সন্ধ্যা যখন
মূল অসমীয়াঃ অতনু ভট্টাচার্য
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর
(মূল গল্পটি ‘সন্ধ্যা যেতিয়া’ নামে ‘প্রান্তিক’ ১৬ অক্টোবর, ২০০৮ সংখ্যাতে প্রকাশিত।)
এক ০
কলিং বেল বাজতেই গোপাল দাসের দুপুরের চিলমিল তন্দ্রা হঠাৎই ভেঙে গেল ।
ঢিলে ফিতেটা টেনেটুনে তিনি পরনের পায়জামাটা এডজাস্ট করলেন । পা দু’খানা কোনোক্রমে সেন্ডেলজোড়াতে আধখানা ঢুকিয়ে মুখে একরাশ বিরক্তি দরজাটা খুলতে উঠে গেলেন ।
বারান্দাতে সেলসম্যানের মতো দেখতে এক সুবেশা যুবক অপেক্ষা করছে। যুবকটি এক মিচকি হাসিতে গোপাল দাসকে অভিবাদন জানাল এবং বেশ অমায়িকভাবে জিজ্ঞেস করল ---
মুখোশ দেখবেন কি?
মুখোশ ?—এক ধরনের বিষ্ময় আর অবিশ্বাসের ভাব নিয়ে গোপাল দাসের ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে পড়ল । কপালে ক’টি অবাঞ্ছিত রেখার আবির্ভাব হলো । নিশ্চিত হবার জন্যে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন---
ইউ মিন মাস্ক ?
হ্যাঁ ।--- যুবকটি নম্রতার সঙ্গে জবাব দিল । ইতিমধ্যে কাঁধের থেকে নামিয়ে রাখা চামড়ার ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলল---
নতুন আইটেম। আর স্যর , মার্কেট ধরবার জন্যে কোম্পানি অফার দিচ্ছে রিজনেবল প্রাইস্ ।
এর আগেও অনেকবার সেলস্ অথবা মার্কেটিঙের পাঠ্যক্রমের ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো এসাইনমেন্টের দায়ে গোপাল দাসের বারান্দাতে পদার্পণ করেছে , আগেও কখনোবা ফেরিওয়ালার ভূমিকাতে ম্যানেজমেন্টের ছাত্র এসে তাঁর ঘরের কলিং বেলে টিপ দিয়েছে । কিন্তু সে সময় গুলোতে তাদের হাতে ছিল কোনো নতুন তথ্যকোষ অথবা নতুন শব্দসম্ভারে পরিপূর্ণ কোনো সচিত্র অভিধান । অবশ্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার অথবা আকুপ্রেসার জাতীয় যন্ত্রও তাঁর বাড়িতে এসে ঘরে ঢুকে তাদের কার্যকুশলতা প্রমাণ করে রেখে গেছে । কিন্তু মুখোশ ?
গোপাল দাসের কৌতুহল হলো । আধখোলা চামড়ার ব্যাগটার ভেতরের আঁধারের দিকে তাকিয়ে তিনি পরম ঔৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন----
কিসের মুখোশ ?
দাঁড়ান, আমি দেখাচ্ছি ।---ছেলেটি বলল । ব্যাগটির ভেতর থেকে সে নানা রঙের বিচিত্র সব মুখোশ বের করতে শুরু করল । বেশ একটা বিষ্ময় আর আগ্রহে গোপাল দাস দেখে গেলেন কার্ল মার্ক্স, শচীন তেণ্ডুলকার, মহাত্মা গান্ধী, মাদার টেরেসা, শাহরুখ খান, তসলিমা নাসারিন ইত্যাদি জীবিত বা মৃত নানান ব্যক্তির নানা রকমের মুখোশ ।
চার্লি চ্যাপলিনও ছিল । --- যুবকটি যেন আক্ষেপের সুরে বলল---কিন্তু আধঘণ্টাখানিক আগে লাস্ট পিসটাও বিক্রি হয়ে গেল ।
নতুন কনসেপ্ট ।---গোপাল দাস নির্মোহভাবে প্রশংসা করলেন; জিজ্ঞেস করলেন---
কিন্তু এগুলো কেনে কারা? মানে আমি জানতে চাইছি, যে লোকেরা এগুলো কেনে তারা কেনেটা কেন ?
