মানুষটা অল্প বিছানাতে পড়েছে, গায়ে গা লাগিয়ে ছেলে মণি বাবার মাথার চুলগুলো বিলিয়ে দিচ্ছিল। মালতী হাতে একটা চিরুনি নিয়ে বাইরের উঠোনে গিয়ে মুড়ো নিয়ে বসল। ঝলমল করে ফোটা লাল গোলাপ গাছে পড়ন্ত বেলার আলো এসে পড়াতে ফুলগুলোকে আরো বেশি লাল করে তুলেছে। সে চুল মেলে সেদিকে অল্প তাকিয়ে রইল। খুলে দেয়া চুলের গাছা মাটি ছুঁয়েছে গিয়ে। সে নারকেলের অল্প তেল হাতে ঢেলে নিলো। চুলের গাছা সামনে টেনে নিয়ে এসে হাতের তালুতে অল্প অল্প করে মাখতে শুরু করল। মায়ের সোনাতে বাঁধানো শাঁখা ক’গাছার থেকে কিটিং কিটিং করে শব্দ একটা হচ্ছে। শাঁখাগুলো ছুঁয়ে দেখল।আজ তার মাকে ভীষণ মনে পড়ল। সব সময় যেমন ভাবে , আজো ভাবতে শুরু করল, তার মা না জানি কেমন ছিল ! কোনও যুক্তি নেই, শাঁখা ক’গাছার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সে মনে মনে মায়ের একখানা ছবি আঁকবার চেষ্টা করল। মা ফরসা ছিল। চোখজোড়া ছোট ছোট । হাসলে প্রায় বুজে আসে। হাতপাগুলো ভরাট। কী পরিয়ে সে মায়ের ছবিখানা দেখে? শাঁখা ক’গাছাতে সে হাত বুলিয়ে দেখতে থাকে। একখানা লাল রঙের সোনালি পাড় দেয়া শাড়ি পরে হাসলে চোখ বুজে আসা এক মেয়েমানুষ তার সামনে এসে দাঁড়ান বটে। লাল শাড়িতে যেন তাঁকে কোথাও মানায় না। রোজকার মতো সে শেষ অব্দি লাল দখনাপরা এক মেয়ে মানুষকে দেখতে পায়। মানুষটির সারা গা লাল । তাতে হলদে সবুজে ফুলের কাজ করা এক হাত পাড়ের দখনাটিতেই যেন সবচে’ বেশি মানাবে। শাঁখার জোড়াগুলো সে সামান্য সময়ের জন্যে ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসে, মিহি নারকেল তেলের গন্ধ। এ যেন সে যে তেল মাখছে তার গন্ধ নয় । এ তার মায়ের গায়ের গন্ধ। কোনও যুক্তি নেই, কোনও কারণ নেই, সে শাঁখাগুলোতে মায়ের গন্ধ পায়। মশলা হলদি তেল, কাপড় ভেজাবার জন্যে করে রাখা সাবানের জল, উঠোন লেপার জন্যে নেয়া গোবরের জল, ধুয়ে থুয়ে রাখা মাছ, কাটা লাইশাক, বাটা সরিষা---হাতের শাঁখা ক’গাছাতে যা কিছুর গন্ধই লাগুক সে তাতেই মায়ের গন্ধটিই ঠিক খুঁজে পায় যেন। অযৌক্তিক , অকারণ। মায়ের কথা ভাবলেই তার বুকটা ভারি হয়ে আসে।
গায়ে মৌজাদারের বংশের রক্ত থাকাটাই পাপ ছিল , সে কি আর নিজের অর্জিত পাপ ? বাপ তারা গাছে ভরা ডোবাতে পড়ে থাকবার পর বাচ্চা মেয়েকে ঘরে রাখতে ভয় করত। বাপ মরার পর বাচ্চাটিকে বুঝি ধানের ডুলিতে পুরো সাতদিন সাতরাত ঢেকে রেখেছিল। রত্নমালাকে দেখে যেমন কিনারাম মাহুতের ডর ভয় মিলিয়ে গেছিল, তার মাকে দেখেও ক্ষিতীশ কারিগরের তেমনি হয়েছিল। শিলিগুড়ি শহরের সাত জায়গাতে গুঁতো খেয়ে বড় হওয়া ছেলে, এমনিতেও ডর ভয় কম। । হাতের বিদ্যে আছে, যেখানে সেখানে ভাত একমুঠো জোগাড় করতে পারবে। এই