ফেলানি
সেদিন ছিল বাজারবার। বাজারে যাবার পথে লোকে দেখল রিজার্ভের কাছে বেশ কিছু চিকমিক গাড়ি, তার অনেকগুলোর রং লাল। গাড়িগুলো থেকে নেমে আসা ছেলেদের পোশাক আশাকগুলো সাধারণ মানুষের পরা কাপড় থেকে আলাদা। সঙ্গে কাজের লোক, গাছ কাটার যন্ত্রপাতি। বাজারে যেতে বেরিয়েছিল যারা তারা থমকে দাঁড়ালো। চোখের সামনে রিজার্ভের গাছগুলোতে করাত লাগল, কূঠারের ঘা পড়ল। নিঝুম অরণ্যে হৈ চৈ একটা পড়ে গেল। রিজার্ভের পাখিগুলো এমন অদ্ভুত ভাবে চিৎকার করতে শুরু করল, যে বস্তির মানুষও অবাক হয়ে ভাবতে বসল, এদ্দিন এই পাখিরা ছিলটা কই?
জোনের মা, মিনতির মায়েরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এসে ছিটকে পড়ল এক ঘুঘু পাখির জংলি কবুতরের বাসা। বাসাতে ডিম ছিল, আর দু’টো চোখ না ফোটা বাচ্চা। ওদের পায়ের কাছে ডিমগুলো ভেঙ্গে গেল, একটু সময় মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাগুলো গেল মরে। অল্প সময় পরে এরা দেখল এক জোড়া পাখি এসে সেই জায়গাটা ঘিরে ঘুরে ঘুরে চিৎকার জুড়েছে। পাখির গলার স্বরে মাখানো কান্না এই ক’জন মেয়েমানুষের বুক চেপে ধরল। শুধু মিনতিকেই এই ভাঙ্গা বাসা, এই পাখিরা ছুঁতে পারল না। তার মুখে এক অপূর্ব আনন্দ। এই মুখটি ভালো করে চেনে শুধু মণির মা। ঠিক একটি সাদা বড় গাড়ির থেকে সে নেমেছে। যেন কোনও রাজা নেমে এসেছেন, সমস্ত মানুষের নজর পড়েছে গিয়ে তার উপরে। সঙ্গের ছেলেরা তার কাছে চেপে গেল। বিচিত্র রঙের একটা হাফপ্যান্ট পরেছে সে, নারকেল গাছ আর সূর্যের ছবি থাকা বুক খোলা একখানা সার্ট। রোদের জন্যে চোখে চশমা। লম্বা, সাদা, চোখা নাক, বড় বড় চোখের ছেলেটাকে ,মিনতি যেমন বলে, এই মুহূর্তে ঠিকই ফিল্মি হিরোর মতো লাগছিল। সে যেন এখনি একটা ঝর্ণার মধ্যেকার পাথরে বসে এক আধা ভেজা মেয়েকে পাশে নিয়ে গান গেয়ে উঠবে ।
মণির মায়ের সেই পুরোনো রাগটা আবার চড়ছে। সে মিনতিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “চল জলদি চল। এরা গাছ কাটবে, পয়সা করবে, আমাদের কি এসে যায়? চল, বলছি না?” সে হনহন করে হাঁটা দিল। পেছন পেছন বাকিরা। মিনতি ঘুরে ঘুরে পেছনে তাকাচ্ছে।
বিকেলে যখন এরা বাজার থেকে ফিরে এলো, দুই ট্রাক কাঠ লোড করা হয়ে গেছে। রাস্তার কাছের এক টুকরো জায়গা খোলামেলা হয়ে গেছে। এরা রোজ যেমন রিজার্ভের কাছে এলে দাঁড়ায়, আজও দাঁড়ালো। কিন্তু অন্যদিনের মতো হাত পা মেলে বসল না। বেলা পড়ে এসেছে। একদল পাখি ফিরে এসে নিজেদের বাসা খুঁজে না পেয়ে ঘুরে ঘুরে চিৎকার করতে করতে কমলা রঙের আকাশটিকে চিরে ফেলছে যেন। পাখির চিৎকার বুকে বেঁধে এরা ক’জন ঘরমুখো হলো।
দেখতে দেখতে রিজার্ভ খালি হতে শুরু করল। বস্তির বহু লোকও অন্য ধান্দা বাদ দিয়ে ওদের তলায় গাছ কাটার কাজে লেগে গেল। দেখতে না দেখতে রিজার্ভ শেষ হয়ে গেল। কেউ মাছের জন্যে বিশাল বিশাল পুকুর খুঁড়েছে। শুয়োর , মুরগির বড় বড় ফার্ম হয়েছে। এসব বুঝি সরকারি পয়সাতে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী সারেণ্ডারীদের লক্ষ লক্ষ টাকা বিলিয়েছেন। খোলা রিজার্ভে নতুন বহু মানুষও এসে বসত করতে শুরু করেছে। একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁসে কিছু গাছ থেকে গেছে।
সারেণ্ডারীরা বেশির ভাগই বিকেলের দিকে ড্রাইভারণীর বাড়ি মদ খেতে যায়। ড্রাইভারণী আজকাল রত্নাকে বিকেল অব্দি রেখে দেয়। পকোরি, চিংড়ি মাছ, মাংস ভাজতে হয়, গ্লাস ধুতে হয়। রত্না একদিন সামনে দিয়ে এক থালা পকোরি দিতে গিয়ে মিনতির রাজকুমারকে দেখতে পেল। তার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। টিভির সেই ছেলেটি। ফর্সা, লম্বা, চোখগুলো সামান্য বাদামি রঙের আর চোখের চাউনি? অনেক কথা বলে যায় কোনও কথা না বলে এই চোখ। সেও রত্নার কোমল মায়া ধরানো মুখখানার দিকে একটু সময় তাকিয়ে রইল। কলেজ জীবনে মিনতিকে দিয়ে নারী নিয়ে খেলা সে আরম্ভ করেছিল সে। রত্নার মুগ্ধ তাকানো দেখে তার অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারল আরেকটি কোমল হরিণী তার ফাঁদে পড়ল।
“ এই মেয়েটি কে? একে দেখছি টিভিতে নামানো যায়,” রত্নার চোখে ভেসে উঠছে সুন্দর ছেলেটির গায়ে আছড়ে পড়া সেই মেয়েটি।
