ফেলানি
সে আঁচ করল, কেউ একজন ওর পিঠে হাত রেখেছে. গা শিউরে উঠল ।ভীষণ হাল্কা একটিহাত, যেন শরীরের উপর অশ্বত্থ বটের পাতা একখানা এসে পড়ল ।সে মুখ তুলে তাকালো ।কালীবুড়ি।
তোর সঙ্গে ছেলে একটি রয়েছে। আমি একেবারে একা ছিলাম ।আমি তোর থেকেও দেখতে সুন্দর ছিলাম ।মা কালী আমাকে বাঁচিয়ে দিলে ।তোকেও উনিই দেখবেন, দেখবি। মাকে প্রণাম কর ।” সে মুখ তুলে তাকালো ।গোটা ঘর জুড়ে জিহ্বা মেলে রাখা একটি কালো মেয়েমানুষের রক্তরাঙা চোখের চাউনি ।এই কালী ঠাকুর কি সত্যি একজন কম বয়সের মেয়েমানুষকে ভাত জোগাতে পারেন, দিতে পারেন দু’বেলা পাল্টাবার মতো দুটো কাপড় ? এই বৃদ্ধা মহিলাটি তো বেঁচে আছেন। খেয়ে পরেই আছেন ।নিজের ঘর একটাও রয়েছে।নিজেও আছে, অন্যকেও রেখেছে ।ওকে আজ মাছে ভাতে একবেলা খাইয়েছে।বুড়ির পিঠে তো কখনো সেগুণ পাতার মতো কোনও ছড়ানো ছিটানো হাতের ছোঁয়াছিল না।তবুও বুড়ি ওর রোগা হাতটিওর পিঠে রাখতে পেরেছে। কেবল কি ঐ কালী ঠাকুরের জন্যেই ? বুড়ির আদেশ মানতে নয়, নিজের থেকেই সে কালীর কালো জিহ্বা মেলা মুখখানার দিকে তাকিয়ে প্রণাম করল ।ওর কিচ্ছু চাইনে, দুবেলা খেতে পারার মতো দুমুঠো ভাত, মণিকে পরতে দিতে পারবার মতো একটা কাপড়।ওর গালের দুই পাশদিয়ে জলের ধারা নেমে এলো।
“
বুড়ির চুলোর তুষ লাল হয়ে এসেছে।সেদ্ধ করে তৈরি করে রাখা মালভোগ ধানের চালের গন্ধে চারদিক মোঁ মোঁ করছে। বুড়ি চালগুলোতে এক বাটি লবণ জল ঢেলে দিল ।ফেলানি বুড়ির বাঁদিকে বসে চুলোর উপরে রাখা মাটির কলসিতে গরম বালিতে অল্প অল্প করে চালগুলো দিতে শুরু করল ।ফটফট করে ভাজা চাল ফুটে সাদা সাদা মালভোগ ধানের মুড়িতে ভরে পড়ল। সে হেসে ফেলল ।বুড়ি ওর দক্ষ হাতে তুষের আগুন থেকে গোবরের ঘুঁটে একবার বের করছে, আরেকবার ঢুকিয়ে দিচ্ছে ।সমান তাপে ভাজা চালের থেকে মুড়িগুলো ঠিকঠাক ফুটে বেরুচ্ছে ।দেখতে দেখতে একটা মাঝারি আকারের বস্তা মুড়িতে ভরে পড়ল ।বুড়ি দুটো বড় বড় কালচে পড়া বিস্কুটের টিনে ঠেসে ঠেসে মুড়িগুলো ভরালো। বস্তাতে থেকে যাওয়া মুড়ির থেকে অল্প ছোট টিন একটিতে ভরিয়ে মালতীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ নে তোর পোলাকে দিবি ।” সে হাত পেতে মুড়ির টিনটা নিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই বুড়ি ডাক দিল, “ ভালো করে ঘুমোবি ।সকালে মুড়ি বেচতে টাউনে যেতে হবে ।আমার বাঁধা গ্রাহক আছে ।” বুড়ি উঠে দাঁড়িয়েছে, “তোরও ভাত-মুঠোর জোগাড় হবে, আমার বুড়ো শরীরও আরাম পাবে।” সে বুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালো ।বুড়ি মুড়ির ঘরের জিনিসগুলো গোছগাছ করছে। কেরোসিনের বাতি আর তুষের আগুনের আগুনের আলোতে বুড়িকে দেখতে এক্কেবারে মেম মরিচটি যেন লাগছিল। রোগা, পাতলা, সাদা। চুলগুলোও সাদা ।শুকনো বুড়ির মধ্যে সে কি ঝাল ! একটা হাসি এসে মালতীর মুখখানাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল যেন ।
মণিকে দু’গ্রাস ভাত খাইয়ে বস্তাটির উপর শুইয়ে দিল । এখন গরমের দিন যেমন তেমন, শীত আসতে আসতে কিছু একটা করতে হবে । সে ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। ঘুমের মধ্যে সে বিড়বিড়িয়ে উঠল, পাখিটা নিশ্চয় ওর বাচ্চাকে নিয়ে খেলছে ।ছেলেকে স্কুলে দিতে হবে ।বুলেনের তৈরি করে দেয়া চুলোর কাছে প্লাস্টিকের প্যাকেটের তলায় সামান্য কয়েকটি চাল পড়ে আছে, গেল রাতে সেই দিয়ে গেছে ।হাতল ভাঙ্গা কড়াই একটা কাল কালীবুড়ি দিয়ে গেছিল ।তাতেই ভাত রেঁধেছিল, তাতেই খেয়েছিল।খালি খালি ঘরটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত সিটকে উঠল ।মণির প্যান্টের পাছার দিকটাতে ফেটে গেছে ।ফেলানি চাদরের আঁচলটা খুলে দেখল , টাকা পাঁচটা রয়েছে ।ক্যাম্পে থাকতে এক বাড়িতে কাজ করে টাকা ত্রিশটা পেয়েছিল, তার থেকেই এই পাঁচ টাকা থেকে গেছে।ক্যাম্প থেকে চলে এসে কি সে ভুল করল ! তাতে অন্তত এক পয়সা না দিয়ে মাথা গুঁজবার ঠাই একটা পেয়েছিল। সপ্তাহে একবার হলেও ধানে,তুষে, পোকে মেশানো চাল একমুঠো পেয়েছিল। এখন সে কী করবে? ক্যাম্পের আশে পাশে কয়েক ঘর মানুষের সঙ্গে চেনা পরিচয় হয়েছিল, দু’একটা কাজ কম্মও পেয়েছিল ।শহর থেকে গাড়ি করে একদল মহিলা ওদের দেখতে এসেছিল ।ওরা একটা শাড়ি দিয়ে গেছিল ।সেটি অবশ্যি , পা মেলে বসতে গিয়ে ওখানে থাকতেই ফেটে গেছিল ।সেটিই সম্বল ছিল ।কিন্তু ক্যাম্পে থাকতেই সেরকম আরেকটা পেয়েছিল। কীর্তন গাইতে গাইতে সাধুর দল একটা এসে সেটি দিয়ে গেছিল ।সাদাতে নীল আঁকি বুকি শাড়িটা সে যত্ন করে তুলে রেখেছে ।শাড়িটার মতো তার বুকখানাও যেন কোথাও ছ্যাঁত করে ফেটে গেছে ।ওর বুকখানাও আজকাল ফাটতে শুরু চাদরের মতো হয়ে গেছে. কোথাও অল্প টান পড়লেই হলো আর কি, এখানে ওখানে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে ছিঁড়তে শুরু করে ।সে মণির দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল ।বুকের ভেতরে ফাটা চাদরখানা নিয়ে সে কালীবুড়ির বারান্দাতে গিয়ে বসল ।চোখ থেকে জল ঝরছিল ।নেই , সেই পুরুষালি হাতের ছোঁয়া নেই, একটা গমগমে গলার সোহাগে নরম শব্দগুলো নেই, “তুই এমন করবিনা তো, আমি মানুষটা....।’ সে ব্যাকুল হয়ে পড়ল । কী করে সে ?কী করে ?
সে আঁচ করল, কেউ একজন ওর পিঠে হাত রেখেছে. গা শিউরে উঠল ।ভীষণ হাল্কা একটিহাত, যেন শরীরের উপর অশ্বত্থ বটের পাতা একখানা এসে পড়ল ।সে মুখ তুলে তাকালো ।কালীবুড়ি।
“মণির মা, কী করছিস?
কোন উত্তর দিল না।কালীবুড়ি ওকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল।
“মাকে প্রণাম কর ।” বুড়ির গলাতে কঠিন আদেশ , “রোজ আমার ঘরে ঢুকবার বেলা প্রণাম করবি।”
সে কালীর মুখোশগুলোর দিকে মুখ করে হাত জোড় করল ।বুড়ি দু’টো কাঁসার থালাতে ভাত বাড়ল । ভাত , আর সঙ্গে লংকা সর্ষে দিয়ে মাছের ঝোল. চুলোর থেকে বুড়ি দু’টো কাঁঠাল বিচি বের করল।সে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে তাকিয়ে রইল। হালকা শিরা বেরিলে পড়া আঙুল ক’টি দিয়ে টিপে বুড়ি ভর্তা বানাচ্ছে। গরম ভাত, মাছের ঝোল আর কাঁঠাল বিচির ভর্তার গন্ধে গোটা ঘর ভরে গেল। ওর মুখখানা বারে বারে ভিজে আসছিল।
“ আয়।” বুড়ি দুটো পিঁড়ি পেতে ওকে ডাকল ।
সে কিছু একটা বলতে চাইছিল ।ভেজা জিভে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে পারল না ।আসলে বলতে চাইছিল,সে ভাত খেয়েছে, ভাতের কোনও দরকার নেই ।
“আয়!” বুড়ির গমগমে ডাকে একটা পুরুষালি ভাব ।ডাকটির মাঝে আদেশের একটা সুর ছিল বলে , না কি, ভেজা জিহ্বার জন্যে—সে পিঁড়িটিতে গিয়ে বসে গেল ।নীরবে চেটে পোঁছে সব ক’টা ভাত খেয়ে ফেলল। খেয়ে কালীবুড়ির মুখের দিকে তাকালো ।বুড়ির মাথার জটাটি নেই ।অথচ বেলা পড়লেই বুড়ির মাথাতে মেটে রঙের ফণাধর সাপের মতো একটা গুচ্ছ জটা বেরিয়ে আসে ।জটা বেরুলে কালীবুড়ির চোখ লাল হয়ে আসে ।পুজো দিতে দিতে কখনো বা বুড়ি উদোম নাচে। কপালের সিঁদুরের ফোঁটাতে লাল হয় কপাল। বস্তির লোকের ভিড়ে ভরে পড়ে কালীবুড়ির উঠোন ।কালীমায়ের সামনে রাখা ধূপ ধুনোর আশে পাশে খুচরো পয়সা পড়ে জমতে থাকে। বাতাসা, ফলমূল, নকুলদানাতে মায়ের কালো রং ঢেকে যায় ।লোকে নিজের নিজের মানত করে, কালীবুড়ি আশীর্বাদ দেয় ।ফেলানি এগুলো দেখেনি, শুনেছে শুধু ।
বুড়ি এঁটো বাসন গুছিয়ে এসে ওর কাছটিতে বসল ।সে বুড়ির সাদা চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। সাদা চুলগুলো কপালের সামনে নেমে এসেছে ।কপালের উপরের কোঁকড়ানো চুলগুলো ভুরু ছুঁই ছুঁই করছে ।এই চুলগুলোতে জটা বাঁধবার কোনও চিহ্ন মাত্র নেই । অবাক হয়ে বুড়ির চুলগুলো দেখছে দেখে বুড়িই বলল, “ মা যখন ভর করেন আমার মাথাতে শুধু তখনই জটা গজায় ।মা আমার শরীর থেকে গেলে সঙ্গে করে তাঁর চিহ্নও নিয়ে যান ।” বুড়ি অল্প ফোঁপাচ্ছে ।এক দুর্বল বৄদ্ধা।ফেলানির ইচ্ছে হলো তাঁকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দেয় ।ঘরের বেড়াতে হেলান দিয়ে রোগা পাতলা মানুষটি যখন বসে থাকেন তখন এই ঘরে বহুবার বহু মানুষ তাঁকে থালা ভরে নাড়ু পিঠা, ধুয়ে মুছে খোসা ছড়িয়ে আনা বাড়ির গাছের পেয়ারাটা, পেঁপেটা এগিয়ে দিয়ে গেছে ।ফেলানিরও ইচ্ছে হলো এমনটি এগিয়ে দেয় ।বুড়ি ধীরে ধীরে বেড়াতে হেলিয়ে রাখা মাথাটা তুলে ধরল ।ফেলানিকে ভাত ক’টি বেড়ে দিতেই যেন বুড়ির বড্ড কষ্ট হচ্ছিল ।ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসগুলো নিয়মিত হতেই বুড়ি জিজ্ঞেস করল,
“ তোর বড় খিদে পেয়েছিল, না রে?”
সে মাথা নিচু করে আছে ।সত্যি সে ভাতের থালাতে হাত দিয়েই আর সব ভুলে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করেছিল ।হ্যাঁ, মাছ ভাতের গন্ধে খানিকক্ষণের জন্যে হলেও সে আর সব ভুলে গিয়েছিল ।এমনকি সে নিজেকেও ভুলে গিয়েছিল ।আজ সে কত দিন হলো এমন স্বাদ করে একবেলাটিও খেতে পায়নি ।তার অল্প লজ্জাও করছিল ।
“পেটের জ্বালা বড় জ্বালারে !”
ওর পিঠে যেন আবারো আরেকটি বটের পাতা এসে পড়ল ।রোগা পাতলা হাতটিতে একধরণের আশ্বাস ।অশ্বত্থ পাতার মতো হালকা ছোঁয়াকেন জানি হঠাৎই মনে পড়িয়ে দিল সেগুণ পাতার মতো ছড়ানো হাতটিকথা ।সে হাঁটুতে মাথা গুঁজে দিল ।পাকা অশ্বত্থ পাতাটি তখন ওর চুলের উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে ।
তোর সঙ্গে ছেলে একটি রয়েছে। আমি একেবারে একা ছিলাম ।আমি তোর থেকেও দেখতে সুন্দর ছিলাম ।মা কালী আমাকে বাঁচিয়ে দিলে ।তোকেও উনিই দেখবেন, দেখবি। মাকে প্রণাম কর ।” সে মুখ তুলে তাকালো ।গোটা ঘর জুড়ে জিহ্বা মেলে রাখা একটি কালো মেয়েমানুষের রক্তরাঙা চোখের চাউনি ।এই কালী ঠাকুর কি সত্যি একজন কম বয়সের মেয়েমানুষকে ভাত জোগাতে পারেন, দিতে পারেন দু’বেলা পাল্টাবার মতো দুটো কাপড় ? এই বৃদ্ধা মহিলাটি তো বেঁচে আছেন। খেয়ে পরেই আছেন ।নিজের ঘর একটাও রয়েছে।নিজেও আছে, অন্যকেও রেখেছে ।ওকে আজ মাছে ভাতে একবেলা খাইয়েছে।বুড়ির পিঠে তো কখনো সেগুণ পাতার মতো কোনও ছড়ানো ছিটানো হাতের ছোঁয়াছিল না।তবুও বুড়ি ওর রোগা হাতটিওর পিঠে রাখতে পেরেছে। কেবল কি ঐ কালী ঠাকুরের জন্যেই ? বুড়ির আদেশ মানতে নয়, নিজের থেকেই সে কালীর কালো জিহ্বা মেলা মুখখানার দিকে তাকিয়ে প্রণাম করল ।ওর কিচ্ছু চাইনে, দুবেলা খেতে পারার মতো দুমুঠো ভাত, মণিকে পরতে দিতে পারবার মতো একটা কাপড়।ওর গালের দুই পাশদিয়ে জলের ধারা নেমে এলো।
“
“ এর জন্যেই, মানুষের এই ব্যাপারটাই আমার এক্কেবারে পোষায় না| কান্না আর কান্না !আর কিছু করতে পারিস কি? না ব্যস , ভেঁ ভেঁ করে কাঁদতে পারিস ! কোন মরদকে দেখাতে চাইছিস ? মেয়ে মানুষের এই কান্না মরদদের দেখাবার জন্যে ।তবে সে, একটা ভাতার আসবে।শরীর দলাই মলাই করে বলবে, আহা ! হা , বেচারি! মেয়ে মানুষ আহ্লাদে আটখানা ।দলাই মলাই পর আসল সুখ ।তার পর পেট।”
বুড়ি তেতে উঠেছে ।“ পেট লাগে যদি আরো কান্না জোড় ।হাউ মাউ করে কান্না জোড় ।বস্তির সবক’টা ভাতার এক্ষুনি এসে পড়বে।তোর শরীরের বাঁধুনি ভালো ।দলাই মলাই ভালোই হবে ।”
ফেলানির রাগ চড়ে গেল ।কী বলে বুড়ি? ওর বাড়িতে আছে বলেই এতো কথা ! এক বেলা এক মুঠো ভাত খাওয়ালো বলেই এতো কথা ! সে রেগে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে গেল ।চোখ শুকনো। ক্ৰোধের তাপে ওর চোখের জল শুকিয়ে গেছে। চোখের থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে ।
“ আপনি আমার মায়ের চে’ও বয়সে বড়। আমি আপনার বাড়িতে আছি ।এমনি এমনি থাকছি না ।দস্তুর মতো ভাড়া দেব ।কিছু একটা রোজগার করে ভাত জোগাড় করব। মানুষটা নেই বলেই... আমার ছেলেটা আছে... হাত দুটো আছে... এক বেলা দুটো ভাত খাওয়ালেন বলে...।” রাগে ওর কথাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছিল ।কী বলতে চেয়ে কী বলছে ।
ওর পিঠে আবারও সেই পাকা বটের পাতার ছোঁয়া ।যেন বিছে পড়েছে তেমনি ঝ্যাঁটিয়ে সে হাতটিসরিয়ে দিল এবারে ।বুড়ি আলু প্যাঁজের ছোট্ট বাঁশের ঝুড়ি থেকে একটি লংকা তুলে নিলো। সাদা ছোট্ট লংকা ।সে চিনতে পারল মেম লংকা, কেউ কেউ সূর্যমুখী মরিচও বলে থাকে, কেউ বলে বিষ মরিচ, কেউ বা নাগা মরিচ, কেউ বা ধেনো ।উপর মুখো হয়ে গাছ ভরে থাকে এগুলো ।সাদা সাদা। ছোট ছোট ।প্রচণ্ড ঝাল।মুখে দিলেই মনে হয় যেন মুখ পুড়ে যাবে ! কী করছে বুড়ি? মরিচটা ওর চোখে ভেঙ্গে দেবে না তো ? মরিচটা হাতের তালুতে নিয়ে বুড়ি ওর কাছে চেপে এসেছে ।সে কুঁচকে সামান্য সরে দাঁড়ালো ।
“ মেয়ে মানুষকে এই লংকার মতো হতে হয় ।দেখতে ছোট কিন্তু মুখে দিলে জ্বালিয়ে দিতে পারে ।” বুড়ি মেম মরিচটা ওর হাতে দিল ।ওর রাগ কমে নি। বুড়ি এবারে মহাদেবের শরীরের উপরে পা রেখে দাঁড়ানো কালী মায়ের একটা ছবি দেখালো তাকে, “ মায়ের শক্তি দেখ, পুরুষকে কেমন করে পদাঘাত করছে। মায়ের ভক্ত হ’ । শক্তি পাবি ।”
ছবিটা সেভালো করে দেখে নি ।আসলে ভরপেট ভাত খেয়ে ওর ঘুম পেয়েছে।বারে বারে মা কালী, বুড়ি, মেম মরিচ---সবকিছু চোখের সামনে আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে ।হঠাৎ যেন ও নিজের নাকের শব্দ নিজেই শুনতে পেল ।
“ ওঠ, এদিকে আয় ।” বুড়ি ওকে মূল ঘরের পাশের বেড়া দিয়ে ঢাকা চালা একটার নিচে নিয়ে গেল। ছোট চালাটিতে ধানের গন্ধ একটা ছড়িয়ে আছে ।একদিকে একটা চুলোর উপর লোহার কড়াই একটা, কয়েকটা চালনি, দু বস্তা ধান, মাটির কলসি, বালি, লবণের বয়াম একটা ।মুড়ি ভাজার এক সম্পূর্ণ আয়োজনে ভরা চালাটিতে দাড়িয়ে ওর চোখের তন্দ্রা ছুটে পালিয়ে গেল ।বুড়ি একটি বস্তার থেকে একমুঠো ধান বের করে হাতের তালুতে নিলো, “ দেখ কি সুন্দর মালভোগ ধান।” আরেকটা বস্তার থেকে আরেক মুঠো বের করে মালতীর হাতে দিয়ে বলল , এই শালি ধানের মুড়িও ভালো হয়।” এবারে বড় ধান সেদ্ধ করবার কড়াইটা দেখালে,” পুরো আটশ পঁচিশ টাকা নিয়েছিল।” মাটির কলসিটি ছুঁয়ে বুড়ি হেসেই ফেলল,” বালি গরম করে করে কলসিগুলো লোহার কড়াইর মতোই হয়ে গেছে ।” কলসিগুলো বাজিয়ে দেখালো ।মুড়ি ঘাঁটাবার ভোঁতা হাতাখানা ওর হাতে তুলে দিল ।“ নে, মুড়ি ভাজ।” কথাটি বলে বুড়ি আগুন জ্বালিয়ে বালি, মাটির কলসিতে বালি গরম করেই ফেলল। কাজে নেমে পড়লে বুড়ির হালকা, সাদা আঙুলগুলো দেখলে মনে হয় যেন বাতাসের ছোঁয়াতে গোটা এক নলবন কাঁপছে ।ফেলানি এক দৃষ্টিতে বুড়ির আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল ।
“ধান সেদ্ধ করে চাল বের করে রাখা আছে ।” বুড়ি চালাটার এক কোনায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ।
সে কিচ্ছুটি বলল না ।যেমনি দাঁড়িয়ে ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি।বুড়িই বা কী বলতে চাইছে! ওর আবারও ঘুম পাচ্ছিল ।
বুড়ি খ্যাঁট খ্যাঁটিয়ে উঠল , “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মুড়িগুলো ভেজে উঠতে না পারলে কাল কী খাবি ।রোজ রোজ আমি তোকে খাওয়াতে পারব না। তোর ছেলেকে স্কুলে দিবি না? কোন ভাতার আসবে তোর খরচ চালাতে, শুনি?”
সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল ।
“আসছিস না যে বড়? এই বুড়ো শরীরে একা আর আমি পারি নে বাপু।”
সে ঐ একই রকম দাঁড়িয়ে রইল। ওখান থেকেই শুধু আস্তে আস্তে বলল, “ আমার হাতে টাকা পয়সা নেই, কোথাও যদি কাজ কর্ম কিছু....।” সে আসলে বলতে চাইছিল, মুড়ি ভেজে বিক্রি করতে তাকে প্রথমে ধান কিনতে হবে, অন্যান্য আসবাব পত্র কিনতে হবে। একটা ব্যবসা করতে গেলে মূলধনের দরকার পড়ে । আরো জিজ্ঞেস করতে চাইছিল মুড়ি ভেজে দিলে বুড়ি ওকে কী দেবে? মানে, মজুরি কী দেবে? পারলে সেই মজুরি থেকেই সে অল্প অল্প করে পয়সা বাঁচাবে আর কড়াই, কলসি, মালভোগ ধান কিনে নেবে ।
বুড়ি এবারে তেতে একেবারে খিঁচিয়ে উঠল, “তোকে টাকার কথা কে বলেছে? আমি তোকে মুড়ি ভাজার কথা বলছি।”
সে ভয়ে ভয়ে বুড়ির এগিয়ে দেয়া পিঁড়িতে গিয়ে বসল ।
বুড়ির চুলোর তুষ লাল হয়ে এসেছে।সেদ্ধ করে তৈরি করে রাখা মালভোগ ধানের চালের গন্ধে চারদিক মোঁ মোঁ করছে। বুড়ি চালগুলোতে এক বাটি লবণ জল ঢেলে দিল ।ফেলানি বুড়ির বাঁদিকে বসে চুলোর উপরে রাখা মাটির কলসিতে গরম বালিতে অল্প অল্প করে চালগুলো দিতে শুরু করল ।ফটফট করে ভাজা চাল ফুটে সাদা সাদা মালভোগ ধানের মুড়িতে ভরে পড়ল। সে হেসে ফেলল ।বুড়ি ওর দক্ষ হাতে তুষের আগুন থেকে গোবরের ঘুঁটে একবার বের করছে, আরেকবার ঢুকিয়ে দিচ্ছে ।সমান তাপে ভাজা চালের থেকে মুড়িগুলো ঠিকঠাক ফুটে বেরুচ্ছে ।দেখতে দেখতে একটা মাঝারি আকারের বস্তা মুড়িতে ভরে পড়ল ।বুড়ি দুটো বড় বড় কালচে পড়া বিস্কুটের টিনে ঠেসে ঠেসে মুড়িগুলো ভরালো। বস্তাতে থেকে যাওয়া মুড়ির থেকে অল্প ছোট টিন একটিতে ভরিয়ে মালতীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ নে তোর পোলাকে দিবি ।” সে হাত পেতে মুড়ির টিনটা নিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই বুড়ি ডাক দিল, “ ভালো করে ঘুমোবি ।সকালে মুড়ি বেচতে টাউনে যেতে হবে ।আমার বাঁধা গ্রাহক আছে ।” বুড়ি উঠে দাঁড়িয়েছে, “তোরও ভাত-মুঠোর জোগাড় হবে, আমার বুড়ো শরীরও আরাম পাবে।” সে বুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালো ।বুড়ি মুড়ির ঘরের জিনিসগুলো গোছগাছ করছে। কেরোসিনের বাতি আর তুষের আগুনের আগুনের আলোতে বুড়িকে দেখতে এক্কেবারে মেম মরিচটি যেন লাগছিল। রোগা, পাতলা, সাদা। চুলগুলোও সাদা ।শুকনো বুড়ির মধ্যে সে কি ঝাল ! একটা হাসি এসে মালতীর মুখখানাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল যেন ।
6 comments:
লেখাটির চমৎকার ভাষা বিন্যাস দারুণ লেগেছে। বইটি প্রকাশের পর এক কপি যেন পাই সে অনুরোধ রইল। যদি তা না হয় যেন পিডিএফ হলেও পাই। সংগহে রেখে মাঝে মাঝে পড়তে পাবর। ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।
ধন্যবাদ সৈকত ! পিডিএফের চে' বেশি কিছু দেবার চেষ্টা করব!
দেরিতে হলেও আগ্রহ হারাইনি বলে আগের মতই এক টানে পড়ে গেলাম।
আপনি এবং আপনার মতো কিছু বন্ধু আমার বিশৃংলার অত্যাচার সহ্য করছেন বলেই কাজটা এগুচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে নিয়মে বাঁধতে পারছিনা খালিদদা!
নিয়মিত পাঠক হিসেবে পড়লাম। আরও পড়ার ইচ্ছা রাখি।
ইচ্ছে পূরণ হবে সুশান্ত!
Post a Comment