আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Wednesday, 7 May 2014

বিহু , বাঙালি এবং শিলচর শহর থেকে প্রতিবাদী শিলাবৃষ্টি

(২০শে এপ্রিল দৈনিক যুগশঙ্খের রবিবারের বৈঠকে প্রকাশিত দুটি লেখা শিলচর শহর তথা বরাক উপত্যকাতে বেশ ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল, সেই প্রসঙ্গে আমার চিঠিটি বেরুলো আজ। এখানে পুরো চিঠির সঙ্গে ছবিতে রইল মূল দুই লেখা এবং সেই নিয়ে এযাবৎ প্রকাশিত অন্যান্য চিঠি এবং লেখাগুলো। ছবিগুলো ক্লিক করুন দু'বার , পড়বার মতো বড় হয়ে যাবে। মূল চিঠিতে 'শিলাবৃষ্টি' কথাটি ছিল। সম্পাদক হয়তো সঠিকতর শব্দের সন্ধানে কথাটি পাল্টেছেন, তাতে আমার মতে অর্থটি কঠোর হয়ে গেছে বেশি। আমাদেরটি ছিল শ্রুতিমধুর এবং সম্মান জনক।   )
       

      রবিবারের বৈঠকের ২০ এপ্রিল সংখ্যাতে  বিহু সংক্রান্ত বাসর রায় এবং প্রশান্ত চক্রবর্তীর লেখা দুটি পড়ে আমাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল এরকম: মাঝে মধ্যে এমন নাড়িয়ে দিতেই হয়। সৌমেন ঠিকই দেখেছে, প্রশান্তও ঠিকই লিখেছেন।  বাঙালি হিন্দুও ধর্মীয় উৎসবে যত উৎসাহ দেখায় আর কিছুতে তেমন নয়। স্মরণ করতে দ্বিধা কি বাঙালি মুসলমান ধর্ম ছাড়া কিছু বোঝেন না বলে বহু হিন্দুই দিনে রাতে সমালোচনা মুখর, যখন কিনা তাদের নিজেদের বাস্তবতা অসমে ভিন্ন কিছু নয়।  এমন কি বিশুদ্ধ ভাষিক অনুষ্ঠানেও নয় ---যদি সেখানে ধর্মের ছোঁয়া না থাকে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি হিন্দু সম্পর্কে কথাগুলো সত্য। আরো অনেক কথাই ছিল, যা নিয়ে কথা এগুনো যেতো। অনেক প্রশ্নে তর্ক করবারও সুযোগ নিশ্চয়ই ছিল।  তবে কিনা, বাঙালি যে নিজে উদ্যোগ নিয়ে বিহু করবে তাতে আতঙ্কেরও কারণ আছে। বিহু মঞ্চে জুবিন গার্গের হিন্দি গান নিয়ে বিতর্ক তার নজির, সেই আতঙ্ক জয়ের পথ না হলে স্থিতাবস্থা কাটানো মুস্কিল। সেখানেও নিশ্চয় বাঙালির দায়িত্ব আছে। প্রশ্ন হলো, সেটি কী?
