আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Saturday 10 May 2014

অধ্যায় তেইশ (২৩)


ফেলানি 
( জুন, ২০১৬ সংখ্যা মাসিক সাময়িক ব্যতিক্রমে বেরুলো এই অধ্যায়)
               
ণি স্নান করে এসেছে। সে আজকাল খুব সকাল সকাল স্কুলে যায়। দশম মানে উঠেছে থেকেই সকালে স্কুলে কোচিং ক্লাস করে। আগামীবার মেট্রিক দেবে। কী করে যে সময়গুলো পেরিয়ে গেল। মণি স্কুল পেরিয়ে কলেজে পড়বে। হবে, তার মণি বড় মানুষ হবে। স্নানে যাবার আগেই বেগুন দুটো গাছ থেকে ছিঁড়ে চুলোর কাছে রেখে গেছিল। গাছটা ঘরের ভিটেতে এনে লাগিয়েছিল সেই। কোত্থেকে যে গুটি বিচি এনেছিল সেই জানে। সে মাটিতে গুঁজে দিলেই গাছ হয়, ফল ধরে। সাদা সাদা বেগুনগুলো ভাতে দিয়ে তেলনুনে ভর্তা করে খেতে সে ভীষণ ভালোবাসে। একদিন মণিরও একটা ঘর হবে। চারদিকে গুঁজে দিলেই ফল হয় যে হাতে সেই হাতের লাগানো গাছপালার ছায়া আর সে –মণির মা। সে গাছের তলাতে বসে নাদুসনুদুস ছেলে কোলে রূপকথার গল্প বলে যাবে। পাখির গল্প, বেড়ালের গল্প, রাজা-রানির গল্প। ভাতে দেবার জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে বেগুনগুলো ধুতে যাবে ডাঁটার চোখা কাঁটাতে বুড়ো আঙুল বিঁধে গেল। কাঁটাও যে সে নয়, একেবারে বরই গাছের কাঁটার মতো। ওর আঙুল থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ে মেখেলার চাদরে লাল দাগ ফেলে দিল। মুখে চোষে সে রক্ত বন্ধ করল। মণি আসতে আসতে তার ভাতও হলো, বেগুন ভর্তাও হয়ে গেল।
     মণি যাবার পর ও মুড়ি ভাজতে বসল। কাল বাজার বার। মোড়ার কাজ করতে করতেই সময় চলে গেল। আজকের দিনটা বসতে পারলেই হয়ে যাবে। মণি রান্না করা ভাত দু’মুঠো খেয়ে গেছে। সে এলে আবার দু’মুঠো বসিয়ে দেবে। মাগুরি ধানের মুড়িগুলো ফুলে ফুলে উঠছে।
     “বৌদি, ও বৌদি!” বুলেনের ডাক। কি যে অসময়ে এসেছে মানুষটা। মুড়িগুলো ফেলে এখন যায় কী করে?
    “ আয় ভাই, এখানে আয়। সে যে পিড়িতে বসেছিল সেটি বুলেনকে এগিয়ে দিয়ে চাদরের আঁচলে মুখখানা মুছে নিলো। খবরের কাগজে প্যাঁচিয়ে কিছু একটা এনেছে বুলেন। সে এলে খালি হাতে আসে না, মণির জন্যে কিছু না কিছু আনবেই। কথাবার্তা বলে, চা পান খেয়ে যাবার বেলা চুপটি করে তোড়াটা রেখে যায়, “এগুলো মণির জন্যে এনেছিলাম গো।” কলাপাতাতে মোড়ে লাই একমুঠো, লাউ এক টুকরো, কলা চারটা, ছোট মাছ কটা।
     কিন্তু আজ সে এসেই কাগজের তোড়াটা খুলল। একটা সবুজ দখনা, পাড়ের কাছে ছোট ছোট হলদে লতা আঁকা। বুলেনের গলার স্বরে ফণিমনসার হুল, “ বেঁচে থাকবার ইচ্ছে আছে যদি এটা পরবি।”
     “কী এটা?”
    “ দেখিস না?” সে কাপড়টা মেলে ধরল।
    “এগুলো রঙিন কাপড়। তুই কেন ভুলে গেলি ভাই? মণির বাবা...।”
    “বডোদের মধ্যে এসব নিয়ম নেই।”
    “ এসব কাপড় আমি কোনোদিন পরিনি...।”
    “ না পরলে নেই, আমি ভালোর জন্যে বলছি, এই বলে রাখলাম।”
    “তোর হয়েছে কী, বল দেখি?” ওর স্বরটা কান্নার মতো শোনাচ্ছিল।
    “কী হয়েছে আমার ঘরে দেখগে গিয়ে।”
    “সুমলার কিছু হয়েছে। বেশি ঘোর উঠেছে কি?”
    বুলেন হনহন করে বেরিয়ে গেল। কী করে না করে ভাবতে বাহতে সেও মুড়ির চুলো সামলে সুমলে বুলেনের পিছু নিলো। কীই বা হলো মেয়েটির! ঘোরের বশে ছেলেটাকেই কিছু করে বসেনি তো? বুলেন ফিরে তাকিয়ে তাকে দেখে দাঁড়ালো।
     “বৌদি তুইই বল, আমাদের এমন অত্যাচার করলে আমরা আলাদা রাজ্য দাবি না করে কী করব? আমি ভাঙুয়ার ছেলের পার্টিতে নাম লিখিয়েছি।”
     “এই পার্টি কী করবে?”
    “আমাদের জন্যে রাজ্য আনবে।”
    “ এই রাজ্যে তোরা একা থাকবি না অন্যদেরও থাকতে দিবি?”
    “কাউকে তাড়াবো না, মিলে মিশে থাকতে হবে। আমাদের রাজ্যে আমাদের কথা শুনে থাকতে হবে।”
    “ একদল তো নিজে একা খাবে বলে রাজা হলো, তোরাই বা একা খাবি বলে কী করিস!” মণির মা হাসল।
    “বৌদি এগুলো হাসি ঠাট্টার কথা নয়। অনেক সয়েছি, আর নয়।” বুলেনের রাগত মুখখানা দেখে সে চুপ করে গেল।

        
বুলেনের বাড়ির উঠোনে বসে আছে সুমলা। ওর গায়ে রশি দিয়ে বেঁধে পরানো লাল দখনা ও শরীর থেকে টেনেটুনে খসিয়ে বসে আছে। সুমলাতো ঠিকই আছে। তবে আবার কার কী হলো? ছেলেটাও স্কুলে গেছে। সে প্রশ্নবোধক চিহ্নটা চোখে নিয়ে বুলেনের দিকে তাকালো। বুলেন ফণিমনসার নিচে বসে মাটিতে কিলোচ্ছে। অদ্ভুত এক রাগে মানুষটাকে কালো দেখাচ্ছে। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবার আর সাহস হলো না মালতীর। সে বারান্দাতে বসবে বলে ভেতরে যাচ্ছিল কি একটা গোঙানোর শব্দ কানে এলো। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে তের চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে গায়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে শুয়ে আছে। পাশে বুকে মেখলা পরে মাঝ বয়েসী এক মহিলা মেয়েটির মাথাতে বাতাস করছেন।
     “কী হয়েছে ওর?” মহিলা কিছু বললেন না।
     “কোনও অসুখ করেছে? মেলেরিয়া?”
    বুলেন ভেতরে এলো, রাগে মানুষটা কাঁপছে। ওর রাগটুকু যেন একটুকরো বিধ্বংসী আগুন। চোখের পলকে এই চাল থেকে শুকিয়ে ঠনঠনে অন্য চালে ঝাপিয়ে পড়ছে যেন। মহিলাটির মুখও রাগে লাল হয়ে পড়েছে, “ দেখ, তোদের সরকারে আমার এই কচি মেয়েটাকে কেমন কাক-শকুনের মতো খেয়েছে।” মহিলা মেয়েটির অচেতনপ্রায় শরীর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিলেন। মালতী চেঁচিয়ে উঠল প্রায়। বুকের মাংস খুবলে তুলেছে। পুরো শরীরে দাঁতের দাগ। যৌনাঙ্গে একটা কাপড় গুঁজে দেয়া রয়েছে।
     “পুলিশ, আমাদের সরকারের পুলিশ? আমাদের সরকার...” মালতী মহিলাটিকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সরকারের সঙ্গে ওর সম্পর্ক কী? ওর সরকার বলে কেন বলছে মহিলাটি? মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বুলেনও এলো। সে বেড়ার থেকে একটা দা বের করে মাটিতে কোপাচ্ছে।
     “দেখলি বৌদি, আমার এই পৃথিবীতে আপন বলতে ছিলেন এই পিসিই। ভাতিজি বলেছিল এখানে থেকেই কলেজে পড়বে, ওর পড়ার বড়ো ইচ্ছে ছিল।”
    “পুলিশ কেন?”
    “ গাঁয়ের আরো অন্য অনেকের সঙ্গে সেও মিছিলে গেছিল।”
    “কিসের মিছিল?”
    “আন্দোলনের সময় যে রকম তোদের লোকেরা গেছিল। পুলিশ আমাদের মেয়েদের ছিঁড়ে কুরে খেল। বল বৌদি,তুইই বল এই সরকারের শাসন না থাকত যদি কোন কুকুরের এতো সাহস হতো?” এতো জোরে দা’টা মাটিতে কোপালো যে মাটিতেই বসে গেল সেটি।
     “মিছিল করতে হলো কেন?”
    “নিজের রাজ্যের জন্যে। এই কুকুরদের সঙ্গে আমরা আর থাকব না। দেখবি, তুই চেয়ে থাকবি আমরা নিজেদের রাজ্য আদায় করেই ছাড়ব। একজনকে আধমরা করলি, আরো কত আছে আমাদের দেখতে থাক। হরি ভাঙুয়ার ছেলে পাহাড়ে গেছে, সে বোমা বানানো শিখে আসবে। ওরা ঘুরে এলেই দেখবি, সব ছারখার হবে।”
     “ওহ!” খুব ছোট্ট করে শব্দটা উচ্চারণ করল সে।
    “বৌদি দেখ, তোর গায়ে বডো রক্ত আছে বলেই এগুলো বলছি। তোকে আবারো বলি, নিজের পোশাক পরবি। কিছু হবে না। নাহলে দেখবি আগুনে ছাই হয়ে যাবি।”
    সুমলা ইতিমধ্যে টেনে টেনে দখনাটা খুলে ফেলেছে। ওদের দিকে সে এগিয়ে আসছে।
    “ভাই, তুই শরণীয়া , সুমলা কোচ, তোরা এই আলাদা রাজ্য দাবির পার্টিতে কেন ঢুকলি?”
     “আমার ভাতিজিটা কী ছিল? ও আমাদের রক্তের নয়? সে কী করেছিল? বন্ধুদের সঙ্গে কী হচ্ছে দেখতে গেছিল। আর আমি সুমলাকে বিয়ে করেছি, ওর পেটে আমার ছেলে দিয়েছি।”
     সুমলা দখনাটা লম্বা করে মেলে মাটিতে ছ্যাঁচড়াচ্ছিল , একটা গিঁটে এক টুকরো লেগে ছিল মাত্র। ও এখন ভাত খাবে। ভাত না দিলে খানিক পরেই মানুষটির ঘোর চড়বে।
     “ আমি যাচ্ছি হে, মুড়ির বালি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আজ মুড়িগুলো না ভাজতে পারলে পেটে গামছা। ” সে একটু হেসে বলল, “বুঝলি ভাই, আমি তোদের সব কথা বুঝি না। কিন্তু একটা কথা বুঝেছি , পেটের ভাতমুঠো জোগাড় করা বড় কঠিন কাজ। যে কাজই করিস করবি, কিন্তু আমাদের ভাতমুঠো জোগাড় করবার রাস্তাটা বন্ধ করবি না।”
     যাবার জন্যে গেট অব্দি যেতেই সে দেখে কলাপাতা মোড়া তোড়া একটা ওর হাতে দিচ্ছে বুলেন, “ সৌলফা একমুঠো আছে, মণিকে রেঁধে দিবি।” সৌলফাগুলো মুঠোতে ধরে সে বুলেনের দিকে তাকালো, “ভাই, ঘর একটা উচ্ছন্নে যেতে একরাতও লাগে না, পাততে...।” কেন জানি ওর চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে এলো। সে দ্রুত পথ ধরল।
     বস্তির মানুষগুলো দেখি দৌড়াদৌড়ি করে বিশেষ একটা গলির দিকে এগুচ্ছে। কীই বা হলো? লোকগুলো যে চেঁচামেচি করছে , তাও নয়। মুখ গুমড়া করে আছে। ভয় না পেলে হোক না হোক একটা কিছু নিয়ে কাজিয়া ঝগড়া করবে, হাসি তামাসা করবে, এভাবে থাকে না মানুষগুলো। কীই বা হলো, কোথায় বা কী হলো?


  ঐ যে লাতুর মা। একই চেহারা , জল তেল নাপড়া চুল, অপরিপাটি কাপড়, নোংরা হাত পা। আজ লাতুর মাও চুপচাপ হাঁটছে। সে হাজিরা কাজ করে। কাজ মানে কাপড় ধোয়া, উঠোন লেপা, বাসন মাজা। ওর নোংরা চেহারা দেখে কেউ ওকে কাজে লাগায় না। আবার মানুষটাই নোংরা, ওর ধোয়া কাপড়, মাজা বাসন দেখলে আবার ডাকেও কাজে। উৎসবে অনুষ্ঠানেও ওকে ডাকবার লোক রয়েছে। দাদা বৌদির সংসারের এক কোনে পড়ে থাকে। স্বামী ছিল। বিয়ের পাঁচ মাসের মাথাতে ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। দাদার সঙ্গে এক সঙ্গে কাঠমিস্ত্রির কাজ করত। বোধহয় বিহারি লোক ছিল। লাতুর মা নিজে রেঁধে বেড়ে খায়। ওর একটাই কথা, ওর ভাই বৌ ওর এই অবস্থা করেছে। ওর স্বামী ভালো মানুষ ছিল। বারে বারে সে বলতেই থাকে, তার কিনে দেয়া শাড়ির কথা, দুটো বালার কথা, সে দেখানো সিনেমার কথা, তার দেয়া খাটি সোনার আঙটিটা, সে যে জমিটা কিনবে বলেছিল তার কথা, যে ঘর তুলবে বলেছিল তার কথা। একমাত্র বৌদিটাই কান মন্ত্র দিয়ে দিয়ে ওর মন ভেঙ্গে ফেলেছিল। ওর ছেলে মামা-মামীদের ওখানে থাকে, সেখানেও খায় দায়। মামীর ছেলেমেয়ে নেই। মামার সঙ্গে যোগালির কাজ করে। পুরো দিন রান্দা মেরে , কাঠ কেটে এসে সে মায়ের বক-বকুনির থেকে মামীর হাসতে হাসতে এগিয়ে দেয়া জল এক গ্লাস খেতে ঢের বেশি ভালোবাসে। মায়ের চালা ঘরে কম তেলে, জল ছিটিয়ে ভাজা আলুভাজা, রেশন চালের ভাতের থেকে মামীর হাতের মাছের ঝোলের ভাত খেতে সে বেশি ভালোবাসে। মামার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে গৃহস্থ যদি এভাবে কর, ওভাবে কর বলে বোঝাতে শুরু করে মুখের উপর ফোঁস করে বলে দেয়, “এতো মাথা খেয়ে কাজ করতে পারব না কিন্তু।” নইলে এমনিতে সে বেশি কথা বলেই না। মামা যদি দিন দুইর জন্যে ঠিকাদারের সঙ্গে দূরে কোথাও কাজ করতে যায়, মামী তবে, “আমার ভয় করে, আমার সঙ্গে শুবি আয়। ” বলে নিয়ে চলে যায়। মায়ের চালা ঘর থেকে মামীর সঙ্গে ফেনের নিচে ঘুমোতে ও বেশি ভালোবাসে। ভালো লাগার অনুভূতি, ভরপেট ভাত এবং গোটা দিনের পরিশ্রম। লাতু নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়ে। কখনো বা মামী দাঁত খটমট করে বলে উঠে, “এই পাগলিটার জন্যে একটু শোবারও উপায় নেই!” সে জেগে ওঠে। ওদিকে চালাঘরে মা বকতে থাকে, “রাক্ষসী, সব খেলো সে আমার। আমার ছেলেকে যাদু করেছে, আমার স্বামীটাকেও তাড়িয়েছে।” লাতুর মা কখনো বা কেঁদে ফেলে, “আমাকে এই রাক্ষসী শেষ করেছে।” মামী লাতুর গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, “শুয়ে থাক। পাগলী মানুষ। সকালে আবার কাজে যেতে হবে।” ভালো লাগার অনুভূতির মধ্যে মাঝে মাঝে এই এক মেয়ে মানুষের কান্না। লাতুর ভালো লাগে না, রাগ উঠে। ‘এতো মাথা খেতে পারব না’ , বলে যে নাক ডাকতে শুরু করে।

     আজ সেই লাতুর মাও বকা বকি করছে না, মাথা নিচু করে হাঁটছে। কিসে বা ওর মুখখানা বন্ধ করেছে? আশ্চর্য হলো , ওর পাশে পাশে মামীও। সাপে নেউলে একসঙ্গে! ঐ যে লাতু আর ওর মামা, সঙ্গে ওদের মিতির পার্টিও। জগুও এসেছে। নবীনও। রত্নার বাবা, এমন কি ড্রাইভারও পা চালিয়ে বিশেষ একটা গলির দিকেই এগুচ্ছে। কিছু একটা হলে ছেলে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ড্রাইভার ড্রাইভারণীর কাজিয়া, জগুকে মিনতির মারা চড়টা, হরি ভাঙুয়ার জমি বিক্রি করে পাওয়া টাকাতে লালপানি* দিয়ে শুয়োরের মাংস খাবার আসরে বাপে ছেলেতে হুড়োহুড়ি—এসব ঘটনাই এই মানুষগুলোকে জড়ো করবার পক্ষে যথেষ্ট। কালীবুড়ির জটা উঠে ঘোর লাগা, হাঁপানির শ্বাস টেনে টেনে নীল কাঠের মতো স্বামীকে তেল মালিশ করে জোনের মায়ের হায় হায় করে কান্না , নবীনের একটা ছোট টিভি নিয়ে আসা—এরকম ঘটনা ঘটলে-তো কথাই নেই। কলবল করতে করতে মানুষগুলো ঠিক জায়গাতে এসে জড়ো হবেই। তৎক্ষণাৎ কারণটা জানাজানি হয়ে যায়।
     “কালীবুড়ির ঘোর লেগেছে, আজ জটা হাঁটু অব্দি এসে পৌঁছেছে।”
     “নবীন টিভি এনেছে। আনবেই, বই বিক্রি করে কম টাকা কি পায়?”
    “ করুণার বাবা মারা গেল। বৌটা কী করে? এতো জোয়ান বৌ।”
    “ লাতুর মা ভাইবউকে ঘা দুয়েক মেরেছে। না না, ভাই বৌটাই ননদীকে চেরা কাঠ দিয়ে মেরেছে... পাগলি মানুষ... না হে পাগলি... লাতুর মাই মেরেছে।”
     কারণগুলোর নিজের নিজের ব্যাখ্যাও আরম্ভ হয়ে যায়।
     আজ উল্টো হচ্ছে। লোকগুলো কেমন যেন গুমড়ো হয়ে গেছে। কেউ মুখ খুলতে চাইছে না। কিসের এতো ভয় পেয়েছে লোকগুলো? বুড়ো দর্জি আর ফুলের বাড়ির কাছাকাছি এসে লোকগুলো দাঁড়িয়ে পড়ছে। সেখানে জোনের মা আর মিনতি আগে থেকেই রয়েছে। মিনতির কাছে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? মিনতি মানুষের ফাঁকে ফাঁকে ওকে নিয়ে এগিয়ে গেল।
    বুড়ো দর্জি আর ফুল ওদের ওদের উঠোনের সামনে রাস্তাতে কানে ধরে, হাঁটু মোড়ে বসে আছে। উঠোনে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে ফুলের মদ বানাবার জিনিসপত্র। বুড়ো দর্জি যেন আরো বাঁকা হয়ে গেছে। মাথাটা মাটি ছোঁয় ছোঁয়। চোখা রোদে মানুষটা একটা ছিঁড়ে ফেলা আমরুতের ডগার মতো নেতিয়ে আছে। এমনিতেই বেমারি মানুষ। ফুলের চোখে জল আর ক্রোধ। সে কানে ধরে ধরেই স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে। বুড়ো দর্জির মাথাটা ঘুরছে যেন, চার দিকে ধোঁয়া ধোঁয়া দেখছে। লোকে থ হয়ে দেখছে। কেউ কিছু বলছে না। হঠাৎ মণির মা এগিয়ে গেল। সে ফুলের মাথাতে হাত দিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ জোড়াতে জল। এবারে ফুল থাকতে পারল না। হাঁটু মোড়েই মণির মায়ের পা দুটো ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল, “মণির মা, আমি কেন মদ বানাই বল? সে কেন মেশিনে বসতে অক্ষম হয়ে গেল বল। বল , মণির মা এই অসুস্থ মানুষটার কী দোষ? যা করেছি, আমি করেছি। আমাকে শাস্তি দে, এই বেমারি মানুষটাকে কেন? কত যত্ন করে মানুষটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি।”
 
 বুড়ো দর্জি বাঁকা হাড়গুলো যতটা পারে তুলে ট্যাঁরা চোখে ফুলের দিকে তাকালো। চাউনিটা ট্যাঁরা মনে হয় বটে, আসলে বাঁকা ঘাড়ে ওর তাকাতে অসুবিধে হয়। চোখ জোড়া মরা মাছের মতো ম্লান হয়ে গেছে। ফুল ওর পা ছেড়ে দেয় নি, “ তুই বোঝার মানুষ, পারলে আমার মানুষটাকে বাঁচা। দেখছিস না ওর মুখখানা। ও মরলে আমি কার সঙ্গে থাকবরে মণির মা!”
     “চুপ থাক, মদ বানাবি আবার এখন কান্না জুড়েছিস!” মটর সাইকেলে করে আসা দুটো ছেলে ফুলকে ধমকে দিল। সবাই দেখল ছেলে দুটোর কোমরে অস্ত্র চিকমিক করছে।
     “শুন, কেউ যদি মদ বেচিস বা বানাস, বা জুয়ার আড্ডা বসাবি তো কী হবে জানিসই।”
    একটা ছেলে কোমর থেকে পিস্তল বের করে ব্ল্যাংক ফায়ার করল, মানুষগুলো হুড়মুড় করে সরে গেল। কোনও শব্দ নেই। মাটি ধ্বসে পড়ে যেমন তেমনি ঢেলাগুলো ধ্বসে পড়ল। দাঁড়িয়ে রইল শুধু ফেলানি-মণির মা। ফুল ওর পা দুটো ছাড়েনি। ছেলে দুটো মোটরসাইকেল থেকে নেমে ওদের দিকে আসছিল। সে আস্তে আস্তে বলল, “ মানুষটা অসুস্থ, তাঁকে ছায়াতে যেতে দেবেন?”
     “মদ বানাবার বেলা তো সে অসুস্থ ছিল না।”
    “ মদ আমি বানাই, আমাকে শাস্তি দিন। অসুস্থ মানুষটাকে নয়।”
    “চুপ কর , তুই!”
    ফুল চুপ করে গেল। মালতীর স্নিগ্ধ মুখে এক ধরণের কঠোরতা জায়গা করে নিলো, “ অসুস্থ মানুষটা যদি ছায়াতে গিয়ে হাঁটু গাড়ে কিছু হবে বুঝি!”
    “ উঠ ! ছায়াতে যা। ঐ বেটি, তুইও যা!”
    “ না, আমি যাব না! বেমারি মানুষটাকে যেতে দে!”
    বুড়ো দর্জি উঠতে পারে নি। মালতী গিয়ে দর্জির বাঁকা শরীরটা ধরে ধরে ছায়াতে বসিয়ে দিল গিয়ে। সে পিস্তল কোমরে ছেলেদের দিকে না তাকিয়েই ফুলের ঘরে ঢুকে এক গ্লাস জল এনে বুড়োকে খেতে দিল। চাদরের আঁচল ভিজিয়ে সে দর্জির মুখ মুছিয়ে দিল।
     ছেলেগুলো যাবার জন্যে বেরিয়েছে। মটর সাইকেলের শব্দ হচ্ছে। আবার বন্ধ হচ্ছে। ছেলেগুলো এবারে ওর দিকে আসছে। ওর মনে হলো শুকনো কলাপাতায় ভরা গর্ত একটাতে ও ঢুকে যাচ্ছে, এখনই আগুন দেবে, গায়ে এসে লাগবে দাউ দাউ আগুনের এক টুকরো। সে যেন মণিকে কাছে টেনে নিয়েছে। “মণি।” অস্ফুটভাবে সত্যিই সে মণির নামটা উচ্চারণ করল।
     “আপনি আমাদের মানুষ হয়ে এই বেজাতগুলোর হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন কেন?” ছেলেগুলোর কথাতে সম্ভ্রম থাকলেও স্বরটি বেশ কঠিন।
     “ দেখবেন কিন্তু, এই বেজাতদের সবাইকে এখান থেকে উঠতে হবে, আর কথায় আছে না নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না!” এই ছেলেটার স্বর আগেরটার থেকেও কঠোর।
     “লোকগুলো যাবে কোথায়?” মালতীর স্বর কান্নার মতো শোনালো। মটর সাইকেলের শব্দে ওর ক্ষীণ স্বরও মিলিয়ে গেল। ছেলেগুলোর দিকে সে তাকিয়ে রইল। ওরা কী করতে চাইছে? ওদের স্বাধীন দেশে কে থাকবে? আর বুলেনদের নিজের রাজ্যে? কী কী ভাগ করবে এরা? মাথার উপরের আকাশটা? নদীর জল? এই গাছগুলো? মাটি? না মানুষকে? ও আর কালীবুড়ি? সুমলা আর মিনতি? জোনের মা আর জগুর বৌ? কালীবুড়ি আর ফুল? কী করে ভাগ করবে? কেটে টুকরো টুকরো করে? নদীতে বাঁধ দিয়ে? জমিতে গড়খাই দিয়ে? গাছগুলো মাটিতে গড়িয়ে দিয়ে? এ রাজ্য থেকে ঐ রাজ্যে ওরা কি উড়ে যেতে দেবে ঘরমুখো পাখির দল? মায়ের সঙ্গে মাছের পোনাগুলোকে কি উজিয়ে আসতে দেবে? ভেসে যেতে দেবে ফুলের সুবাস? এক গাছের ফুলের রেণু আর গাছে নিয়ে যেতে দেবে কি ভোমরাকে?
   
       
  সে ঘরে ফিরে এলো। বেলা মাথার উপরে এসে গেছে। সমস্ত কাজগুলো পড়ে আছে। মুড়িগুলো ভাজতে হবে, কাপড় ধুতে হবে, ভাত রাঁধতে হবে। কোনটা রেখে কোনটা করে ? আকাশের কোনে কালো মেঘ জমেছে। বৃষ্টির কথা বলা যাবে না। এখনো আসতে পারে, রাতেও আসতে পারে। কাপড় ক’খানা না শুকোলে দিগদারি আছে। সেই সকালে বেগুন ছিঁড়তে গিয়ে চাদরে দাগ লাগিয়ে দিল। রক্তের দাগ তাড়াতাড়ি না ধুলে যাবে না, শুকনো তো দূরেই থাক। বাজারে পরে যাবার এই একখানাই আছে। নদীতে যাবার সময় নেই। আর নদীতে চাড়ি ভরে কাপড় নেবার ওর আছেই বা ক’টা?
     সে চাদরটা আর ছোটখাটো কাপড় কতকগুলো নিয়ে কালীবুড়ির কলের পাড়ে গেল। পাথর ফেলে কলের পাড়টা বেশ ভালো করে তুলেছে মণি। মণির কথা ভাবলেই তার গর্ব হয়। পাথরে সে চাদরের দাগ লাগা আঁচলটা মেলে ধরল। বেশ বড় করে লেগেছে দাগটা। সেখানে কাপড় ধোবার সাবান খানিক ঘসে ও বসে রইল। এ ওর রক্তের দাগ। কার কার রক্ত মিশে আছে এই দাগে?
     ওর দিদিমা মৌজাদারের মেয়ে রত্নমালার?
    ওর দাদু হাতির মাহুত কিনারাম বডোর?
    মায়ের রক্তে কার রক্ত বেশি ছিল? রত্নমালা না কিনারামের? না বাবা ক্ষিতীশ ঘোষের রক্তই একটু বেশি আছে ওর রক্তে?
    আর সেই মানুষটা? ওর কোলে বাচ্চা দিল যে! তার রক্ত কি সিঁদুর হয়ে ওর কপালে ভাস্বর হয়ে ছিল না?
    দিদিমা রত্নমালার কামরাঙাহারটা।
    দাদু কিনারামের মায়ের বওয়া দখনাটা।
    মায়ের সোনার কাজ করা শাখা ক’গাছা।
    ছেলে হলে মণির বাবার কিনে দেয়া সেই বড় ফুলের ছাপ থাকা মুগার কাপড় জোড়া।
     কী পরবে ও? কী নেবে ও? বেঁচে থাকবার ইচ্ছে হলে শাখাগুলো খুলে রাখতে বলেছিল বৈশ্য। বুলেন বলল, বেঁচে থাকবার ইচ্ছে থাকলে দখনা পরতে। বন্দুকধারী ছেলেগুলো বলল বেজাতের লোকগুলোর সঙ্গে থাকলে বেঁচে থাকতে হবে না। কী করে বেঁচে থাকবে সে?

   মেঘ অনেক উপরে উঠে এসেছে। বৃষ্টি রাত অব্দি অপেক্ষা নাও করতে পারে। অল্প পরেই যদি চলে আসে তবে আর মুড়িগুলোও ভাজা হবে না। চালটাতে বেশ ভালো করে একটা ফুটো হয়েছে। অল্প বৃষ্টি দিলেই হুড়হুড় করে জল পড়ে। আজ মুড়িগুলো ভাজা না হলে কাল আবার বাজার আছে। সে হাত চালিয়ে চাদরে সাবান মাখিয়ে কচলে দিল। রক্তের দাগ উঠে গেল। কাঁচা রক্তের দাগ, বেশিক্ষণ হয় নি , তাই সহজে দাগটা উঠে গেল।
     সে কাপড়ক’টা মেলে মুড়ির খোলাতে গিয়ে বসল।
    বেঁচে থাকবার জন্যে ওকে এখন এই ছেঁড়া শাড়িতেই শরীর ঢেকে আগে মুড়িগুলো ভাজতে হবে। পারলে মোড়াদুটোর কাজও শেষ করতে হবে। মণি আসবে অল্প পরেই, ভাতদুটোও বসাতে হবে। ওর রান্নাঘর থেকে মুড়ি ভাজার গন্ধটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

No comments: