ফেলানি
চাল প্রায় পাওয়াই যায় না । অল্প যেটুকে আসে মানুষে কাড়াকাড়ি লাগিয়ে দেয়। সে আর মণি প্রায়ই ওই কাড়াকাড়ির মধ্যে গিয়ে ঢুকতে পারে না। ওদের ভাগের চাল প্রায়ই বুলেন গিয়ে এনে দেয়। বুলেন শরণীয়া১মানুষ। ফেলানিকে নিজের বলে ভাবে। কিনারামের লতায় পাতায় ও কিছু একটা হয়ও। সেই সূত্রেই সে ফেলানি আর মণিকে নিজের বলে ভাবে। বুলেন ওর মা না দিদিমার থেকে যেন কিনারাম রত্নমালার গল্প শুনেছে। বুলেনই আগে ভাগে গিয়ে ওদের ভাগের টিন ক’খানাও গুটিয়ে দিয়েছিল। পয়সাপাতি সেও পায়নি, মণিরাও পায়নি।
বুলেন ছেলে ভালো , স্বাস্থ্যও ভালো। শরীরের রঙ লালচে সাদা। চোখদুটো অল্প ছোট, নাক তীক্ষ্ণ। মাথাতে চুল আর মুখের দাড়িও ঘন। বুলেনদের গাঁয়ের মানুষের চেহারা পাতি সাধারণ বডো মানুষের থেকে অল্প আলাদা। ওদের গ্রাম সম্পন্ন গ্রাম। বুলেনের অবস্থাও ভালো। খেত খামার রয়েছে। বছরের খোরাকি বাদেও কিছু ধান বিক্রিকরতে পারে। বাড়িতে কর্মী মানুষ বুলেন মাছ দুধ ডিমের ব্যবসা করেও দু’পয়সা রোজগার করে। ও বিয়ে করেছে মাধব দাসের বোন সুমলাকে। মাধব দাস সে অঞ্চলের একজন সুপরিচিত বামপন্থী কর্মী। একদল মানুষ মাধব দাসকে যেভাবে মনে প্রাণে ভালোবাসে আর দলের কাছে তিনি তেমনি কালশত্রু। বিশেষ করে সেই যেবারে তাঁর পার্টির কর্মীরা জমি দখলের আন্দোলনে জয়ী হয়ে কয়েকজন কৃষকের জমির দখলী স্বত্ব ঘুরিয়ে দিল সেবার থেকে তাঁর আরো অনেক শত্রু বেড়ে গেল।
সেদিন বোনকে দেখতে মাধব দাস এসেছিলেন। এসেছিলেন মানে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। সুমলা-বুলেনের প্রথম সন্তানের অন্নপ্রাশনছিল। বুলেনের ইচ্ছে ছিল লোক ডেকে এনে পুকুরের রঙিন রৌ মাছ দিয়ে ভাত দুমুঠো খাওয়াবে। দেশের অবস্থা দেখে মনের কথা মনে চেপে মামাকে ডেকে কাজটি সংক্ষেপে সারাই ঠিক করলো। ও বেছে বেছে জাল ফেলে লাল হয়ে ওঠা একটা রুই মাছ তুলেছিল। এক জোড়া পায়রাও মেরেছিল। সুমলা সেই সকাল বেলা স্নান করে গিয়ে রান্না ঘরে ঢুকেছিল। ঘর উঠোন সেই তাজা মাছের ভাজার গন্ধে মোঁ মোঁ করছিল। গোবর মাটিতে লেপা উঠোনে খিলখিল করে খেলছিল দাসের ছোট্ট ভাগ্নেটি। মামা ওর জন্যে একটা জামা ছাড়াও এনেছিল একটা স্লেট, ‘কুঁহিপাত’ ২এবং পেন্সিল। মাধব দাসের সঙ্গে এসেছিল পার্টির কর্মী রত্নেশ্বর বৈশ্য। ভাত বাড়া হয়েছিল। মামা ভাগ্নেরমুখে প্রথম অন্ন বলে পায়েস এক চিমটে দিতে গেছিলেন। ঠিক সেই সময় ‘জয় আই অসম’৩ বলে ধ্বনি দিয়ে এক দল ছেলে বুলেনদের বাড়িটাকে ঘিরে ফেলল। বুলেনের সে ভয় ছিল। সম্বন্ধীর জন্যে তাকেও বহু দিন বহু কথা এই আন্দোলনকারীদের থেকে শুনে সহ্য করে যেতে হয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীদের বলে রেখেছিল অল্প চোখ কান খোলা রাখতে। কে কোন দিকে চোখ রাখবে ? ছেলেগুলো হাতা হাতে দা, সাইকেলের চেন, লাঠি বল্লম নিয়ে এসে পুরো বাড়িটা ঘিরেই ফেলল।
“বদনকে৪ বের করে দে!”