“আমার বোনই বলতে পারো।” ড্রাইভারণীর স্বর চাপা, এরা মদ খেতে এলে সে একটু সাবধানে থাকে। এই ছেলেদের সবার মতো সেও একটু ভয় করে।
“বেশ সুন্দরী মেয়ে।” সে অভিজ্ঞ। প্রথম তিরটি ছুঁড়ল। রত্না এতেই কাৎ যে একটি ছেলে তাকে সুন্দরী বলছে।
“কিন্তু অমন সুন্দর মেয়ের গায়ে এসব কাপড় মানায় না।” রত্নার বড় করে কাটা চুড়িদারের গলা দেখে সে কথাটা বলল।
রত্নার ইচ্ছে করছিল বলে, কেঁদে কুটেই বলে, ওর কিছুই নেই। এগুলো সবই দিদির আনা পুরোনো কাপড়। একটাও নতুন জামা আজ অব্দি সে পরে নি। মুখে মাখবার পাউডার নেই তার। স্নান করবার সাবান নেই। কিছুই নেই তার। দেবেটা কে? সত্যি সত্যি চোখের জল পড়তে শুরু করল। ছেলেটি ঝাঁপ দিয়ে প্রায় তার কাছে গেল। হাতে ধরে টেনে এনে সস্তা বিছানা চাদরে সাজানো ড্রাইভারণীর বিছানাতে বসালো নিয়ে গিয়ে। টেনে চেপে ধরল নিজের শরীরের কাছে। “কাঁদছ কেন? আমি দেবো, তোমার যা কিছু চাই আমি দেবো। আমার সঙ্গে চলো একদিন।” ওর হাত রত্নার শরীরের যেখানে সেখানে গড়াতে শুরু করল। রত্না চোখ মুদে দিল। হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাদামী চোখের ছেলেটি, সেই সুন্দরী মেয়েটি। কিছু সময় সেভাবেই রেখে রত্নাকে সে ছেড়ে দিল। রত্না বিছানাতেই বসে রইল।
ছেলেরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। ওরা কী সব বলাবলি করতে করতে গেছে। কিছু তার শুনেছে রত্না , কিছু শোনেনি।
“ জিতদাকে কিন্তু মানতে হবে হে!”
“ যেদিকে যায় , সেদিকেই ঘি-মধু।”
“ জিতদার প্রজাপতির পেছনে ছুটতে হয় না, আপনি এসে গায়ে বসে।”
ওরা বেরিয়ে যেতেই , ড্রাইভারণী বাঘিনীর মতো রত্নার উপরে চড়াও হলো।
“তোর একটাও চুল মাথাতে থাকবে না, লজ্জা শরম নেই? ওর শরীরে শরীর লাগিয়েছিলি কেন? ক’দিন ধরে ওকে জানিস তুই? তোকে কি আমি এখানে রেণ্ডীগিরি করতে ডেকে এনেছি? তোর মা তোকে এখানে বিশ্বাস করে পাঠায়, গরীব মানুষ। দু’টো পয়সা পাবি, দু’টো ভাত খাবি, আমারও সহায় হবে বলে তোকে আমি আমার বাড়ি আসতে দিই। তুই কেন এতোগুলো লোকের সামনে ওকে তোর গায়ে হাত দিতে দিলি?” ওর চুল মুঠো করে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল ড্রাইভারণী।
রত্না কিছু বলল না। চুলগুলো ঠিক করে বেরিয়ে গেল। আর সে ড্রাইভারণীর ওখানে আসে না। এতে চুল ধরে টানাটানির কী আছে? মা অনবরত ব্যস্ত, বাবাতো বাবাই। বাবা তার থেকে টাকা পয়সাও পাচ্ছে। রত্নার কাপড় পাল্টালো, হাসি পাল্টালো, জোতা পাল্টালো। সবাই রত্নাকে তার মটর সাইকেলের পেছনে নইলে গাড়ির সামনের সীটে বসে থাকতে দেখতে পেলো।
ট্রাকে ট্রাকে গাছ ফুরিয়ে যাচ্ছে। সজীব অরণ্য দেখতে কবরের মতো হয়ে আসছে। দিনে দিনে আরো একটি মেয়ে মানুষের বুকের সবুজ অরণ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে শুরু করেছে। ইদুঁর মারবার ঔষধ খেয়ে মুখে ফেনা বের করে মিনতিকে পড়ে থাকতে দেখেছে নবীন। মিনতি যেদিন ইদুঁরের ঔষধ খেয়ে মরতে গেল, সেদিনই রত্না ছেলেটির দেয়া পোশাক আশাক পরে তার গাড়ির সামনের আসনে বসে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিল। মিনতি কিন্তু মরল না। জোনের মাকে যেমন বাঁচিয়েছিল এরা, তাকেও বাঁচিয়ে তুলল।
একমাস পরে রত্না ফিরে এলো। ইতিমধ্যে রিজার্ভ পুরো শেষ। যাবার বেলা গেছিল গাড়িতে, আসার বেলা বাসে। রত্নাও এখন এক উজাড় অরণ্য।
জোনের মা, মিনতির মায়েরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এসে ছিটকে পড়ল এক ঘুঘু পাখির জংলি কবুতরের বাসা। বাসাতে ডিম ছিল, আর দু’টো চোখ না ফোটা বাচ্চা। ওদের পায়ের কাছে ডিমগুলো ভেঙ্গে গেল, একটু সময় মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাগুলো গেল মরে। অল্প সময় পরে এরা দেখল এক জোড়া পাখি এসে সেই জায়গাটা ঘিরে ঘুরে ঘুরে চিৎকার জুড়েছে। পাখির গলার স্বরে মাখানো কান্না এই ক’জন মেয়েমানুষের বুক চেপে ধরল। শুধু মিনতিকেই এই ভাঙ্গা বাসা, এই পাখিরা ছুঁতে পারল না। তার মুখে এক অপূর্ব আনন্দ। এই মুখটি ভালো করে চেনে শুধু মণির মা। ঠিক একটি সাদা বড় গাড়ির থেকে সে নেমেছে। যেন কোনও রাজা নেমে এসেছেন, সমস্ত মানুষের নজর পড়েছে গিয়ে তার উপরে। সঙ্গের ছেলেরা তার কাছে চেপে গেল। বিচিত্র রঙের একটা হাফপ্যান্ট পরেছে সে, নারকেল গাছ আর সূর্যের ছবি থাকা বুক খোলা একখানা সার্ট। রোদের জন্যে চোখে চশমা। লম্বা, সাদা, চোখা নাক, বড় বড় চোখের ছেলেটাকে ,মিনতি যেমন বলে, এই মুহূর্তে ঠিকই ফিল্মি হিরোর মতো লাগছিল। সে যেন এখনি একটা ঝর্ণার মধ্যেকার পাথরে বসে এক আধা ভেজা মেয়েকে পাশে নিয়ে গান গেয়ে উঠবে ।
মণির মায়ের সেই পুরোনো রাগটা আবার চড়ছে। সে মিনতিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “চল জলদি চল। এরা গাছ কাটবে, পয়সা করবে, আমাদের কি এসে যায়? চল, বলছি না?” সে হনহন করে হাঁটা দিল। পেছন পেছন বাকিরা। মিনতি ঘুরে ঘুরে পেছনে তাকাচ্ছে।
বিকেলে যখন এরা বাজার থেকে ফিরে এলো, দুই ট্রাক কাঠ লোড করা হয়ে গেছে। রাস্তার কাছের এক টুকরো জায়গা খোলামেলা হয়ে গেছে। এরা রোজ যেমন রিজার্ভের কাছে এলে দাঁড়ায়, আজও দাঁড়ালো। কিন্তু অন্যদিনের মতো হাত পা মেলে বসল না। বেলা পড়ে এসেছে। একদল পাখি ফিরে এসে নিজেদের বাসা খুঁজে না পেয়ে ঘুরে ঘুরে চিৎকার করতে করতে কমলা রঙের আকাশটিকে চিরে ফেলছে যেন। পাখির চিৎকার বুকে বেঁধে এরা ক’জন ঘরমুখো হলো।
দেখতে দেখতে রিজার্ভ খালি হতে শুরু করল। বস্তির বহু লোকও অন্য ধান্দা বাদ দিয়ে ওদের তলায় গাছ কাটার কাজে লেগে গেল। দেখতে না দেখতে রিজার্ভ শেষ হয়ে গেল। কেউ মাছের জন্যে বিশাল বিশাল পুকুর খুঁড়েছে। শুয়োর , মুরগির বড় বড় ফার্ম হয়েছে। এসব বুঝি সরকারি পয়সাতে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী সারেণ্ডারীদের লক্ষ লক্ষ টাকা বিলিয়েছেন। খোলা রিজার্ভে নতুন বহু মানুষও এসে বসত করতে শুরু করেছে। একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁসে কিছু গাছ থেকে গেছে।
সারেণ্ডারীরা বেশির ভাগই বিকেলের দিকে ড্রাইভারণীর বাড়ি মদ খেতে যায়। ড্রাইভারণী আজকাল রত্নাকে বিকেল অব্দি রেখে দেয়। পকোরি, চিংড়ি মাছ, মাংস ভাজতে হয়, গ্লাস ধুতে হয়। রত্না একদিন সামনে দিয়ে এক থালা পকোরি দিতে গিয়ে মিনতির রাজকুমারকে দেখতে পেল। তার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। টিভির সেই ছেলেটি। ফর্সা, লম্বা, চোখগুলো সামান্য বাদামি রঙের আর চোখের চাউনি? অনেক কথা বলে যায় কোনও কথা না বলে এই চোখ। সেও রত্নার কোমল মায়া ধরানো মুখখানার দিকে একটু সময় তাকিয়ে রইল। কলেজ জীবনে মিনতিকে দিয়ে নারী নিয়ে খেলা সে আরম্ভ করেছিল সে। রত্নার মুগ্ধ তাকানো দেখে তার অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারল আরেকটি কোমল হরিণী তার ফাঁদে পড়ল।
“ এই মেয়েটি কে? একে দেখছি টিভিতে নামানো যায়,” রত্নার চোখে ভেসে উঠছে সুন্দর ছেলেটির গায়ে আছড়ে পড়া সেই মেয়েটি।
“আমার বোনই বলতে পারো।” ড্রাইভারণীর স্বর চাপা, এরা মদ খেতে এলে সে একটু সাবধানে থাকে। এই ছেলেদের সবার মতো সেও একটু ভয় করে।
“বেশ সুন্দরী মেয়ে।” সে অভিজ্ঞ। প্রথম তিরটি ছুঁড়ল। রত্না এতেই কাৎ যে একটি ছেলে তাকে সুন্দরী বলছে।
“কিন্তু অমন সুন্দর মেয়ের গায়ে এসব কাপড় মানায় না।” রত্নার বড় করে কাটা চুড়িদারের গলা দেখে সে কথাটা বলল।
রত্নার ইচ্ছে করছিল বলে, কেঁদে কুটেই বলে, ওর কিছুই নেই। এগুলো সবই দিদির আনা পুরোনো কাপড়। একটাও নতুন জামা আজ অব্দি সে পরে নি। মুখে মাখবার পাউডার নেই তার। স্নান করবার সাবান নেই। কিছুই নেই তার। দেবেটা কে? সত্যি সত্যি চোখের জল পড়তে শুরু করল। ছেলেটি ঝাঁপ দিয়ে প্রায় তার কাছে গেল। হাতে ধরে টেনে এনে সস্তা বিছানা চাদরে সাজানো ড্রাইভারণীর বিছানাতে বসালো নিয়ে গিয়ে। টেনে চেপে ধরল নিজের শরীরের কাছে। “কাঁদছ কেন? আমি দেবো, তোমার যা কিছু চাই আমি দেবো। আমার সঙ্গে চলো একদিন।” ওর হাত রত্নার শরীরের যেখানে সেখানে গড়াতে শুরু করল। রত্না চোখ মুদে দিল। হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাদামী চোখের ছেলেটি, সেই সুন্দরী মেয়েটি। কিছু সময় সেভাবেই রেখে রত্নাকে সে ছেড়ে দিল। রত্না বিছানাতেই বসে রইল।
ছেলেরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। ওরা কী সব বলাবলি করতে করতে গেছে। কিছু তার শুনেছে রত্না , কিছু শোনেনি।
“ জিতদাকে কিন্তু মানতে হবে হে!”
“ যেদিকে যায় , সেদিকেই ঘি-মধু।”
“ জিতদার প্রজাপতির পেছনে ছুটতে হয় না, আপনি এসে গায়ে বসে।”
ওরা বেরিয়ে যেতেই , ড্রাইভারণী বাঘিনীর মতো রত্নার উপরে চড়াও হলো।
“তোর একটাও চুল মাথাতে থাকবে না, লজ্জা শরম নেই? ওর শরীরে শরীর লাগিয়েছিলি কেন? ক’দিন ধরে ওকে জানিস তুই? তোকে কি আমি এখানে রেণ্ডীগিরি করতে ডেকে এনেছি? তোর মা তোকে এখানে বিশ্বাস করে পাঠায়, গরীব মানুষ। দু’টো পয়সা পাবি, দু’টো ভাত খাবি, আমারও সহায় হবে বলে তোকে আমি আমার বাড়ি আসতে দিই। তুই কেন এতোগুলো লোকের সামনে ওকে তোর গায়ে হাত দিতে দিলি?” ওর চুল মুঠো করে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল ড্রাইভারণী।
রত্না কিছু বলল না। চুলগুলো ঠিক করে বেরিয়ে গেল। আর সে ড্রাইভারণীর ওখানে আসে না। এতে চুল ধরে টানাটানির কী আছে? মা অনবরত ব্যস্ত, বাবাতো বাবাই। বাবা তার থেকে টাকা পয়সাও পাচ্ছে। রত্নার কাপড় পাল্টালো, হাসি পাল্টালো, জোতা পাল্টালো। সবাই রত্নাকে তার মটর সাইকেলের পেছনে নইলে গাড়ির সামনের সীটে বসে থাকতে দেখতে পেলো।
ট্রাকে ট্রাকে গাছ ফুরিয়ে যাচ্ছে। সজীব অরণ্য দেখতে কবরের মতো হয়ে আসছে। দিনে দিনে আরো একটি মেয়ে মানুষের বুকের সবুজ অরণ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে শুরু করেছে। ইদুঁর মারবার ঔষধ খেয়ে মুখে ফেনা বের করে মিনতিকে পড়ে থাকতে দেখেছে নবীন। মিনতি যেদিন ইদুঁরের ঔষধ খেয়ে মরতে গেল, সেদিনই রত্না ছেলেটির দেয়া পোশাক আশাক পরে তার গাড়ির সামনের আসনে বসে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিল। মিনতি কিন্তু মরল না। জোনের মাকে যেমন বাঁচিয়েছিল এরা, তাকেও বাঁচিয়ে তুলল।
একমাস পরে রত্না ফিরে এলো। ইতিমধ্যে রিজার্ভ পুরো শেষ। যাবার বেলা গেছিল গাড়িতে, আসার বেলা বাসে। রত্নাও এখন এক উজাড় অরণ্য।
মা যেদিন কথাটা টের পেল সেদিন প্রথমে ওকে আচ্ছা করে পেটালো। গাছের কাটা গুড়িতে ভরা জঙ্গলের মতোই সে নিথর। মার খেতে খেতে ওর হাত পা ফেটে গেল। টু শব্দটি করে নি। দাওয়াতে বসে বাবা চেঁচিয়েই চলেছে, “ ছেলে সন্তানহীন বাপ আমি, আমার কী আছে? থাকলে আজ কি আর বোনটিকে অমন ঠকাতে পারত ছেলেটা? সে গিয়ে তাকে ছ্যাঁচড়িয়ে ছ্যাঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে আসত। আমার মেয়েকে ওভাবে যেতেই দিত না। আমার ছেলে...ছেলে রে...।” একটা কাল্পনিক ছেলে বুড়োকে কী দিতে পারত, কী করতে পারত এই সব বকতে বকতে মানুষটা দাওয়াতে বসেই রইল, কিছু একটা হলেই সব সময় সে যা করে থাকে।
বাজার থেকে এসে মণির মা ঘরের কাজকর্ম শেষ করতে পারে নি, রত্নার হাতে ধরে রত্নার মা ওর এখানে চলে এলো। আজ মণি নেই, সিঙের গাড়ি নিয়ে গুয়াহাটি গেছে । কাল আসবে। এমনিতেই ওর মন ভালো ছিল না। রত্নাদের দেখে ভালো লেগে গেলো, কথা বলবার লোক পাওয়া গেল তবে।
রত্নাকে কাছের থেকে দেখল সে। কত কি কথা শুনেছে এই মেয়েটিকে নিয়ে। বোলতায় বিঁধে নষ্ট করে ফেলা ঝিঙের মতো মেয়েটির দিকে অল্প সময় সে তাকিয়ে রইল।
“মণির মা , তুই আমার সঙ্গে এক জায়গাতে যাবি?”
“কই?”
“একে পুঁতে রেখে আসব।”
“কী বলছিস রত্নার মা?”
“ যাবি কি যাবি না , বল।” তোকে বিশ্বাস করতে পারি বলেই এসেছি। মেয়ে মানুষের সবচাইতে বড় যে বিপদ সেই বিপদে পড়েছে মেয়ে।
“কত মাস?”
“ চার মাস।”
“ কী করবি এখন?”
“ আমি কী করতে হবে করব, যোগাড় যন্ত্রও করে এনেছি। একটা মানুষ চাই সঙ্গে। সে জন্যেই তোর এখানে এসেছি।”
হঠাৎ সে মালতীর হাতে ধরে কেঁদে ফেলল, “মণির মা, একা আমার সাহস হচ্ছে না। আমার সঙ্গে তোকে যেতে হবে।”
“কই যেতে হবে?”
“কেঁচাইখাতি থানে।”
সে বস্তির মানুষের মুখে এই থানের কথা শুনেছে। সেখানে বুঝি এক সময় মেয়ে মানুষও বলি দেয়া হতো। সাধারণত কোনও মানুষ সেদিকে যায় না। দরকারও পড়ে না তেমন। তারউপর একটা ভয়। সেখানে গেলে বুঝি শরীরে দোষ লেগে যায়। এসেই জ্বর হবে, নইলে রক্ত আমাশা হবে। কেউ কেউ বুঝি মরেওছে। জঙ্গলের মাঝে পড়ে আছে একটা মন্দির। সেই ভাঙ্গা মন্দিরে জট পাকিয়ে বসে থাকে কাল কেউটের এক বিশাল পরিবার।
মালতী থুথু গিলছে,” কেঁচাইখাতি থান!”
“কিছু হবে না , চল না। আমরা মন্দিরের দিকে যাবো না তো। আমি গিয়ে দেখে এসেছি। একটা বটগাছ আছে। তার নিচে কাজটা করে চলে আসব। ...আর কোনও জায়গাও নেই । তুইই বল যাই কই? মেয়েটির জীবন নিয়ে কথা।” সে রত্নার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। কেমন বাঁকা হয়ে পড়েছে কেঁদে কেঁদে। তার থেকেও অসহ্য লাগছে রত্নার মুখখানা। ভেতর থেকে সমস্ত রস টেনে নিয়ে বোলতাতে ভেতরে ভেতরে গলিয়ে ঝিঙার শুধু বাইরের বাকলটা ফেলে রেখেছে। কেমন করে আছে মেয়েটা। তার থেকে যদি সেই মাটিতে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকত।
“ চল তবে।” সে দরজাতে তালা দিল। কালী বুড়ির মন্দিরের সামনে দণ্ডবৎ করল রত্নার মা, তামার থালাতে দু’টো পয়সা দিল।
“ মন্দিরটা একেবারে ধ্বসে যাচ্ছে, দেখেছিস চালটা কেমন হয়েছে। কোনোমতে মায়ের মূর্তিটা বেঁচে আছে। বড় করে বৃষ্টি দিলেই মূর্তিটা পড়ে যাবে। দেখিস নি , মায়ের গায়ের কালো রঙ কীভাবে ঝরে যাচ্ছে?”
“তুই কী করবি? ছেলেকে বুকে বেঁধে কোনোভাবে সংসার চালাচ্ছিস। মন্দির একটা ঠিকঠাক করা কি আর মুখের কথা?”
“আমি আর কই পারব? আমার কীইবা শক্তি আছে? কালী বুড়ি একবেলা খেয়ে আর বেলা উপোস থেকে মায়ের সেবা চালিয়ে গিয়েছিল। কালী বুড়ির মধ্যে সত্যিই মায়ের শক্তি ছিল। বুড়ি আমাকে মায়ের দায়িত্ব দিয়ে গেল, কিন্তু শক্তিটুকু দিয়ে গেল না।”
রত্না ওর মা আর মালতীর পেছনে পেছনে আসছে। একবার সে বমিও করল। দেখলেই বোঝা যায় সে দেহটাকে টেনে টেনে এগুচ্ছে। একে দেখলে কালী বুড়ি কী বলত? বুড়ির টনটনে উচুঁস্বরের গলা মালতীর কানে বেজে উঠল, “ কাঁদ, আরো কাঁদ। মেয়ে মানুষের এই কান্না মরদকে দেখাবার জন্যে। তবে না ভাতার আসবে, শরীর দলাই মলাই করে বলবে, ‘আহা বেচারি।’ ব্যস, মেয়ে মানুষ আহ্লাদে আটখানা। দলাই মলাইর পরেই না আসল সুখ।” বুড়ির পাতলা কম্পমান দেহ মালতীর চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল। বুড়ি ক্ষেপে গেছে, “পেট লাগে যদি আরো কান্না জোড়...বস্তির সমস্ত ভাতার ছুটে আসবে।” তাকে বুড়ি একটা ছবি দেখাচ্ছে, “মায়ের শক্তি দেখ, পুরুষকে কীভাবে পদাঘাত করছে...” একটা সূর্যমুখী লংকা তার চোখের সামনে তুলে ধরেছে। অনেকক্ষণ বুড়ির মুখখানা চোখের সামনে ভেসে রইল।
ওরা এসে থানে ঢুকল। থান শব্দটা ভুল হবে, কারো পা না পড়া এক টুকরো পরিত্যক্ত ভয়ঙ্কর জায়গা। বেলা পড়ে আসতে এখনো কিছু বাকি। তবুও এই জায়গাটা হালকা অন্ধকারে ইতিমধ্যে ঢেকে ফেলেছে। যেখানে সেখানে গজানো গাছগুলোতে জংলি লতা উঠেছে, এমনভাবে গাছগুলোকে জড়িয়েছে এই লতাগুলো যে অন্ধকারে প্রত্যেকটা গাছকে এক একটা বিচিত্র বসে থাকা জন্তু বলে মনে হচ্ছে। ওর সমস্ত শরীর শিরশিরিয়ে উঠল।
রত্নার মা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সে কাছে চেপে আসতে গিয়ে কিছু একটা দেখে চমকে গেল। এক টুকরো অদ্ভুত পাথর। পাথরের মাঝখানে প্রতিপদের নতুন চাঁদের মতো কাটা। সেখানে দিব্বি একটা মানুষের গলা বসানো যেতে পারে। পাথরটা সে ছুঁয়ে দেখল। এই জায়গাতে রাজা চুপিচুপি মেয়ে মানুষ বলি দিয়েছিল। এই পাথরেই কি বসিয়ে দিত মেয়েদের গলা? হাতটা সে আবার সরিয়ে আনল। প্রচুর বিষাক্ত পিঁপড়ে পিলপিল করছে সেখানে। ওর হাতেও কামড় বসিয়ে দিয়েছে, সেই উহু আহ করে উঠল। কয়েকটা পিঁপড়ে রত্নার মুখে কপালেও উঠে গেছে। নিশ্চয় কামড়েছে। গলাতেও বেশ ক’টি লেগে ধরেছে। রত্না কাঁই কুঁই করে নি।
কী করে এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়? অর গলার থেকে পিঁপড়ে ক’টা সরিয়ে সামান্য হেঁচকা টান দিয়ে মা ওকে নিয়ে গিয়ে পাথরের খাঁজে মাথা বসিয়ে দিল। নতুন চাঁদের মতো খাঁজে গলা বসিয়ে সে যেন খানিক আরাম পেলো, মাথাতে একটি বালা পরানোর মতো দেখালো।
রত্নার পা দুটি ফাঁক করে মা একটা শেকড় ঢুকিয়ে দিল। রত্না মুখে সামান্য গোঙালো। হঠাৎ রত্নার মা বুকে হাত দিয়ে মুখ বাঁকা করে ফেলল। একদিনে রক্তের ডোঙাতে পড়ে থাকা মেয়েটি, আর দিকে বুকে হাত দিয়ে নীল হয়ে আসা মা। মালতী চোখে সর্ষে ফুল দেখতে পেল। সে এখন কী করে? কাকে সামলায়?
