ফেলানি
সেহাতে মুড়ির টিনটা নিয়ে যখন বেরুলো তখন কালী বুড়ি সাদা কাপড়ের শাড়ি, সাদা ব্লাউজ পরে, কাশ ফুলের মতো চুলে খোঁপা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুড়ির ঢেউ খেলানো চিকমিকে চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল খানিকটা। কালীমেমকে, লংকার মতো ঝাল বুড়িকে দেখে আজ তার সাদা বেলি ফুলের কথা মনে পড়ল, কোমল কিন্তু মজবুত। ঝরে ঝরে পড়তে থাকলেও অনেকক্ষণ সতেজ থাকবে। বুড়ি ইতিমধ্যে ঘরে তালা মেরেইছে, ওকে দেখে বেরিয়ে এলো।
“ পোলাকে কী খেতে দিলি?”
“মুড়ি।”
“আর বুলেনের বৌকে?”
“মুড়ি।”
“আজ চাল নিয়ে আসবি।”
বুড়ি সাদা শাড়ির আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলল আবার। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ওকে ডাক দিল, “ চুলোর কাছে কালকের কিছু ভাত তরকারি আছে, যা ছেলেকে দিয়ে রেখে আয়। মুড়ি খেয়ে ও বুঝি থাকতে পারবে?”
সে অল্প সংকোচ করছিল।
“জলদি কর! বস্তির সব মানুষ বেরিয়ে গেছে, যা!” সে যাবে কি যাবেনা করতে করতে বুড়ির ঘরে ঢুকে চুলোর কাছে গিয়ে সাদা চাড়ি একটিতে ভাত তরকারি নিয়ে মণির কাছে গেল। মণি ইতিমধ্যে মুড়িগুলো খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। সে একটা খবরের কাগজ নিয়ে বানান করে করে পড়বার চেষ্টা করছিল। প্রায়ই মুখে কিছু একটা দিয়েই বিছানাতে বই মেলে ধরে সে। আজ বহু দিন পর সেই চেনা ভঙ্গিতে বিছানাতে গা ছেড়ে বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে।
বাবা, তোর জন্যে আমি একটা বই নিয়ে আসব। কী বই লাগবে, বল।” মা ওর মাথাতে হাত বুলিয়ে দিল। ছেলের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
“
“ সত্যি বলছ , মা?”
“সত্যিই তো।”
“ পয়সা কই পাবে?” ওর গলা দিয়ে কান্না বেরিয়ে আসছিল ।”
“ আজ আমি মুড়ি বেচতে যাচ্ছি যে !” সে আঙুল দিয়ে ছেলেকে বাইরে রাখা কালচে পড়া বিস্কিটের টিনটা দেখালো।”
“ তুই দুষ্টুমি করবি না, কেমন? ঘরে থাকবি...।”
“ নদীতে গিয়ে সাঁতরাতে থাকবি না। ভাতগুলো খেয়ে দৌড়বি না।” ছেলে মাকে হুবহু নকল করে কথাগুলো বলতেই মায়ে ছেলেতে একসঙ্গে হেসে উঠল।
“ মায়ে ছেলেতে কী এতো কথা হচ্ছে?”
ফেলানি তাকিয়ে দেখে এক রোগা লম্বা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মাথাতে একটি বস্তা। তার দাঁড়াবার ভঙ্গি থেকেই বুঝা যায়, বস্তাটি বেশ বড় যদিও, পাতলা। বস্তার মুখে লেগে আছে কতকগুলো মুড়ি, সেগুলোও দেখে বোঝা যায় বস্তাটা মুড়ির। মেয়ে মানুষটি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “ চল, মনির মা।” ফেলানি বুড়ির দিকে নজর ফেলল। বুড়ি ইতিমধ্যে রাস্তাতে পা ফেলেইছে। হালকা শরীরে বুড়ি পাখির মতো পা ফেলে। সে অনভ্যস্ত হাতে মুড়ির টিন দুটো সামলাতে পারছিল না। বুড়ি একবার তার দিকে ফিরে তাকিয়ে হাত তার হাত থেকে মুড়ির টিনটা নিয়ে মাথাতে তুলে নিলো। সে শুধু ঐ বুড়ির রাজ হাঁসের মতো ছোট, ক্ষীণ, সাদা গলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই গলা নিয়ে সত্যি সত্যি টিনটা নিয়ে যেতে পারবে বুড়ি? পারছেই তো, অনায়াসে বুড়ি টিনটা মাথাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
“জোনের মা, তোর ঘরের বরটি কেমন আছে?”
“ওর কথা আর জিজ্ঞেস করে লাভ আছে কী?”
“ কেন? ওর শ্বাসের টান বেড়েছে বুঝি?”
“কোন দিনই বা কম ছিল, বল?”
“বাজার হাট করতে পারছে?”
“আজ দু’সপ্তাহ ধরে বসে আছে।”
“সংসার তুই একা টানছিস?”