“ ঘরের শত্রু বিভীষণকে শেষ করে ফেল!”
“ বেরিয়ে আয় কুকুর !”
“দুটো বদনকে আজ বলি দেয়া হবে!”
চিৎকার চেঁচামেচিতে সুমলার লেপা মোছা উঠোনখানা ভরিয়ে তুলল। সুমলা আর বুলেন বাচ্চা মেয়েকে কোলে করে নিয়ে বেরিয়ে এলো। নমস্কার জানিয়ে গলবস্ত্রে এই চ্যাংড়া ছেলেগুলোকে সরাইতে৫ করে পান তাম্বুল৬এগিয়ে দিল । দু’জনেই ওদের বলতে যাচ্ছিল যে এই শিশুকে মুখে ভাত দেবে বলে ওর মামা এসেছে। কিচ্ছুটি বলতে পেল না। ভেতর থেকে রত্নেশ্বর আর মাধব দাস বেরিয়ে এলেন। জংলি৭কুকুরের পাল যেমন শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি সেই ছেলেগুলো মাঝবয়সী এই মানুষ দুটোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভাঁড়ার ঘর থকে দা একটা নিয়ে চিৎকার করে বুলেন ওদের তাড়িয়ে গেল। জনা দুয়েকে মিলে বড় লাঠিতে ঘা দিয়ে ওকে ভাঁড়ারের সামনেই ফেলে দিল। কাছে রাখা এক মকৈর বাঁধা আটির উপর বুলেন পড়ে গেল। ওর মুখের রক্তে লাল হয়ে গেল ওরই হাতে চাষ করে গুটিয়ে রাখা মকৈর সোনালি রঙ। এমন ঘটনা দেখে যারা জড়ো হয়েছিল সেই পাড়া প্রতিবেশিরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদেরই দু’একজন বুলেনকে তুলে নিয়ে গিয়ে নাগা ঘাস কিছুটা থ্যাঁতলে ক্ষততে লাগিয়ে দিল।ভাগ্য ভালো যে উপরে উপরে কিছুটা আঘাত পেয়েছে। খানিক পরেই রক্ত পড়া থেমে গেল। একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ওকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল। মানুষটি সেখানে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইল।
মাধব দাস আর রত্নেশ্বর বৈশ্যকে ওরা হাতে পায়ে গলাতে রশি বেঁধে টানতে শুরু করল। দেড় কিলোমিটারের মতো পাথরে ভরা পথে ওরা ওদের টেনে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে গেল। নিজেদের পার্টি অফিস পাবার আগে ঐ জংলিকুকুরেরা মানুষ দুটোর হাতের আঙুল কেটে টুকরো টুকরো করে পথের কুকুরকে খেতে দিল। ওদের শরীরের রক্তে পথের পাথর লাল হয়ে গেল। পাগল কুকুরগুলোর পেছনে পেছনে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়োচ্ছে সুমলা, “দাদা! ও দাদাগো! আমি তোমাকে ডেকে আনলাম গো...ছেড়ে দে ছেড়ে দেরে আমার দাদাকে...!” মাধব দাসের আঙুলই ওরা প্রথম কাটল। আঙুলটা দেশি কুকুর একটার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে একজন বলল, “ নে খা রে! বদনের মাংস, টেস্ট আছে।” ডান হাতের মধ্যমাটি অল্প শুঁকে কুকুরটি লেজ তুলে দৌড়ে পালালো। সুমলা সেই কুকুরটির দিকে তাকিয়ে সেখানেই গড়িয়ে পড়ল। একজন বডো চাষি ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাড়ি নিয়ে গেল। চোখে মুখে জল ছিটিয়ে ওর জ্ঞান ফেরবার চেষ্টা করল।
পার্টির কার্যালয়ে মাধব দাস আর রত্নেশ্বর বৈশ্যের শরীরের ছাল তুলে তুলে নুন আর খার মাখে দেয়া হলো। চোখ দুটো খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলল। এক সময় বদন নীরব হয়ে গেল।