                 কিন্তু কী মুস্কিল! এর পরে একটি মাত্র শহর শিলচর থেকে যে কটি প্রতিবাদী চিঠি বেরুলো তাতে মনে হচ্ছে  বৌদ্ধিক আলোচনার বদলে  দুই উপত্যকার দ্বৈরথের আগুনে ঘি ঢেলেছে  এই লেখা দু'টো। বাসব রায় লিখেছেন ক্ষোভে , “বরাক উপত্যকার বাঙালি ব্রহ্মপুত্র পাড়ে বাঙালি আছে বলে মনেই করে না” সবার সম্পর্কে না হলেও শহুরে জনপ্রিয় বৌদ্ধিক মহল সম্পর্কে  এই কথাকে সত্য পরিণত করে দেখিয়েছে এই চিঠিগুলো। অথচ সত্য হলো এই উপত্যকাতে বাঙালি সংখ্যা বরাক উপত্যকার থেকে বেশি বই কম হবেন না। যদিবা অস্তিত্ব স্বীকারও করলেন, তবে তাদের যে কোনও বোধ বুদ্ধি আত্মমর্যাদা বোধ থাকতে পারে এই কথা ভাবেন বলেও মনে হলো না কেউ , অন্তত চিঠিগুলো পড়ে তাই ধারণা হলো। এমন চিঠি আগেও কিছু লেখা সম্পর্কে আমরা পড়েছি, বিপরীতে কলমও ধরতে বাধ্য হয়েছি। এই সত্যও জানেন কিনা জানি না, যে দৈনিক যুগশঙ্খের ব্যাপক বিস্তারের দৌলতে তাদের এই গালি গালাজ গুলো নীরবে পড়ে যাচ্ছেন ধুবড়ি থেকে ধলার মানুষ।  শিলচর শহরের বহু লেখকের লেখাতে  নামগোত্রহীন ভাবে  আমাদের শহরপদগুচ্ছ দেখেও ধলার মানুষ নিশ্চয়  নীরবে হাসেন। কেন না, কলকাতার বৌদ্ধিক আবহ থেকে একটা জিনিস শিখেছে বাঙালি ----তার শহর একটার বেশি দুটো হবে না। অসমের বাঙালির শহর একটাই। শিলচরের বাইরে  হাইলাকান্দিও না, হোজাইরতো কথাই নেই। তাই আমাদের শহরলিখলে পাঠকের দায়িত্ব বুঝে নেয়া যে শহর শিলচরের কথাই হচ্ছে।  এর বাইরে যারাই আছেন, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে-- ভাবেন বুঝি এরা সবাই কর্তাভজাদলের লোক। এমন এক মনস্তত্ত্ব সেখানকার একাংশ লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী---তাদের মধ্যে ডান-বাম সবাই আছেন। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই মতাদর্শ প্রচার করে যাচ্ছেন। সে অনেকটা চাপা-উগ্র-জাতীয়তাবাদের মতো। সত্য হলো এই বাঙালি কর্তাইভজেন বটেকিন্তু সেই কর্তা কলকাতার আমদানি ধর্মগুরু। কুল-গুরুদের এখন ব্যবসা নেই। লেখাগুলো এই প্রথম সেদিকে নজর ফিরিয়েই করেছে অন্যায়।


এখন যখন যুগশঙ্খের দৌলতে এই উপত্যকার কণ্ঠ কিছুও সরব হয়েছে আর পালটা কিম্বা চাপা বাঙালি উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের মৌরসি পাট্টাকে প্রত্যাহ্বান জানাচ্ছেন তখন সমস্যা জটিল হয়ে উঠেছে। একটু ধৈর্য ধরে লেখা দুটো পড়ে দেখলে দেখতেন সেখানে প্রসঙ্গক্রমে বাইরের বাকি বাঙালির কথা এলেও মূল কথাগুলো ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি সমাজ নিয়েই লেখা । তাই শিলচরের পত্রলেখকেরা  অপেক্ষা করতে পারতেন , ব্রহ্মপুত্রের বিশাল পাঠক সমাজ কী লেখেন পড়বার জন্যে। অসমের বাঙালি নিয়ে লিখলেই সব লেখা শিলচরের হয়ে যায় না, যদিও আমরা ভুলে যাচ্ছি না যে বাসব রায়ের লেখাতে কথাপ্রসঙ্গে শিলচর এসেছে।  কিন্তু দুটো লেখাই শুরু হয়েছে গুয়াহাটির কথা দিয়ে। যারা এখানে বাংলা ভাষা সাহিত্য  শিল্প নিয়ে কাজ করেন তাদের নিজস্ব  সমস্যা এবং সংকট থেকে উঠে আসা এক যন্ত্রণা বোধের থেকে।
        
 
