দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত ইসমাইল হোসেন সংক্রান্ত চিঠি
আপনার সম্পাদিত কাগজের ১৮ ডিসেম্বর সংখ্যাতে প্রকাশিত লেখক ইসমাইলকে বরাক বঙ্গের ‘সমাজের শত্রু’ আখ্যা দেবার সংবাদ প্রসঙ্গে এই চিঠি । এই লেখকের সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘বরাক উপত্যকার অসমিয়ার ইতিহাস’ শীর্ষক গ্রন্থটি আমি পড়িনি, যদিও শিরোনাম দেখে মনে হচ্ছে অসমিয়া সাময়িকী ‘প্রান্তিক’ এবং ‘সাদিনে’ প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলো নিয়েই তিনি বইটি সাজিয়েছেন । ঐ দু’টো কাগজেরই আমি নিয়মিত পাঠক এবং সেই সূত্রে তাঁর এই লেখাগুলো আমি আগেই পড়েছি । তাঁর লেখাগুলো পড়লে যে কারোরই বঙ্কিম চন্দ্রের ‘কমলা কান্তের দপ্তরে’র বঙ্গ দর্শন সম্পাদকের কাছে লেখা কমলা কান্তের চিঠির কথা মনে পড়বে । চিলারায়ের নাম থেকে ‘চিলচর’ এবং তার থেকে ‘শিলচরে’র নাম এসছে এমন উটকো তথ্যকে সত্য বলে জাহির করা কিম্বা সুবীর করের বই থেকে ভুল উদ্ধৃতি দিয়ে মিথ্যাচার করা এই ভদ্রলোকের পুরোনো অভ্যেস । এমন মিথ্যাচারী লেখক কম দেখেছি । এই ভদ্রলোক অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্য –দুইয়েরই মান ও সম্মানের অবনমন করে চলেছেন নির্বিকার । ইনি ধর্মেও থাকেন আবার জিরাফেও থাকতে ভালোবাসেন । আমি জানিনা এঁর মতো একজন লেখককে ‘নতুন সাহিত্য পরিষদ’ নিজেদের সংগঠনে রেখেছেন কী করতে । সেখানে ইনি নিখাদ বামপন্থী | ক’দিন আগে কাগজে দেখলাম শিলচরের ‘‘সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ’’ তাঁকে বিষ্ণু রাভার শত বর্ষ অনুষ্ঠানে অতিথির মর্যাদা দিয়ে নিয়ে গেছে । তিনি আবার শঙ্কর দেব বিশেষজ্ঞও | তাতে কোনো অসুবিধে নেই । অসুবিধে এই যে এই বামপন্থী (?) বুদ্ধিজীবিটি সেখানেও কেবল সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে অধ্যয়ন করেন না , বেশ ( ভক্তি ) ভাবেও গদগদ হয়ে পড়েন । শুনেছি ( শুনেছি মানে,যদ্দূর মনে পড়ে তাঁর লেখাতেই পড়েছি ) তিনি দীক্ষা নিতেও চাইছেন , কিন্তু বরপেটা সত্র যদ্দিন না তাঁর মত ‘শুদ্ধাচারী’কে দীক্ষা দিতে প্রস্তুত না হবে ততদিন তিনি অদীক্ষিত থাকবেন । তাঁর নিজের ধর্ম ইসলাম নিয়ে যে কোনো আগ্রহ আছে, তা কোনো লেখা পড়ে মনে হয় নি ।
আমার ব্যক্তিগত প্রার্থণা হবে তাঁর শঙ্কর প্রীতিতে যাঁরা অভিভূত তাঁরা যেন অচিরেই মোহমুক্ত হয়ে পড়েন । এতো মিথ্যে বোধহয় ধর্মও সইবে না । সাহিত্য ও সংস্কৃতি যে বেশিদিন সইবেনা এ প্রায় নিশ্চিত ।
