ফেলানি
রাতে শুতে যেতে দেরি হয়েছিল। মণি মায়ের আগে ঘুম থেকে উঠে গেছে। ফেলানি চোখ মেলে দেখল ছেলেটি বস্তাতে বসে সাহিত্য বইটি পড়ছে। সে আজ আর বানান করে পড়ছে না, ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে। ওর মুখ থেকে যেন আলো ঠিকরে পড়ছে। চেহারার দিকে তাকিয়ে ওর মুখেও হাসি ফুটে বেরুলো। বাবার চোখের মণি ছিল ছেলে। পারলে বাবা যেন ওকে আকাশের চাঁদও এনে দেয় আর কি। ছেলেকে পড়বার জন্যে ওরই মাপের এক জোড়া টেবিল চেয়ারও তৈরি করে দিয়েছিল। শহর থেকে কলম এনে দিয়েছিল। তার স্কুলের জামা গ্রামের আর সমস্ত ছেলের থেকে ভালো ছিল।
“মা, আমি স্কুলে কবে যাব?”
“আগামী সোমবার থেকে।” কথাটা বলে সে চুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। একমুঠো ভাত দুটো আলু দিয়ে বসিয়ে দিল। কালীবুড়ি এখনই আসবে। গতকাল যে মুড়িগুলো ভেজে রেখেছিল, এসেই সেগুলো সে বুড়ির কথামতো টিনে ভরিয়ে রেখেছিল।
“মণি, যা তো। কলাপাতা একটা কেটে নিয়ে আয়গে'।” গায়ে ভালো করে কাঁথা মুড়ে ছেলে একমনে বইয়ের ছবিগুলো দেখছিল। মায়ের কথাগুলো শুনতে মাথা তুলেও সে আবারও ছবি দেখাতে মন দিল।
“ভাত খাবি না বুঝি?”
“ হ্যাঁ।” ছেলে মায়ের দিকে তাকালোই না।
“ মাটিতে খাবি বুঝি?” মা ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল।
“পাতা আনতে কী করে যাব? রিজার্ভে জল জমে গেছে।” যেন সে জলে ডোবাতে নামেই না আরকি। জলের জন্যে নয়, ওর মন আসলে বইটি ছেড়ে যেতে চাইছে না।
মালতীর নিজের উপরে খানিকটা রাগ চড়ল। এতো কি শুতে হয়? বস্তির বেশির ভাগ মানুষ কাজে কর্মে বেরিয়েইছে। সে আর আজ কই নদীতে গিয়ে স্নান করতে পারবে? কালীবুড়ির ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল বুড়ি শাদা শাড়ি পরে আঁচলে চাবি বেঁধে তৈরি।
“ কী করছিস তুই, মণির মা?” সে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকালো। পেছনে কোলে বাচ্চা নিয়ে ফর্সা মেয়ে মানুষটি আর তারও সামান্য পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জোনের মা। দুজনে ভেতরে ঢুকে এলো।
“ ভাত খেলি?”
“ স্নান করলি?”
জবাবে সে মাথা নাড়ল। কালীবুড়িও এসে ঢুকে পড়ল।
“জলদি কর।”
“ মরদ নেই মেয়ে মানুষ এতো বেলা অব্দি শোয় !” ফর্সা মহিলাটি খিলখিলিয়ে হাসছে। মালতী দাঁড়িয়ে আছে। কী করে সে? স্নান করতে হবে, ভাত খেতে হবে।
“ যা কল তলাতে গিয়ে স্নান করে আয়গে'।” কালীবুড়ি কলতলাটা দেখিয়ে বলল। বস্তির ক'টা বাড়িতেই বা কল আছে। সবাই রাস্তার সরকারি কলের জলই খায়। তবে কালীবুড়ির কলের জল অন্যগুলোর চে' ভালো। সে দাঁড়িয়ে আছে।
“কী হলো ?” বুড়ি বিরক্ত হয়ে পড়ছে।
মালতী বুলেনের দিয়ে যাওয়া টিনটার দিকে তাকাচ্ছিল। কী করে সে । টিনটা তুলে নিয়ে যাবে কি? খাবার জলগুলো কী করে? ছেলেকে যে বলবে জল নিয়ে আসতে, ওর ইচ্ছে নেই।
যা কলের পারে বালতি আছে।” জোনের মা হেসে উঠল। সে কলের পারে স্নান করতে গিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে রইল। পেটিকোটটা ভিজিয়ে ফেলে যদি কী পরে যাবে সে? এই একটাই তো ভালো পেটিকোট রয়েছে ওর। ক্যাম্পে থাকার সময় যে বাড়িগুলোতেগিয়ে কাজ করত তারই এক বাড়ির দিদি একজন ওকে দিয়েছিল। সে প্রথমে শাড়িটা খুলল। দাঁতে কামড় দিয়ে কাপড়টা ধরে পেটিকোট খুলে কলের উপরে রাখল। জোনের মায়ের দেয়া শাড়িটা শরীরে রেখে চট করে এক বালতি জল সে ঢেলে দিল। ফাটা শাড়িটা ওর শরীরে লেপ্টে গেল। ফাটা, ভেজা শাড়িতে শরীর ঢাকতে না পেরে ভীষণ অস্বস্তি হলো। জোনের মায়ের মতো গলা করে সমস্ত তিক্তটা ঝেড়ে ফেলতে সে বিড়বিড় করে উঠল , ”এই বেড়ালের শরীর...” দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে পেটিকোটটা নিতে গিয়েই সে থেমে গেল। একটা তীক্ষ্ণ মিহি শিষ। চমকে উঠে সামনের দিকে তাকালো সে। সামনের বাড়ি একটার উঠোনে দাঁড়িয়ে একজন পুরুষ মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখে পড়তে স্পষ্ট একটা নোংরা আর কুৎসিত হাসি দেখতে পেল । শিউরে উঠল সে। মাথা নুয়ে ঘরের দিকে আসবার পথে ওর কানে পড়ল টানা ঢিল পড়বার মতো কিছু নারী কণ্ঠের গালি। শাড়িটা কোমরে প্যাঁচিয়ে নিয়ে কোলের বাচ্চাকে জোনের মায়ের কাছে তুলে দিয়েছে গৌরাঙ্গিনীমেয়েমানুষটি। বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানো এম্বেসেডার গাড়িতে হেলান দিয়ে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে । ওকে অনবরত গালি বর্ষণ করছে সে। বেঁটে, ফর্সা এই মেয়েমানুষের মধ্যে কোথায় যে এতো গালি লুকিয়ে ছিল।
“ কুকুর! শালা! মাইয়া দেখলে চুলকানি উঠে। এই বুড়িমায়ের দিকে তাকিয়ে একটা শিষ দে, দেখি তো। মার খেয়ে বেটা হেগে দিবি...।” লোকটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। বেরিয়ে এলো এক রোগা লম্বাটে দেখতে মহিলা। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিকের উগ্র রং, হাতে একটা খাড়ু। পরনে লাল পেড়ে একটা সবুজ শাড়ি। মহিলাটি কালীবুড়ির বাড়ির দিকে তেড়ে আসছিল। ঠিক যেন একটা ফড়িং ঝাঁপ দিয়ে বেড়াচ্ছে। জোরে একটা ঝাঁপ দেয় আর গোরাটিকে গালি দেয়, “ ঐ কুত্তি ! আমার বাড়ির অতিথিকে তুই গালি পাড়িস কেন?”
