ফেলানি
সকাল হতেই বস্তিতে হুলস্থূল লেগে গেল। সুমলা পাগলি রিজার্ভে পড়ে রয়েছে। রাস্তার থেকে সামান্য দূরে একটা শিশু গাছে তলায় ক্ষতবিক্ষত উলঙ্গ দেহটা পড়ে আছে। ওর শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট। শুকনো স্তন-দুটোর জায়গাতে দু’টুকরো ঘা। শুকনো আমের মতো যোনীর জায়গাতে একটুকরো দগদগে ঘা। এক টুকরো রুটির জন্যে মিলিটারি ক্যাম্পের ধারে কাছে ঘোরা ফেরা করতে ওকে সবাই দেখে। সে মণির মায়ের পেছনে পেছনে এসে ক্যাম্পে যাবার রাস্তার গাছটার নিচে বসে পড়ে। বিকেলে মণির মা ফিরে না আসা অব্দি বসে থাকে। অনেকেই দেখে মিলিটারিদের কেউ কেউ ওর দিকে রুটি, কখনো বা বিস্কুট ছুঁড়ে দেয়। লোকের নজরে পড়ল রোজ যেখানে সে বসে থাকে সেখান থেকে সামান্য দূরে বাঁশঝাড়ের থেকে রিজার্ভের ওই শিশু গাছটার নিচে অব্দি গলগলে রক্তের ধারা। কেউ যেন এই পথ ধরে দায়ের কোপ দিতে দিতে একটা ছাগল নিয়ে গেছে।
মালতী ঘরের কাজকর্ম সেরে মুড়ির টিন সাজিয়ে ভাবছিল গোটা রাত এই পাগলিটা ছিল কই। ঠিক তখন ঘটনা ঘটে। আগের রাতে সিঙের ছেলের বৌর ছেলে হয়েছে বলে একটা অনুষ্ঠান ছিল। তাকে ডেকেছিল। মণি তাকে নিয়ে যাবার জন্যে সিঙের লাল লাল ছোট গাড়িখানা নিয়ে এসেছিল। কোনও জিনিস নিয়ে যেতে পাঠিয়েছিল, সঙ্গে মাকেও নিয়ে আসতে বলেছিল। গাড়ি মণিই চালিয়েছিল। নরম বসার জায়গা, একটা গান বাজছিল। বাইরের এতো গরমের মধ্যেও ভেতরটা ঠাণ্ডা, মণিকে ওর অচেনা মনে হচ্ছিল। সিঙের ছেলের দেয়া লঙ পেন্ট-সার্টে ওকে বেটা ছেলে লাগছিল। সামনে একটা গরু পড়েছে, কুকুর একটা দৌড় দিল, একটা বাঁশের গাড়ি, একটি ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে চলে এলো রাস্তাতে। কী অনায়াসে সে এই সব কিছু পেরিয়ে চলে এলো। গাড়িটা মণি অল্প আঁকা বাঁকা করে চালাচ্ছিল। সে বলেছিল, “মা , আমিও একটা গাড়ি নেব। কুলদীপের বাবা আমাকে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে দেবে। তুই আর কত মুড়ি বিক্রি করবি।” সে কিছু বলেনি, মণির পিঠে পড়ে থাকা এক গাছা চুল সরিয়ে দিয়েছিল মাত্র।
রাতটা এই ভালো লাগার অনুভূতির মাঝে মাঝে পাগলিকে মনে পড়েছিল। শেষ রাতের দিকে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল যে তাকে না দেখে নিশ্চয় মিনতি বা জোনের মায়ের বাড়িতে পড়ে আছে। খবরটা শুনে সে পড়ি কি মরি সেখানে গিয়ে পৌঁছুলো। দেহটা মিলিটারি কর্ডন দিয়ে রেখেছে। এক পলক দেখে ওর মাথাটা ঘুরতে শুরু করল। সে হেলে দুলে গিয়ে পথের পাশে বসে পড়ল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল বুলেনের সেই স্বাস্থ্যবতী গোলগাল মেয়েটির একটা হাসিতে শান্ত হয়ে পড়া ক্রুদ্ধ মুখখানা। তার সেই মুখখানা বেড়ে বেড়ে যেন দশটা হয়ে গেল, মুখটা মানুষের, মাংসল হাড়ের তীক্ষ্ণ কুনোই থেকে বাকিটা এক একটা বাঘের থাবা, সেই থাবাতে এরা সুমলার শুকনো দেহটা চিরে চিরে খাচ্ছে। তার কানে স্পষ্ট বেজে উঠল কড়কড় করে হাড় চিবোনোর শব্দ। পুলিশ এসে সুমলার দেহটা গাড়ির পেছনে মালপত্র নেবার জায়গাতে তুলে নিয়েছে। লম্বা মানুষটি ভালো করে ঢোকেনি। কেউ জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কট করে একটা হাড়ের শব্দ হলো, মনে হয় পায়ের একটা হাড় ভেঙেই গেলো, উঠতে গিয়ে মণির মা কলকল করে বমি করে ফেলল।
রিজার্ভে বস্তিতে পিল পিল করে ঘোরা ফেরা করতে করতে আর্মির লোকেরা বস্তির মানুষের জানাশোনা হয়ে গেছে। ওদের কেন্দ্র করে যেভাবে চারালিতে দোকান-বাজার গড়ে উঠেছে। সেভাবে বাড়ি বাড়ি মদের দোকানও বসেছে। বিশেষ করে ড্রাইভারণীর বাড়িতে দিনে দিনে মদের ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। শুধু দেশীই নয়, সে ভালো জিনিসও রাখে। ওর নতুন ঘর উঠেছে, কালার টিভি, ফ্রিজ এসেছে। বাড়ির চারদিকে দেয়াল, তাতে ভাঙ্গা কাঁচ বসানো। সুদের ব্যবসাও বেড়েছে বেশ।
নবীন ড্রাইভারণীর বাড়িতে কোনোদিন যায় নি। মিনতিকে নিয়ে একদিন যাবার জন্যে বেরুলো। সামান্য টাকা ধারে চাই, সুদে নেবে। অসুখে পড়ে থাকতে থাকতে ওর টাকাপয়সা সব শেষ হয়ে গেছে। গোলমালের মধ্যেই মাঝে মাঝে বাজারটা বসে। নতুন করে শুরু করতে হবে সব। মিনতি ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। ছেলের অসুখ, ঝাড়া তেল আনতে হবে। মিনতির দিকে একবার তাকালো সে, কত দুঃখই না সহ্য করছে মেয়েটি। ছেলেটার কী যেন হার্টের অসুখ আছে। বুড়ো ডাক্তার একবার বলেছিল। প্রায়ই ঝাড়া তেল, তাবিজের সন্ধানে ফেরা মেয়েটির জন্যে ওর মায়া হলো। এ ক’দিন সে কম করেছে কি নবীনের জন্যে? এই ক’দিনে সে টের পেয়েছে মেয়েটির মনে দগদগে ঘা। ঘা শুকোলে যেমন হয়, চামড়া কালো হয়েছে। কিন্তু অল্প ছোঁয়াতেই চামড়ার তলার গা-তে হাত পড়ে, আর সে আর্তনাদ করে উঠে।
যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতে সে ড্রাইভারণীর ঘরে ঢুকেই গেল। লাল শাড়ি, লাল চুড়ি, লাল ঠোঁট।
বসেনি নবীন। সে টাকার কথা বলতে যাচ্ছিল। পুরো পরিবেশটাই ভালো লাগছিল না।
“বস।” নবীন যে চেয়ারে বসেছে তারই হাতলে বসেছে। মদ খেয়ে পয়সা দিয়ে দিয়ে ছোট চুলের লোকগুলো চলে গেছে।
মালতী ঘরের কাজকর্ম সেরে মুড়ির টিন সাজিয়ে ভাবছিল গোটা রাত এই পাগলিটা ছিল কই। ঠিক তখন ঘটনা ঘটে। আগের রাতে সিঙের ছেলের বৌর ছেলে হয়েছে বলে একটা অনুষ্ঠান ছিল। তাকে ডেকেছিল। মণি তাকে নিয়ে যাবার জন্যে সিঙের লাল লাল ছোট গাড়িখানা নিয়ে এসেছিল। কোনও জিনিস নিয়ে যেতে পাঠিয়েছিল, সঙ্গে মাকেও নিয়ে আসতে বলেছিল। গাড়ি মণিই চালিয়েছিল। নরম বসার জায়গা, একটা গান বাজছিল। বাইরের এতো গরমের মধ্যেও ভেতরটা ঠাণ্ডা, মণিকে ওর অচেনা মনে হচ্ছিল। সিঙের ছেলের দেয়া লঙ পেন্ট-সার্টে ওকে বেটা ছেলে লাগছিল। সামনে একটা গরু পড়েছে, কুকুর একটা দৌড় দিল, একটা বাঁশের গাড়ি, একটি ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে চলে এলো রাস্তাতে। কী অনায়াসে সে এই সব কিছু পেরিয়ে চলে এলো। গাড়িটা মণি অল্প আঁকা বাঁকা করে চালাচ্ছিল। সে বলেছিল, “মা , আমিও একটা গাড়ি নেব। কুলদীপের বাবা আমাকে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে দেবে। তুই আর কত মুড়ি বিক্রি করবি।” সে কিছু বলেনি, মণির পিঠে পড়ে থাকা এক গাছা চুল সরিয়ে দিয়েছিল মাত্র।
রাতটা এই ভালো লাগার অনুভূতির মাঝে মাঝে পাগলিকে মনে পড়েছিল। শেষ রাতের দিকে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল যে তাকে না দেখে নিশ্চয় মিনতি বা জোনের মায়ের বাড়িতে পড়ে আছে। খবরটা শুনে সে পড়ি কি মরি সেখানে গিয়ে পৌঁছুলো। দেহটা মিলিটারি কর্ডন দিয়ে রেখেছে। এক পলক দেখে ওর মাথাটা ঘুরতে শুরু করল। সে হেলে দুলে গিয়ে পথের পাশে বসে পড়ল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল বুলেনের সেই স্বাস্থ্যবতী গোলগাল মেয়েটির একটা হাসিতে শান্ত হয়ে পড়া ক্রুদ্ধ মুখখানা। তার সেই মুখখানা বেড়ে বেড়ে যেন দশটা হয়ে গেল, মুখটা মানুষের, মাংসল হাড়ের তীক্ষ্ণ কুনোই থেকে বাকিটা এক একটা বাঘের থাবা, সেই থাবাতে এরা সুমলার শুকনো দেহটা চিরে চিরে খাচ্ছে। তার কানে স্পষ্ট বেজে উঠল কড়কড় করে হাড় চিবোনোর শব্দ। পুলিশ এসে সুমলার দেহটা গাড়ির পেছনে মালপত্র নেবার জায়গাতে তুলে নিয়েছে। লম্বা মানুষটি ভালো করে ঢোকেনি। কেউ জোর করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কট করে একটা হাড়ের শব্দ হলো, মনে হয় পায়ের একটা হাড় ভেঙেই গেলো, উঠতে গিয়ে মণির মা কলকল করে বমি করে ফেলল।
রিজার্ভে বস্তিতে পিল পিল করে ঘোরা ফেরা করতে করতে আর্মির লোকেরা বস্তির মানুষের জানাশোনা হয়ে গেছে। ওদের কেন্দ্র করে যেভাবে চারালিতে দোকান-বাজার গড়ে উঠেছে। সেভাবে বাড়ি বাড়ি মদের দোকানও বসেছে। বিশেষ করে ড্রাইভারণীর বাড়িতে দিনে দিনে মদের ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। শুধু দেশীই নয়, সে ভালো জিনিসও রাখে। ওর নতুন ঘর উঠেছে, কালার টিভি, ফ্রিজ এসেছে। বাড়ির চারদিকে দেয়াল, তাতে ভাঙ্গা কাঁচ বসানো। সুদের ব্যবসাও বেড়েছে বেশ।
নবীন ড্রাইভারণীর বাড়িতে কোনোদিন যায় নি। মিনতিকে নিয়ে একদিন যাবার জন্যে বেরুলো। সামান্য টাকা ধারে চাই, সুদে নেবে। অসুখে পড়ে থাকতে থাকতে ওর টাকাপয়সা সব শেষ হয়ে গেছে। গোলমালের মধ্যেই মাঝে মাঝে বাজারটা বসে। নতুন করে শুরু করতে হবে সব। মিনতি ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল। ছেলের অসুখ, ঝাড়া তেল আনতে হবে। মিনতির দিকে একবার তাকালো সে, কত দুঃখই না সহ্য করছে মেয়েটি। ছেলেটার কী যেন হার্টের অসুখ আছে। বুড়ো ডাক্তার একবার বলেছিল। প্রায়ই ঝাড়া তেল, তাবিজের সন্ধানে ফেরা মেয়েটির জন্যে ওর মায়া হলো। এ ক’দিন সে কম করেছে কি নবীনের জন্যে? এই ক’দিনে সে টের পেয়েছে মেয়েটির মনে দগদগে ঘা। ঘা শুকোলে যেমন হয়, চামড়া কালো হয়েছে। কিন্তু অল্প ছোঁয়াতেই চামড়ার তলার গা-তে হাত পড়ে, আর সে আর্তনাদ করে উঠে।
যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতে সে ড্রাইভারণীর ঘরে ঢুকেই গেল। লাল শাড়ি, লাল চুড়ি, লাল ঠোঁট।
বসেনি নবীন। সে টাকার কথা বলতে যাচ্ছিল। পুরো পরিবেশটাই ভালো লাগছিল না।
“বস।” নবীন যে চেয়ারে বসেছে তারই হাতলে বসেছে। মদ খেয়ে পয়সা দিয়ে দিয়ে ছোট চুলের লোকগুলো চলে গেছে।
কিছু না বলে ড্রাইভারণী ভেতরে চলে গেল। পোশাক পালটে এলো। হাতের নামে মিহি ফিতা দু’টো গায়ে ল্যাপ্টে থাকা নরম কাপড়ের জামা একটা পরে এসেছে সে। পিঠ আর বুকের একাংশ বেরিয়ে এসেছে। ফেনটা আরও জোরে চালিয়ে দিল।
“ কী গরম পড়েছে গো!” বোতল একটার থেকে কী যেন নিয়ে সে ফ্রিজের থেকে বরফ বের করে তাকে দিল, “ খা, আজ প্রথম এলি, আমি ভাবতেই পারিনি তুই আমার এখানে আসবি বলে।”
“ এই, মানে ড্রাইভার কই?”
“এই মরাটার কথা আর জিজ্ঞেস করিস কেন? সে মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।” একটা হাসি মারল, “ ও ওভাবেই থাকে।”
“কেন?” জিজ্ঞেস করতে হয় বলেই করল। সে একটা কথাই ভাবছিল, টাকা কিছু ধারে চাইতে হবে।
“কেন আবার?” বৌয়ের টাকাতে খেতে পায় যে । পুরুষ সে মৌজ করবে নাতো কী করবে আর?” হঠাৎ সে নাকি সুরে প্রায় কেঁদে ফেলেই বলল, “তোরা কী বুঝবি ও আমাকে কী অত্যাচার করে। রাতে মদ খেয়ে পড়ে থাকবে, গন্ধ, মাতালের নাকের থেকে বেরুনো গন্ধ শুনেছিস? শুয়োর কাটতে গেলে যেভাবে ডাকে সেরকম করে ডাকে ওর নাক। আমি পুরো রাত কাঁদতে থাকি।”
কেঁদে কেঁদে সে মাথাটা ওর কাঁধে ফেলে দিল, “আমার জন্যে তোর কষ্ট হয় না?” এবারে সে পুর শরীরের ভার নবীনের উপরে ফেলে দিল।
নবীনের রাগ উঠল,
“কী করছ?”
এবারে হাসল ড্রাইভারণী, “তুই আমাকে শহরের বাবুনিদের ডাকবার মতো ডাকছিস দেখি।” বলে হাসতে হাসতে সে নবীনের শরীরে গড়িয়ে পড়েছে।
নবীন উঠে দাঁড়ালো, “আমি সামান্য টাকা দেবার কথা বলতে এসেছিলাম, সুদ দেবো।”
“কত চাই?” কাজের কথাতে আসতে পেরে নবীনের ভালো লাগল।
“দেবে? এই হাজার তিনেকের মতো।”
“চল, তবে দিয়েই দিই। ভেতরে চল।”
ভেতরের ঘরে শুধু একখানা বড় বিছানা। সে আলমিরা খুলে টাকা বের করল, “নে।” নবীন হাত মেলে টাকাগুলো নিলো। “এগুলো খা, নেশা হবে না, লেবুর শরবৎ।” নবীন ওকে অসন্তুষ্ট করতে চায় নি। খেয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝিনঝিন করতে শুরু করল।
“যাই এখন।” টাকাগুলো নিয়ে যাবার জন্যে উঠল সে। টের পাচ্ছে কিছু একটা তার মগজ গ্রাস করে ফেলছে।কথাগুলো ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারছে না। হাঁটতে গিয়ে এমন মনে হচ্ছে যেন সে শূন্যে হাঁটছে , পা ফেলতে পারছে না। সে অনুভব করছিল কিসে যেন তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তার শরীরে রুনুঝুনু করে বাজতে বাজতে একটা হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরো শরীর জুড়ে অভূতপূর্ব এক তীব্র ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে। এই সব কিছুর মধ্যেও সে বুঝতে পারছে যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না। ড্রাইভারণীকে ঠেলে সে আবার দাঁড়ালো, “ আমি যাই।” ঠেলাটা মনে হয় একটু বেশিই হলো, মহিলা ধপাস করে পড়ে গেল। পড়ার থেকে উঠে সে সাপের মতো ফোঁস করে উঠল। নবীনকে এক গোঁতা দিল। তারপরেই বকে দিয়ে বলল, “ তুই একটা বাঁধা কপি, কী আছে তোর? সবই তো মিলিটারি থ্যাৎলে দিয়েছে। বেরিয়ে যা, দে আমার টাকা ঘুরিয়ে দে।” নবীনের হাত থেকে টাকাগুলো ছিনিয়ে নিয়ে নিলো সে।
প্রায় অবশ মগজে সে অনুভব করল কেউ যেন চাবুক পেটা করেছে তাকে। কী বলে মহিলাটি? তাকে বলছে বাঁধা কপি? তার উত্তেজিত স্নায়ুতে অপমানের ভাবটা খানিক বেশিই হয়েছে। ওর ভেতরকার পুরুষমানুষটি অবসন্ন মগজে দপদপিয়ে উঠল। মিলিটারি তার সব থ্যাৎলে দিয়েছে! কী ভেবেছে মেয়েটি? এবারে সে ওর উদলা বাহু দু’টো ঝাঁকিয়ে দিল, “ কী ভাবছিস তুই? আমার কিছু নেই? আয়, দেখবি আয়।”
ফিক করে একটা হাসি দিল ড্রাইভারণী, ফাঁদে পড়া শিকার দেখে শিকারির হাসি নবীনকে আরও উত্তেজিত করে তুলল।
“দাঁত দেখাবার কী হলো? হাসছিস কেন তুই? কেন হাসছিস?” ভাঁজ না পড়া জিহ্বাতে একই কথা জিজ্ঞেস করতে করতে তার হেঁচকি এসে গেল।
“ নে, খা।” ড্রাইভারণী তার দিকে এক গ্লাস চাল ধোয়া জলের রঙের পানীয় এগিয়ে দিল। টেবিলে ছিল একটা প্যাঁজ, কেটে দিল।
“খা, আমাকে একটা আর্মি দিয়েছিল, বেশ দামি জিনিস।” সে এক ঢোকে খেয়ে ফেলল। আসলে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
আবার হাসছে ড্রাইভারণী।
নবীন আবার সেই একই কথা জিজ্ঞেস করতে থাকল, “কেন হাসলি? হাসলি কেন?”
চুড়ির রুনুঝুনু শব্দটির সঙ্গে সঙ্গে একটা ভালো লাগার অনুভূতি তার শরীরে চরে বেড়াচ্ছে। মগজের শক্তি কমে আসছে, শরীরটা যেন জলাজমির থেকে উঠে আসা প্রকাণ্ড হাতির মতো উঠে আসছে, শক্তিশালী হচ্ছে। বারে বারে হুংকার দিচ্ছে।
“লোকে মিথ্যে বলে।” মহিলাটির প্রতিটি শব্দেই খিলখিল হাসি।
“ কী মিছা কথা”
“তুই বাঁধা কপি হোস নি।”
“কী বললি?”
“লোকে যেমন বলে সেভাবে থ্যাৎলে দিতে পারে নি মিলিটারি।”
“তুই কেন হাসছিস “ কেন হাসছিস? হাসছিস কেন?” সে একটাই কথা বলে যাচ্ছে বারে বারে।
জলাজমির থেকে এক ধাক্কাতে উঠে এসেছে হাতিটা, বারে বারে হুংকার দিচ্ছে, তার চিৎকারে জল কাদা সব ছড়িয়ে পড়ছে, বিদীর্ণ করে ফেলছে বাতাস, চির চির করে ফেলেছে আকাশ।
সকাল আটটা নাগাদ সবাই দেখল মাথা নিচু করে ড্রাইভারণীর বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে নবীন । কথাটা জানাজানি হয়ে গেল। নবীন ড্রাইভারণীর ওখানে পুরো রাত কাটিয়েছে। সে গিয়ে নিজের ঘরে সেই যে ঢুকলো আর ঢুকলই, আর নাগাল পাওয়া গেল না।
জোনের মা গেল, মণির মা, মিনতি, ফুলরাও গেল। কারো সঙ্গে কথা বলল না। সেই যে মানুষটা চুপ মেরে গেল, গেলই। কেউ দেখেছিল, ড্রাইভারণী ড্রাইভারের হাতে দিয়ে টাকাগুলো পাঠিয়েছিল। সে বুঝি ওর ঘরে ফেলে এসেছিল। সেই টাকাও নেয় নি নবীন।
বাজারগুলো আবার নিয়মিত বসতে শুরু করেছিল। বন্ধ দিলেও আর্মি দরজায় দরজায় ঘা দিয়ে খুলিয়ে দিয়েছে। ছোট করে হলেও বাজার বসেছিল। লোকজন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যে যা পারে জমিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিল। চারদিকে গুজব ছড়াচ্ছে এক হাজার ঘণ্টার বন্ধ হবে। বন্যা এলে যেমন পিঁপড়েরা মুখে ডিম নিয়ে ছুটো ছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষজনও সেভাবেই করছিল।
নবীন ঘরে ঢুকে আছে, না ব্যবসা শুরু করেছে এসব দেখবার কারো সময় ছিল না। এক হাজার ঘণ্টা বন্ধের একটা কালো ছায়া সবাইকে চেপে ধরেছে।
ব্যাপারটি মিনতিই প্রথম দেখেছে। সকালে সে নবীনকে লাল চা আর মুড়ি দিতে গিয়েছিল। সেও আসলে নবীনকে ভালো করে দেখাশোনা করতে পারে নি। সময় পেলে এই একটু চা দিয়ে আসে গে’ । তাকেও এক হাজার ঘণ্টার বন্ধটা পাগলপ্রায় করে ফেলেছে। কী করে কী করবে? অন্য অনেকে মতো গুয়াহাটি চলে যাবে কি কিন্তু বেমারি ছেলেটিকে নিয়ে কী করে? যাই বললেই কি আর হলো? যায় কই? কই বা যাবে? এই ক’দিনে সে মশলা গুড়ো করে যতটা পারে বিক্রি করবার চেষ্টা করছে। কাগজের ঠোঙা বানাচ্ছে। মুড়ি ভাজছে। দুই হাতে যত পারে তত রোজগার করে রাখছে। নবীনকেই কেন, ছেলেটাকেও ভালো করে দেখতে পারে নি। যদি বিশ না হোক, দশ কেজি চালও উঠিয়ে রাখতে পারে।
একটু অবসর পেয়ে সে সামান্য মুড়ির সঙ্গে লবণ চা নিয়ে নবীনের ঘরে গিয়েছিল। শরীরের তলাটা জবজবে রক্তে ভেজা সে পড়ে আছে। তার হুঁশ নেই। উলঙ্গ যৌনাঙ্গ থেকে গলগলে রক্ত বেরিয়ে আসছে। কাছেই একখানা ধারালো ছুরি। দু’টুকরো মাংস পড়ে আছে বিছানাতে।
“নবীন তার আলু-বেগুন কেটে ফেলেছে রে!” চিৎকার দিতে দিতে সে রাস্তাতে চলে এলো।
বস্তিতে হল্লা পড়ে গেল, নবীন আলু-বেগুন কেটে ফেলেছে। ডিম মুখে নিয়ে যাতায়াতে ব্যস্ত পিঁপড়েদের মধ্যে হুলস্থূল লেগে গেল। বুড়ো ডাক্তার, ইঞ্জেকশন, ঔষধ, ব্যান্ডেজ, মূর্ছিত নবীন।
এক হাজার ঘণ্টার বন্ধ হবেই হবে। কালো ছাদটা তলায় নেমে এলো। সুস্থ হয়ে উঠা নবীনও চেনা বইয়ের দোকান থেকে ধারে বই নিয়ে বাজার ছাড়াও ফুটপাতে বসতে শুরু করল। কালো ছাঁদের করাল ছায়াতে ঢাকা পড়ে গেল দগদগে ঘা নিয়ে শিশু গাছের তলায় পড়ে থাকা সুমলা, ড্রাইভারণীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা নবীন, আলু-বেগুন কাটা, তার মরে মরে অবস্থা। সমস্ত কালো নেমে এসে ছাদটাকে ঢেকে ফেলল।
No comments:
Post a Comment