরক্ষাত্মক, পরাক্রামক নয়। সেরকম পরীক্ষাতো মাও -ৎসে-তুঙও করেছিলেন, শত ফুল বিকশিত’ হোক আওয়াজ দিয়ে যখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আহ্বান দিয়েছিলেন। আজকের সেনা শাসিত ধনীদেশ চিন সেই বিপ্লবের যতই পালটা বয়ান তৈরি করে যাক না কেন, এটাও সত্য যে ১৯৮৯র তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ছাত্র বিক্ষোভের পেছনেও কাজ করেছিল মাও এরই সেই আহ্বান।
            এবারে জয়দীপের পাঠটিতেই দেখা যাবে তিনিতো উপত্যকা বিভাজনের উর্ধ্বে উঠতে পারেনই নি, বরং স্তালিনের (লেনিনেরও--- বলতে অসুবিধে নেই) সতর্কবাণীকে সত্যে পরিণত করছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাংলা ভাষা সাহত্য চর্চার বৃদ্ধির সংবাদ তিনি সম্মানের সঙ্গেই দিচ্ছেন। দিয়ে লিখছেন, “কিন্তু কোনো পত্র-পত্রিকা, লিটিল মেগাজিনেই অসমের বাঙালির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার নিয়ে কোনো কথা কখনোই উঠে না।” এই শব্দগুলো আমাদের পড়তে হচ্ছে দৈনিক যুগশঙ্খের ডিব্রুগড় সংস্করণেও। এটা কি করে সম্ভব! সম্ভব হতে পারে, যদি সেদিনই ঐ কাগজের সম্পাদকের ‘জ্ঞানচক্ষু’ খুলে থাকে। কিন্তু আমরা জানি, এটা পড়ে আমার মতো অনেকেই চুপেচাপে হেসেছেন। বিশেষ করে সুকুমার বাগচি, অমল গুপ্ত, মনীন্দ্র রায়েরাতো বটেই---- আরো অনেকেই আছেন, যারা এই কাগজে দিনের পর দিন বাঙালি হিন্দু মুসলমানের দুর্গতি নিয়ে ডাক নিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। আর এখনতো তাদের সঙ্গে গলা মেলাবার মতো আরো অনেক দৈনিক কাগজ যোগ দিয়েছে । সাময়িক পত্রিকাগুলো না হয় বাদই দিলাম। বাদই দিলাম অসমীয়া জনপ্রিয় সাময়িক ‘সাতসরী’র ‘রাগ-অনুরাগ’ নামের সেই অত্যাশ্চর্য দুটি সংখ্যা যা বেরিয়েছিল আরো দু’বছর আগে ২০০৮এ, প্রশান্ত চক্রবর্তীর সম্পাদনাতে। কাগজগুলোতে অন্তত যে নীরবতার কোনো অস্তিত্বই নেই, সেই নির্মিত ‘নীরবতা’র সম্পর্কে এর পর তিনি লিখছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এবং এই উপত্যকাতে দিনকতক চাকরি করা এবং বসবাস করবার , “ ...অভিজ্ঞতায় আমি সম্ভবত এর কারণটা ধরতে পারি। বর্তমানে বাঙালি হবার অপরাধে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কাউকে শারীরিক বা মানসিক হেনস্তার শিকার হতে হয় না ।” এই কথাগুলো যখন তিনি লিখছেন, এর দুমাস পরে ২১ জুলাই,১০ বরপেটাতে নাগরিক পঞ্জি শোধন করা নিয়ে আন্দোলনে চারজন মুসলমান ছাত্র নিহত হয়েছেন, তার দু’বছর আগেও সমগ্র উজান অসমে যেখানে সেখানে ভাটি অসমের মুসলমানদের মতো কাউকে দেখলেই দলবদ্ধভাবে ধরে পুলিশে দেয়া , পথে বসিয়ে জুতোর মালা গলায় চড়ানো--- এগুলো হয়েছিল। যিনি ধর্মীয় বিচ্ছেদের উর্ধে উঠবেন, এই শারীরিক হেনস্তাগুলো তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে। ৩০ অক্টোবর, ২০০৮এ যখন গুয়াহাটিসহ অন্যান্য জায়গায় এন ডি এফ বি বোমা ফেলেছিল তখন গোটা রাজ্যে মুসলিম বিদ্বেষী ভাবনার ঢেউ উঠেছিল; তার মাস কয় আগে ভাটি অসমের একটি সংগঠন মুসলমানদের বাঙলাভাষাতে ফিরিয়ে আনবার আহ্বান জানিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করবার ঘোষণা করতেই কাগজে হৈচৈ শুরু হয়েছিল, এমন কি উগ্রজাতীয়তাবাদ বিরোধী বলে পরিচিত হোমেন বরহোঁহাই "আমার অসমের' (১৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৮) ‘প্রথম কলামে’ এদের এই ‘ব্লেকমেইলিঙ’এর নিন্দা করে লিখেছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকেই দাবি উঠা উচিত বরাক উপত্যকাকে রাজ্য থেকে বিচ্ছিন করে দেবার জন্যে । তাতে তাদের এই প্রয়াস ব্যর্থ হবে । ২০০৭এ গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, যিনি শঙ্করদেব সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়নে অসমীয়া বৌদ্ধিক মহলেই সম্মান অর্জন করে নিতে সমর্থ হয়েছেন --তাঁর একটি লেখাতে লক্ষীনাথ বেজবরুয়া নিয়ে করা মন্তব্য দু’মাস ধরে কাগজেপত্রে এতো ঢেঊ তুলেছিল যে পাছে অসমিয়া বাঙালি ঝগড়াতে না পরিণত হয় তার জন্যে দু’পক্ষেরই শুভচিন্তকদের মাঠে নামতে হয়েছিল। এর চে’ বরং সুকুমার বাগচি যখন পূর্বোক্ত লেখাতে লেখেন ডি--ভোটার সমস্যা অমীমাংশিত থাকা , বাংলা স্কুলে অসমিয়া শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি বেশ কিছু অসুবিধেজনক অবস্থানে রয়েছেন, এবং “তাদের নায্য স্বার্থ নিয়ে সংগঠিতভাবে সরব হবার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে” তখন এই উচ্চারণকে অনেক সবল এবং সঠিক বলে মনে হয়।