“ সব সময়েইতো একা টানছি।। কী আর এমন নতুন কথা হলো?”
ফেলানি মনে মনে মহিলাটি আর বুড়ির কথা শুনে যাচ্ছিল। আবহাওয়া পরিষ্কার। ঝাঁ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। জোনের মা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল, “ মণির মা, চুপচাপ কেন? শরীর খারাপ লাগছে, না মন খারাপ?” উত্তরে সেও মানুষটির দিকে তাকিয়ে হাসল খানিকটা। জোনের মায়ের গায়ের রং পাকা কালো জামের মতো। মিহি, কালো, চিকমিক করে।” রোদে ঝরে যাওয়া কালো জাম যেন পাতার ঝুটির মাঝখানে তিড়বিড় করছে। কালো মুখে সাদা আর সমান দাঁতের পাটি ফেলানির চোখের সামনে খানিকক্ষণ ভেসে রইল।
“ তোমাদের কথা শুনেছি। তোমার উনার কোনও অসুখ করেছে?”
“ আমার বুড়োটার অসুখ হয় না কবে সেটি জিজ্ঞেস কর।” ওর কপালে আধুলির সমান সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতেও উজ্জ্বল সিঁদুরের টান।ফেলানি লক্ষ্য করল হেসে হেসে কথা বললেও মেয়ে মানুষটির গলাতে সারা রাজ্যের সমস্ত বিরক্তি মিশে রয়েছে।বস্তিটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা দোকানের সামনে গিয়ে জোনের মা দাঁড়ালো। রাস্তার এক পাড়ে বুড়ি আর মালতী , অন্য পাড়ে জোনের মা। জোনের মা বস্তার থেকে মুড়ি বের করছে, দাড়ি-পাল্লাতে মাপছে। কেন জানি মালতীর মনে হলো সে এই কাজগুলো করতে ইচ্ছে করেই দেরি করছে। এতো হাসাহাসির কী এমন কথা হচ্ছে ওখানে?
মেয়ে মানুষটি আবার যখন মুড়ির বস্তা মাথাতে তুলে ওদের দিকে আসছিল মালতীর তখন ওর দিকে তাকাবার ইচ্ছে হচ্ছিল না। শাখা-সিঁদুর পরা মেয়ে মানুষ, মান ইজ্জত নেই? সে মুখ গুমড়ো করে কালি বুড়ির কাছে দাঁড়িয়ে রইল। বুড়ির মুখের দিকেও সে একবার তাকালো, কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।
“ চলো, তাড়াতাড়ি চলো। নাহলে বাজারে বসবার জায়গা পাওয়া যাবে না।” এবারে জোনের মা তাড়াহুড়ো শুরু করেছে।
“আরে জোনের মা কী বলে?” মেয়ে কি বৌ ধরা মুস্কিল, চাঁদপানা মুখের বাচ্চা কোলে এক ফরসা দেখতে মহিলা এসে ওদের সঙ্গ নিলো।
বস্তির গলিটি ছেড়ে এই ক’জন মহিলা মূল রাস্তাতে পা দিল। ফরসা মহিলাটি কোলের বাচ্চাটিকে টপাট্টপ কয়েকটা চুমু খেয়ে নিলো। একবছরের বাচ্চাটিকে দেখলে দেখতেই ইচ্ছে করে। নাক চোখা, দুধে আলতা রং, হাসলে গালে একটা টোল পড়ে। ফরসা হলে কি হবে, মায়ের নাক চোখ চ্যাপটা, শরীরের রং ছেলের মতো এতো মিহি নয়। মা ছেলেকে এক সঙ্গে দেখলে মনে হয় যেন বাড়ির ঝি বড়লোক মনিবের ছেলেকে নিয়ে এসেছে । বাচ্চাটির মা ছেলের কোল পালটে বলল, “জোনের মা যদি বাজারে জায়গা না পায় তবে আর পাবেটা কে?”
“ কেন? আমার পেয়ারের লোক আছে না বাজারে?” কালো মানুষটি কালো কেউটের মতো ফোঁস করে উঠল। বাচ্চা কোলে মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
“ হাসছিস যে বড়ো? সবই তো দেখি তোরই পেয়ারের লোক। যেখানে যাবি সেখানেই ঠাই পাবি, খেতে পাবি শোবার জন্যে বিছানা তো দেখি পাতাই থাকে...।”
“ আমার তো আর বাজারে ডম্বরু বাজিয়ে, ইঁদুর মারার ওষুধ বিক্রি করা শক্ত সমর্থ পুরুষ নেই। এইসব পুরুষেরাই আমাকে খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে।”
“ জারজ সন্তান নিয়ে বেড়াস । লাজ লজ্জা নেই।”
“ঐ কালি বেটি! লাজ শরমের কথা তুই বলবি না বলে দিলাম। বস্তিতে তোর কথা সব ফাঁস করে দেব।
“ কোন কথাটা ফাঁস করবি শুনি?” কালো বৌটির মাথার উপরের মুড়ির বস্তাটিও কথার তালে তালে কাঠঠোকরা পাখির জটার মতো নাচছিল ।
“তোকে কোন ব্যাপারী কম দামে সিঁদুরের কৌটো দেয়, কে আলতা দেয় আমি জানি না বলে ভেবেছিস বুঝি?