এখানে পড়ুন
    ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অনেকেই মনে হয় রবিবারের বৈঠকের লেখাগুলোতে আমার মতো মূল কথাতে আপত্তির কিছু দেখেন নি। তাই চিঠি লেখেন নি। বরাক উপত্যকার থেকে আপত্তি করবার কথা খুঁজে পেয়েছেন তাই চিঠি লিখেছেন। তা লিখুন
।  কিন্তু ওই যে বললাম চাপা উগ্র-জাতীয়তাবাদ। তাই এক লেখিকা রীতিমত  ছাপা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বসলেন। আরেকজন পত্রলেখক তাঁকে সমর্থন জানিয়েও বসলেন।  কেন? অন্য সময় এই লেখক লেখিকারাই কি ‘বাক স্বাধীনতা' নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না, তর্ক যদি হতো তসলিমা বা রুশদী নিয়ে? এতো সেই মার্কিনি স্টাইল হলো—যেখানে যেমন সুবিধে।  এখানে যেই মনে হয়েছে লেখক বাঙালিদের গালি দিয়েছেন তক্ষুনি প্রশ্ন -- এমন লেখা ছাপা হবে কেন! স্বজাতিকে গালি দিলে যে লোকে ভালোবেসে দেয়, সংস্কার আশা করে দেয়--অপমান করতে দেয় না---এই বোধ কি আমাদের হবে না? এই ভাবেই যদি চলে, তবে মনে হচ্ছে বরাক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা কাগজের সংস্করণ দুটো করে ফেলতে হবে। কাগজ তো একটাই। আর সংস্করণ আলাদা হলে কিন্তু শিলচরের পাঠকই হারাবেন বাকি ২৪টি জেলার পাঠক । তাই এটি এক কথার কথা। প্রস্তাব নয় কোনও, কাঙ্ক্ষিতও নয়। কিন্তু এই তো প্রথম নয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার থেকে লিখলেই ঐ উপত্যকার কেউ কেউ যখন দিব্বি ভেবে বসেন তাঁদের জানাই শেষ জানা, তাদের বোঝাই শেষ বোঝা, তাদের নির্মিত আখ্যানই একমাত্র মান্য আখ্যান --তখন আত্মমর্যাদাতে বাধে বৈকি। বাসব রায় কিন্তু এই বঙ্গীয় উন্নাসিকতার কথা তুলেছেন।


অসমের একটি সর্বজনীন উৎসব বিহুতে বাঙালির অনুপস্থিতি বা ঔদাসীন্যটা নিয়ম। লেখক দ্বয় বা পত্রলেখকেরাও আদান প্রদানের যে নজির দিয়েছেন সেগুলো আসলে ব্যতিক্রম। বা সাম্প্রতিক শুভলক্ষণ ।  অন্যদিকে এখানকার বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি সমাজ ধর্মীয় উৎসবে যতটা সাহস এবং উদ্দীপনা দেখান সাধারণ বাঙলা ভাষা সংস্কৃতির অনুষ্ঠানেও কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ততটাই ঔদাসীন্য। এখানে যারা এসব কাজ করেন তারা প্রতিদিন হাড়ে হাড়ে টের পান। বাসব রায় ব্যতিক্রম মাসডো  আয়োজিত  ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা সংস্কৃতি মিলনোৎসবের কথা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সংকটের  কথা বলেছেন। দুই একজন পত্র লেখক রেগে-মেগে গেলেন বলেই এসব তথ্য মিথ্যে হয়ে যায় না। এও সত্য যে বাঙালির ধামাইল বা গৌড়ীও নৃত্য থাকলেও সেগুলো জাতীয় কোনও সর্বজনীন উৎসবের অঙ্গ নয়, রবীন্দ্র জয়ন্তীও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উৎসব বই অন্য কিছু নয়। তার সঙ্গে বিহুর তফাৎ অনেক অনেক। একাংশ বাঙালি নির্দ্বিধাতে সর্বত্র মনে করে দুর্গোৎসবই তার জাতীয় উৎসব। সেইতো ধর্মীয় ব্যাপার। তো কেউ যদি আশা করেন বাঙালিরও একটা এমন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব থাকুক তাতে অন্যায়টা  কী হয়েছে? সেটি সম্ভব কি অসম্ভব সেই তর্ক করা যেতেই পারে।  