গেল জুলাই মাসের শেষের দিকে এক শুক্রবার সকালে মার্ঘেরিটা কলেজের অধ্যাপক দেব বরার সঙ্গে তিনসুকিয়া থেকে আসাম ট্রাঙ্ক রোড ধরে মার্ঘেরিটা যাচ্ছিলাম। তাঁরই গাড়িতে করে । যারা এ পথে গেছেন তারা জানেন যে মাকুম পেরিয়ে অল্প এগুলে প্রায় সতের কিলোমিটার আর ডানে বাঁয়ে তাকাতে হয় না । লোকে বলেএটি বুঝি এশিয়ার ভেতরে সবচেয়ে দীর্ঘ সোজা পথ । হতেও পারে, নাও হতে পারে । আমাদের এই পোড়া দেশে সামান্য একটা সুযোগ পেলেই লোকে এমন গৌরব করে । কিন্তু পথটা যে দীর্ঘ এবং সচরাচর এমন চোখে পড়ে না, অসমেতো নয়ই --এ নিয়ে সন্দেহ করে লাভ নেই ।
গ্রীষ্মের সকাল, হাল্কা মেঘও ছিল । ভ্রমণ বেশ সুখেরই ছিল । আমাদের যদি কোনো অসুখের কারণ ছিল তবে সে স্বয়ং ভ্রমণের কারণটাই । মার্ঘেরিটা কলেজেরকিছু আভ্যন্তরীণ সংকট নিয়ে সাত সকালে গিয়ে সে কলেজের পরিচালন সামিতির সভাপতি শক্তি মন্ত্রী শ্রী প্রদ্যুত বরদলৈকে ধরতে হয় । ডুমডুমা থেকে এসেমাকুমে আমাদের জেলা শিক্ষক সংস্থার এক সহকর্মী যোগ দিয়েছেন । ডিগবয় থেকে যোগ দেবেন আরো একজন । তারপর চারজনে মিলে গিয়ে সভাপতিকে ধরব,এরকমই কথা । অতএব আমাদের কিছু উদ্বেগও ছিল, তাড়াও ছিল । গাড়ি খুব জোরে চলছিল । সকাল বেলার খালি পথ । তার উপর ঐ যে লিখলাম --দীর্ঘসোজা পথ । সুতরাং জোরে গাড়ি চালাবার কোন অসুবিধে ছিল না।
কিন্তু হঠাৎই গাড়িখানা জোর শব্দ করে কেঁপে উঠল । টাল সামাল দেয়া মুস্কিল হচ্ছিল । চোখ ফেলতেই দেখা গেলো মসৃণ পাকা পথের মাঝে মাঝেই বড় বড় গর্ত । যেন কেউ হঠাৎই মাঝখান থেকে টুকরো তুলে নিয়ে গেছে । তাকিয়ে দেখি সামনে যত দূর চোখ যায় এমন অজস্র গর্ত রয়েছে । অধ্যাপক বরাকে আমরা অন্য দুই যাত্রী বললাম বটে একটু দেখে পথ চলতে, কিন্তু আমি নিজে বেশ অবাক হলাম । কেননা, জেলার কলেজগুলোর কাজে এ পথে আমি আরো অনেক এসছি । বছরে চার পাঁচবার এ পথে আমাকে আসতেই হয় । এর আগে এত গর্ত এ পথে দেখিনি । গেল দশ বছরে এ পথে কোনো মেরামতির শ্রমিককে দেখিনি। দেখার প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় নি । গেল ক’মাসে এ অবনতি কী করে হল, আমার মাথাতে ঢুকলো না । দেব বরাও কোনো স্পষ্ট উত্তর দিতে পারলেন না । বললেন, “পুরণা হ’লতো । গাড়িওতো কম নচলে !”
তার ঠিক দু’দিন পরের রোববার সকালে আমি আবার শিলচরের বাড়ি যাবো বলে তিনসুকিয়া থেকে বাসে চেপেছি । বছর দেড়েক যাই নি । বাড়ি থেকে ছোট ভাইয়ের জরুরি তলব, একবার দিন দুইএর জন্যেও যেতে হবে । সাধারণতঃ আমি ট্রেনেই যাই । একা গেলেও , আর সপরিবারে গেলেতো কথাই নেই । কিন্তু মাস ক’য় আগে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় পাহাড় লাইনে উগ্রপন্থীর গুলিতে এক ট্রেন ড্রাইভার এবং কিছু নির্মাণ শ্রমিক মারা যাওয়াতে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে । এই খুলবে , ওই খুলবে করছে । কিন্তু ঠিক কবে খুলবে কেউ জানে না । ট্রেনে গুয়াহাটি অব্দিও যাওয়া যেত, কিন্তু সে রয়েছে বিকেলে । রোববারটার সদ্ব্যবহার করতে না পারলে সামান্য ছুটিতে কুলোবে না । সুতরাং বাসে যাওয়াই ঠিক হলো । একা পুরুষ মানুষ, অসুবিধে হবার কথা নয় ।
কিন্তু গ্রীষ্মের দিনের বাসে গুয়াহাটি যাত্রার আগের এক এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে । মনে হয় বুঝি বা আগুনের চুল্লিতে বসে যাচ্ছি । তাই জীবনে প্রথমবার ঠিক করলাম, নাক চোখ বন্ধ ‘ভলবো’ বাসেই গুয়াহাটি অব্দি যাবো । অন্ততঃ আগুন থেকে গা’টা বাঁচানো যাবে । বাকি পথটা রাতে পার করব , তাই যা হোক একটা কিছু পেলেও চলবে । শুনেছিলাম ‘ভলবো’ খুব জোরে চলে এবং ভালো চলে । অতএব তাড়াতাড়ি গুয়াহাটি পৌঁছে শিলচরের পথে ভাল গাড়িতে ভাল আসন পাওয়া যাবে এই আশাতে একেবারে পেছনের সিটে বসেই গুয়াহাটি যাত্রা করা গেল । সাড়ে আটটার গাড়ি সাড়ে ন’টায় ছাড়ল । তবুও যেহেতু এ গাড়ি জোরে চলে বলে শুনেছি সুতরাং এই আশাতে বুক বাঁধলাম যে নিশ্চয় সন্ধ্যের আগে গিয়ে পৌঁছুবে । কিন্তু বাবুর যত বড় নাম তত বড় চাল । এক আধটু গিয়েই নানা বাহানা ধরে থেমে যেতে শুরু করল । কাজিরঙা পার কারে নগাঁওতে ঢুকে বেশ ভালই বাহানা পাওয়া গেল । জাতীয় মহাসড়কের কাজ হচ্ছে । তাই রাস্তা ভাঙা এবং এবড়ো থেবড়ো । গাড়ি তখন সত্যি কাজিরাঙার হাতির চালে চলতে শুরু করল । গরম কালের সন্ধ্যে হয়ে এলো, গাড়ি তখনো নগাঁও ছাড়েনি । শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতরেও আমার তখন ভ্যাপসা এক গরমে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা । গেল দশ বছরে সাধারণ বাসে করে এর থেকে শতগুণ ভাল যাত্রা কারে বহুবার এপথে যাতায়াত করেছি । পথের কাজের ধরণ দেখে কেবল এই সুখে সব সহ্য করে গেলাম যে এই পথ তৈরি হয়ে গেলে শিলচর অব্দি যাবে , তখন বেশ প্রাণের সুখে পায়ের উপর পা তুলে ‘বাপের বাড়ি’ যাওয়া যাবে ( ছেলেরা বুঝি বাপের বাড়ি যায় না ? ওসব সেকেলে কথা । ক্লিসে কথা । একুশ শতকের ছেলেরা কেউ বাপের বাড়িতে বাস করতে পায় না ) ।
রাত আটটাতে যখন গুয়াহাটি পৌছুনো গেল , তখন শিলচরের একটাও ভালো-মন্দ কোনো গাড়ি নেই । করিমগঞ্জ হাইলাকান্দিরো নেই । একটা, কোনো ভাগ্যের বলে, আগরতলা যাবার গাড়ি আছে । তার শেষ কোণে একটা আসন খালি আছে । যারা এমন অবস্থাতে পড়েন তারা জানেন যে তখন আর খবর নিয়ে দেখার মন মানসিকতা থাকে না। খবর নিলে হয়তো দেখা যেত অন্য কোথাও আরো ভালো গাড়ির ভাল আসনও রয়েছে , কিন্তু না থাকলে এও যেতে পারে হাতের থেকে । অগত্যা . . . .
