From My Articles |
আজমল পুত্রের বাংলা শিক্ষক ও অসমের বাংলা ভাষা
এ আই ডি ইউ এফের সভাপতি বদরুদ্দিন আজমল লোকসভাতে নির্বাচিত হওয়াতে তাঁর বিধান সভা কেন্দ্র দক্ষিণ শালমারা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হচ্ছে। এতে তাঁর দল বদরুদ্দিনেরই পুত্র আব্দুর রহমানকে প্রার্থী করেছে। অনেকে একে পরিবারবাদ বলছে। দল বলছে, বদরুদ্দিনের পুত্র না হলে এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের ওয়াজেদ আলিকে হারানো যাবে না। পরিবারবাদ না হলেও দলটির বিরুদ্ধে এতোদিন সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ উঠেছে। যদিও বিজেপির মতো এদের কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখাত যায়ই নি, উল্টে সব্বাইকে নিয়ে চলার প্রবণতা দেখা গেছে। অবশ্যি এটা ঠিক যে এরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থের পক্ষে কথা বলে এসছেন।
অসমিয়া জাতিয়তাবাদী দলগুলো আজমলেদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকে প্রশ্রয় দেবার অভিযোগও করে থাকে। কিন্তু এহ বাহ্য! তাঁরা এবং বাঙালি জাতিয়তাবাদীদের যে অংশটি 'বাঙালি' আর হিন্দু শব্দকে সমার্থক মনে করে তার বিজেপির চাইতেও এ আই ডি ইউ এফের উত্থানে বেশি আতঙ্কিত।
এবারের নির্বাচনে যেটি সবচাইতে চোখে পড়বার দৃশ্য তা হলো কংগ্রেসের প্রার্থী ওয়াজেদ আলি আজমল পুত্রের বিরুদ্ধে বাংলা না জানার অভিযোগ এনেছেন। সেই অভিযোগের জবাব দিতে ইতিমধ্যে হোজাই থেকে এক বাংলা শিক্ষককে ভালো মাইনে ও থাকা খাওয়ার সুবিধে দিয়ে মুম্বাইতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আব্দুর রহমান ইংরেজি জানেন, জানেন উর্দু এবং হিন্দিও। কিন্তু জানেন না অসমিয়া ও বাংলা। তাই যেটুকু তিনি মুম্বাইতে শিখবেন , শিখবেন। বাকি টুকু অসুবিধে দূর করবার জন্যে এই শিক্ষক নির্বাচনী প্রচারে সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গে থাকবেন।
বাইরের পাঠকেরা এতে অবাক হবার কিছু দেখবেন না। কিন্তু অসমের সব্বাই জানেন এতে অসমের বাঙালিদের উৎসাহিত হবার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী অসমিয়াদের চিন্তিত হবার কারণ আছে।
বদরুদ্দিন হোজাই বাসিন্দা হলেও খাস সিলেটি। ষাট ইংরেজির ভাষা দাঙ্গার পর অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সমস্ত মুসলমান বাঙালি বিশেষ করে ময়মনসিংহমূলীয়রা নিজেদের অসমিয়া বলে আদমসুমারিতে লিখিয়ে আসছেন। বরাক উপত্যকার মুসলমানদের বাংলা ভাষা আনুগত্যও প্রশ্নাতীত নয়। যদিও এদের সব্বারই মাতৃভাষা বাংলা। তাঁদের ক্ষুদ্র মধ্যবিত্ত অংশটি সবসময়েই বাংলার পক্ষে থাকলেও ষাট ইংরেজিতে মইনুল হকের ভূমিকা ও আশিতে আলগাপুরের অগপ বিধায়ক সহিদুল আলমের ভূমিকা ঐ প্রশ্নগুলোকে পাকা করতে সাহায্য করেছিল। আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে, দেখেছি আগে যখন বাংলাদেশের টিভি চেনেলগুলোর নাটক -ধারাবাহিকগুলোর ব্যাপক প্রচার ও জনপ্রিয়তা কাছাড়ে করিমগঞ্জে ছিল তখন শিল্পীদের নামের ভিড়ে কোনো হিন্দু নাম দেখালেই আত্মীয়রা চেঁচিয়ে বলতেন, "ঐ একটা বাঙালিও আছে বে!" বুঝুন ঠেলা, বাংলাদেশে বাঙালি থাকবে না তো 'কিরঘিজ' থাকবে? আজো বরাকের হিন্দুরা প্রকাশ্যেই মুসলমানদের বলে 'বাঙাল'! এরা এটি কখনোই বুঝতে চায়নি যে মূলতঃ কৃষক হবার সুবাদে এতোদিন মুসলমানদের কাছে ভাষা ততো গুরুত্ব পায় নি। যে ভাষা সরকারী কাগজে লেখালে নিরাপদে থাকবেন তাই লিখিয়েছেন। বরাকে অবশ্য তারা চিরদিনই নিজেদের বাঙালি লিখিয়েছেন, যদিও মধ্যবিত্ত সমাজ তার জন্যে কোনো সম্মান জানায় নি তেমন।
কিন্তু বদরুদ্দিনের দল শুরু থেকেই অন্য প্রবণতা দেখাচ্ছে। তাঁর দলের বদরপুরের বিধায়ক নির্বাচিত হয়েই ১৯৬১র শিলচরের গণহত্যার পর গঠিত মেহরোত্রা কমিটির প্রতিবেদন কেন প্রাকাশিত হবে না, এই প্রশ্ন তুলে বিধান সভার বাইরে ও ভেতরে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। অন্য বিধায়ক আতাঊর রহমান রাজ্য বিধানসভাতে বাংলাতে শপথ নিয়েছিলেন।বদরুদ্দিন প্রায়ই বলেন বটে অসমিয়া সংস্কৃতি রক্ষা করাই তার দলের লক্ষ্য। কিন্তু কথায় কথায় এ ইঙ্গিতো দিতে ভুলেন না যে বাঙালিদের বিপন্ন হতেও তিনি দিচ্ছেন না। যখনই ভাটি অসমের মুসলমান মজুররা উজান অসমে বা পূর্বোত্তরের অন্য রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে মার খান, তিনি প্রকাশ্যেই বাঙালি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
গেল বছর তাঁর দলের কিছু কর্মী ভাটি অসমের গোয়ালপাড়াতে এক সম্মেলন করে নিজেদের বাঙালি বলে ঘোষণা করবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদালগুড়ির দাঙ্গা ও ৩০ অক্টোবরের ধারাবাহিক বোমা বিষ্ফোরণের ( যেটির জন্যে প্রথমে মুসলমান জঙ্গীদের দায়ী করা হলেও ধরা পড়ে বডো উগ্রপন্থী) পর সে উদ্যোগে পানি পড়ে। এই উদ্যোগে হোমেন বরগোঁহাইয়ের মতো আপাত উদার বুদ্ধিজীবিও বেশ ক্ষেপেছিলেন । এ নিয়ে আমারও এক লেখা ছেপেছিল দৈনিক জনকণ্ঠ। ( এখানে দেখুন) । তখন ঝিমিয়ে গেলেও কিন্তু তলায় তলায় যে একটি চোরাস্রোত বইছে তা বোঝা যায় এই ঘটানাতে যে বদরুদ্দিন পুত্র অসমিয়া জানেন না, এটা কংগ্রেসের মতো মৃদু জাতীয়তাবাদীদের কাছেও আর কোনো ইস্যু নয়। ইস্যু বাংলা না জানা।সম্প্রতি আলগাপুরের প্রাক্তন বিধায়ক সহিদুল আলমকেও দেখা যাচ্ছে পুরোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবার উদ্যোগ নিতে । তিনি এখন এ আই ডি ইউ এফ আর তৃণমূল কংগ্রেসের ঐক্য ঘটিয়ে বাঙালি ঐক্য সম্ভব করে তুলতে চান।এগুলো এ রাজ্যের বাঙালিদের কাছে নিশ্চইয়ই এক সুখবর । যদিও হাইলাকান্দির 'সাহিত্য' পত্রিকার শততম সংখ্যাতে 'নিরালম্ব'এর মতো গল্পের লেখক অরিজিত চৌধুরীদের মতো বুদ্ধিজীবিদের কাছে এও এক দুঃসংবাদ মাত্র। কারণ তাঁরা একে দেখেন 'বাঙলাদেশী আধিপত্য কায়েমে'র এক ষড়যন্ত্র হিসেবেই। এদের মতো বাঙালিরা হচ্ছেন মুসলমানদের কাছে শাখের করাতের মতো। আসতেও কাটেন, যেতেও কাটেন।
আমার ব্যক্তিগত অনুমান হলো, এ রাজ্যে অচিরেই বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন মুসলমানেরা। কারণ হিন্দুদের নয়, একমাত্র এদেরই আছে নিচু তলা অব্দি সংযোগ। শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে। আগামী আদমসুমারিতেই এ রাজ্যের জনবিন্যাসের চরিত্র পাল্টে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।
ষাটের দশকে এদের যেভাবে অসমিয়া লিখিয়ে রাজ্যের জনবিন্যাসের চরিত্র পালটানো হয়েছিল তা নিয়ে রাজ্যের প্রখ্যাত অসমিয়া বুদ্ধিজীবি ড০ হীরেন গোঁহাইর উদ্ধৃতি দিয়ে আরো এক বুদ্ধিজীবি ড০ দেবব্রত শর্মা তাঁর বহুখ্যাত গ্রন্থ ‘অসমিয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া আরু জাতীয় –জনগোষ্ঠীগত অনুষ্ঠানসমূহ’ গ্রন্থে লিখেছেন যে “. . .ড০ হীরেন গোঁহাইর মত এই যে ১৯৬১-৭১ সময়চোয়াত ৫৭%র পরা ৭১% শতাংশলৈ অসমীয়াভাষীর এই চমকপ্রদ সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটোয়া হৈছে রাজনৈতিক হাত-সাফাইর জরিয়তে। তেঁও সকীয়াই দিছে যে এনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিমিষতে থান-বানো হৈ যাব পারে ।”( পৃষ্ঠা ৫৪৮) আমাদের অনুমান এই ‘থান-বান’ ( টুকরো টাকরা ) হয়ে যাবার সময় সমাগত।
বরং গণতন্ত্রে যে ভাবে পৃথিবীর সব দেশে, মায় বাংলাদেশেও, 'সংখ্যাগরিষ্ঠরা' রাজ করে তাতে অন্য এক বিপদ মাথা তুলতেই পারে। সে বিপদ 'বাংলাদেশী'র নয়, বাঙালি উগ্রজাতীয়তাবাদের। বাঙালির ' আপনা মাংসে হরিণা বৈরি' দশা। পশ্চিম বাঙলা, বাংলা দেশ, ত্রিপুরা কোত্থাও অবাঙ্গালি দুর্বল সংখ্যালঘুরা নিরাপদে নেই। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সমান সম্মান ও স্বীকৃতি নেই। পূর্বোত্তরের জনগোষ্ঠীগুলোকে এখনো বাঙালি বুদ্ধিজীবিরাও নির্বিকার 'পাহাড়ি' বলে গল্পে কবিতাতে লিখে চলে। এদের সম্পর্কে জানা র আগ্রহ অতি অল্প। বাঙালির উন্নাসিকতা দেখেই অসমিয়া মনেও 'অসমিয়াকরণে'র স্পৃহা জেগেছিল একদিন। আজো তাই আছে। তাই যারা 'ভাষা জাতীয়াতাবাদ'কে ( এদের মধ্য আমাদের অনেক বামপন্থী বন্ধুরাও আছেন) ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দাওয়াই বলে ভাবেন তাদের দলে আমি। নেই। 'ভাষা সাম্প্রদায়িকতা' যে কী ভীষণ দম বন্ধ স্থিতির জন্ম দেয় জানবার জন্যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে এসে বাস করার অভিজ্ঞতা চাই।
তাই আমরা যারা বর্তমান গণতন্ত্রের বদলে 'সংখ্যালঘুও তার ভাষা-ধর্ম নিয়ে সমান নিরাপদ ও সম্মানিত বোধ করবে' এমন এক উন্নত তথা নয়া গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখি তাদের দায়িত্ব আগামী দিনের অসমে বাড়ল বলে। আমাদের তখন অবশ্যই অসমিয়া সহ অন্য ভাষীদের সম্মানের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।
7 comments:
Good article
চিন্তাশীল লেখা। পড়লাম। আসলে সচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। আর সচেতনতা আসতে পারে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই।
ফন্ট রঙ আর একটু গাঢ় করে দিন। তাহলে স্পষ্ট দেখা যাবে।
নীল নক্ষত্র ভ্রমনের পর আমাকে মেইল পাঠিয়েছেন, তার প্রেক্ষিতে মস্ত এক চিঠি লিখেছিলাম কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য বশত যান্ত্রিক পাগলামির কারনে সে মেইল সেন্ড না হয়ে সুন্দর করে ডিলিট হয়ে গেল দুঃখে কান্না পাচ্ছিলো, এত যত্ন করে আপনাকে চিঠি লিখলাম আর সেটা মুছে গেল?
কয়েক দিন পর আবার লিখবো।
byaparta eto purono ebong jotil ar sporshokator je soishob theke avigyatar jhuli bhore niyeo matamot daoata kashtokar.
amio ashomia bhasha andolane jail khetechi dudin . jhola gur ar kakor bhorti bhat ar dal namok ekti taral padartho dibrugarh jail er unki mere jaye.....ei ami assam shahityo sabha theke "Sarat chandra Goswami Bota" peyeo nije hate ante jete parini...
samoy bhuliye dey anek kichu-- kintu axom ke ma chara ekhono bhabte parina--- durbalota na akorshon? jana nei....
আপনার জন্ম শৈশব যেখানে কেটেছে তার প্রতি আকর্ষণ না থাকাটাই তো অস্বাভাবিক। এখানে আপনার অস্তিত্বের অর্ধেকটাই ছড়িয়ে আছে। আপনাকে ধন্যবাদ যে ওখানে গিয়েও এই সুন্দর ধরণীকে ভুলে যায় নি। অনেক বাঙালিকেই প্রায় রোজই শুনি কলকাতাতে বাড়ি করে যায় আর ওখানকার লোকেদের গিয়ে বলে," অসমের কিচ্ছু হবে না।" ঐ সব নেমকহারামদের থেকে আপনি আপনাকে নিয়ে গৌরব করতে পারেন। বাঙালি হয়েও আপনি অসমিয়া ভাষার জন্যে লড়েছেন সেতো আরো গৌরবের। কিন্তু দিদি আপনি যদি ষাট ইংরেজির ভাষা আন্দোলনের কথা বলেন তবে, তখন বাঙালিরা লড়ছিল অসমকে দ্বিভাষিক রাজ্য করবার জন্যে। অসমিয়ারা লড়ছিল কেবল অসমিয়ার জন্যে। অসমিয়ার এ একাধিপত্যের মানসিকতার জন্যে তারপরে অসম পুরো ভেঙ্গে যায়। এ কথা এখন বহু অসমিয়া বুদ্ধিজীবিও স্বীকার করেন। আসলে ভারতে একভাষিক রাজ্যের ধারণাই বিড়ম্বণা। এটা আগামী দিনগুলোতে আরো বেশি স্পষ্ট হবে অসমে। আর এখান থেকেই গোটা ভারতে আরো বেশি গণতান্ত্রিকরণের কাজ শুরু হবে বলে আমার বিশ্বাস। যাই হোক আজমল পুত্রের বাংলা শেখাটা আপনার কেমন লাগছে?
chitansheel ar manansheel lekha.....
shachenata briddhir jonyo anek samoy chokhe angul diye dekhiye dite hoy.....
ar tai e dharaner article er prayojan ache boiki.
Post a Comment