ছোট্ট গাঁয়ে কম দিনে ওঁর ব্যবসা বেড়েছিল। হাতে সোনাতে বাঁধানো শাঁখা পরিয়ে , শিলিগুড়ির লাল বেনারসিতে সাজিয়ে, চিনির রসে রসগোল্লা দেয়ার মতো বড় আলতো করে মিঠাইর কারিগর যুতিমালাকে হাফ ওয়ালের ঘরটাতে এনে ঢুকিয়েছিল। গাঁয়ের লোকে প্রাণ জুড়িয়ে খেয়েছিল আমির্তি, মুখে দিলেই গলে যায় এমনটি ছানায় তৈরি আমির্তি । কিনারামেদের সমাজের সব নিয়মই সে মেনেছিল। মেয়ের বাড়ির নেমন্তন্ন খাওয়াবার সমস্ত খরচই সে দিয়েছিল।শিলিগুড়ির থেকে ক্ষিতীশের আত্মীয় পরিজন যারা এসেছিল তারা সবাই তার ব্যবসাপাতি, বাড়িঘর দেখে কপাল চাপড়েছিল। দেশ-বাড়ির মেয়ে বিয়ে করলে সে ঘড়ি সাইকেল, রেডিও ছেড়েও সোনা আর নগদ টাকাও পেত। এখন আর ঘরে কিসের দুটো পয়সা আসবে ? উলটে বরং গেল। বৌভাতের দিন শিলিগুড়ির থেকে মিঠাই কারিগরের ভাগ্নি ভাতিজী যারা এসেছিল তারা যখন ময়ূরপঙ্খী রঙের বেনারসি পরিয়ে কনেকে বাহারি খোঁপা বেঁধে দিল, তাতে খৈয়ের মালা পরিয়ে কপালে লাল চন্দনের তিলকে সাজিয়ে দিল , তখন তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল মিঠাই কারিগরের মনটি ঠিক কোথায় এক মুঠো মচমচে ভুজিয়ার মতো হয়ে পড়েছিল।হাতে নিয়ে একটু চেপে দিলেই বেশ সহজে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়।
সে মাটিতে নারকেল তেলের কৌটাটা রাখতে চাইল , পারল না। পেটটা অল্প নিচের দিকে নেমে গেছে। সামান্য একটু ব্যথা যেন এই এলো, এই গেল। কোলের উপর তেলের বোতলটা রেখে সে পরম মমতায় শাঁখা ক’গাছা গালে লাগিয়ে বসে রইল। চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। বাতাসে চড় চড় করে কলাপাতাগুলোর নড়বার শব্দও এমন কি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে । এ যেন কলাপাতার শব্দ নয়, কালবৈশাখীর বাপের বাড়ি যাবার পথে প্রমত্ত বাঁশঝাড়ের বুক কাঁপানো শব্দ এ। বাড়িগুলোতে তালা, প্রায় মানুষই চলে গেছে। অসমিয়া, বাঙালি, বিহারি, বড়ো প্রায় সব বাড়িরই পুরুষ মানুষগুলো কোথাও থাকলেও পরিবারগুলো নেই। বাঙালিদের পুরুষমানুষেরাও নেই। মালতী পাশের শিবানীদের বাড়ির দিকে তাকালো। পথের মোড়ে ওদের ফার্মাসি রয়েছে, শিবানীর বাবা আর বড় দাদা আছে । বাকি পরিবারটি চলে গেছে। কোচ বিহারের মাসির বাড়ি গেছে। বাঁ পাশের সুভাষ মাস্টারের বাড়ির উঠোন এ সময়ে সাইকেলে ভরে থাকে। মাস্টার , “কী করছ হে লম্বোদর?” বলে ডাক একটা দিয়ে যায়। মণির বাবাও চেঁচিয়ে কখনো জিজ্ঞেস করে, “ ট্যুশন চলছে কি না?” আজ থমথমে নীরবতা। মাস্টারও নিজের পরিবারকে আলিপুরদোয়ারে পিসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামনের রতি সাহার বাড়িতে বুড়োবুড়ি দু’জন আছেন। ছেলে বৌরাও আছে। সমস্যা হয়েছে এই