অনেক অসমিয়া পাঠক তাঁর স্বরূপ জানেন । কিন্তু, শঙ্করদেব ভক্তির আড়ালে সরলমনা মানুষের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা এতো প্রবল যে খুব কম লোকই মৌচাকে ঢিল ছুড়তে সাহস করেন । যারা করেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাও খুব সুখের হয় নি । বিশেষ করে যখনই তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কলম ধরেছেন ( শিলচর থেকে ফিরেই তিনি 'সাদিনে' ওখানকার ভাষা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন । যার বিরুদ্ধে বহু অসমিয়া পাঠক সরব হয়েছিলেন ) , পরের সংখ্যাতে দেখা গেছে তিনি আর চিঠিতে জবাব দিচ্ছেন না, সরাসরি অশালিন ভাষাতে প্রত্যাক্রমণ করে আবারো প্রবন্ধ লিখছেন । এভাবে তিনি নিজের মর্যাদার হানি নিজেই ঘটিয়ে থাকেন । আমার ভয় হয় , আমার এই চিঠি যদি ছাপা হয় আর তিনি পড়েন, তবে হয়তো অন্য কোনো অসমিয়া কাগজে বিকৃত উদ্ধৃতি দিয়ে প্রবন্ধ লিখে তাঁর স্বরূপ তিনি দেখাবেন । এবং সেখানে একটু উগ্রজাতীয়তাবাদি রঙও চড়াবেন ।
এই ভদ্রলোকের লেখা পেলেই আমি পড়ে থাকি । এমনই এক বই ''সাহিত্যত সাম্প্রদায়িকতাবাদ আরু রবীন্দ্রনাথ' অনেক আগেই আমার পড়বার সৌভাগ্য ( অথবা দুর্ভাগ্য ?) হয়েছিল। ভাগ্যিস, আমি তখনই তাঁর কিছু মিথ্যাচার কলমে চিহ্নিত করে রেখেছিলাম । আজ মনে হলো, এখনই তাঁকে পাঠকের সামনে 'চিহ্নিত' করবার যথার্থ সময় । বস্তুতঃ এই ভেবেই আমার আজকের এই চিঠি ।
বাঙালিদের দোষ আছে, অসমিয়া বই কম পড়েন, তাই বোধহয় 'সাহিত্যত সাম্প্রদায়িকতাবাদ আরু রবীন্দ্রনাথ' বইটি লোকায়ত প্রকাশন থেকে দশ বছর আগে (১৯৯৮) প্রকাশিত হলেও কারো তেমন চোখে পড়েনি । বইটি আবার শ্রদ্ধেয় অমলেন্দু গুহ এবং তাঁর সুযোগ্যা পত্নীর নামে উৎসর্গ করে তাঁদের সম্মান বাড়ালেন না কমালেন সে নিয়েও প্রশ্ন তোলাই যায়।
না, পাঠকের ভয় পাবার প্রয়োজন নেই | এতে রবীন্দ্রনাথের মান হানিকর কোনো কথা নেই । রবীন্দ্রনাথ যে 'বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যে'র সাধক এবং যাদের হাতে ভারতে জাতীয়তাবাদের ভাবনা এক ধর্মীয় ভিত্তি লাভ করে তাদের অন্যতম ছিলেন বঙ্কিম----লেখকের বলবার মূল কথাগুলো এরকমই । এ নিয়ে বর্তমান চিঠির লেখকের মৌলিক কোনো মতবিরোধ নেই । সমস্যা তাঁর তথ্যের বেসাতিপনা নিয়ে, যা দেখলে যে কোনো সৎ পাঠকের গা কিলবিল করবে, আমাদের বলবার কথা এইটুকুনই । আমরা কেবল তাঁর বিভ্রান্তিগুলো তুলে ধরছি। কোনো বিশ্লেষণের মনে হয় না তেমন দরকার পড়বে ।
ইসমাইলের ইতিহাস জ্ঞান ঃ বইটির ২১ পৃষ্ঠাতে তিনি লিখছেন, “দুর্ভাগ্যজনক কথা যে বঙ্গর 'কৃতি-সন্তান' হৈয়ো বঙ্কিম চন্দ্রই বহু ক্ষেত্রত বঙ্গর ইতিহাস নেজানিছিল- - - ।'' বঙ্কিম চন্দ্রের ইতিহাস জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা ছিল বললে হজম হয়, কিন্তু 'নেজানিছিল' লিখলে লেখকের ঔদ্ধত্য দেখে আৎকে উঠতে হয় বৈকি । কারণ, তাঁর হাত ধরে ভারতীয়ের হাতে ভারতের আধুনিক ইতিহাস চর্চা যাত্রা শুরু করেছিল। এ সত্য না জেনে ইসমালই যদি আরেক ইতিহাস লিখতে বসে যান তবে যে তিনি যে কোনো ভারতীয় ভাষার সত্যানুসন্ধানী ইতিহাসবিদের কাছে হালে পানি পাবেন না । যাই হোক, এবারে দেখা যাক ইসমাইলের নিজের ইতিহাস জ্ঞানটা কদ্দূর । পৃষ্ঠা ১৩তে এক জায়গায় তিনি লিখছেন, “ যি সময়ত ইংরাজ বিরোধী নীল বিদ্রোহ বা সন্তান বিদ্রোহ সংঘটিত হৈছিল, প্রায় একে সময়তে বঙ্গত আরম্ভ হৈছিল ওহাবী আন্দোলন - - -” । মজা হলো, ইতিহাসে 'সন্তান বিদ্রোহ' বলে কোনো ঘটনাই নেই । ইসমাইল শব্দটি কোনো ইতিহাসের বই থেকে নেন নি । নিয়েছেন 'ইতিহাস না জানা' বঙ্কিমেরই উপন্যাস থেকে । ইতিহাসে আছে ফকীর বা সন্যাসী বিদ্রোহ । আর নীল বিদ্রোহ হয়েছিল সেই সন্যাসী বিদ্রোহের প্রায় এক শতাব্দী পরে , এগুলো 'বা' অব্যয় দিয়ে যুক্ত হবার মতো একই আন্দোলনের দুই নাম নয় । আর ওহাবী নামে কোনো বিদ্রোহ বাংলাতে হয়েছে বলে আমরা জানি না । হ্যাঁ , লোকে বলে বটে যে তিতুমীরের আন্দোলনে ওহাবীদের প্রভাব রয়েছে । সারা ভারতেই ঐ নামে কোনো আন্দোলন হয় নি। সৈয়দ আহমদ বেহরেলভীর নেতৃত্বে হওয়া 'তারিকা-এ-মুহম্মদিয়া' আন্দোলনকে ভুল করে অনেকে ওহাবী আন্দোলন বলে থাকেন । কিন্তু ইসমাইলের কলমে এ গুলো সব একই সময়ের ঘটা বাংলার ঘটনা !
ইসমাইলের সাহিত্য সমালোচনা দক্ষতা ঃ (১) পৃষ্ঠা ১৪তে তিনি লিখেছেন, “ 'আনন্দমঠ'র কাহিনী উপস্থাপনর ক্ষেত্রত বঙ্কিম চন্দ্রর দুর্বলতার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেও উপলব্ধি করিছিল । এই বিষয়ে 'ছিন্নপত্র'ত রবীন্দ্রনাথে উল্লেখ করিছিল, “বঙ্কিমবাবু ঊনবিংশ শতাব্দীর পোষ্যপুত্র আধুনিক বাঙালির কথা যেখানে বলেছেন সেখানে কৃতকার্য হয়েছেন ; কিন্তু যেখানে পুরাতন বাঙালির কথা বলতে গিয়েছেন সেখানে তাঁকে অনেক বানাতে হয়েছে ; চন্দ্রশেখর , প্রতাপ প্রভৃতি দেশীয় সকল জাতীয় লোকই হতে পারতেন, তাঁদের মধ্যে জাতি এবং দেশকালের বিশেষ চিহ্ন নেই, কিন্তু বাঙালি আঁকতে পারেন নি।” 'আনন্দমঠ' সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথর উপলব্ধিয়ে সঠিক নির্দ্দেশনা দিয়ে । কারণ, রবীন্দ্রনাথর দৃষ্টিত বঙ্গর জাতীয় জীবনত হিন্দু বা মুসলমান বুলি কোনো ভিন্ন জাতীয় সত্বা নাই ।”----এই টুকুন রবীন্দ্র উদ্ধৃতির মধ্যে 'আনন্দমঠ' প্রসঙ্গই কই আর কই বা 'হিন্দু-মুসলমান' প্রসঙ্গ !
(২) পৃষ্ঠা ১৫তে তিনি লিখছেন, '' সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগত প্রদর্শন বন্ধ করি দিয়া বঙ্কিমচন্দ্র রচিত নাটক ' রাজসিংহ'র সংলাপত পোয়া যায় ....'' । এই তথ্য তিনি কোথায় পেয়েছেন উল্লেখ করেন নি । আর বঙ্কিম 'রাজসিংহ' নামে এক নাটকও লিখেছিলেন ----এই সত্য ইসমাইল না পড়লে আমাদের সত্যি জানাই হতো না !! এরকমই তাঁর কলমের পাণ্ডিত্যের জোরে বঙ্কিমের 'কমলাকান্তের দপ্তর' হয়ে গেছে 'উপন্যাস' ( পৃষ্ঠা ১৮) !!!!
ইসমাইলের রবীন্দ্র জীবনী পাঠ পারিচয় ঃ সবচাইতে বড় রসিকতা তিনি করেছেন রবীন্দ্র জীবনী পাঠ করতে গিয়ে । কোত্থেকে এক পীর আলি খাঁ নামের এক ব্যক্তিকে আবিষ্কার করে পৃষ্ঠা ৪৯এর 'টোকা' অংশে লিখেছেন,''বঙ্গর যশোরত থাকোতে রবীন্দ্রনাথর এক পূর্বপুরুষে পীর আলি খাঁ নামর এক জমিদারর ঘরত গো-মাংস রন্ধার গোন্ধ শুঙি চোয়ার অপরাধত 'আধা মুছলমান' হৈ যায় । সেই কারণেই ঠাকুর পরিয়ালক 'পীরালি ব্রাহ্মণ'বুলি কৈছিল ।” গো-মাংসের গন্ধ শুঁকলে 'পিরালি' তথা পতিত বামুন হবার নজীর আছে বটে । কিন্তু 'পীর আলি খাঁ' সত্যি ইসমাইলের একক আবিষ্কার । তিনি এখানেও কোনো তথ্য সূত্র দেন নি । বোধহয় ধরে নিয়েছেন, তিনি বললেই আমাদের বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে ! আমরা যে টুকু জানি, রবীন্দ্রনাথের পারিবারে সে রকম কিছু হয় নি । তবে তাঁর এক পূর্বপুরুষ ( সম্ভবতঃ তাঁর নাম ছিল জগন্নাথ কুশারি) এক 'পিরালি' বামুনের মেয়েকে বিয়ে করার 'অপরাধ' করে পতিত হয়েছিলেন বটে ।
কিন্তু এহ বাহ্য ! পাঠক বিদগ্ধ পণ্ডিত (!) ইসমাইলের পাণ্ডিত্যের দৌড় দেখে কৌতুক বোধ করবেন এইখানে, ইসমাইল যেখানে লিখছেন (পৃষ্ঠা ৪৫) , “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়র হ'লেও তেঁওর ধর্মমত সম্পর্কে বিতর্কর অভাব নাছিল। এবার সাধারণ ব্রাহ্মণ সমাজর পরা রবীন্দ্রনাক সম্বর্ধণা জনোয়ার ব্যবস্থা করাত নিষ্ঠাবানরূপে পরিচিত গোড়া ব্রাহ্মণসকলে আপত্তি জনাই কৈছিল যে রবীন্দ্রনাথে যিহেতু নিজকে সম্পূর্ণ ব্রাহ্মণ বুলি স্বীকার নকরে, গতিকে তেওঁক সম্বর্ধনা জনাই লাভ নাই । তদুপরি তেওঁক 'পীরালি ব্রাহ্মণ' রূপে প্রত্যাখ্যান করারো চেষ্টা চলাইছিল । কিন্তু কেইজনমান তরুণ ব্রাহ্মণে এই কথাত রবীন্দ্রনাথর পক্ষত থিয় হয় আরু 'কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই' শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করি কয় যে রবিন্দ্রনাথক সম্বর্ধনা জনোয়াত গোড়া ব্রাহ্মণসকলে বাধার সৃষ্টি করিলে তেওঁলোক ব্রাহ্মসমাজর পরা আঁতরি আহিব । অবশেষত সাধারণ ব্রাহ্মণসকলে রবীন্দ্রনাথক সম্বর্ধনা জনায় . . . .।” ( এ তথ্য তিনি অমিতাভ চৌধুরীর গ্রন্থ 'ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ' গ্রন্থে পেয়েছেন বলে অধ্যায় শেষে উল্লেখ করেছেন!--পত্রলেখক)
ইসমাইল আরো লিখছেন, “ . . . ১৮৯৫-১৯০৫ খৃষ্টাব্দর এই দহোটা বছর রবীন্দ্রনাথে এক রক্ষণশীল পরিবেশত জীবন অতিবাহিত করিছিল । পশ্চিমবঙ্গর বোলপুরত ব্রাহ্ম-চর্যাশ্রম প্রাতিষ্ঠা করি তেওঁ ব্রাহ্ম-ধর্মমত প্রচারত মনোনিবেশ করিছিল। এই সময়ত রবীন্দ্রনাথর ওপরত স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা আরু ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়র প্রভাব গভীরভাবে পরিছিল ।
১৯০৫ খৃষ্টাব্দর পিছর সময়চোয়াত রবীন্দ্রনাথর ধর্মমতর বিবর্তন ঘটে । বিশেষকৈ 'গোড়া' ( 'গোরা' নয় !--পত্রলেখক ) উপন্যাস লিখার সময়র পরা রবীন্দ্রনাথে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গীরে ধর্ম-ব্যাখ্যা দাঙি ধরে আরু ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মসমাজর স্থূল গণ্ডীর পরা ওলাই আহিবলৈ সক্ষম হয় । রবীন্দ্রনাথে মনুষ্যত্ব স্খলিত ধর্মক ঘিন করি ধর্মতত্বর এক নতুন ব্যাখ্যা দাঙি ধরি কৈছিল-- 'মানুহ হিচাপে মানুহর যি মূল্য সেইখিনিকেই সহজ প্রীতির সৈতে স্বীকার করাটোয়েই হ'ল প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি।' রবীন্দ্রনাথক এনে ধরণে ভাবিবলৈ বাধ্য করাইছিল ব্রাহ্ম ধর্মর গোড়ামীয়ে । ব্রাহ্ম ধর্মর যি বৈদিক নীতি তার নিয়ন্ত্রণর সৈতে 'মনুস্মৃতি'র যথেষ্ট সম্পর্ক আছে । মনুস্মৃতিত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আরু শূদ্রর প্রভেদে মানুহ আরু জন্তুর মাজর প্রভেদকো চের পেলাই গৈছে । রবীন্দ্রনাথর চিন্তা-চর্চা মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ওপরত প্রতিষ্ঠিত আছিল বাবেই তেওঁ ব্রাহ্ম ধর্মর গোড়ামী আরু বর্ণ-বৈষম্যর বিরুদ্ধে সমালোচনাত্মক মনোভাব গ্রহণ করিছিল । তেওঁর মতে--' মানুষক ঘৃণা করা যি দেশর ধর্মর নিয়ম, প্রাতিবেশীর হাতত পানী খালে যিসকলর পরকাল নষ্ট হয়, পরক অপমান করি যিসকলে জাতি রক্ষা করিব লাগিব, পরর হাতত চিরদিন অপমান নোহোয়াকৈ যিসকলর গতি নাই, তেওঁলোকে যিসকলক ম্লেচ্ছ বুলি অবজ্ঞা করি আহিছে সেই ম্লেচ্ছর অবজ্ঞা তেওঁলোকে সহ্য করিবই লাগিব।'” এই যে 'মানুষকে ঘৃণা করা . . .থেকে. . . . সহ্য করিবই লাগিব।' ---এই অংশ পড়ে পাঠক সহজেই বুঝবেন ইসমাইল আসলে 'দুর্ভাগা দেশ' কবিতার দুর্বল গদ্য অনুবাদ করেছেন। কিন্তু কোথাও তার উল্লেখ নেই । এমন ভাবে উল্লেখ করেছেন যেন এই দুর্বল গদ্য রবীন্দ্রনাথেরই লেখা !
পাঠক বুঝে গেছেন নিশ্চয় যে যিনি রবীন্দ্রনাথের ধর্ম ও সমাজ চিন্তা নিয়ে রীতি মতো বই লিখতে চলেছেন সে ইসমাইলের উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতের ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন গুলো নিয়ে কোনো প্রাথমিক ধারণাই নেই !!! বোলপুরের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতার মতো মানুষের প্রেরণা রয়েছে---এমন তত্ব পড়তে পেলে আমরা হাসব না কাঁদব স্থির করা মুস্কিল হয়ে পড়ে । 'ব্রাহ্ম' আর 'ব্রাহ্মণ্য ধর্ম' যে এক নয় ---এ তাঁর বোধে প্রবেশ করেনি । সন্যাসী বিদ্রোহ আর নীল বিদ্রোহ যেমন এক কালের ঘটনা নয় , তেমনি 'বেদ' আর 'মনুস্মৃতি' যে সমকালীন ঘটনাই নয় এ নিয়েও তাঁর কোনো অধ্যয়ন নেই । তিনি যদি নিন্দার্থে বলা কথাগুলো 'ব্রাহ্মণ্য ধর্ম' এবং 'মনুস্মৃতি' নিয়ে বলে যেতেন তবে বোধহয় কারো বিশেষ কিছু বলবার থাকত না । কিন্তু মুস্কিল হলো তিনি 'ব্রাহ্ম' আর 'ব্রাহ্মণ্য' শব্দগুলোকে গুলিয়ে ফেলেছেন । সুতরাং এরপর যে তত্ব কথা তিনি দাঁড় করিয়েছেন এ তাঁর একেবারেই 'মৌলিক' আবিষ্কার । বাঙালি পাঠকতো দূরেই থাক, এমন অদ্ভূৎ তত্ব কথার ভেতরে যেতে হলে বিদগ্ধ অসমিয়া পাঠকদেরো বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে !!! কারণ অসমিয়াদের মধ্যে রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞের সংখ্যা বড় কম নয় ।
বাংলার পাঠকদের সামনে বহু গ্রন্থের প্রণেতা ইসমাইল হোসেনের বুদ্ধিচর্চার স্বরূপ তুলে ধরে কিছু কৌতুক করবার উদ্দেশ্য নিয়ে এই ছোট্ট চিঠি লিখলাম। আমাদের বিনম্র অনুরোধ থাকবে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক যেন বৌদ্ধিকতার সীমা অতিক্রম করে সাম্প্রদায়িক রূপ গ্রহণ না করে। কারণ, এমন বিতর্ক মুক্ত-মতবিনিময়ের পথ বন্ধ করে । তাতে অসমিয়া ও বাংলা --দুই ভাষা সাহিত্যই বদ্ধ জলায় আবদ্ধ হবার এবং এমন আবর্জনায় ভরে উঠবার বিপদ প্রশয় পেতে থাকবে এবং কেউ দেখেও না দেখার ভান করবে । এটা বাংলা ও অসমিয়া--কোনো ভাষা সাহিত্যের পক্ষেই কাম্য হতে পারে না । বিশেষ করে তাঁর এমন বিভ্রান্তিপূর্ণ রচনাতে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্য , এ কথা বোধহয় আমাদের দুই ভাষা সম্প্রদায়েরই লক্ষ্য রাখা উচিত ।
ইতি
সুশান্ত কর,
প্রভাষক,বাংলা বিভাগ,
তিনসুকিয়া মহাবিদ্যালয়,
তিনসুকিয়া---৭৮৬১২৫
অসম ।
ই-মেলঃ k_sushanta@yahoo.co.in
দূরভাষঃ ৯৯৫৪২২৬৯৬৬
|
No comments:
Post a Comment