বুলেনদের গাঁয়ে সেদিন কারোরই ঘরে চুলো জ্বলে নি। বুলেন, সুমলা আর ওদের বাচ্চা ছেলেটিকে ঘিরে গ্রামের মানুষ সারা রাত জেগে কাটিয়ে দিল। গ্রামের থমথমে নীরবতাকে যেন সুমলা নিজের বুকে বেঁধে ফেলেছে। সেই যে নীরব হলো, আজ অব্দি ওর গলাতে কোনও স্বর বেরোয় নি। হাসি খুশি মানুষটি পাথরের মতো জড় হয়ে গেল। তার কিছু দিন পরেই বুলেনদের ঘরে আগুন দিল। পাথর প্রায় স্ত্রী আর শিশু পুত্রকে বুকে তুলে নিয়ে বুলেন এই শিবিরে এসে উঠল।
মণির মা প্রায়ই তাকিয়ে দেখে , বুলেন হাজিরা করে এসে বৌয়ের মুখ হাত ধুইয়ে দেয়। ছেলেটিকেও হাত পা ধুইয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। ভাত রাঁধে। নিজেও খায়। বৌ ছেলেকেও খাইয়ে দেয়। কখনো বা বৌ ভাত খেতে চায় না, মুখ চেপে রাখে। অসীম ধৈর্যে বুলেন এক গ্রাস দু গ্রাস করে ওকে ভাত খাওয়ায়। সে লক্ষ্য করেছিল বুলেন হাজিরার কাজ করতে গেলে সঙ্গে করে ছেলেটিকেও নিয়ে যায়। মা যে থাকা না থাকা একই। যখন ফিরে আসে ছেলেটির তখন খিদে তেষ্টাতে একেবারেই কাহিল অবস্থা। কিছুদিন থেকে ফেলানিই ওকে রাখছে। কোনও অসুবিধে নেই। এক মুঠো খাইয়ে দিলে মণির সঙ্গে খেলতে থাকে। সে জন্যে এইটুকুন করতে পেয়ে ওর ভালোই লাগে। বুলেনও ফেলানিকে বৌদিবলে ডেকে ওর জন্যে কম করেনি কিছু।
হাজিরা কাজ করে এসে রোজ যেমন করে , বুলেন ভাত রাঁধল। বৌয়ের হাত মুখ ধুয়ালো। ভাতও খাওয়ালো। ছেলেটির জন্যে ওর আজকাল আর বেশি ভাবনা নেই। মণির মাই দেখাশোনা করে। আজ ভাত খাওয়াবার বেলা স্ত্রী ওর বাহুতে আঁচড়ে লাল করে ফেললে। বোবা মহিলাটি মাঝে মাঝেই এমন রেগে উঠে। এমনটি হলেই সে ওকে ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দেয়। চাল জোগাড় করতে না পারলেও সে ঔষধটা ঠিক জোগাড় করে রাখে।
সেদিন সুমলার উন্মাদনাতে পেয়েছিল। হাতে ছুরি একটা নিয়ে লোক জনকে তাড়াতে শুরু করেছিল। কেউ কাছে আসতে পারছিল না। কেউ ওর চোখে মরিচের গুড়ো অল্প ছিটিয়ে দিল । জ্বালাতে চিৎকার করে সে বসে পড়ল। সেই সুযোগে কেউ একজন একটা রশি এনে বেঁধে ফেলল। বুলেনের তৈরি চালাটার একটা খুঁটিতে ওকে বেঁধে রেখে সবাইচলে গেল। মুখে ফেনা বের করে সুমলা ওখানেই পড়ে রইল।
ফেলানি দূর থেকে একবার সুমলাকে দেখে সরে এলো। হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে করতে প্লাস্টিকের রশি রক্তে লাল হয়ে গেছে। চোখ জোড়াও রক্তের মতো লাল হয়ে পড়েছে। ছেলেটি পাশে কাঁদছে। ওকেই কোলে তুলে ফেলানি চলে এলো। নিজের চালাতে ঢোকার মুখে ও দেখল পাগলিকে ছেলে ক’জন পাথর ছুঁড়ে মারছে। সে ওদের তাড়িয়ে যেতে ছেলেগুলো পালালো। ছেলেটাকে হাত পা ধুইয়ে এক মুঠো খাইয়ে দিতে দিতে বুলেন এসে পড়ল। এসেই সে বৌয়ের বাঁধন খুলল। ফেলানি তাকিয়ে রইল। এতোক্ষণ যে চেঁচাচ্ছিল সে একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল। শিশু ছেলেটিকে স্নান করিয়ে এক বালতি জল নিয়ে বুলেন সুমলাকেও স্নান করিয়ে দিল । তারপরে ওকে চাঙে৮তুলে শুইয়ে দিলে । ইকড়ার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল বুলেন চুলোতে আগুন দিয়েছে। আগুনের আলোতে যে মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তাতে দুনিয়ার যত ক্লান্তি। কিন্তু চোখজোড়াতে রয়েছে একটা শান্ত ভাব। সে একটা থালাতে ভাত বেড়ে বিছানাতে রাখল। তারপর বৌয়ের মুখখানা কোলে নিয়ে এক গ্রাস এক গ্রাস করে খাওয়াতে শুরু করল। পাগলি কোনও গোঁ গা করল না। খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ল। বুলেন খানিকক্ষণ ওর চুলে হাত বুলিয়ে গেল। ফেলানি যেন এক অস্পষ্ট গানের গুণ গুণ শুনতে পেল।
বুলেন বেরিয়ে এলো। এক মগ জল নিয়ে চোখে মুখে দিয়ে সে এবারে ফেলানির চালার মুখে দাঁড়িয়ে ডাক দিল, “ বৌদি, ও বৌদি ! ছেলেটা কি শুয়ে পড়েছে?” সে বেরিয়ে এলো। ক্লান্ত বুলেনকে একটা মোড়া এগিয়ে দিল। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বুলেন ওকে বলল, “ বুঝলে বৌদি !ভাবছি আমরা এখান থেকে চলে যাব।“
“শহরের সামনেই একটা জঙ্গল আছে। সেখানে অনেকেই গিয়ে বসেছে। আগে থেকেই একটা বস্তি ছিল। এখন সেটিই বাড়ছে।”
“যা ভালো বুঝিস কর।” ওর বুকখানা কাঁপছিল। একজন একজন করে শিবির থেকে মানুষজন চলে যাচ্ছে। বেছে বেছে, ঐ পরের হাড়ি ভেঙ্গে খায় যে ক’টা বদমাশ, ওরাই থেকে যাবে এই নর্দমাতে। বুলেন চলে গেলে ও কার ভরসাতে থাকবে এখানে? পাগলি হলেও সুমলা ওকে সঙ্গ দিত। আর দিত এই বাচ্চাটি। সে নিজের কোলে ঘুমোনো বুলেনের ছেলেটির দিকে তাকালো। একে ছেড়ে ও...। ফেলানির চোখের থেকে একফোটা জল শুয়ে থাকা ছেলেটির গায়ে পড়ল গিয়ে।
“কী হলো বৌদি ? তুই দেখছি চুপ করে রইলি? চিরদিন এখানে থেকে যাবি বলে ভাবছিস বুঝি?”
“যাব কোথায়?” ওর চাপা গলাতে বলল।
“কেন, আমরা যে বস্তিতে যাব সেখানে যাবি। টিন ক’টাতো আছেই। ঘর একটা নয় আমিই তুলে দেব।”
“ আর মাটি?”
“ ওখানেই বের করতে হবে।”
“ না পারলে?”
“ হবে কিছু একটা। শুরু শুরুতে গিয়ে ভাড়া ঘর একটা নিবি।”
“ ভাড়া দেব কী করে? এখানে তবু মাঝে মধ্যে চাল এক দু মুঠো পাই। আশে পাশের দু’একটা লোকের ঘরেও কাজ পাই।”
বৌদি ! মনটা শক্ত করে বেরো। কিছু একটা হবে।” বুলেন একটু থেমে আবারো বলল,” মনটা শক্ত করে আছি বলেই টিকে আছি, বুঝলি? সুমলাকে তুই ভালো থাকতে দেখলি না। মেয়েটি এমনিতেই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেল , বুঝলি।”
“ ফেলানি দেখল জোয়ান মদ্দ মানুষটা কাঁদতে শুরু করেছে। বেটা মানুষের চোখে জল দেখে ওরও খারাপ লেগে গেল। বুলেন আর সে এক সঙ্গে দেখতে পেল পাগলিকে যে রশিটা দিয়ে বেঁধে রেখেছিল সেটি কয়েকটি কুকুর মিলে টানাটানি করছে। বুলেন চট করে উঠে গিয়ে কুকুর ক’টাকে তাড়িয়ে রশিটা তুলে বুকে নিয়ে নিলো। ফেলানির এমনটি মনে হলো যেন বুলেন রশি নয়, নিজের বৌকেই কুকুরগুলোর থেকে বাঁচিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। সে যেন একটা শুকনো গলার গুঞ্জন শুনতে পেল।
বুলেনের ছেলেটিকে মণির কাছে শুইয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে এলো।হাতে একটি ভেজা কাপড়। সেই ভেজা কাপড়ে পাগলিকে যে খুঁটিতে বেঁধে রেখেছিল সেখানে লেগে থাকা রক্ত মুছে ফেলল।
বুলেন শুতে যাচ্ছিল, ফেলানি জিজ্ঞেস করল, “কবে যাবি?”
“ কালই যাই চল। আমি ঘর একটা দেখে রেখে এসেছি। পঞ্চাশ টাকা করে ভাড়া । কালী বুড়ির ঘর। টিন ক’টি লাগিয়ে নিতে হবে।”
“ কোন বুড়ি?”
“ গেলেই তো দেখবি।”
ভেতরে সুমলার কোঁকানো শোনা গেল। বুলেন দৌড় দিল। ফেলানির হাসি পেয়ে গেল। এ যেন বিছানাতে শোয়ানো বাচ্চাকে কাঁদতে শুনে ওর মা দৌড়ে গেল। ঘুম না আসা অব্দি হাসিটা ওর মুখে লেগে রইল।।
টীকা:
১) শরণীয়াঃ দীক্ষিত । যে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। বডোদের মধ্যে যারা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন তাদের সংক্ষেপে ঐ নামে বা ‘শরণীয়া কছাড়ি’ চিহ্নিত করা হয়।
২) কুঁহিপাতঃনতুন বেরুনো কোমল পাতা। জনপ্রিয় অসমিয়া বর্ণপরিচয়ের বই।
৩) জয় আই অসমঃ জয় মা অসম। অসম আন্দোলনের সময় জনপ্রিয় হওয়া জাতীয়তাবাদী স্লোগান।
৪) বদনঃ বদন বরফুকন আহোম রাজপুরুষ ছিলেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুতে (১৭৯৬-১৮২৬) অসমে মানের আক্রমণের জন্যে বদন বরফুকনকে দায়ী করা হয়। আহোম রাজসভার অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে ক্ষমতা নিজের কুক্ষিগত করবার আশাতে তিনি ব্রহ্মদেশে গিয়ে মানেদের ডেকে আনেন। পরের দশকগুলোতে মানের আক্রমণে অসম বিপর্যস্ত হয়। বহু ধন ও প্রাণ বিপন্ন হয়। সেই স্মৃতি অসমের মানুষ আজো ভুলেন নি। বদনকে তাই অসমে বাংলার মীরজাফরের মতো বিশ্বাসঘাতক রূপেই মানুষ মনে রেখেছে।
৫) সরাইঃ বিশেষ ধরণের একটি মাত্র পায়া সহ অসমিয়া পানের বাটা ।
৬) তাম্বুলঃ সুপারি । কাঁচা সুপারিকে বিশেষ উপায়ে পচিয়ে তৈরি। যা কেবল অসম নয় গোটা পূর্বোত্তরে এক জনপ্রিয় নেশা জাতীয় ফল।
৭) জংলি কুকুরঃ মূলে আছে ‘রাং কুকুর’। এর অর্থ'বনরীয়া' বা জংলি কুকুর ।
৮) চাঙঃ বাঁশে বা কাঠে তৈরি খাট। শব্দটি স্থানীয় বাংলাতেও রয়েছে বলে রেখে দিলাম।
6 comments:
বাস্তব ঘটনা ফুটিয়ে তোলা এবং কল্প কাহিনী রচনার মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকে। এই ঘটনা কোন বাস্তবের প্রেক্ষাপটে রচিত কি না আমার জানা নেই তবে গল্পের গতি এতই ছন্দময় যে একে দলিল বই ভিন্ন কিছু ভাবা কঠিন। অনুবাদের ভঙ্গিও একই সুরে বাধা।
বেশ চলছে।
যে কবি প্রথম কামধেনুর কল্পনা করেছিলেন তিনিও নারী দেখেছিলেন, গরু দেখেছিলেন আর দেখেছিলেন পাখি। তার পর যে কামধনু গড়েছেন লোকে সেটিকে বলেছে কাল্পনিক। পুরো কাল্পনিক কিছু হয় না খালিদদা!আর অসমের এগুলোই গেল আধা শতকেরো বেশি সময় ধরে বাস্তবতা। গেল বছরও অসমের উদালগুড়িতে ভয়াবহ দাঙা হয়ে গেছে!
ঠিক তাই, জীবন নিয়েই উপন্যাস, উপন্যাস নিয়ে জীবন নয়। তাই নয় কি?
অনেকটা ঠিক!
এমনিই চাল ডাল নেই তার পরে যদি চলতে ফিরতে এতো দেরি হয় তাহলে বেচারির কপালে যে আছে কে জানে।
সত্যি! আমার মানে মাথা কাটা যাবার যোগাড়। তবে ভাবনার কিছু নেই ।ফেলানি রোজগারের সন্ধান করছে। মাথা গোঁজার ঠাই একটা জুটেছে। আসছে দু'একদিনের মধ্যেই!
Post a Comment