“আমাকে না হয় আলতা সিঁদুর দিয়েইছে। তোর মতো তো আর কোলে জারজ সন্তান দেয় নি।”
“আমার ছেলেকে জারজ বলে বলবি নে , বলে দিলাম! আমি খাওয়াচ্ছি, আমি পরাচ্ছি। আসলে তো হিংসে। তোদের নোংরা চালার সামনে আমার চালা যেন কাকের পালে ময়ূর।“ সে বাচ্চাটিকে আবারো চুমো খেলো।
ফেলানি একবার কালো মহিলাটি, একবার নাক চ্যাপ্টা ফরসাটি আরেকবার কালী বুড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ওদের দুজনের কথা শুনে ও ভেবে পাচ্ছিল না কী করে সে। বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে, সেও দাঁড়িয়ে রইল।
“আমরা তো এদিক দিয়েই যাব।” বুড়ি মূল রাস্তার থেকে বেরিয়ে যাওয়া গলি পথ একটা দেখালো।
সে কালো আর ফরসা মেয়েমানুষ দুটির দিকে তাকালো।
“ওরা দুজন বাজারের দিকে যাবে।”
“বুড়ি মা, তুই কি এদিকে যাবি?”
“আমি এই মণির মাকে অল্প কয়েকটা বাড়ি ঘর দেখিয়ে আসি।” ওরা দু’জন মণির মায়ের দিকে তাকালো। সে ঠোঁট কামড়ে মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওর চোখে মুখে স্পষ্ট ঘৃণা, বিরক্তি আর রাগ।
“ মণির মা , তুই দেখি আমাদের সঙ্গে কথাই বলিস না।” ফরসাটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। মাকে হাসতে দেখে বাচ্চাটিও খিলখিল করে হাসছে। ফেলানির দিকে দুই হাত মেলে বাড়িয়ে দিয়েছে। সে বাচ্চাটির দিকে তাকায় নি।
“মণির মা, খারাপ পাবি না। অল্প ঠাট্টা ইয়ার্কি না করলে কী করে থাকবি বল? বাড়ি গিয়ে তো সেই দেখবি বুড়ো উঠোনে বসে শ্বাস টানছে আর বক বক করছে। ফরসাটি ফেলানির মুখে ধরে বুড়োর মতো লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে টেনে, মাঝে মাঝে কেশে কেশে বলতে শুরু করল, “ শালি... মাগি...কই মরতে গেছিলি ...। কোন মরদ ধরেছিলি...বাড়িতে যে পুরুষ মানুষটা...। বজ্জাত মেয়ে মানুষ...। তোকে...।”
দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। সে শুধু অবাক হয়ে এই দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল। কোলে কচি শিশু , মাথাতে মুড়ির বস্তা নিয়ে এই দুটি মেয়ে মানুষের দিকে সে তাকিয়েই রইল।
“ কী হলো মণির মা? চল , এদিক দিয়ে চল। ওরা বাজারের দিকে যাবে।”
সে কালি বুড়ির নামিয়ে রাখা মুড়ির টিনটা কলসির মতো কাঁখে নিয়ে নিলো। এক হাঁতে কাঁখের টিন ধরে অন্য হাতে আরেকটা ঝুলিয়ে নিয়ে সে দিব্যি পথ হাঁটতে শুরু করল।
“একটা আমাকে দে, তোর অভ্যেস নেই। গৃহস্থ ঘরের বৌ, মুড়ির টিন এমনি করে বয়েছিলি কখনো?”
“কেন, জল টানিনি বুঝি? একটা কলসিতে কাঁখে আরেকটা বালতি হাতে।” কথাগুলো বলে সে এমনিই হেসে ফেলল। কেন জানি ওর মনটা বড় হালকা বোধ হলো।
“ সংসারের কি জ্বালাতে যে জ্বলছে রে মেয়েগুলো...।” সে ঠিক ধরতে পারেনি বুড়ি কার কথাই বা বলল।
যখন ফিরে এলো ওর হাতে তখন এক কেজি চাল, চারটা ডিম, আধা কেজি আলু, একপোয়া মিঠা-তেল আর একটি সাহিত্যের বই। মুল রাস্তার থেকে যে গলি ছোট পথটি বস্তিতে ঢুকে গেছে তার মোড়ে তেঁতুল গাছের নিচে মণির মায়ের জন্যে দাঁড়িয়েছিল। মাকে দেখেই দৌড়ে কাছে ছুটে গেল। মায়ের হাতের থেকে বাজারের থলেটা নিজের হাতে নিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলে, “মা, চাল এনেছ?” মা ওর মুখের দিকে তাকালো। এক্কেবারে শুকিয়ে আছে। সেই সকালে বুড়ির দেয়া ঠাণ্ডা ভাত কতকগুলো খেয়েছিল। ফেলানির বুক টনটন করে উঠল।
ঘরে ঢুকে দেখে টিন একটাতে পরিষ্কার এক টিন জল ভরে রাখা। চুলোর কাছে এক আঁটি লাকড়ি।
“ মা, বুলেন কাকা টিনটা রেখে গিয়েছিলেন। আমি নদীতে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে এনেছি। লাকড়িগুলোও কাকার সঙ্গে গিয়ে রিজার্ভ থেকে নিয়ে এসেছি।”
“জল কিসে করে আনলি? এই টিনে?”