        পাঠকের মনে পড়বে, অমল গুপ্তের একটি লেখার কথা, যার শিরোনাম ছিল, “গ্রেণাইট পাথরের মতো জড়তা গ্রাস করেছে অসমের বাঙালিদের” বেরিয়েছিল যুগশঙ্খেই, সম্ভবত ২০০৮এর ৫ অক্টোবর। সেই জড়তার কারণ অমল গুপ্তও নির্ণয় করবার চেষ্টা করেছেন, করতে গিয়ে শুরুতেই তিনি তিনটি গল্প লিখেছেন। তার একটির চরিত্র ‘ধুবড়ির চর অঞ্চলের বানভাসি মানুষ মাঝবয়সী জাকির হুসেন” যাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বাংলা বল না কেন? জবাব, বাবু ডর করে।’ জিজ্ঞেস করেছিলাম কিসের ভয়?...” এমন কোনো চরিত্রের সন্ধান কিন্তু জয়দীপে নেই। বরং আছে মূলত বরাক উপত্যকা থেকে রবীন্দ্র সংগীত গাইতে আসা শিল্পীদের অভিজ্ঞতার কথা। কী, সেটিতে আমরা আসছি। এই উপত্যকাতে কোনো হেনস্তা নেই। “কিন্তু একজন বাঙালিকে প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য লক্ষণরেখা মেনে চলতে হয়। এ এক অদ্ভূৎ ব্যাখ্যাতীত মনস্তত্ব । কেউ আপনাকে মারধর করছে না, কটু কথা বলছে না। কিন্তু আপনি ভেতরে ভেতরে সদাই কুকড়ে আছেন। এটা এক ধরণের অন্তর্লীন অভিবাসী সত্বা । এটাই সংখালঘু মনস্তত্ব। উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঙালি মাত্রেই এই মনস্তত্বের অংশীদার স্বীকার করুন আর নাই করুন।” আমাদের স্বীকার করতে কোনো অসুবিধে নেই, কিন্তু সর্বত্র সব পরিস্থিতিতে নয়। আর বরাকে বা ত্রিপুরাতে কথাটা সত্য নয়, সেখানে বরং অবাঙলিদেরকেই এমন সমস্যার মুখে পড়তে হয়। সেটি শিলচর ইটখোলার এক কোনে পড়ে থাকা বিপ্লবী ইরাবৎ সিংহের মূর্তীর মুখের দিকে তাকালেই বেশ বোঝা যায়। একই কথাগুলো অমল গুপ্তও লিখেছেন। তিনি মানিক দাসের একটি লেখার ( হিন্দু-মুসলমানঃ সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতার মৃদুপাঠ) উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন, “সংসারে যারা মাইনোরিটি অর্থাৎ সংখ্যালঘু তাঁরা সর্বত্রই দুর্ভাগা। তাঁদের দুর্ভাগ্যের রকমফের আছে বটে তবে অবস্থানগত বৈশিষ্টের ক্ষেত্রে এক ধরণের ঐক্য লক্ষ্য করা যায় এরা প্রত্যেকেই হীনমন্যতার শিকার, সংখ্যাগুরুর দয়া ও দাক্ষিণ্যে তাঁদের বাঁচতে হয়, তাঁদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ, আত্মবিশ্বাসের ক্ষেত্র সীমিত, সংখ্যাগুরুর সন্দেহ আর অবিশ্বাস তাঁদের তাড়া করে ফেরে, আক্রান্ত হবার ভয়ে তটস্থ থাকতে হয় নিত্যদিন, তাঁরা স্বপ্ন দেখেন না তবে স্বপ্ন সওদাগররা তাঁদের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করেন। কথাগুলো পৃথিবীর প্রায় তাবৎ মাইনোরিটির ক্ষেত্রেই বোধহয় সত্য। আমেরিকার নিগ্রোদের বেলায় যেমন সত্যি, ভারত বর্ষের হরিজনদের বেলায়ও সত্যি। অসমের হিন্দুদের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষেত্রেও তেমনি।” এই কাব্যপ্রায় গদ্যে জয়দীপের প্রতিধ্বনি মাত্র, শুধু একটি সংযোজন রয়েছে হরিজনদের তিনি ভাষিক সত্ত্বার সমস্যার সঙ্গে এক করছেন। আরেকটি আশ্চর্য বিয়োজন চোখে পড়বার মতো ---আমেরিকার নিগ্রো আছেন অথচ, ভারতের নিদেন পক্ষে অসমের মুসলমান নেই! যাদের শুধু ডি-ভোটার করে রাখা হয় না, পারলে বেসরকারী সংগঠনগুলোই রাস্তার উপর দাঁড় করিয়ে জুতোর মালা পরিয়ে আইন বহির্ভূতভাবে শাস্তি দিয়ে দেয়, পরে প্রমাণও করবার দায় নেয় না যে ওরা ‘বাংলাদেশি’। নেলিতে যাদের প্রাণ গেল কয়েক হাজার! এই সংযোজন এবং বিয়োজন দুটো কথাতেই আমরা আসব ।
                 আপাতত, জয়দীপের সংখ্যালঘু মনস্তত্বের পক্ষে টানা নজির নিয়ে দুই এক কথা বলবার আছে। তিনি বলেছেন, “ ...এই উপত্যকার একজন নামী রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সাংস্কৃতিক উদ্যোক্তারা বহুবার অনুরোধ করেছেন , একটি বিহু গান গেয়ে দেবার জন্যে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ ব্যাপারে কিন্তু আসু থেকে আলফা কেউই কোনোদিন ফরমান জারি করে নি।” সবটা মিথ্যে বলেন নি । কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এমন অনুরোধ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পেলে কী করতেন? শিখেইতো নিতে চাইতেন! ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বহু অসমীয়া শিল্পীকেও আজকাল বাংলাগানের অনুরোধ রক্ষা করতে হয়, সকাল বেলার টিভি খুললেই বোঝা যায়। এমন বহুভাষিকতা ভারতের আর কোথায় দেখা যাবে? এতোই যদি দুর্দশা তবে জ্যোতির্ময়ের মতো আমাদেরও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, “তবে ক্রমাগত বাংলা বই প্রকাশের সংখ্যাটা বাড়ছে কেন? কেন বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে বাংলা সম্প্রচারের সময় বাড়ছে ? কেন বাংলা সংবাদপত্রের সংখ্যাটাও বাড়ছে?” (ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ) বাঙালির নিজের মনেই এতো ভয় সত্বেও তারা কাজগুলো করছেন কী করে? এমনও হতে পারে, যে বিশেষ করে বরাকের সেই শিল্পী অসমের বাকি ভাষা সংস্কৃতির প্রতি কতটা ‘রাবীন্দ্রিক’ সেটিও জেনে নিতে চান সেই আয়োজকেরা। কারণ, প্রতিবেশিদের প্রতি ঔদাসীন্য এখন আর অনেকেই মেনে নিতে প্রস্তুত নন। সবসময় ভয় থেকে নয়, একটা প্রায়শ্চিত্তভাবনাও কাজ করে এই উপত্যকার বাঙালিদের মনে। বিশেষ করে স্বাধীনতা পূর্বযুগের থেকে যারা আছেন , ছিলেন, তখনকার ইতিবৃত্তগুলো জানেন, বোঝেন। আর এই করেই খুব দ্রুত অসমের বাংলা সংস্কৃতির এখন পীঠস্তান হয়ে উঠছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা আর তার কেন্দ্র হয়ে উঠছে গুয়াহাটি-- বললে কি খুব অতিশোয়ক্তি করা হবে?