গৌরাঙ্গিনীও পিছিয়ে যায় নি, “ তোর অতিথি? চেনা আছে। তোর বিছানায় আসা অতিথি তোরই শরীর চাটতে থাকুক। অন্য বাড়ির ভদ্র মেয়ে মানুষের দিকে চোখ দেয় কেন?”
“ দেখ রেণ্ডী, জিহ্বা বের করে আনব কিন্তু!”
“পুলিশ লাগিয়ে তোকে একদিনেই জিন্দা লাশ বানিয়ে দেব।”
“ ডেকে আন তোর পেয়ারের লোকেদের।”
“ বিয়ে করা বৌ আমি। মাথার উপর পুরুষ মানুষ আছে। ঘরে ছেলে মেয়ে আছে। তোর মতো...।”
“বিয়ে করা বৌ । মাথার উপর পুরুষ মানুষ আছে। তোর মাথার উপরের লোকটাকে ডেকে আন। ওর মুখখানা দেখি একবার...।”
“ ঐ! আমার মানুষটার নামে তুই কেন কথা বলতে যাবি, শালি রেণ্ডী!” রোগা পাতলা মহিলাটি এবারে সত্যি ফড়িঙের মতো লাফিয়ে কালীবুড়ির বেড়া পার করে চলে এলো। এসেই গোরা মেয়েটির চুল টেনে ধরল।
ইতিমধ্যে মণির মা মাথা আঁচড়ে , কাপড় পরে, খাবার নামে ভাত দুটো ছুঁয়ে মুড়ির টিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে। বাইরে ঐ চকচকে লালপেড়ে শাড়ি পরা মেয়ে মানুষটির কীর্তি দেখে ওর গা কেঁপে উঠল। কি কুটিল আর হিংস্র চাউনি এই মহিলাটির। মেয়ে মানুষের যে এমন দৃষ্টি থাকতে পারে সে কল্পনাও করতে পারে নি। সেই দৃষ্টি এবারে ওকেই ঘিরে ধরল। “ ভদ্দর ঘরের মেয়ে যদি এই রেণ্ডী মেয়েগুলোর সঙ্গে কেন?”
“কাকে তুই রেণ্ডী রেণ্ডী বলছিসরে! চুপ করবিকি না বল?” এবারে জোনের মাও যোগ দিল। মাথার থেকে মুড়ির বস্তা নামিয়ে সে ঐ ফড়িং মেয়েটিকে চেপে ধরল। ফড়িং তখনো গোরির চুল টেনে ধরে আছে। জোনের মায়ের উঁচু লম্বাটে মজবুত শরীর। ধাক্কাটা ঐ রোগা পাতলা মেয়ে মানুষ সহ্য করতে পারে নি। সে এবারে গলা ফাটিয়ে চেঁচালো, “ এই রেণ্ডীগুলো আমাকে মেরে ফেলল রে! ঐ ড্রাইভার, ড্রাইভার! শালা বৌয়ের পয়সাতে মদ খেয়ে পড়ে থাকবি। বৌ বাঁচল কি মরে গেল, বেটার কোনও খবরই নেই। ঐ ড্রাইভার!” ওর খিনখিনে স্বর ভেঙে গিয়ে এক অদ্ভুত সুর বেরুচ্ছে।
ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন পায়ে পা লেগে চিঁ চিঁ করতে করতে শালিক তিনটা ধুলোয় মাটিতে একসা হয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কালীবুড়ির ঘরের সামনে ইতিমধ্যে একটা ভালো জটলা বেঁধেছে। এরই মধ্যে কালীবুড়ি এক কালীভক্তকে কিছু একটা বিধান দিচ্ছিল। বিধানের কাজ শেষ করে সে বেরিয়ে এলো। বুড়িকে দেখে মালতী আর মণি দুজনেই চমকে গেল। বুড়ির মাথাতে একটা দীর্ঘ জটা, কপালে লাল সিঁদুর।
বুড়ি আঙুল তুলে ড্রাইভারণীকে শাসিয়ে দিয়ে বলল, “ আমার বাড়িতে এই ভদ্র ঘরের বউ মায়ের পায়ে শরণ নিয়েছে। ওকে কেউ কিছু করলে মায়ের কোপ দৃষ্টিতে পুরো ভস্ম হয়ে যাবি বলে দিলাম।” বুড়ির রোগা শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। চর্বিতে ঠাসা থলথলে শরীরের একটা লোক এসে কালীবুড়ির বাড়ির গেটে দাঁড়ালো। লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায় এই মাত্র শুয়ে উঠে এসেছে, চোখ লাল হয়ে আছে। সে মুখের লালা মুছে ফেলে বৌয়ের কাছে চেপে দাঁড়ালো। “ চল, ঘরে চল।” সে একবার কালীবুড়ির দিকে তাকালো আর কিচ্ছুটি না বলে স্বামীর পিছু নিলো। স্বামী তার আগে আগে গামছাতে গিঁঠ দিতে দিতে যাচ্ছে। খানিক পরেই আবার সেই খিনখিনে গলার জোর গালি গালাজের সবটাই এসে কানে পড়ল। কান না দিলেও শব্দগুলো ঢিল পড়বার মতো ছুটে কানে আসছিল। বৌয়ের পয়সাতে খায় বলে খিনখিনে গলাটি চাবুক চালিয়ে যাচ্ছে। আর আড়ষ্ট জিহ্বে লোকটি নিজেকে বাঁচাবার জন্যে প্রাণপাত করছে। সে বারেবারেই বলতে চাইছে, নিজের রোজগারেই খাচ্ছে সে। গাড়ি চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করছে, বৌয়ের রোজগারে নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
বই বন্ধ করে মণি বসে ছিল। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এক নর্দমার থেকে ছেলেকে সে আরেক নর্দমাতে নিয়ে এলো বুঝি? যেখানটায় সে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই বসে ওর প্রাণ খুলে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরল। কালীবুড়ি ভেতরে এলো না। বাইরে থেকেই একটা থালাতে করে কিছু এগিয়ে দিয়ে বলল, “ দে, পোলারে দে ।” বুড়ির গলাটা যেন কেমন কেমন লাগছে ,”আর তুই বেরোসনি যে? মুড়িতে যদি বাতাস লেগে যায়, কেউ নেবে না বলে দিলাম।” সে বুড়ির হাত থেকে থালাটা নিলো। মিষ্টি আর কয়েক পদ ফল। থালাটা দেখে ছেলে হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে মালতীরও মনের ভার নেমে গেল।
“ আয়,মণির মা।” জোনের মা মুড়ির বস্তা মাথাতে উঠিয়ে নিয়েছে। মালতী একটা টিন মাথাতে, আরেকটা কোমরে তুলে বেরিয়ে এলো। বাইরে বেরিয়ে দেখে গোরাটি উঠোনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া ক'মুঠো ঢেঁকি, ক'মুঠো কলমি, কলার থোড় দুটো গুটিয়ে থলেতে ভরছে আবার। কাঁখ আর মাথার থেকে টিন দুটো নামিয়ে মালতী ওকে জিনিসগুলো থলেতে ভরাতে সাহায্য করল। সে লক্ষ্য করল মেয়েটির গালে আঁচড়ের দাগ। তিনজনেই কালীবুড়ির গেটে গিয়ে পৌঁছুলো। মালতী দাঁড়িয়ে গেল। কালীবুড়ি আসে নি।
“কার জন্যে দাঁড়িয়ে আছিস? কালীবুড়ির জন্যে? ” মাথার চুলগুলো ঠিক করতে করতে গোরা ওকে জিজ্ঞেস করল।
“ হ্যাঁ।”
“ বুড়ির শরীরে মা ভর করেছেন ।” জোনের মা অল্প সময় চোখ মুদে দাঁড়িয়ে রইল। সঙ্গে সেই গৌরাঙ্গিনীও।
তিনজনেই রাস্তার দিকে বেরিয়ে গেল।
“তুমি...মানে তুই এই জিনিসগুলো বাজারে বিক্রি করবি?” গৌরাঙ্গিনীকে তুমি বলে সম্বোধন করতে গিয়ে ওর জোনের মায়ের কথাগুলো মনে পড়ল, “ আমাকে শহরের বাবুণীর মতো কেন ডাকছিস?”
