কেঁদে কেঁদে ফুলে উঠা ওর চোখজোড়াতেও হাসির বালুকণা চিকমিক করে উঠেছে। সে বাবার সঙ্গে এসে রেলে চড়ল। এই রেল রঙিয়াতে যাবে। তারপর রঙিয়াতে রাতটা থেকে সকালে ব্রাঞ্চ-লাইনের ছোট রেলটাতে চড়বে। ব্রাঞ্চ-লাইনের রেলে চড়ে বাপে মেয়েতে যাবে ভুটান পাহাড়ের নিচের সেই রাধিকা আর কৃষ্ণাইকে বুকে ধরে রাখা সেই জায়গাটিতে।
যতই রেলখানা বন জঙ্গলে ভরা জায়গাটিতে গিয়ে ঢুকছে, ততই মেয়েটির চোখের ভোমরা দু’টো চঞ্চল হয়ে উঠছে। এখানে পড়ছে , ওখানে পড়ছে। যেখানে পড়ছে সেখানেই ঝিরঝির করে ঝরছে পায়ের বালুকণা। ওর বয়সটাই হলো রূপালী বালুকণা কুড়িয়ে বেড়ানোর। কেঁদে কেঁদে ফুলে ওঠা চোখের পাতাও উড়ন্তভোমরা ক’টিকে বেঁধে রাখতে পারে না। রত্নমালার মনটি এ ক’দিন গুয়াহাটির সেই একদল মানুষের ঘরে বালিতে এক ভাঙ্গা শামুকের ওলটানোখোলার মতো পড়ে ছিল। দেখলেই যে লোকটিকে ভয় করে, লোকটি যাতে কিছুতেই রাতে ওর কাছে না আসে তার জন্যে ঈশ্বরের কাছে কত প্রার্থনা ।সেই মানুষটি হঠাৎ চলে গেল। আসলে লোকটি আজ প্রায় মাসখানেক ছিলই না। বায়ু পাল্টাবার জন্যে টিবি রোগী মানুষটিকে কোথাও নিয়ে গেছিল। নিশ্চিন্ত রাতগুলোতে সে প্রাণভরে শুয়েছিল, গুনগুণ করে গান গেয়েছিল। যেদিন রাতে বাড়িটিতে কান্নার রোল উঠল, সেদিন সে ভাশুরেরমেয়েটির জন্যে ছেঁড়া কাপড়ে তৈরি বর-কনেকে ঘরে তৈরি পাটের খুদে খুদে জামা পরিয়ে শেষ করেছিল মাত্র। ওর ঘরে একদল মানুষ ঢুকে পড়েছিল। ওর শরীর থেকে জামা কাপড়, গয়না গাটি সব খুলে ফেলেছিল। সাদা কাপড় পরতে দিয়েছিল। তাকে মাটিতে শুতে দিয়েছিল। এতো আগ্রহে তৈরি করা বর-কনেকে কেউ আবর্জনার সঙ্গে ঝেড়ে নিয়ে গেছে। বর কনের জোড়টিকে এনে গুটিয়ে রাখতে গিয়েও সে আর তা করে নি।
আজ মানুষটি চলে যাবার মাস খানিক পরে এই রত্নমালা নামের এক আধফোটা সাদা পদ্মটির মতো মেয়েটি সাদা একখানা কাপড় প্যাঁচিয়ে বাবা চন্দ্রধর মৌজাদারের সঙ্গে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যি দিয়ে ব্রিটিশ সাহেবের বসানো ব্রাঞ্চ-লাইনের রেলটিতে উঠে বাড়ি আসছে।
রেলটি দাঁড়িয়েছে। এই জনশূন্য স্টেশনে রত্নমালা ও তার বাবা নামবে। অরণ্য ঘেরা এই স্টেশনে সময়ের থেকে আগে সন্ধ্যা নামে। খুব কম মানুষের সমাগম হয় এখানে। শুধু সোমবারে সোমবারে উজান মুখো রেলখানা যাবার বেলা স্টেশনটিতে কিছু মানুষের আনাগোনা দেখা যায়। বেশ কিছু গরুর গাড়ি এসে দাঁড়ায়। গরু-গাড়ির থেকে চা পাতার বাক্স নামে। বাক্সগুলো রেলে উঠে। ব্রাঞ্চ-লাইনের রেলটি আমিনগাঁয়ে দাঁড়াবে। সেখানে বাক্সগুলো নামবে। ব্রহ্মপুত্র নদী ফেরিতে পার করে বাক্সগুলো পাণ্ডুতে নামাবে। তারপর বাক্সগুলোর সাত সাগর তের নদী পার করবার যাত্রা শুরু হবে। আজ একখানা ছই দেয়া গরু-গাড়ি এসে স্টেশনের কাছের শিমূলতলাতে দাঁড়িয়ে আছে । রত্নমালা দৌড়ে গিয়ে গাড়িটার কাছ চাপল। ঝাঁপ দিয়ে ছইর ভেতরে ঢুকল।
ছইতে ছাওয়া গাড়িটা এসে গাছ গাছালিতে ঢাকা বাড়িটার মুখে দাঁড়াল। বড় সড় ঘর। শীতে রোদ পোহাবার মতো করে প্রশস্ত পূবের বারান্দা, গরমে গায়ে বাতাস লাগাবার মতো দক্ষিণের বারান্দা। দু’হাত শক্ত ডাঁট করে বওয়া খড়ের চালের উপর জালের মতো কাটা বাঁশের সিলিং। উঠোনে ঢোকার আগে একটা ছোট্ট জলের ধারা তথা খাল পেরোতে হয়। খালটি লোকে ব্যবহার করে তাতে একটা জলের শব্দ সারাক্ষণ শোনা যেতেই থাকে। মৌজাদারের সঙ্গে যারা দেখা করতে আসে তারা সবাই সেখানে হাত পা ধুয়ে আসে । জলের ধারা পার করে একটি তোরণ । বিষ্ণুর দশাবতার খোদাই করা পাকা তোরণটারত্নমালার পার হবার পক্ষে যথেষ্ট উঁচু।সবাই তোরণটির নিচে একটু থেমে গিয়ে প্রণাম করে তবে বাড়িতে প্রবেশ করে। এমন কি রত্নমালাও শুঁড় তুলে একটা নমস্কার করে। মৌজাদারের মেয়ে রত্নমালা নিজের নামটা হাতিকেও দিয়েছিল। রত্নমালা বলে ডাকলে হাতিটাও মাথা তোলে আর মেয়ে রত্নমালাও দৌড়ে আসে।
বাপে মেয়েতে বাড়িতে ঢুকতেই কান্নার রোল উঠল। রত্নমালা খানিক ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। মায়ের কান্না দেখে সেও খানিকটা কাঁদল। চোখে নাচতে থাকা ভোমরাগুলো নিয়ে সে আর কতক্ষণই বা চোখের জল ফেলতে পারে? পারে নি। সে ঠাকুমার পুরোনো ফাটা পাটের চাদর একটা নিয়ে খুড়তুতো বোনের জন্যে বর কনে তৈরি করতে শুরু করল। তাকে বর কনে তৈরি করতে দেখে মা ঠাকুমা পিসিরা আবারো হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