         
              এটাতো ঠিক, এক সময় এই উপত্যকার শাসকের অবস্থানে ছিলেন বাঙালিরা। অনুরাধা শর্মাপুজারী ‘সাতসরী’র সেই অসমীয়া-বাঙালি সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত সংখ্যাদুটোর দ্বিতীয়টিতে ( রাগ-অনুরাগ ২) সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে Myron Weiner-এর একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করে লিখেছেন, “অসমীয়াই বাঙালীক এক উচ্চস্থানত আৰু নিজকে নিম্নস্থানত দেখিবলৈ পাইছিল। শিক্ষকজন হৈছে বাঙালী আৰু ছাত্রজন অসমীয়া । চিকিৎসকজন বাঙালী, ৰোগীজন অসমীয়া। উকীলজন বাঙালী, বিচাৰাধীনজন অসমীয়া। দোকানীজন বাঙ্গালী আৰু গ্রাহকজন অসমীয়া ।সৰকাৰী বিষয়াজন বাঙালি আৰু আবেদনকাৰীজন অসমীয়া ।” অসমীয়ার পাশে তাদের সারিতেও বহু বাঙালি ছিলেন, যারা কোনোভাবেই শাসক শ্রেণিতে ছিলেন না। আজো আছেন তারা সেই তিমিরেই। তাদের কথা নিয়ে ‘রাগ অনুরাগে’ও খুব একটা কথা হয় নি । হয় নি বাঙালি মুসলমান নিয়ে । কিন্তু এটাতো ঠিক যে একটা সময় অসমের শাসক শ্রেণির অংশীদার বৃটিশের সঙ্গে ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত। জয়দীপ যখন লেখেন, “উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঙালি মাত্রেই এই মনস্তত্বের অংশীদার” –তখন প্রায়ই হাটে বাজারে শোনা এক বাঙালি বয়ান মনে পড়ে যায়, “দেশের স্বাধীনতার জন্যে কত প্রাণ দিল বাঙালি, অথচ আজ যেখানে যায় সেখানে মার খায়।” তখন এই কথাও কি মনে রাখতে হবে না যে, অসমীয়া সহ দেশের তাবৎ অবাঙালির চোখে বাঙালির আরেকটা ছবিও ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। তা এই যে, লাহোয়াল ( ডিব্রুগড়) থেকে লাহোর ব্রিটিশ প্রশাসনকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গিয়ে ছড়িয়েছিল বাঙালি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরে ধরে জেলে পুরেছিলও বাঙালি । উনিশ শতকে যে চার ধশক অসমের প্রশাসনিক ভাষা বাংলা ছিল , এর পেছনে বাঙালির কোনো ভূমিকা নেই এই সত্য আজকাল অসমীয়া বুদ্ধিজীবিরাও স্বীকার করেন। কিন্তু, আম জনতাকে এই বাস্তবতার আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায় যখন-- তার কোনো সমাধান এখনো আমরা এগিয়ে দিতে পারিনি। তার উপর দীর্ঘদিন আমাদের পূর্বপুরুষেরা এও মেনে নিতে চাননি যে অসমীয়া বাংলার থেকে স্বতন্ত্র একটি সমৃদ্ধ ভাষা । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমীয়া ভাষার পঠন পাঠন শুরু করতে গেলে, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কালে অসমের না হোন কলকাতার বেশ কিছু বিদগ্ধ বাঙালি বিরোধীতা করেছিলেন এই সত্যওতো তাড়া করে বেড়ায়। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হতে গেলে অসমেও অনেকে তার বিরোধীতা করে সিলেটে স্থাপনের দাবি জানিয়েছিলেন, এই ঐতিহাসিক সত্যও ড০ প্রফুল্ল মোহন্ত উল্লেখ করেছেন তাঁর ‘অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাস’ বইতে। কেবল বরাক উপত্যকাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধীতা করেছিলেন অসমীয়াদের একাংশ-- এই সত্য মনে রেখে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মনস্তত্ব বোঝা যায় না, কিন্তু বরাক উপত্যকাতে নঞার্থক বয়ান নির্মাণের প্রয়াসটি বেশ বোঝা যায়।
                সেদিনের অসমের বাস্তবতা রবীন্দ্রনাথও ধরেছিলেন ভালো, মনে হচ্ছে জয়দীপের যিনি সাক্ষী সেই রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী এখনো বুঝে উঠতে পারেন নি, “ আসল কথা আমাদের দুর্ভাগ্য দেশে ভেদ জন্মাইয়া দেওয়া কিছুই শক্ত নহে, মিলন ঘটাইয়া তোলাই কঠিন। বেহারিগণ বাঙালির প্রতিবেশী এবং বাঙালি অনেকদিন হইতেই বেহারিগণের সঙ্গে কারবার করিতেছে, কিন্তু বাঙালির সঙ্গে বেহারির সৌহার্দ্য নাই সেকথা বেহারবাসী বাঙালিমাত্রেই জানেন। শিক্ষিত উড়িয়াগণ বাঙালি হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলিয়া দাঁড় করাইতে উৎসুক এবং আসামিদেরও সেইরূপ অবস্থা । অতএব উড়িষ্যা আসাম বেহার ও বাংলা জড়াইয়া আমরা যে দেশকে বহুদিন বাংলাদেশ বলিয়া জানিয়া আসিয়াছি তাহার সমস্ত অধিবাসী আপনাদিগকে বাঙালি বলিয়া কখনো স্বীকার করে নাই, এবং বাঙালিও বেহারি উড়িয়া এবং আসামিকে আপন করিয়া লইতে কখনো চেষ্টামাত্র করে নাই, বরঞ্চ তাহাদিগকে নিজেদের অপেক্ষা হীন মনে করিয়া অবজ্ঞা দ্বারা পীড়িত করিয়াছে।” (সদুপায় , রবীন্দ্রনাথ) বিহু গাইতে অনুরোধ করেন যে বাঙালি, তিনি এই রবীন্দ্রবাক্যকেও বহু সময় আজকাল শিরোধার্য করে ফেলেন। আমরা বিহু কেন, কোনো একটাও অসমিয়া গান না গাওয়া অনুষ্ঠানও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে প্রচুর দেখি, এমন কি গামছার বদলে ‘উত্তরীয়’ সংস্কৃতিকেও এই উপত্যকাতে আজকাল প্রচুর বাড়তে দেখা যাচ্ছে। কয়েক হাজার নানা ভাষা নানা বেশ মানুষের উপস্থিতিতে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে যোগ দেবার অভিজ্ঞতা বর্তমান লেখকের রয়েছে এক মফস্বল শহরে । কিন্তু এও সত্য যে বহু সার্বজনীন অনুষ্ঠান –প্রতিষ্ঠানে ( স্কুল-অফিস-আদালত-ট্রেড ইউনিয়ন—দূরদর্শন—আকাশবাণী) বাংলা কেন, অন্য বহু ভাষার দ্বার এখনো অবারিত নয়। বহু অসমিয়া চাইলেও, সেই দ্বার খুলে দিতে পারেন না উগ্রদের ভয়ে। যে ‘লক্ষণরেখা’র কথা জয়দীপ উল্লেখ করেছেন তার অস্তিত্বের এও এক বড় কারণ। সেটি অহিন্দু ভারতীয়দের ক্ষেত্রেও সত্য । কিন্ত জয়দীপতো সেরকম কোনো ‘হেনস্তা’র অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে প্রমাণপত্র দিয়ে রেখেছেন। তা নইলে বাঙালিরভীতির তত্বকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে ব্যর্থ হতেন।
  ‘অসম’ এবং ‘আসাম’ লেখা নিয়ে সেই পুরনো তর্ককেও জয়দীপ টেনেছেন। কেউ বুঝি বাধ্য করে না, তবু বাঙলিরা ‘অসম’ লেখেন। ‘অসম’ বরাক উপত্যকাতেও অনেকে লেখেন, আর ‘আসাম’ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও আকছার লেখা হয়ে থাকে। সেই সত্য ইচ্ছে করেই বরাকে যারা তর্ক তুলেন ঢেকে রাখেন। ‘অসম’ কেন, আরো প্রচুর অসমীয়া শব্দ এই উপত্যকার বাংলাতে ঢুকে যাচ্ছে। এটা ভাষার সাধারণ নিয়ম। তাতে ভাষা দূষিত হয় না, হয় তার রূপ এবং বাক্যতাত্বিক গঠন পাল্টালে। কিন্তু আরেকটি তথ্য তাঁরা সবসময়েই উল্টো উপস্থিত করেন। তাঁরা বলেন, ‘অসম’ লেখাতে বহু অসমিয়ারও আপত্তি আছে। সত্য বটে ‘আসাম’ নামটি আহোম রাজদের সময় থেকে চলে আসছে । আর তাই ইংরেজিতে লিখবার বেলা ‘Assam’ নামটিকে অনেকেই পাল্টাবার পক্ষে নন। কিন্তু অসমিয়াতে লিখবার বেলা কেউ ‘অসম’ লিখতে বিরোধীতা করেন, এমনটি আমাদের কারো চোখে কখনোই পড়ে না। চাইকি তার আইনী স্বীকৃতি থাকুক বা নাই থাকুক।  তাঁরা সেই শিলচর থেকেই কেবল দেখে থাকেন! ইচ্ছে করেই দেখেন।
                 ‘উনিশ নিয়ে অন্য কথা’ লেখাটির জবাবে তিনটি চিঠি আমাদের নজরে এসছে। দুটি শিলচর থেকে, একটি করিমগঞ্জ থেকে। শিলচরের প্রমথেশ দেব, জিজ্ঞেস করেছেন গুয়াহাটি বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাসকালে লেখক বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিকাশের জন্যে কী কাজ করেছেন? হয়তো, এটি বোঝাতে যে তাতে তিনি কাজের পদ্ধতিগত পার্থক্যটা ধরতে পারতেন। কবি-গল্পকার সৌমিত্র বৈশ্য মানেন নি যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মানুষের ভাষাচেতনাকে লালন করবার মতো সংবেদনশীলতার কোনো অভাব আছে। আছে বলে, তার দায় বরাক উপত্যকার মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়াতে তিনি ক্ষুব্ধ। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, এ রাজ্যে সাধারণ অসমিয়া এবং বাঙালির শ্রেণিস্বার্থের মধ্যে কোনো বিরোধ আছে কি? তাঁর মতে, গনতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধই...অসমিয়া বাঙালির মৌল স্বার্থ যে এক ও অভিন্ন, সেই বোধে উপনীত হতে পারে। সমস্ত মহতোদ্দেশ্য সত্বেও সৌমিত্রের এই শ্রেণি চেতনার সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করি। তিনি লিখেছেন, গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং গণআন্দোলনের অভাবে উগ্রজাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আমাদের বক্তব্য হলো, জাতি সংক্রান্ত প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে, ভাষা-সংস্কৃতি, ধর্ম এবং অঞ্চল ভেদের মতো বিষয়কে নেহাতই এক উপরি কাঠামোর বিষয় বলে মনে করে কোনো গণআন্দোলন মাথা তুলতে পারেই না। এটি অখিল গগৈর আন্দোলনেও বোঝা যায়, যখন তাঁকে এই সব প্রশ্নে নীরব থাকতে দেখি। দেখি, পাহাড়ি জেলাগুলোতে তাঁর আন্দোলনের কোনো সম্প্রসারণ নেই, উত্তরকাছাড়ের দুর্নীতি নিয়ে এতো সরব হবার পরেও। বরাক উপত্যকাতেও তাঁর নেতৃত্বাধীন আন্দোলন প্রধান ধারাতে পরিণত হয় নি । দেখি, তাঁর পাশে থাকা সমর্থক সংগঠন বা ব্যক্তিরা বসত উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনকেও ‘খিলঞ্জিয়া-অখিলঞ্জিয়া’ প্রশ্নে বিভাজিত করেন। ‘ধনী-দরিদ্রের’ বিভাজনে সীমাবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হন। পৃথিবী জুড়ে যত শ্রেণি রয়েছে তাকে যে কেবল ‘বোর্জুয়া-পেটি বোর্জুয়া- প্রলেতারিয়েত’ বলে তিনটি মাত্র ভাগে ভাগ করতে হবে এমন নির্দেশ মার্ক্সবাদের আদিগ্রন্থগুলোতেও কোত্থাও নেই।ব্যস, ইংরেজি বই পড়া পণ্ডিতদের মুখে মুখে চলে আসছে।
       
             উগ্র-জাতীয়তাবাদই হোক , কিম্বা বর্ণবাদ, কিম্বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা তাকে এড়িয়ে যাবার কোনো মানে হয় না। তাকে তার প্রতিভাষাতেই জবাব দিতে শিখতে হবে । সৌমিত্র একটি সত্য উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু সেই উচ্চারণ নিজেও যেমন স্প্রিঙের মতো বাঁকানো তেমনি মুসলমান প্রশ্নে এসে এটি তাঁর ‘শ্রেণিচেতনা’কেই অন্তর্ঘাত করে বলেই আমাদের মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “জয়দীপ বাবু ধর্মীয় পরিচয়কে অতিক্রম করে এক অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্বা নির্মাণে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ রাজ্যের বাঙালি জাতিসত্বা কি অসম্পূর্ণ?...... ধর্মীয় পরিচয় অতিক্রম করে বাঙালির ভাষিক জাতীয়তাবাদ জাগরিত করার একটা উদ্যোগ প্রাক-স্বাধীনতা যুগে একবার নেওয়া হয়েছিল, যা অচিরেই ব্যর্থ হয়। ইউরোপীয় ভাষিক জাতীয়তাবাদের ধারণাটি, হিন্দু মুসলমান ধর্মীয় পরিচয়ে বিভাজিত বিভাজিত জনমানসে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কারণ এ নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির দুর্বলতাই অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।” পরের একটি চিঠিতে জয়দীপ এই স্ববিরোধকে সঠিক ভাবেই চিহ্নিত করেছেন। এবং সঠিক ভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, “ তবে কি বদরুদ্দিন আজমলের মতো সৌমিত্রবাবুও মনে বিশ্বাস করেন মুসলমান বাঙালিরা বাঙালি নন?” এই প্রশ্ন থেকে একটি ইঙ্গিততো স্পষ্ট যে বহু হিন্দুও এবং ‘গণতান্ত্রিক চেতনার ধারকও’ মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে বাঙালিকে ভাবতে প্রস্তুত নন, মুসলমান যায়তো কোথায় যায়! কিন্তু তিনি এই মন্তব্যও করেছেন,”... অর্থাৎ তিনি (সৌমিত্র) মনে করছেন বাঙালি জাতি সত্বা নির্মাণের কাজটি এই রাজ্যে সম্পূর্ণ হয়েছে।” যেন বা হতেই হবে আর হওয়া সম্ভব। এই কাজটি না করেও যে মিলন সূত্র তৈরি ছিল ভারতে, ভারতের এই প্রতিভাকে যে নষ্ট করে দিয়েছে ঔপনিবেশিক মন ( সৌমিত্রোক্তঃ ইউরোপীয় ভাষিক জাতীয়তাবাদ) , সেই সব রাবীন্দ্রিক এবং বহুদূর মার্ক্সের বয়ানগুলোর দিকে চোখ ফেরাবার উদ্যোগ বড় একটা দেখা যায় না। নির্মাণের প্রক্রিয়াটি এইভাবেই বাঁকা পথেই এগোয় এবং শ্রেণি বা গোষ্ঠী স্বার্থ একে নিজের মতো সোজা করে নিতে জোর খাটায়।মার্ক্স আশা করেছিলেন বৃটিশ শিল্পনীতি ভারতের বর্ণবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দেবে, কিন্তু মার্ক্স এওতো আশা করেছিলেন ভারতের বিপ্লবের ঠেলায় বিলেতেও বিপ্লব হয়ে যাবে! তার যখন কোনটাই হয় নি, তখন তাঁকে স্বীকার করেও আবার নতুন করে পড়তে হবে বৈকি।
                জয়দীপের লেখাটি নিয়ে তৃতীয় চিঠিটি লিখেছেন, সুলেখক ডাঃ মৃন্ময় দে যার আবার বাল্যবেলা কেটেছে ডিগবয়ে, এখন থাকেন করিমগঞ্জে।  তিনি লিখেছেন, “উত্তর পূর্বের বাঙালির মনস্তত্ব অত্যন্ত জটিল, তার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবিধ প্রেক্ষিত বর্তমান। বরাক উপত্যকার সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের বিস্তৃত চিন্তাভাবনা আরো বেশি করে জনসমক্ষে আসা প্রয়োজন।” ‘আসাম’ ও ‘অসম’ নিয়ে তাঁর মতে “কয়েক বছর আগে ‘সাহিত্য’ এক অহেতুক বিতর্ক তৈরি করেছিল... এ অঞ্চলে মানুষ অসমিয়া বোঝাতে আসামি শব্দটি ব্যবহার করতেন ( কেউ কেউ এখনো করে থাকেন)। এই সব কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘অসম’ লিখে থাকি । আসাম অসম নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও ভাষা ও জাতির পরিচয় জ্ঞাপক শব্দ হিসেবে অসমিয়া অবিতর্কিত। আর এটা নিতান্ত সহজবোধ্য যে রাজ্যের নাম ‘অসম’ না হলে ‘অসমিয়া’ উদ্ভব অসম্ভব ও অবাস্তব হয়ে দাঁড়ায়। পরিবর্তে আসামি, আসাম্যা, আসামিয়া গ্রহণের ঝোঁক দেখা দেয়, সেটা কি খুব বাঞ্ছনীয়?” এই প্রশ্নের উত্তরে ‘আসাম’ পক্ষের ‘সাহিত্যে’র নেতৃত্বাধীন বুদ্ধিজীবিদের সাধারণত নীরবতা অবলম্বন করতে দেখা যায়। যেন , ‘অসম’ বলে বাঙালির মান হানি করার থেকে ‘আসামী’ বলে অসমিয়াদের আত্মসম্মানে আঘাত করে যাওয়াটা শতগুণে শ্রেয়। এহেন বাঙালি মানসিকতাই যে অসমীয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের ভ্রুণকে লালন পালন করেছিল এই ঐতিহাসিক সত্যের দিকে ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিকে চোখ না দিলে চলে না বটে । বাঙালিরা যখন ‘অসম’ মুখে বলেন তখন কিন্তু ঠিক বাঙালিয়ানা বজায় রাখেন। তাতে আজ অব্দি কোনো অসমিয়াকে হস্তক্ষেপ করতে দেখি    নি । বরং অসমের বাইরেও এখন যে ‘আসামী’ লেখা বন্ধ হয়েছে বা হচ্ছে এতেই তাদের খুশি থাকতে দেখা যায়।
               আত্মবিস্তারের এই চোখ দিয়েই আজকাল পথ করে করে এগুচ্ছেন, ব্রহ্মপুত্রের বৌদ্ধিক সমাজ। ‘রাগঅনুরাগে’র দ্বিতীয় সংখ্যাতে ( ১৬ আগষ্ট, ২০০৮)অধ্যাপক জ্যোতির্ময় জানা তাঁর লেখার     ( অসম-বঙ্গ সম্পর্ক, ১৮২৭-৯৫) শুরু করেছেন এই ভাবে “ যোৱা বছৰৰ আগভাগত অসমত এক প্রলয়ৰ সূত্রপাত হৈছিল—লক্ষীনাথ বেজবৰুৱাক কেন্দ্র কৰি। যাৰ কলমলৈ যি আহিছিল তাকেই লিখিছিল, ১৮২৬ চনৰ পৰা বর্তমান কাললৈকে বাঙালিয়ে অসমীয়াৰ যিমান নিন্দা কৰিছে কেবাখন্ডত তাৰ সঙ্কলন উলিয়াব পাৰি। একো একোটা খন্ডত থাকিব দহ বছৰীয়া নিন্দা । এই হিচাপে প্রকাশযোগ্য খন্ড হ’ব লাগে ওঠৰখন। প্রত্যুত্তৰত আন এজনে লিখিলে, অসমীয়াই কৰা বাঙালী নিন্দাৰো সঙ্কলন উলিয়াব পাৰি আৰু সেই সঙ্কলনৰ লগত ফেৰ মাৰিব পৰা বিধৰ হ’ব। যি কি হওক, অসমীয়া বাঙালীৰ পাৰস্পৰিক নিন্দাৰ সঙ্কলনবোৰ হয়তো কেতিয়াও নোলাব। যদি ওলায় তেন্তে আন এটি সঙ্কলনৰো প্রয়োজন অনিবার্য হৈ উঠিব। সি হ’ল অসমীয়া বাঙালীৰ মৈত্রী আৰু সৌভাতৃত্বৰ পৰিচয়বাহী উক্তি আৰু কর্মৰাজিৰ সঙ্কলন। সেই সঙ্কলনে যে পূর্বোক্ত দুবিধ সঙ্কলনক আকাৰ , শক্তি আৰু মহত্বেৰে চেৰ পেলাব পাৰিব সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত।” প্রথম দুটোকে আত্মসাৎ করেও তৃতীয় সংকলনটি রচনা করা যায়। সেই বিদ্যা এখন অনেকেই আয়ত্ব