দেখা গেল, ছেলেটি বেশ উৎসাহিত হলো, বলল---
নানা কারণে কেনে---কেউ কেউ শো’পিস হিসেবে সাজিয়ে রাখবে বলে কেনে। কেউ বা, এই ধরুন, সাম্ সর্ট অব্ ফান …। ক্রিকেট ফেনরা তেণ্ডুলকার কিনছে, ধোনি কিনছে, এমন কি দু’চারজন ভগবানের মুখোশও ।
গোপাল দাস দু’একটা মুখোশ হাতে ছুঁয়ে পরীক্ষা করলেন , কী পদার্থে তৈরি তা শনাক্ত করবার জন্যে নাকের খুব কাছে নিয়ে একবার শুঁকেও দেখলেন । বোঝা গেল যে তিনি বেশ উৎসাহিত হয়েছেন। কিন্তু সে ভাবটি জোর করে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে অভিজ্ঞ এক গ্রাহকের ভংগীতে জিজ্ঞেস করলেন—
দাম কত ?
কোনটার?--ছেলেটি জিজ্ঞেস করল। সামান্য সময় নিয়ে একজন সুদক্ষ ফেরেওয়ালার সুরে বলল--
দামের জন্যে আপনি ভাববেন না, স্যর ! বেশি করে নিলে কোম্পানি দিচ্ছে স্পেসাল ওফার. . .।
ছেলেটির কথা আধখানা রইল, কেনোনা মাঝখানেই গোপাল দাস জিজ্ঞেস করলেন---
পরে দেখতে পারি ?
নিশ্চয় পারেন ।--এমন এক ভাব ভংগীতে ছেলেটি জবাব দিল--আপনি নিশ্চয়ই একটা ট্রাই করে দেখতে পারেন, স্যর ।
গোপাল দাস মহাত্মা গান্ধীর মুখোশ একটা খানিকটা লজ্জার সঙ্গে তুলে নিলেন । ছেলেটির সামনে সেটি পরতে লজ্জা হলো। ছেলেটিকে সামান্য দাঁড়াতে বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। বাথরুমের বেশিনের উপরের হাফ সাইজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সবিষ্ময়ে তিনি দেখেন যে আয়নার পেছনে যে প্রতিবিম্বটি দেখা দিয়েছে সেটি তাঁর নয় । যেন কালের বুকের থেকে উঠে আসা এক অশীতিপর, বৃদ্ধ মহাত্মার প্রতিবিম্ব আয়নার ওপার থকে কোনো এক রহস্যময় স্থানের থেকে বড় করুণ ভাবে উঁকি দিতে চাইছে । বড় অসহায়ভাবে যেন তিনি বলতে চাইছেন---
কোথাও এক ভুল হয়ে গেছিল আমার ।
মূল অসমীয়াঃ অতনু ভট্টাচার্য
বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর
(মূল গল্পটি ‘সন্ধ্যা যেতিয়া’ নামে ‘প্রান্তিক’ ১৬ অক্টোবর, ২০০৮ সংখ্যাতে প্রকাশিত।)
এক ০
কলিং বেল বাজতেই গোপাল দাসের দুপুরের চিলমিল তন্দ্রা হঠাৎই ভেঙে গেল ।
ঢিলে ফিতেটা টেনেটুনে তিনি পরনের পায়জামাটা এডজাস্ট করলেন । পা দু’খানা কোনোক্রমে সেন্ডেলজোড়াতে আধখানা ঢুকিয়ে মুখে একরাশ বিরক্তি দরজাটা খুলতে উঠে গেলেন ।
বারান্দাতে সেলসম্যানের মতো দেখতে এক সুবেশা যুবক অপেক্ষা করছে। যুবকটি এক মিচকি হাসিতে গোপাল দাসকে অভিবাদন জানাল এবং বেশ অমায়িকভাবে জিজ্ঞেস করল ---
মুখোশ দেখবেন কি?
মুখোশ ?—এক ধরনের বিষ্ময় আর অবিশ্বাসের ভাব নিয়ে গোপাল দাসের ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে পড়ল । কপালে ক’টি অবাঞ্ছিত রেখার আবির্ভাব হলো । নিশ্চিত হবার জন্যে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন---
ইউ মিন মাস্ক ?