“ধ্যৎ ! না না। কালী বুড়ির বালতিতে করে নিয়ে এলাম। বালতিটাও বালি দিয়ে মেজে রেখেছি।”
“কই রাখলি বালতিটা?”
“ঐ যে ওখানে” সে বুড়ির বারান্দার দিকে দেখিয়ে দিল।
মণি থলের থেকে বাজার বের করতে লেগে গেল। একেকটা জিনিস বের করে মাটিতে রাখে আর আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে।
“চাল”
“আলু”
“ডিম”
“মিঠা-তেল”
“এটি আমার সাহিত্যের বই।”
বইটিহাতে নিয়ে আনন্দে ছেলের মুখের রা বন্ধ হয়ে গেল। অল্পক্ষণ বইখানা নেড়ে চেড়ে দেখে হাসিতে ভরা তার মুখখানা আবার ম্লান হয়ে পড়ল।
“ অংক তো ভুলেই গেছি।”
“কেন ভুলবি, স্কুলে গেলে মাস্টার আবার শিখিয়ে দেবে না বুঝি?”
“আবার আমি স্কুলে যাব? সত্যি মা?”
“যাবিই তো” আগামী সপ্তাহের থেকেই যাবি। আমি তোকে স্কুলে যাবার জামাও তো এনে দেব।”
“মুড়ি ভেজে দিলে কালীদিদা কি রোজ তোকে পয়সা দেবে?”
“রোজ কি আর আমি অন্যের মুড়ি ভাজব রে? আমি নিজেই ধান কিনব, মুড়ি ভাজব।”
“পয়সা কোথায় পাবে?”
“জোগাড় করব।”
ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে ডাল বসালো, ভাত বসালো। ডিম দুটো সেদ্ধ করবে বলে ভেবেও চারটা দিয়ে দিল। আলু একটা আগুনে পুড়ে বের করে রাখল। মণি মায়ের গায়ে গা দিয়ে বসে আছে।
“ এই ক’টা বুলেন কাকাকে দিয়ে আসতে পারবি রে?” দুটো সেদ্ধ ডিম কাগজ একটাতে বেঁধে ছেলেকে এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখে সে ঘুমে ঢলে পড়েছে। তার পেটের থেকে করকর করে শব্দ একটা বেরুচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি করে ভাত বাড়ল। ছেলে নিজেই কলাপাতা কেটে রেখেছিল।
“ওঠ বাবা, ভাত ক’টা খেয়ে নে।”
সে চোখ মেলে তাকালো, “ মা তুই না খেলে আমি একা একা ভাত খাব না।”
“ তাই হবে।” নিজের পেটের থেকেও একটা করকর শব্দ শুনতে পেল। তারও ছেলের সঙ্গে বসে এবেলার ভাত খাবার ইচ্ছে হলো। কলাপাতে নেয়া গরম ভাতের গন্ধে ওর উপোসি পেটটাই যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিল।
ভাত ক’টা খেয়ে ফেলানির শরীরটাতে যেন জোর ফিরে এলো। যে একটা অস্থির ভাব ছিল সেটি এখন চলে গেছে। ছেলেকে বস্তাটিতেই শুইয়ে দিয়ে ওর গায়ে কালো পাড়ের অল্প ছেঁড়া শাড়িটা দু'ভাঁজ করে দিয়ে দিল। ক্যাম্পে গেরুয়া পোষাকে যে সাধুর দল এসেছিল ওরা এটি দিয়ে গেছে। খানিকক্ষণ ওঁ ওঁ করে ছেলে আবার ঘুমিয়ে গেল। সেছেলের কাছ থেকে সরে এসে ডিম সেদ্ধ দুটো কলাপাতাতে বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে ফুরফুরে জ্যোৎস্না। ফিনফিনে বাতাস বইছে। গরমও নেই ঠাণ্ডাও নেই। অল্প আগেও বস্তির বাঁশের বেড়ার ঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ভেতরে আগুন জ্বলতে দেখা গিয়েছিল। এখন আগুনগুলো নিভে গেছে। আগুনের সঙ্গে করে মানুষের হৈ-হল্লাগুলোও থেমে গেছে। কাকভোরে যে বস্তি জেগে উঠে রাত আটটা ন’টা বাজতেই সেটি শুয়ে পড়ে। সে কলাপাতাতে বাঁধা ডিম দুটো হাতে নিয়ে বুলেনের ঘরের দিকে পা চালাল। আজ এতোটা দিন ধরে মানুষটা ওদের এতো কিছু খাইয়েছে, সেতো উল্টে কিছু দিতে পারেনি। বাড়ির চারদিকে বুলেন গাছের ডালে বেড়া দিয়ে সাজিয়ে ঘিরে ফেলেছে। আধা মাটি চাষ করাও হয়ে গেছে, কয়েকদিনের মধ্যেও ওর মাটি থেকে হাসি বেরুবে। সে কাঠে তৈরি ফাটকটা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজা খোলাই ছিল। বাঁশের চাঙে ছেলে শুয়ে আছে।।