“মণির মা , তুই হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা বের করে আন।”
সে দাঁড়িয়ে আছে। কী করে এখন? মেয়েটি বুকে মোচড় দিচ্ছে। মা ঘামছে, কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে।
“মণির মা , বের করে আন। নইলে ফুলটা উজিয়ে গিয়ে কলজেতে কামড় বসাবে। তখন আর সে বাঁচবে না। আন , মণির মা। ওটা বেরিয়ে এসেছে, বের করে আন।”
এবারে রত্নার মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘাসের উপর গড়িয়ে পড়েছে। নাড়াচাড়া করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
মালতী রত্নার শরীরে হাত ভরিয়ে দিল। বেরিয়ে এলো এক টুকরো মাংস, লপথপ করছে। ঘাসে গড়াতে গড়াতে বুকে হাত দিয়ে রত্নার মা দেখছে, “ফেলে দে ওটা।”
সে দুই হাতে তুলে নিলো মাংসপিণ্ডটা। কাছ থেকে দেখলে এক বিঘৎ পরিমাণ ছেলের ভ্রূণ এটা। বাঁশের শলাকার মতো হাত পা, ছোট্ট এইটুকুন মুখ। শরীরে চামড়া নেই। চোখ মুদে আছে। সে দৌড়ে গিয়ে সেটি ফেলে দিল সামান্য দূরে। শেয়াল না কিসে যেন খাপ পেতে ছিল , নিয়ে চলে গেল। রত্নার শরীর যেন আগুনের মতো গরম। ওর মা উঠে বসেছে।
“যা, তুই ঘরে যা গে’। আমি মনে হয় না আর উঠতে পারব।” সত্যি এক হাতে বুকটা চেপে মানুষটি আবার পড়ে গেল। রত্না দূরে গিয়ে কাছের একটা ডোবার থেকে সামান্য জল নিয়ে এসে মায়ের চোখে মুখে মারল। মা চোখ মেলে তাকালো।
“মা।” মায়ের মুখখানা সে জল দিয়ে ধুইয়ে দিল।
“বেগে জামা আছে।” মেয়ের রক্ত মাখানো স্কার্টটার দিকে দেখিয়ে বলল। রত্না জামা পাল্টালো। বয়ে যাওয়া রক্তেরও ব্যবস্থা হলো। কাজগুলো করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে সে কোঁকাচ্ছিল। পরে মাকে ধরে তুলল। মা একদিকে মেয়ে আর দিকে মালতীর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো।
তিনজনেই কেঁচাইখাতি থান থেকে বেরিয়ে এলো।
রত্নার মা ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। বস্তির রাস্তাতে উঠতে গিয়েই মাটিতে পড়ে গেল, মুখটা কেশরাজের মতো কালো করে সে মাটিতে পড়েই চোখ বুজে ফেলল। তৎক্ষণাৎ সর্বত্র হুলস্থূল পড়ে গেল। রত্নার নতুন জামাতে আবার দাগ দেখা যাচ্ছে। মণির মা তাকে বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকতে বলল।
রত্নার মাকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া, গুয়াহাটির থেকে বড় মেয়ের টাকা পয়সা নিয়ে আসা, যেভাবে পারে শ্রাদ্ধ শান্তি করা—এসবের মাঝেই রত্না উঠে বসল। ওর জামাতে যখন তখন দেখা দেয়া দাগগুলোও কারো নজরে পড়ল না। সে সব সময় যেমন কামরাঙা গাছের তলার পাথরটিতে বসে থাকত বেশিরভাগ সময় তেমনি বসে রইল।
রত্নাকে সবাই নতুন রূপে দেখল এক বাজার বার দিনে। সে দুই হাতে দুই জোড়া মোড়া নিয়ে সবার সঙ্গে বাজারে হাঁটা দিল। সবাই ওর সঙ্গে এটা ওটা কথাও বলল টুকটাক।
“রত্না, মা মারা যাবার পরে তুই বড় রোগা হয়ে গিয়েছিস।”
“মোড়া কি তুই নিজেই বানালি?”
“তোর বাবা ভালো তো?”
“দিদি কি গুয়াহাটিতেই আছে?”
রত্না যেদিন মোড়াগুলো নিয়ে বাজারে যাবার জন্যে বেরুলো, ওর বাবা সেই কপাল চাপড়ে বকেই যাচ্ছিল, “আমার ছেলে একটা আজ থাকত যদি, বোনকে এভাবে বাজারে যেতে দিত? কক্ষনো না। আমার পোড়া কপাল। ”
বাজার থেকে এসে মণির মা ঘরের কাজকর্ম শেষ করতে পারে নি, রত্নার হাতে ধরে রত্নার মা ওর এখানে চলে এলো। আজ মণি নেই, সিঙের গাড়ি নিয়ে গুয়াহাটি গেছে । কাল আসবে। এমনিতেই ওর মন ভালো ছিল না। রত্নাদের দেখে ভালো লেগে গেলো, কথা বলবার লোক পাওয়া গেল তবে।
রত্নাকে কাছের থেকে দেখল সে। কত কি কথা শুনেছে এই মেয়েটিকে নিয়ে। বোলতায় বিঁধে নষ্ট করে ফেলা ঝিঙের মতো মেয়েটির দিকে অল্প সময় সে তাকিয়ে রইল।
“মণির মা , তুই আমার সঙ্গে এক জায়গাতে যাবি?”
“কই?”
“একে পুঁতে রেখে আসব।”
“কী বলছিস রত্নার মা?”
“ যাবি কি যাবি না , বল।” তোকে বিশ্বাস করতে পারি বলেই এসেছি। মেয়ে মানুষের সবচাইতে বড় যে বিপদ সেই বিপদে পড়েছে মেয়ে।
“কত মাস?”
“ চার মাস।”
“ কী করবি এখন?”
“ আমি কী করতে হবে করব, যোগাড় যন্ত্রও করে এনেছি। একটা মানুষ চাই সঙ্গে। সে জন্যেই তোর এখানে এসেছি।”
হঠাৎ সে মালতীর হাতে ধরে কেঁদে ফেলল, “মণির মা, একা আমার সাহস হচ্ছে না। আমার সঙ্গে তোকে যেতে হবে।”
“কই যেতে হবে?”
“কেঁচাইখাতি থানে।”
সে বস্তির মানুষের মুখে এই থানের কথা শুনেছে। সেখানে বুঝি এক সময় মেয়ে মানুষও বলি দেয়া হতো। সাধারণত কোনও মানুষ সেদিকে যায় না। দরকারও পড়ে না তেমন। তারউপর একটা ভয়। সেখানে গেলে বুঝি শরীরে দোষ লেগে যায়। এসেই জ্বর হবে, নইলে রক্ত আমাশা হবে। কেউ কেউ বুঝি মরেওছে। জঙ্গলের মাঝে পড়ে আছে একটা মন্দির। সেই ভাঙ্গা মন্দিরে জট পাকিয়ে বসে থাকে কাল কেউটের এক বিশাল পরিবার।
মালতী থুথু গিলছে,” কেঁচাইখাতি থান!”
“কিছু হবে না , চল না। আমরা মন্দিরের দিকে যাবো না তো। আমি গিয়ে দেখে এসেছি। একটা বটগাছ আছে। তার নিচে কাজটা করে চলে আসব। ...আর কোনও জায়গাও নেই । তুইই বল যাই কই? মেয়েটির জীবন নিয়ে কথা।” সে রত্নার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। কেমন বাঁকা হয়ে পড়েছে কেঁদে কেঁদে। তার থেকেও অসহ্য লাগছে রত্নার মুখখানা। ভেতর থেকে সমস্ত রস টেনে নিয়ে বোলতাতে ভেতরে ভেতরে গলিয়ে ঝিঙার শুধু বাইরের বাকলটা ফেলে রেখেছে। কেমন করে আছে মেয়েটা। তার থেকে যদি সেই মাটিতে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকত।
“ চল তবে।” সে দরজাতে তালা দিল। কালী বুড়ির মন্দিরের সামনে দণ্ডবৎ করল রত্নার মা, তামার থালাতে দু’টো পয়সা দিল।
“ মন্দিরটা একেবারে ধ্বসে যাচ্ছে, দেখেছিস চালটা কেমন হয়েছে। কোনোমতে মায়ের মূর্তিটা বেঁচে আছে। বড় করে বৃষ্টি দিলেই মূর্তিটা পড়ে যাবে। দেখিস নি , মায়ের গায়ের কালো রঙ কীভাবে ঝরে যাচ্ছে?”
“তুই কী করবি? ছেলেকে বুকে বেঁধে কোনোভাবে সংসার চালাচ্ছিস। মন্দির একটা ঠিকঠাক করা কি আর মুখের কথা?”
“আমি আর কই পারব? আমার কীইবা শক্তি আছে? কালী বুড়ি একবেলা খেয়ে আর বেলা উপোস থেকে মায়ের সেবা চালিয়ে গিয়েছিল। কালী বুড়ির মধ্যে সত্যিই মায়ের শক্তি ছিল। বুড়ি আমাকে মায়ের দায়িত্ব দিয়ে গেল, কিন্তু শক্তিটুকু দিয়ে গেল না।”
রত্না ওর মা আর মালতীর পেছনে পেছনে আসছে। একবার সে বমিও করল। দেখলেই বোঝা যায় সে দেহটাকে টেনে টেনে এগুচ্ছে। একে দেখলে কালী বুড়ি কী বলত? বুড়ির টনটনে উচুঁস্বরের গলা মালতীর কানে বেজে উঠল, “ কাঁদ, আরো কাঁদ। মেয়ে মানুষের এই কান্না মরদকে দেখাবার জন্যে। তবে না ভাতার আসবে, শরীর দলাই মলাই করে বলবে, ‘আহা বেচারি।’ ব্যস, মেয়ে মানুষ আহ্লাদে আটখানা। দলাই মলাইর পরেই না আসল সুখ।” বুড়ির পাতলা কম্পমান দেহ মালতীর চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল। বুড়ি ক্ষেপে গেছে, “পেট লাগে যদি আরো কান্না জোড়...বস্তির সমস্ত ভাতার ছুটে আসবে।” তাকে বুড়ি একটা ছবি দেখাচ্ছে, “মায়ের শক্তি দেখ, পুরুষকে কীভাবে পদাঘাত করছে...” একটা সূর্যমুখী লংকা তার চোখের সামনে তুলে ধরেছে। অনেকক্ষণ বুড়ির মুখখানা চোখের সামনে ভেসে রইল।
ওরা এসে থানে ঢুকল। থান শব্দটা ভুল হবে, কারো পা না পড়া এক টুকরো পরিত্যক্ত ভয়ঙ্কর জায়গা। বেলা পড়ে আসতে এখনো কিছু বাকি। তবুও এই জায়গাটা হালকা অন্ধকারে ইতিমধ্যে ঢেকে ফেলেছে। যেখানে সেখানে গজানো গাছগুলোতে জংলি লতা উঠেছে, এমনভাবে গাছগুলোকে জড়িয়েছে এই লতাগুলো যে অন্ধকারে প্রত্যেকটা গাছকে এক একটা বিচিত্র বসে থাকা জন্তু বলে মনে হচ্ছে। ওর সমস্ত শরীর শিরশিরিয়ে উঠল।
রত্নার মা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সে কাছে চেপে আসতে গিয়ে কিছু একটা দেখে চমকে গেল। এক টুকরো অদ্ভুত পাথর। পাথরের মাঝখানে প্রতিপদের নতুন চাঁদের মতো কাটা। সেখানে দিব্বি একটা মানুষের গলা বসানো যেতে পারে। পাথরটা সে ছুঁয়ে দেখল। এই জায়গাতে রাজা চুপিচুপি মেয়ে মানুষ বলি দিয়েছিল। এই পাথরেই কি বসিয়ে দিত মেয়েদের গলা? হাতটা সে আবার সরিয়ে আনল। প্রচুর বিষাক্ত পিঁপড়ে পিলপিল করছে সেখানে। ওর হাতেও কামড় বসিয়ে দিয়েছে, সেই উহু আহ করে উঠল। কয়েকটা পিঁপড়ে রত্নার মুখে কপালেও উঠে গেছে। নিশ্চয় কামড়েছে। গলাতেও বেশ ক’টি লেগে ধরেছে। রত্না কাঁই কুঁই করে নি।
কী করে এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়? অর গলার থেকে পিঁপড়ে ক’টা সরিয়ে সামান্য হেঁচকা টান দিয়ে মা ওকে নিয়ে গিয়ে পাথরের খাঁজে মাথা বসিয়ে দিল। নতুন চাঁদের মতো খাঁজে গলা বসিয়ে সে যেন খানিক আরাম পেলো, মাথাতে একটি বালা পরানোর মতো দেখালো।
রত্নার পা দুটি ফাঁক করে মা একটা শেকড় ঢুকিয়ে দিল। রত্না মুখে সামান্য গোঙালো। হঠাৎ রত্নার মা বুকে হাত দিয়ে মুখ বাঁকা করে ফেলল। একদিনে রক্তের ডোঙাতে পড়ে থাকা মেয়েটি, আর দিকে বুকে হাত দিয়ে নীল হয়ে আসা মা। মালতী চোখে সর্ষে ফুল দেখতে পেল। সে এখন কী করে? কাকে সামলায়?
“মণির মা , তুই হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা বের করে আন।”
সে দাঁড়িয়ে আছে। কী করে এখন? মেয়েটি বুকে মোচড় দিচ্ছে। মা ঘামছে, কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে।
“মণির মা , বের করে আন। নইলে ফুলটা উজিয়ে গিয়ে কলজেতে কামড় বসাবে। তখন আর সে বাঁচবে না। আন , মণির মা। ওটা বেরিয়ে এসেছে, বের করে আন।”
এবারে রত্নার মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘাসের উপর গড়িয়ে পড়েছে। নাড়াচাড়া করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
মালতী রত্নার শরীরে হাত ভরিয়ে দিল। বেরিয়ে এলো এক টুকরো মাংস, লপথপ করছে। ঘাসে গড়াতে গড়াতে বুকে হাত দিয়ে রত্নার মা দেখছে, “ফেলে দে ওটা।”
সে দুই হাতে তুলে নিলো মাংসপিণ্ডটা। কাছ থেকে দেখলে এক বিঘৎ পরিমাণ ছেলের ভ্রূণ এটা। বাঁশের শলাকার মতো হাত পা, ছোট্ট এইটুকুন মুখ। শরীরে চামড়া নেই। চোখ মুদে আছে। সে দৌড়ে গিয়ে সেটি ফেলে দিল সামান্য দূরে। শেয়াল না কিসে যেন খাপ পেতে ছিল , নিয়ে চলে গেল। রত্নার শরীর যেন আগুনের মতো গরম। ওর মা উঠে বসেছে।
“যা, তুই ঘরে যা গে’। আমি মনে হয় না আর উঠতে পারব।” সত্যি এক হাতে বুকটা চেপে মানুষটি আবার পড়ে গেল। রত্না দূরে গিয়ে কাছের একটা ডোবার থেকে সামান্য জল নিয়ে এসে মায়ের চোখে মুখে মারল। মা চোখ মেলে তাকালো।
“মা।” মায়ের মুখখানা সে জল দিয়ে ধুইয়ে দিল।
“বেগে জামা আছে।” মেয়ের রক্ত মাখানো স্কার্টটার দিকে দেখিয়ে বলল। রত্না জামা পাল্টালো। বয়ে যাওয়া রক্তেরও ব্যবস্থা হলো। কাজগুলো করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে সে কোঁকাচ্ছিল। পরে মাকে ধরে তুলল। মা একদিকে মেয়ে আর দিকে মালতীর হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো।
তিনজনেই কেঁচাইখাতি থান থেকে বেরিয়ে এলো।
রত্নার মা ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। বস্তির রাস্তাতে উঠতে গিয়েই মাটিতে পড়ে গেল, মুখটা কেশরাজের মতো কালো করে সে মাটিতে পড়েই চোখ বুজে ফেলল। তৎক্ষণাৎ সর্বত্র হুলস্থূল পড়ে গেল। রত্নার নতুন জামাতে আবার দাগ দেখা যাচ্ছে। মণির মা তাকে বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকতে বলল।
রত্নার মাকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া, গুয়াহাটির থেকে বড় মেয়ের টাকা পয়সা নিয়ে আসা, যেভাবে পারে শ্রাদ্ধ শান্তি করা—এসবের মাঝেই রত্না উঠে বসল। ওর জামাতে যখন তখন দেখা দেয়া দাগগুলোও কারো নজরে পড়ল না। সে সব সময় যেমন কামরাঙা গাছের তলার পাথরটিতে বসে থাকত বেশিরভাগ সময় তেমনি বসে রইল।
রত্নাকে সবাই নতুন রূপে দেখল এক বাজার বার দিনে। সে দুই হাতে দুই জোড়া মোড়া নিয়ে সবার সঙ্গে বাজারে হাঁটা দিল। সবাই ওর সঙ্গে এটা ওটা কথাও বলল টুকটাক।
“রত্না, মা মারা যাবার পরে তুই বড় রোগা হয়ে গিয়েছিস।”
“মোড়া কি তুই নিজেই বানালি?”
“তোর বাবা ভালো তো?”
“দিদি কি গুয়াহাটিতেই আছে?”
রত্না যেদিন মোড়াগুলো নিয়ে বাজারে যাবার জন্যে বেরুলো, ওর বাবা সেই কপাল চাপড়ে বকেই যাচ্ছিল, “আমার ছেলে একটা আজ থাকত যদি, বোনকে এভাবে বাজারে যেতে দিত? কক্ষনো না। আমার পোড়া কপাল। ”
No comments:
Post a Comment