“ হ্যাঁ গো! তা না করে করবটা কী? কাল রিজার্ভের থেকে জোগাড় করে রেখেছি।”
“সংসার চলে অমন করে?”
“ কইআর চলে মণির মা? ছেলেটার খরচ আছে, আমার পেট আছে, আছে ঘর ভাড়া। খরচাপাতি অনেক।”
“তোর মানুষটা?”
“ বলতে পারব না, ও পেটে থাকতেই নেই।”
“ নেই মানে?”
“ মিনতির মা -বাবা নেই। দিদির ঘরে বড় হয়েছে। দিদিই ওকে গুয়াহাটির এক বড়লোকের ঘরে কাজ করতে ঢুকিয়েছিল। সেখানেই সর্বনাশ হলো ওর।”
“ কী হলো ওখানে?”
“ মেয়ে মানুষের সবচে' বড় বিপদটা হলো, আমার পেট করে ও চলে গেল।”
“ কে সে?”
“মালিকণীর ভাই।”
“ তুই তাকে ছেড়ে দিলি? গুণ্ডা কোথাকার।”
“ আর বলিসনে মণির মা, ওকে খারাপ মানুষ বলে বলিসনে, গুণ্ডাও না। সে আমাকে বড্ড ভালোবেসেছিল।” এতো আদর কোনও ছেলে মানুষ মেয়েমানুষকে দিতে পারে না। কী আর করে । বেচারা ওর বাড়ি ছাড়ে কী করে?” মেয়ে মানুষটির মুখের থেকে কেউ যেন রাগ উষ্মা সব মুছে নিয়ে গেল। ওর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে এলো। কোমল মুখখানাতে একটা লাজুক লাজুক হাসি ফুটে বেরুলো।
“ এতো সুন্দর ছেলেমানুষ আমি আর দেখিনি। ওর চুলগুলো, চোখ দুটো, শরীরের রং...। ফিল্মের হিরোর থেকেও সুন্দর ছিল সে। কী রকম করে যে কথা বলত সে...।” বলতে বলতে ওর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ছেলেটি বাবার চেহারা পেয়েছে। সে ওকে একটা চুমো খেল।
ওরা এসে বড় রাস্তাতে পা দিল। হঠাৎই মালতীর খেয়াল হলো, সেদিন তো সে কালীবুড়ির সঙ্গে এসেছিল। বাড়িগুলোর পথগুলোর কিছুই তো ওর মনে নেই। ড্রাইভারণীর কাজিয়া, তীক্ষ্ণ শিষটা, কালীবুড়ির জটা---সব মিলিয়ে ওর মাথাটা চেপে ধরেছিল যেন। কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না সে। তা না হলে অমন করে কালীবুড়িকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস না করে আর কি সে বেরিয়ে আসে? বুড়ির সঙ্গে করে আসার দিন যে পথে নেমে গেছিল সেটির মোড়ে এসে সে দাঁড়িয়ে গেল।
“ এদিক দিয়েই গেছিলাম। বাড়িগুলো বের করে নিতে পারবো তো?”
“আজ নাহয় বাজারেই চল। এই ক'বাড়িতে কালকেই তো মুড়ি দিলি। আজ কি আবার নেবে ওরা?”
হ্যাঁ, সে কথা তো সে ভাবেই নি। লোকে কি আর ভাত খাবার মতো করে মুড়ি খাবে ? বাজারে যাবার কথাতে ও একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। বাজারে গিয়ে ও কীভাবে কী করবে?