মাটিতে একটা বস্তা পেড়ে গামছা পরে খালি গায়ে বুলেন বৌকে ভাত খাওয়াবার চেষ্টা করছে। বৌ বড় জ্বালাতন করছে। সে গিয়ে ওদের দু’জনের পাশে বসল। নিঃশব্দে ডিম দুটো থালাতে রেখে দিল। ডিম দুটো দেখেই ওর বৌ হাত দুটো মেলে ভাতের থালাতে ছোঁ মারতে গেল। বুলেন তৎক্ষণাৎ ডিম ভেঙ্গে এক এক টুকরো এক এক গ্রাস ভাতের সঙ্গে দিতে শুরু করল। বৌ তখন শান্ত শিশুর মতো ভাতগুলো খেয়ে গেল। বুলেনের মুখটাও শান্ত হয়ে এসেছে , “আজ গোটা দিন ওর মুখে কিছু দিতে পারি নি।” আস্তে আস্তে কথাগুলো বলে মানুষটি ফেলানির দিকে তাকালো। ইতিমধ্যে বৌয়ের মুখ খালি হয়ে গেছে। রাগে সে নিজের গায়ের চাদর খুলে ফেলানির গায়ে ছুঁড়ে ফেলল। বুলেন বৌয়ের মাথাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বৌ ওর কোলে উঠে বসল। গায়ে গা লাগিয়ে বসে চোখ জোড়া আধা বুজে বৌ ভাত খেতে থাকল। বাতিটা নিভে গেল, তেল ফুরিয়ে গেছে। চুলোর আগুনও ছাই হয়ে গেছে। শুধু আধা খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আলো এসে ওদের গায়ে পড়ছে। ভাত খাওয়া শেষ হলে বুলেন অল্প জলে বৌয়ের মুখ মুছিয়ে দিল। কুঁ কুঁ একটা শব্দ করে পাগলি গিয়ে ওর স্বামীর বুকে লেপটে গিয়ে বসল। ওর শরীরে ঢিলেঢালা পেটিকোট একটা। পুরুষ মানুষের বেঁধে দেয়া টান টান বেণি মেঝেতে পড়ে আছে। বুলেন ওর উদোম পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাত অল্প সরালেই মানুষটি জেগে উঠে। বাঁকা জ্যোৎস্নার আলোতে এই নারী পুরুষের জোড়াকে দেখতে পাথরে কাটা মূর্তির মতো লাগছিল। এক লহমা ওদের দেখে সে যাবার জন্যে উঠল। বুলেন চোখের ইশারাতে ওকে একেবারেই শব্দ না করে যেতে বলল। খিরিক করে শব্দ একটা হলেই পাগলি উঠে যাবে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে বড় জ্বালাতন করে। বুলেনের ক্লান্ত চোখে মিনতি। সারা দিন জুড়ে বাইরে কাজ করে এসে আবার তাকে ঘরে এতোটা করতে হয়। তার মুখখানা দেখলেই বোঝা যায় তার পেটও ভাতের গন্ধে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভাতক’টা খেয়ে তারও একটু গড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। ফেলানি যতটা আস্তে পারে শব্দ না করে বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে এসে অল্প দাঁড়ালো । দরজাটা ভেজিয়ে দেবে কি? থাকুক, আবার যদি শব্দ হয়। সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো।
বস্তিটা প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। দ্রুত পায়ে বুলেনদের ঘর থেকে নিজের বাসাতে আসছিল। আসার পথে হঠাৎই শুনতে পেল। কেউ একজন ওর স্ত্রীকে গালি দিচ্ছে। লোকটার গলা যেন ওর চেনা চেনা মনে হলো। কোথাও যেন এই শব্দগুলো সে শুনেছে। ওর পা মন্থর হয়ে এলো। একচালা নয়, দু’চালা কেঁচি বাটা দেয়া একটি ঘরের বারান্দাতে সে দেখল একজন বুড়ো মানুষ হাঁটু গুঁজে বসে আছে। মানুষটির পিঠ ওঠানামা করছে। শ্বাস নেবার ঘর-ঘর শব্দ একটা শুনতে পেল সে। ঘরটির সামনে সে অল্প দাঁড়ালো।