হ্যাঁ ।--- যুবকটি নম্রতার সঙ্গে জবাব দিল । ইতিমধ্যে কাঁধের থেকে নামিয়ে রাখা চামড়ার ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলল---
নতুন আইটেম। আর স্যর , মার্কেট ধরবার জন্যে কোম্পানি অফার দিচ্ছে রিজনেবল প্রাইস্ ।
এর আগেও অনেকবার সেলস্ অথবা মার্কেটিঙের পাঠ্যক্রমের ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো এসাইনমেন্টের দায়ে গোপাল দাসের বারান্দাতে পদার্পণ করেছে , আগেও কখনোবা ফেরিওয়ালার ভূমিকাতে ম্যানেজমেন্টের ছাত্র এসে তাঁর ঘরের কলিং বেলে টিপ দিয়েছে । কিন্তু সে সময় গুলোতে তাদের হাতে ছিল কোনো নতুন তথ্যকোষ অথবা নতুন শব্দসম্ভারে পরিপূর্ণ কোনো সচিত্র অভিধান । অবশ্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার অথবা আকুপ্রেসার জাতীয় যন্ত্রও তাঁর বাড়িতে এসে ঘরে ঢুকে তাদের কার্যকুশলতা প্রমাণ করে রেখে গেছে । কিন্তু মুখোশ ?
গোপাল দাসের কৌতুহল হলো । আধখোলা চামড়ার ব্যাগটার ভেতরের আঁধারের দিকে তাকিয়ে তিনি পরম ঔৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন----
কিসের মুখোশ ?
দাঁড়ান, আমি দেখাচ্ছি ।---ছেলেটি বলল । ব্যাগটির ভেতর থেকে সে নানা রঙের বিচিত্র সব মুখোশ বের করতে শুরু করল । বেশ একটা বিষ্ময় আর আগ্রহে গোপাল দাস দেখে গেলেন কার্ল মার্ক্স, শচীন তেণ্ডুলকার, মহাত্মা গান্ধী, মাদার টেরেসা, শাহরুখ খান, তসলিমা নাসারিন ইত্যাদি জীবিত বা মৃত নানান ব্যক্তির নানা রকমের মুখোশ ।
চার্লি চ্যাপলিনও ছিল । --- যুবকটি যেন আক্ষেপের সুরে বলল---কিন্তু আধঘণ্টাখানিক আগে লাস্ট পিসটাও বিক্রি হয়ে গেল ।
নতুন কনসেপ্ট ।---গোপাল দাস নির্মোহভাবে প্রশংসা করলেন; জিজ্ঞেস করলেন---
কিন্তু এগুলো কেনে কারা? মানে আমি জানতে চাইছি, যে লোকেরা এগুলো কেনে তারা কেনেটা কেন ?
দেখা গেল, ছেলেটি বেশ উৎসাহিত হলো, বলল---
নানা কারণে কেনে---কেউ কেউ শো’পিস হিসেবে সাজিয়ে রাখবে বলে কেনে। কেউ বা, এই ধরুন, সাম্ সর্ট অব্ ফান …। ক্রিকেট ফেনরা তেণ্ডুলকার কিনছে, ধোনি কিনছে, এমন কি দু’চারজন ভগবানের মুখোশও ।
গোপাল দাস দু’একটা মুখোশ হাতে ছুঁয়ে পরীক্ষা করলেন , কী পদার্থে তৈরি তা শনাক্ত করবার জন্যে নাকের খুব কাছে নিয়ে একবার শুঁকেও দেখলেন । বোঝা গেল যে তিনি বেশ উৎসাহিত হয়েছেন। কিন্তু সে ভাবটি জোর করে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে অভিজ্ঞ এক গ্রাহকের ভংগীতে জিজ্ঞেস করলেন—
দাম কত ?
কোনটার?--ছেলেটি জিজ্ঞেস করল। সামান্য সময় নিয়ে একজন সুদক্ষ ফেরেওয়ালার সুরে বলল--
দামের জন্যে আপনি ভাববেন না, স্যর ! বেশি করে নিলে কোম্পানি দিচ্ছে স্পেসাল ওফার. . .।
ছেলেটির কথা আধখানা রইল, কেনোনা মাঝখানেই গোপাল দাস জিজ্ঞেস করলেন---
পরে দেখতে পারি ?