ভাগ্যিস, এর চাল ভাল ছিলো । আগরতলা যাবার তাড়াতেই বোধহয় সে ভোর রাতেই কাছাড় সীমান্তে ঢুকে গেল । পেছনের আসনে বসেও সুখস্বপ্নে আমার তেমন কোনো ব্যঘ্যাত ঘটেছিল বলে মনে পড়ে না । কাছাড় সীমান্ত জোর ধাক্কা দিয়ে সে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল । রাতাছড়ার পাহাড় থেকে নেমেই ভাঙা রাস্তা, ভাঙা সেতু । মেরামতির কাজ চলছে । কালাইন পার করেও একই দশা । আর আগরতলার গাড়ি বদরপুর ঘাটের যে জায়গাটাতে আমাকে নামিয়ে দিল , সেতো নরক কুণ্ড । ধানের মাঠও এর থেকে মসৃণ থাকে । কপালে পেছনের আসন এবারেও লেখা ছিল। একটা জীপ গাড়ি পাওয়া গেল, তাতে। কোনো এক বিখ্যাত ময়রার দোকানের ( নামোল্লেখ করে বেচারাকে নাহয় বিপদে নাই ফললাম, গরীব মানুষ ) মিষ্টি নিয়ে আসছিল । সামনে আরো যাত্রী ছিল, আমাকে পেছনে ঠেসে দিল ।
একের পর এক ভাঙা বাঁক আর ভাঙা সেতু । মায়, ঐ সেদিন গড়ে তোলা বহু অপেক্ষা আর স্বপ্নের কাঠাখালের বাইপাস অব্দি কুড়িতে ( থুড়ি, বছরে ) বুড়ি হয়ে ভাঙা দাঁতগুলো বের করে মুখ ভেঙাচ্ছিল । শিলচর অব্দি পুরো পথের প্রায় সর্বত্র মেরামতির কাজ চলছে । সেই সত্তরের দশকের শুরুর সময় ছেলে বেলা থেকে দেখে আসছি, কাজ চলছে । এই আশাতে দিন গুণেছি যে একদিন এ কাজ শেষ হবে আর আমাদের যাত্রা সুখের হবে। বন্ধ হবে হাড়-মাস এক করা দুলুনি আর ধুলো-কাঁদার অত্যাচার । সে দিনটি আজ জীবনের অর্ধেকটা পার করে এসেও এসে পৌঁছোয় নি । একটা সেতু ঠিক হয়তো পাঁচ বছর আগের সেতু মেরামত বা পুণর্নির্মান করবার সময় এসেই পড়ে । এক বুক হতাশা নিয়ে শিলচর পৌঁছে ভাবলাম, যাক ! শেষ অব্দি বাঁচা গেল । ওমা ! একী ! এ যে চেনাই যায় না! হাড় কঙ্কাল বেরিয়ে গেছে বললেও যে কম বলা হয় ! রাঙিরখাড়ি অব্দি যে পথের উপর দিয়ে আমার রিক্সা এগিয়ে গেল, আমার রিক্সাচালাকের প্রতি দয়াই হলো । এই নরকের উপর দিয়ে রিক্সা চালাবার আগের জন্মের (?) পাপের শাস্তি ভোগ করেই তাকে পেটের ভাত জোগাড় করতে হয় । চিত্তরঞ্জন এ্যাভিন্যুর রামকৃষ্ণ সরণির সামনে গিয়ে সে যখন আমাকে নামিয়ে দিল যে ক’টা খুচরো টাকা ছিল তার হাতে দিয়ে পাপ স্খলন করা গেল । সে টাকা ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল । বললাম , রেখে দাও । তোমার বেশ কষ্ট হয়েছে । সে বোধহয় একে আমার বাড়ি ফেরার আনন্দের বকশিশ হেসেবেই নিয়ে নিল ।
তিনসুকিয়া থেকে ডিগবয়ের পথে গেল দশ বছরে যদি বা কখনো নির্মাণ শ্রমিকেরা কাজ করেছে তবে তার পরিমাণ এতো কম যে আমার কখনো চোখে পড়ে নি । যদিও তিনসুকিয়া শহরে চোখে পড়েছে অনেকবার । এ টি রোড বাদ দিলে এই শহরের পথঘাট এতো জঘন্য এবং নোংরা যে শিলচর শহর নিয়ে আমার এক আলাদা গৌরবের জায়গা তৈরি হয়েছিল গেল দশ বছরে । বস্তুত শিলচরের বহু মানুষ যারা গুয়াহাটির বাইরে অসমের আর অন্য শহর তেমন দেখেন নি তারা জানেনই না যে প্রাকৃতিক বিচারে এ শহর অসমের সুন্দর দু’তিনটি শহরের একটি । চামড়াগোদাম, ফাটক বাজার বাদ দিলে শিলচরের পথঘাটও কি সত্যি এতো বিচ্ছিরি ছিল ? আমার মনে পড়ে না । কিন্তু জাতীয় সড়কের অগুণতি সেতুগুলোর কথা আগেই লিখেছি, এদের পুনর্নির্মাণ আর মেরামতি দেখতে দেখতে আমার প্রজন্মের বার্ধক্যের দুয়ারে এসে হানা দেয়া । প্রায়ই ভেবেছি কেন্দ্র-রাজ্যের সরকারের বৈষম্য যদ্দিন চলবে এ দুর্দশার থেকে মুক্তি নেই । কিন্তু এবারই প্রথম, বোধহয় দিন দুই আগে তিনসুকিয়া- মার্ঘেরিটা পথের ঐ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে বলেই , আমার মনে দেখা দিল এক প্রশ্ন , সত্যিই কি সে রকম কোনো বৈষম্য রয়েছে ? তাহলে এতো মেরামতি আর পুনর্নির্মাণের টাকাগুলো আসে কোত্থেকে ? দেয় কারা ? বছরের পর বছর ধরে এতগুলো টাকার অপচয় যারা ভালোবাসে তারা কারা ? এ আমাদের নিজেদের কেউ নয় তো ? যিনি আমাদের ভালোবাসার এ উপত্যকার অসাংবিধানিক মুখ্যমন্ত্রীর আসন দখলে রেখেছেন , যিনি ভারি শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী হলেও এ উপত্যকাতে একটা মাছের পুকুর খোঁড়া হলেও নিজে দিল্লী থেকে এনেছেন বলে ঘটা করে ঘোষণা করেন এ তারই কোনো কারসাজি নয়তো ? এতো বৈষম্যের রাজত্বেও কেন্দ্রের সরকারে তার মত ক্ষমতাশালী মন্ত্রী অসম থেকে আর একজনকেও দেখা যায় না কেন এও কোনো গোপন বোঝাপড়ার পরিণাম নয়তো ?
অন্ততঃ , ব্রডগেজের কাজে যে উপত্যকার মাড়োয়াড়ি পরিবহণ ব্যবসায়ী চক্রটি কোটি কোটি টাকা ঢেলে বাগড়া দিয়ে আসছে সেতো উপত্যকার ঐ সেদিন জন্ম নেয়া শিশুটিও জেনে গেছে । তার পরেও আমরা ওদের সায়েস্তা না করে দিসপুরের বঞ্চনার গান গেয়ে আমাদের উপত্যকার‘অসাংবিধানিক’ মুখ্যমন্ত্রীর শাসনকাল দীর্ঘায়িত করে যাচ্ছি কেন ? তিনিই কৃপা করবেন, আমাদের মুক্তি দেবেন এই আশাতে বুক বেঁধে রেখেছি কেন ? আমি জানি না । আমি বুঝি না । যেমন বুঝি না এ উপত্যকার ইতিহাসকে । এ উপত্যকার জন্মেই বুঝি অসমিয়া জাতিবিদ্বেষের বিষ লেগেছে । সিলেটের অর্ধেকটা ওপারে ঠেলে দিয়ে অসমিয়া জাতীয়তাবাদ বাঙালিদের কোমর ভেঙে রেখেছে । আমার মনে প্রায়ই এ জিজ্ঞাসা কাজ করে , যে তোমাদের কে সেধেছিল রে বাবা অসমে এসে ঢুকতে । পারলে না, পুরোটাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে ? ফাঁকি , মস্ত ফাঁকি । এ উপত্যকার সর্বত্র ঃ এর ইতিহাসে, রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মে এবং দর্শণে ।
দিন তিনেক পর আমি যেদিন আবারো তিনসুকিয়া ফেরার দুঃসহ অভিযানের পরিকল্পনা করছি তার আগের দিন, ভাগ্যিস, জানা গেল যে পরদিন সকালে ট্রেন চলতে শুরু করবে । সকাল বেলার প্রথম ট্রেন বদরপুর থেকে ছাড়বে । এক বুক অবিশ্বাস নিয়ে বাসে চেপে সক্কাল বেলা বদরপুর ষ্টেশনে এসে দেখা গেলো সত্যি একটা ট্রেন ছাড়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে । এ ট্রেন হাফলং অব্দি যাবে । ওদিকে লামডিং থেকে যে ট্রেন আসবে, হাফলঙে আবার তাতে চড়ে লামডিং গিয়ে পৌঁছুতে হবে । দেখা গেলো , আমার মতো অবিশ্বাসীর সংখ্যা নেহাত কম নয় । সেদিন যাত্রী খুবই কম ছিল । তাতে বেশ শুয়ে বসেই যাত্রা করা গেল । জাটিঙ্গা অব্দি গিয়ে জানা গেল হাফলঙে গাড়ি পাল্টাবার ল্যাঠাও আর নেই, এ গাড়িই সোজা লামডিং যাবে। সুতরাং হাফলং ষ্টেশনের ভাতগুলোও বেশ ভালই হজম হলো । বালি কিম্বা মাটি যাই মেশানো থাক, মনে হলো অমৃত !