“শালি! বজ্জাত মেয়ে মানুষ...। ঘরে বেমারি মানুষটা পড়ে আছে... আর মেয়ে মানুষটা মরতে যায় কই...।” শব্দগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। শুনা যাচ্ছে শুধু শ্বাস টানার একটা ঘর ঘর শব্দ। সে ওখানে অল্প সময় দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পৌঁছলো। তাকেও ঘুমে ফেলে দিচ্ছে। সেও ছেলের কাছে হাত পা গুটিয়ে শুয়ে পড়তে গিয়েও থেমে গেল। এই শাড়ি পড়েই কি সে শুবে? শুধু এই শাড়িটাই আছে। সে শাড়িটা খুলে ভাঁজ করে গুটিয়ে রাখল। বুলেনের জোগাড় করে দেয়া বস্তাটা টেনে এনে ঘুমোবার জন্যে শরীরটা এলিয়ে দিল। সারা দিনের ক্লান্ত দেহ, সে ভেবেছিল শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে যাবে। কিন্তু বস্তাতে গা এলিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে তার ক্লান্তি মিলিয়ে গেল। তার চোখের সামনে আসা যাওয়া করতে শুরু করল এর পেছনে ওই ছবিগুলো। একটা বারান্দাতে লম্বা শ্বাস টানতে টানতে শাপ শাপান্ত দিতে ব্যস্ত বুড়ো মানুষটা...বেলি ফুলের মতো এক বুড়ি…পাকা জামের মতো কালো মেয়ে মানুষ একটি...চাঁদের মতো বাচ্চার মতো নাক চাঁপা ফরসা একটি মেয়ে মানুষ...কালো একটি পাল্লাতে উপচে পড়া সাদা সাদা মুড়ি। সমস্ত ছবিগুলো এসে ভিড় করল বাঁকা চাঁদের আলোর নিচে পড়ে থাকা এক জোড়া মানুষের গায়ের উপর। এক উদোম বুকে, দুই বাহুর মাঝে এক যুবতি মেয়ে ...ছেলে মানুষের হাতে বাঁধা একটি বেণি। ওর চোখের সামনে অনেকক্ষণ ছবিটা রইল। ছবিটা ক্রমেই সেগুন পাতার মতো কাজের লোকের হাত হয়ে গেল, মালতীর গায়ের উপর সেগুন পাতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশস্ত হাতখানা যেখানেই পড়ে সেখানেই যেন পড়ে চাঁদের এক টুকরো বাঁকা জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্নার আলো যে তুষের আগুন হয়ে মালতীকে ঘিরে ফেলেছে। সে ঘোপ করে উঠে বসল। তারপর সে দরজা খুলে ঘুরের বাইরে গিয়ে বসল। হাঁটুর মাঝে মাথা রেখে সে চুপচাপ বসে রইল। সে অনুভব করল ওর পিঠে এক কর্কশ হাতের স্পর্শ। ক্রমেই ওর চোখ জোড়া ভিজে এলো। বাইরে সোঁ সোঁ করে বাতাস বইছে। শরীরটা শিরশিরিয়ে উঠল। পাহাড়ের পাশের শহরটিতে বৃষ্টি আসার হলেই বাতাস ভারী হয়ে পড়ে। বৈশাখ মাসেও শরীরে গরম একখানা কাপড় নিতেই হয়। সে আবারও ভেতরে চলে গেল। মণির ঠাণ্ডা লাগছে, ঠাণ্ডাতে বেচারা কুঁকড়ে শুয়েছে। ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখা ক্যাম্পে পাওয়া শাড়িখানা , যেটি এখনো ছেঁড়েনি, ওর গায়ে বিছিয়ে দিতে গিয়ে কিছু ভাবছিল। ঠাণ্ডাতে ছেলেটি কেঁকিয়ে উঠল। দু'ভাঁজ করে সে কাপড়টি দিয়ে ওর শরীরে চাপিয়ে দিল। ওম পেয়ে ও আবার ঘুমিয়ে গেল। সে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিল। তার জন্যে একটাগেঞ্জি, একটা পেন স্কুলের পোশাক, শরীরে দেবার একখানা কাপড়, শুবার জন্যে একটা বিছানা, ভাত খাবার জন্যে একটা থালা। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হবে। বাতাস একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ফেলানি বস্তাটিই গায়ে দেবে ভেবে আবার খানিক অপেক্ষা করল। কিছু একটার গন্ধ বেরুচ্ছে। গন্ধটা কিসের সে ধরতে পেল। মানুষটা প্রত্যেকবারই যখন কপি খেত করতে শুরু করবে তখন এক সারের বস্তা নিয়ে আসে , তাতে অমন গন্ধ করত। কপিরচারা উঠাতে উঠাতে রোদে পোড়া মানুষটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “ মালতী চুলগুলো টেনে টেনে কী সব ভাবছিস বসে?” নেই আর কেউ নেই, গায়ে বস্তা একটাও দেবার সামর্থ্য হারানো মালতীকে দেখবার এখন আর কেউ নেই। চোখের জল যেন ওর বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। মণি স্বপ্ন দেখে কিছু বিড়বিড় করছিল। সে যদি এখন জেগে উঠে। তার শরীরের থেকে শাড়িটা টেনে আনতে গিয়ে সে হাত গুটিয়ে নিলো। থাকুক, মাথা ঢেকে শুয়ে আছে এখন শাড়িটা টেনে আনলে সে কাঁচা ঘুম থেকে উঠে যাবে। গামছা গায়ে দিয়েই সে আবার বাইরে বেরিয়ে এলো। এবারে ওর বুক ফেটে হুড় হুড় করে চোখের জলের ধারা নেমে এলো। চোখের জল মুছে মুছে সে একটা চেনা পথ ধরে এগিয়ে গেল। একটা কামরাঙা গাছ রয়েছে দুবছরেই ফল ধরে যায়, কলিতেই মিষ্টি তার ফল—সেই গাছ পেরিয়ে, ফল ধরলে মাটি ছুঁই ছুঁই করে যে জাহাজি কলার গাছ --সেটি পেরিয়ে, লাল গোলাপের গাছ পেরিয়ে, মাছে ভরা পুকুরটা পার করে সে সেই ঘরটার দরজায় গিয়ে হাত দিল। ভেতরে একটা বিছানা, রোদে গরম করা লেপ, শিমুল তুলোর বালিশ, রোদে গরম করা তোষক, ধবধবে সাদা বিছানা চাদর , সাদা মশারি। সে হামাগুড়ি দিয়ে বিছানাতে গিয়ে ঢুকছে। রোদে দেয়া লেপ তোষকের সঙ্গে মিশে আছে আরেকটা উত্তাপ। সেই উত্তাপে তাকে ছেয়ে ফেলেছে। সে ঐ তাপে খানিকক্ষণ ডুবে রইল কি রইল না দাউদাউ আগুনে সব জ্বলে উঠল, কামরাঙা গাছ, জাহাজি কলার গাছ, লাল গোলাপের গাছ মিইয়ে গেল। ঘরের জিনিসগুলো ছাই হয়ে গেল। পুকুরের মাছগুলো সাদা হয়ে ফুলে ফুলে ছাই কালিতে মেখে জলে ভেসে উঠল। থোকা থোকা ছাইয়ের থেকে উঠে এলো এক হাদাভোঁদা মানুষ। কথাগুলো লেগে লেগে যায়। র বলতে পারেনা। হেলে দুলে হাঁটে... সে মালতীর পায়ের কাছে পড়ে গোঙাতে শুরু করল, “মলি বাবা... পুখুলেল থেকে ...নামঘলে আগুন।” অনেকগুলো কলাপাতার শুকনো ডাঁটাতে ওকে ঢেকে ফেলেছে, গালে মুখে পিছল পিছল ভেজা কিছু লেগে ধরেছে। ওর নাকে এসে লাগল এক অদ্ভুত গন্ধ। ওর পুরো শরীর পুড়েছে, মাথাতে কি যেন করছে। সে মাথাটা বেড়াতে হেলিয়ে দিল।
“মণির মা, কী করছিস?” সে চমকে উঠল।
'‘কে?”
“আমি-ই, মণির মা।”
সে ধীরে ধীরে মাথাটা সোজা করে তার সামনে দাঁড়ানো মেয়ে মানুষটির দিকে তাকালো। জোনের মা। জ্যোৎস্নাতে মানুষটির শরীরকে দেখতে কেমন যেন লাগছে। সে চোখ দুটো মুছল।
“কে?”
“আমি জোনের মা।” মহিলাটি ওর কাছে বসল। এবারে মহিলা ওর কাঁধে হাত রাখল। “আরে দেখো, সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গায়ে একটাও কাপড় নেই।” ফেলানি কোনও কথা বলল না।
“ কী হয়েছে মণির মা?”
উত্তরে ওর চোখের জল জোনের মায়ের হাতে পড়ল।
“তুই ভালো করে কাপড় একটা গায়ে চাপাসনি কেন?”
ঐ একই রকম হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে রইল। জোনের মা ধীরে ধীরে সেখান থেকে উঠে গেল। মেঘ গিরিং গিরিং করে ডাকছে। ওর কোনও নড়ন চড়ন নেই। সে অনুভব করল ওর গায়ে একটা আধা পুরোনো কাপড়ের ওম।
“কাপড়টা পরে নে। ভালো কাপড় নয়। বেশ ক’ জায়গায় ফেটেছে।”
সে নড়ে চড়েনি।
“ এই একখানা কাঁথা নে। ছেলেটার গায়ে চাপিয়ে দে।” পুরোনো কাপড় জোড়া দিয়ে দিয়ে কাঁথাটা সেলাই করা হয়েছে।
“ কাঁথাটাও ভালো নয়, বুঝলি। উপরে দেবার জন্যে ভালো কাপড় একটুকরোও নেই। ছেঁড়া-ফাটা জুড়ে বানিয়েছি।”
হঠাৎ ডাকতে ডাকতে মেঘ যেন ভেঙ্গে পড়ে গেল। একচালা ঘরটা থেকে হুড়হুড় করে জল পড়ছে। দু’জনে নিঃশব্দে ভেতরে উঠে গেল। জোনের মা-ই কাঁথাটা মণির গায়ে চাপিয়ে দিল।
ফেলানির ইচ্ছে হলো মহিলাকে কিছু খেতে দেয়। এতো দিন বাড়িতে আসা মানুষকে যেমন খাইয়ে এসেছে। সকালে বুড়ির দেয়া মুড়ি অল্প ছিল। নরম হয়ে গেছে। সেগুলোই একটা কলাপাতাতে এগিয়ে দিল। মানুষটি বড় আগ্রহে সেগুলোই খেয়ে নিলো। মুড়িব’টি খেয়ে এক গ্লাস জল ঢকঢক করে পান করে যেন তার শরীরে প্রাণ ফিরে এলো।
“উস! বড় খিদে পেয়েছিলরে মণির মা।”
“কেন ভাত খাওনি কেন?”
“খাইনি।”
“আসবার সময় দেখি পুটি মাছ কিনে এনেছিলে।”
“এনেছিলাম, ভাতও রেঁধেছিলাম, মাছও রেঁধেছি।”
“তবে খেলেনা কেন?”
“ মণির মা, আমাকে শহরের বাবুনির মতো ডাকছিস কেন?” সে অল্প হাসল।
“ ভাত খেলি না কেন?”
“ কী আর পেটের খিদে থাকবে রে, এসেই বুড়োর গালি।”
“রাতের বেলা এখানে এসে বসে আছিস। জোনের বাবা কিছু বলবে না?”
“ সে কিছু টের পেলে তবে না বলবে। ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে এসেছি। শ্বাসের টান উঠে দিন দুই পর যখন একটু ভালো হয়, কাটা কাঠের মতো পড়ে থাকে। বুড়ো শরীরে এতো কড়া ঔষধ সইবে কেন?”
“তুই ঘরটার জন্যে এতো করিস। বুড়ো এতো গালি পাড়ে কেন?”
হঠাৎ জোনের মা ব্লাউজখানা খুলে ফেলল।ফেলে দিল গায়ের চাদর। পাকা জামের মতো রসে টইটম্বুর তুলতুলে দেহ নগ্ন হয়ে পড়ল।
“এই শরীরটার জন্যে বুঝলি, এই শরীরটার জন্যে।”
মহিলার রাগ চড়েছে।
“ওর গায়ে রসকষ কিছু নেই, রাতের কাজ করতে না পেরে সে আমাকে কী করে দেখ।” ছ্যাঁত করে সামান্য বিজলি চমকালো। সেই আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল কালো জামের থ্যাতলানো চামড়ার মাঝেমধ্যে লালা মাংস উঠে গেছে, ভরে গেছে ঘায়ে।
“ছুঁয়ে দেখ মণির মা, ছুঁয়ে দেখ।” মেয়েমানুষটি ওর ক্ষতবিক্ষত বুকে ওর হাতখানা লাগিয়ে দিলে। এবারে মানুষটি কেঁদে উঠলে, “ বল মণির মা , আমি কী করে ভাত খাই?”
এবারে সে জোনের মার পিঠে হাত রাখল। কিছু একটা বলতে গিয়েও তেমনি থেমে গেল।
“মণির মা, আমার শরীরটা ওর মতো শুকিয়ে গেলেই আমার শান্তি হবে। কিন্তু এই বেড়ালের শরীর, এর কিচ্ছুটি হয় না। কফ কাশি নিয়ে ঐ বুড়োর পাশে আমার এই শরীর...।” পাকা জাম যেমন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে সে তেমনি ফেলানির গায়ে গড়িয়ে পড়ল।
অল্প সময় দু’জনে এমনি করে বসে রইল। বৃষ্টি থেমেছে। বাইরে আবার আলো দেখা দিয়েছে। জোনের মা উঠে দাঁড়ালো । সে শরীরের আঁচল থেকে কয়েকটা নোট বের করল। এবারে টাকাগুলো ফেলানির হাতে গুঁজে দিল।
“একটা কাপড় কিনে নিবি।”
সে না না করছিল। জোনের মা বাইরে বেরিয়ে গেছে।
“পারবি যখন দিয়ে দিবি।” পেছনে না তাকিয়ে সে বেরিয়ে চলে গেল।
No comments:
Post a Comment