আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Saturday 10 May 2014

অধ্যায় বিশ (২০)


              

বুড়োর দোকানের দিকে চোখ পড়তেই ওর শরীরটা কেমন কেমন করতে শুরু করল। কী করে যে ধ্বসে গেল পুরো একটা পরিবার।সেবারে টাকা নিতে এলে মেজো ছেলেটা মারা পড়ল। যারা জড়ো হয়েছিল, তাদের আর বুড়োর নিজের মানুষের সঙ্গে ওদের একটাও মরল। তার এক সপ্তাহ গেল কি গেল না বুড়োর ছোট ছেলেটাকেও মেরে রেখে গেল। তারপর পুরো চারবার আক্রমণ করে বুড়োর পরিবারের জনা ছয় মানুষ মেরে ফেলল। বুড়ো দোকান গুটিয়ে দেশে চলে গেল। এখন ওদের সংগঠনের নাম শুনলেই লোকে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে থাকে। একটা ছোট্ট চিঠি হাতে পড়লেই মোটা অংকের টাকা ওদের পায়ে দিয়ে আসে গিয়ে।
     আজ মণির মায়ের বাজারে আসতে সামান্য দেরি হলো। মোড়া পাঁচটা এনেছিল। একজোড়া বাকি ছিল। সেই দুটোর আশাতে সে অনেক বেলা পর্যন্ত বসে রইল। মোড়াগুলো অবশ্য শেষে বিক্রি হলো। মিনতি আর জোনের মা চলে গেছে, ঘরে বাচ্চা ছেলে রেখে এসেছে। ওদের ছেলেমেয়ের পেনপেনানি শেষ হয় নি। ওর ছেলেটাই আজকাল বোঝদার হয়ে উঠেছে। সবাই মণির প্রশংসা করে। এমন ছেলে বুঝি বহু সাধনা করেই পায় লোকে। মায়ের কত দুঃখ বোঝে! সে সংসারটাকে ধরেছে বলেই প্রাণী দুটো টিকে আছে। কটা ছোট ছেলেই বা সেদিকে তাকায় যে মায়ের থালাতে কি আছে কি নেই? নিজে খেতে পেলেই হলো, পারলে মায়ের থেকেও নিয়ে যায়। মা গিয়ে না পৌঁছুনো অব্দি রাস্তার পাশে কেমন দাঁড়িয়ে থাকে। লেখাপড়াতেও ভালো এতো কষ্টের মধ্যেও ছেলেটা মন দিয়ে পড়ছে। যে কাজই করবে মন দিয়ে করে। তার নতুন ক্লাস শুরু হয়েছে, বইপত্র চাই। মোড়া ক’জোড়া বিক্রি করে ওর বুকখানা একটু শক্ত হলো। টাকা কিছু বেরুলো যদি ছেলের খরচাপাতির জন্যে কোনও ভাবনা নেই। আবার বা কবে বাজার বসে! কোথায় কী ঘটনা ঘটে বলা তো যায় না। বুড়োর দোকানের ঘটনাগুলোর জন্যেই বেশ ক’তা বাজার গেল। ছেলের ডিমগুলো বেচা গেল বলেই ভাতের জোগাড় হতে পেরেছে। এ পর্যন্ত সে নিশ্চয়ই হাঁসমুরগিগুলো তুলে নিয়েছে। পড়তে বসছে কী? না কি চুলোতে আগুন দিয়ে ভাত বসাবারই চেষ্টা করছে। কীই আর আছে ঘরে! চালের পাত্রটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল, আধার থেকেও কম আছে। থাক, আজ চাল না হলেও চলবে। আসছে বাজারে নেয়া যাবে। সে নিশ্চয় ভাত বসিয়েছে, তাতে ডিম আলু সেদ্ধ দিয়েছে হয়তো। ডাল , মিঠা তেল কিছুই নেই। সে ভাতের সঙ্গে ডিম আলু সেদ্ধ করতে ভালোবাসে, সহজ হয়। ফেলানির মনটা ছেলের জন্যে আনচান করতে শুরু করে। এই বয়সে এতো চিন্তা ওর মাথায় ঢুকেছে! কীই বা পেয়েছে সে। কিছুতেই কোনও আপত্তি করেনা, কোনও রকম দাবিও নেই তার। ছেলের জন্যে কিছু একটা কেনার ইচ্ছে হলো ওর। তার কলমটা খারাপ হয়েছে, একটা কলম হলে পরীক্ষাতে লিখতেও ওর সুবিধে হবে। সে জোরে নবীনের দোকানের দিকে পা চালাল।
     নবীন ওর বইপত্র প্রায় গুটিয়ে ফেলেছিল। ফেলানি কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
    “মামী , আজ দেখি একা?” নবীন আজকাল ওকে মামী বলে ডাকে। একদিন কথাপ্রসঙ্গে মণির বাবার শহরের বাড়িটার কথা উঠেছিল। সেই বাড়িতে নবীনের পরিবারের কোনও মহিলার বিয়ে হয়েছে। সেই সূত্রেই নবীনের মামী হবার উপাধিটা পেয়েছে।
     “আর বলো কেন, বাকিদের ছেলেমেয়ের ঝামেলা আছে, তাড়াতাড়ি চলে গেছ। আমিই একজোড়া মোড়ার জন্যে বসে রইলাম।”
    “মোড়া বিক্রি হলো কি না?”
    “হ্যাঁ, হয়ে গেছে! আমার ছেলের হাতের জিনিস পড়ে থাকবে বুঝি?” ওর মুখে একটা গর্বের হাসি।
    “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। মণির মতো ছেলে ক’জনের ভাগ্যেই বা জোটে?”  নবীনের মুখ কালো হয়ে এলো, “মামী , আমার ভাইটাও মণির মতো ছিল, কিন্তু ওকে যে পাহাড়ের আগুনে ডেকে নিয়ে গেল।”
     কী বলবে কী বলবে না ভেবে মালতী দাঁড়িয়ে রইল। নবীন জোরে হাত চালিয়ে ওর দোকান গোটাচ্ছে, “ কিছু নেবেন মামী?”
    “মণির জন্যে একটা কলম লাগছিল।”
    কলমটা সে নিজেই হাত লাগিয়ে বাছতে বাছতে নবীনের বড় বড় বেগগুলোতে দোকান সামলানো হয়ে গেছে। সাইকেলে বেগ তোলাও হয়ে গেছে।
  