রাত দশটা নাগাদ যখন লামডিং পৌঁছুলো গাড়ি , ওদিককার কামরূপ এক্সপ্রেস আসতে তখনো আধঘণ্টাখানিক বাকি । বেশ আয়েস করে হাতমুখ ধুয়ে খাবার দাবার সেরে যখন গাড়ির জন্যে দাঁড়াতে গেছি শুনি ঘোষণা হচ্ছে , কামরূপ আসতে ঘণ্টাখানিক দেরি হবে । এ আর এমন কি কথা ? শিলচরের কিছু সাহিত্যের কাগজ কিনে নিয়ে এসছিলাম। তাই পড়ে দিব্যি এক ঘণ্টা পার করে দিলাম । গাড়ি আসার তখনো কোনো সাড়াটি নেই । গিয়ে অনুসন্ধানের কক্ষে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল আরো ঘণ্টা খানিক সময় নেবে । এই করে বসে বসে আর তন্দ্রাতে ঢুলে ঢুলে সারা রাত পেরিয়ে গেল । গাড়ি এলো না । এলো আক্ষরিক অর্থে সাত সকালে । এমনটা এ পথে সচরাচর হয় না । রাজ্যের ভেতরে সবচাইতে ভালো বাস পথ থাকা সত্বেও আমি গুয়াহাটি গেলে ট্রেনেই যাতায়াত করি , সুতরাং জানি যে সেদিনের কামরূপের এই অস্বাভাবিক বিলম্ব যাত্রাটা ব্যতিক্রম, নিয়ম নয় । সুতরাং তেমন আর ক্ষোভ পোষে রাখলাম না । জানি বিকেলের আগে বাড়ি পৌঁছে যাবো । তাই গেলাম । রোদ ঢাকা পড়েছিল মেঘে , তাই ট্রেনেই বেশ ভালো ঘুমও দিলাম ।
প্রায় বছর দেড় পর বাড়ি গেছিলাম একা । তাই কথা দিয়ে এসছিলাম , ডিসেম্বরের শেষে যখন মেয়ের পরীক্ষা শেষ হবে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে আবার বাড়ি যাব । মাস খানিকের জন্যে রেখে আসব । মেয়ের আমার গ্রীষ্মের ছুটিতে মামার বাড়ি যাওয়াও হয় না, আম কাঠালের স্বাদ নেয়াও হয়ে উঠেনা । ওকে স্বপ্ন দেখালাম শীতের জাটিঙার কমলা খাওয়াব । যিশু খৃষ্টের সঙ্গে একই দিনে জন্মেছে সে , সমস্ত বন্ধুদের জানিয়ে রেখেছে ( মনের দুঃখে কিনা , জানি না ) এবারের জন্মদিনে সে তাদের নিমন্ত্রণ করতে পারছে না । এবারে সে বাড়ি যাবে । বরং এবারে সে ছ’মাস আগে থেকেই ওর সমস্ত তুতো ভাইবোনদের ফোনে নিমন্ত্রণ করে রেখেছে এবারে সে বাড়ি আসছে । সবাই যেন ওর জন্মদিনে আসতে ভুল না করে বসে । এক আধটু হিসেব করতেও শিখেছে । ওর বাবাকে বলে রেখেছে , এবারেতো আর তুমি আমার জন্মদিন করতে যাচ্ছো না । করবে ঠাম্মা । তোমার তাই খরচ কম হবে । এবারে তাই উপহারটা দিতে হবে বেশ বড় দেখে ।
আমি যখন দিন গুনছি কবে আমার বাড়ি যাবার পথ ভাল হবে আমার ছোট্ট মেয়েটি তখন দিন গুনছে কবে তার সপ্তম জন্মদিনটি কাছে আসবে । কিন্তু বাতাসে তখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর ঢিবি ঢিবি পায়ের শব্দ শোনা যেতে শুরু করল । তাকে বরণ করা শুরু হলো বাংলাদেশি তাড়াবার নাম করে নিম্ন অসমের নির্মাণ শ্রমিকদের লাঠিপেটা আর জুতোর মালা পরিয়ে । তারপর দরং-ওদাগুড়িতে সত্যি মানুষ মরল, ঘর পুড়ল , ধর্ষিতা হলো । ত্রিশ অক্টোবর ইতিহাসের সবচে বড় বোমাতে কাঁপালো রাজ্য । তার রেশ না ফুরোতেই মুম্বাই ।
বাড়ি আসার সব স্বপ্ন কেমন যেন আবছা হয়ে যেতে শুরু করল বারুদের ধোঁয়ায় । তবু আশা ছিল, মানুষ বাঁচা ছেড়ে দিলেতো আর সন্ত্রাস হেরে যাবে না । আমার বাড়ি যাওয়া নিশ্চয় এর জন্যে আটকাবে না । কিন্তু ডিসেম্বর আসতেই ২ তারিখে ডিফুতে ট্রেনে বোমা ফুটল । ৬ তারিখে আবারো ফুটলো এক মাছের বাজারে । এখানে ওখানে প্রায় রোজই বোমা উদ্ধার করল পুলিশ । দু’এক জন হিন্দিভাষীকে গুলি করেও মারল উগ্রপন্থীরা । লামডিং-শিলচর পথে রাতের ট্রেন বাতিল করে দেয় কর্তৃপক্ষ। নতুন বছরেরে উৎসবে মেতে উঠে ব্যক্তিগত পরিবহন মহলের অন্দরমহল ।
মুম্বাইর বোমা কাণ্ডে তাজ-ওবেরয়ে যারা মারা গেছেন বা বিপন্ন হয়েছেন তারা তখনো এতো প্রবল প্রতাপে আর ক্ষমতাতে টিভির পর্দা, খবরের কাগাজের পৃষ্ঠা দখল করে রেখেছেন যে ছত্রপতি শিবাজী স্টেশনে মারা যাওয়া গরীব-গুরোবদের খবরই কেউ নেয় নি , কেউ জানায় নি । আর আমরাতো অসমের মতো এক ফেলনা রাজ্যের ফেলনা মানুষ । আমরা না খবর হই, না খবর তৈরি করি । আমরা দেবতুল্য সন্তোষ কিম্বা সমুজ্জ্বলের মতো ‘অসাংবিধানিক মুখ্যমন্ত্রী’দের অনুগ্রহের কৃপাতে পথ চেয়ে রই । তাতে তাদেরও রাজত্ব নিরাপদ থাকে ; নিরাপদ থাকে সাংবিধানিক সরকার প্রধানদের সাম্রাজ্য। মসৃণ হয় তাদের পথ চলা । কেবল অবরুদ্ধ হয় আমাদের মতো ‘আমআদমির’ পথ ।
১৫ ডিসেম্বর, ০৮ আমার মেয়ের স্কুলের ছুটি হওয়া অব্দি অপেক্ষা করি। তার পর সে রাতেই বাড়িতে ফোন করি । বৃদ্ধ আর অসুস্থ বাবা ফোন তুলেন । তাঁকে বলি, আমাকে বলতেই হয়, ‘বাবা, আমি এবারো বাড়ি আসছি না !!!’ কারণটা তাঁকে বলতে হয় না, তিনি তার আগেই কণ্ঠ ম্লান করে বলেন, ‘হ্যাঁ, এখন না আসাটাই ভালো হবে; ভালো থাকিস।’ যদিও তিনিও জানেন, ভালোই জানেন, আমরা ভালো নেই । এভাবে ভালো থাকে না কেউ!!
লেখা শেষ ঃ ১২-০১-২০০৯,সোমবার, বেলা ১০টা । পাঠাবো দৈনিক জনকণ্ঠে ( শিলচর)
No comments:
Post a Comment