আর এই যে, ধর্মের বাইরে বাঙালি বা অসমিয়া অনুষ্ঠানে সাধারণ বাঙালি সমাজের ঔদাসীন্য—এ কি স্ব-সমাজের জন্যেই খুব স্বাস্থ্য ব্যঞ্জক? হয়তো কথাগুলো বরাক উপত্যকা বা অন্যত্র যে বাঙালি থাকেন তাদের জন্যে অন্য। যেমন বরাক উপত্যকাতে যদি বিহু সেভাবে পালিত না হয় তবে তা অন্যায় হতে পারে না। বাসবদা তার জন্যে সমালোচনা করেছেন। করা উচিত নয়। বরং সেখানে মণিপুরি, ডিমাছা, ঝাড়খণ্ডী আদিবাসী উৎসব নিয়ে বাঙালি আগ্রহ দেখায় কতটা সেই নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাতে পারে। ওখানকার ঝাড়খণ্ডী আদিবাসীদের নিয়ে বাঙ্গালিদের ঔদাসীন্যতো ক্ষমারও অযোগ্য। কোনোদিন কি ‘কোরাস’ কিম্বা ‘গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থা’র মতো  দুই একটি ব্যতিক্রমী সংগঠনের কথা বাদ দিলে কেউ ১৯শ, ‌ ২১শের অনুষ্ঠানেই এই প্রশ্ন তুলেছেন, তারা কেন সেখানে হিন্দি ভাষী বলে পরিচিত হবেন? তাঁদের মাতৃভাষার কী হবে? তার উপর সেখানে, বিহুকে উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরা একটা সরকারি উৎসবে পরিণত করে রেখেছেন। বিহু সেখানে বহু সময় আগ্রাসনের প্রতীক হিসেবে গিয়ে উপস্থিত হয়। এই নিয়ে সেখানকার মানুষের ক্ষোভ সংগত। তো এসব ফাঁক ফোঁকর হয়তো লেখাতে আছে। তাই বলে সৌরভ গাঙুলি, জগদীশ বসুর নাম বাসবদাকে জানানো কিন্তু শুধু পত্রলেখকদের দৈন্য নয়, এগুলোই দেখায় আমরা নিজেদের আবহ নিয়ে কতটা উদাসীন এবং নিঃস্পৃহ। এবং বাসবদা ঠিকই লিখেছেন, বাঙালির আছে এক রা, আমরা বেশি জানি। এই জানাটা বাঙালি জানিয়ে দেবেই। কিন্তু এই পত্রলেখকেরা যে অসমের বাঙালি প্রতিভা নিয়ে বেশি জানেন না সেতো বোঝাই গেল। অসমের লেখা লেখির জগত নিয়ে যারাই সামান্য সংবাদ রাখেন তারাই জানেন, বাসবদা বা প্রশান্তের নজর বা দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, কিন্তু তাকে জ্ঞানের বহর নিয়ে অসম্মানজনক প্রশ্ন তোলা আসলে চিঠি লেখকের নিদারুণ অজ্ঞতা আর ঔদাসীন্যকেই প্রকট করে।
মূল লেখার শেষাংশ দেখুন

 শুধু তাই নয় এমন আরো কতো লোক যে গোটা উপত্যকাতে বাংলা ভাষা সাহিত্য শিল্পের এবং বৌদ্ধিক উত্থানের জন্যে দিনকে রাত আর রাতকে দিন করছেন শত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে এগুলো শিলচরে বসে আঁচ করবার কথা নয়, যন্ত্রণাটাও বুঝবার কথা নয়। ধরে নেয়া হয় যে এখানে সবাই কর্তাভজাগান করেন। মানে অসমিয়া আগ্রাসনের শিকার হয়ে যেতে এক কথাতে প্রস্তুত। তাই যদি হবে তবে এই সব চিঠি গুয়াহাটি ডিব্রুগড়ের সংস্করণে প্রকাশ পায় কী করে! আর তার পরেও একটাও অসমিয়া-বাঙালি হাঙ্গামা না হয়ে থাকে কী করে! ভয়ে শিলচরের এমন চিঠি কিম্বা লেখা  ছাপতে আপত্তি জানাবার কথা তো এখানকার পাঠকদের। তফাৎ শুধু এই যে বরাক উপত্যকাতে বসে পরামর্শ দেয়া হয়, সামাজিক মিলনের দায়িত্বটা অসমিয়াদেরই নিতে হবে আগেবুঝিবা তারা সারাক্ষণ মারামারি করবার জন্যে প্রস্তুত। অথচ দুজনেই এই কথাই আশা করে লিখলেন, বিহুর মঞ্চে বহু অসমিয়া শিল্পী বাংলা গাইছেন, বাঙালি শিল্পী অসমিয়া। যদি এখানকার বাঙালি সমাজ এগুলো দেখতেন। যে সমাজ দেখে না ---তারা শুধু মঞ্চবিহু ( বিহু আর মঞ্চবিহুর তফাৎটাও মনে রাখতে হবে) থেকেই দূরে থাকে তাই নয়---তারা ভাষা সংস্কৃতি মিলনোৎসবথেকেও দূরেই থাকেন। রবীন্দ্র- সুভাষ-বিবেকানন্দ জন্ম জয়ন্তী বাদ দিলে তারা আর সব বাংলা সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক অনুষ্ঠানের ঠিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কলকাতাকে দিয়ে রেখেছেন। মানে, যা কিছু বাংলাতে হয়, বাংলাতে সম্ভব সবই ওখানে হয়। এখানেও যে হয়, এখানেও যে সম্ভবএই সত্য জানেন না পত্রলেখকেরাও এই সত্য খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে।  আর এই যে স্ব-সমাজের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে চরম ঔদাসীন্য এর দায় শুধু অসমিয়াদের নয়। বেমার অনেক গভীর। বাঙালির জাতীয় জীবনের সঙ্গে এর যোগ আছে। আছে তার ভেতরকার শ্রেণি, বর্ণ , সম্প্রদায় বিভাজনের  সমস্যাতেও।  
        
  
            বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলন নিয়ে কথাটিই নেয়া যাক। এটি ঠিক যে বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন বা ছোট কাগজ দুই উপত্যকার মধ্যে একটা আদান প্রদানের কথা ভাবেন, সেরকম কাজও করেন।  কিন্তু বড়মাপের সংগঠন বলেই এর কথা এসেছে। তারা কি শুধুই অসমিয়া নিয়েই উদাসীন? তারা উগ্র অসমিয়াদের মতো যেন ধরেই নিয়েছেন এই উপত্যকাতে কেবল অসমিয়াই থাকেন। আর সবাই উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী।  এখানে যে বহু বাঙালিও থাকেন , কই তাদের ডাকেন বলেতো দেখা যায় না সেভাবে? অথচ, বহু ব্যয় করে বহু সাধনাতে কলকাতা-বাংলাদেশ থেকে লোকজন এনে ভিড় করান এবং ভিড় বাড়ান। এই সব সংবাদ আজকাল নজরে পড়ে ব্রহ্মপুত্রে, আগে পড়ত নাএই সত্য জানতে হবে।  এমন কি ত্রিপুরা থেকেও নিয়মিত লোকজন ডাকতে দেখাই যায় না। বাসবদা লিখেছেন , আগরতলার লোকে শিলচরকে গুরুত্ব দেয় না। কথাটি আসলে আমরা দেখেছি উলটো ---শিলচরের বহু লোকে আগরতলাকে পাতেই নেয় না।  কিন্তু এই প্রশ্নটাও সংগঠনটিকে করা হয়েছে মানে কিন্তু তার গুরুত্বকে সম্মান জানানো হয়েছে। আরো তো দুই একটি  সর্বভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন রয়েছে যারা ঘটা করে ধর্মীয়রঙে রাঙিয়ে নিরাপদে  বিজয়া সম্মেলনতো করেন কিন্তু অসমের সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে কোনোদিন বিশেষ ভাবনা চিন্তা করেন বলে নজরে পড়ে না। তাই তাদের কথা আসেই নি।  এসব না বুঝলে চলবে?