“ কী হলো দাঁড়িয়ে রইলি যে, চল। আজ বেরুতেই কত দেরি হলো।”
দ্রুত পায়ে তিনজন গিয়ে বাজারে পৌঁছুলো। বাজারে ভিড় শুরু হয়ে গেছে। বসার আগে তিনজনেই ঠিক করল আজ মুড়ি পাইকারকেই দিয়ে চলে যাবে।মিনতিও জিনিসগুলো ব্যাপারীকেই দিয়ে দেয়া ঠিক করল। দুটো পয়সা কম পেলেও কিছু হবে না।আজ সবারই বাজারে কাজ আছে। মিনতি ছেলেকে ডাক্তার দেখাবে, ক'দিন থেকেই ওর পেট খারাপ যাচ্ছে।ছেলের জন্যে একটা জামাও নেবে।জোনের মা একটা কড়াই কিনবে। নিজের জন্যে পারলে একটা ব্লাউজ, বুড়োর ধুতি, জোনের জন্যে স্লেট।অনেক দিন ধরেই নেবে নেবে করছিল কিন্তু এতো দিন ধরে বাজার বসেছিল যদিও ভিড় ছিল না বললেই চলে। আজ ক'দিন ধরেহে বাজার জমতে শুরু করেছে। তিনজনেই গিয়ে দোকানীকে জিনিসগুলো সমঝে দিয়ে পয়সা নিয়ে বাজার করতে বেরুলো। প্রথমে ওরা নবীনের ওখানে গেল। নবীন স্লেট-পেন্সিল, বই খাতার ব্যবসা করে। ওদের বস্তিতেই থাকে। হাটে হাটে 'কুঁহিপাত'১, বই , স্লেট, পেন্সিল, কালি , পেন, পেনের নিব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
নবীনও তাড়া খাওয়া লোক। এই বস্তিতে ওর আজ তিন বছর হলো। মা বাবা কেউ নেই। কেবল এক ভাই পুতুকণ। মা বাবা দুজনেই আগে পরে মারা গেছেন। বাধ্য হয়েই তাকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তার পরেই এই স্লেট পেন্সিলের ব্যবসাতে নেমে পড়েছিল। বড় মামার বইয়ের দোকান ছিল। মামা প্রথম প্রথম সাহায্য করেছিলেন। মামার দোকান থেকেই বই খাতা নিয়ে গিয়ে হাটে হাটে বিক্রি করে ফিরত। দাদা আর ভাইয়ের ছোট সংসারটা চলে যায়। মাথা গুঁজবার বাড়ি একটা ছিল। ধান ছিল, দুধ ছিল। শাক, কলাগাছের ঝাড় বাড়ির কোনেই ছিল। চলে যাচ্ছিল। নবীন ভেবেছিল মেট্রিক পাশ করলে পরে কলেজে পড়িয়ে ভাই পুতুকণকে মানুষ করবে। দুটোই স্বপ্ন ছিল তার। পুতুকণ বড় মানুষ হবে আর তার নিজের স্লেট পেন্সিলের দোকান হবে।স্বপ্ন দুটোকে এহাত ওহাত করে তালুতে নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে খেলবার মতো করে একটা চেহারা করে ফেলেছিল সে। ছুঁয়ে উত্তাপের আঁচ নেবার মতো অবস্থাও হয়েছিল। ঠিক সেই সময়েই সব ওলট পালট হয়ে গেল।
বাজারে বাজারে বই , খাতা, স্লেট পেন্সিলের বোঝাটা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আগে কোনোদিনই না শোনা শব্দ কয়েকটা ঘন ঘন শুনতে শুরু করল। 'বিদেশি, 'আন্দোলন', 'আসু','সংবিধান', 'ইয়াণ্ডাবু সন্ধি', 'ছাত্র সংস্থা', 'গণ সত্যাগ্রহ',। কয়েকটি নাম বাজারে আলু পেঁয়াজের মতো গড়িয়ে বেড়াতো, 'প্রফুল্ল মহন্ত', 'ভৃগু ফুকন'। লোকে বেশি বেশি করে খবরের কাগজ পড়তে শুরু করেছিল। ওই যে সব শব্দ সর্বত্র শোনা যায় খবরের কাগজগুলোও সেগুলোতেই ভরে উঠছিল। সে ভেবেছিল ওই শব্দগুলো খবরের কাগজে আর মানুষের গুঞ্জনের মধ্যেই রয়ে যাবে। কিন্তু রইল না। শব্দগুলো পথে নেমে এলো। ঘরে ঘরে, হাটে বাজারে ঢুকে পড়ল। প্রায়ই তার বাজারের দিনগুলো মার যেতে শুরু হলো। বাজারের ক্ষতি হলেও বন্ধগুলোতে থেকে যে যখন বাড়িতে থেকে বাগিচা সাফাই করত দেখত পুতুকণ প্রায় রোজই ঘরে থাকে না। সে বেরিয়ে না গেলেও ওর বয়সের কিছু ছেলে এসে ডেকে নিয়ে যায়। অবিরত যে ছেলেটি বইয়ের পাতায় মাথা গুঁজে পড়ে থাকত সে এখন বই ছোঁয়েও দেখে না । পড়ার মধ্যে খবরের কাগজই বেশি করে পড়তে শুরু করেছে।
সেদিন নবীন ঘরে ছিল। ভীষণ শীত করেছে, ঘন কুয়াসা ছিল। সে গরুটার জন্যে বস্তা দিয়ে গায়ে দেবার জামা একটা তৈরি করেছিল। পুরো ছত্রিশ ঘণ্টার বন্ধ ছিল। গোটা শহর থমথমে হয়ে গেছিল। ভোটের অফিসের মুখে মুখে পুলিশ মিলিটারি। ছাত্র সংস্থার ছেলেরা দলে দলে মানুষকে বাড়ি বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গেছে। পুতুকণ ওদের পাড়ার লোকগুলোকে জড়ো করে পরের দিন ভোর রাতে সার্কিট হাউসে যাবার কথা বলে রেখেছিল। এতো গুলো ছেলে-বুড়োতে মাথা নত করে শুনে গেছে। ভোর রাতে দলে দলে মানুষগুলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের মধ্যিখানে সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলল গিয়ে। সেই রাতে পুতুকণ বাড়ি ছিল না। নবীন রাস্তার এপার থেকে বড় বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। চারপাশের মানুষের মধ্যে 'নমিনেশন পেপার', 'ইলেকশন', 'কার্ফিউ', 'আর্মি', 'পুলিশ' এই শব্দগুলো উড়ে বেড়াচ্ছিল। সার্কিট হাউসের থেকে একখানা পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে এসেছিল, গাড়িতে একজন মহিলা বসে। রাস্তার এপাশ থেকে দেখতে পেয়েছে নবীন। মুহূর্তে মানুষগুলো গাড়িটি ঘিরে ফেলেছিল, এগুতে দিচ্ছিল না। পুলিশের মারে ওরা ছিটকে পড়েছিল। তারই মধ্যে শুনেছিল গুলির শব্দ। লোকগুলো মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। শুধু পথের মধ্যিখানে এক কিশোরের মৃতদেহ পড়ে ছিল। নবীন দৌড়ে গেছিল। দেহটি ছিল পুতুকণের। সে তাকিয়ে রইল, পুতুকণের মৃত্যু যেন সমগ্র শহরের জন্যে একটা উৎসবে পরিণত হলো। ফুলের মালা, গান বাজনা, ধুমধাম শ্রাদ্ধ, সর্বধর্ম প্রার্থনা, গাড়ি মটরে আসা মানুষ, সার সার বাতি। নবীনের কেমন যেন লাগল সব কিছু। এক রাত দুপুরে সে সেই শহর থেকে, পুতুকণকে হারানো শূন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার মতো চলে এলো। সে সময় সে আর কিছু চায় নি। কেবল ফুল, প্রদীপ, ভজন , কীর্তন, ফটো, মানুষের ভিড়ের চাপ থেকে বেরিয়ে এসে বুক ভেঙে কাঁদতে চাইছিল।