নিশ্চয় পারেন ।--এমন এক ভাব ভংগীতে ছেলেটি জবাব দিল--আপনি নিশ্চয়ই একটা ট্রাই করে দেখতে পারেন, স্যর ।
গোপাল দাস মহাত্মা গান্ধীর মুখোশ একটা খানিকটা লজ্জার সঙ্গে তুলে নিলেন । ছেলেটির সামনে সেটি পরতে লজ্জা হলো। ছেলেটিকে সামান্য দাঁড়াতে বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। বাথরুমের বেশিনের উপরের হাফ সাইজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সবিষ্ময়ে তিনি দেখেন যে আয়নার পেছনে যে প্রতিবিম্বটি দেখা দিয়েছে সেটি তাঁর নয় । যেন কালের বুকের থেকে উঠে আসা এক অশীতিপর, বৃদ্ধ মহাত্মার প্রতিবিম্ব আয়নার ওপার থকে কোনো এক রহস্যময় স্থানের থেকে বড় করুণ ভাবে উঁকি দিতে চাইছে । বড় অসহায়ভাবে যেন তিনি বলতে চাইছেন---
কোথাও এক ভুল হয়ে গেছিল আমার ।
মুগ্ধ নয়নে গোপাল দাস সেই প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর চোখের সামনে সবরমতি আশ্রম এলো, ডাণ্ডি যাত্রার ছবিটি এলো, জিন্না এলেন, চৌরিচৌরা এলো। পলকের জন্যে তাঁকে ব্যথিত হতেও দেখা গেল। অবশ্য দক্ষ এক রাজনীতিজ্ঞের মতো তিনি যেন সে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলেন। একজন মহাত্মার সুরে তিনি সেই অমোঘ মন্ত্রটি উচ্চারণ করলেন---
অহিংসাই পরম ধর্ম।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেন এক ধরণের স্বর্গীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন ! তিনি ছেলেটিকে ভেতরের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। এক গ্লাস জল দিলেন খেতে । যথেষ্ট আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করলেন---
কত নেবে?
সাতশ পঞ্চাশ টাকা । ---ছেলেটি বলল ।
মাত্র সাতশ পঞ্চাশ টাকা ? –-মহাত্মা গান্ধীর মুখোশ পরা গোপাল দাস অবাক হয়ে বললেন---এতো কষ্ট
করে তৈরি করা একটা মুখোশ মাত্র সাতশ পঞ্চাশ টাকাতে ?
সময়ের অপচয় না করবার জন্যে তিনি মুখোশটা খুলে অন্য এক কোঠায় পয়সা আনতে গেলেন বটে , কিন্তু মুখোশটা খুলবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার আগের মানুষটি হয়ে গেলেন । তিনি আবার হয়ে পড়লেন রাগ ,দুঃখ, অভিমান, ঈর্ষা, লোভ আর কামনা বাসনা সম্পৃক্ত এক সাধারণ গোপাল দাস।ছেলেটির কাছে এলেন, বললেন---
একটা সাধারণ মুখোশের এতো দাম বলছ ? আমি কী করব এসব মুখোশ নিয়ে ?
ছেলেটির মুখের হাসি ম্লান হয়ে এলো । কোম্পানির ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লেখা কার্ড একটা পকেটের থেকে বের করে গোপাল দেসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল---
প্রয়োজন হলে কখোনোবা . . .।
দুই ০
একটা খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হয়েছে ।---বিলু বলল ।
কী ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ? ---গোপাল দাস জিজ্ঞেস করলেন ।
লোকে মুখোশ কিনছে ।--- বিলু বলল ।
গোপাল দাস কিছু না বুঝার ভান করে বললেন---
কী মুখোশ ?