বর কনে তৈরি করতে করতে সে একটা লক্ষ্য করল তার বহু চেনা ঘরখানা একেবারে বদলে গেছে, কোথাও কিছু একটা হয়েছে। যেই আসে সেই তাকে ধরে কেবলই কান্না জুড়ে বসে। চোখের জলগুলো তার চোখের ভোমরা দু’টোকেও ভিজিয়ে ফেলল। উড়তে না পেরে পাখা দুটো মিইয়ে গেল। চেয়ে থাকতে থাকতে পাখাগুলো ভেসে গেল। ওর ঝলমলে চোখদুটো যেন দুটো কালো অঙ্গার হয়ে গেল। আলো নেই, প্রাণ নেই, রং নেই। কেবল নিথর দু’টুকরো জ্বলে পুড়ে শেষ হওয়া কালো অঙ্গার। যেখানে সেখানে চুপটি করে বসে থাকা রত্নমালার চোখের অঙ্গার দুটো দেখে এবারে বাড়িটিতে নতুন করে অশ্রুধারা বইতে শুরু করল। গোপনে , সে টের না পায় এমন করে, বাড়ির যেখানে সেখানে অশ্রুধারা বইতে থাকল। তার চোখের ভোমরাগুলোকেই নয় শুধু, সে মানুষটাকেও এই চোখের জল ডুবিয়ে ফেলল। সব্বাই দেখল সে শুধু চুপ করে বসেই থাকে না, যেখানে বসে সেখানে সে ফুঁপিয়েকাঁদতেও থাকে।
রত্নমালাকে একদিন ওর খুড়ো এসে নিয়ে গেল। বাড়ির সবাই চাইছিল সে অল্প বেড়িয়ে টেরিয়ে আসুক, মনটা ভালো হবে। মৌজাদারের ভাই কুলধর বরুয়া পলাশতলি বাগানের বড়বাবু। পলাশতলি বাগানটাই ভুটান পাহাড়ের নিচে। দূরের থেকে দেখলে বাগানখানাকে একটি ঢেউ খেলানো সবুজ সাগর বলে মনে হয়। ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিল পাহাড়ের নিচে এ অঞ্চলে সোনা গজাতে পারবে। নামটাই বা কে পলাশতলি রাখল। ফাল্গুন মাসে এ অঞ্চলে মাঘ বিহুর ‘মেজি’২আগুনের মতো পলাশ ফোটে। সে জন্যেই বোধ হয় বাগানটির নাম পলাশতলি হয়েছে। পলাশতলি পর্যন্ত যোগাযোগের মাধ্যম হল হাতি আর গরুর গাড়ি। বাগানের বড় সাহেব অলিভার স্মিথ সাহেব বাগানের স্টাফের মানুষজনকে কোথাও যেতে হলে কাগজে লিখে দেন। তাদের নিয়ে আসতে বা রেখে আসতে যাবার বেলা ‘Bullock cart with Soi’ ব্যবহার করতে হয়। চা পাতার বাক্স বা অন্যান্য জিনিসের জন্যে হাতি আছে। মৌজাদারের হাতি রত্নমালাকে বাগানে মাস কয়েকের জন্যে দেয়া হয়েছে। চতুর বড়বাবুটি এই জন্যে প্রয়োজনীয় যোগাযোগটুকু করে দিয়েছেন।
রত্নমালা হাতির উপরে চড়ে খুড়োর সঙ্গে মৌজাদার তনয়া রত্নমালা এসে সেই নদীটার কাছে পৌঁছুলো। শুকনো নদী। শুধুই ভেজা পাথর। রত্নমালা দাঁড়ালো। মাহুত ওকে দাঁড় করায় নি। নিজেই দাঁড়িয়েছে। হাতিটি জানে নদীটি পার করার আগে অল্প দাঁড়াতে হয়। সবাই দাঁড়ায়। কখন বা শুকনো নদীতে পাগলা জোয়ার আসে কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দেখা গেল, ঢেউ তুলতে তুলতে শুকনো নদীতে নুড়ি-পাথর ভেঙ্গে জোয়ার আসছে। বেশি সময় নয়। খুবই কম সময়ে নদী আবার আগের মতো হয়ে যায়। আজও হলো। মানুষ রত্নমালাকে পিঠে নিয়ে হাতি রত্নমালা নদীখানা পার করে গেল। এবারো, তাকে কেউ কিছু বলে নি। জেনে বুঝে সে নিজেই নিজের কাজ করেছে।
এর আগেও রত্নমালা খুড়োর সঙ্গে বাগানে এসেছে। মা কাকীমাদের সঙ্গে আসে আর চলে যায়। এবারে সে একা অনেকদিন থাকবে বলে এসেছে। সঙ্গে এসেছে রম্ভা দিদি। বাগানে এসে তার সবসময়েই ভালো লাগে। সবচে’ ভালো লাগে উড়ন্ত ময়ূরগুলোকে দেখতে । দিনটিতে এক না হয় একবার সে ময়ূরের পেখম তোলা দেখবেই। ছোট ছোট ছাগলের মতো হরিণগুলোকে দেখেও ওর ভালো লাগে। আর এত্তোগুলো সারি সারি চা গাছ! সবুজ ঢেউ খেলানো একটা চাদর মেলে গিয়ে নীল পাহাড়টিতে গিয়ে মিশে গেছে। সন্ধেবেলা বাঘের গর্জন শুনতে পেলে ও ভয়ও পায়। আর ভয় পায় সময়ে অসময়ে এসে পড়া বন্য হাতির দলকে। মাঝে মাঝে বাগানের মজুরেরা মেরে কাঁধে ঝুলিয়ে আনা প্রকাণ্ড সাপগুলোকে দেখলেও তার ভয় করে। সবচে’ ভয় করে গা কাঁপানো জ্বরটিকে। বাবা তাকে বাগানে আসতে দিত না কেবল ঐ জ্বরটির জন্যে । বাগানে আসবার কথা উঠলেই জ্বরের কথা উঠে। খুড়োর প্রথম ছেলের মরবার কারণও ছিল ঐ গা কাঁপুনি জ্বর। কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎই এই কাঁপুনি জ্বর একটা পুরো মানুষকে কাবু করে ফেলে।বাতাসে যেমন করে কলাপাতা কাঁপে তেমনি কাঁপতে শুরু করে তার পর গা পোড়া জ্বর। কুইনাইন খেলেও লাভ কিছু নেই। জ্বর কমলেও লিভার বেড়ে যায়। পেট ঢোল হয়ে পড়ে। মানুষটা যে চা গাছের গুড়ির মতো হয়ে পড়ে। কোনও কাজেই আর লাগে না। গুড়ি পচার মতো পচতে শুরু করে।উঁচু জমির এই পলাশতলি বাগানের জল একেবারে বিশুদ্ধ। এই বিশুদ্ধ জলে ম্যালেরিয়ার মশা প্রবল প্রতাপে বংশ বিস্তার করে। ম্যালেরিয়ার বীজাণু শরীরে নিয়ে মশাগুলো গোটা অঞ্চল জুড়ে বনবন করতে থাকে। লেবারদের পাতা মাপতে আসবার সময়েই দু’দুটো কুইনাইন পিল খেতে দিতে হবে। ম্যানেজার স্মিথ সাহেবের কড়া হুকুম। খুড়ো তাকেও তেতো বড়ি গুটি কয় দিয়ে সবসময় খেতে বলেছে। সব সময় ঐ তেতো বড়িগুলো খেতে তার ভীষণ বাজে লাগে। বাবাই বা তাকে কেন বাগানে পাঠালো? ম্যালেরিয়াহয় বলেই, একটা সময় ছিল, বাবা তাকে এদিকটাতে আসতেই দিত না। সে বুঝতে পেরেছে। খুড়োও তাকে আদর করে এখানে আনে নি। তাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছে। তেতো বড়ি ক’টা গিলবার বেলা তার চোখের জল নেমে আসে।
কিছু দিন থেকে ওর মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। ওর যেন কেউ নেই। বাবারাও ওর কোনও খবর টবর নেন নি। নীরব এই বাড়িটাতে সে আর রম্ভা দিদি। রম্ভা দিদি কাজের ভেতর ওই ভাত ক’টা রান্না করে, গাল ভরে খায় আর পাটি একটা পেতে শুয়ে থাকে। ডাকলেও রাগ করে। খুড়ো বাড়িতে নেই। যুদ্ধের জন্যে বাগান থেকে শ’খানিক মজুর নিয়ে মিছামারি গেছে। সেখানে নিজের নিজের বাগান থেকে মজদুর নিয়ে গিয়ে আলাদা আলাদা বাগান থেকে মানুষগুলো গিয়ে জড়ো হবে।মিছামারিতে এয়ার ফিল্ড আছে। সেখান থেকে ইংরাজ সরকার যুদ্ধের কাজে খাটাবার জন্যে বাগান থেকে মজদুর চেয়ে পাঠিয়েছে। আর খুড়োরই বা কি, ঘরে থাকা আর না থাকা। বন্ধ পেলেই বাড়ি চলে যায়।
বাকি রইল রত্নমালা আর মাহুত কিনারাম। রত্নমালা আর কিনারাম সাধারণত বাগানের কাজে লেগে থাকে। পাহাড়ের নিচের দিকে বাগানে নতুন চারা গাছ রোয়া হচ্ছে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাছ কেটে ফেলা গড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। রত্নমালা নইলে কারবা সাধ্য সেই গাছ নাড়াবার? দিন দুই কাজ বন্ধ। রত্নমালাকে নিয়ে কিনারাম ঘরেই আছে।
মেয়ে রত্নমালাকে দীর্ঘ নির্জন দিনটি যেন একেবারে চেপে ধরেছে। কিনারাম জাল দিয়ে মাছ মেরে এনে দিয়েছিল। তাই দিয়ে রান্না করা ঝোলে ভাত খেয়ে রম্ভা দিদি পাটি পেতে নাক ডাকছে। সে ধীরে ধীরে এসে কিনারামের কাছে দাঁড়ালো। সে রত্নমালাকে কলাগাছ খাওয়াচ্ছিল। কিনারামের শরীরের রং পাকা পেয়ারার মতো। চোখ জোড়া ছোট ছোট। হাসলে চোখের জায়গাতে রেখা একটাই দেখা যায়। মণিগুলো যেন পাগলা নদীটির বুকের কালো পাথরের দু’টো টুকরো। অল্প একটু হাসলেই পাথরের টুকরোগুলো ঘোলা জলে ঢেকে যাবার মতো যায়।
সে তরুণী রত্নমালার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল । চোখের কালো পাথরের টুকরো ক’টার উপর রয়েছে মাছে ঘোলা করা খানিক জল। সে হাতিটিকে আদর করছে, “খা রত্নমালা খা।’’ নিজের নামটি তার মুখে শুনে মানুষ রত্নমালার হাসি পেয়ে গেল। সে হাতিকে বসিয়ে তার উপরে চড়তে যেতেই রত্নমালা আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলে “কোথাও যাবে বুঝি ?’’ আসলে তার কারো সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলবার ইচ্ছে হচ্ছিল।
“শিকার দেখতে ।” সে হাতিকে দাঁড় করিয়েই দিল ।
“কার শিকার?” তরুণী রত্নমালার স্বর কাঁদো কাঁদো।
“ লেবারদের হরিণ শিকার।”
“ আমাকে নেবে?” সে চট করে জিজ্ঞেস করে ফেলল।
কিনারাম আবারো হাতিকে বসালো। মেয়ে তাতে উঠে গেল। অনেকদিন পরে সে রত্নমালার পিঠে চড়েছে। কিনারামের সঙ্গে চড়েছে। চেনা ছন্দে হাতি যেতে শুরু করল। কিনারাম একটিসাঁকোর কাছে গিয়ে হাতিকে দাঁড় করালো। সাঁকোটিব্রিটিশ সরকারের তৈরি। মজবুত লোহার সাঁকো। সাঁকোর নিচে শুধুই ভেজা বালি আর পাথর। এই সেই পাগলা নদী। সাঁকোর নিচে তির ধনুক নিয়ে একদল মজদুর দাঁড়িয়ে আছে। সামনের থেকে আরো এক দল হুর হুর করে হরিণ তাড়িয়ে আনছে। রত্নমালা চোখে স্পষ্ট দেখতে পেল দুটো ছাগলের মতো হরিণ। মুগার মতো রং , তাতে সাদা গোল গোল ফোটার মতো দাগ । সারা বাগান জুড়ে এই ছোট ছোট হরিণগুলো সে বহুবার দেখেছে। তির বিদ্ধ হরিণগুলো কাঁধে ঝুলিয়ে মজদুরের দল চলে গেল। এই হরিণের মাংসও সে অনেকদিন খেয়েছে। বাড়ির পেছনের উঠোনে মাটিতে পোঁতা একটা গোল কাঠের টুকরো মাংস কাটতে কাটতে একদিকে বাঁকা হয়ে গেছে।
হরিণ শিকার দেখেই রত্নমালার দিনটা কেটে গেল।
পর দিন, তার পরদিনও, খুড়ো ফিরে আসার পরেও তার দিনগুলো কিনারামের সঙ্গে রত্নমালার পিঠে পিঠে পাগলা নদীর পারে পারে, সবুজ সাগরের ঢেউগুলোর মাঝে ছড়িয়ে পড়ল।
একদিন রাত ভোর না হতেই কিনারাম রত্নমালাকে নিয়ে এসে হাজির হলো। রম্ভা দিদি শুয়ে আছে, খুড়া বাড়িতে গেছে। সে রত্নমালার পিঠে চড়ে সবুজ সাগরের মাঝে মিলিয়ে গেল। আজ কিনারাম পাগলা নদীতে জাউরিয়া৩মাছের ঝাঁক দেখাবে। মাছগুলোর চামড়া কালো আর রূপালিমেশা। মুখটা কর্কশ । মনে হয়ে যেন কেউ সুচ দিয়ে খুঁচিয়ে কিছু ফুটো করে রেখেছে। চামড়া আর পাতিগুলো বড্ড আঠা আঠা। এ মাছের খোসা ছাড়াতে রম্ভাদিদির বেশ কষ্ট হয়। ছাইতে ভালো করে মাখিয়ে না নিলে তাতে বটি দা লাগাতেই পারে না। স্বাদের জন্যেই মাছগুলো কষ্ট করে কাটে সে। কিনারামের মুখে সে শুনেছে এই মাছ ধরতে পাহাড়ের উপরের দিকে যেতে হয়। সেখানে পাগলা নদীতে কিছু গর্ত আছে, যেখানে জল জমে থাকে। আকাশ গোলাপি হতেই সে ডোবাগুলোতে জাউরিয়া মাছের ঝাঁকগুলো আসে। উপরের দিকে নদীতে মাঝে মাঝেই হাঁটু সমান গর্তে স্ফটিকের মতো জল দেখা যায়। বাকি সবটাই ভেজা ভেজা পাথর আর বালি। ভেজা পাথর আর বালির মাঝে মাঝে এক একেকটা গর্ত। আকাশ রাঙা হতেই সেই গর্তগুলোতে কালো রূপালী মাছগুলো এসে খেলতে শুরু করে । চুপ চাপে জাল ফেলে দিলেই মাছগুলো ধরা যায়। খিরিক করে একটা শব্দ হলেই মাছগুলো তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যায়। আকাশে গোলাপি রং থাকা অব্দিই মাছগুলো থাকে, আলো খানিকটা উজ্জ্বল হতেই ওরা চলে যায়। কিনারাম কদম গাছ একটার নিচে হাতিকে বসালো। রত্নমালা বড় শান্ত হাতি। ওকে বাঁধতে হয় না। মাহুত কিনারামের আদেশ না পেলে সে এক পাও এদিক ওদিক করে না। শীত আসতে এখনো দেরি। কিন্তু এই পাহাড়ের নিচে সবুজ সাগরটিতে শীত অল্প আগেই চলে আসে। বিন্দু বিন্দু কুয়াশা পড়তে শুরু করেছেই। বাতাসেও একটা মৃদু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। মেয়ে রত্নমালা কিনারামের পেছনে পেছনে একটা সরু পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। এ জায়গাটাতে অল্প চড়াই উঠতে হয়। তার পরেই নদীর উঁচু পাড়শুরু হয়েছে। বালি মাটি। পা পড়লেই মাটি অল্প ঝর ঝর করে তলাতে ঝরে পড়ে। সে বারে বারে পেছনে পড়ে যাচ্ছে। কিনারাম অল্প দাঁড়িয়ে গিয়ে ওর হাতখানা ধরল। আকাশ অল্প অল্প ফর্সা হয়ে এসেছে।তাকে সে মুখে রা করতে মানা করে রেখেছে। শব্দ হলেই মাছ একটাও থাকবে না। নদীর পাড়শুরু হয়েছে। খাড়া বালি মাটির পাড়। রত্নমালা দাঁড়িয়ে পড়ল। কিনারামও। রত্নমালা নামবে কী করে? কিনারাম হাত দু’খানা বাড়িয়ে তাকে ধরে নিল। দু’জনে ধরাধরি করে নেমে গেল। কোথাও একটা পাখি দীর্ঘ সুর ধরে ডাকছে। বালিতে নেমেই রত্নমালা আকাশের দিকে তাকালো। শাদা মেঘগুলো গোলাপি হয়ে গেছে । নদীর হাঁটু জলে কেউ যেন গোলাপি রঙের পাটের চাদর একখানা মেলে দিয়েছে। কিনারাম তাকে আঙুলে দেখিয়ে দিল। সত্যিই জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট গর্তে জাউরিয়া মাছের ঝাঁক ঝিলমিল করছে। কিনারাম নদীতে নেমে গিয়ে জাল মেলে ধরল। রত্নমালাও অল্প দাঁড়িয়ে থেকে শেষে নদীতে নেমে গেল। পায়ের পাতা সমান জলে ওর ঘি রঙের পা দু’টো দুটো ফোটা চাঁপা ফুলের মতো ঝলমল করে উঠল। সামনের গোলাপি রঙে রাঙ্গা গর্তে সাঁতরাচ্ছে এক ঝাঁক কালো রূপালিজাউরিয়া মাছ, আর কাছেই ঝলমল করছে খোলা চুলের আরো এক কালো আর ঘি রঙ মেশানো জাউরিয়া মাছ। কিনারাম জাল ধরে অল্প দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎই একটা শব্দ শুনতে পেল। পাগলা নদীতে জোয়ার এসেছে। গড়িয়ে দেয়া বিশাল এক পাথরের মত জোয়ার আসছে। সাদা সাদা ফেনাগুলোতে গোলাপি রঙ ছড়ানো। কিনারাম ঘোপ করে রত্নমালাকে তুলে ধরল। নিল , জলে এই ওদের ভাসিয়ে নিল বলে। নিমেষে রত্নমালাকে বুকে নিয়ে সে গিয়ে পাড়পেল। দু’জনের গায়েই রূপালিবালুকণা লাগল। পাগলা নদীর জোয়ারের ছিটেয় দু’জনের শরীর ভিজে গেল। ওদের চোখে আর কিছুই ছিল না। ছিল শুধু গোলাপি জলের ডোবাতে খেলায় ব্যস্ত এক ঝাঁক কালো রূপালিমাছ। একটাও শব্দ উচ্চারণ করা যাবে না। মাছগুলো যে খিরিক করে শব্দ একতা হলেই হারিয়ে যায়।
বাগানের সীমা পার হলেই পাহাড়ের নিচে সারি সারি চন্দনের গাছ। এ জমিতে গাছের গুটি খেয়ে পাখিতেই নিশ্চয় এই চন্দন গাছের চারা গজিয়েছিল। এখন পাহাড়ের নিচে আঁকা বাঁকা করে চন্দন কাঠের একখানা সম্পূর্ণ সুরভিত অরণ্য। মিঠে, লাল লাল চন্দন গুটি খাবার জন্যে গাছে গাছে, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। কিনারাম ওকে জাউরিয়া মাছের ঝাঁকই নয়, চন্দন কাঠের সুরভিত অরণ্যও দেখালো। সেদিন রত্নমালা মুখে কথা বলতে পারছিল না। কথা কিছু শুনলেই যে নির্জন অরণ্যে চন্দনের বীজ খেতে ব্যস্ত পাখির ঝাঁকগুলো নিমেষে উড়ে চলে যায়।
কী করেই বা কথা বলে রত্নমালা ? ওর যে গোলাপি নদীর জলে নাচতে থাকা কালো-রূপালিমাছের ঝাঁক , চন্দন গাছে বসে গান গাওয়া পাখিগুলো, পেখম তোলা ময়ূরের পালকের রঙ বড় ভালো লাগে। নীল রঙে হাজার হাজার তাঁতে বোনা ফুলের কাজ। রঙ আর ফুলগুলো নাচছিল। সে মেয়ে একটাও কথা বলতে পারছিল না।
রত্নমালাকে নিয়ে যেতে মা, বাবা আর কাকিমা এলেন। তাকে দেখে মানুষগুলো অবাক হয়ে গেল। বাগানের জল-হাওয়া গায়ে লাগানো ভালো। তাই বলে মেয়েটা কি অমন পদ্ম ফুলের ফুলের মতো ফোটে উঠবে ? মায়েরা আসার পরদিন সবাই দেখল রত্নমালাকে বেঁধে রাখা জায়গাটিতে একটি বিরাট বড় হাতি দাড়িয়ে আছে। অন্ধকারেও তার পাকানো দাঁত জোড়া সবাই দেখতে পেল। এক দু’দিন নয়, অন্ধকার হবার সঙ্গে সঙ্গে রোজ দাঁতাল হাতিটা এসে রত্নমালার কাছে দাঁড়ায়, রাত ভোরে আবার চলেও যায়। প্রত্যেক দিন লোকে ভাবে আজ আর রত্নমালাকে দেখতে পাবে না, হাতিটা নিয়ে যাবে। কিন্তু তাকে দেখা যায়, সে একই রকম শান্ত হয়ে গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে । রাতে বাড়ির ভেতর থেকে সবাই টের পেল দাঁতাল এসেছে। সবাই স্থির হয়ে যায়। কখনো বা কেউ একজন কৌতূহলে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকায়, দেখে একজোড়া হাতি। নিঃশব্দে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে।
এ ক’দিন মা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে শুয়েছেন। একদিন রাতে মা মেয়েকে কাছে না দেখে চমকে উঠলেন। দোয়ারখানা আজানো ছিল। ঠেলা দিয়ে খুলে সেখানেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। এক জোড়া হাতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে অল্প দূরেই এক জোড়া ছেলে মেয়ে। ছেলেটার শরীরের পাকা পেয়ারার রং দাঁতালের ঘি রঙের দাঁতজোড়ার মতো অন্ধকারেও ঝলমল করছে। তিনি কথাটা কাউকে বললেন না। শুধু আর একরাতেএখানে থেকে বাড়ি যাবার কথা তুললেন। দু’জন মেয়ে মানুষ বেরিয়ে এসেছে, বাড়িখানা এমনিতেই ছাড়া বাড়ি হয়ে আছে নিশ্চয়। মা রত্নমালাকে পুরোটা দিন চোখে চোখে রাখলেন। এদের সব কথাই স্পষ্ট হয়ে গেল। একবার সে এসে মেয়েকে কলাপাতায় মোড়া কিছু বকুল ফুল দিয়ে গেল , একবার অল্প পাকা হীরাচেরা৪। মেয়ে মাথা নুয়ে এখানে ওখানে বসে থাকে আর চোখের জল ফেলে। বাড়ির লোকে ভাবে সেতো কাঁদবেই, এ এমন কী নতুন কথা? মা বুঝতে পেরেছেন মেয়ের এ অন্য চোখের জল । সে রাতেই হাতি রত্নমালা আর মানুষ রত্নমালা হারিয়ে গেল। হাতি রত্নমালা ঘুরে এলো, মানুষ রত্নমালা আর এলো না।
তার পরের কথাগুলো বড় সংক্ষিপ্ত। মেয়ে একটা জন্ম দিতে গিয়ে রত্নমালা মারা গেল। মৌজাদারের ভয়ে পাহাড়ে গিয়ে লুকোনো রত্নমালা আর বেঁচে থাকতে পারল না। বাচ্চাটাকে নিয়ে কিনারাম বাগানের কাছে নিজের গাঁয়ে ঘুরে আসার ক’দিন পর তার গুলিবিদ্ধ দেহ নদীতে দেখা গেছিল। জাউরিয়া মাছের ঝাঁক যখন নদীতে খেলতে আসে তখন লোকে সে দেহ নদীতে ভাসতে দেখেছিল। সেই দাঁতাল হাতিটা এসে যে তারা গাছে ভরা ডোবাতে৫লুকোয় সেখানে কিনারামের রক্ত বয়ে গেছিল। কেউ টু শব্দটিও করে নি।
রত্নামালা আর কিনারামের মেয়েটিকে বহুদিন ধানের ডুলিতে ঢেকে রেখেছিল। পাহাড়ের তলায় গ্রামটিতেসে বড় হয়েছিল। কিনারাম মায়ের কামরাঙ্গা৬হারটিওমেয়ের সঙ্গে নিজের বাড়িতে সমঝে দিয়েছিল । কামরাঙ্গাহারটি বুঝি কিনারামের বাড়ির লোকেরা মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। কেউ বুঝি সেখান থেকে মাঝরাতে কেমন এক আলো বেরোতে দেখেছিল । ওঝা ডেকে এনে ঝাড় ফুঁক করে মণিটা চুলোর উপরে সরিষার ডুলিতে ভরিয়ে রেখেছিল।
তার পরের কথাগুলো আর ছোট। যুতিমালাকে গোটা গ্রাম যেন ধানের ডুলিতে ঢেকে রাখার মতো রেখেছিল। তেমনি করে থেকেই সেও একদিন যৌবনে পা দেয়। যুতিমালা নিজেই জানত সে অন্য মেয়েদের মতো যেখানে সেখানে বেড়াতে বেরোতে পারে না। সে এক সময় একে ওকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করে দাঁতাল হাতিটা এসে যে তারা গাছে ভরা ডোবাতে লুকিয়ে থাকত সে জায়গাটা কোথায়? বাগানের কোন কোয়ার্টারে ঢোকার পথে হাতিটা এসে মাদি হাতির কাছে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকত। সে রকম সময়েই যুতিমালা একদিন ক্ষিতীশ ঘোষ নামের জোয়ান ছেলেটির সঙ্গে পরিচিত হয়। ক্ষিতীশ নামী মিঠাইর কারিগর। অসুরের মতো খাটতে পারে। ছেলেটি বড় কম বয়সে ভালো পশার জমিয়েছিল। পাহাড়ের নিচের বাগানটির থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ কি: মিঃ দূরের শহরমুখো যে গ্রামটিকে রেললাইন ছুঁয়ে গেছে সেখানে তার এক মিষ্টির দোকান বেশ বড় হয়ে উঠেছিল। মৌজাদের পরিবারটি যে শহরে থাকে সেখানে বিয়ে-শ্রাদ্ধেতে সেই মিষ্টি যোগান দেবার দায়িত্ব নেয়। পয়সা কড়িও হাতে এসেছে। ভুটান পাহাড়ের নিচে এই গ্রামে বছরে এক বড় মেলা বসে। ক্ষিতীশ এই মেলাগুলোতে জনা তিনেক কর্মচারী নিয়ে প্রতিবছরেই একটা দোকান দিয়ে এসেছে। শুরুর দিনগুলোতে শিলিগুড়ি থেকে এসে এই মেলাগুলোতে দোকান দিয়েই সে পায়ের নিচের জমি পাকা করেছিল। সাইকেলে মালপত্র বেঁধে সাঁকো ছাড়া ভাঙ্গা ছেঁড়া রাস্তাগুলো দিয়ে সে মেলায় মেলায়, বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াতো। যেখানে রাত সেখানেই কাত। আজকাল মেলাগুলোতে সে আর নিজে যায় না, কর্মচারী পাঠিয়ে দেয়। এই মেলাতে সে এসেছে অন্য এক কারণে। এই মেলাতে ভুটিয়া লোকেরা কুকুরের বাচ্চা বিক্রি করবার জন্যে নিয়ে আসে। এরা যে বাচ্চাগুলো আনে সেগুলো ছাগলের বাচ্চা থেকেও ছোট পুতুলের মতো দেখতে হয়। কিন্তু বড় হলে হয় ঘোড়ার সমান। সেগুলো ওরা অন্য জিনিসের সঙ্গে বিক্রি করতে নিয়ে আসে। সে এসেছে ঐ পুতুলের মতো ছোট্ট কুকুরের খোঁজে। নতুন সাজানো ঘরে রাতে গিয়ে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে তার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কুকুর একটা থাকলে তার সঙ্গী হবে। সাত জায়গাতে থেকে সাত ধাক্কা খেয়ে বড় হয়েছে সে, তার এ জগতে কেউ নেই। টাকা পয়সা হতে দেখে শিলিগুড়ির কোনও কোনও নিজের মানুষ বেরিয়েছে। মাঝে মধ্যে খবর আত্তি করতে , টাকা পয়সা চাইতে আসে। সেও দেয়। এলে ঘরে রাখে, খাইয়ে বসিয়ে পাঠায়। কিন্তু এইটুকুন মানুষে তার ঘরের নির্জনতা ঘোচে না।
এই মেলাতে সে যুতিমালাকে দেখতে পেল। দখনা৭পরলেও ওর চেহারা কারো সঙ্গে মেলে না। রাজহাঁসের মতো ঝিল মিল করে যে মেয়ে তার খবর বের করা এমন কী কঠিন কাজ? সে ঐ কোয়ার্টারও দেখে এলো। ঘরটা ভেঙ্গে চুরে গেছে। কেউ থাকে না সেখানে। ঘরটার সামনে আগের সেই তারা গাছে ভরা ডোবাও আছে। তার পর সে সোজা যুতিমালার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছুলো। ভয় ডর নেই ছেলের, এমন জোয়ান মানুষ। শরীরের জোরআছে, পয়সার জোর আছে। যুতিমালার বাবা কিনারামের সমাজের সমস্ত নিয়ম মেনেই সে তাকে নিয়ে গেল। সে অবশ্য কুকুরের বাচ্চা একটাও নিয়ে গেল। এক ভুটিয়া ছেলে হলৌচোলার৮ জেবে ভরে দুটো কুকুরেরে বাচ্চা এনেছিল। হাতের তালুতে নেয়া যায় এমন ছোট্ট কুকুর বাচ্চা দুটোকে তার হাতে দেবার সময় সেই ভুটিয়া দুটো চুমো খেয়ে দিয়েছিল।
তার পরের কথাগুলো যেন তারা গাছে ঢাকা ডোবাতে গুলি খেয়ে পড়ে রয়েছিল ছিল যে সেই পেয়ারা রঙের জোয়ান ছেলেটির জীবনটির মতো, চোরাই ব্যাপারীতে উজাড় করা পাহাড়ের নিচের সুরভিত চন্দন কাঠের অরণ্যের মতো, মেরে মেরে মাংস খেয়ে শেষ করে ফেলা সেই ময়ূর পাখিদের মতো, ফুটফুটে হরিণগুলোর মত ---সবই আরম্ভ হয়েছিল, সবই ছিল, কিন্তু এখন কিছু নেই। আছে শুধু হাহাকার, শূন্যতা, অপূর্ণতা। জোয়ান ছেলের বুকের থেকে বেরুনো ছলাৎ ছলাৎ রক্তের মতো, কেটে গড়িয়ে ফেলা চন্দন গাছের অরণ্যে বাসা বাঁধা আকাশ বাতাস কাঁপানো চিৎকারের মতো, পালক টেনে টেনে মেরে লাল মাংস বের করে ফেলা ময়ূর পাখিগুলোর মসৃণ উলঙ্গ শরীরের মতো, কেটে কেটে বাজারে ভাগ করে রাখা ফুট ফুটে হরিণগুলোর রক্ত লেগে থাকা মাংসের মতো—কেবল শূন্যতা,ধ্বংস এবং হাহাকার।
ভয়ডর নেই ছেলেটার, ভেবেছিল পৃথিবীর সমস্ত বিপদের সঙ্গে লড়াই করা যায়। জেতা যায় যুদ্ধ করে। কোঁকাচ্ছিল যুতিমালা ঘরে। ওকে তেমনি রেখে ক্ষিতীশ বেরিয়ে গেছিল। চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল, বন্দুক ছুটছিল। বহু মানুষ মরাপাটের ক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। সেই যে গেল সে আর ঘুরে এলো না। যুতিমালা মেয়ে একটির জন্ম দিয়ে উঠোনেই পড়েছিল। প্রাণ বাঁচিয়ে ক্ষিতীশের দূর সম্পর্কের ভাতিজা রতন এসে এ বাড়িতে পৌঁছেছিল। সে তাকাচ্ছিল। আগুন ধরিয়ে দেয়া ঘরের চালখানা এসে অচেতন যুতিমালার গায়ে পড়ছিল বলে। সে পুকুরে ঝপাং করে একটা শব্দ শুনেছিল। কেউ কচি শিশুটিকে জলে ফেলে দিয়েছিল। লোকগুলো চলে গেছিল। রতন বেরিয়ে এসে পুকুরে এসেছিল। দল ঘাসের মাঝে শিশুটি পড়ে রয়েছিল। রতন ঘোষ তাকে দলবনের মধ্যি থেকে এনে কোলে তুলে নিল।
এই মেয়েটি ফেলানি । ওর নামটির সঙ্গে থেকে গেল জলে ঝপাং করে হওয়া সেই শব্দ। জলে ফেলে দেয়া মেয়ে ফেলানি হলো।
লম্বোদর ওকে বাড়ি নিয়ে আসার পরেও নামের সঙ্গে শব্দটি জড়িয়ে রইল। লম্বোদরের ঘর উঠোন করেই সে এখন ছেলের মা, সাত মাসের পোয়াতি। এক হাতে চুলে তেল মেখে মেখে আর হাতে ঝলমলে ফোটা লাল গোলাপ ছুঁয়ে আছে যে সেই ফেলানি, রত্নমালার নাতনি,যুতিমালার মেয়ে। আশ্বিনের ধানের মাঠের মতো সাত মাসের পোয়াতি তরুণী, বঁধুটিই ফেলানি। লম্বোদরের ঘরনি, মণির মা।
টীকা:
১) খঞ্জনা:অসমিয়াতে পাখিটির নাম বালিমাহী। এর প্রতিশব্দ আছে খঞ্জনা। খঞ্জনা বাংলাতে পরিচিত নাম। যদিও স্থানীয় নাম পেলে শোধরানো হবে।
২) মেজিঃছই দিয়ে তৈরি একরাতের অস্থায়ী ঘর। যা পৌষ সংক্রান্তির পরদিন মাঘের প্রথম ভোরে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অসমের বরাক উপত্যকার বাংলাতে একে বলে ভেড়াভেড়ি বা মেড়ামেড়ির ঘর। যদ্দূর জানি,বাংলাশব্দটি ব্রহ্মপুত্রের বাঙালিদের মধ্যে পরিচিত নয় । তাই মূল নাম রেখে দিলাম।
৩) জাউরিয়াঃ দল বেঁধে পাহাড়ের উপরের ডোবাতে ভেসে বেড়ায় বলে অসমিয়াতে এমন নাম। কেউ বাংলা নাম বলে দিলে উপকৃত হব।
৪) হীরা চেরা: মূলে শব্দটিজেতুলি। সিলেটিতে হীরাচেরা বলে।এক ধরণের লতানে গাছের ফল, যে গাছে কাঁটা থাকে। Rosaceaeপরিবারের গাছটির বৈজ্ঞানিক নামRubus hexagynous
৫) তারা গাছে ভরা ডোবাতে:অসমিয়াতে শব্দটি ‘তরাণিডরা’। অসমের বরাক উপত্যকাতেও ডোবা জমি বোঝাতে ‘ডর’ বা ডহর ব্যবহৃত হয়। যেমন, নারায়ণডর, মালিনীডর। ‘হ্রদ’ থেকে ‘ডর’ এসেছে। কিন্তু ‘তরাণিডরা’র মতো নামকরণের নজির বাংলাতে নেই। বেতের মতো সবুজ এক ধরণের আধা জলজ উদ্ভিদকে ‘তারা’ গাছ বলে যার থেকে সাদা ফুল হয়। বাংলাতে কেউ এর বিকল্প নাম, যা অসমে চলে , জানালে শোধরানো হবে।Zingi beraceae পরিবারের গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Alpinia alughas
৬) কামরাঙ্গা হারঃ মূলে শব্দটি কর্দৈমণি। ‘কর্দৈ’ শব্দের অর্থ কামরাঙা। বাংলাতে হারটির নাম কামরাঙ্গাহার ।
৭) দখনাঃবডো মেয়েদের ঐতিহ্যগত পোশাক। মেখলা চাদরের মতো।
৮)হলৌ চোলাঃপশু-চামড়াতে (সম্ভবত হলৌ বাঁদরের) তৈরি এক ধরণের পুরো শরীর ঢাকা আলখাল্লা।
10 comments:
অসাধারণ গল্পের গতি চলেছে....আমি আপনার "ফেলানি"র সাথী হলাম! এ পর্যন্ত যা যা চোখে পড়ল বলছি :
যুবতী বানান, ছেঁড়া, কেঁদে কেঁদে "ফুলে" ওঠা চোখ,
বালির "গুঁড়ো", আর ঠ্যাংকে পালটে "পায়ের তলা" বললে মিষ্টি শোনাবে। ,
ধন্যবাদ ইন্দিরাদি! আমি অন্যেরা আর কি বলেন দেখে একসাথে ঠিক করব।
Bikram Baruah mailed me saying:
Sushanta,
Thanks. The over-all getup of the site is looking very beautiful.
Just one comments...I think the fonts are too small for someone to read online.
Keep up the good work...
Thanks,
BIKRAM M. BARUAH
bikram98@yahoo.com
P.O.Box:45481
Abu Dhabi - UAE
+971-50-389-7942 (Mobile)
+971-2-671-6464 (Office)
WHAT I HAVE TO SAY, after thanking HIM IS:
Bikram works on Xobdo. That is he knows how to use UNICODE. So, I'll have to give a thought on his suggestion. But, here adorsholipi fonts are looking big in my side. But, I found what works in a website, doesn't work in blog.
Might be, Bikram, you are not using
1) Mozila Fire fox as I have written in the beginning.
2) One will have to activate UNICODE Font & size in browser. going Tool--option---content & content---advanced
ইন্দিরাদি, আপনার পরামর্শের বানানগুলো ঠিক করলাম। শুধু 'যুবতি' রেখে দিলাম। কেন কি আকাদেমি বানান অভিধানে দেখি বিকল্প বানান হিসেবে ওটি চলবে বলছে। 'গুড়িগুড়ি' আছে ঐ অভিধানে , কিন্তু 'গুড়ো' নেই। তাই আপনি যেমন বললেন 'গুঁড়ো' করেদিলাম। 'ঠ্যাং' আদর্শ অসমিয়াতে 'ভরি' আমি ভাবছিলাম, লেখিকা যখন ঠ্যাং ব্যবহার করেছেন, আর বাংলাতেও আছে রেখেই দিই। আপনার কথা পড়ে মনে হলো পালটে পা করে দিলে শোনায় ভালো , আর গল্পের এমন কোনো ক্ষতি হয় না। তাই ওটা পালটে দিলাম।
কিছু কিছু জায়গায় "ট" না লিখে ত পড়েছে..অ যেমন "একটা";শ্বশুর, কাহিনী.... বানান বোধ হয় আমি যেটি লিখলাম সেটি ঠিক; অন্যথায় ঠিক আছে ।
আবারো ধন্যবাদ! ইন্দিরা দি! হ্যাঁ ঐ ট এর জায়গায় ত, ত এর জায়গায় ট এমন আরো কিছু ভুল ছিল। যা পেয়েছই ঠিক করেছি। বাকি শব্দ দুটো এই ১ম অধ্যায়ে আছে কী? না ২য় অধ্যায়ে? এখানে পাইনি। হ্যাঁ, শ্বশুর বানান আপনি যেমন বলেছেন , তেমনি হবে । আমিও ভাবছিলাম কাল আমি শব্দটা অভিধানে খূঁজে খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেন? আমি শাশুড়ির মতো এখানেও 'র' না 'ড়' হবে তাই খুঁজছিলাম। ব-ফলার কথাটা মাথাতে আসেই নি। ২ অধ্যায়ে আছে জানি, ওখানে ঠিক কচছি। এখানে থাকলে প্লীজ ধরিয়ে দেবেন। 'কাহিনি' বানান নতুন নিয়মে (আ.বা.অ) ঠিকই আছে।
আপনার অনুবাদকৃত লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো | একটা কথা বলার ছিল | বাংলায় 'কামরাঙ্গা মালা' কিন্তু আছে |সোনার তৈরী | কামরাঙ্গার মত ছোট ছোট ফলের আদলে বানানো | আমার মা কেও পড়তে দেখেছি| চন্দ্রহার জিনিসটি খানিকটা অন্য রকম |
জেতুলি পকাকে শিলেটিতে বলে 'হীরা চেরা' (হয়তো হীরাছড়া হতে পারে। শিলচরে একটা চা বাগানও আছে ঐ নামে।
শুভেচ্ছা রইলো | আরো লিখুন |
প্রথমেতো অনুবাদটি পড়বার জন্যে ধন্যবাদ মধুমিতাদি। তথ্যগুলো দিয়ে বড় উপকার করলেন। একেবারে শেষে আমি আবার এই পরামর্শগুলোর উপর ভিত্তি করে সংশোধন করে নেব। আচ্ছা, এই জেতুলিকে 'লুকলুকি'ও বলে কি?
বেশ শুরু হয়েছে উপন্যাসটি। অন্য এক জীবন, অন্য এক জগতের স্বাদ নিয়ে। তবে দীর্ঘ কাহিনীমূলক লেখার ক্ষেত্রে বর্ণনা বা স্থানিক-কালিক পরিচিতি কিছু সময় দীর্ঘ হয়েই যায়। সেখানে যদি লেখক ছোট বাক্যে ভেঙে কিছু গতি সঞ্চার করার কথা ভাবেন তাহলে কিছু হতে পারে। নিতান্তই পাঠ প্রতিক্রিয়া। কাজে লাগলে ভাল, না লাগলেও ক্ষতি নেই। আধুনিক গদ্য সাহিত্য শুরু হওয়ার কাল থেকেই বর্ণনা ও বিবৃতিমূলক উপন্যাস নানা ভাষায় প্রচুর। ভাষা, বিষয় এবং স্টাইলের ব্যাঞ্জনায় সেখানে নতুনের স্থান করার কাজটা বেশ কঠিন। সেই জন্যেই এই চিন্তা!
পরের পর্বগুলোও ধীরে ধীরে পড়ে ফেলবো। শুভেচ্ছা রইলো।
পড়বার জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ!
Post a Comment