মাঝ রাতে ট্রেনে চেপে সত্যি নবীন এক কোনে বসে বুক ভেঙে কেঁদেছিল। রেলখানা কোথায় যাবার জন্যে স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। তখন অব্দি ট্রেনে কেউ উঠেই নি। গোটা রাত সে সেই শূন্য রেলে উঠে হো হো করে কেঁদেছিল। ভোর রাতে ট্রেন ছেড়েছিল। মেঝেতে হাঁটু গুঁজে বসা নবীনকে এক কাপ চা এনে দিয়েছিল মিনতি। ওকে কাঁদতে দেখে ওর মায়া হচ্ছিল। সেদিন মিনতিও মাঝরাতে সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে যে বাড়িতে এতো দিন ধরে কাজ করেছে । সেখানেই ওরা জগুর দেখা পেয়েছিল। জগু রেলে ঘুরে চানা বিক্রি করে বেড়ায়। সেদিন কোথাও এক বড় গোলমাল হয়েছিল। রেল যাবার পথে কোনও চা বাগানে সে রাতেই সাতজন মানুষ মারা গেছিল। সে এলাকাতেকার্ফিউ ছিল। নবীন যে কামরাতে চড়েছিল তাতে মাত্র ওরা তিনজনই ছিল---নবীন, মিনতি আর জগু। তিন জনেই চানার সঙ্গে দুঃখগুলোকেও নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। জগুই ওদের বস্তিতে নিয়ে এসেছিল। বস্তিতে এসে নবীন আবার আগের ব্যবসাই শুরু করেছিল। চার মাস পর মিনতির রাজপুত্তুরের মতো একটা ছেলে হয়েছিল।
সেই নবীনের ওখানে স্লেট বই কিনতে এসেছে জোনের মা, মিনতি আর মালতী।
ওদের দেখে হেসে নবীন ওর গ্রাহককে বিদেয় করে নিলো।
“ চা খাবি?” বলেই পাশের দোকানে বলতে চলে গেল। জগুর দোকান । ওই গোলমালগুলোর জন্যেই জগু রেলে চানা বিক্রি বন্ধ করে বাজারে চায়ের দোকান খুলে বসেছে। পাঁচটা ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার। ওর স্ত্রী ঘরে চিঁড়ার নাড়ু, মুড়ির নাড়ু, ভুজিয়া তৈরি করে বেঁধে দেয়। সে এখানে চা তৈরি করে বেচে। বাজারগুলো ঠিক মতো বসলে উপোস করতে হয় না। খাবার খরচ উঠেই যায়। বাকি খরচের জন্যে টাকা জমানোটা বড় কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। জগুর স্ত্রী দেখতে রোগা হলে হবে কি, হাত দুটোতে যেন মা লক্ষ্মীর বাস। ওর হাতে নারকেলের সন্দেশ, মচমচে ভুজিয়া, মুড়ির নাড়ু,চিঁড়ার নাড়ুর জন্যেই জগুর দোকানে একবার চা খেলেই লোকে পরের বার আর একবার আসে। মুড়ির নাড়ুগুলো মুখে দিলেই গলে যায়। শহরের কিছু বাড়িতেও ওর বৌ এই সব জিনিস বানিয়ে , বিশেষ করে নারকেলের সন্দেশ, নিয়মিত দিয়ে আসে। বিহু , পুজোর দিনগুলোতে ওর টগর ফুলের মতো শাদা নারকেলের নাড়ু আর সন্দেশের চাহিদা বেড়ে যায়।
নবীন জগুর দোকানের লাল চা আর সন্দেশ এনে তিনজনকে খেতে দিল। নবীন মালতীর সঙ্গে বড় ভদ্রভাবে ব্যবহার করছে। নারকেলের সন্দেশটা খেয়ে সে বলেই ফেলল , “ বড় ভালো হয়েছে তো!” জোনের মা স্লেট দেখছে। হাতে সন্দেশ নিয়ে মালতীর চোখের সামনে ভেসে উঠল ছড়ানো হাতে বড় আদরে তুলে আনা পুকুর পারের নারকেলগুলো। দুটো গাছে ধরেছিল। দিদা ঠিক এরকমই এক থালা সন্দেশ বানিয়েছিল। দুজনের সন্দেশ এতোটাই এক! কামড়টা দিয়েই ওর বুকখানা খা খা করে উঠল।
“খা মণির মা, কী ভাবছিস?” সঙ্গে আসা ছেলেমেয়েদের যেমন মায়েরা দেখে দেখে নিয়ে যায় মিনতি ওকেও তেমনি করে দেখছে।
জোনের মা স্লেট কিনল, মিনতিও একখানা ছোট মণি বসানো স্লেট কিনে ছেলেটির হাতে দিল। সে হেসে স্লেটের মণিগুলো ছোঁবার কাজে নেমে পড়ল।
“ তোর ছেলে দেখি পড়তে শুরুই করেছে।” নবীন ছেলেটির গালে হাত বুলিয়ে দিল।
“ দেখবি, ও কত মেধাবী ছেলে হবে। ওকে আমি যে করেই হোক পড়াব।” মিনতির মুখ আবারো কোমল হয়ে এলো।
মালতীও একখানা খাতা নিতে চায় বলে জোনের মাকে জানাল। প্রায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ খাতা একটা আর কলম কত পড়বে?” সে ব্লাউজের ভেতর থেকে টাকাটা বের করল, “ তোর দেয়া টাকাটা আছে।”
“ এই পয়সাগুলো তো তোকে একখানা কাপড়ের জন্যেই দিয়েছিলাম।” কথাগুলো বড় করে বলাতে ও লজ্জা পেয়ে গেল।
“ হোক গে। একটা কাঁপড় তো তুই দিলিই দেখি।” সে পেন একটা আর খাতা দুখানা নিলো।
নবীন হিসেব করে করে ওদের থেকে যতটা পারে কম করে পয়সা নিলো। নবীনের ওখান থেকে ওরা একটা কাপড়ের দোকানে গেল। বাজারে যাবার এই রাস্তার দোকানগুলো হাটবারে মুল দোকান থেকে অল্প অল্প এগিয়ে আসে। বাসনের দোকানের বাসনে, কাপড়ের দোকানের কাপড়ে আর বাক্স পেটরার দোকানের বাক্সতে ওদের সামনের জায়গাটা ভরে যায়। মাড়োয়াড়ি বুড়োর দোকানে ভালো একখানা ভিড় হয়েছে। লাল, হলদে দখনা পরা একদল মেয়ে রঙিন সুতোগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিল। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন ফুলের উপর প্রজাপতির মেলা বসেছে। দেখলেই বোঝা যায় চুলপাকা ঐ মাড়োয়াড়ি বুড়োর সঙ্গে এই মেয়েদের ভালোই জানাশোনা রয়েছে। মিনতিরা ভেতরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের ভিড়ের ভেতর থেকে বুড়ো ডাক দিল,
“ কী নিবি রে?”
“ অনেক কিছুই নেব রে!” জোনের মা খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল।
হাসিতে উজ্জ্বল মুখখানার দিকে মালতী খানিক তাকিয়ে রইল। চুলপাকা মাড়োয়াড়ি বুড়োর সঙ্গে দর কষাকষি করে জোনের মা একখানা সাদা ধুতি, একটা সাইজের হাত কাটা গেঞ্জি আর একটা ব্লাউজ কিনল। মিনতি ছেলের জন্যে একটা পেন্ট কিনল। দুজনে হাতের বাকি পয়সাগুলো গুনল, মেলাল। সেই পয়সাতে দু'জনে মিলে একটা পেটিকোট কিনে মালতীকে দেবার জন্যে এগিয়ে দিল। সে না না করছিল।
“ ধার শোধ করে দিবি, পরে।” মিনতি বলল।
“ ধার আমি কোত্থেকে শুধব?” ওর কাঁদো কাঁদো অবস্থা। বুক কেমন করছিল। ওদের দু'জনেরই নেই আবার অন্যকে দিচ্ছে। পেটিকোটের পোটলাটা সে বুকে জড়িয়ে ধরল। তিনজনে বেরিয়ে এলো। বস্তিতে যাবার পথে পড়ে কল্যাণ ডাক্তারের হোমিওপ্যাথিক ফার্মাসি । মিনতি ওখানে ঢুকে ছেলেটার জন্যে ঔষধ নিয়ে যাবে। খানিক দূর হেঁটে মালতী কাপড়ের পোটলাটা মিনতিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ আমাকে কালই জোনের মা টাকা দুটো দিয়েছে। তার ধারই কী করে শোধ করি?”
“ তোকে কে ধরেছে ধার নে বলে?”
“ তোরা আমাকে রোজ খাওয়াবি পরাবি বুঝি?” ওর চোখে জল নেমে এসেছে।
“ কী করে পারব মণির মা?” জোনের মায়ের গলা ধরে এলো।
“ তুই কি একটা বাসন নিবি বলেছিলি না?” মিনতি বাসন বর্তনের একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালো।
“ ওর ঘরে কড়াই একটাই নেই, থাল বাটি এক জোড়াও নেই।” জোনের মাও বাসনের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল।
তিনজনে একটা কড়াই , থালা দুখানা, বাটি একটা, গ্লাস একটা আর একটা বালতি কিনল। ওর হাত খালি হবার জোগাড় হলো।
“ থালা দুখানা লাগবে না, একটাতেই হবে। গ্লাসও লাগবে না তো।” দুইজনেই কিছু বলল না। সে নিজেই একটা থালা আর একটা গ্লাস রেখে দিল।
“ টাকা কী রইল?” জোনের মা জিজ্ঞেস করল।
উত্তরে সে হাত দুটোমেলে ধরল। কথাটা মিনতিই প্রথমে তুলল। ও পরের বাজারে আসার সময় ডালের বড়া বানিয়ে আনতে পারে দেখি। মিনতি লবণ তেলের খরচটা ঐ ডালের বড়াতেই বের করে থাকে। ওরা এবারে কলাই ডাল আধা কেজি, মসুর ডাল আধা কেজি, পান-মশলা আর কালিজিরা কিনল। মালতী মসুর ডাল দেখে জিজ্ঞেস করল, “ দুরকম ডাল নিলি যে?”
“ দু'রকম বড়া বানাবি।”
“আমি এসব করিনি কখনো, গ্রামে দিদাকে বানাতে দেখেছি।”
“ কাল তো বাজার নেই, আসবি সকাল বেলা, আমি শিখিয়ে দেব।”
“ বড়া কিনবে কে?”
দুজনেই হেসে উঠল, “ এতো মানুষ বাজারে এসে এতো এতো জিনিস কিনছে।” সে মানুষের দিকে তাকালো, সব্বারই বেগগুলো শাক সবজিতে উপচে পড়ছে। প্রায় সব মানুষের বেগে সজনে আর মিষ্টি কুমোড়ের ডোগা বেরিয়ে আছে। সে নরম নরম সজনে বিচির স্বাদ জিহ্বে অনুভব করল। কিনবে কি একমুঠো সজনে? বাজার ভরে চতুর্দিকে সজনের দম। পর মুহূর্তেই পিছিয়ে এলো। ওর চোখ যেন পুড়ে যাচ্ছে। দু'ফোঁটা জল এসে চোখ ঝাপসা করে দিল। মানুষের ভিড়ে গমগমে বাজারটি, এমন কি ওর সঙ্গে করে এসেছে যে এই মেয়েমানুষ দুটি--তাদেরকেও যেন ধোঁয়া রঙের একটা পর্দা ঢেকে ফেলল। দৌড়ে সে গিয়ে লালমাটিতে লেপে রাখা রান্নাঘরে ঢুকল। চুলোর কাছে কয়েকটা সজনে, ভেতরে নরম নরম বিচি হয়েছে। তেলে মেথি ফোটার গন্ধ, আদা সরষের বাটা, বুক চেরা কাঁচা লংকার গন্ধের সঙ্গে আরেকটা গন্ধ বারে বারে ওর নাকে এসে লাগছে। এইমাত্র পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান সেরে এসে ওর কাছে ভাত খেতে বসেছে মানুষটি। এ তারই গায়ের গন্ধ। মানুষটি মুখের দিকে না তাকিয়ে ওরই থালাতে সরষে মাখানো সজনে ডাঁটা দিয়ে দিয়েছে। সে তারই একটা হাতে নিয়ে চুপি চুপি বলছে, “আমাকে দিয়ে দিচ্ছ কেন? আমি কি নিইনি না কি?” এবারে মানুষটি ভাতের পাতের থেকে মুখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে, “ ডাঁটাগুলো চিবুতে কোন ছাগলী ভালোবাসে?” সরষে, আদা, লংকা, মেথির গন্ধের সঙ্গে দুটো হাসির গন্ধ মিশে গেছে...। ওর চোখে আটকে থাকা জলের ফোটা গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। আবার পরিষ্কার হয়ে এসেছে বাজারটি। কাছের বৌমানুষ দু'জন। দু'জনে মিলে আধা কেজি মসুর আর আধা কেজি কলাই ডালে বড়া তৈরি করে বেচলে কতটা লাভ হবে তারই হিসেব করছিল। মিনতি ওকে বলতে চাইছিল, সপ্তাহের বাজারে কয়েকটা বড়া বানিয়ে আনতে পারলে অন্তত ওর লবণ তেলের খরচটা বেরিয়ে যাবে। সে তৎক্ষণাৎ মালতীর গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলের ফোটা দেখতে পেল।
“ কীহলো রে!”
“ শরীর খারাপ লাগছে বুঝি?”
দু'জনেই উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সে এবারে দুটি মহিলার উদগ্রীব মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যি কথাটিই বলে ফেলল।
“ আমার সজনে খেতে ভালো লাগত, মণির বাবা...”, ওর গলা ধরে এলো।
“ ছাড় হে মণির মা, বরের টান বড় টান। আমার দিকেই তাকা না। শ্বাস টেনে টেনে আমাকে গালি পাড়তে থাকে মানুষটা, ওর কিল ঘুসি। সেই যদি একবার বলে উঠে ' জোনের মা, শুনে যা তো...' আমি আর সব ভুলে যাই। মাছি তাড়ানো, ইঁদুর তাড়ানোর ঔষধ ফেরি করে করে মানুষটি এখনো সংসারটাকে টানছে। বুড়োটা চলে গেলে...” এবারে জোনের মায়ের গলা ধরে এলো।
“মেয়ে মানুষের মরদের টানটা বড় টানরে মণির মা, তা সে না হয় মরেই যাক...।” মিনতির একই দশা।
হনহনিয়ে হেঁটে তিনজনে বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। মালতী ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে কালীবুড়ির ঘরে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে । কালীমূর্তির সামনে জটাধারী সিঁদুরের ফোটাতে কালীবুড়িকে প্রথমে সে চিনতেই পারেনি। মাকালীর সামনে নৈবেদ্য আর পয়সা জমা হচ্ছে। মানুষ আসছেই। ওর চোখের সামনে ড্রাইভার এলো। সে গামছা পরে আসে নি, এক জোড়া প্যান্ট সার্ট পরে এসেছে। ড্রাইভার এসে কালীবুড়ির পায়ে প্রণাম করল। তারপর সিঁদুর মাখানো থালাতে টাকা বিশটা রাখল। ভাবগম্ভীর হয়ে লোকটার কালীবুড়িকে প্রণাম করা দেখে মালতীর হাসি পেয়ে গেল। কী মানস করছে লোকটি? বৌয়ের সুমতি? মণি ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘর এসেছে। বই, খাতা আর পেন্সিল পেয়ে সে হেসে ফেলল। কড়াই, থাল, গ্লাস ক'টা বের করে মা মণিকে বলল, “ এগুলো তোর জন্যে।” সে জিনিসগুলো গুছিয়ে চুলোর কাছে রাখল। চুলোর কাছে এক আঁটি ঢেঁকি শাক, চালতা দুটো, এক আঁটি কারিপাতার ডোগা , শুকনো লাকড়ি এক আঁটি।
“রিজার্ভে কার সঙ্গে গেছিলি?”
“জোনের সঙ্গে ।” মালতী চুলোর কাছে রাখা জিনিসগুলো দেখছিল আর দেখছিল ছেলের শুকনো মুখ। বাবা নেই বলেই ছেলেটাকে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। মা ওর মাথাতে হাত বুলিয়ে দিল,” বাবা খিদে পেয়েছে?” সে রা করল না। শুধু ডালের পোটলাটা খুলেছে।
“ আজ কি ডাল রাঁধবি মা?”
সে বলতে চাইছিল, “ এ ডাল খাবার জন্যে নয়।” বলল না। ছেলে ছেপ গিলছে।
“রাঁধব বাবা।” ডাল কতকগুলো ধুয়ে ফেলল।
বাইরে ঢাকের শব্দ হচ্ছে। মণি দৌড় দিল। কালীমায়ের সামনে বসে ঢাক বাজাচ্ছে বড় রাস্তার পাশের দোকানের মালিক যদু। বস্তি বহু মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। কেউ একজন বেসুরো গলায় কীর্তন আরম্ভ করেছে।
মালতী ডালে ঢেঁকি শাক কতক গুলো আর চালতা দু টুকরো ফেলে দিল। গন্ধতে সে টের পেল চালতাটা মিষ্টি। তেল দিতে গিয়ে দেখে বোতলে এক ফোটাও তেল নেই। হবে, গন্ধটা তো হবে। ভাত নামিয়ে ছেলেকে ডাকতে গেল। কালীমায়ের সামনে প্রণাম করছে বুলেন। বুড়ি ওকে আশীর্বাদ করছে। সিঁদুর মাখানো থালাতে টাকা দশটা দিল। বুড়ি মানুষকে বিধান দিচ্ছে---মালতী অল্পসময় দাঁড়িয়ে তাই দেখল। ঢাকের শব্দ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। বুড়ি এবারে কালীমায়ের সামনে নাচতে শুরু করল। বুড়ি নেচে নেচে দাঁতে কোনও এক ভক্তের দেয়া পায়রা একটার গলা ছিঁড়ে রক্তগুলো পান করে ফেলল। সমবেত সবাই সাষ্টাঙ্গ দণ্ডবৎ করল। চারদিকে ধ্বনি উঠল –জয় মা কালী! মালতীর শরীর কেমন ঘুলিয়ে এলো। অবাক হয়ে দেখছিল ছেলে, ওকে হাত ধরে টান দিল। কিছুতেই আসবে না। সে ভেতরে গিয়ে বস্তাতে শরীর এলিয়ে দিল। গোটা দিন ধরে পরিশ্রম গেছে। ক্লান্তিতে ওর শরীর ঢলে পড়েছে। ঘুমে চেপে ধরা অবস্থাতেই সে একসময় টের পেল মণি ওর কাছে এসে শুয়েছে।
সকালে সে বস্তির অন্যদের সঙ্গেই জেগে গেল। উঠেই নাকে একটা গন্ধ পেল। ধূপধুনো, ফুল, মিঠাতেলের বাতি। উঠে বাইরে এলো। উঠোন নোংরা হয়ে আছে। কলার খোসা, প্লাস্টিকের থলে, কলাপাতা--এমন নানা জিনিসে উঠোনটা ভরে আছে। অথচ বুড়ি রোজ উঠোনটাকে ঝেরে লেপে পরিষ্কার করে রাখে। বুড়ির ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে দোয়ার বন্ধ। সকাল সকাল উঠে বুড়ি কাজ শুরু করে, আজই বা কী হলো? সে দোয়ারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরে একটা অস্পষ্ট গোঙানোর আওয়াজ। কীই বা হলো বুড়ির? আস্তে আস্তে দরজাতে কয়েকটা টোকা দিল। দরজাটা খোলাই আছে। ভেতরে যাবে কি যাবে না ভেবে সে দাঁড়িয়ে রইল। এবারে দুর্বল গলার ডাক শুনতে পেল, “মণির মা।” সে ঢুকে গেল। বুড়ি বিছানাতেই পড়ে আছে। বুড়ির চোখজোড়া দুর্বল।, মুখখানা ম্লান। সে বুড়ির কাছে চাপল। বুড়ি ওকে একগোছা দিল। বিছানার নিচের কাঠের ছোট একটা বাক্স দেখালো। বুড়ির নির্দেশে বাক্সটার থেকে একটা প্লাস্টিকের বেগ তুলে আনল।বেগে কয়েকটা নোট আর খুচরো পয়সা। বুড়ি ওকে বিছানার তলার বাক্স একটাতে পয়সাগুলো রাখতে বলল। বুড়ি উঠে বসেছে।
“ চা খেয়েছিস?”
“ না।” সে কী করেই বা বলে যে তার ঘরে চায়ের কোনও জোগাড় যন্ত্রই নেই।
“ছেলেকে কী দিলি?”
সে চুপ করে রইল। এখন চাল আনতে যাবে মাত্র।
বুড়ি আবারো বিছানাতে শরীর এলিয়ে দিল। ঠিক শোয় নি। যেন বড় ক্লান্ত। মালতী গামছা একটা ভিজিয়ে বুড়ির মুখখানা মুছে দিল। মরাপাটের মতো শাদা চুলগুলো আঁচড়ে ঠিক করে দিলে। বুড়ির কপালের সিঁদুরগুলো দেখে ওর ভাল্লাগেনি। গামছাটা আর একবার মুছে ওই সিঁদুরগুলো মুছে দিল। বুড়ি ঠোঁট দুখানা জিহ্বে ভেজাবার চেষ্টা করছে। সে বুড়ির স্টোভ জ্বালাল। সসপেনে জল দিয়ে এককাপ লাল চা করে বুড়িকে দিল । সঙ্গে কিছু মুড়ি। বুড়ি উঠে বসতে পারে নি। রোগাপটকা মহিলাটি বড় দুর্বল হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে ধরে সে বুড়িকে বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। চাগুলো খেয়ে নিয়ে বুড়ি যেন অল্প বল পেল। ওর শরীর ভালো লাগতে শুরু করেছে। বুড়ির মুখ দেখে মালতীর মনে হলো দুটো ভাত পেটে গেলে যেন মানুষটি খানিক স্বস্তি পাবে। তাইতো, সেই কাল সকাল থেকে কালীমা ভর করেছে বলে বুড়ি কিচ্ছুটি মুখে দেয়নি।
“ ভাত ক'টা...।” ওর কথা না ফুরোতেই বুড়ি ওকে ভাত বসাতে বলল। বুড়ির কাঠের তক্তাতে সব জিনিস সাজানো গোছানো থাকে। সে শুধু দেখল, লাকড়ি কম আছে। মণিকে হাঁক দিয়ে ঘর থেকে লাকড়ি কয়েকটা আনতে বলে চুলোতে আগুন দিল।
“ তোর আর পোলার জন্যেও রাঁধবি।” কথাটা বলেই বুড়ি বেড়ার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল। সে শুধু অস্পষ্ট এক বিড়বিড়ে আওয়াজ শুনতে পেল। বুড়ি কী যেন কী উপবাসে থাকার কথা বলছে। বিছানাতেই বুড়িকে ভাত ক'টা খাইয়ে সে বেরিয়ে যেতে চাইল। যাবার আগে আগের দিনের মুড়ি বিক্রির টাকাগুলো বুড়ির সামনে হাতের তালুতে মেলে ধরল। বুড়ি টাকাগুলো নিয়ে আধা নিজে রেখে আধা ওকে দিয়ে দিল। ভাত ক'টিখেয়ে বুড়ি তরতাজা হয়ে পড়েছে। গলাও স্পষ্ট হয়ে গেছে, “মণির মা, মুড়ির ব্যবসাটা তুইই চালা। কোনও ঝামেলা নেই। বাঁধা গ্রাহক আছে। এক বাজারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিবি, আরেক বাজারে জোনের মায়ের সঙ্গে বাজারে বসবি। ধানের টাকা আমি খাটাব।” বুড়ি ওর হাতখানা ধরেছে, “ মণির মা! এতো ধকল আর আমার শরীরে সয়না রে!” সে বুড়ির গায়ে একটা কাঁথা চাপিয়ে দিল।
কোন বুড়ি আসল বুড়ি? কাঁচা লংকার মতো বুড়ি? কালী ভর করা দেবী বুড়ি? না এই শিশুর মতো বুড়ি? যেই হোক, দিনে দিনে বুড়ি ওর আপন হয়ে এসেছে। সে নীরবে বুড়ির চুলে হাত বুলিয়ে দিল, বুড়ি ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।
“মণির মা! মণির মা!” বলে হাঁক পাড়তে পাড়তে জোনের মা ঢুকে এলো। এসেই আগের দিন ভিজিয়ে রাখা ডাল চেয়ে বসল।
“ ভালো রোদ দিয়েছে, বড়া দিবি না?”
“আমি যাচ্ছি, স্নান করে নি।”
“ কই স্নান করবি? কলের পাড়ে?”
“ না, নদীতে যাব। এসে ডাল বাটব।”
ওর সঙ্গে জোনের মাও নদীতে স্নান করতে চলল। শহর আর এই বস্তিকে ভাগ করেছে রিজার্ভটি। তার অল্প ভেতরেই নদীর একটা বাঁকা ভাঁজ আছে। ভাঁজে তিনটা বড় বড় পাথর। এই পাথর তিনটাতেই সাধারণত বস্তির মেয়েরা স্নান করে। ওরা গিয়ে পাবার আগেই ওখানে আরো ক'জন স্নান করছে। প্রায় সবাই কাপড় ধুচ্ছে। মেয়ে-বৌদের গায়ে সুতো সামান্যই আছে। সেও বিনা দ্বিধাতে শাড়ি ব্লাউজ খুলে পেটিকোটটা বুকে টেনে নিয়ে জলে নামল। বনের আড়ালে সেও বাকি মেয়েদের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেল।
স্নান সেরে এসে দেখে মণি ইতিমধ্যে বুড়ির ওখানে ভাত খেয়ে ফেলেছে। একটা ভাত ঘুম দিয়ে বুড়িও টনটনে হয়ে পড়েছে। বুড়ির ঘরের দাওয়াতে মিনতি বসে আছে। ওর ছেলেটি মণির সঙ্গে। সুপুরি পাতার খোল দিয়ে মণি ওকে টেনে নেবার রথ বানিয়েছে, তাতে বসে বাচ্চাটি দুহাতে জোরে সেটি ধরে রেখেছে। সুন্দর ছেলেটি তারও চেয়ে সুন্দর করে খিলখিলিয়ে হাসছে। ওদের দু'জনকে ভেতরে আসতে দেখে মিনতি দাঁড়িয়ে গেল, “মণির মা, আজ বড় ভালো রোদ দিয়েছে। আয়, বড়াগুলো দিয়ে দি।” সে কালীবুড়ির পাটা বাইরে এনে এমন কি ডালগুলোও ধুয়ে আলাদা করে রেখেছে। চুল আঁচড়ে মিনতি আর জোনের মায়ের সঙ্গে কাজগুলো শুরু করতে গিয়েই দেখে বুলেন কাঁধে একটা বাঁশ নিয়ে এসেছে। “বৌদি, বাঁশটা রেখে যাই। মাচাটা রাতে এসে বেঁধে দিয়ে যাব।” ওর নিজের বোঝাটি সাইকেলে বেঁধে নিয়ে বুলেন রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে গেল। যাবার পথে ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেখিয়ে গেল। জগু আর রোগা মহিলা একজনও গেল। মেয়ে মানুষটির হাড় বের করা শরীর। মেয়েটি কালীবুড়ির গেট পার করে আবার ফিরে এলো। বুড়ির পায়ে ধরে প্রণাম করল। মালতীর দিকে তাকিয়ে রোগা মেয়েটি একটা হাসি দিল, “তুই ঠিকই বলছিলি , মিনতি! ” ওর শুকনো মুখখানা দেখতে বড় ভালো লাগল। হঠাৎই ওর মনে হলো এখানকার সমস্ত মানুষেরই হাসিগুলো বড় সুন্দর। কালীবুড়ির ভাঁজ পড়া মুখের হাসিটা, মিনতির চোখে মুখে হাসিটা, জোনের মায়ের কালো মুখের শাদা সমান পাটির দাঁতের হাসিটা, বুলেনের ক্লান্ত মুখে জেনে না জেনে বেরুনো হাসিটা, নবীনের লাজুক লাজুক হাসিটা, জগুর বোকা বোকা হাসিটা, জগুর বৌয়ের শুকনো মুখের পাতলা ঠোঁট দুখানার মধ্যি দিয়ে বেরোনো হাসিটা। সব ক'টা হাসিমুখ ওর বড় ভালো লেগে গেল। ওর মুখেও ফুটে বেরুলো এক ছড়ানো ছিটোনো হা...হা...সি।
টীকাঃ
১) কুঁহিপাতঃ অসমিয়া বর্ণপরিচয়ের বই।
No comments:
Post a Comment