  “মামী হলো?” কলমের বাক্সটাই শুধু ভরাবার বাকি। সে একটা কালো আর একটা নীল কলম নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলে। শেষে কালোটাই নিলো।
     “পয়সা...?”
    “মামী, কই আর পালিয়ে যাবেন? বাড়িতে নেব গিয়ে।” নবীন হাসছে।
    “সাইকেল ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে নবীন, কাছে কাছে সে।
    “মামী, মুড়ির টিনটা সাইকেলে তুলে দিন।”
    “না লাগবে না, তোমার বোঝাটাই তো বেশ ভারি দেখি।তোমার ব্যবসা কেমন চলছে?”
     “চলছে , বাজার ঠিকমতো চললে চিন্তা থাকে না।”
    “হ্যাঁ, বাজারটা নাহলেই মাথায় বাড়ি পড়ে।”
     “কই আর বাজার ঠিকমতো বসে? কিছু না কিছু একটা লেগেই থাকে।”
     “ব্যাংকে যে ডাকাতিটা হয়েছিল, তারপর চারটা বাজার মারা গেল।”
    “সে কি আর কম কিছু হলো সেবার?”
    “তুমি ছিলে না ব্যাংকে?
    “ আমি যে দোকান থেকে বইপত্র আনি তার মালিকের ছেলে একটা পাসবুক খুলে দিয়েছিল, তারই মাসিক কিস্তি জমা দিতে গেছিলাম।”
     “ডাকাতগুলো মুখে কাপড় বেঁধে এসেছিল?”
    “না না, তা আসেনি। আপনি তো বুড়োকে যখন সংগঠনের ছেলেরা এসে এট্যাক করে তখন সেখানে ছিলেন?”
    
