ফেলানি
মিলিটারি ট্রাকটি দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে কালো পর্দাটির তলার থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে চোখ ধাঁধানো রোদ। আগে আগে মিলিটারি পেছনে মানুষ, মানুষের পেছনেও মিলিটারি। গ্রামটিতে ঢুকতেই পড়ে নামঘর। অনেকদিনের পুরোনো। নামঘরের উঠোন জুড়ে ডালপালা মেলে ছায়া ফেলে রেখেছে অজস্র গাছ গাছালি। গাছগুলোতে পায়রার ঝাঁক। ঠিক বন্যও নয়, ঘরে পোষাও নয়। পায়রারারাতে নামঘরের সিলিঙে থাকে, দিনে গাছের ডালগুলোতে পড়ে থাকে। নামঘরের কাছে গিয়ে পায়রাগুলোর বহু চেনা বাক-বাকুম, বাক-বাকুম শব্দটি না শুনতে পেয়ে ও একটু অবাক হলো। কোথায় গেল এই পায়রাগুলো ? সত্যি সত্যি একটাও পায়রা নেই। আর নামঘরটি? সেখানে যেন একটা যুদ্ধই হয়ে গেছে।গাঁয়ের লোকে লেপে মুছে যেখানে একে পরিপাটি করে রাখে সেখানে পুরো নামঘরটার এক তৃতীয়াংশ শুয়ে পড়েছে। দু’একজন লোকের সঙ্গে সেও নামঘরের দোয়ারের সামনে অল্প দাঁড়ালো। ঠিক গেটের মুখটাতে কিছু একটা ভেঙ্গে টুকরো টাকরা হয়ে আছে। সে ভাঙা টুকরোগুলো কিসের তা চিনতে পেল। বিয়ের আগে গা ধুয়ে গাঁয়ের অন্য মেয়েদের সঙ্গে সেও নামঘর মোছার জন্যে আসত। মণিকুটের১ ভেতরে ঢোকা নিষেধ ছিল। নামঘরের প্রতিটি জিনিসের প্রতি ওদের ছিল অপার কৌতূহল । নামঘরের লোকেরা অন্য কোনও জিনিসে হাত দিতে না দিলেও আসতে যেতে দবাটিতে২ দু’এক ঘা বসাতে দিয়েছিল। ভেঙে টুকরো টুকরো সেই দবাটি সে ঠিক চিনতে পারল। ওর কানে ভেসে এলো দবার গুম গুম শব্দ।এই শব্দটিই একদিন গাঁয়ে বিপদের আগাম সংকেত হবে বলে কি কেউ ভেবেছিল? সে যখন ছোটোছিল, কতদিন যে সন্ধ্যে হলেই নামঘরের এই দবার শব্দে সেও বড়দের সঙ্গে হাতজোড় করেছিল। গালিও খেয়েছিল। নামঘরে দবা বেজে উঠার আগেই ছোটদের হাত পা ধুয়ে নিতে হতো। তখন কেউ ভাবেনি যে নামঘরে নামঘরে মানুষ জড়ো হবে, দবা বাজবে আর দবার শব্দে মানুষ প্রণাম করবে না। এ হবে রণভেরী। কেউ ভাবেনি। দবার শব্দে জুড়ে যাবে রক্ত , মৃতদেহ, আগুন আর হত্যা।
সে বাকি মানুষগুলোর সঙ্গে বড় নামঘর পেরিয়ে এগুতে থাকল। চতুর্দিকে আধপোড়া ঘর। বাগিচার ফল ধরাগাছগুলো মাটিতে শুয়ে আছে।ধানের ভাঁড়ারগুলোর জায়গাতে ছাইয়ের দম। ছাইয়ের মধ্যে কয়েকটিকুকুর শুয়ে আছে। ওরা তেমাথার মোড়ে এসে পৌঁছুলো। তেমাথার এই মোড়ে রয়েছে এক বিশাল বটগাছ। বটগাছটিতে নানা রকমের পাখির বাসা। এ গাছটির কাছে এলেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির কিচির মিচির শোনা যায়। আজ নামঘরের গাছগুলোর মতো এই বটগাছটিও যেন নিস্তব্ধ। সে এমনিই মাথা তুলে তাকালো। তাকিয়েই সে চেঁচিয়ে উঠল। দুর্গন্ধে নাক চাপা দিয়ে অন্যেরাও সেদিকে মাথা তুলে তাকালো। গাছটির ডালে ঝুলিয়ে রাখা আছে কাটা হাত পা, দুটো মুণ্ডহীন শিশু আর...। ওর মতোই অনেকেই আর ওদিকে তাকাতে পারল না।
মাত্র দুটা রাত। মানুষজনে ভরা একটা পুরো গমগমে গ্রাম শ্মশানপুরী হয়ে পড়ল। বেশির ভাগ বাড়িই আগুনে ছাই হয়ে গেছে। ধানের ভাঁড়ারগুলোর জায়গাতে ছাইয়ের দম। তিন চার বছর চালানো যায় এমন ধানের কিছু ভাঁড়ার থেকে এখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সাদা সাদা পাকিয়ে পাকিয়ে উপরের দিকে উঠা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ওর চোখে ভেসে উঠল ওদের নিজেদের ধানের গোলাটি। একটা পুরো বছর চলে এমন ধানের ভাঁড়ারটিকে সে আর মণি ওই কলাপাতার ডোবা থেকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখছিল। গোলাটির থেকে কি এখনো তেমনি আগুন বেরুচ্ছে না, কবেই জ্বলে ছাইয়ের দম হয়ে গেছে। বৈশ্যবাবুর পেছনে পেছনে সে চেনা পথটিতে পা দিল। আধপোড়া বাড়িগুলোর মধ্যি দিয়ে এগুতে থাকল।
লোকটিউঠে বাড়ির গেটে যেতেই আরেকটা লোক পেছন দিক থেকে দৌড়ে এলো। চেনা মুখ। রঘু। মালতী ওকে লম্বোদরের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই চেনে। রঘুর কেউ কোথাও নেই। সে যদিও একটু ভেদার মতো কিন্তু বুদ্ধিহীন নয় মোটেও। লেলিয়ে লেলিয়ে কথা বলা, একটু ছড়ানো বাঁকানো পা দুটোতে হেলে দুলে হাঁটা -- –এসব নিয়ে প্রথম দৃষ্টিতে রঘুকে দেখলে পুরো একটা ভেদা মানুষ বলেই মনে হবে।কিন্তু ওকে যেই একবার কোনও কাজে লাগায় সেই বুঝতে পায় এই ভেদাই চেহারাটার আড়ালে এক ধরণের বিশেষ বুদ্ধি রয়েছে। মণির বাবা ওকে প্রায়ই দিন হাজিরা করতে ডাকত। একবার দুটো কাঠ দিয়ে ইট ভরে ভরে একটা সিমেন্টের ফিল্টার সে একাই এমন করে বসিয়ে দিলে যে মণির বাবা বহুদিন ধরে কথাটা কাউকে বা কাউকে সুযোগ পেলেই বলত।রঘু যেখানেই ইচ্ছে সেখানেই পড়ে থাকে। কুকুর একটার যতটুকু ঠাঁই চাই, ওরও সেটুকুই চাই। জনশূন্য গ্রামটিতে রঘু এখন একচ্ছত্র সম্রাট। এই ক’দিনধরে সে সাহাদের আধপোড়া ঠাকুর ঘরটাতেই থাকতে শুরু করেছে।
(জানুয়ারি , '১৫ সংখ্যা ব্যতিক্রমে প্রকাশিত হয়েছে এই অধ্যায়।)
ভোরেই আর্মি এসে সব ক’টি শিবির থেকে মানুষ তুলে নিলো। প্রায় সবারই কেউ না কেউ নিখোঁজ হয়েছে।বৈশ্য বাবুর সঙ্গে ফেলানিও বেরুলো। ওকে আরো দু’জন মহিলার সঙ্গেসামনে বসতে দিল।
ভোরেই আর্মি এসে সব ক’টি শিবির থেকে মানুষ তুলে নিলো। প্রায় সবারই কেউ না কেউ নিখোঁজ হয়েছে।বৈশ্য বাবুর সঙ্গে ফেলানিও বেরুলো। ওকে আরো দু’জন মহিলার সঙ্গেসামনে বসতে দিল।
গাড়ি চলতে শুরু করলে কিছু পরেই সে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঠিক ঘুম নয়, এক ধরণের তন্দ্রা ।যখন তখন কোথাও একটু হেলান দিলেই, শুয়ে পড়লে তো কোনও কথাই নেই, চোখে কালো ছাই রঙের এক চাদর নেমে আসে। হালকা সেই অন্ধকারের মধ্যি দিয়ে সে খুব ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে। আজও গাড়ির সিটে হেলান দেবার সঙ্গে ওর চোখে নেমে এলো পাতলা চাদরখানা। ক্রমেই সেই পাতলা কুয়াশা রঙের চাদরখানা একটা ডাঁট কালো পর্দা হয়ে এলো। পর্দাটি মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি খেয়ে আবারও স্থির হয়ে পড়ে। এবারে ঐ কালো পর্দাটি এক গর্ত ভরা শুকনো কলাপাতার ডাঁটার সমান হয়ে ওকে পোঁতে ফেলল।ওর গালে মুখে সর্বত্র খসখসে কলার শুকনো পাতা। মাছ আটকাবার পর জাল টেনে আনলে তার ভেতরে যেমন মাছগুলো ধড়ফড় করতে থাকে সেও ঐ কলাপাতার ডাঁটার মধ্যে ধড়ফড় করতে শুরু করেছিল। যতই সে হাত পা ছুঁড়ছে কলার পাতাগুলো ওকে যেন আরো চেপে ধরছে. সে শ্বাস নিতে পারছিল না। চারদিকে অন্ধকার দেখছিল।শুধু যে ঐ কলার পাতাগুলো--- তাই নয়, এই অন্ধকারও যেন ওকে পোঁতে ফেলতে চাইছে। আঁধারের মধ্যে সে ওর হাতে একটা চেনা হাতের ছোঁয়া অনুভব করল। স্পর্শটি কোমল বা মিহি নয়, শক্ত আর খসখসে। খসখসে হাতটি ওকে কলাপাতার ডাঁটাগুলোর মধ্যি থেকে তুলে ধরল।আলোতে সে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দেখেঐ মানুষটির হাতখানা ওকে জোর করে ধরে রেখেছে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল মানুষটির শক্ত হাতের টান টান আঙুলগুলো।সে খিলখিলেয়ে উঠেছে, “এ মা! এটাই কি হাত, না সেগুনের পাত! কী যে বড়!” শক্ত হাতের মানুষটির সেগুন পাতার মতো হাতে ওর হাতটিলুকিয়ে পড়ল, “ হবে হয়তো। ভগবান তোকে টগর ফুলের মতো হাত দিয়েছে, আমার না হলে সেগুন পাতার মতোই হলো!” কেবলই আলো আর আলো। আলোতে সে মানুষটিকেভালো করে ঠাহর করতে পারেনি। চারদিকের রোদে যেন ওর মানুষটিকে ঢেকে রেখেছে। সে চোখ কচলে তাকাবার চেষ্টা করল। কিচ্ছু দেখা যায় না। এক অদ্ভুত ধারালো রোদ ছ্যাঁত করে গিয়ে ওর চোখে পড়েছে।
মিলিটারি ট্রাকটি দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে কালো পর্দাটির তলার থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে চোখ ধাঁধানো রোদ। আগে আগে মিলিটারি পেছনে মানুষ, মানুষের পেছনেও মিলিটারি। গ্রামটিতে ঢুকতেই পড়ে নামঘর। অনেকদিনের পুরোনো। নামঘরের উঠোন জুড়ে ডালপালা মেলে ছায়া ফেলে রেখেছে অজস্র গাছ গাছালি। গাছগুলোতে পায়রার ঝাঁক। ঠিক বন্যও নয়, ঘরে পোষাও নয়। পায়রারারাতে নামঘরের সিলিঙে থাকে, দিনে গাছের ডালগুলোতে পড়ে থাকে। নামঘরের কাছে গিয়ে পায়রাগুলোর বহু চেনা বাক-বাকুম, বাক-বাকুম শব্দটি না শুনতে পেয়ে ও একটু অবাক হলো। কোথায় গেল এই পায়রাগুলো ? সত্যি সত্যি একটাও পায়রা নেই। আর নামঘরটি? সেখানে যেন একটা যুদ্ধই হয়ে গেছে।গাঁয়ের লোকে লেপে মুছে যেখানে একে পরিপাটি করে রাখে সেখানে পুরো নামঘরটার এক তৃতীয়াংশ শুয়ে পড়েছে। দু’একজন লোকের সঙ্গে সেও নামঘরের দোয়ারের সামনে অল্প দাঁড়ালো। ঠিক গেটের মুখটাতে কিছু একটা ভেঙ্গে টুকরো টাকরা হয়ে আছে। সে ভাঙা টুকরোগুলো কিসের তা চিনতে পেল। বিয়ের আগে গা ধুয়ে গাঁয়ের অন্য মেয়েদের সঙ্গে সেও নামঘর মোছার জন্যে আসত। মণিকুটের১ ভেতরে ঢোকা নিষেধ ছিল। নামঘরের প্রতিটি জিনিসের প্রতি ওদের ছিল অপার কৌতূহল । নামঘরের লোকেরা অন্য কোনও জিনিসে হাত দিতে না দিলেও আসতে যেতে দবাটিতে২ দু’এক ঘা বসাতে দিয়েছিল। ভেঙে টুকরো টুকরো সেই দবাটি সে ঠিক চিনতে পারল। ওর কানে ভেসে এলো দবার গুম গুম শব্দ।এই শব্দটিই একদিন গাঁয়ে বিপদের আগাম সংকেত হবে বলে কি কেউ ভেবেছিল? সে যখন ছোটোছিল, কতদিন যে সন্ধ্যে হলেই নামঘরের এই দবার শব্দে সেও বড়দের সঙ্গে হাতজোড় করেছিল। গালিও খেয়েছিল। নামঘরে দবা বেজে উঠার আগেই ছোটদের হাত পা ধুয়ে নিতে হতো। তখন কেউ ভাবেনি যে নামঘরে নামঘরে মানুষ জড়ো হবে, দবা বাজবে আর দবার শব্দে মানুষ প্রণাম করবে না। এ হবে রণভেরী। কেউ ভাবেনি। দবার শব্দে জুড়ে যাবে রক্ত , মৃতদেহ, আগুন আর হত্যা।
ওদের সেই মরাপাটের খেতের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। মরাপাটের খেতের প্রায় চিহ্নই নেই আর। চিঁড়া। মুড়ি , নারকেল গুটিয়ে নিয়ে গিয়ে যেখানে লুকোনোর জায়গা করা হয়েছিল সেখানে এখন সার দিয়ে পড়ে আছে অজস্র মৃতদেহ। শিশু আর মেয়ে মানুষই বেশি। মৃতদেহগুলোতে কাদা লেগে আছে। কাদা আর রক্ত মাখা এই দেহগুলো থেকে মানুষগুলোর শরীর থেকে একটা দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। ঢেকে রাখা মৃতদেহগুলোর আবরণ সরিয়ে দেয়া হলো। বেশ কিছু মানুষ। তিনজন মহিলা গিয়ে ঐ মৃত দেহগুলোর উপর আছড়ে পড়ল। মামণির বাবাও বুকে জড়িয়ে ধরেছে মাথা কাটা যাওয়া একটি ছেলের শরীর। মানুষটি হাউমাউ করে কাঁদছে। মালতীর বুকে যেন কেউ একটা পাথর বেঁধে দিয়েছে। সে শ্বাস নিতে পারছিল না। কাঁদতে পারছিল না। ওর চোখ দুটো যেন পুড়ছিল। সে মৃতদেহগুলো দেখার চেষ্টা করছে। পোড়া চোখে সে কিছুই দেখছিল না। চতুর্দিকে চাকা চাকা রক্ত আর কাদাতে লেপ্টানো কতকগুলো মৃতদেহ। সে ওই পড়ে থাকা পাটগাছগুলোর উপর হাঁটু মোড়ে তাতে মাথা গুঁজে বসে পড়ল। আবারো ওর চোখে নেমে এলো পাতলা কুয়াশা রঙের চাদরখানা। চাদরটি কালো হতে যাবে কি তখনই ওকে কেউ ট্রাকে উঠতে আদেশে দিল। ট্রাকটি এবারে গাঁয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। স্কুলের কাছেই মিলিটারি মানুষগুলোকে ছেড়ে দিল। সবাই যার যার বাড়ি ঘরের খোঁজে এগুলো। সেও বৈশ্যবাবুর সঙ্গে হাঁটা দিল।
মাত্র দুটা রাত। মানুষজনে ভরা একটা পুরো গমগমে গ্রাম শ্মশানপুরী হয়ে পড়ল। বেশির ভাগ বাড়িই আগুনে ছাই হয়ে গেছে। ধানের ভাঁড়ারগুলোর জায়গাতে ছাইয়ের দম। তিন চার বছর চালানো যায় এমন ধানের কিছু ভাঁড়ার থেকে এখনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সাদা সাদা পাকিয়ে পাকিয়ে উপরের দিকে উঠা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ওর চোখে ভেসে উঠল ওদের নিজেদের ধানের গোলাটি। একটা পুরো বছর চলে এমন ধানের ভাঁড়ারটিকে সে আর মণি ওই কলাপাতার ডোবা থেকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখছিল। গোলাটির থেকে কি এখনো তেমনি আগুন বেরুচ্ছে না, কবেই জ্বলে ছাইয়ের দম হয়ে গেছে। বৈশ্যবাবুর পেছনে পেছনে সে চেনা পথটিতে পা দিল। আধপোড়া বাড়িগুলোর মধ্যি দিয়ে এগুতে থাকল।
ওদের পাড়াটার শুরুতেই প্রশস্ত উঠোনের সাহাদের বাড়ি। পান সুপারির ভরা বাগানের ছায়াতে ঢাকা বাড়িটির একাংশ পুড়ে গেছে। বাগানের ফল ধরতে শুরু করা গাছগুলোকে যেন এক তুমুল ঘূর্ণি বাতাসে দুমড়ে মোচড়ে ফেলে দিয়েছে। মাটিতে শুয়ে পড়া গাছগুলোর মধ্যি দিয়ে ঘরটাকে দেখে সে অল্প দাঁড়ালো, দাঁড়ালো বৈশ্যবাবুও। হাতে একটা পোটলা নিয়ে একটি আধবয়সী লোক ঘরটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। বুড়া বুড়ির ছেলে, মেজোটি। ওর গায়ের একটা ধুতি প্যাঁচানো, হাতে কুশের ধাড়া দেখে মালতীর মুখের থেকে একটাই কথা বেরুলো,’দাদু-দিদা।‘ ওর মুখের উপরেই বৈশ্যবাবু জিজ্ঞেস করে ফেলল, ‘বুড়া বুড়ির...।’ জবাবে মানুষটি মাটিতে বসে পড়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে শুরু করল। মালতীর আবারো সেই তন্দ্রা এসেছে। চারদিকের রোদ যেন নিস্তেজ হয়ে এসেছে। ওর চোখের সামনে একটা হাত ভেসে উঠেছে যার সর্বত্র কালো কালো ফুট ফুট দাগ, কুঁচকে যাওয়া ঢিলে ছাল দিয়ে যেন প্যাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। হাতটিওর মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পুরো সাদা চুলের মাঝখানে লাল সিঁদুর। কান জুড়ে বসে পেখম তুলে বসে আছে এক ময়ূর পাখি। সে যেন বহু দূর থেকে দুটো মানুষকে কথা বলতে শুনতে পাচ্ছে। সেই শব্দগুলোরসঙ্গে সঙ্গে সে দিনে দুপুরে, এই অসময়ে নামঘরে নামঘরে দবা বাজানোর শব্দ শুনতে পেল। মানুষের হুড়োহুড়ি লেগেছে। অলক্ষুণে ছেলেটি বাতের বেমারি বুড়ো বুড়ি দুজনকে হাতে ধরে ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।মানুষগুলো পালাচ্ছে যেন হরিণের পেছনে শিকারি পড়েছে । বাতের বেমারি বুড়ো বুড়ি দৌড়োনো তো দূরের কথা , ভালো করে হাঁটতেই পারছে না। তিন টুকরো করে কেটে ফেলল বুড়ো বুড়িকে। মানুষটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, “ ঐখানটায়...।” ফল আসা যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে সেগুলোর মাঝখানে শিমুল গাছটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি আজই চলে যাবে। এখানে আর থাকবে না।সে পোটলাখানা খুলে মেলে দিল, “ মা-বাবার চিহ্ন বলে এগুলো নিয়ে যেতে এলাম।” মালতী পোটলাটার দিকে এক লহমার জন্যে তাকিয়ে বুঝতে পারল দিদা-দাদু রোজ যাকে পুজো করতেন সেই কৃষ্ণের মূর্তিটা। সে একটা প্রণাম করল।
সে এসে সাহার পায়ে পড়ে কোঁকাতে শুরু করল। তার পর হাতে একটা ছোট্ট পোটলা তুলে দিল। পোটলাটা ভালো করে বাঁধা ছিল না, সব জিনিস মাটিতে পড়ে গেল। হাতি দাঁতের মূর্তি,তামার কোষা-অর্ঘ, রূপোর বাসন। সে লেলিয়ে লেলিয়ে বুঝিয়ে দিলে, এসব জিনিস বাঁচাবার জন্যেই সে এ ক’দিন ঠাকুর ঘরে শুয়ে আছে। জিনিসগুলো হাত পেতে নিয়ে মানুষটি কোনও দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
মালতী ঘাসের উপর বসে পড়ল। রঘু একটা কলাপাতাতে চার পাঁচটা পাকা মালভোগ কলা এনে দিল। বাটি একটাতে সামান্য জল। কলার কাঁদিটা ওর চেনা । মণির বাবা বীজ এনেছিল। দিদা ওর থেকে চারা একটা এনেছিল। খাব না, খাব না বলতে বলতে সে দুটো কলা খেয়ে ফেলল। রঘু ওদের কাছে বসে কেঁদে ফেলল। সব সময় যে মুখে একটা বোকা বোকা হাসি নিয়ে কাজ করতে থাকে সেই রঘুর মুখের কান্নাটা ওর কেমন কিজানি লাগল।রঘুর ঐ লেলিয়ে লেলিয়ে বলা কথাগুলো শুনতে ওর তখন অসহ্য লাগছিল। তবুও সে বলেই যাচ্ছে।, মাঝ মাঝে অদ্ভুত এক কান্নাতে ওর মুখখানা বাঁকা হয়ে যায়। রঘু ‘র’ উচ্চারণ করতে পারে না, ‘ল’ হয়ে যায়। কখনো বা ‘র’ গিয়ে ‘ন’ হয়ে যায় আর তুই- তুমি- আপনির কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। এখন সেটি আরো বেশি হচ্ছে। ওর চিন্তা, শব্দ সব এলোমেলো হয়ে গেছে। সে মণির মায়ের শরীরে শরীর লাগিয়ে বসতে চাইছে। বহুদিন পর বাড়ির মালিককে দেখতে পাওয়া কুকুর একটার মতো করছে সে।
মলি মা! মলি বাবা!...আমি ইশকুলে ছিলাম। লাতে এতো এতো মানুষ, মুখ নেই...।”
“ “ মুখ ছাড়া মানুষ দেখেছিলি তুই?” বৈশ্যবাবু কোমরের তাবিজটা ধরে টানাটানি করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন।
“নেই , চোখ নেই, মাথা নেই, কালো কালো কাপল...নামঘলে দবা, লাতে দবা, দুম দুম দুম , নামঘলেও মানুষ...মাথা নেই, চোখ নেই, আমি পুকুলে, বল নামঘলেল পুকুলে। মাথাল উপল কচুলি পানা। আগুন দিল , মলি মা, কিবানি আর কিবানিল বাবা, তোদেল ঘলে আগুন। সকালে কুকুল আর শিয়াল। পুলো গলৈ মাছ, কালা।” সে হাঁউ মাউ করে কাঁদছে। ঠিক কান্না নয়, এক ধরণের গোঙানো, “ দাদু...দিদাল শিমুল গাছের তলায়, বুলো বুলিল মাথা...ছাগলের মাথা, বীনেন কছাইল দোকান...লাল লাল লক্ত।” ভোঁৎকা একটা গন্ধ বেরুচ্ছে ওর গা থেকে। সেই ওকেই জলে ডুবতে যাওয়া মানুষ যেমন বাঁচতে গেলে খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে তেমনি জড়িয়ে ধরতে চাইছিল মালতী। এ সব দেখেছে। “ রঘু তুই মণির বাবাকে দেখেছিলি কি, দেখেছিলি কি ?”
রঘু চুপ করে গেল। সে মাথা নিচু করে কিছু একটা মনে করবার চেষ্টা করল।
“মলিল বাবা...।”
“ হ্যাঁ রঘু , মণির বাবা। অ্যাঁ মলিল বাবা।” সে টেরই পেল না কখন রঘুর স্বরেই বলে ফেলল।
“ মলি বাবা সুভাষ মাচতল পাহলা পাটিতে...।”
“হ্যাঁ রঘু, মণির বাবা, সুভাষ মাষ্টার সেদিন পাহারাতে ছিল।”
“পাহলা পাটি পুলের কাছে, পুলের উপল দিয়ে মানুষ, মাথা নেই, চোখ নেই।”
“ তার পর রঘু, তারপর কী হলো?”
মাষ্টলকে টিশনের ছেলেলা নামঘলে নিয়ে গেল। সাল! সাল! আমলা আপনাকে মলতে দেব না, টিশনেল ছেলেলা মলিল বাবাকেও নিয়ে গেল। মাষ্টলকে নামঘলে কেলাশিন,আগুন। টিশন ছেলেকে মলি বাবা গালি, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গালি। পুলে মানুষ...মাথা নেই...চোখ নেই...মলি বাবাকে আগুন...।” রঘু এবারে মাটিতে গড়িয়ে মুখ ঢেকে গোঙাতে শুরু করল, “ মলি বাবা, মাষ্টল...নামঘলে আগুন...পুলে মানুষ...মাথা নেই...চোখ নেই...।” এমনিতেই অস্বাভাবিক রঘুর মুখখানা আরো বাঁকা হয়ে গেছে। সে মণির মাকে নিজে দেখা সব কথা বলতে চাইছিল। একই কথাগুলো বারে বারে বলে মণির মাকে সে অনেক কথাই বলবার চেষ্টা করছিল।“তোদেল বাড়িতে আগুন...দাদু দিদাল মাথা...ছাগলেল মাথা...লাল লাল লক্ত।” ওর চোখ দুটো এক অদ্ভুত ভয়ে বিস্ফোরিত, “ মানুষ , বহু মানুষ...মাথা নেই, চোখ নেই, মুখ নেই...কালো কাপল।”
“বৈশ্যবাবু এসে মালতীর কাছে দাঁড়ালো, “ চল, জোরে চল। এটি এক প্রেতের গ্রাম হয়ে গেছে গো মণির মা। এখানে কেউ থাকে না। শুনলি না রঘু কী বলছে, মুণ্ডহীন মানুষ। বেরুবে বুঝলি, রাত হলেই বেরুবে। ওকে এতো করে বললাম গামছা একটা রাখ । শুনল না। বাঙালিদের বাঁচাতে যায়। গামছা রেখেই বা আমার কী হলো? আগুনে কী চেনে। পুড়ে ফেলল, সব পুড়ে ফেলল। দুটো ছেলে মেয়েকে এই শ্মশান পুরিতে রেখে গেলাম। বাকি ক’টাকে...।” মালতী বৈশ্যবাবুর সঙ্গে পা মেলাতে পারেনি। এবারে মানুষটা দাঁড়িয়েছে। ওদের বাড়িটা । লম্বোদরের হাতের কাজে ফুলটাতে ফলটাতে সেজে গ্রামের ভেতরে চোখে পড়বার মতো সেই বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সে আধপোড়া সদর দরজাতে হাত দিতে চাইল। মামণির বাবা ওর হাত ধরল, “ ঢুকবি না, ঢুকবি না বলেছি না। তার উপর দু-দুটো মানুষ। বাড়ির ভিটে ছেড়ে যায় না ওরা। ঢুকবি না বলেছি, গায়ে লেগে এসে পড়বে।” ওকে মানুষটি ছ্যাঁচড়ে নেবার মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। “ চল না , বলছি জোরে চল। আর্মির গাড়ি এখন ফিরে যাবে। ওদিকে তাকাবি না।গায়ে করে লেগে আসবে।
মালতীর এমনটি মন হলো যেন এই রঘু আর মানণির বাবার কথাগুলো একই। কেবল রঘু ‘র’ বলতে পারেনা,মণির বাবা পারে।
টীকা:
১)মণিকূটঃ নামঘরের পূর্ব বা উত্তর দিকে বিগ্রহ ভাগবত ইত্যাদি স্থাপন করবার জন্যে ছোট ঘর।
২) দবাঃ নাগরার আকারে গড়া একধরণের বাদ্য , যাকে ছোট লাঠির ঘায়ে বাজাতে হয়।
7 comments:
গতকাল কপি করে রেখেছি কিন্তু এখনো পড়তে পারিনি। এই সাইটের আপডেট আমার কাছে যাচ্ছে না কেন, ফীড বার্ন করা হয়নি না কি?
আমি এডঅন ব্যবহার করে পাঠাই, এবারেরটাও পাঠিয়েছি। পাননি? ফিডবার্নারের ব্যাপারটা বড্ড জটিল এখনো বুঝিনা
ফিড বার্ন করা কঠিন কিছু নয়। ২/১ দিনের মধ্যে বাংলা হ্যাকসে এ ব্যাপারে পোস্টিং যাবে ওটা দেখে করে নিলেই হবে। ফিড বার্ন করা থাকলে যে কোন জায়গায় সঙ্গে সঙ্গে আপডেট চলে যায়, এটা থাকা জরুরী।
http://feedburner.google.com/fb/a/myfeeds
এ পর্যন্ত গেছি। এর পরে কী জানি না!
এরপর?এরপর বাংলাহ্যাকসে আজকের ভ্যালেন্টাইন ডের পোস্টিং। সহজ সমাধান। ছবি দিয়ে ধাপে ধাপে সব বলে দেয়া হয়েছে, একেবারে জলবত। তারপরেও যদি না হয় তাহলে আমি রয়েছি কি জন্য?
এইতো বেশ। সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়েছে। এখানে না এসেই আমি বুঝতে পেরেছি। স্মৃতিকণায় আপডেট চলে গেছে। সফল ভাবে প্রয়োগের জন্য অভিনন্দন। আশা করি এবার সব গুলিতে করা যাবে।
তার মানে কি আমি পোষ্ট করবার সঙ্গে সঙ্গে ওখানে চলে যাবে?
Post a Comment