আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Friday 9 October 2009

The Autumn issue of ‘Byatikrom’ ; The Problem of Practicing Bengali Language and Literature in Assam

গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত ‘ব্যতিক্রম’ কাগজটি তাদের সেপ্টেম্বরে (০৯) প্রকাশিত পুজো সংখ্যা দিয়ে এক বছর পূর্ণ করে অসমের বাংলা প্রকাশনার সংজ্ঞাই  পাল্টে দিয়েছে। এর আগে বহু চেষ্টা হলেও অসমে
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে  প্রকাশিত কোনো বাংলা সাময়িক পত্রিকাই এক বছর পার করতে পেরেছে বলে মনে পড়ে না। শিলচর থেকে সন্দীপ আচার্য দশকখানিক আগে এক চেষ্টা করেছিলেন। পরম ভট্টাচার্য , সুজিত
দাসেদের মতো ব্যক্তিত্ব এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু এক বছর পুরো করেছিল বলে মনে হয় না। তাই এর নামও ভুলে গেছি। একাধিক দৈনিক কাগজ বেরোলেও তাদের মালিকেরা কেঊ এই পথে  পা বাড়াতে
সাহস করেনি। এখন শুনছি যুগশঙ্খ পা বাড়াবে । ইতিমধ্যে ‘অন্যদেশ’ নামে অঞ্জলি সেনগুপ্তের সম্পাদনাতে আরো একটা কাগজ বেরুচ্ছে। ভালো কথা। যত বেরোয় অসমের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্যে ততই সুসংবাদ বয়ে নিয়ে আসবে।
    এর আগে সোনার কাছাড় ও যুগশঙ্খ শারদসংখ্যাও দু’একবার বের করেছিল । কিন্তু ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি। বোধহয় খরচ ওঠেনি। বরাক উপত্যকাতে যারা অলিতে গলিতে ঘটা করে উনিশ
–একুশ পালন করেন তারাও এ ধরণের কাগজ কিনে বাঁচিয়ে রাখাটা ধর্ম বলে জ্ঞান করেন না। শুধু লেখক-বুদ্ধিজীবিতে আর কতদূর এগুতে পারে! বরাক তথা অসমের বাঙালির বাঙালিয়ানার  মানে পশ্চিম বাংলার থেকে ধার করে আনা আধখানা ( পড়ুনঃ হিন্দু বাঙালিয়ানা)  । কলকাতার ছোঁয়া না থাকলে কিছুই তাদের মুখে রোচে না। মায়, ধর্মও না । কলাকাতার প্রকাশনাগুলো আমাদের টাকাতে সওদা করে।  কিন্তু তাদের রচনাতে এখানকার মাটির গন্ধ জুড়ে দিতে তাদের বয়েই গেছে! তাঁরা হিল্লী-দিল্লী বছরে বেশ ক’বারই করেন । কিন্তু অসমে বুড়ো বয়সে এলেও নির্দ্বিধাতে সরল মনেই বলে ফেলেন, এই প্রথম এলাম। এখানেও যে বাঙলাতে লেখা হয়, প্রচুর হয়, জানলে ‘বিপন্ন বিষ্ময়ে’ বলে ওঠেন ‘ওমা! এ কী! এখানেও হয় !’ সম্প্রতি ক’মাসের ব্যবধানে এসে গেলেন হর্শ দত্ত, জয় গোস্বামী, মহাশ্বেতা দেবী। সব্বারই মুখে আমরা শুনেছি ঐ একই কথা ।  
      এ অবস্থাতে ব্যতিক্রমের সম্পাদক সৌমেন ভারতীয়া  কী যাদুটি করেন , তা তিনিই জানেন। কয়েকটা সংখ্যা পড়ে গেলে অবশ্য যাদুর রহস্য অনুমান করাটা পাঠকের পক্ষে অসুবিধে হয় না । কিন্তু সেটি প্রকাশ্য করে দিয়ে তাদের ভাতে মারার ইচ্ছে আমাদের মোটেও নেই। শুধু আশংকা হয়ে এ যাদুতে বেশি দিন চলবেতো ! তা যাদুকর স্বয়ং জানেন। আমরা শুধু শুভেচ্ছাই জানাতে পারি। ইংরেজিতে যাকে বলে professionalism তা তাদের আছে পুরো মাত্রাতে। শুধু অর্থ নয় , তথাকথিত ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র  তত্বও আগেকার সম্পাদকদের পথ রোধে দাঁড়িয়েছিল। একটা বিকল্প প্রতিষ্ঠান তুলে ধরাই যে অসমের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রাহু মুক্তির অন্যতম পথ এই সহজ কথা তাদের অনেকের মাথাতেই ঢুকত না। ফলে তাঁরা ‘অপসংস্কৃতি’ নামের অস্পৃশ্যতার ছোঁয়া মাড়িয়ে যা বের করতেন তা শুধু গুরু গম্ভীর বৌদ্ধিক জ্যেঠামশাইদেরই পাতে তোলবার মতো ছিল।  কখনো বা একেবারেই প্রাচীন  ছেঁড়া পুথির রঙে  ও রেখায়। এখনো এই কম্প্যুটার যুগেও অনেকে সেই ‘লেটারপ্রেসের’ যুগের নিরলঙ্কার রূপটিকেই সাময়িক
পত্রের আদর্শ রূপ বলে ভাববার কুসংস্কার মুক্ত হতে পারেন নি। কেবল তাই নয় সেই কুসংস্কার নিয়ে তাদের বেশ গর্বও আছে। তাদের নিজেদের কাগজ যেমন তেমন চলে যায়। তাতেই তাদের এক আত্মতুষ্টি
আছে। বাকি আঙিনা যে ঝরা পাতাতে নোংরা হয়ে আছে এ নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। এভাবে তারা ‘কলকাতা’র প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা বাঁচিয়েই রেখেছিলেন নিজেদের অজান্তে।  দৈনিক কাগজগুলো
দেড় দশক আগে থেকেই অসমে পশ্চিম বাংলার কাগজগুলোর বাজারে ভাগ বসিয়ে ছিল। কিন্তু সাময়িক পত্রগুলো পারে নি।
                ‘ব্যতিক্রম’ এদিক থেকে ব্যতিক্রম। তাঁরা এক বিকল্প  প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলবার পথে এগুচ্ছেন। তা করতে গিয়ে কিছু অশুভ আপোস করতে হচ্ছে। মায় প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ভেতরের
পাতাগুলোতে সুন্দরী মেয়েদের ছবিতে ছড়াচ্ছড়ি। এতেও আমরা আপত্তির কিছু দেখিনা। মেয়েরা যত পাঠিকা হয়ে উঠে আসবেন তত ছেলেদের ছবিতেও ভরে যাবে  ব্যবসায়িক কাগজের পাতাগুলো। মানব
শরীরের থেকে সুন্দর কিছু আছে কি এ ধরণীতে ?! এ প্রশ্নটি নিয়েও ‘প্রগতিশীল’দের ভাববার যুগ বোধহয় পেরিয়ে গেল। শুধু মেয়েদের মর্যাদা যাতে শরীর মাত্রে নেমে না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে অনুরোধ করব সম্পাদককে ।
    এমনিতে কাগজটি  জীবন-জীবিকা ও ব্যক্তিত্ব গঠনের পরামর্শ দেয়াটেয়াতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে। সাহিত্যের খবর কিছু দিলেও , সাহিত্যের কাজ কিছু এতে রাখতেন না এতোদিন। কিন্তু শারদ সংখ্যাতে এর ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, “আগামী সংখ্যা থেকে আমরা সাহিত্যের জন্যে কয়েকটি পাতা বরাদ্দ করছি।” সুতরং আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, “ সাহিত্যের পাতার জন্যে যে কেউ
আমাদের দপ্তরে মৌলিক লেখা পাঠাতে পারেন।” লেখাপড়া, জীবিকা নিয়ে এ সংখ্যাতেও বেশ কিছু ভালো লেখা ও তথ্য রয়েছে।  বিভাস লাহিড়ি লিখেছেন ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষাঃ ১০ টি পরামর্শ ; প্রশান্ত চাকলাদার
লিখেছেন ‘Career & Respect  দুটোই আছে মানবাধিকারের কোর্সে ; গীতার্থ সেঙ্গুপ্ত লিখেছেন ‘ তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের পেশা Visual Merchandising ; Interview সহজ, সাবলীল, সপ্রতিভ থাকুন লিখেছেন াবলীল, সপ্রতিভ থাকুন লিখেছেন নিখিল তালুকদার ; কর্মক্ষেত্রে—Sales & Marketing লিখেছেন ধনঞ্জয় মেধি ; ইতি মজুমদার লিখেছেন ‘পরীক্ষার মুখে নয় , পাঠ পরিকল্পনা করো এখন থেকেই । বিকাশ
সরকার প্রত্যেক সংখ্যাতেই লেখেন কোনো না কোনো এক ব্যতিক্রমী দেশি বিদেশী চেনা-অচেনা ব্যক্তিত্ব নিয়ে যাদের জীবন পাঠকদের জীবনের নতুন আশার আলো জাগাতে পারে বলে তাঁর মনে হয় । এ
সংখ্যাতেও  ‘ আমার শৈশবকে কি তুমি দেখেছো ?’ রচনাতে সদ্য প্রয়াত মাইকেল জ্যাকসনের  স্মৃতিচারণ করেছেন।  এ লেখার উপরী  পাওনা ‘Have you seen my childhood?’ গানের পূর্ণপাঠ । 
    শুরু থেকে প্রতিটি সংখ্যাতে দু’একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়ে এসছে ‘ব্যতিক্রম’। সে সাক্ষাৎকারকে প্রচ্ছদ নিবন্ধের মর্যাদা দিয়েছে ।  জানিয়েছে সেই ব্যক্তি ব্যতিক্রমী। তাতে
বুঝি, জীবনে তাঁদের সফলতার পেছনকার ইতিবৃত্য জানিয়ে কাগজটি তরুণদেরও উদ্বুদ্ধ করতে চেয়ে এসছে। শুরু করেছিল পাথারকান্দির বিধায়ক কার্তিক সেনা সিনহাকে দিয়ে। আমার এখনো মনে পড়ে সামান্য গরীব  কৃষকের ঘরের ছেলে যিনি ছেলেবেলাতে গরু চরাতে মাঠে যেতেন তিনি এখন একজন সফল রাজনীতিবিদই নন , একজন সফল বড়মাপের ব্যবসায়ী এবং সমাজসেবীও। তাঁর রাজনীতির সঙ্গে বর্তমান লেখকের দূর দূর পর্যন্ত কোনো সহমত পোষণ করবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু অতি কম বয়সে  তাঁর উত্থানের যে গল্প ‘ব্যতিক্রম’ শুনিয়েছে সে এক কথাতে ‘রূপকথা’! মাঝে মাঝে মনে হয়েছে এর পেছনে প্রচুর বাঁকা পদক্ষেপ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সে রকম পা বাড়াতেও কিছু সদর্থক গুণের দরকার পড়ে। সেই গুনগুলো আমাদের অনেক কম আছে , আমরাতো ব্যর্থতার ভয়ে আগে আগেই পিছিয়ে আসতে অভ্যস্থ । 
       এ সংখ্যাতে তেমন ব্যক্তিত্ব মহাশ্বেতা দেবী। তাঁকে নিয়েই প্রচ্ছদ নিবন্ধ। কিন্তু তিনি ছাড়াও এবারে আছেন আরো অনেকে।  ত্রিপুরার শিক্ষা সংস্কৃতি মন্ত্রী অনিল সরকার, ইংরেজি দৈনিক আসাম ট্রিবিউনের
সম্পাদক তুলসীগোবিন্দ বরুয়া,প্রতিদিন কাগজের সম্পাদক জয়ন্ত বরুয়া,যুগশঙ্খের সম্পাদক বিজয় কৃষ্ণ নাথ, নিউজ লাইভ টিভি চ্যানেলের সম্পাদক অতনু ভূঁইয়া ( অসমের বাংলা ভাষা যে এক স্বতন্ত্র চেহারা
নিচ্ছে তার প্রমাণ হলো , ব্যতিক্রম লিখেছে—ভূঞা) , গুয়াহাটির এক সফল বাঙালি ব্যবসায়ী গৌতম বন্দোপাধ্যায়, ফ্যাশন ডিজাইনার প্রশান্ত ঘোষ, সংস্কৃতি কর্মী মিতালি নাথ, নগাঁওয়ের নৃত্য শিল্পী মন্দিরা
ভট্টাচার্য , রাজ্যের বাঙালি  কৃষিমন্ত্রী নুরজামাল সরকার। তালিকাটি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার এই উপত্যকার বাংলা কাগজ অন্তত বাঙালিদের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবেনা। আসাম ট্রিবিউন বা প্রতিদিনের মতো কাগজ এ রাজ্যের সংবাদ মাধ্যমে বহুদিন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। কাগজগুলোর ভেতরের খবর আমাদের কমই জানবার সুযোগ হয়।   শারদ সংখ্যাতে ব্যতিক্রম সে সুযোগ করে দিলেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি রাজনীতির নেতাদের কথা এলেই কিছু হিন্দু নেতৃত্বের কথা শুনে শুএনেই আমরা অভ্যস্থ ছিলাম। নুরজামান তেমন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। কিন্তু যে জন্যে তাঁর সাক্ষাৎকারটি দরকারি মনে হল তা এই যে নুরজামানতো বটেই  ব্যতিক্রমও তাঁকে বাঙালি বলে চিহ্নিত করছে। এ উপত্যকার থেকে উল্লেখযোগ্য বাঙালি নেতা উঠে না আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলছেন, “ এই উপত্যকায় বাঙালিদের বসবাস বেশিদিনের নয়। আগে থিতু হোক , তারপর দেখবেন অনেক বাঙালি নেতা উঠে আসবে এখান থেকেই।” না প্রশ্ন না উত্তর –কোনোটাই কাজের নয়। দু’টতেই সত্যভ্রম আছে।   কিন্তু তাঁকে বাঙালি বলে তুলে ধরে ব্যতিক্রম অন্তত একজন বাঙালি বিধায়কের সংখ্যা এ রাজ্যে বাড়িয়ে দিল। এমন করে দেখলে আরো বহু  বাঙালি নেতার দেখা পাওয়া যাবে।  আশা করছি বুদ্ধিমানেদের জন্যে এই ইশারাই যথেষ্ট হবে। 

       মহাশ্বেতাকে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মের স্মরণ অনুষ্ঠানে পুরস্কার দিয়ে সম্মান  জানাতে ডাকা হয়েছিল।  উপেন্দ্রনাথ বডোদের জাতীয় পিতা বলে সম্মানিত হন। কিন্তু যে আন্দোলন তাঁর হাতে গড়ে উঠেছিল সেটি সব জনজাতীয়দের মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত ছিল না। বরং সে  আন্দোলনের ধাক্কাতে বিপন্ন হয়েছে এ রাজ্যের রাজবংশি, ঝাড়খণ্ডি সহ অন্য প্রায় সমস্ত জনজাতি। আর ময়মনসিংহমূলীয় মুসলমান চাষিদের কথাতো বলেই লাভ নেই।  তেমন আন্দোলনের পুরোধার স্মরণে পুরস্কার নিতে তিনি কেন এলেন এ প্রশ্নটা মনে কাঁটা বিধিয়ে দেয় বটে। বোধহয় কিছু  জনজাতীয় আন্দোলন যে নিপীড়ক চরিত্রের হতে পারে সে  নিয়ে তাঁর ধারণা কম।  এমনিতেও  এ তাঁর দ্বিতীয়বার অসম ভ্রমণ। এর আগে একবার অসম হয়ে ত্রিপুরা গেছিলেন জানালেন। ‘সব মনে নেই, ভুলেও গেছি অনেকটা’—তাই বোধহয় এখানকার জনজাতীয় সমস্যার জটিল চরিত্রটা তেমন জানা নেই তাঁর।  সাক্ষাৎকারেও তেমন প্রসঙ্গ উঠে এলো না। কিন্তু সেই তিনি ব্যতিক্রমের সদস্যদের মৃদু ধমকে দিয়েছেন দেখে আমাদের বেশ কৌতুক বোধ হয়। কলকাতার লোকেরা ধমকে টমকে দিলে আমরাও বেশ বাধ্য ছাত্রের মতো মেনে টেনে নিই। ব্যতিক্রম জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, “ আপনি এই যে লোধা, শবর, ওঁরাও, সাঁওতাল এদের নিয়ে . . .। তিনি বললেন, “ লোধা, শবরদের সঙ্গে ওঁরাও-সাঁওতালদের এক করে দেখলে চলবে না , ওরা আলাদা।” ব্যতিক্রম বলল, “ ঠিক আছে এই যে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির কাছে . . .” তিনি বললেন, “ না , না ওরা অন্ত্যজ নয়। কয়েকটা ভালো ভালো শব্দ বললেই ইন্টারভিঊ হয় না।”  ‘অন্ত্যজ’ শব্দটা  কেবল ব্যতিক্রমের নয় এই উপত্যকার বাঙালি মধ্যবিত্তের সমাজবিচ্ছিন্ন চরিত্রকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় বটে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো এমন
ধমকে  দেবার অধিকারটা তিনি মহাশ্বেতা বলেই তাঁকে দিতে হবে? তিনি কি জানেন যে এ রাজ্যে আমাদের ভাষাচাষিদের অবস্থাও ‘অন্ত্যজ’দের থেকে খুব একটা ভালো নয়? তিনি কি জানেন না আমাদের
লেখকেরা সব্বাই একলব্যের স্কুলের ছাত্র ! তাঁর জানবার দরকার কী!  জয় গোস্বামীরো দরকার ছিল না এখানে আসবার আগে, ছিল না হর্শ দত্তেরও । যদিও শ্রী দত্তের কাগজটি ভারতের এই টুকরোতে লক্ষ লক্ষ
টাকার ব্যবসা করে প্রতি মাসে!  আমরা কেবল ‘অন্ত্যজ’ নই, ‘অন্ত্যজে’র মানসিকতার থেকেও মুক্ত নই । সে প্রমাণ এ সংখ্যা ব্যাতিক্রমের পাতাতেই আছে। কবিতা লিখেছেন অনেকেই। পীযুষ রাউত থেকে শুরু
করে স্বর্ণালি বিশ্বাস ভট্টাচার্য, অনীতা দাস টন্ডন, রবীন্দ্র  সরকার,  সুব্রত পাল, তপন মহন্ত, দিলীপ বিশ্বাস,অমরেশ দত্ত, কানাই লাল জানা স্মৃতি পাল নাথ এমন প্রায় বত্রিশজন কবি । আমিতাভ দেব চৌধুরী
লিখেছেন, এক অপূর্ব কাব্যোপন্যাস ‘ঈশ্বরের শেষ গুপ্ত চর’। সঙ্গে আছে জয় গোস্বামীর কবিতা ‘কী বিস্মিত নাম’। অসমের কোনো কাগজে এই প্রথম লিখেছেন –এই সংবাদটি ব্যতিক্রম জানিয়ে দিয়েছেন।
           আমাদের অভিমত হলো তিনি এখানকার কাগজে আর বেশি লিখবেনও  না। তাঁকে একেবারে কাগজটির শুরুতে অন্য নিবন্ধ-প্রবন্ধ সহ সব রচনার আগে  জায়গা করে দেয়া কেন ? এটি তাঁকে সম্মান জানানো না আমাদের লেখকদের অপমান করা হলো এই প্রশ্নটা ওঠাই  উচিৎ ।  আমাদের অশুভ ছায়া থেকে তাঁকে বাঁচানো হলো কি ? এই হীনমন্যতা যত তাড়াতাড়ি আমরা ছাড়তে পারি তত দ্রুত আমাদের রাহু মুক্তি ঘটবে। ব্রজেন্দ্র সিংহের আশ্চর্য সুন্দর ও তথ্য সমৃদ্ধ স্মৃতিকথা ‘আমাকে নিয়ে সাতকাহনে লিখেছেন, “ আমি মাঝে মাঝে অভিমানী হয়ে যাই । একবার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলা কবিতা নিয়ে জোর তর্ক  বা আলোচনা চলছিল, মাঝখানে বীরেনবাবু ( রক্ষিত) বললেন, ইনি কিন্তু বাঙালি নন। সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপনের কথা বলা বন্ধ। আর একটি শব্দও বলল না আমার সঙ্গে এই নিয়ে ।” এই অভিমানের সম্মান দিতে  আমরাই বা শিখব কবে ?
          ব্রজেন্দ্র বাবু না হয় অবাঙালি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি মানুষ। কিন্তু বাঙালি হলেই বা আমাদের অভিজ্ঞতা কেমন, তার সন্ধানও পাওয়া যাবে তাঁর লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন, “ তিনি ( বীরেন রক্ষিত) দারুণ অভিমানী। নিজেকে প্রায় গুটিয়ে রেখেছেন । দল বেঁধে হইচইয়ের মধ্যে নেই সুনীল-শক্তিদের সঙ্গে তেমন ভাব নেই। কারো সঙ্গেই সম্ভবত বনত না। তিনি ছিলেন একা ও অভিমানী। তিনি বলতেন লিখে কী হবে । আমাদের জন্যেতো আর একটা চ্যাপ্টার থাকবে না । ফুটনোটেও নাম থাকবে কিনা ঠিক নেই। তাঁর সঙ্গে মিশে আমিও একজন পেসিমিস্ট হয়ে উঠলাম। . .  .  আমি আমার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে আঁকাব, অন্তত অনুরোধ করব। বীরেন বাবু বললেন, সত্যজিৎ রায় কর্মচারীর আঁকা একটা ছবি দিয়ে দেবেন। ” চাকরি শেষে কলকাতাবাসি বীরেন রক্ষিতের সঙ্গে জীবনে প্রথম আমার দেখা হয়েছিল  ২০০৫এ পুনর্বিন্যাস পাঠক্রমে যোগ দিতে গিয়ে। রবীন্দ্রভারতীতে।  কমল কুমারের উপর বক্তৃতা করেছিলেন। বক্তৃতা শেষে দু’চারটে কথাতে আলাপ পরিচয়। আমার তাঁকে মনে হচ্ছিল হতাশ, নিঃসঙ্গ ও দুর্বল। তার দিন  বছর না ঘুরতেই তিনি মারা যাবেন তখন কি ভেবেছি! বীরেনবাবু না হয় পেসিমিস্ট ছিলেন। শক্তিপদ আমার কলেজের শিক্ষক ছিলেন। নিজে প্রবাসী হবার দিন কতক আগে একবার তাঁর বাড়ি গেছিলাম। তিনি জানালেন দিনকতক আগে এক সাহিত্যের অনুষ্ঠানে কলকাতা গেছিলেন। তাঁর যৌবনের বন্ধু সুনীল এখন আর তাঁকে, ‘কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করবারও সময় পান না। মৃত্যুর পর আনন্দ বাজার বোধহ্য় একটা ছোট্ট  সংবাদ ছেপেছিল। তাও শিলচরের কেউ তুলিয়েছিল বলে। ব্যস , ঐ টুকুনি। ব্রজেন্দ্র সিনহা ( এটিই বোধহয় তাঁর উপাধির আসল বানান)  লিখেছেন, “ শক্তিপদ কবি হিসেবে কারো থেকেই কম নয়। কিন্তু মৃত্যুর পর সেই সম্মান তাকে দেওয়া হয় নি     বাইরে ।”  সম্মান মৃত্যুর দিনে জীবনানন্দেরও মেলেনি । কিন্তু তাঁর সঙ্গে শক্তিপদের ভাগ্যকে মেলানো যাবে কি ? এ হচ্ছে আমাদের মতো  ‘অস্পৃশ্যদের অদৃষ্ট’ । সে অদৃষ্ট ফেরাতে আমরা পাটকেলটি ছোঁড়ব , সে পরামর্শ আমাদের   নয় । জয় –মহাশ্বেতাদের আমাদের লাগবে। কিন্তু তাই বলে আমাদের অতি সম্মানের আর ভালোবাসার শিক্ষক, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সাহিত্যের আকাশে  সুর্য টেনে আনবার রথের  যিনি সারথী, সেই  উষা রঞ্জন মহাশ্বেতাকে তিন বছর আগের পাওনা প্রণাম করবার জন্যে উতলা হবেন আর প্রত্যাখ্যাত হবেন এর ভার আমাদের সহ্য করবার কোনো দায় নেই ।
         ‘গুয়াহাটিতে আমার সাহিত্য আড্ডা’ নামে মানস শিকদার এক অতি সুন্দর স্মৃতি কথা লিখেছেন। যাকে বলে সাহিত্যিক প্রবন্ধ—তার মর্যাদা পাবার যোগ্য এটি। শুরু হয়েছে এরকম, “ ঢ্যাঢারং ঢ্যাটাং ঢ্যাটাং,
ঢ্যাঢারং ঢ্যাটাং ঢ্যাটাং শব্দটা কনে বাজতেই চোখের সামনে যেন খুলে যায় এক রঙিন ক্যালাইডোস্কোপ , বুকের ভিতর থেকে উড়াল মারে হাজার পাখির অক্লান্ত ডানার বিস্তার, যেন খুলে যায় সিমসিমের হীরক
দ্যুতিময় গুহামুখ। . .” প্রবন্ধটি গুয়াহাটির বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত  জানতে গেলে পরের কালের লেখকদের জন্যে এক ভালো আকর হবে। এতে তিনি লিখেছেন এক জায়গায়, “  ‘ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার
লেখালেখির সমস্যা, একটি খসড়া’ নামক মানিক দাসের একটি প্রবন্ধ যা লেখাকর্মীর শরৎ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল, যথেষ্ট বিতর্ক তুলেছিল। বেশ কিছু দিন সেই প্রবন্ধ উত্তেজনার ঢেঊ তুলেছিল বিভিন্ন আড্ডায়।
পরবর্তী শরৎ সংখ্যায় তার জবাবে অখিল দত্ত পাল্টা লিখেছিলেন এক দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘আমাদের সৃজনশীল সাহিত্য কি শূন্য?’ এবং পাশাপাশি ছাপা হয়েছিল মানিক দাসের জবাবমূলক প্রবন্ধ ‘ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার
লেখালেখির সমস্যা বিতর্কের জবাব এবং সিদ্ধান্ত’ । সেই পাল্টা প্রবন্ধ এবং তার জবাব নিয়েও লেখা কর্মী শরৎ সংখ্যা বেশ কিছুদিন যাবৎ উত্তাপ তুলেছিল সাহিত্য আড্ডায়। সেই আগুনে আমরা সকলেই
অল্পবিস্তর হাত সেঁকলেও এবং চায়ের কাপে তুফান তুললেও লিখিত আকারে, পক্ষে বা বিপক্ষে কোনোও যুক্তিসমৃদ্ধ বিশ্লেষণাত্মক লেখায় বিষয়টিকে টেনে নিয়ে যাইনি। সেটা হলে অসমের বাংলা সাহিত্য বিষয়ে
চিন্তা ও চর্চার কিছু দিক নিশ্চয়ই উঠে আসত। উপেক্ষার বিরোধীতা এবং এড়িয়ে যাওয়ার আলস্যপরায়ণতা আমাদের সেই দিকটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ”  এই শেষ বাক্য ক’টি নির্ঘাৎ এক সবল সত্য ভাষণ। এমন বাচনে গুয়াহাটি বা এই উপত্যকার লেখকেরা অভ্যস্ত বলে মনে হয় না। বছর কয় আগে বর্তমান লেখকও এ নিয়ে একটা তর্ক তোলবার চেষ্টা করেছিলাম ‘কবিতার পূর্বোত্তর’ কাগজে। কিন্তু যুক্তি তর্ক কোথায় ! শেষ অব্দি ব্যক্তিগত আক্রমণে সে তর্কের ইতি পড়েছিল। এক ‘নক্ষত্র’কবিতো একবার ফোনেই আমাকে যা নয় তা গালি গালাজ করে বসলেন। বিষয় আর কিছু নয়। প্রশ্ন শুধু এই করেছিলাম যে তিনি  এতো বিদেশি  লেখকদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন কেন?  যাই হোক সমস্যাটি আছে তার স্বীকৃতি আছে এই লেখাতে। মানিক দাসের বক্তব্য কী ছিল জানবার সুযোগ করে দেন নি মানস। যাই থাক এ নিয়ে তর্ক একটা নিরন্তর  চালিয়ে যাওয়া উচিত। এখনো গুয়াহাটির বাইরে বেশির ভাগ জায়গাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কথা বললে একটি বাঙ্গালি বন্ধু জোটা মুসকিল হয়। এমন কি বেশির ভাগ বাংলার শিক্ষক-অধ্যাপকেরাও মাইনে নেবার  অমানবিক-অসামাজিক কল মাত্র।  বাংলা ভাষা  ও সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে গেলে কী ভীষণ মাজাদার কৌতুককর অভিজ্ঞতার মধ্যি দিয়ে যেতে হয় এ নিয়ে পরে আমার লেখার ইচ্ছে আছে।
            এখানেতো অনেক বাঘা বাঘা সংস্কৃতি কর্মীও ভাবেন, কবি মানে রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর একটাই বই আছে সেটির নাম ‘সঞ্চয়িতা।’ একবার এক বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী যখন জেনেছিলেন যে আমার কাছে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ আছে কিন্তু ঐ ‘সঞ্চয়িতা’ নেই বেশ হতাশ হয়েছিলেন! কারণ আর কিছু না, কলাকাতার থেকেও কোনো অতিথি এলেও তিনি দেখেছেন ঐ ‘সঞ্চয়িতা’রই খবর করেন। কলকাতার অতিথির থেকেতো আর  আমি বেশি জানতে পারি না!
আরো আসছে অপেক্ষা করুন।


 

1 comment:

Paramita pragya Bhowal said...

Uporokto lekhata pore besh shacchando bodh korlam.Amader eto byastotar modhye, anek shukkho anubhuti jacche hariye.Surjoday theke surjasto shudu dam daoa putuler mato chutchi....hatat hatat eshob besh nara diye jaye amake.