ফেলানি
সবার আগে জাগল জোনের মা। সে উঠে একটা হাই দিতেই বাকিরাও সেই শব্দে সাড়া পেয়ে উঠে গেল। রাতে শুতে যেতেই একটা বেজে গেছিল। “আমরা নাহয় উপোস থাকলাম। কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোকে কী করে না খাইয়ে রাখি?” বলে ফুলই প্রথম ভাত বসাবার কথাটা তুলল। এই ক’দিন সে ড্রাইভারণীর মেয়েটিকে বুকের থেকে নামায় নি। মেয়েটাও ওর গায়ে চ্যাপ্টা হয়ে লেগে আছে। চাল-ডাল মণির মায়ের ঘরে ছিল। আজ দু’দিন আগে মণি মাকে বাজার টাজার এনে দিয়েছিল । কে কে তিন চারজন লেগে পড়ে যেন নিজের নিজের বাড়ি থেকে কী কী নিয়ে এলো। সবার জন্যে খিচুড়ি হয়ে গেল। সবাই সাত সকালে ঘুম ছেড়ে উঠেছে। রাতে শুতে যেতে যতটাই হোক, ভোর না হতেই বিছানা ছাড়াটা সবার অভ্যাস। আর জেগে উঠেই কেউ বসে থাকতেও পারে না।
মীরা বাসন ধুতে গেল। সঙ্গে গেল রত্না।
জোনের মা ফুলঝাড়ু হাতে নিলো।
মিনতি নিলো শলার ঝাড়ু।
ফুল ঘর মোছার বালতি আর কাপড়।
মীরার মা বিছানাগুলো তুলে ফেলল।
মুহূর্তের মধ্যে ফু দিয়ে ঘরটা ভাত খাবার যোগ্য হয়ে গেল। তারপরে সবার স্নান-টানও হয়ে গেল। লবণ দেয়া লাল চা নিয়ে সবাই বসেছিল মাত্র। একটা ছেলে, মণিদের বয়সের, সঙ্গে একটি মেয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো।
মণির মা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই মেয়েটি ঝড় তুফানে দোলানো মূলি বাঁশের মতো তার বুকে ঢলে পড়ল। বুক ভাঙ্গা কান্নাতে অস্থির মেয়েটিকে বুকে ধরে রাখতে পারে নি মণির মা। মেয়েটির কান্না সবার মধ্যে গড়িয়ে গেল।
“কাঁদবি না রীণা, কাঁদবি না।” ওকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে মণির মাও কেঁদে ফেলল। কীই বা হচ্ছে ছেলেটার! সে কি এতোই বড় হয়ে গেছে যে তাকে মিলিটারি ধরে নিয়ে যেতে পারে। ও করেছে কী? ধনী মানুষের ছেলে হতো তবে কলেজে পড়ত, ছোট্ট ছেলেটি হয়ে থাকত।
সবারই যেন হঠাৎ ই ছোট বলে ভাবতে ভাবতে ছেলেগুলো বড় হয়ে গেল। চালের মুঠো জোগাড় করতে করতে ছেলেগুলো বড় হয়ে গেল, পুলিশ মিলিটারি ধরে নিয়ে যাবার মতো বড়ো হয়ে গেল। সবাই মিলে হাউ হাউ করে কাঁদততে শুরু করল।
ফুল কাঁদছে অসুস্থ কুঁজো মানুষটির জন্যে।
মীরার মা কাঁদছে অন্যের দোকানে জিনিস বিক্রি করে, তার গোঁফ গজানো ছেলে মণ্টুর জন্যে।
নতুন ঠেলা একটা কিনে ধানের মিল থেকে তুষ নিয়ে হোটেলগুলোতে পৌঁছে দিয়ে ঘরে কিছু চাল নিয়ে আসে জোন। জোনের মা কাঁদছে সেই জোনের জন্যে।
মিনতি নবীনের জন্যে।