করছেন। তাতে অসম সাহিত্য সভার মতো, অসমীয়া সমাজেও নানা কারণে সমালোচিত, সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে পথ হাঁটছেন অনেকে। এই নিয়ে জ্যোতির্ময়ের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি । তাতেই বছর দুই আগে অসম সাহিত্য সভার সভাপতি সম্পাদক বরাক উপত্যকাতেও ভ্রমণ করেছিলেন। এবারে গুয়াহাটিতে ‘ব্যতিক্রম সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ যখন ১৯শে মে আয়োজন করল বড় করে, সেখানে অসম সাহিত্য সভার নেতৃত্বকে হাজির করবার অত্যাশ্চর্য ঘটনাটিও ঘটিয়ে দিল। গুয়াহাটিতে ১৯শের শহীদদের স্মরণে বেদি নির্মাণে সভার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও আদায় করে ফেলল। কিন্তু বাঁকা চোখ তাতেও প্রশ্ন তুলল। সম্প্রতি পরম ভট্টাচার্য শিলচরের ‘বরাক কণ্ঠ’ কাগজে সিলেটিতে এক রম্যরচনা লিখেছেনঃ উনিশ মায়ের অর্ধশত। তাতে লিখেছেন, “...আসামো কোনঠাসা অইয়া উগ্রভাষা কর্তাইন হকলে আর অসম সাহিত্য সভায় ওখন ‘আত্তিকরণ’ লাইনে আগ্রাসনর ধান্ধা করিত্রা।লাইনর মাউথ পিশ রংবং টেরং । ‘জনজাতি’ ‘উপজাতি’ ‘বরাক’ ইতা অখন তারার খুব মিষ্টি লাগের, ভালা লাগের। মেইন লাইন অইল –আইও পার্টনার। আমার ( বৃহৎ বিকট মূল) ভিতরে হামাই যাও।নিজেরে আমার মধ্যে বিলীন করি দেও।সব ভাষা সংস্কৃতির উপনদী বিকট ব্রহ্মপুত্রত ( অসমীয়া অহং ) আইয়া মিলি যাও। আমিউ তুমি । বরাক ব্রহ্মপুত্রর নাম আর পুইসার ধান্ধায় দালাল হকলে লাইন মারিয়া যাইরা । ইতা আর কতগু? সাহিত্য সংস্কৃতির লাইনর দালাল হকলে সাহিত্য সভার পিছে হাটরা আবার উনিশ মেও মারাইতরা। মারাউক    তারা । ইতা বজ্জাত । ডরাই না আমরা । মাতৃভাষার অধিকার আমরা অর্জন করছি ।” রম্য রচনা বলেই আমরা একে পরমের প্রত্যক্ষ বয়ান বলে নিচ্ছি না । কিন্তু এই বয়ানের অস্তিত্বটি এতে ধরা পড়ছে । ২১ জুলাই, ২০১১ তারিখে কানু আইচ, যিনি উনিশের ইতিবৃত্ত নিয়ে লেখালেখি করে ইতিমধ্যে এক খ্যাতনামা নাম, ‘প্রান্তজ্যোতি’ কাগজে এক প্রবন্ধ লিখেছেনঃ “৬১তে একাদশ, ৭২এ দ্বাদশতম এবং ত্রয়োদশ ও চতুর্দশতম শহীদের জন্ম দিয়েছে বরাক।” সেখানে তিনি লিখেছেন, আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালিরা নানান চাপের মধ্যে থাকার পরেও বরাক সন্তান ‘ব্যতিক্রম’ পত্রিকার সম্পাদক এবং বাংলাভাষী বোর্ডের চেয়ারমেন ঘোষণা করেন অসমে বাংলা ভাষার কোনো সংকট নেই।” উপত্যকা পাল্টালে ‘ভাষিক সংখ্যালঘু’ বোর্ডের নামের আগেও ‘বাংলাভাষী’ শব্দটিও বসে যায়। চিহ্নায়িততো দূরেই থাক চিহ্নায়ক নিজেই কেমন পালটে যায়। হতেই পারে, এই দু’জন কোথাও বলেছেন, এই উপত্যকাতে এমন কোনো সংকত নেই যে বাংলা ভাষা সহিত্য করতে হলে ভয়ে ভয়ে মাথা নত করে করতে হবে। ভাষিক সংখ্যালঘু বোর্ডের চেয়ারমেন কী করছেন আপাতত তা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামেও চলবে, কিন্তু তিনি দৈনিক যুগশঙ্খের সম্পাদকও বটে। যুগশঙ্খ সেই কাগজ যে কাগজ জয়দীপের লেখা সদিয়া থেকে ধুবড়ি, ইটানগর থেকে আইজল অব্দি পৌঁছে দেবার সাহস রাখে। এই উপত্যকার বাঙালির বুকে আশা আর মুখে ভাষা দিয়ে যাচ্ছেন যারা প্রবল সাহসে আর সক্রিয়তায় তারা এমন বলতেই পারেন। যাদের কাজ নয় এই ভাষা আর আশা যোগানো, বরং এই উপত্যকা মাথানত করে থাকলেই যাদের প্রতিবাদের বৌদ্ধিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সওদা চলে ভালো-- তারা এরকম বয়ান পাল্টাতেই পারেন।
             সুজিত চৌধুরী তাঁর সমস্ত ধ্রুপদী সুকৃতি সত্ত্বেও একটি মারাত্মক কর্মসূচী এবং সূত্র দিয়ে গেছেনঃ “এমন নয় যে সমাজ সকল দিক থেকেই সংহত একটা গোষ্ঠী, তার মধ্যে শ্রেণি বর্ণগত, পেশাগত বা অন্যধরণের বিভাজনের ব্যাপার থাকে, কিন্তু সাধারণ স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক লক্ষ্য সম্পর্কে যে কোনো সংগঠিত সমাজই সহমত পোষণ করে। বরাক উপত্যকার বঙ্গভাষী জনগোষ্ঠীর সেই ধরণের কোনো সাধারণ লক্ষ্য নেই—এমন কি নিজের মাতৃভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকার করে নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা এবং সংশয় প্রকাশ করার মানুষ পর্যন্ত এখানে খুঁজে পাওয়া যায়। অবশ্য পেছনে কাঞ্চনমূল্য প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলেই এই সমস্ত মাতৃঘাতিরা মাঠে নামেন। তাতেও ক্ষতি ছিল না—কিন্তু দেখা যায় যারা যারা বাঙালিত্বের মৌলিক পরিচিতিকে পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে চায়, সাধারণ মানুষের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। অবশ্য এই সমর্ত্থনের পেছনেও কাজ করে নগদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা—কিন্তু একটা জাতি সত্তাকে আমরা সুসংগঠিত হিসাবে ধরে নেব, যখন এই সত্তার যে বা যারা বেইমানি করে, তারা তীব্র জনরোষের শিকার হয়। বরাক উপত্যকায় তেমনটি ঘটে না, অতএব বলা যায় বরাক উপত্যকায় বাঙালি সমাজ বা জাতিসত্তা কোনোটাই ঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি । সেই অসমাপ্ত প্রক্রিয়াকে সমাপ্ত করাটাই হচ্ছে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ।” ( বরাক উপত্যকার বাঙ্গালিঃ অস্তিত্ব ও অবয়বের সঙ্কট; প্রবন্ধ একাদশ) এটা কি স্পষ্ট নয় যে পরম কিম্বা কানু আইচ সেই দায়িত্বকে নিষ্ঠার সঙ্গে বহন করে চলেছেন? জয়দীপের ‘জাতিগঠনে’র আহ্বানও সেরকমই নির্দেশ প্রসূত?  এখনো বরাক উপত্যকার সামাজিক পরিবেশে তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু যখন তিনি এগুলো লিখছিলেন তখন শহিদূল আলম চৌধুরী অসম সাহিত্য সভাকে হাইলাকান্দিতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় সম্মেলন করাবার জন্যে । জানাচ্ছেন বরাকের ভাষা ‘বাংলা’ নয়, ‘বরাকী’। এখন কিন্তু সেই শহীদূল ১৯শের বেদিতে মালা দেন। কিন্তু আজ সেই আশির শহীদুল আলমের কিম্বা ষাটের মইনুল হককে চৌধুরীর ছায়ার সন্ধান করা হচ্ছে যারা ‘ব্যতিক্রম’ কিম্বা ‘রাগঅনুরাগ’ প্রকাশ করছেন তাদের মধ্যে । ‘রাগ-অনুরাগে-১’এর সম্পাদিকা অনুরাধা শর্মা পূজারী সম্পাদকীয়তে লিখেছেন, “ এই সংখ্যাত লেখা লেখক সকলক বাঙালী বা অসমিয়া হিচাপে আমি গণ্য কৰা নাই। সকলোকে অসমীয়া বুলি ধৰি লৈহে এই সংখ্যাৰ পৰিকল্পনা কৰা হৈছে।” এর সরলরৈখিক পাঠের অর্থ হতেই পারে, “...আইও পার্টনার। আমার ( বৃহৎ বিকট মূল) ভিতরে হামাই যাও।নিজেরে আমার মধ্যে বিলীন করি দেও।” কিন্তু, যদিবা তা হয়ও, তবে তা অন্তর্ধর্মে ড০ সুজিত চৌধুরীর ‘দায়িত্বে’র থেকে তফাৎ কতটুকু? প্রশ্ন উঠতেই পারে তিনিতো আর অবাঙালিকে ‘বাঙালি’ বলেননি। ‘রাগ-অনুরাগে’র সম্পাদিকাও ‘বাঙালি’র স্বাতন্ত্র্যকে ঝেড়ে ফেলেন নি। বরং সেই স্বাতন্ত্র্যকে ধরবার প্রয়াসেই ‘সাতসরী’র পরিকল্পনাটি করেছিলেন। মনের ভেতরে বিলীন করে দেবার চাপা আকাঙ্খার অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে আমরা একেবারে উড়িয়ে দেবনা । কিন্তু অসম রাজ্যের বাসিন্দা হিসেবে ‘অসমিয়া’ পরিচয় ধারণ করা না করা নিয়ে কেবল যে আরেকটা তর্ক আছে তাই নয় শুধু , বাস্তব সমস্যাতেও পড়তে হয় আকছার। বাসিন্দা হিসেবেও অসমিয়ারা এবং অন্য অনেকেই পরিচয় দেন ‘অসমীয়া’। এটি তাদের বেশ পাকা নির্মিত বয়ান। বহু চিহ্নিত উগ্রজাতীয়তাবাদ বিরোধীও এই চিহ্নটি ব্যবহার করেন। বাঙালিরাই লেখেন ‘অসমের’ ( অসমের বাঙালি, অসমের মানুষ ইত্যাদি)। এই সমস্যার সমাধানে কেউ কেউ ‘অসমিয়া বাঙালি’ পরিচয় একটা গড়ে তোলবার প্রস্তাব দিলেও সবাই তাকে মেনে নিচ্ছেন না তার পক্ষে মনে পড়ছে ২০০৭এর ৬ নভেম্বর দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত মণীন্দ্র রায়ের একটা চিন্তা ও তথ্যে সমৃদ্ধ লেখা, “বঙ্গভাষী অসমিয়া বনাম বঙ্গভাষী অসমিঞা অসমিয়ার অশনি সংকেত । ” তাই বলে, ব্রহ্মপুত্রের বাঙালি অসমিয়া মুখে ‘অসমীয়া’ শব্দটি শুনলেই আৎকে ঊঠেন না, বরং এর পাশে ‘রাগ-অনুরাগে’র অতিথি সম্পাদক প্রশান্ত চক্রবর্তীর মতো অন্তর্ঘাতী বয়ানটি নির্মাণ করেন এইভাবে, একই সম্পাদকীয়ের পাশে তাঁর ‘দু-আষাৰে’ আছে , “উত্তৰাধিকাৰৰ গৌৰবময় ভূমিত থিয় হৈ আমি আখ্যা দিঁও মাতৃভাষা আৰু ধাত্রীভাষা, অনুভব কৰো দৈবকী আৰু যশোদা আইৰ চিৰ-চেনেহী মাতৃৰূপ।” সরলরৈখিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী এই পাঠকে পড়ে প্রশ্ন তুলবেন, “বরাক ব্রহ্মপুত্রর নাম আর পুইসার ধান্ধায় দালাল হকলে লাইন মারিয়া যাইরা। ইতা আর কতগু?” কেন, ভারতীয় মাত্রের কাছেই কি ইংরেজিটা, হিন্দিটা ‘যশোদা’ হয়ে যায় নি? বরাকের মণিপুরি, ডিমাছা, খাসিয়াদের কাছে বাংলাটা/ সিলেটিটা ‘যশোদা’ হয়ে যায়নি? সেই ‘যশোদা’দের বিরুদ্ধে চুপটি করে থেকে ‘অসমিয়া’র বিরুদ্ধে এতো উষ্মাটা কী নেহাতই উগ্রজাতীয়তাবাদের এক প্রতিনির্মাণ নয়? ‘যশোদা’র স্নেহকে অস্বীকার করে কি আর ভারতীয় থাকা যায়? বরং বিলেতি হওয়া যায়, ‘জাতিরাষ্ট্রে’র স্বপ্ন দেখা যায়। যে স্বপ্ন কিন্তু আর যেই হোক ভারতের মতো বৈচিত্র ভরা আরেকটি দেশ রাশিয়ার জর্জীয় ভদ্রলোক স্তালিন দেখেন নি । অন্তত, তাঁর ১৯১৩র সেই বিখ্যাত বইটি পর্যন্ততো বটেই।
          প্রশান্তের মতোই আরেকটি অন্তর্ঘাতের সংবাদ আমরা দেব অসমিয়া ‘দৈনিক অগ্রদূত’ কাগজ থেকে। ‘ব্যতিক্রম’ সম্পাদক সৌমেন ভারতীয়া যে কথাগুলো তাদের নানা অনুষ্ঠানে বলেই থাকেন, তাই এবারে তিনি লিখলেন সেখানে। ২৭ জুলাই সংখ্যাতে প্রকাশ পেল তাঁর উত্তর সম্পাদকীয় ‘অসমৰ বাঙালীৰ মনৰ বেদনাৰ কথা’। সেখানে ১৯৬১র ভাষা আন্দোলনে শহিদের বলিদান প্রসঙ্গ টেনে তারপরে এই কথাগুলো লিখতে তাঁর কলম কাঁপেনি মোটেও, “আঠৰ দশকৰ ৰক্তাক্ত সময় প্রত্যক্ষ কৰাসকলে জানে হিংসাৰ ৰূপ কেনে।তেতিয়াৰ পৰা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাৰ বাঙালীৰ মনত ভয় আৰু আতঙ্কই আঁহ বান্ধে ।সম্ভবত ইয়াৰ বাবেই এই উপত্যকাত ষাঠিলাখ বাঙালি থকা সত্বেও বাঙালীসকলৰ কোনো শক্তিশালী ৰাজনৈতিক বা অৰাজনৈতিক সংগঠন নাই। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাৰ বাঙালীসকলে যেন মুখ খুলিবলৈ ভয়   করে ।” বরাক উপত্যকাতে প্রায় কেউ এখনো অসমিয়া কাগজে এমন সংলাপ রচনার কথা কল্পনাও করতে পারবেন না! এই লেখাতে সৌমেন ভাষা নিয়ে ছ’ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, গুয়াহাটি –ডিব্রুগড় দূরদর্শনে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষাতে গবেষণা পত্র লেখার সুবিধে প্রদান, ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে বাংলা শুরু করা, বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয় এবং ছাত্রদের জন্যে বাংলাতে প্রশ্নপত্র দেয়া এবং উত্তর লেখার সুবিধে দেয়া, বাংলামাধ্যমের স্কুলগুলোতে অসমিয়া বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়ে অসমিয়া শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করা ইত্যাদি। জ্যোতির্ময় এমনি লেখেননি,“আত্মীকরণ মানে কিন্তু আপোষ নয়, আত্ম-বিনষ্টিও নয়। অন্যকে জানার মাধ্যমেই আত্ম-বিস্তার ঘটে ।” এই পাঠ পূর্বোত্তরের সমস্ত বাঙালি আয়ত্ব করে নিলেই দেখা যাবে ‘ যেখানে যায় বাঙালি, কেবলি মার খায়’ –এমন নির্মিত বয়ান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
             
                সুজিত চৌধুরী ‘বেইমানি’র বিরুদ্ধে যে ‘জনরোষে’র কথা লিখেছেন, তা এখনো তেমন বাঙালিদের মধ্যে নেই বটে। কিন্তু তেমন জনরোষ যে স্বজাতির বিরুদ্ধেই কেমন প্রবলভাবে প্রকাশ পেতে পারে তার এক সাম্প্রতিক অসমীয়া নজির ‘অসমীয়া জাতীয় অভিধান’ এবং ‘হেমকোষ’ নিয়ে বিতর্ক । দুই দলই অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে ‘অসমীয়া জাতি’ ধ্বংসের ষঢ়যন্ত্রের অভিযোগ পরস্পরকে নিষিদ্ধ করবার আহ্বান জানাচ্ছেন। পথে দাঁড়িয়ে প্রতিলিপি পোড়ানোর মতো ঘটনাও ঘটছে । বৌদ্ধিক বিতর্কের খোলা হাওয়া আর থাকছে না । কিন্তু সেই গণ-বিতর্কেও উঠে আসছে জনগোষ্ঠীগত বৈচিত্রের সম্মানের সংগত প্রশ্নগুলো। আমরাও যে বাঙালির মধ্যে সেরকমই এক পরিবেশের দিকে এগুতে যাচ্ছি তার ইঙ্গিত কিন্তু,                 ‘ইতা বজ্জাত’এ মেলে। আশির দশকে যখন শহীদুলেরা আলমেরা ‘বরাকী’ ভাষার কথা বলছিলেন তখন আত্মরক্ষার স্বার্থে প্রতিবাদের ভাষাটা নাহয় বুঝি । তখনো জনরোষ না হলেও বৌদ্ধিকরোষের মুখে শহীদুল আলম চৌধুরী এবং অসম সাহিত্য সভাকে পড়তে হয়েছিল। বৌদ্ধিক সমাজের এক বড় অংশ সেই অনুষ্ঠানকে বয়কট করেছিলেন। কিন্তু এখন সেগুলোই “সাহিত্য সংস্কৃতির লাইনর দালাল হকলে”র বিরুদ্ধে চালিত হচ্ছে । এমন বেইমানি বিরোধী বৌদ্ধিক রোষের এক সাম্প্রতিক বিড়ম্বনাতে জড়িয়েছিলেন সুজিত চৌধুরীর বই ‘প্রবন্ধ একাদশে’র সম্পাদক জয়দীপ বিশ্বাস এবং অনেকে । শিলচরের এক সাম্প্রতিক ছোট কাগজ ‘ভায়া ট্রাঙ্ক রোড’ দৃষ্টি কাড়ার জন্যে ষাটের অতন্দ্র বা হাংরিদের এক নিম্নমানের সংস্করণ চালাচ্ছেন। তাতে তাঁরা সাম্প্রতিক এক সংখ্যার প্রচ্ছদে শহীদ বেদি নিয়ে এক ব্যঙ্গচিত্র এঁকে ফেলেছিলেন। বেদির পাশে পড়ে আছে আধপোড়া সিগারেট আর মদের গ্লাস । নিচে লেখা ২০৫০। আর যায় কোথায়! শহীদ বেদির অপমান, শহীদের অপমান, বাংলা ভাষার অপমান সহ্য করতে না পেরে ‘জাতীয়’ আন্দোলনের দুই একজন নেতৃত্ব তাদের বিরুদ্ধে পুলিশে মামলা ঠুকে দেন। পুলিশ সম্পাদকদের গ্রপ্তার করে নিয়ে যায়। এর প্রতিবাদে ২৯ জুলাই কাগজে প্রায় ২৯ জন কবি লেখক সংস্কৃতিকর্মীকে কলম ধরতে হয়েছিল। তাদের মধ্য জয়দীপ ছাড়াও রয়েছেন, বিজিত কুমার ভট্টাচার্য, পিযুষ রাউত, অমিতাভ দেব চৌধুরী, চন্দ্রিমা দত্ত, বিজয়া কর সোম, তমোজিৎ সাহা, বিশ্বজিত দাস, শান্তনু পাল এমন আরো অনেকে। তাঁদের মতে ‘শহীদবেদিকে আবর্জনা মুক্ত করে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনে সচেতনতা গড়ে তোলাই’ এই ব্যঙ্গচিত্রের উদ্দেশ্য । একটা কথাতো সত্য, ‘বেইমানি’কে চিহ্নিত করে তাকে ‘রোষে’র মুখে ঠেলে দেয়াটাও বড় সরল রৈখিক কাজ নয়। ‘জাতিগঠনে’র বহু সৈনিককে কিন্তু বরাকে বহুবার শক্তিশালী ‘হিন্দু বাঙালি জাতীয়তাবাদী’দের ‘রোষে’র মুখে পড়তে হয়েছিল। স্বয়ং সুজিত চৌধুরীও আত্মরক্ষা করতে পারেন নি, পারেন নি পরম ভট্টাচার্য, পারেন নি তপোধীর ভট্টাচার্য, পারেন নি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীও। পারেন না, পারবার কথা নয়। কেননা বরাকের রাজনীতিতে ‘বাঙালি’নয়, ‘হিন্দু বাঙালি’ ধারাই প্রধান শক্তি, যার নাড়ির যোগ সর্বভারতীয় হিন্দি-হিন্দু –হিন্দুস্তানী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে।

3 comments:

স প্ত র্ষি said...

জয়দীপ বিশ্বাস এখানে ধান্দাবাজির একটি ক্ষুদ্র উদাহরনমাত্র যারা ধর্মে ও জিরাফে, অর্থাৎ সিপিএমে ও সন্তোষ মোহনে সমান হাজিরা দিয়ে গাছের ও তলার দুই’ই কুড়িয়ে নেওয়ার তালে। এদেরকে এভাবেই চিনিয়ে দেওয়া উচিৎ। সুশান্তদা, ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।-সপ্তর্ষি বিশ্বাস – saptarshi.biswas@gmail.com

স প্ত র্ষি said...

জয়দীপ বিশ্বাস এখানে ধান্দাবাজির একটি ক্ষুদ্র উদাহরনমাত্র যারা ধর্মে ও জিরাফে, অর্থাৎ সিপিএমে ও সন্তোষ মোহনে সমান হাজিরা দিয়ে গাছের ও তলার দুই’ই কুড়িয়ে নেওয়ার তালে। এদেরকে এভাবেই চিনিয়ে দেওয়া উচিৎ। সুশান্তদা, ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
সপ্তর্ষি বিশ্বাস – saptarshi.biswas@gmail.com

সুশান্ত কর said...

তুমি যে এই দীর্ঘ লেখাটা পড়েছ মন দিয়ে তার জন্যে ধন্যবাদ! হ্যা, যাদের ফাঁকিবাজি নিয়ে বললে, সেগুলোতো লোকে জানে, আরো জানবে। চলবে না বেশিদিন! এই করে এগুনোও যাবে না বেশিদূর!