বুড়ো বুড়িকে নিয়ে। দু’জনেরই বাতের ব্যথা। দু’জনেই হাড় মাস এক করে , রক্ত জল করে বানানো ভিটে বাড়ি ছেড়ে যাবেন না । এমনিতেও মরবার বয়স হয়েছে। কেউ মারলেও মরা, এমনিতেও মরা। পেছনটায় বীরেন বৈশ্যের বাড়ি, পাট মুগার কাপড়ের ব্যবসা করে। অবস্থা বেশি ভালো নয়, ছেলে মেয়েও পাঁচটা। প্রায়ই মানুষটি মণির বাবার কাছে এসে হাত পাতে। বহু বছরের পুরোনো মানুষ এরা। যদিও রতি সাহাদের মতো নয়। সাহারা ধান পাটের খেত খামারে, গুয়া তাম্বুলের গাছে, গরু গোয়ালে ভরা গৃহস্থ।
কারো কাশির শব্দ শুনে সে মাথা তুলে তাকাল।মামণির বাবা ,মানে বীরেন বৈশ্য এসেছেন। মানুষটা এসেই ওর শাঁখাগুলোর দিকে কটমট করে তাকালেন ।
“তুই এখনো এগুলো খুলিস নি?”
সে মাথা নত করে। কেউ বলল বলেই কি সে এগুলো খুলতে পারে? কেউ কি বুঝবে তার মায়ের গন্ধটার কথা?
“মরবি! এই ক’টির জন্যেই মরবি! যখন আসবে হাতিতে গুঁড়িয়ে নিয়ে যাবার মতো নিয়ে যাবে।”
কী হলো?” মণির বাবা উঠে এসেছে। মালতী চা করবার জন্যে উঠে গেল।ভেতর থেকে সে কান পেতে মণির আর মামণির বাবার কথা শুনে গেল। ওরা সেই একই কথা গুণগুণাচ্ছে। মামণির বাবা আবারো সেই একটা করে গামছা পতাকার মতো দুই ঘরে উড়িয়ে রাখার কথা বলছে। মণির বাবা মানা করছে, “ এতো দিন এক সঙ্গে থাকলাম । আজ খারাপ দিন এলো বলেই...।” মণির বাবার স্বর কান্নার মতো শোনাচ্ছে। সে মামণির বাবার হাতটা চেপে ধরেছে, “ওকে কী করে বাড়িতে নিয়ে যাই? পুল নেই, রাস্তার হাল এমনটা। ঠেলা ধাক্কার চোটে বেটা মানুষের শরীরেরই হাড়ে মাংসে এক হয়ে যায় আর ওকে এই শরীরে...।” মালতী চায়ের কাপগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু পরোয়া করে না যে মানুষটা সেই সমর্থ মানুষটা আজ কেমন কেঁদে গলে যাচ্ছে। রতি সাহা এসেছে , সঙ্গে সাহার মা। বুড়ি হাতে করে এক কাঁদি কলা নিয়ে এসেছে। বুড়িকে দেখেই মালতী ‘দিদা’ বলে এগিয়ে গেল। বুড়ি ওকে ভীষণ আদর করে। বুড়ি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। তাঁর হাতে শুধু ছাল আর হাড়। ছাল ঝুলে পড়েছে। সাদা আঁকি বুঁকিতে ভরা ছালে কালো কালো ফুট ফুট দাগ পড়েছে। পাটি একটাতে বসে সে বুড়ির সঙ্গে কলকলিয়ে বাংলাতে কথা বলতে শুরু করেছে। বুড়ির সঙ্গে সে এমন করে বাংলাতে কথা বললে লম্বোদর বেশ আমোদ পেয়ে তাকিয়ে থাকে।সেও তার দরঙ্গীয় ধাঁচে দু’একটা বাঙলা বাক্য বলবার চেষ্টা করে। মেয়ে মানুষ দুটিতে হেসে অস্থির হয়ে পড়ে। মালতী আজ বুড়িকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করছে। ষাট ইংরাজির গোলমালের সময় মা কেমন করে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে রতন ঘোষের আধপোড়া ভিটেতে মরে গেছিল। সে কথা আজ সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল। বহুবার শুনেছে। কখনো বা বুড়ি তুলেছে, কখনো বা সে নিজে তুলেছে কথাটা লম্বোদর অল্প চুন নিতে এসে ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না। আবারো মাথা নুয়ে চলে গেল। মালতী বুড়ির কোঁচকানো মুখখানার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বলিরেখাতে ভরা একটি মুখ, মাথার চুল পুরো সাদা, ভুরু দু’টোও সাদা হয়ে গেছে। সাদা চুলের সিঁথিতে উজ্জ্বল লাল সিঁদুর, কপালে বিশাল বড় সিঁদুরের ফোঁটা।সমগ্র কান জুড়ে মিনা করা এক ময়ূর পাখি। লতিতে ঝুটির সঙ্গে মাথা আর কান জুড়ে পেখম তোলা লেজখানা। নাকে একটা ছোট্ট নাকফুল। বুড়ি কথা বলবার বেলা হাত নাড়িয়ে অঙ্গী ভঙ্গি করে কথা বলে। হাত নাড়ালে হাতের পলা আর শাঁখা ক’গাছার থেকে একটা শব্দ হয়। মালতী যেন এই রোদ পড়ে মাঝে মাঝে ঝিলমিলিয়ে ওঠা বুড়ির কানের পেখম তোলা ময়ূরটা, নড়ে ওঠা লালে সাদায় পলা আর শাঁখা ক’গাছা, কপালের সিঁদুরের ফোটার যাদুতে বাঁধা পড়েছে। সে সব ভুলে গেছে। গোলমাল , মণির বাবা, মণি এমন কি মাঝে মাঝেই ব্যথায় রাইজাই করা নিজের শরীরটিকেও। ময়ূরটি, শাঁখার জোড়া , ফোঁটাটা নাড়া চাড়া করছে। তারই মাঝে মাঝে তার মা তার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে।
“ বুড়ির শাঁখাগুলো একবার নিচে নামছে আরেকবার উপরে উঠছে, মাঝে মাঝে ডানে বাঁয়ে দুলছে।... গ্রামটির থকে শহরে ফুটবল খেলবে বলে বাসে করে দলটিকে নিয়ে যাচ্ছিল সুভাষ মাষ্টার। বাসে রোজ যেমন উঠে তেমনি মানুষ উঠেছিল। সেই ছেলেগুলোও কোনও একটাতে উঠেছিল। হঠাৎই মাষ্টার দেখল কোথাও যেন শব্দ একটা হয়েছে। না হবার মতো কিছু একটা হয়েছে। তাঁর কানে এসে পড়ল গোটা কয় শব্দ, ‘ এক পিস করেও ভাগে পড়বে না।” শব্দ নয়, যেন গলানো সিসে।মাষ্টার তৎক্ষণাৎ বাসটা থামিয়ে নিজের ছাত্রদের থেকে চারটাকে নামিয়ে দিলে। “ভাগে এক পিস করেও” না পড়ার কথা যারা সরবে বলছিল তারা হায়ার করা প্লেয়ার। মাষ্টার নিজের গাঁয়ের থেকে নিয়ে আসা নিজের ছাত্র কয়েকজনকে নামিয়ে দিয়ে ভাবল তাঁর নিজের শরীরটা বা ভাগে ক’পিস করে পড়বে? ছেলেগুলো গ্রামে ফিরে গেল। ভাষা আন্দোলনের গরম বাতাসের সামনে ফুলকি পড়ল, চারদিকে ধোঁয়া দেখা দিতে শুরু করল। বাসের থেকে নামিয়ে দেয়া গাঁয়ের ছেলেরা বেশ করে পাথর লাঠি নিয়ে টাউনে যাবে বলে বেরুল। ‘ভাগে এক পিস করেও পড়বে না’ বলে আশংকা করেছিল যারা সেই ‘হায়ার করা প্লেয়ার’ , অচেনা ছেলেদের দলও এগিয়ে গেল। বেলা চারটার থেকে হাতাহাতি, মারামারি, পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি। চারদিকে ঢিল ছুটে আসবার মতো গুজব রটল। হায়ার করা প্লেয়ারের দলটি রাতে ট্রাকে উঠে আসা বন্দুকধারীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এক ধার থেকে গাঁয়ের পর গাঁ জ্বলল।
বুড়ির চোখের জল কপালের ফোঁটার আকৃতি পাল্টে দিয়েছে...মালতীর মায়ের মালতীর মতো অবস্থা তখন। পেট নামছে। জলও ভাঙছে। গ্রামের লোক গাঁওবুড়া হরেন দাসের বিশাল মরাপাটের খেতের মাঝে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে বসেছে। গাঁওবুড়া থেকে শুরু করে গাঁয়ের মাতব্বর লোকেরা ট্রাকে যারা উঠে এসেছে সেই সব লোকেদের দলকে পাটখেতের মাঝে লুকোনো মানুষগুলোরনামগন্ধ পেতে দেন নি। ওঁরা চিঁড়া মুড়ি, নারকেল যা পারেন লুকিয়ে লুকিয়ে এই লুকোনো লোকজনকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। এমন কি পুকুরে বাসন কোশন ফেলে রাখতে, পাট খেতে ট্রাঙ্ক লুকোতে সাহায্য করেছেন। ‘হায়ার করা প্লেয়ার’ গুলো বাড়তে বাড়তে তিন চার ট্রাক হয়ে গেছে, হাতে হাতে লাঠি, বল্লম, পেট্রল , কেরোসিন। গাঁওবুড়া, শইকিয়া, বরা, হাজরিকারা কাঁপতে কাঁপতে দেখছেন চতুর্দিকে আগুন। এ আগুন পাটখেতের ভেতর থেকেও মানুষগুলো দেখছে। সেখানে এই বুড়িও ছিল। আগুনে লাল করে ফেলা আকাশের দিকে বুড়ি তাকিয়ে ছিল।
এবারে নাকের জলে নাকফুলটাও ভিজে গেছে...মালতীর মায়ের থেকে থেকে ব্যথা উঠছিল। তাকে বিছানার নীচে রেখে ক্ষিতীশ কারিগর একটু বাইরে গেছিল পরিস্থিতি দেখবে বলে। সঙ্গে সম্পর্কিত ভাই রতন। দু’জনেই দেখেছিল এক লরি বন্দুকধারী মুখ বাঁধা মানুষ, হাতে হাতে অস্ত্র। রতন ঝোপ জঙ্গলের মধ্যি দিয়ে পাট ক্ষেতের মাঝের জায়গা করে বসা মানুষগুলোর কাছে গিয়ে পৌঁছুলো। লরি আসবার খবর পেয়ে পাট খেতে না আসতে পেরে কেউ বা উপরে আগাছা আবর্জনা দিয়ে গর্তের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে, কেউ বা জঙ্গলে লুকিয়েছে। শুধু লুকোবার চেষ্টা করেনি ক্ষিতীশ। সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। বাড়িতে যে মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছে তার কী করে সে? এক বালতি জল তুলতে না দিয়ে , ভালোর থেকে ভালোটা এনে খেতে দিয়ে রেখেছে যাকে সেই ঘরের মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছে। দরকারের সময় লাগবে বলে টাকা পয়সা কিছু গুটিয়ে রেখেছিল। এখন সে পয়সাতে কী করে? সে হনহন করে রাস্তা দিয়ে হাঁটা দিল। কিছু একটা করতেই হবে। সেই তাকে শেষ দেখা গেছে। কেউ জানতে পেল না তার কী হলো। ঘরে যে মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছিল সে ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে রতনের বাড়ি অব্দি এসেছিল।
বুড়ির মুখের ভাঁজ আরো আঁকা বাঁকা হয়েছে। মালতী প্রায়ই যেমন শুনতে পায়, তেমনি জলে একটা ঝপাং করে শব্দ শুনতে পেল।মায়ের কথা উঠলেই সে শেষে ওই শব্দটি শুনতে পায়। হাতের শাঁখা ক’গাছা গালে লাগিয়ে সে বসে রইল। ওর শরীরটা যেন কেমন করেছে। কেউ ওকে ডাক একটা দিয়ে গেল। গাঁ ছেড়ে যাওয়ার পথে কেউ হবে বুঝি বা। মাকে ডেকে নিয়ে যেতে বুড়ির ছেলে এলো। বুড়ির ছেলের থেকেই জানতে পেল পাটখেতের মাঝে জায়গা করা হয়েছে। নারকেল চিঁড়া মুড়ি গোটানো হয়েছে। জায়গায় জায়গায় গর্ত করে আগাছা আবর্জনাতে ঢেকে রাখা হয়েছে। গেলবারের গণ্ডগোলের সময় বহু মানুষ এই গর্তে ঢুকেই প্রাণ বাঁচিয়েছিল।মানুষগুলো বারে বারে গেলবারের গণ্ডগোলের কথা পাড়ছে।
আগুন দেয়া দলটি রাতে আগুন দিয়ে সকাল থেকে আর আসে নি। হাতে বন্দুক এক দু’টোই ছিল পুকুরের বাসনপত্র, ঝোপঝাড়ে রাখা বাক্সপত্রে হাত দেয় নি।পাটখেতের ভেতরের মানুষগুলো কিছু রাত থাকতেই বেরিয়ে বাড়ি ঘরে ফিরে এসেছিল। আগুন নিভিয়েছিল। পুকুর থেকে বাসনপত্র তুলেছিল। ঘুরে ঘুরে মিঠাই কারিগরের কথা উঠছিল। কেউ একজন ক্ষিতীশ নিখোঁজ হবার পরদিন কুকুরে টানাটানি করে শতচ্ছিন্ন করা রক্তমাখা সার্ট একখানার কথা বলছে।
ভীষণচাপা গলাতে বলাবলি হচ্ছিল এ গাঁয়ে ওরা আসবেই । এখানেই বিয়ে হয়েছিল রত্নমালার মেয়ে যুতিমালার। যুতিমালা এখানেই মিঠাইর কারিগরের গৃহিণী হয়েছিল। এখানেই আছে যুতিমালার মেয়ে। মৌজাদারের বাড়ির একটি ছেলে আন্দোলনের বড় লিডার। গুয়াহাটির থেকে সমস্ত নেতাগুলো এলে ওখানে থাকে। বহু কথা উঠছে। গেলবারের গণ্ডগোলের বেলা লোকগুলোর হাতে যে বন্দুক ছিল সে বুঝি ঐ মৌজাদারেরই বাড়ির বন্দুক।প্রথম রাতে এ গাঁয়ে এ জন্যেই আক্রমণ হয়নি যে বন্দুকটি অন্য গাঁয়ে গেছিল। মিঠাই কারিগরকে বুঝি পেছন থেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে গুলি করেছিল। অনেক কথা উঠছে, আগা নেই গোড়া নেই, জাতে জাতে কথা। ঘুরে ঘুরে কথাগুলো এসে ঐ এক জায়গাতেই জড়ো হয়। এবারে আর বন্দুক একটা নয়, হাতে হাতে বন্দুক। মৌজাদারের বাড়ির নেতাটি বুঝি এবারে এই গ্রামটিকেউপড়ে ফেলে তবে ছাড়বে। গুয়াহাটির দু’জন বড় লিডার এসে শহরের হাইস্কুলের ফিল্ডে সভা করে গেছে বুঝি। সভাতে অসমিয়া মানুষকে ওরা দয়া মায়া, আদর স্নেহ ইত্যাদি ভুলে যেতে বলে গেছে। বলে গেছে মানবতা, মানুষ এই শব্দগুলো ভুলে নিজেদের কঠিন করে তুলতে। কেউ একজন গুয়াহাটির নেতা বুঝি মৌজাদারের বাড়িতেই আছে। ওর হাতে বুঝি এমন বন্দুক রয়েছে যেটি ঘুরালেই পাখি মারবার মতো মানুষ মারে। একই ধরণের কথাগুলোকে ফেনানো হচ্ছে। শোনা কথাটাকে বলছে নিজের চোখে দেখা, চোখে দেখা কথাটাকে বলছে নিজেরই কথা। মাথা মুণ্ডু নেই, দাড়ি কমা নেই, লম্বা লম্বা ভাষণ।
সবাই লম্বোদরের উঠোনের থেকে দেখতে পেল গাঁওবুড়া পরিবার নিয়ে, জিনিসপত্র সহ যাবার জন্যে বেরিয়েছেন। সবাই উঠে রাস্তা অব্দি গেল। সবারই গলা শুকিয়ে গেছে। নিজের পাটখেতে যিনি সবাইকে জায়গা করে দিয়ে আশ্রয় দেন, যিনি লরিতে আসা লোকগুলোর একা একা মুখোমুখি হন , ঘর বাড়ি পোড়া মানুষগুলোকে নিজের বাঁশঝাড়ের থেকে বাঁশ দিয়ে যিনি অভয় দেন সেই মানুষটি আজ পরিবার নিয়ে যাবার জন্যে বেরিয়েছেন! লম্বোদরদের মুখে রা নেই। তাঁর মুখখানা ভয় আর আতঙ্কেসাদা হয়ে গেছে। লম্বোদরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ আগুনে যখন পোড়ায় লাকড়ি , বাঁশ, খের কিচ্ছু মানে না। হাভাতে মানুষ হয়ে আগুনের সঙ্গে কী যুদ্ধ করবি?” বৃদ্ধ মানুষটির স্বরটা বসে গেছে , “এ আগুন কারো ভালোর জন্যে জ্বলে নি । কোনও সাধারণ মানুষের সাধ্য নেই একে বাধা দেয়, সব্বাইকে পুড়িয়ে ছাই করবে।” এবারে বৃদ্ধ লাঠিটা ধরে বসে পড়লেন, “ আমার কুকুরটা কোনও কাজের নয়, শুধু পড়ে পড়ে খায়। ওর উপরেই পিতৃপুরুষের ভিটেমাটির ভার দিয়ে যাবার জন্যে বেরিয়েছি। বুড়ো বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছেন,“ যমে মানুষে টানাটানির দিনে আর পাপ বাড়াব না।”
দৃঢ়চেতা মানুষটিপা ফেলতে গিয়ে কাঁপছেনদেখে সব্বাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। নিমেষে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো কাল ভোরেই সবাই এই গ্রাম ছাড়বে। নেবে, মালতীকে পাঁজাকোলা করে হলেও নিয়ে যাবে। আজ রাত্রিটা শুধু পার হোক।
4 comments:
i see you have used the axamiya 'ya' in the bengali script :-) reminds me of so many instances where - just as the people of assam have taken from the bengalis - bengalis of assam have also adopted so many idioms and idiosyncracies of the other communities of assam. this give and take is true of every community living in assam. and yet, we had the assam movement, and yet, we continue to hear of ethnic cleansings. novels like 'phelani' help us go beyond our petty search for narrow, exclusivist identities and i am glad you have taken up the task of translating it.
Oho! You anticipated I might have write, 'আসামী(!)' Ha Ha Ha ! Thanks for your stirring words.It will make others to follow the novel. If propagated well I hope this novel will be considered as one of the best classic in the Indian literary history!
really true!! darun lagche ...Plz carry on.. We are with you...
I will! The journey of Phelani has started from the chapter Four! It's terrible. Your words give me enough strength to keep going!
Post a Comment