       
           
সঞ্জীব দেবলস্করের লেখা এখানে
  যাই হোক
, ভালো লাগত বিতর্কটি যদি বস্তুনিষ্ঠ পথে এগুতো। সুমিত্রা দত্ত ভেবেছেন , লেখাগুলো বৈষম্যের বার্তা ছড়িয়েছে। কী করে?    এই লেখা পড়ে কি বাঙালি উদ্বুদ্ধ হবে অসমিয়াকে গালি দিতে?   বরং লেখিকার লেখাতে সেই বাঙালির জাতীয়তাবাদী উন্নাসিকতাই প্রকট হয়েছে, তিনি দেখাবার চেষ্টা করেছেন বাঙালি চেতনা সর্বভারতীয়। এই বিদেশী খেদা টেদা ইত্যাদি অসমিয়াদের কাজ। তাই কি! অসম আন্দোলন আর অসম চুক্তির সঙ্গে ছিল যারা সেই হিন্দুত্ববাদীরাজনৈতিক দলগুলো যখন বরাক উপত্যকাতে বিশেষ করে, এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও মূলত বাঙালি হিন্দুদের উপরেই নির্ভর করে তিন দশক ধরে গণভিত্তি গড়ে রেখেছে তখন কিছু বাঙালির ঔদার্যের স্বরূপ  অন্তত বিকটভাবেই  নজরে পড়ে। আর এও জানি এই তর্ক তুললেই, ওসব হিন্দু নয় -- মুসলমানের পাপে হচ্ছে বলে তর্ক হাজির করতেও আরেক দল ময়দানে নেমে যাবেন। বাকি বাঙালির বর্ণভেদ ইত্যাদিতো রইলই। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার থেকেই প্রকাশিত কর্তাভজাদের (?) দলেরই কারো কারো দ্বারা সম্পাদিত কাগজ নাইন্থ কলামের সম্প্রতি প্রকাশিত দেশভাগ-দেশত্যাগসংখ্যাতে বরাক উপত্যকারই কিছু চিন্তক তথ্য তুলে দেখিয়েছেন , কীভাবে শুধু একাংশ অসমিয়া বা মুসলমান বাঙালি চাইছিলেন বলেই নয়, দলিত হিন্দু বাঙালিকে সিলেটি বর্ণহিন্দু মানুষের মর্যাদা দিতেন না বলেও তাদের একাংশও সিলেট বিভাজনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। বাঙালির এই সব পাপ নিয়ে প্রশ্ন না তুললে হবে? আর তুললেই উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরা যেমন উদার অসমিয়াদের বিরুদ্ধে তেড়ে আসে, সেভাবে তেড়ে আসতে হবে?
গেল রবিবারে ২৭শে এপ্রিলের পত্র লেখক নবেন্দু চক্রবর্তী  লিখলেন 'বাঙালি মন থেকে এই ভয় দূর করবার দায়িত্ব বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর' , মিলনের হাত আগে তাদেরই বাড়াতে হবে' বেশ! আমাদের প্রশ্ন ---তারা সে মিলনের হাত বাড়িয়ে দিলেও কি আর এমন লেখকের সগোত্রীয়রা নজর ফেলে দেখবেন? তাঁরা যে কলকাতাছাড়া আর কিছু দেখেন না, সেই আক্ষেপই তো লেখা দুটোর পঙক্তিতে পঙক্তিতে। এটা তো আর আশা করে লাভ নেই যে পুঁজিবাদ আর সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে এমন কোনোদিন আসবে যে সব অসমিয়া বোতাম খোলা সার্ট নিয়ে শুধু বাঙালিকেই আলিঙ্গন করতে ব্যস্ত হবেন।  আর যতদিন না হন  ----তদ্দিন কি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি বসে বসে  হরি কীর্তন করতে থাকবেন? যা তারা করেও থাকেন? তার পরেও কি এই প্রশ্ন করা যাবে না, যে অসমিয়াদের তুলনাতে সত্যি বাঙালি অসমে নিদেন পক্ষে বৌদ্ধিক কর্মকাণ্ডে অনেক খাটো হয়েই আছে। চোখ মেলে তাকালেই তো নজরে পড়ে।   আসলে প্রতিবেশি সমাজের মধ্যে মিলন এবং সংঘাতের সমস্যা একটার পরে আরেকটা আসে না। এগুলো সমান্তরালে চলে। সংঘাতকে যারা বৈরি করে রাখতে চান নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থে তারাই  শুধু কল্পনা করেন একটার পরে আসবে অন্যটা। তারা মিলনের ঐতিহ্যকেও ভুলিয়ে দিয়ে একটা পুরো সমাজের সঙ্গে  সংঘাত টিকিয়ে রাখেন। উলটো দিকে, সংঘাত যাদের স্বার্থ পূরণ করে তাদের বিরুদ্ধে লড়তেও আমাদের চাই বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য। নইলে সমাজ স্থবির হয়ে পড়ে—তার আদর্শ নজির ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা তথা অসমের বাঙালি সমাজ।


          এসব দিকে নজর দিতে বললে কি শুনতে হবে, যেমন লিখেছেন   নবেন্দু চক্রবর্তী , “লেখক দ্বয়ের মনে রাখা উচিত নিজের জাতি সংস্কৃতি-ভাষাকে খাটো করে কেউ কোনদিন বড় হতে পারে না”  বেশ তাও না হয় নাই হলো। গেল ১৩ এপ্রিল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে সমীক কুমার ঘোষের লেখা উত্তর সম্পাদকীয় চিঙ্কিপ্রবন্ধটি কি পড়লেন কেউবাসব রায়ের লেখাতে মাড়োয়াড়ি মেড়ো, বিহারি খোট্টা...ইত্যাদি প্রসঙ্গ সেই লেখা থেকে এসেছে মনে করবার অনেক কারণ আছে। সেই লেখার বিরুদ্ধে চিঠি লেখার কথা কেউ ভেবেছেন? রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছিলেন বঙ্গবীরদের সম্পর্কে , “...মোক্ষমুলর বলেছে আর্য’,/    সেই শুনে সব ছেড়েছি কার্য,/    মোরা বড়ো বলে করেছি ধার্য,/    আরামে পড়েছি শুয়ে।/    মনু না কি ছিল আধ্যাত্মিক,/     আমরাও তাইকরিয়াছি ঠিক/     এ যে নাহি বলে ধিক্ তারে ধিক্,      শাপ দিপইতে ছুঁয়ে।এসব রবীন্দ্র কবিতার বিরুদ্ধে বলে কোনো রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে তাঁকে  তুলো-ধুনো করবার কথা ভেবেছেন কখনোনাকি, মোদ্দা কথাটা এই যে তাঁরা গুরুদেব মানুষ, নিদেন পক্ষে মহা-নাগরিক বঙ্গীয় তীর্থবাসী। তাদের বিরুদ্ধে  রা কাড়াটাও পাপ। তাঁরা বাঙালির গৌরব। আনন্দ বাজার নইলে আর বাঙালি থাকল কই? তাই ওসব নিয়ে নয়, সরব হতে হবে যদি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা বিশেষ করে অসমের কেউ কখনো অমন বেয়াড়া প্রশ্ন তোলে , তাঁকে দাবড়া মেরে বসিয়ে দিতেই হবে। তা তিনি যতই বাংলা ভাষার শিল্প সাহিত্যের সেবক হোন---তাকে বাঙালি বিদ্বেষী কর্তাভজাদলের লোক বলে ছাব্বা দিতেই হবে! তাঁর লেখা ছাপানো চলবে না!  এই যেমন যুগশঙ্খেই প্রকাশিত অরূপ বৈশ্যের একটি  উত্তর সম্পাদকীয়তে পড়েছি ২৫শে এপ্রিল, তিনি লিখেছেন শিলচরেরই আত্মতূষ্ট মধ্যবিত্ত নিয়ে যাকে টেনে গোটা অসমের বাঙালি সম্পর্কেই বলা চলে, “সামাজিক মিলনের জায়গা নিচ্ছে শপিং মলের মত বাজারের প্রতিষ্ঠান যেখানে বিত্তবানরা শুধু পণ্যকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেই ভাবের আদান প্রদান করতে পারেন। অথচ কলকাতার তথাকথিত নবজাগরণ-পর্যায়ের ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণিরমত এদের গ্রামাঞ্চলের জমিদার-মহাজনি শ্রেণি-স্বার্থ না থাকায় এরা একটি প্রগতিশীল শ্রেণি হয়ে উঠতে পারত, সত্তরের দশকে এই প্রবণতা দেখাও গিয়েছিল। অন্যরা বিচ্ছিন্ন, যাদের কোন সামাজিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ভাবের আদান প্রদান হতে পারে, তাই তাদের জন্য যে সামাজিকতা বাকী থাকল তা দখল করে নিল ধর্মীয় উন্মাদনা। যেহেতু শহরের ভাষা-সংস্কৃতির সামূহিক চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার ও ধর্ম, সুতরাং এই প্রতিষ্ঠান-দ্বয়ই নির্ধারণ করবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সেটাই স্বাভাবিক। বাজার যে ভাষাকে চাইবে তাকে রাখবে, যাকে চাইবে না তাকে ধ্বংস করবে। বাজার আমাদের বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করবে না, কারণ বাঙালিরা ইতিমধ্যেই এই সংকটের বাজারে পণ্যের এক বড়সড় ক্রেতা, কিন্তু বাজার ভাষার রূপ-রস-গন্ধ শুষে নেবে শুষে নেবে তার জীবন ও প্রাণশক্তি।চিঠিগুলো পড়ে আমাদের মনে হয় নি কোনও প্রাণের ছোঁয়া আছে এতে।

নবেন্দু চক্রবর্তী এও লিখেছেন, বছর খানিক ধরে রবিবারের বৈঠক কৌলীন্য হারিয়েছে। তা তিনি লিখবেনই। কারণ তখনকার বৈঠকে এই সব বেয়াড়া প্রশ্ন কেউ তুলত না। অসমের বাঙালি জাহান্নমে যাক, কিম্বা অবনমন হোক তার সমস্ত বৌদ্ধিক শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের এই কুলীনসময়ে কোনও ভাবনা ছিল না। আমরা দেখিনি, আপনারা কি দেখেছেন কেউ
তবে কিনা, পরে আবার  বাসবদার লেখাটি পড়ে মনে হলো, আলোচনাকে কিছু ছড়িয়ে যাবার সুযোগ তিনিও করে দিয়েছেন।প্রশান্তের লেখাটি সেদিক থেকে একেবারেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ভিত্তিক।  পরে যদি উত্তর দেন, তবে যেন বস্তুনিষ্ঠ করে গুটিয়ে আনেন  এই অনুরোধ রইল। তাঁকে জগদীশ বোস, সৌরভ গাঙুলির নাম জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি যেন সেই প্রসঙ্গটাও টেনে আসেন কী করে, কোন প্রক্রিয়াতে শিলচরের  সন্তান বিজ্ঞানী বিমান নাথ কলকাতার দেশপত্রিকাতে লিখে লিখে কলকাতার হয়ে যান ক্রমশ। অসমের কোনও বাংলা কাগজ তাঁর জন্যে জায়গা করে নি এখনো, এই নিয়ে  হরি কীর্তনে কিম্বা ‘জাতীয় দুর্গোৎসবে’ ব্যস্ত  বাঙালির কেন কোনও আক্ষেপও নেই!  প্রশ্ন তুলবেন।
ইতি
সুশান্ত কর




No comments: