ফেলানি
(ফেব্রুয়ারি , '১৫ সংখ্যা ব্যতিক্রমে প্রকাশিত হয়েছে এই অধ্যায়।)
শিবিরে মুখ্যমন্ত্রী আসবেন। পায়খানা, পেচ্ছাব পরিষ্কার করা হচ্ছে। এখানে ওখানে চুন দেয়া হচ্ছে। ফেনাইল ছেটানো হচ্ছে। ভাতের সঙ্গে এসেছে মাছ! চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার , ঔষধ। মোটের উপর শিবিরে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। মণি মাথা আঁচড়ে কাপড় চোপড় পরে এদিক ওদিক দৌড়ো দৌড়ি করছে। মানুষে এখানে ওখানে জটলা পাকিয়ে এ কথাই বলাবলি করছে। মুখ্যমন্ত্রী হাত খুলে দেবে। প্রত্যেক পরিবারকে এক বান্ডিল করে টিন আর পাঁচ হাজার করে টাকা দেবে। আজই দেবে । মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে হাতে হাতে দেবে। সত্যি সত্যি ট্রাকে করে চিকচিকে সাদা টিন এসে গেল। লোকগুলো যে যার ঘরে ফিরে যাবার কথা ভাবছিল।টিনই যখন এলো পাঁচ হাজার টাকা কি আর না এসে থাকবে? শিবিরগুলোর থেকে অল্প দূরে খোলা মাঠে লোকগুলো জড়ো হয়েছে। অল্প পরে হেলিকপ্টার আসবে। প্লাস্টিকের কাপড়ের ঘরগুলোর সবক’টাই খালি হয়ে গেল।
শিবিরে মুখ্যমন্ত্রী আসবেন। পায়খানা, পেচ্ছাব পরিষ্কার করা হচ্ছে। এখানে ওখানে চুন দেয়া হচ্ছে। ফেনাইল ছেটানো হচ্ছে। ভাতের সঙ্গে এসেছে মাছ! চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার , ঔষধ। মোটের উপর শিবিরে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। মণি মাথা আঁচড়ে কাপড় চোপড় পরে এদিক ওদিক দৌড়ো দৌড়ি করছে। মানুষে এখানে ওখানে জটলা পাকিয়ে এ কথাই বলাবলি করছে। মুখ্যমন্ত্রী হাত খুলে দেবে। প্রত্যেক পরিবারকে এক বান্ডিল করে টিন আর পাঁচ হাজার করে টাকা দেবে। আজই দেবে । মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে হাতে হাতে দেবে। সত্যি সত্যি ট্রাকে করে চিকচিকে সাদা টিন এসে গেল। লোকগুলো যে যার ঘরে ফিরে যাবার কথা ভাবছিল।টিনই যখন এলো পাঁচ হাজার টাকা কি আর না এসে থাকবে? শিবিরগুলোর থেকে অল্প দূরে খোলা মাঠে লোকগুলো জড়ো হয়েছে। অল্প পরে হেলিকপ্টার আসবে। প্লাস্টিকের কাপড়ের ঘরগুলোর সবক’টাই খালি হয়ে গেল।
ফেলানি হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। শরীরটা অস্বস্তি করছে। থেকে থেকেই একটা ব্যথা চাগিয়ে উঠছে। সে পেটে হাত দিয়ে দেখল, বেশ ক’দিন ধরে একই আছে। সাড়া শব্দ নেই। বাঁশের একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে সে বসে রইল। খানিক বসে থাকার পর কোঁকাতে শুরু করল। ওর চারদিকে আবারো এক কুয়াশা রঙের কাপড়। অনেক দূর থেকে সে শুনতে পেল, “ মালতী , তুই এমনটি করবি না তো...।” একটা রোগা হাত ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিল। কান জুড়ে পেখম তোলা ময়ূর । শাখা ক’গাছাতে লেগে আছে নারকেল তেলের গন্ধ।একটা মানুষের অদ্ভুত গোঙানো শোনা যাচ্ছে। কাছে চলে আসছে দবার শব্দ ...। কেউ যেন ফেলানিকে তুলে ধরেছে।
যখন সে চোখ খুলল, ওর নাকে লাগল তীব্র ঔষধের গন্ধ। শিবিরের অস্থায়ী চিকিৎসালয়ে ওর এক মরা মেয়ে হলো। সে উঠে বসল। শরীরটা হালকা হালকা লাগছে। একটি মেয়ে ওকে জিজ্ঞেস করল, “ মরা বাচ্চাটা দেখবেন কি ? জমাদার নিয়ে যাবে যে।” সে বড় আস্তে আস্তে বলল, “ছেলে না মেয়ে ছিল?”
“মেয়ে। বেবিটা বেশ মেচিওরই হয়েছিল।”
“একবার দেখব ওকে।” নার্স একটা গামলাতে করে বাচ্চা একটা নিয়ে এলো। পুরোটা শরীর ভেজা,এক মাথা কালো চুল। এই টুকুন হাত পা নিয়ে এইটুকুন ছোট্ট একটি মেয়ে। গায়ে কিছু নেই। গায়ের রঙটা নীল হয়ে গেছে। অবশ হাত পায়ের ছাল চামড়াগুলো কুঁচকে গেছে। সে হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে একবার ছুঁয়ে দেখল, ঠাণ্ডা। ঠিক যেন একটা পাথরের মতো। একটা লোক এসে মেয়েটি শুদ্ধ গামলাটাকে বাইরে নিয়ে গেল। সে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে রইল। ওর চোখদুটো শুকনো। লাল। বালি পড়লে যেমন করে তেমনি খচমচ করছিল।
তিনদিন থেকে অস্থায়ী হাসপাতাল থেকে ও বেরিয়ে এলো। এসে মাথা ভিজিয়ে স্নান করল । অনেক দিন সে অমন করে স্নান করে নি। স্নান করে ওর নিজেকে বেশ হাল্কা বোধ হলো। চুল আঁচড়ে সিঁথিতে দেবার জন্যে একটু সিঁদুর আনবে বলে মামণির মায়ের কাছে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর কানে বেজে উঠল রঘু ভোঁদাইর ‘র’ বাদ পড়া শব্দগুলো...। “ মলি বাবা পুকুলেল থেকে নামঘল...মাথা নেই, চোখ নেই, মলি বাবাকে...” ওর শরীরের ভেতরেই যেন ওই ভোদা মানুষটার অদ্ভুত গোঙানো পাক দিয়ে উঠছে। মাথার থেকে পা অব্দি গোঙানিটা নেমে যায় , আবারো পায়ের থেকে উঠে আসে। সে সিঁথি ঢেকে চুলগুলো পেছনে খোপা করে বেঁধে ফেলল । ঘন কালো চুলের ভেতরে খালি সিঁথিটা ঢেকে গেল। কাপড় ধোঁয়া সাবানের জল চোখে ঢুকেছে বলেই বোধ হয় ওর চোখ জোড়া জ্বলছিল। চাদরের পাড়ে মুখের থেকে নিয়ে অল্প গরম ভাপ লাগিয়ে তবে যেন সে অল্প আরাম পেল।
বাইরে হুলস্থূল লেগে গেছে। এ রকম হুলস্থূল লেগেই থাকে। কালও লেগেছিল ঐ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে নিঃস্ব বুড়ি দিদিমা আর ওর নাতনি রুণুকে নিয়ে। রুণু সতেরো বছরের উঠতি মেয়ে। সে বিকেলে লম্বা চুল খুলে সামনে নিয়ে শিবিরের গেটে দাঁড়িয়ে থাকে । ওর বয়সই এমন। এই মুহূর্তে কাঁদলে পর মুহূর্তে আবার হাসতে পারে। সে শিবিরের পচা চালের ভাত খেয়েও ফুলের মতো ফুটতে পারে। কারো থেকে একটু মিঠা তেল চেয়ে নিয়ে কৌটা একটার ঢাকনিতে প্রদীপ বানাতে পারে। তাতে আবার ছেঁড়া ন্যাকড়ার সলতে জ্বালিয়ে কাজল বানাতে পারে। সেই কাজলে নিজের চোখও সাজাতে পারে। এই রুণুকে নিয়েই হুল্লোড়টা বেঁড়ে চলেছে। গতকাল ও শিবিরে দিদিমাকে নিয়ে শুয়েছিল। প্লাস্টিকের ফাটা বেড়া দিয়ে মাঝ রাতে দুটো ছেলে ঢুকে পড়ে ওকে বাইরে তুলে নিয়ে গেছিল। ছেলে দুটো কারা ও চিনতে পারে নি। চীৎকার চেঁচামেচিতে ওকে ওরা ফেলে রেখে চলে যায়। আজো তারই জের চলছে।
ক্রমেই শিবিরে সার্বজনীন রান্নাঘরগুলো উঠে গেল। সে জায়গাতে এখন এক থপথপে উন্মুক্ত পায়খানা। রোদ দিলে উপরে এক কালো প্রলেপ পড়ে। বৃষ্টি দিলে কাদার মতো আবার বিষ্ঠাগুলো বেরিয়ে পড়ে। চারদিকে সেই বিষ্ঠার গন্ধ ছড়িয়ে থাকে । সেখানে সাদা সাদা একধরণের পোকা হয়েছে। একটু বৃষ্টি দিলেই দলে দলে পোকাগুলো ছড়িয়ে পড়ে কিলবিল করতে থাকে। ঝুপড়িগুলোর প্লাস্টিকগুলো ফুটো হয়ে গেছে। রোদ বৃষ্টি কোনোটা থেকেই বাঁচাতে পারে না। শিবিরের অর্ধেক মানুষ চলে গেছে। যারা আছে ওদের অসুখে ধরেছে। একবার যদি রক্ত পায়খানা হয় তো অন্যবারে বমি পায়খানা তো পরের বারে জ্বর।
মামণির বাবারা পুরোনো ভিটেতে গিয়ে উঠেছে। একেবারে শুয়ালকুচির পিতৃ-ভিটা। দাদু-দিদা মারা যাবার পর সাহা পরিবার বাংলাতে চলে গেছে। সুভাষ মাষ্টারের পরিবার গেছে কোচ বিহারে। মাস্টারণীর বাপের বাড়ি ওখানে। সে শুনতে পেয়েছে , এমন কি গাঁওবুড়াও সেই গ্রাম ছেড়ে গেছে, শহরে বাড়ি ঘর করেছে। শিবানীদের পরিবার শিলিগুড়িতে, ওখানে নতুন করে ব্যবসা ধরেছে। পুরো গ্রামটিতে যে ক’জন থেকে গেছে ওদের আঙুলে গোনা যায়। এখন ওই আধপোড়া গ্রামটিতে শুধু ‘র’ বলতে পারে না যে লোকটা সেই গোঙাতে গোঙাতে ঘুরে বেড়ায়। সে সব খবর পাচ্ছে, বাতাসে খবর ঘুরে বেড়ায়। ভাবছিল সে যায় কই। ওর বরের যে বাড়িটি কোনোদিন দেখেনি ওখানে সে কী দাবিতে যায়? বেজাতের মেয়ে, তায় বিধবা। ওকে রাখবে কে? মামণির মা বাবা শুয়ালকুচিতে যাবার কথা বলছে। মানুষটার নিজেরই মাথার উপর কিছু নেই। তবু যে বলছে ! সেকি যাবে একবার মণির হাতে ধরে মৌজাদারের বাড়িতে? পড়ে থাকবার জন্যে একটা কোণআর থাকবার জন্যে উচ্ছিষ্টের ভাগটুকুও কি সে পাবে না? কী বলে পরিচয় দেবে?
ক্যাম্পের চাল মুঠো সেদ্ধ করে মণিকে খেতে দিয়ে বাকি সময় সে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকে। শব্দ একটা শুনবে বলে খানিক ক্ষণ এমনি বসে থেকে রোজ সে ঘুমে ঢুলতে থাকে। তার পরেই শুরু হয় চোখের সামনে সেই ছবিগুলোর যাওয়া আসা। হাতির পিঠে উঠে যাচ্ছে এক ভর যৌবনের তরুণী।তারা গাছের ডোবাতে পড়ে থাকা একটি তরুণ। সারা গায়ে দখনা পরে সারাক্ষণ হাসে একটি মেয়ে। আর একটি পুরুষ যে জানে না ভয় কাকে বলে । বিছানাতে পড়ে কোঁকাচ্ছে ওর বৌ আর সে যায় ওকে একা রেখে ধাইয়ের খোঁজে।যতই ওর চোখ দুটো বুজে আসে ততই স্পষ্ট সেই ছবিগুলো সে দেখতে শুরু করে। কুশিয়ার খেতের হাল্কা আঁধারে পায়ে লেগে ছিটকে পড়া শিশুর এক ফালি কোমল দেহ । দুটো অদ্ভুত সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর কেউটে। রক্তমাখা দুটো মুরগীর বাচ্চা। গামলা একটাতে একটি অবশ নীল মেয়ে সন্তান । প্রায়ই সে মহিলাটির থেকে গামলাটি কেড়ে নেয় । দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে শক্ত বাহুর পুরুষ একজনের গায়ে । স্পষ্ট শুনতে পায় সে শুকনো গলার স্বর , “ এমনটি করবি না তো মালতী, এমনটি করবি না তুই!” গামলার থেকে মেয়েটি উঠে আসে , বাতাসে কেঁপে উঠে এক মাথা কালো চুল। প্রায়ই এমন হয়, মণি ওর মাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে উঠিয়ে দেয়—“ মা! ও মা! তুমি হাসছ কেন?” “ ও মা অমন করে কাঁদছ কেন?” “ ও মা! চেঁচাচ্ছ কেন?” সে কিছু বলতে পারে না। মণি টের পায়, মাকে সবাই আধ পাগলী বলে বলতে শুরু করেছে। সে আজকাল খেলাধুলো করে বেড়ায় না, মায়ের কাছে কাছে থাকে।
সেদিন মণির ভীষণ খিদে পেয়েছিল। ঠেলা ধাক্কার মধ্যে মা চাল তুলে আনতে পারে নি। সে কিছু লাকড়ি আর পায় যদি, তবে কিছু বন্য কচুর খোঁজে গেছিল। কখনো কখনোবা কাজের খোঁজেও বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে। সে দোকান দাকানে গিয়ে কাজের কথা বললেই , ‘ভাগ ব্যাটা বাচ্চা , কোথাকার ! কী কাজ করবিরে তুই!’ বলে লোকে তাড়িয়ে আসে। তবুও সে একদিন এক হোটেলে গ্লাস বাটি ধুয়ে এক বেলার ভাত আরেক দিন এক দোকানে পচা পেঁয়াজ বেছে পাঁচ টাকা রোজগার করেছিল। খিদেতে থাকতে না পেরে শিবিরের একেবারে শেষের দিকে থাকে যে মেয়েগুলো, ওদের ওখানে গিয়েছিল। ওদিকে ওকে যেতে মানা করা হয়েছিল। একদিন কৌতূহলের বশে ওদিকে যাবার দায়ে সে আর রন্টু মামণিদি’র বাবার হাতে মার খেয়েছিল। মণি জানে এই মেয়েদের কাজ করে দিয়ে বিজয়, কুলু, যোগেনরা পয়সা রোজগার করছে। ওদের গায়ের জামা ছেঁড়া নয়, ওরা খালি পেটেও থাকে না। মণি এক পা দু’পা করে ওখানে চলে গেছিল। তখন সন্ধ্যে হয় হয়ে। সে দাঁড়িয়ে ছিল। একটি লোক নীল প্লাস্টিকের চাল আর চাটাইতে তৈরি বেড়ার একটি ঘরের থেকে বেরিয়ে এসে ওর হাতে তিনটা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে সোজা সামনে আঙুলে কিছু দেখিয়ে দিল। মণি কিছুই না বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে রইল । বিজয় এসে ওর কাছে দাঁড়ালো, “ কী হলো বে ? বাবুর মাল এনে দে জলদি!”
“মাল ? কী মাল?” মণি একটু অবাকই হলো। ইতিমধ্যে কুলু আর যোগেনও এখানে এসে গেছে।
“ বুদ্ধু।“ কুলু ওকে গালি দেবার মতো করে বলল।
“ নতুন লাইনে এসেছে, আস্তে আস্তে শিখে যাবে।” বিজয় বড় মানুষের মতো গাম্ভীর্য নিয়ে কথাটা বলল।
“ যা মণি ভায়া! ঐ দোকানের থেকে এক পেকেট পেপেসি এনে লতাদি’র ঘরে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিবি।”
“ খবরদার বাচ্চা ছেলে! বেড়া দিয়ে ভেতরে তাকাবি না। বাবুদের মৌজ করবার সময় এটা।“ যোগেন স্বর আরো বেশি বড় মানুষের মতো ।
“ পেপসি?” মণির কথাতে বিজয়ের রাগ উঠে গেল।
“ তুই লতাদি’র হাতে মার খাবি, বুঝলি?” বিজয় মণির হাতে ধরে শিবিরের মাঠটা পার করে রাস্তাতে নিয়ে গেল। রাস্তার কাছে একটা পান সুপারির দোকান।
“ দেখ, ঔ দিকে দেখ।” বিজয় মণিকে দোকানের পেছনের দিকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিল। বিজয়ের নির্দেশ মেনে পান সুপারির দোকানের পেছনে তাকিয়ে দেখল একটি গর্ত ভরে ফেলেও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে সাদা কালো নীল সবুজ এক গাদা প্লাস্টিকের বেগ ।
“ এগুলো পেপসির পেকেট , বুঝলি?”
বিজয় মণিকে দুটো তরল পদার্থে ভরা পলিথিনের পেকেট কিনে দিল। সে যেমনটি শিখিয়ে দিয়েছিল মণি সেই রকমই প্লাস্টিকের নীল কাপড়ে তৈরি দরজার নিচে ছিঁড়ে যাওয়া টুকরোর ফাঁক দিয়ে পেকেটগুলো রেখে এলো। ওর হাতে রইল পুরো একটি দশ টাকার নোট। বিজয় তাকে ছোট ছোট চালাগুলো একটা একটা করে চিনিয়ে দিল। এক নম্বর লতাদি, দুই নম্বর মেনকা, তিন রুমি, চার রানি, পাঁচ জবা, ছয় সীতা, সাত গীতা। বিজয় ওর শিক্ষার প্রমাণ নেবার জন্যে জিজ্ঞেস করল, “ তুই এখন কাকে পেপসির প্যাকেট দিয়ে এলি, বল দেখি?”
মণি ঘরগুলো গুনে গেল, এক দুই তিন...। পাঁচ নম্বর চালাটির দরজার তলাটা ছেঁড়া। তার পরেই হেসে ফেলে বলল,
“লতাদি।”
“ ঠিক। এ লাইনে তুই আমাদের থেকেও ওস্তাদ হবি।”
মণি আর বিজয় দেখতে পেল ছোট চুলের একটা মোটা লম্বা লোক এসে দাঁড়িয়েছে । বিজয় মণির কানে ফুসফুসিয়ে বলল, “এ ফৌজের লোক। এ লাইনের সবচে’ ভালো কাস্টমার।” লোকটিকে সে তিন নম্বর চালাটিতে নিয়ে গেল। ঢোকার আগে লোকটি ওকে টাকা দশটা দিল। আরেকটি কালো মোটা পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোক এসে দাঁড়ালো । বিজয় মণিকে ঠেলে দিল, “ যা মণি, এক নম্বরে নিয়ে যা।” মণি মুখে কিছু না বলে লোকটিকে ডাক দিল। এক নম্বরের লতাদি বেরিয়ে এসে মণিকে আদর করে টাকা দুটো ধরিয়ে দিল। লোকটিও টাকা পাঁচটা দিল। সতেরো টাকা হাতে নিয়ে মণির মনে পড়ল চাল বেছে সে পেয়েছিল মাত্র পাঁচ টাকা। মণি দেখল যতই রাত বাড়ছিল বিজয়দের কাজ আর দৌড়া দৌড়িও বেড়ে যাচ্ছিল। সেও ওদের সঙ্গে দৌড় ঝাঁপ শুরু করে দিল। শীঘ্রই ওর সতেরো টাকা বেড়ে বাইশ টাকা হলো।
“চাল।“ মণির সোজা উত্তর।
“ ক্যাম্পে চাল দেয়া প্রায় বন্ধই হলো। চাল যখন দিচ্ছিল এ লাইনে তখন কোনও বিজনেসই ছিল না।। চাল যতই কমিয়ে দিয়েছে, এ লাইনে ততই বিজনেস বেড়ে গেছে।”
“ তোদের কি রোজই এমন রোজগার হয়?”
“ নসিব থাকলে হয় বে।”
“ তুই কি স্কুলে গেছিলি?” বিজয় , যোগেনদের দেখে মণির নিজের স্কুলটাকে মনে পড়েছে।
“ গেছিলাম। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত উঠেছি। তারপরেই তো গোলমালটা হলো”
“ তোর বাবা আছে?”
“ আছে। বরং আমার মাই নেই। গোলমালে মা আর দিদি মারা গেল। বাবার পায়ে গুলি লেগেছিল। এখানকার ডাক্তার গুলিটা বের করে দিয়েছে। কিন্তু পা-টা পচতে শুরু করেছে। কিছুই করতে পারে না। বোন একটি আছে।” বিজয় অল্প আগে পেপসি কিনে আনতে গিয়ে দুটো মর্টন কিনে এনেছিল। তারই একটা মণিকে দিল।
“ গোলমালে তোর কে মারা গেল?”
“ বাবাকে হারিয়েছি।” মণির চোখে জল এসে পড়েছিল।
“ মা আছে?” বিজয় মণির কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“ সবাই বলছে, মা বুঝি আধা পাগল হয়ে গেছে।”
“ কী করবি? গোলমালের পর সব মানুষেই আধ পাগলা হয়ে গেছে। আমার ছোট্ট বোনেরও তোর মায়ের মতো অবস্থা।
সেও এটা ওটা দেখিয়ে অনবরত কী সব বকতে থাকে। সে মা আর দিদিকে...।” বিজয়ে গলার স্বর বসে গেল।
মণি দেখল মা ওর দিকে আসছে। মা এসে ওর হাতে ধরল , “ চল।” সে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা দিল।
* * *
সেদিন রাতে মণির রোজাগারের টাকাতে ভাত খেতে খেতে সে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। ছেলেটিকে নিয়ে এই নর্দমার থেকে সে বেরিয়ে যাবে। ভাত খেয়ে মুখ ধোবার পরেই বৃষ্টি দিয়েছিল। বৃষ্টিতে ছোট ছোট লেজের সাদা সাদা পোকাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।মামণির বাবার ফেলে যাওয়া ক্যাম্প-খাটটিতে মণি বেঘোরে ঘুমচ্ছিল। কিচ্ছুটি বলতে পারে না। ফেলানি সারা রাত, মণি কোত্থেকে জোগাড় করে নিয়ে এসেছে একটা সাবানের বাক্স , তাতে বসে জেগে কাটিয়ে দিল। ওর মনে হঠাৎই একটা ভয় ঢুকল, এই কিলিবিলিয়ে আছে যে পোকাগুলো ওদের একটাও যদি ওর ছেলের শরীরে ঢুকে পড়ে ! বেয়ে বেয়ে নাকে, কানে, শ্বাস নেবার জন্যে সামান্য মেলানোমুখ দিয়ে যদি পোকাগুলোর একটাও ওর শরীরে ঢুকে যায়! কী হবে তখন? একটা মোম জ্বালিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল পোকাগুলোকে। পলিথিনের একটা থলে হাতে পরে নিয়ে পিষে পিষে মেরেছিল সারাটা রাত। মাছের পেটির মতো পোকাগুলোর শরীর থেকে দলা দলা যে জিনিসগুলো বেরুচ্ছিল তাতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছিল ওর হাতের পলিথিনের থলেটা। একটি বারের জন্যেও চোখের পাতা ফেলেনি। একটিবারের জন্যেও সেই ছবিগুলো ওর চোখের সামনে আসে নি।
4 comments:
Sushanta Da,
Reading after a long time. I'm so happy that you've been able to keep with your resolve of translating the entire story.
Cheers to your determination and patience!
Regards,
Anita
Thank You Anita! It's the determination and patience that make man perfect! It's my journey towards perfection. You are my companion! Try pick up any wrong doing here. Whatever you feel uneasy with just speak out.
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ৭ প্রকাশ হলেও পড়ার সুযোগ পাইনি, আজ ৭ এবং ৮ দুটাই এক সাথে পড়লাম। মন ছুয়ে যাওয়া কাহিনী। মনে হচ্ছে অনুবাদের মধ্যে কোথায় যেন চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি ভেজা মাটির কোমল গন্ধ ভেসে আসছে।
ধন্যাবাদ স্মৃতিকণা! কাহিনির এতো সবে শুরু! দেখুন, এই নর্দমা থেকে বেরিয়ে কোন নরকে গিয়ে পড়ে ফেলানি!
Post a Comment