রীণা মণি নামের দাদার বন্ধু জোয়ান ছেলেটার জন্যে।
ফেলানি মণি নামের হঠাৎই বড় হয়ে উঠা ছোট ছেলেটার জন্যে।
মীরা কাঁদছে দাদার জন্যে।
রত্না তার চোখের সামনে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া বস্তির মানুষগুলোর জন্যে।
ফেলানির বাড়ি হয়েছে যেন মরা বাড়ি। আধা তৈরি ঘর, কালী বুড়ির থান ---সবটাই কান্নাতে ডুবে গেল।
হাউ হাউ করে কান্নার শব্দ ফোঁপানোতে পরিণত হয়েছে। কেঁদে কেঁদে নেতিয়ে পড়া মহিলাদের দেখে ফেলানির রাগ উঠে গেল। কালী বুড়ি ঠিকই বলত, মেয়ে মানুষ খালি ভেঁ ভেঁ করে কাঁদতে পারে। কী করে যে কাঁদছে মেয়ে মানুষগুলো! কিসের আশাতে কাঁদছে? বাইরে একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। কান্নার শব্দ শুনে ভেতরে আসবে। এসে কী বলবে? “ মাল তো বেশ বড়িয়া দেখছি! ভাগিয়ে নিয়ে যাবি কি রে?”
“ এই তোরা চুপ করলি ?” ফেলানির গলা শুনে সবাই চমকে উঠল।
“ কাকে শোনাবার জন্যে কাঁদছিস? কোন পেয়ারের লোক আসবে?”
“ ওভাবে বলছিস কেন মণির মা?” আমার ছেলেটা ঠেলাতে করে ক’বস্তা তুষ টানে জানিস? ওকে আর্মি নিয়ে গিয়ে...” জোনের মা আবার কাঁদছে। সঙ্গে সঙ্গে সামান্য সময় বন্ধ হয়ে পড়া কান্নার রোল আবার উঠল।
“তোদের কি ছেলে , স্বামী ফিরিয়ে চাই? না ওদের আর্মির হাতে ছেড়ে দিবি?”
“ পাক্কা খবর । সবাইকে অল্প পরেই চালান দেবে।” রীণার দাদা কথাটা বলেই মাটিতে বসে পড়ল। ভেতরে আসা ছেলেটার মুখে এই কথা শুনেই ফোঁপানো কান্না আবার হাউ হাউ-তে পরিণত হলো।
কান্নার শব্দে বাইরে টহলদার কয়েকটা আর্মি ভেতরে এলো।
“কিউ হাল্লা –চিল্লা করতা হে?”
“কার্ফিউ লাগা হুয়া হে, মালুম নেহি?”
“চুপ নেহি রেহনে ছে...” একটা তেড়ে আসছিল।
“ কী করবি কুত্তার দল?...” কথাটা মুখের ভেতরে গিলে থেমে গেল ফেলানি। ওরা চলে গেল।
“ দাদা, তুই যা গিয়ে।” পেছনে গিয়ে লুকোনো দাদাকে বলল রীণা।
“তুই ?”
“ও থাকুক আমার সঙ্গে।” রীণাকে নিজের পাশে বসিয়ে বলল ফেলানি। “শুনলি ওরা কী বলে গেল? শুনলি না , না?”
“কী করবে ওরা আমাদের?” মীরার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
“ কী আর করবে? কিচ্ছু করতে পারবে না।” ফেলানির কথাতে যেন সবাই সাহস ফিরে পেলো।
“কী করবি মণির মা? মানুষগুলোকে মরতে দিবি কি?”
“ কী করবি? ওদের চালান দেবে। তখন কী হবে?”
“কী হবে আর? মেরে ফেলবে?” নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে উত্তরটা দিল ফেলানি।
“ কী বলছিস রে , মণির মা?”
“ তোর মুখে কিসে ভর করেছে?”
“তুই মা হয়ে এই কথাটা বলছিস?”
“পোকা পড়ুক তোর মুখে।”
“তোর বুকে কি মায়া মমতা নেই?”
সবাই ফেলানিকে চটে গিয়ে ঘিরে ধরেছে। আবার ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
“ কেঁদে কেঁদে প্যারের লোকগুলোকে ডাকতে থাকবি? না কিছু একটা করবার কথা ভাববি?”
“কী করবে?” রীণার কথা বড় কষ্টে বেরিয়ে এলো।
“ কী আর করবি?”
“আমাদের হাতে বন্দুক আছে, না টাকা আছে?”
“কোথায় যাবো আমরা?”
“ আর্মির কাছেই বা যাই কী করে?”
“গেলেই বন্দুক দেখাবে।”
“হট যাও, হট যাও—বলে তেড়ে আসবে।”
ফোঁপানো কান্নার শব্দ বাড়ছে।
“মরতে তোদের প্রচুর ভয়, তাই না?” একটু হাসল ফেলানি। কেউ কিছু বলল না।
“আমাদের আবার মরা কী, বাঁচাই কী?” জোনের মা প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।
“ঠিক বলেছিস জোনের মা। আমরা জ্যান্ত মরা হয়েই আছি।” মিনতি গলা ভার করে বলল।
“জোনের মা মরতে মরতে ফিরে এসেছে। তুইও মরার থেকে বেঁচেছিস।”
“ঠিকই বলছিস, আমাদের আর মরা-বাঁচা কী?” হাতের যে জায়গাটা ফুলে গেছে সেখানে হাত বুলিয়ে বলল মীরার মা।
“আমাদের কত মরল। জগু মরল, ওর বৌ মরল।” ওদের মনে করিয়ে দিতে চাইল ফেলানি।
“জোনের বাবা, সুমলা, বুলেন।”
“হরি ভাঙুয়ার পোলা।”
“রত্নার মা।”
“কালী বুড়ি।”
“ড্রাইভার।”
“রত্নার বাবা।”
“ড্রাইভারের ছেলেটা।”
“হ্যাঁ, অনেক মানুষ মরল।” কথাটা এমন করে বলল ফুল যেন লোকগুলো মরার কথা সে জানেই না।
“আমাকেও মরা বলেই ধরো।” রত্না মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
“মা মরল, বাবা মরল।” হুঁ হুঁ করে কাঁদছে সে।
“তার মানে মরতে তোদের ভয় নেই?”
“তোর, মণির মা?” মীরার মা তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“আমার আর কী?” ছেলেটাই আমার সব। আমার বাঁচা-মরা কি আর আলাদা কিছু?”
ফেলানি সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
“তোরা যাবি আমার সঙ্গে?”
“কই?”
“এখনো ওদের চালান দেয় নি। সেখানেই আছে। যাবি?”
“কী করব?”
“কোথায় যাবো?”
“কী করে যাবো?”
“কোথায় যাব আবার কী? আর্মি ক্যাম্পে!” গায়ের কাপড় ঠিক করে নিলো ফেলানি।
সবাই উঠে দাঁড়ালো।
“দেখিস নি তোরা কতবার মেয়েরা গিয়ে ক্যাম্প ঘিরে ধরেছিল?”
“সেবারে জংলি পার্টিটার পাঁচটা ছেলে বের করে নিয়ে যায় নি?”
“একবার ক্যাম্পে বুলেনের পার্টির মেয়েরা তিনদিন তিনরাত গিয়ে ছিল না?”
নিঃশব্দে দাঁড়ালো এরা আর আর্মি ক্যাম্পের দিকে পা বাড়ালো। নিঃশব্দে বস্তিটা পার হলো, পাকা রাস্তাতে পা দিল। কেটে খালি করে ফেলা রিজার্ভ পার হয়ে গেল। তারপর আর্মি ক্যাম্পের সামনে এরা বসে গেল। যেখানে বসেছিল তার থেকে সামান্য দূরে ছিল শিশু গাছ একটার কাটা গুড়ি। সেখানেই পড়ে রয়েছিল সুমলা পাগলি। একটা পুরো গাছ ছিল সেখানে। এখন পড়ে আছে কিছু শুকনো গুড়ি।
ওদেরকে দেখে দুই একটা বন্দুকধারী বেরিয়ে এলো। ওরা বসেই আছে। কেন বসে আছে জিজ্ঞেস করল বন্দুকধারীরা। এখান থেকে চলে যেতে বলল। ফেলানি দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গের বাকিরাও দাঁড়ালো।
“আমাদের লোকজনকে নিয়ে যেতে এসেছি।” ক্যাম্পের ভেতর থেকে আরো কয়েকজন বন্দুকধারী বেরিয়ে এলো। ওরা বন্দুকের পেছন ভাগ দিয়ে ফেলানিকে ঠেলা দিল। এরাও ওদের চলে যেতে বলল।
“আমার মানুহকিটা লাগে।”
“হামার আদমি...”
“ আমাদের লোক আমাদের চাই।”
“হামার মরদ...”
“হামারা বেটা।”
একটাও মহিলা ফিরে যাবে না। ওদের মানুষজন না নিয়ে যাবে না।
মীরা বাসন ধুতে গেল। সঙ্গে গেল রত্না।
জোনের মা ফুলঝাড়ু হাতে নিলো।
মিনতি নিলো শলার ঝাড়ু।
ফুল ঘর মোছার বালতি আর কাপড়।
মীরার মা বিছানাগুলো তুলে ফেলল।
মুহূর্তের মধ্যে ফু দিয়ে ঘরটা ভাত খাবার যোগ্য হয়ে গেল। তারপরে সবার স্নান-টানও হয়ে গেল। লবণ দেয়া লাল চা নিয়ে সবাই বসেছিল মাত্র। একটা ছেলে, মণিদের বয়সের, সঙ্গে একটি মেয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো।
মণির মা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই মেয়েটি ঝড় তুফানে দোলানো মূলি বাঁশের মতো তার বুকে ঢলে পড়ল। বুক ভাঙ্গা কান্নাতে অস্থির মেয়েটিকে বুকে ধরে রাখতে পারে নি মণির মা। মেয়েটির কান্না সবার মধ্যে গড়িয়ে গেল।
“কাঁদবি না রীণা, কাঁদবি না।” ওকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে মণির মাও কেঁদে ফেলল। কীই বা হচ্ছে ছেলেটার! সে কি এতোই বড় হয়ে গেছে যে তাকে মিলিটারি ধরে নিয়ে যেতে পারে। ও করেছে কী? ধনী মানুষের ছেলে হতো তবে কলেজে পড়ত, ছোট্ট ছেলেটি হয়ে থাকত।
সবারই যেন হঠাৎ ই ছোট বলে ভাবতে ভাবতে ছেলেগুলো বড় হয়ে গেল। চালের মুঠো জোগাড় করতে করতে ছেলেগুলো বড় হয়ে গেল, পুলিশ মিলিটারি ধরে নিয়ে যাবার মতো বড়ো হয়ে গেল। সবাই মিলে হাউ হাউ করে কাঁদততে শুরু করল।
ফুল কাঁদছে অসুস্থ কুঁজো মানুষটির জন্যে।
মীরার মা কাঁদছে অন্যের দোকানে জিনিস বিক্রি করে, তার গোঁফ গজানো ছেলে মণ্টুর জন্যে।
নতুন ঠেলা একটা কিনে ধানের মিল থেকে তুষ নিয়ে হোটেলগুলোতে পৌঁছে দিয়ে ঘরে কিছু চাল নিয়ে আসে জোন। জোনের মা কাঁদছে সেই জোনের জন্যে।
মিনতি নবীনের জন্যে।
রীণা মণি নামের দাদার বন্ধু জোয়ান ছেলেটার জন্যে।
ফেলানি মণি নামের হঠাৎই বড় হয়ে উঠা ছোট ছেলেটার জন্যে।
মীরা কাঁদছে দাদার জন্যে।
রত্না তার চোখের সামনে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া বস্তির মানুষগুলোর জন্যে।
ফেলানির বাড়ি হয়েছে যেন মরা বাড়ি। আধা তৈরি ঘর, কালী বুড়ির থান ---সবটাই কান্নাতে ডুবে গেল।
হাউ হাউ করে কান্নার শব্দ ফোঁপানোতে পরিণত হয়েছে। কেঁদে কেঁদে নেতিয়ে পড়া মহিলাদের দেখে ফেলানির রাগ উঠে গেল। কালী বুড়ি ঠিকই বলত, মেয়ে মানুষ খালি ভেঁ ভেঁ করে কাঁদতে পারে। কী করে যে কাঁদছে মেয়ে মানুষগুলো! কিসের আশাতে কাঁদছে? বাইরে একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। কান্নার শব্দ শুনে ভেতরে আসবে। এসে কী বলবে? “ মাল তো বেশ বড়িয়া দেখছি! ভাগিয়ে নিয়ে যাবি কি রে?”
“ এই তোরা চুপ করলি ?” ফেলানির গলা শুনে সবাই চমকে উঠল।
“ কাকে শোনাবার জন্যে কাঁদছিস? কোন পেয়ারের লোক আসবে?”
“ ওভাবে বলছিস কেন মণির মা?” আমার ছেলেটা ঠেলাতে করে ক’বস্তা তুষ টানে জানিস? ওকে আর্মি নিয়ে গিয়ে...” জোনের মা আবার কাঁদছে। সঙ্গে সঙ্গে সামান্য সময় বন্ধ হয়ে পড়া কান্নার রোল আবার উঠল।
“তোদের কি ছেলে , স্বামী ফিরিয়ে চাই? না ওদের আর্মির হাতে ছেড়ে দিবি?”
“ পাক্কা খবর । সবাইকে অল্প পরেই চালান দেবে।” রীণার দাদা কথাটা বলেই মাটিতে বসে পড়ল। ভেতরে আসা ছেলেটার মুখে এই কথা শুনেই ফোঁপানো কান্না আবার হাউ হাউ-তে পরিণত হলো।
কান্নার শব্দে বাইরে টহলদার কয়েকটা আর্মি ভেতরে এলো।
“কিউ হাল্লা –চিল্লা করতা হে?”
“কার্ফিউ লাগা হুয়া হে, মালুম নেহি?”
“চুপ নেহি রেহনে ছে...” একটা তেড়ে আসছিল।
“ কী করবি কুত্তার দল?...” কথাটা মুখের ভেতরে গিলে থেমে গেল ফেলানি। ওরা চলে গেল।
“ দাদা, তুই যা গিয়ে।” পেছনে গিয়ে লুকোনো দাদাকে বলল রীণা।
“তুই ?”
“ও থাকুক আমার সঙ্গে।” রীণাকে নিজের পাশে বসিয়ে বলল ফেলানি। “শুনলি ওরা কী বলে গেল? শুনলি না , না?”
“কী করবে ওরা আমাদের?” মীরার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
“ কী আর করবে? কিচ্ছু করতে পারবে না।” ফেলানির কথাতে যেন সবাই সাহস ফিরে পেলো।
“কী করবি মণির মা? মানুষগুলোকে মরতে দিবি কি?”
“ কী করবি? ওদের চালান দেবে। তখন কী হবে?”
“কী হবে আর? মেরে ফেলবে?” নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে উত্তরটা দিল ফেলানি।
“ কী বলছিস রে , মণির মা?”
“ তোর মুখে কিসে ভর করেছে?”
“তুই মা হয়ে এই কথাটা বলছিস?”
“পোকা পড়ুক তোর মুখে।”
“তোর বুকে কি মায়া মমতা নেই?”
সবাই ফেলানিকে চটে গিয়ে ঘিরে ধরেছে। আবার ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
“ কেঁদে কেঁদে প্যারের লোকগুলোকে ডাকতে থাকবি? না কিছু একটা করবার কথা ভাববি?”
“কী করবে?” রীণার কথা বড় কষ্টে বেরিয়ে এলো।
“ কী আর করবি?”
“আমাদের হাতে বন্দুক আছে, না টাকা আছে?”
“কোথায় যাবো আমরা?”
“ আর্মির কাছেই বা যাই কী করে?”
“গেলেই বন্দুক দেখাবে।”
“হট যাও, হট যাও—বলে তেড়ে আসবে।”
ফোঁপানো কান্নার শব্দ বাড়ছে।
“মরতে তোদের প্রচুর ভয়, তাই না?” একটু হাসল ফেলানি। কেউ কিছু বলল না।
“আমাদের আবার মরা কী, বাঁচাই কী?” জোনের মা প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।
“ঠিক বলেছিস জোনের মা। আমরা জ্যান্ত মরা হয়েই আছি।” মিনতি গলা ভার করে বলল।
“জোনের মা মরতে মরতে ফিরে এসেছে। তুইও মরার থেকে বেঁচেছিস।”
“ঠিকই বলছিস, আমাদের আর মরা-বাঁচা কী?” হাতের যে জায়গাটা ফুলে গেছে সেখানে হাত বুলিয়ে বলল মীরার মা।
“আমাদের কত মরল। জগু মরল, ওর বৌ মরল।” ওদের মনে করিয়ে দিতে চাইল ফেলানি।
“জোনের বাবা, সুমলা, বুলেন।”
“হরি ভাঙুয়ার পোলা।”
“রত্নার মা।”
“কালী বুড়ি।”
“ড্রাইভার।”
“রত্নার বাবা।”
“ড্রাইভারের ছেলেটা।”
“হ্যাঁ, অনেক মানুষ মরল।” কথাটা এমন করে বলল ফুল যেন লোকগুলো মরার কথা সে জানেই না।
“আমাকেও মরা বলেই ধরো।” রত্না মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
“মা মরল, বাবা মরল।” হুঁ হুঁ করে কাঁদছে সে।
“তার মানে মরতে তোদের ভয় নেই?”
“তোর, মণির মা?” মীরার মা তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“আমার আর কী?” ছেলেটাই আমার সব। আমার বাঁচা-মরা কি আর আলাদা কিছু?”
ফেলানি সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
“তোরা যাবি আমার সঙ্গে?”
“কই?”
“এখনো ওদের চালান দেয় নি। সেখানেই আছে। যাবি?”
“কী করব?”
“কোথায় যাবো?”
“কী করে যাবো?”
“কোথায় যাব আবার কী? আর্মি ক্যাম্পে!” গায়ের কাপড় ঠিক করে নিলো ফেলানি।
সবাই উঠে দাঁড়ালো।
“দেখিস নি তোরা কতবার মেয়েরা গিয়ে ক্যাম্প ঘিরে ধরেছিল?”
“সেবারে জংলি পার্টিটার পাঁচটা ছেলে বের করে নিয়ে যায় নি?”
“একবার ক্যাম্পে বুলেনের পার্টির মেয়েরা তিনদিন তিনরাত গিয়ে ছিল না?”