       
  মালতীর কানে শব্দটা যেন ঝনঝনিয়ে উঠল, ‘এট্যাক!’ সন্ধ্যে গড়িয়ে রাতের শুরু হয়েছে। পুব দিকে জ্বলে উঠেছে একটুকরো দাউ দাউ আগুন। ভেসে আসছে নাগারা আর শঙ্খের শব্দ। দাউ দাউ আগুনে গ্রাস করে ফেলছে ঘরের পর ঘরের সারি। আগুন থেকে একটাই শব্দ বেরুচ্ছে, “এট্যাক, এটাক, এইটেক, আটেক, উটেক...” শব্দগুলো স্ফুলিঙ্গের মতো মানুষের ভিড়ে গিয়ে পড়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে। পোড়া দাগ গায়ে নিয়ে একটা খুটাতে প্যাঁচিয়ে আছে সাপ একটা, দুটো চাকার মতো দুলছে ওর বাকি শরীর...।” মালতীর শরীর শিউরে শিউরে উঠল।
     সন্ধ্যা নেমে আসছে, আগুনের তাপ নিয়ে একটা শব্দ ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওর কানে গিয়ে ঝনঝনিয়ে উঠছে।
     “মামী, কীসব যে আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমি একটা জোয়ান ছেলের মরা লাশ ডিঙ্গিয়ে পেরিয়ে এসেছিলাম। মরা লাশ ছিল না মামী! জ্যান্ত মানুষ ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছিল। ওর চোখদুটো...ওর বুক থেকে ছলকে ছলকে রক্ত বেরুচ্ছিল। ওর চোখদুটো ছিল আমার ভাইয়ের মতো। ওর ঠোঁটের থেকে বেরুনো শব্দগুলো শুনবার জন্যে আমি ঝুঁকেছিলাম, কেউ আমাকে লাথি মেরে দিয়েছিল , বুট জুতো পরা পায়ের লাথি, মামী...” মানুষটা কাঁপছিল।
     “ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা ছেলেগুলো আর বুড়োকে...” ‘এটাক’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে মালতী থেমে গেল, ঠিক যেমন সন্ধ্যে হলে সাপের নাম নিতে গিয়ে, অমাবস্যার দিনে যেমন মরা মানুষের নাম নিতে গিয়ে থেমে যেতে হয়—তেমনি।
     “একই পার্টি, একই সংগঠন।”
    সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। আর তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। মণি নিশ্চয় পথের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের দেরি হলে মণির রাগ উঠে। মালতী বুঝে তার বেচারার মায়ের জন্যে ভাবনা হয়। নিয়ে আসতে না বলেও যখন কলমটা হাতে পাবে তখন ওর মুখটা দেখতে কেমন হবে? ওকে টাউনের দিকে আসতে হবে না। কোথায় কী হয়ে যাবে। সে তার উপর এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াবার ছেলেও নয়। স্কুলেও যায় আর বাড়ি আসে। শুধু ঐ রিজার্ভে পারলে রোজ যায়। জঙ্গলের মধ্যের খালবিলের মাছ, গাছের শুকনো ডাল--- ওসবের খোঁজে সে অস্থির হয়ে থাকে। লাগবে না ওকে রিজার্ভে যেতে, লাগলে লাকড়ি কিনেই নেবে। জঙ্গলে আজকাল অচেনা ছেলেদের দেখা মেলে।
   
       
  ওরা সেই জঙ্গলটা পেরিয়ে যাচ্ছে। শালগাছগুলো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে এসেছে। সেগুন, তিতা-চাঁপা, চামগাছগুলোও এতো বড় হয়ে গেছে যে একটা মানুষ লাফ দিয়েও নাগাল পাবে না। জায়গাটা থমথমে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। কালো জঙ্গলে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকা জ্বলছে নিবছে।
     “মামী জানেন তো? ব্যাঙ্ক ডাকাতির আগের দিন ওরা বুঝি এখানে এসেছিল। কেউ কেউ বলে সবগুলো ছিল, কেউবা বলে দুটো ছেলে ছিল। আমার চোখের সামনে ছেলেগুলো যেন শূন্যে পাক খেয়ে খেয়ে গাড়িতে চড়ছিল। ওদের কি কম ট্রেনিং আছে বলে ভেবেছো?”
     “টাকাগুলো তো সব নিয়ে গেছে।”
    “অনেক টাকা নিয়েছে! শুধু কি আমাদের এখানেই ব্যাঙ্ক লুঠ করেছে? কত জায়গাতে যে লুটছে। আমাদের এখানে নাহয় কেউ মরেনি। কত জায়গাতে যে মানুষ মেরেছে!”
    “সেই ছেলেটা...” নবীনের ভাইকে মনে পড়িয়ে দেয়া ছেলেটির কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল মালতী।
    “সে সংগঠনের ছেলে ছিল।”
    “এই ছেলেরা চায়টা কী?”
    আন্দোলন করে সেই পার্টিটা তো রাজপাটে বসল। ওদের আর কী চাই! নিয়ম করে রোজ কাগজ পড়ে নবীন, তার দিকে বড় আগ্রহে তাকিয়ে রইল মালতী।মিনতি বলেছিল এরা দেশ স্বাধীন করতে চায়। দেশটা দেখি এমনিতেই স্বাধীন। নবীনকে এসব জিজ্ঞেস করতে ওর লজ্জা হলো।
     “আগেরগুলো তো বিদেশি তাড়িয়ে সোনার অসম গড়বে বলে মানুষকে বোকা বানালো। এরা বলছে অসমকে ভারত থেকে আলাদা করে এনে স্বাধীন করবে। সব্বাই এক, সবারই লুটেপুটে খাওয়া চাই, রাজা হওয়া চাই। মাঝে পড়ে এই আমাদের হয়েছে মরণ।”
     ওরা এসে বস্তির কাছ চেপেছে। নবীন দাঁড়ালো। মালতী এই জায়গাতে ঢুকে যাবে, সে সামনের গলি দিয়ে। নবীন লজ্জা মাখানো হাসি একটা হেসে তাকালো। কিছু একটা বলতে চাইছে।
     “মামী! আমার বিয়ে।”
    “তাই বুঝি? কোথাকার মেয়ে?”
    “আমি যে দোকান থেকে বইপত্র আনি, সে দোকানের ছেলেটিই ঠিক করে দিয়েছে। আমি যে বলেছিলাম ব্যাংকে পাসবই খুলে দিয়েছে বলে, ওকে আমার মাঝে মধ্যে নিজের ভাইয়ের মতো মনে হয়।”
    নবীনের মুখ থেকে লজ্জার হাসিটা চলে গেল। ভাইটির কথা উঠলেই ওর চোখের দিকে আর তাকানো যায় না। পোড়া কয়লার মতো কালো হয়ে আসে, চোখের পাতা পড়ে না।
  
  মণি দৌড়ে আসছে। কলমটা পেয়ে সে হেসে ফেলল। ওকে দেখে নবীনের মুখ থেকে পোরা কয়লা খসে পড়ল। পাগলাটে চোখের জায়গা নিয়েছে এক টুকরো হাসির ঝিলিক। ভরা সাইকেলটার জন্যে নবীন মণিকে গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে পারে নি। কিন্তু ওর পুরো শরীরে মণির জন্যে আদর উপচে পড়ছিল। মা মরা ভাইটাকে সে কত ভালোবেসেছিল। নিজে অনাথ হয়েও জন্ম দিতে গিয়ে মা মরা ভাইটাকে নিজের হাতে বড় করেছিল সে। মালতীর বুকটা কেমন করে উঠল। ওর গায়ে আঁচ একটা পড়তে না দিয়ে রেখেছিল যে মানুষটি। কত মানুষ যে হারিয়ে গেল। সে ঘোপ করে মণিকে ধরে ফেলল, “মণি, তোকে আর রিজার্ভে যেতে হবে না।”
    “কেন মা?”
    “যেতে হবে না, ব্যস!” মালতীর স্বর ভয়ে কাঁপছে।
    “ ওখানে যেতে হবে না, ওখানে বাজে লোকেরা আসে।” নবীন মণিকে কাঠ পেন্সিল একটা দিল। নবীন চলে যাবার পথে ওরা দু’জনে খানিক তাকিয়ে রইল।
    “কোন বাজে লোক রিজার্ভে আসে মা?” মায়ের হাত থেকে মণি মুড়ির টিনটা নিলো।
    “এই দু’হাতে দেশ লুটেপুটে খেতে চায় এমন মানুষ কিছু।”
    বোঝে না বোঝে মণি মায়ের কথাতে মাথা নাড়ল।
    “লুটেপুটে কীকরে খায় মা?” ছেলেটা ভাবছে, “ সেই যে কাপড়ের দোকানিকে মারল, সেরকম? তাই না মা?”
    ছেলের মুখে অমন কথা ওর ভালো লাগেনি।
    “তুই কিছু খেলি মণি?”
    “খাইনি মা, একসঙ্গে খাবো বলে অপেক্ষা করছি।”
    মায়ে-ছেলেতে দু’জনে দু’জনার গায়ে গা লাগিয়ে ভেতরে চলে গেল।

                       

No comments: