ফেলানি
সেচোখ খুলে মণির উদ্বেগ ভরা মুখখানা দেখতে পেল। দেখাচ্ছিল বসন্ত রোগীর মতো। পুরো মুখে ঘা।সে তাকে ডাকতে চাইল , ‘মণি’। পারল না। আসলে সে তাকে ওর বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। পারল না। স্বরটা যেন কেমন গলাতে লেগে ধরেছে। এবারে কাত হয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকালো। গাঁয়ের মুখ, চেনা লোক। বাঁচবে বলে পাটের খেতে জায়গা করে যারা বসেছিল, তাদের থেকে সত্যি সত্যি দু’একজন বেঁচে গেছিল। তারাও রয়েছে। সে বসবার চেষ্টা করল। কোথায় আছে সে? চারদিকে হালকা ঝোপঝাড়। ধরতে পারল চা বাগানের কাছে এসে পড়েছে সে। কিন্তু ওকে এতো দূরে কে নিয়ে এলো? তার চোখের সামনে একখানা কালো চাদরকে কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে যেতে দেখেছিল।দেখেছিল জালে বাঁধা পড়া মানুষটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবার দৃশ্য। ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছিল রক্ত। সে জিজ্ঞেস করতে চাইছিল কোথায়, কী ভাবে , কেন ? দুপুরের গা পোড়া রোদ। মণি একখানা কচু পাতাতে করে অল্প জল নিয়ে এলো। সেই জলে সে অল্প তেষ্টা মেটালো, অল্প চোখে মুখে দিয়ে ঝরঝরে হয়ে উঠল। একটা লোক দৌড়ে দৌড়ে সেখানে এসে পৌঁছুলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, কেঁদে কেঁদে, থেমে থেমে, আটকে আটকে যতদূর সে উচ্চারণ করতে পারল তার থেকে মালতী বুঝতে পারল তাদের গাঁয়ে একটাও বাড়ি টিকে নেই, একটা মানুষ বেঁচে নেই।জালে বাঁধা পড়ে পাটখেতের মধ্যে যে লাশটা পড়ে রয়েছিল সেটি নিয়ে যেতে শহর থেকে একদল মানুষ এসেছে। সঙ্গে বন্দুক, নানা রকমের অস্ত্র। লোকগুলো তৈরি হয়ে এসেছে।গ্রামে সেই সকাল দশটা থেকে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেছে। সে আর বেশি কথা বলতে পারল না, হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল।
একজন কেউ বেশ কষ্ট করে জিজ্ঞেস করল, “ পুলিশ মিলিটারি?”
কান্না বন্ধ করে মানুষটা জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। তোতলাতে তোতলাতে বলবার চেষ্টা করল, শহর থেকে বড় নেতা এসেছে। রাগে সব ক’টা জ্বলছে। ছাগলও একটাও বেঁচে নেই।
লোকগুলো উঠে দাঁড়ালো। মালতী জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাব? কেউ একজন মুখে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে মানা করল। যে লোকটা গাঁয়ের খবর এনেছিল সে তার দিকে তাকিয়ে শুধু একটাই শব্দ উচ্চারণ করল , ‘ইস্টেশন’ ।
বাগান হয়ে স্টেশনে যাবার ছোট রাস্তাটা মালতী চেনে। সে মানুষগুলোর পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করল। পেটের বাড়ন্ত অংশটিতে হাত দিল। হঠাৎই ওর খেয়াল হলো পেটেরটি অনেক ক্ষণ নাড়াচাড়া করেনি। মণির মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বুকখানা ধড়ফড় করে উঠল। দুটো প্রাণীকে উপোস রাখতে হচ্ছে । একটা সরকারী টিউব কলের কাছে গিয়ে সবাই দাঁড়ালো। দু’হাতের আঁজলা ভরে জল খেল। এখানেই সরু রাস্তাটা এসে পাথুরে মূল রাস্তাটিতে উঠেছে। এরকম বিকেলে রাস্তাটা লোকজনের ভিড়ে গমগম করতে থাকে, আজ জনশূন্য।দোকান টোকান সব বন্ধ। পাথুরে রাস্তাটার থেকে নেমে গেলে সামান্য ঢালু জায়গা । ওখানে নাগাগাছ১, ঢেঁকী , ফুটুকলার ২গাছে হালকা একখানা জঙ্গলই হয়ে গেছে। জায়গাটিতে শুকনো পায়খানার গন্ধ। নাকে হাত দিল সে। ঢালু জায়গাটা গিয়ে একটা মাঠে পড়েছে । এতোদিন মাঠে সবুজ বিন্নি ধানের গাছ বাতাসে হেলত দুলত। এবারে অন্য আরো বহু মাঠের মতো এই মাঠেও কেবলি খের । মাঠখানা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একখানা গ্রাম শুরু হয়েছে। হালকা জনবসতির গ্রামটিতেএখন একটাও জনমানব নেই, দু’একটা ঘর এখনো জ্বলছে।গ্রামেপা দিয়েই মানুষগুলোর রা করা বন্ধ হয়ে গেল। এখনি বুঝি শুনতে পাবে শঙ্খ আর নাগরার শব্দ। ভেসে আসবে একটা তীক্ষ্ণ হুইসেলের শব্দ। পোড়া ঘরগুলোর ধোঁয়াতে ভারি বাতাস এখনি ভরে উঠবে রক্তের গন্ধে। কানে ধরা সেই আতশবাজির থেকেও জোরালো শব্দগুলো চারদিক থেকে বাতাস চিরে ফালাফালা করে ফেলবে। ওরা একটা বাড়ির উঠোন পেরোচ্ছিল। গোবরে লেপা উঠোনে গৃহস্থ বাড়ির ধান শুকোনো হচ্ছিল । ঘরের বেড়াতে হেলিয়ে রাখা রয়েছে একখানা ভিমকলার আটি ।এদের ধানের ভাঁড়ারটা তখনো জ্বলছে।কেউ টু শব্দটি না করে হাতে যতটা পারেকলা ছিঁড়ে নিয়ে নিলো। মালতীর কিছুই মুখে দিতে ইচ্ছে হলো না। যে মানুষটি ওকে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে কষ্ট দিতে চায় নি তাকে বারেবারেই মনে পড়ছিল। কইবা গেল, কী বা হলো! বাড়িটার উঠোন পেরোতেই বেলা ডুবে এলো। এবারে লোকগুলোর পায়ের জোর বেড়ে গেল। একজন মণিকে কাঁধে তুলে নিলো।মণির হাতটিছেড়ে ওর কেমন খালি খালি লাগছিল। কানা মানুষ একটার হাত থেকে যেন কেউ লাঠিটা নিয়ে গেছে। ওরা এক আখের খেত পার হচ্ছিল। আখের খেতও সেই পাট খেতের মতো মাড়িয়ে গেছে। অল্প আঁধারে একটা শরীর দেখতে পেল সবাই, যার মাথাটা নেই। চারদিকে দলা দলা রক্ত। সে কাছে গেল। গায়ের ছাল কুঁচকে যাওয়া এক বৃদ্ধের শরীর, কোমরে একটা ছেঁড়া ধুতি প্যাঁচানো রয়েছে। “ মা, তাড়াতাড়ি আয়।“ ছেলের ডাক অনুসরণ করে সে দেখল লোকগুলো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। হনহন করে ওদের যাওয়া দেখলে মনে হয় যেন কেউ ওদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। হঠাৎই ওর পায়ে লেগে একটা কিছু ছিটকে পড়ে গেল। আখের খেতের ভেতরটা বাইরের থেকে একটু অন্ধকার যদিও সে স্পষ্ট দেখল ওর পায়ে লেগে একটা বাচ্চার শরীর ছিটকে পড়েছে । একটা সম্পূর্ণ মানব শিশু নয়। উপর থেকে নিচে সমানে কেটে দু’টুকরো করা হয়েছে। নাক মুখ , পেট , পা সব সমানে সমানে কাটা । সে চীৎকার দিয়ে উঠল। লোকগুলো ঘুরে তাকালো।দু’টুকরো শিশুটিকে দেখে সবারই মুখের থেকে কিছু চাপা শব্দ বেরুলো। কোথাও একটা শব্দ হলো। ধস্ত আখের খেতের মধ্যি দিয়ে যেন কিছু একটা দৌড়ে গেল। সবারই চোখে পড়ল দুটো শেয়াল। মণি, মালতী আর সঙ্গের মানুষগুলোও দেখল দুটো শেয়ালে শিশুটির এক টুকরোকে টেনে খেতের যে দিকটা ধসে যায়নি সেখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।মালতী দৌড়তে শুরু করল। মণি আর সঙ্গের লোকগুলোও ওর পিছু নিলো।
সে যখন আখের খেত থেকে বেরুলো তখন বাতাসে কলাপাতার মতো কাঁপছিল। ওর চারপাশের সবকিছু যেন চাকার মতো ঘুরছিল। মণির গায়ে কাঁধে হাত রেখে সে যখন এসে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছুলো তখন ওর গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। মানুষের ভিড়ে প্ল্যাটফর্ম ভরে গেছে। বিচিত্র বাক্স বোচকা তল্পিতল্পার জন্যে কোথাও পা ফেলবার জো নেই। ওকে কেউ একজন একটু জায়গা বের করে দিল। প্ল্যাটফর্মের ঠাণ্ডা পাকা মেঝেতে সে অচেতন মানুষের মতো পড়ে রইল। ঠাণ্ডা মেঝের মতোই ওর শরীর আর মগজখানাও ঠাণ্ডা আর অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছিল।
মাঝরাতে প্ল্যাটফর্ম জুড়ে এক হৈ হল্লা শুরু হলো। হাল্লা মানে একেবারে মারণ চীৎকার ! ‘ এসেছেরে! , এসে পড়েছে!’ বলে স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথা অব্দি আকাশ বাতাস কাঁপানো চীৎকারে সে ঠাণ্ডা পৃথিবীটার থেকে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো। এবারে আকাশ কাঁপানো শব্দগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অদ্ভুত ধরণের কিছু শব্দ। কেউবা হাতের কাছে পাওয়া বাঁশের লাঠিতে স্টেশনের লোহার খুটাতে ঘা মারছে, কেউবা টিনের বাক্সে ঘা দিয়ে আওয়াজ করছে। কেউ একজন ফেলে রাখা ড্রাম একটা পেয়ে তাতেই কাছে বসা এক বুড়োর হাতের লাঠি নিয়ে ঘা বসাচ্ছে। নানারকম শব্দ বাক্যে গলাগুলো একেবারে ছিঁড়ে ফেলে সবাই মিলে আর্ত চীৎকারে শুধু একটাই কথা বারে বারে বলে যাচ্ছে, “ এসে গেছে ওরা! এবারে আর কেউ বাঁচবে না! সব শেষ হয়ে যাবে!” সারা রাত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ভোরের দিকে মানুষগুলো একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আবারো একবার চীৎকার চেঁচামেচি শুরু হলে সবাই আঁতকে উঠল। একটা মুগা রঙের কেউটে এসে প্ল্যাটফর্মের আবর্জনা ফেলবার বাক্সটাকে প্যাঁচিয়ে বসে আছে। মানুষের হৈ হট্টগোলে সাপটা ফণা তুলে দিয়েছে। ফণাতে মধ্যিখানে সবাই এক অদ্ভুত সুন্দর আর ভয়ঙ্কর চক্র দেখতে পেল। ভয়ার্ত মানুষগুলোর দুর্বল মনে সাপের চক্রটি ক্রমেই অলৌকিক হয়ে পড়ল। মা মনসা, শিব কিম্বা নিজের নিজের দীক্ষাদাতা গুরুর নাম কীর্তন ,জপ আরাধনাতে প্ল্যাটফর্ম দেখতে দেখতে এক মন্দির হয়ে পড়ল। পুজো অর্চনার মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছিল সেই মৃত্যু ভয়ের আর্তনাদ। ‘এটাক হবেই’ । মানুষের মুখে মুখে শব্দগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। শুধু মানুষ ভেদে শব্দটা একটু অন্যরকম হচ্ছে। এটেক, অটেক,আটেক, উটেক...। শব্দটি ভিন্ন রূপ নিতে পারে। কিন্তু অর্থ সেই একই।এক ভয়ঙ্কর আতংক মিশে আছে শব্দটিতে। সমস্ত আশংকা, ভয় গিয়ে জড়ো হলো গিয়ে ঐ চক্রটিতেই।
মালতীর অর্ধ-চেতন মনটিতেও চক্রটি ঢুকে পড়েছে, একবার মণিকে , একবার ওর বাবাকে চক্রটি এসে গ্রাস করে । তারপর আবারো সব হালকা আঁধারে ডুবে যায়।
পরদিন, ঠিক রাত নয় সন্ধ্যার খানিকটা পরেই প্ল্যাটফর্মের লোকেরা পুবদিকে দাউদাউ করে ঘরবাড়ি জ্বলতে দেখতে পেল । আগুন থেকে বেরুচ্ছে একটা শব্দ , এটেক, এইটেক, এটাক, আটেক, উটেক...। মানুষগুলোর মাঝখানে শব্দটি এক আগুনের শিখা হয়ে দাউদাউ করে জ্বলছে। সাপটা আবর্জনার বাক্সটি থেকে অল্প অল্প করে বেরুচ্ছিল।ভয়, খিদে আর তেষ্টাতে উন্মাদ মানুষগুলোর থেকে দু-একজন কাঁদতে শুরু করল। মা মনসা থাকবার জন্যেই ওরা আসতে পারেনি। গেলেই এসে পড়বে। আবারো আরম্ভ হলো জপ আরাধনা। ক্ষুধা, ভয় আর কান্নার মাঝ থেকে উঠে আসা এই প্রার্থনা সঙ্গীতের হুলস্থূলতে সাপটি আবারো একবার ফণা তুলে দাঁড়ালো।গোল গোল করে চক্কর দিতে দিতে ঘুরতে থাকল। সারা রাত এই মানুষগুলো তাদের চারদিকে দেখতে পেল আগুন জ্বলছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল শঙ্খ আর নাগরার শব্দ। এই শব্দগুলো এসে প্ল্যাটফর্মের মানুষগুলোর কাছে পেলেই একটাই মাত্র শব্দে এসে জড়ো হয়। অর্থ সেই একই। মুখ ভেদে তার ধ্বনিগুলো আলাদা আলাদা চেহারা নেয়। সাপটি আবর্জনার বাক্স থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের মাঝে এসে পড়েছে। একটা খুঁটি প্যাঁচিয়ে ধরেছে। লোকগুলো এবারে ভালো করে দেখল সাপটার গায়ে ঘা। পোড়ার দাগ। সাপটি যেন পোড়া কোনও কিছু উপর দিয়ে চলে এসেছে। ওদের লাগানো আগুনে মা মনসাও পুড়েছেন! অভিশাপ লাগবে। ওরা সবংশে মারা পড়বে। লোহার ঘর তৈরি করে ঢুকে থাকলেও বাঁচবে না। চাঁদ সওদাগর কি পেরেছিল লক্ষীন্দরকে রক্ষা করতে? পারে নি, কখনোই পারবে না। মা মনসার শাপে ওরা শেষ হয়ে যাবে। আবারো শুরু হলো সেই নাকি সুরের মা মনসার বন্দনা। সাপটা খুঁটির প্যাঁচটাকে অল্প ঢিলে করেছে। আকাশে ফরসা হয়ে আসছে। এবারে যেন মানুষগুলো শঙ্খ আর নাগরার শব্দ খুব কাছে থেকে শুনতে পেল। চারদিকে খা খা নীরবতা। এই ছোট্ট স্টেশনটিতে এমনিতেও রেল কম আসে।এখন সেগুলোও নেই। স্টেশন মাস্টার, গার্ড সবারই কোয়ার্টার সেই কবে থেকেই খালি।যেন নয়, সত্যি সত্যি ওরা পুবদিকে শঙ্খ আর নাগরার আওয়াজ শুনতে পেল। আবারো আরম্ভ হলো সেই মৃত্যু কাতর চীৎকার চেঁচামেচি । এখানে ওখানে ঘা বসাবার বিচিত্র অদ্ভুত সব শব্দ। সাপটা আবারো একবার ফণা তুলে দাঁড়ালো। ওর গলার দোলন্ত চক্র দুটো ঝিলিক দিয়ে উঠল। এক মহিলা, যার হাতে পায়ে দায়ের কোপের চিহ্ন ফুলে ঘা হয়ে গেছে , সে গিয়ে সাপটার সামনে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। চক্র দুটো অল্প দুলে নিচে নেমে এলো। তার পরেই সাপটি ফোঁস ফোঁস করে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গেল। মহিলাটির ইতিমধ্যে কোনও সাড়াশব্দ নেই । মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে গেছে। ভিড়ের লোকেরা কাছে সরে এলো। এবারে কী করা যায়? একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলো। দাঁত-শূন্য মুখে এক অদ্ভুত শব্দ করে একটা ছুরি বা ব্লেড আর মুরগীর বাচ্চা চাইল। একটা ব্লেড পাওয়া গেল। কেউ একজন বেঁধে সঙ্গে করে আনা দুটো মুরগীর বাচ্চাও বের করে দিল।বৃদ্ধ মেয়েমানুষটির পায়ের হাঁটুর নিচে, হাঁটুর ঠিক উপরটাতে এবং উরুতে তিন জায়গাতে বাঁধল। তারপর যেখানে সাপের দাঁত বসেছিল ওখানে কেটে দিল। খানিকটা কালো রক্ত বেরিয়ে এলো। বৃদ্ধ এবারে মুরগীর বাচ্চার মলদ্বার কাটল। সবাই ঝুঁকে গিয়ে লক্ষ্য করছে বৃদ্ধের হাতটা যতই কাঁপুক না কেন ঠিক সময়ে ঠিক থেমে যায়। বৃদ্ধ এবারে মুরগীর বাচ্চার কাটা মলদ্বার মহিলাটির ক্ষততে লাগিয়ে দিল। খানিক পরেই মুরগীর বাচ্চাটি ধড়ফড় করে মরে গেল। অন্য যেটি ছিল সেটিকেও একই রকম মলদ্বার কেটে ক্ষততে লাগিয়ে দিল। খানিক পরে সেটিও মরে গেল। এবারে বুড়ো একটা শব্দ উচ্চারণ করল, কী করল কেউ বোঝেনি। ওর ছেলে-বৌ বুঝিয়ে দিল আরো যদি ত্রিশ পঁয়ত্রিশটা মুরগীর বাচ্চা পাওয়া যায় তবে গিয়ে মেয়ে মানুষটি বাঁচবে। মুহূর্তে সবার চোখে ভেসে উঠল এক একেকটা ঝাঁট দিয়ে লেপে মুছে রাখা উঠোন। উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছে মায়ের সঙ্গে একদল মুরগীর বাচ্চা।খুবই সাধারণ দৃশ্য । এই প্ল্যাটফর্মে জটলা বেঁধে থাকতে গিয়ে মানুষগুলো হঠাৎই আবিষ্কার করল এইটেই পৃথিবীর সবচে’ বড় স্বপ্ন যেটিকে আর হাতে ধরা যাবে না।মুরগীর বাচ্চা নিয়ে একেকটা উঠোনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতে থাকতেই মুরগীর বাচ্চাগুলোরই মতো সামান্য ধড়ফড় করতে করতে মেয়েমানুষটি নিথর হয়ে গেল।মা মনসা বলি নিয়েছেন বলে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করতেই সবাই শুনতে পেল হুঁইসেলের শব্দ ।মাঝখানে নীল হয়ে পড়ে থাকা একটি মহিলা আর মরা মুরগীর বাচ্চাগুলো নিয়ে মানষগুলো নীরব হয়ে গেল। সব্বাই একে অন্যের আরো কাছে চেপে এলো। বৃদ্ধ তার দু হাত উপরে তুলে দাঁতঝরা মুখে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। ভিড়ের মানুষগুলো বৃদ্ধের আরো কাছে চেপে এলো।কেউ একজন মণির মাকেও কাছে টেনে কাছে নিয়ে এলো। ওর অর্ধ-চেতন শরীরে সাপের বিষে বিষাক্ত কালো রক্তের কয়েক ফোটা লেগে গেল। এইবারে বন্দুকের আওয়াজ স্পষ্ট শোনা গেল। হুঁইসেলের তীক্ষ্ণ শব্দটি আর হৈ ..ঐ... ঐ ধ্বনির শব্দ ক্রমেই মিলিয়ে গেল।খানিক সময় থমথমে নীরবতা। নীরবতা ভেঙ্গে মণির মা কিছু একটা বলে বিড়বিড়িয়ে উঠেছিল, তারপরে আবার শুয়ে পড়ল।পাকা মেঝেতে পড়ে থাকা মণির মা আর নীল হয়ে যাওয়া মহিলাটির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। শুধু একজনের পেটটা ঢিলা হয়ে নিচে নেমে গেছে আর অন্যজনের পেটটা ছোট।
ওরা ঘরঘর করে গাড়ির শব্দ শুনতে পেল। এবারে যেমন পিঁপড়েতে জমাট বাঁধে তেমনি মানুষগুলো জড়ো হয়ে গেল। নিশ্চুপ মানুষগুলো থরথর করে কাঁপতে শুরু করল।অল্প পরেই বুট জুতোর গপ গপ শব্দে প্ল্যাটফর্ম ভরে গেল।
দলবাঁধা লোকগুলোকেআর্মি কর্ডন করে ফেলল। মাঝখানে দুটি মেয়েমানুষ। একজন অচেতন , অন্যজন মৃতা । আর দুটো মুরগীর বাচ্চা, রক্তে মাখামাখি যেন তুলোতে তৈরি তেমনি সাদা । এর চারদিকে বানের জলে ভেসে যাবার জন্যে তৈরি একদল পিঁপড়ের মতো মানুষ। মানুষগুলোকে ঘিরে ফেলেছে বন্দুকধারী মিলিটারি। তাদের গায়ে জলপাই রঙের পোশাক তাতে আবার পাতার ছবি আঁকা।কারো মুখে কোনও কথা নেই।
টীকা:
১)নাগাগছঃ অসমিয়াতে শব্দটি নগাবন। আগাছা জাতীয় গুল্ম। মূল বাংলা না পাওয়া অব্দি একে ‘নাগাগাছ’ বলতে অসুবিধে দেখছি না। এমন কাছাকাছি নাম দুটি ভাষাতে বিরল নয়। যেমন ঢেঁকীয়া। ব্রহ্মপুত্রের বাংলাতে এটি ‘ঢেঁকি’।
২) ফুটুকলাঃ আগাছা জাতীয় গুল্ম।
3 comments:
বেশ এগুচ্ছে, এমনি করেই দেখতে দেখতে একদিন ঘাটে পৌছাবে।
স্মৃতিকোনা, আপনি আজ জীটকে এসে যেমনটি বললেন, দেখুন অনুচ্ছেদগুলো একটূ ছোট করে দিলাম। এ রকম পরামর্শ দিতে থাকবেন। তবে নিশ্চয়ই ঘাটে পৌঁছুব।
আসলে অন স্ক্রীনে একটু ছোট প্যারা পড়তে সুবিধা তাই বলেছিলাম, তাছারা আমার আবার চোখে সমস্যা আছেতো। অথচ কাহিনীটা এতো ভাল লাগছে যে ভাল করে পড়তে না পারলে মনযোগ দেয়া যায় না বা তৃপ্তিও পাওয়া যায় না। আমি এই উপন্যাসের একটা অক্ষরও আড়ালে রাখতে চাই না।
তোমার যৌথ প্রচেষ্টা বলে এটাকে যথা সময়ে, উপযুক্ত সাজে এবং ত্রুটিহীন ভাবে সকলের কাছে উপস্থাপন করা হোক সেটাই আমার শুভ কামনা।
আশা করি এক মত হতে দ্বিধা নেই।
ভালো থেকো, সুস্থ থেকো।
আবার দেখা হবে।
Post a Comment