নিঃশব্দে দাঁড়ালো এরা আর আর্মি ক্যাম্পের দিকে পা বাড়ালো। নিঃশব্দে বস্তিটা পার হলো, পাকা রাস্তাতে পা দিল। কেটে খালি করে ফেলা রিজার্ভ পার হয়ে গেল। তারপর আর্মি ক্যাম্পের সামনে এরা বসে গেল। যেখানে বসেছিল তার থেকে সামান্য দূরে ছিল শিশু গাছ একটার কাটা গুড়ি। সেখানেই পড়ে রয়েছিল সুমলা পাগলি। একটা পুরো গাছ ছিল সেখানে। এখন পড়ে আছে কিছু শুকনো গুড়ি।
ওদেরকে দেখে দুই একটা বন্দুকধারী বেরিয়ে এলো। ওরা বসেই আছে। কেন বসে আছে জিজ্ঞেস করল বন্দুকধারীরা। এখান থেকে চলে যেতে বলল। ফেলানি দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গের বাকিরাও দাঁড়ালো।
“আমাদের লোকজনকে নিয়ে যেতে এসেছি।” ক্যাম্পের ভেতর থেকে আরো কয়েকজন বন্দুকধারী বেরিয়ে এলো। ওরা বন্দুকের পেছন ভাগ দিয়ে ফেলানিকে ঠেলা দিল। এরাও ওদের চলে যেতে বলল।
“আমার মানুহকিটা লাগে।”
“হামার আদমি...”
“ আমাদের লোক আমাদের চাই।”
“হামার মরদ...”
“হামারা বেটা।”
একটাও মহিলা ফিরে যাবে না। ওদের মানুষজন না নিয়ে যাবে না।
দিন গেল। রাত হলো। একজনও উঠেনি। ক্যাম্প থেকে এনে দেয়া রুটি কেউ ছুঁয়েও দেখল না। শুধু জল একটু একটু খেলো।
পরদিন পুলিশ এলো। বোঝালো, গালি দিল। একজনকেও নাড়াতে পারল না। মনে হয় কার্ফিউ খুলেছিল, পুরো দিন পুরো রাত বসে থাকা মহিলাদের কথা শহর জুড়ে জানাজানি হয়ে গেছে। বহু লোক এসে আশেপাশে ভিড় বাড়াতে শুরু করল। জিপগাড়িতে করে অফিসার এলো। এই মহিলারা যেমন ছিল তেমনি বসে রইল। কিছু জিজ্ঞেস করলে ওদের একটাই কথা,
“মানুষগুলো, আমাদের মানুষ...।”
আরেকটা দিন গেল, সঙ্গে আরেকটা রাত।
ভোরের দিকে রত্না ঢলে পড়ল। দেখতে আসা লোকজনই ডাক্তার ডেকে আনল। সবাই নেতিয়ে পড়েছে। মাটিতে বালিতে পড়ে থাকা মহিলাদের খবর নিতে কাগজের লোক এলো। ছবি তুলল। সব প্রশ্নের উত্তর একটাই।
“আমাদের লোক, আমাদের লোক ফিরিয়ে চাই।”
দু’টো দিন শেষ হলো, তিন নম্বর রাত আসবার হয়েছে। চোখে ততক্ষণে ধোঁয়াশা দেখছে এই ক’জন মেয়ে মানুষ, তাদের চোখে সন্ধ্যার অন্ধকার আরো ঘন হয়ে নেমে এলো। একজনও ভালো করে মাথা তুলতে পারছিল না। “আমাদের আর বাঁচা-মরা কী?” কে যেন বিড়বিড়িয়ে কথাগুলো বলল। সবার খিদে-কাতর শরীরে লেগে রইল একটাই কথা, “আমাদের বাঁচা-মরা...আমাদের বাঁচা-মরা...।”
ভালো করে অন্ধকার নেমে আসবার ঠিক আগেই ফেলানি শুনল একটা ডাক, “মা।”
সঙ্গে সঙ্গে সবাই শুনতে পেল কিছু চেনা চেনা ডাক।
“মা।”
“মিনতি।”
“ফুল।”
“ও মা।”
“মীরা।”
সবাই উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। ভুল দেখে নি এরা। ওদের আপনারজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কারো মুখে কথা নেই।
একসঙ্গে সবাই বস্তির দিকে পা বাড়ালো। উজাড় করা অরণ্য পেরুলো। পাকা রাস্তা পার করল। তারপর প্রায় নিঃশব্দ পড়ে থাকা বস্তি। বস্তি আর রিজার্ভের কিছু মানুষ রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই মিলে এগিয়ে গেল।
আকাশে চাঁদ উঠেছিল। সেই চাঁদের কোমল আলোতে ফেলানি দেখল মণি রীণার দিকে তাকিয়ে হাসছে। রীণা মাথা নত করেছে লজ্জায়। ফেলানির মুখেও একটা স্নিগ্ধ মিষ্টি হাসি।
পরদিন পুলিশ এলো। বোঝালো, গালি দিল। একজনকেও নাড়াতে পারল না। মনে হয় কার্ফিউ খুলেছিল, পুরো দিন পুরো রাত বসে থাকা মহিলাদের কথা শহর জুড়ে জানাজানি হয়ে গেছে। বহু লোক এসে আশেপাশে ভিড় বাড়াতে শুরু করল। জিপগাড়িতে করে অফিসার এলো। এই মহিলারা যেমন ছিল তেমনি বসে রইল। কিছু জিজ্ঞেস করলে ওদের একটাই কথা,
“মানুষগুলো, আমাদের মানুষ...।”
আরেকটা দিন গেল, সঙ্গে আরেকটা রাত।
ভোরের দিকে রত্না ঢলে পড়ল। দেখতে আসা লোকজনই ডাক্তার ডেকে আনল। সবাই নেতিয়ে পড়েছে। মাটিতে বালিতে পড়ে থাকা মহিলাদের খবর নিতে কাগজের লোক এলো। ছবি তুলল। সব প্রশ্নের উত্তর একটাই।
“আমাদের লোক, আমাদের লোক ফিরিয়ে চাই।”
দু’টো দিন শেষ হলো, তিন নম্বর রাত আসবার হয়েছে। চোখে ততক্ষণে ধোঁয়াশা দেখছে এই ক’জন মেয়ে মানুষ, তাদের চোখে সন্ধ্যার অন্ধকার আরো ঘন হয়ে নেমে এলো। একজনও ভালো করে মাথা তুলতে পারছিল না। “আমাদের আর বাঁচা-মরা কী?” কে যেন বিড়বিড়িয়ে কথাগুলো বলল। সবার খিদে-কাতর শরীরে লেগে রইল একটাই কথা, “আমাদের বাঁচা-মরা...আমাদের বাঁচা-মরা...।”
ভালো করে অন্ধকার নেমে আসবার ঠিক আগেই ফেলানি শুনল একটা ডাক, “মা।”
সঙ্গে সঙ্গে সবাই শুনতে পেল কিছু চেনা চেনা ডাক।
“মা।”
“মিনতি।”
“ফুল।”
“ও মা।”
“মীরা।”
সবাই উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। ভুল দেখে নি এরা। ওদের আপনারজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কারো মুখে কথা নেই।
একসঙ্গে সবাই বস্তির দিকে পা বাড়ালো। উজাড় করা অরণ্য পেরুলো। পাকা রাস্তা পার করল। তারপর প্রায় নিঃশব্দ পড়ে থাকা বস্তি। বস্তি আর রিজার্ভের কিছু মানুষ রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই মিলে এগিয়ে গেল।
আকাশে চাঁদ উঠেছিল। সেই চাঁদের কোমল আলোতে ফেলানি দেখল মণি রীণার দিকে তাকিয়ে হাসছে। রীণা মাথা নত করেছে লজ্জায়। ফেলানির মুখেও একটা স্নিগ্ধ মিষ্টি হাসি।
No comments:
Post a Comment