ভেরাইটিজ,--- বিলু বলে গেল----কার্পেটওয়ালারা যেমন ঘরে ঘরে গিয়ে কার্পেট বিক্রি করে তেমনি মুখোশ বিক্রি করতে কিছু মুখোশওয়ালাও এসে পড়েছে ।
ইন্টারেস্টিং !---গোপাল দাস বললেন।
তা ছাড়া মুখোশগুলোও একদম পার্ফেক্ট, অরিজিনাল মুখগুলোর সঙ্গে একেবারে মিলে যায় ।-- বিলু আগ্রহের সঙ্গে বলল ।
কিন্তু এগুলো কিনছে কারা ?
মানুষে, দোস্ত ! মানুষে ! --- বিলু বলে গেল---বাচ্চা ছেলেরা কিনছে, নাটকের লোকেরা কিনছে, কেউবা অন্যকে কিনতে দেখে কিনছে, কেউবা অন্যকে ভয় দেখাবে বলে, ---আর আসল কথাটা কী জান ?
কী ?
সব মানুষের মনেই অন্য কিছু একটা হবার গোপন ইচ্ছে থেকে যায় । ঐ যেমন ধর--- খেলোয়াড় ,
অভিনেতা কিম্বা কোনো নমস্য মানুষ---।
আমার তেমন কোন বাসনা নেই । গোপাল দাস মাঝখানে বললেন ।
কিন্তু আমার আছে।---বিলু বলল---আমার বিল গেটসের মুখোশ পরে একদিনের জন্যে হলেও বিল গেটস হবার ইচ্ছে আছে। কিন্তু বিল গেটসের মুখোশ ওদের কাছে নেই । অবশ্য ওর্ডার দিলে ওরা যেকোন মুখোশ তৈরি করে দিতে পারে ।
যেকোন মুখোশ ?
যেকোন মুখোশ । ---বিলু বলল---তার জন্যে ওদের ওরিজিন্যাল মুখের ফটো দিতে হবে । আলাদা আলাদা দিক থেকে অন্ততঃ তিনটের মতো ক্লোজ-আপ ।
খানিক চুপ করে থেকে বিলু এক বাড়তি তথ্য জানাবার ইচ্ছেতে বলল,---
ওদের একটা ওয়েবসাইটও আছে ।
কী সেটা ?
www.amazingmask.com
সেটিতে কী করতে হয় ?
জানিনে। --বিলু বলল—কিন্তু আমি জানি যে তাদের এজেন্টরা এক সপ্তাহের জন্যে ব্লু ডায়মণ্ড হোটেলে
বাসর পেতে আছেই। সেখানে গিয়ে ওর্ডার দিলেও দু’চার দিনের মাথায়---।
বিলু কথাটা পুরো করতে পারল না । কেননা গোপাল দাস জিজ্ঞেস করে ফেললেন---
আর যদি এডভান্সের টাকাগুলো নিয়ে পালিয়ে যায় ?
রিস্ক আছে । --বিলু বলল,--- কিন্তু মানুষতো রিস্ক নেয় !
তিন ০
কোন এক স্বপ্নের নগরীতে ক’টি দিনের জন্যে যদি স্পাইডারমেনের মুখোস পরে মহানায়কের মতো উড়ে বেড়ানো যেতো ! ম্যান্ড্রেকের মুখোশ পরে যাদুর চমকে যদি একটি দিনের জন্যেও কোথাও ঘাঁটি গেঁড়ে বসা যেতো ! যদি প্রাধানমন্ত্রীর মুখোশ পরে কয়েকটা মুহূর্তের জন্যেও দেশের শাসনভার নিজের হাতে নিয়ে আসা যেতো !
কী করতেন তিনি ? কী করতেন ?
গোপাল দাসের মনে হলো তিনি বিলুকে সত্য কথাটি বলেন নি । তাঁর এখনো কিছু গোপন বাসনা রয়েছে ; এখনো আছে ধরা দিতে না চাওয়া কিছু পলাতক স্বপ্ন ।
কখনোবা কয়েকটি মুহূর্তের জন্যে এক ঝলক মন পাগল করা বাতাসে মন দুলিয়ে গেলেও গোপাল দাস বড় বেশি দুরন্ত স্বপ্নের কখনোই পিছু নিতে চান নি। অবশ্য তাঁর মনে এ কথাও এলো যে কোনো স্বপ্নের পেছনে ছুটতে নাজানার জন্যেই আজো তিনি নগরের একটি কোনে পড়ে আছেন; চাকরি-বাকরি নেই এক ডানা ভাঙ্গা মানুষ হয়ে রইলেন । যার অবলম্বন, বলা চলে ---একটা টিউটরিয়েল সেণ্টার ।
অথচ সঙ্গের হীরু কিনে ফেলেছে মোটা মাইনের এক চাকরি আর ফ্লেট । ফণী পার্টনারশিপে নিয়ে ফেলেছে এক পেট্রল পাম্প । গণিত আর ইংরেজিতে যে সব সময় ফেল করে গেল সেই অবিনাশ এখন পুলিশ কর্তা । সেও মাত্র ক’টি বছরে কিনে ফেলেছে বাড়ি, গাড়ি আর পত্নী রূপে এক সুন্দরী রমণী ।
তাহলে একবার হীরু, অবিনাশ অথবা ফণীর মুখোশ পরে দেখাতে ক্ষতি কী ?
গোপাল দাস এলবামের থেকে এক পুরোনো গ্রুপ ফটোগ্রাফ বের করবার চেষ্টা করলেন । তাই করতে গিয়ে হাতে এলো বিভীন্ন ভঙ্গীতে পোজ দেয়া অবিনাশ কলিতার মুখ ।
চার ০
সপ্তাহের কোনো এক আমোদে দুপুরে অবিনাশ কলিতের মুখোশ পরে কেউ যাতে ধরতে না পারে সে ভাবে গোপাল দাস ব্লু ডায়মণ্ড হোটেলের আঙিনা পার করে বেরিয়ে এলেন । সেই মুহূর্তেই তিনি লক্ষ্য করলেন যে তাঁর মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে একটা পুলিশী মেজাজ এসে গেছে । তাই তিনি তাঁর ভেতর থেকে এক কঠিন কণ্ঠস্বর বের করে আনলেন । সেই কণ্ঠস্বরে তিনি চৌমাথার মোড়ের বিশৃঙ্খল রিক্সাওয়ালাদের ক’জনকে এমনিই ধমকে দেখলেন একবার। দেখা গেল, কাছের অটোরিক্সা স্টেণ্ডটার ক’জন অটোচালক তাঁর দিকে সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো । ট্রাফিক পুলিশটি অসম্ভব ব্যস্ততার মধ্যেও পুলিশী কায়দায় তাঁকে লক্ষ্য করে একটা সেলাম দিল । সবিষ্ময়ে গোপাল দাস লক্ষ্য করলেন যে ইউনিফর্ম না থাকা সত্বেও নিজেকে অবিনাশ কলিতা বলে প্রতিপন্ন করতে তাঁর বিশেষ অসুবিধে হলো না। কিন্তু অসুবিধেটা হলো এরজন্যে যে বেশ কিছু অপরিচিত ব্যক্তি নানা ভঙ্গীমাতে তাঁকে সম্ভাষণ জানাতে শুরু করল আর গোপাল দাসের পরিচিত বেশ ক’জন ব্যক্তি তাঁর একেবারে কাছ দিয়ে অপরিচিত ভদ্রলোকের মতো পেরিয়ে গেল।
অবশ্য তিনি ভেবে নিলেন যে দুপুরের শহরে টহল দেবার জন্যে একজন অবিনাশ কলিতার একখানা বাহন নেই, এই কথাটি নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য হলো না । গোপাল দাস হিসেবে তিনি বেশ সংকোচিত হয়ে পড়লেন । কিন্তু পর মুহূর্তেই তিনি হয়ে পড়লেন অবিনাশ কলিতার মতো স্ফীত আর বেপরোয়া ।
পরিস্থিতিটাই তাঁকে একরকম প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করল । তাঁর পদক্ষেপগুলো দৃঢ় হয়ে গেল, পেশীগুলো যেন হয়ে গেল সবল আর কোমরের পেটিতে তিনি অনুভব করলেন একটা পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলবারের ভার । তাঁর চোখ দুটোতে ভেসে উঠল ‘হু কেয়ারস্’ ধরণের একটি রুক্ষ, কঠিন দর্শন । ফলে এক কঠিন দৃষ্টিতে তিনি তাঁর চারপাশের সাধারণ মানুষগুলোর দিকে তাকালেন । শরীরের সমস্ত অংগ প্রত্যংগ দিয়ে তিনি উপভোগ করতে শুরু করলেন একটি ক্লীব নগরীর জড়তা । তিনি বেশ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন । একবার পায়ে হেঁটে, তো আরেকবার অটোরিক্সাতে চেপে অনেক সময় ধরে তিনি দুপুরটার স্বাদ নিতে থাকলেন । একবার তিনি কোনো একটা মোড়ে লক্ষ্য করলেন যে তাঁর একেবারেই কাছেই একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে গেল। ভ্যানটির থেকে চালকটি নেমে এলো। তাঁকে লক্ষ্য করে একটা সেলাম ঠুকল আর সেই সেলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করল,--
স্যর !
কৈ যাও ?—গোপাল দাসের ভেতরের অবিনাশ কলিতার অনুশাসনসুলভ কণ্ঠটি যেন জিজ্ঞেস করে ফেলল ।
কাকতি স্যর পাঠিয়েছিলেন, স্যর। বৌদিকে আনতে হবে ।
কোনো দরকার নেই । গাড়ি ঘুরাও। আমি তাঁর জন্যে অন্য ব্যবস্থা করব ।
পরের ঘণ্টা কয়েক তিনি প্রাণ ভরে শহরের অলিতে গলিতে ভ্যানটি ঘুরালেন । একবার পেট্রল পাম্পে ঢুকিয়ে তিন লিটার পেট্রল ভরিয়ে নিলেন । অথচ দেখা গেল তাঁকে পেট্রলের দাম দিতে হলো না। ইউনিফর্ম না থাকা সত্বেও এক সম্ভ্রান্ত রেস্তোরাঁর ম্যানেজার যেন তাঁকে চিনতে ভুল করল না ।
একবার সুযোগ বুঝে তিনি থানার থেকে ক’জন পুলিশ উঠিয়ে নিলেন । পুলিশের ভাষাতে তাঁরা হয়ে পড়লেন একটা পার্টি । পার্টিটি বিকেলের ব্যস্ত বাজারের কাছে একবার গাড়ি থামালো, মদের মহল আর জুয়ার আড্ডাগুলোর কাছ দিয়ে একটা পাক দিলেন; অনুজ্ঞাপত্র নেই এরকম এক ফার্মাসিতে ঢুকে এক হ্রস্ব-দৈর্ঘ্যের হ্যাপি এণ্ডিং চলচ্চিত্রের দৃশ্য একটার অবতারণা করলেন; আরেকবার দ্রুত গতিতে গিয়ে এক শরীরি লেনেদেন হয় যেখানে সেই নিষিদ্ধ এলাকাতে ঢুকে তাদের গাড়ি থেমে গেল ।
এই সমগ্র পথ পরিক্রমাতে তিনি বেশ আমোদের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন যে পদপথে বস্তা পেড়ে বসা দু’একটা নিঃস্ব পেঁপের ব্যাপারি আর হেলমেট পরে নি এরকম দু’চারজন ভদ্র স্কুটার আরোহীর বাইরে কেউই তাদের উপস্থিতিকে শংকা বা সমীহের দৃষ্টিতে দেখে নি । নগরের আঁধারগুলো তাদের প্রত্যহ্বান হিসেবে গণ্য করতেই চায় নি । কিন্তু কোনো জায়গা থেকে যদি তাচ্ছিল্যের শব্দ ছিটকে আসছে তবে কোনো জায়গা থেকে উপড়ে বেরিয়ে আসছে বিরক্তির প্রকাশ । অবিনাশ কলিতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গোপাল দাস আরো লক্ষ্য করলেন যে বাতাসে একটা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে। সে গুঞ্জনের শব্দ সাধারণ সন্ধ্যের তুলনায় ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে পড়ছিল । এমনটি মনে হচ্ছিল যেন অচিরেই কোথাও বিদ্রোহের সৃষ্টি হবে , অচিরেই যেন কোথাও উদ্গীরিত হবে শোষিত মানুষের ক্ষোভ ।
কিন্তু এখন সেসব ভেবে মাথা গরম করবার দরকার কী ? কাল আরো বার দুয়েক রাউণ্ড দিলেই এসে যাবে মাস কয় নিশ্চিন্তে চালিয়ে দেবার নিশ্চিতি।
কী যাদু মাখা আছে মানুষের মুখগুলোতে ? কোন মায়ঙের* যাদু মেখে রাখা আছে মানুষের এই মুখোশগুলোতে ?
এবারে তাঁর পরে রাখা মুখোশটা পরীক্ষা করে দেখবার ইচ্ছে হলো । কিন্তু পার্টির উপস্থিতিতে, পুলিশ ভ্যানের রেয়ার ভিউ মিররটিতে নিজের মুখ অথবা মুখোশ দেখার মতো তুচ্ছ অথচ বিপজ্জনক দৃশ্যের অবতারণা করটা ভালো হবে বলে তাঁর মনে হলো না। হয়তো তাঁর ক্ষিদে পেয়েছে, হয়তো তাঁর বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। সেজন্যে রাস্তার কোনো এক নিরাপদ মোড়ে সহচরদের বিদেয় সম্ভাষণ জানিয়ে স্বয়ং তিনি ঘরের পথে পা বাড়ালেন ।
বাড়ি ফিরে বেসিনের উপরের হাফ সাইজের আয়নাটিতে খোদিত হতে শুরু হওয়া অবিনাশ কলিতার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গোপাল দাস মুখোশটা খুলবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে বড় করুণ আর ভয়ঙ্করভাবে মুখোশটি তাঁর মুখে লেপ্টে চেপে বসেছে । মুখোশটি খুলতে তিনি যারপর নেই চেষ্টা করলেন । তাই করতে গিয়ে গাল আর কপালের ছাল চামড়া ছড়ে বেরিয়ে এলো , রক্ত বেরুলো, কাণের পাশে উপরে নখের আঁচড় পড়ল । তিনি যেন শেষঅব্দি নিজেকে উদ্ধার করতে পারলেন না।
গোপাল দাস ভয় পেয়ে গেলেন । তিনি ঘরের ভেতরে এদিক ওদিক করতে শুরু করলেন । দুপুর বেলা ফেলে রেখে যাওয়া এলবামখানা তাঁর নজরে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখা খান কয় ফটোগ্রাফের কথা ।
তিনি দৌড়বার চেষ্টা করলেন---অবিনাশ কলিতার মতো নয় , একেবারে নিজের মতো করে ।
দেখা গেল, বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে ব্লু ডায়মণ্ড হোটেলের কোনো এক কোঠার দোয়ারে ঠোকা দিচ্ছেন গোপাল দাস। কিছুক্ষণ পরে দরজার ভেতর থেকে এক পরিচিত ছেলের মুখ উঁকি দিল । সময়ের অপচয় না করে গোপাল দাস বড় করুণভাবে সেই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন----
একটা মুখোশ তৈরি করা যাবে কি?
যাবে । ---ছেলেটি আশ্বাস দিয়ে বলল ।
গোপাল দাস তাঁর পকেট থেকে খান কয় ফটোগ্রাফ বের করলেন। চাকরির খোঁজে যে দিনগুলোতে অরণ্যরোদন করে ফিরছিলেন সে দিনগুলোতে তুলে রাখা কয়েকটি পাসপোর্ট আকারের ফটো ।
ছেলেটি একবার ফটো ক’টির দিকে তাকায় আরেকবার গোপাল দাসের মুখের দিকে । এভাবে বার কয় করল। একবার একটি ফটো একেবারে চোখের কাছে নিয়ে দেখার ভংগী করে জিজ্ঞেস করল ----
কে ?
গোপাল দাস একজন শংকিত মানুষের মতো কাঁপা কণ্ঠে বললেন---
গোপাল দাস, গোপাল দাস !
--------------------------------
টিকা ঃ * মায়ঙঃ লোকের বিশ্বাস বর্তমান মরিগাঁও জেলার এই জায়গাটি যাদুর জায়গা। এখানে এলে পুরুষদের ভেড়া বানিয়ে দেয় মেয়েরা ।
লেখকের ঠকানাঃ
মিলন নগর,
গোয়ালপাড়া---৭৮৩১২১।
দূরভাষঃ ৯৪৩৫১-২৭৮৮৮।
ই-মেলঃ atanuarya@yahoo.co.in
No comments:
Post a Comment