আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Saturday, 10 May 2014

অধ্যায় চৌত্রিশ (৩৪)


ফেলানি
জ বস্তির সমস্ত মানুষ এসে জড়ো হয়েছে মণিদের বাড়িতে। মিনতি, জোনের মা, রত্না সবাই মণির মায়ের কাছে হাত লাগিয়েছে। মিষ্টি, শিঙাড়া, লাল চা যে যেখানে পারে বসে খাচ্ছে। অধিকাংশই আছে গাড়ির কাছাকাছি। এখানে ওখানে সামান্য রঙ উঠে গেছে, সাদা গাড়িটি কেউবা ছুঁয়ে দেখছে, কেউবা ধুলো মুছে দিচ্ছে। মালতীও চোখ বাঁকা করে মাঝে মধ্যেই গাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তারমানে সত্যি মণি বড় হয়ে গেছে, নিজের গাড়ি কিনবার মতো বড়। সবাই চলে গেলে রাতে গাড়িতে উঠে মণি চাবি ঘোরালো।

   
     
     “আয় মা, গাড়ি চড়বি। কাল থেকে স্ট্যান্ডে দিয়ে দেবো।”
     মণির নিয়ে আসা নতুন মেখেলা চাদর পরল সে। পোশাক-জোড়া পরে তার মুখে একটা হাসি খেলে গেল। শাশুড়ি যেন লাগছে। হঠাৎ ওর সেই কামরাঙাটা দেখবার ইচ্ছে হলো। কামরাঙাটা পরে ওর কাছে এসে দাঁড়ালো এক লজ্জাবতী তরুণী। টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিলো মেয়েটির গালে। অনেকক্ষণ ধরে একটা মিচকি হাসি ওর মুখে লেগে রইল।
     গাড়ি চলছে। সামান্য ভালো রাস্তা পেলেই জলে নৌকো চলার মতো চলে। গর্তগুলো বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে সে এগুচ্ছে। জ্যোৎস্না রাত, নামিয়ে দেয়া গ্লাসে বাইরের বাতাস ভেতরে আসছে, মালতীর চোখ বুজে এসেছে।
    “মা, মাসে তিন হাজার করে দিয়ে কুলদীপের বাবার ধারটা মেরে দেব।”
    “ তিন হাজার?” সে চমকে উঠল।
    “ উপার্জন হবে তো মা।” মণি হাসছে।
    গাড়ির ভেতরের বাতাস আরও মোলায়েম হয়ে আসছে। মণি রাধিকা নদীর পাড়ে পাড়ে চালাচ্ছে গাড়ি। মালতী আজ বহুদিন পর পিঠে সেই সেগুনের মতো ছড়ানো হাতের ছোঁয়া অনুভব করছে। কানে ভেসে আসছে ভালোবাসাতে ভেজানো এক কণ্ঠ, “ মালতী, তুই তাহলে আমার ছেলেটাকে বড় করলি? খেটে খাবার জন্যে সমর্থও বানালি।”
    চোখ ভিজে আসছে। আজ যদি মানুষটি দেখতে পেতেন।
    “হণ্ট।” কর্কশ হুকুম একটা শুনে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দিল মণি। এক দল আর্মি। জনা দুই ভেতরে মাথা গলিয়ে দেখল।
    “লাইসেন্স।”
    মণি কাগজ পত্র দেখালো।
     “ইধার আও।” মিলিটারি গাড়িটা নদীর দিকে মুখ করিয়ে আলো জ্বেলে রাখতে অর্ডার দিল মণিকে। গাড়ির উজ্জ্বল হেডলাইটের আলোতে নদীর পাড়ের কাদাতে দেখা গেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাম-বুট পরে একদল আর্মি। ওরা ওখানে কিছু খুঁজছে।
     “ কী খুঁজছে ওরা?” মালতীর গলা বসে গেছে ভয়ে। কয়েকটা আর্মি দুই একটা জায়গা খুঁড়ছেও। খুন্তিও লাগিয়েছে দুই এক জায়গাতে।
     “মানুষ টানুষ পুঁতে রাখছে কি না।” মণির মুখও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
    গাড়ির আলো নিভে গেল। মরা অমাবস্যার রাতে হঠাৎই নদীর পাড় অন্ধকার হয়ে গেল। মণি বুঝিয়ে দিল তার গাড়িতে পেট্রল ফুরিয়ে গেছে। আর্মি মণিকে যেতে দিল। বস্তিতে ফিরেই প্রায় সবাইকে এই আর্মির নদী খোঁড়ার কথাটা মণি জানালো। খবরটা ভালো করে জানাজানি হতে না হতেই আর্মি এসে বস্তিতে ঢুকল। পুরুষদের প্রায় সবাইকে হাতে মশাল নিয়ে নদীর পাড়ে মরা মানুষ সন্ধানের কাজে লাগিয়ে দিল। নবীন আর মণি কাছাকাছি থাকছে। মণির নজরে পড়ল এক পাটি মানুষের দাঁত আধা কাদার মধ্যে ডুবে আছে। উপরে দুটো শামুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। হুলস্থূল পড়ে গেল। তখন প্রায় মাঝরাত। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। আর্মি আর বাকি সবাই মিলে জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করল। প্রায় চারফুট মাটির নিচে একটি মানুষের হাত দেখা গেল। ধীরে ধীরে সাত সাতটি জোয়ান ছেলের মৃতদেহ উঠে এলো। একেবারে শেষে উঠে এলো একটা লম্বা মরা লাশ। লাশের হাতের আঙটি একটা দেখে নবীন চেঁচিয়ে উঠল। চিৎকারে একটি আর্মি এসে ওকে বন্দুকের খোঁচা দিয়ে বলল, “চুপ রহো।” ছেলেগুলোকে বন্ধুকের বাটে ঘা দিয়ে, গুলি করে মেরে লবণ ঢেলে নদীর পাড়ে কাদাতে পুঁতে রেখেছিল। লাশগুলো যখন আর্মি নিয়ে গেল আকাশ তখন ফর্সা হচ্ছে। পুরুষ মানুষেরা ফিরে আসা অব্দি প্রায় সব বাড়িতে মেয়েরা জেগে রাত কাটিয়েছে।
     বাইরে বাইরে মণিকে স্নান করতে দেখে কাছে চেপে গেল মা। কিছু না বললেও সব বুঝতে পারল। ধূনার দানিতে নারকেলের ছোলা আর সামান্য খের জ্বালিয়ে মণির সামনে নিয়ে গেল। মণি হাতে ছুঁয়ে দিল। দরজার মুখে মা খের আর কাঠের চেলি দু’টুকরো জ্বালিয়ে দিল। কাপড় চোপড় কলপাড়ে রেখে সে ভেজা গামোছা পরে ঘরে গিয়ে ঢুকল। তুলসীর দুটো পাতা ছিঁড়ে একটা বাটির জলে ভিজিয়ে জলগুলো মণির গায়ে ছিটিয়ে দিল মা। তার পরে সে গিয়ে বিছানাতে পড়ল। সে আর তার মা সেদিন এক-গ্লাস জলও খায় নি।
     সকালে কেউ বন্ধ না দিলেও শহরে বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে চুপি চুপি কাদাতে পুঁতে রাখা জোয়ান ছেলেদের কথা রাষ্ট্র হয়ে গেল। পুলিশে মিলিটারিতে পুরো শহর ভরে গেল। বস্তির মানুষজন সেদিনই কেউ আর বেরুলো না কোথাও। ঘরের দাওয়াতে, বাড়ির উঠোনে সবাই জটলা করে বসে আছে। হঠাৎ দেখতে পেল এক ঝাঁক আর্মি মিনতির ঘর ঘিরে ফেলেছে। তাকে ওরা গাড়িতে উঠবার জন্যে চাপ দিচ্ছে। সে যাবে না। উঠোনে বসেই মিনতি হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
     “তোরা আমাকে নিয়ে গিয়ে কী করবি আমার জানা আছে।” ওর ছেলে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। বস্তির প্রায় সবাই এসে মিনতির বাড়ির ধারে কাছে জড়ো হলো। মহিলারাও।
     সবাই তাকিয়ে আছে। কারো মুখে কথা নেই।
    ওই একটা আর্মি ওকে বন্দুক দিয়ে ঠেলছে। তার চিৎকার বেড়েই চলেছে। আরেকটা এসে ওকে গালি পাড়ছে। কী করছে ওরা? ওর চুলে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইছে।
     মণির মা ছোঁ মেরে এগিয়ে গেলো। বাতাস কলাপাতার মতো সে কাঁপছে।
     “এই কী করছিস তোরা? কাদাতে মানুষ মেরে ও পোঁতেছে?”
     জোনের মা, মীরার মা, রত্না, লাতুর বৌ সবাই এসে মিনতিকে ঘিরে ফেলেছে। পুরুষেরাও কাছে চেপে এলো।
     নবীন মিনতির কাছে এলো। ওর মুখ লাল হয়ে গেছে। একটা আবার বন্দুক দিয়ে খোঁচা দিল মিনতিকে। এবারে সে মণির মায়ের গায়ে পড়ে কেঁদে ফেলল। যে আর্মিটা মিনতিকে বন্দুকের খোঁচা দিচ্ছিল তার হাতে গিয়ে খামচে ধরল নবীন। ধীরে ধীরে কাছাকাছি জড়ো প্রতিটি মানুষ এগিয়ে এলো। লোকগুলো গোঁয়ার হয়ে পড়েছে। ডর ভয় চলে গেছে।
     “বলছিস না যে? কী করেছে মেয়েটি? কেন ওকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবি?”
    “ কী করেছে ও?”
    “ এই এক মহিলা সাতটা ছেলেকে মারতে পারবে?”
    “ গর্ত করে পুঁতে ফেলতে পারে?”
    “ নদীর পাড়ে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে যেতে পারে?”
    “ সাতটা জোয়ান ছেলের মরা লাশ পুঁততে লবণ আনতে পারবে?”
    “ওকে কেন হেনস্তা করছিস তোরা?”
    এক পাশ থেকে ঘন করে গাঁথা মালার মণির মতো লোকগুলো সেই আর্মিকে ঘিরে ফেলেছে। বাকি পুলিশ মিলিটারি সেই ঘেরার ভেতরে যেতে পারে নি। লোকগুলো আরও ঘন হচ্ছেই হচ্ছে। মিনতির কান্না বন্ধ হয়েছে।
     এক সময় পুলিশ মিলিটারি চলে গেল।

     সেদিন রাতে নবীন মিনতিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে গেল। পুরো রাত সে সেখানে থাকল। ধীরে ধীরে দেখা গেল মিনতি নবীনের ভাত রান্না করে দিচ্ছে, ঘর মুছে দিচ্ছে, বিকেলে সে ফিরে আসার পথে তাকিয়ে আছে। যেদিন মিনতি নিজের ভাড়া ঘরটা ছেড়ে দিল সবার নজরে পড়ল কথাটা। কাছাকাছি থাকে, আসা যাওয়া আছে। কিন্তু ঘরটা ছাড়তে যেন বিশেষ করে নজরে পড়ল।
     নবীনের সঙ্গে মিনতি থাকতে শুরু করলে একই মুদ্রার অন্য পিঠে আরও একটা কথাও আবার উঠল, নবীনের সেই আলু-বেগুন কেটে ফেলার ঘটনাটা। সেদিন মিনতি নবীনের বাড়ির উঠোনে কী সব কাজ করছিল। ছেলেটা স্কুলে গেছে। মিনতির পাশে গোল হয়ে শুয়ে আছে কালু। কালু একটা কুচকুচে কালো মাদা কুকুর। কোত্থেকে যেন এনেছিল মিনতি। এখন বড় হয়ে শক্তপোক্ত হয়ে গেছে। মধ্যে শরীর খারাপ হয়েছিল। নবীন কী কী ঔষধ দিয়ে ভালো করেছে। নবীনের বাড়িতে একটা শিউলি ফুলের চারা লাগাতে চাইছিল মিনতি। চারাটা পুঁততে যেতেই দেখল কেং কেং করে কালু তার দিকে দৌড়ে আসছে। যেদিকে কালু যাচ্ছে সেদিকেই একটা রক্তের ধারা। যন্ত্রণাতে কুকুরটা উঠোন জুড়ে কুঁকিয়ে কুঁকিয়ে গড়াচ্ছে। বারে বারে সে মিনতির পায়ের কাছে আসবার চেষ্টা করছিল। বেদনাতে কাতর কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে সে চিৎকার করে উঠল। কুকুরটার যৌনাঙ্গ কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে সমান করে কেটে দিয়েছে। ড্রাইভারণীর বাড়িতে জড়ো হওয়া দু’ একটা মাতালের চাপা হাসি যেন সে শুনতে পেল। হাসিটা না কুকুরের আর্তনাদ –ঠিক ধরতে পারে নি সে , তার মগজে আগুন ধরিয়ে দিল।
     সে পথে বেরিয়ে এলো। গায়ের কাপড় কোমরে বেঁধে নিলো। তারপর উরু চাপড়ে চাপড়ে সে উঁচু গলাতে চেঁচাতে শুরু করল।
     “ বেরিয়ে আসিস না কেন, তোদের আলু-বেগুনে যদি এতোই জোর তবে বেরিয়ে আয় না কেন?”
    কালুর চিৎকার আর ওর গলা দুটো যেন একই বিন্দুতে মিশে গেছে, “শোন , কান পেতে শোন, আমার আলু-বেগুনের পুরুষ চাইনে, অনেক দেখেছি এমন পুরুষ।” মিনতি বুক চাপড়াচ্ছে, “ আমার এখানে চাই মায়া মমতার পুরুষ, আলু-বেগুনের জোরে দেমাক দেখাবার জন্যে কোনও ষাঁড় চাইনা, বুঝলে!”
    এবারে সে মাটিতে বসে কাঁদতে শুরু করল, “আমি ষাঁড় গরু নয়, একটা মানুষ পেয়েছি। আমাকে কেন শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিস না?”
     তারপরে সে উঠে গিয়ে বেদনার্ত কুকুরের কাটা জায়গাটা ধুয়ে দিল। ভেতর থেকে একটা মলম এনে লাগিয়ে দিয়ে পরম মমতাতে কুকুরটিকে জড়িয়ে ধরল। কুকুরও আরাম পেয়ে কুঁ কুঁ করে গৃহিণীর পায়ের তলাতে জায়গা নিলো। এমনি করে কুকুরকে জড়িয়ে ধরে অনেক ক্ষণ বসে রইল মিনতি।
   
       হঠাৎই একবার ইচ্ছে হলো রত্নার সংগে দেখা করবার। রত্না কি জানে জিতের সেই আংটিটার কথা? হীরে বসানো ছিল। পাহাড়ে যাবার বেলা অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সেই আংটিটাও মিনতির কাছে রেখে গিয়েছিল। বহুদিন সেটি মিনতির কাছে ছিল। মিনতির কাছে রাখতে দেয়া জিনিসগুলো নবীনও দেখেছে। রত্না কি জানে লবণ ঢেলে পুঁতে রাখা শবগুলোর একটির হাতে নবীন নিজের চোখে সেই আংটি দেখেছিল? সে কি আর রত্নাকে শুধু সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েই একটা পুরো মাস রেখেছিল? সে কি রত্নাকেও বলেছিল, “তোমাকে আমি বিপদে ফেলব না?” রত্না মেয়ে মানুষ, ছোট্ট মেয়ে। সে কি আর বুঝেছে কথাগুলোর অর্থ? সেই একমাস রত্না কী ভেবেছিল? সবাই ওকে হিংসে করে, না কি ভেবেছিল ফিল্মের হিরোর মতো দেখতে ছেলেটির সঙ্গে সেও ফিল্মি নায়িকা হবে? নদীতে সাঁতার দেবে, বাগানে নাচবে। সে রত্নাকেও বলেছিল কি এসব, “আমার বাড়িটা হয়ে গেলেই তোমাকে আমি বিয়ে করব?” রত্নার দেহও তার জন্যে কেঁদেছিল কি? এখনো কি কাঁদে? সে তো আর আংটির কথাটা জানে না। ওর মুখখানা দেখলেই রত্নারও পাখির মতো উড়ে যেতে ইচ্ছে করেছিল কি?
     
     সত্যিই সে রত্নার বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। বাড়িতে রত্না ছিল, সে উঠোনে একটা কুরুনি দিয়ে লাউ গাছের গুড়ি সাফ করছিল । মিনতিকে দেখে তাকিয়ে রইল। সেই ছেলেটি এই মহিলাকেও...। রত্নার শুকনো শরীর দেখে তাকিয়ে রইল। একবার মিনতির তাকানো দেখে সে তার গায়েই হেলে পড়ে কেঁদে ফেলল।
     “সত্যি কথাটা বলত রত্না, তোকে কে বিপদে ফেলেছে? ও?”
     “না, সে রোজ...”
    “তবে?”
    “তার বন্ধুরা আমাকে দিনে তিন-চারবার করে...সেই সিনেমার শুটিং হবে বলে কয়ে জঙ্গলের মধ্যের বাংলোতে...”
    বোলতাতে খেয়ে বাঁকা করে ফেলা ঝিঙের মতো সে মাটিতে বসে কেঁদে যাচ্ছে। রক্ত গিয়ে গিয়ে মেয়েটি ফ্যাকাসে হয়ে পড়েছে। পচা ঝিঙের থেকে বেরুনো তরলে যেমন মাটি ভিজিয়ে ফেলে তেমনি সে যেখানে বসেছিল সেখানকার মাটি ভিজে গেছে। মিনতির নাকে একটা পুঁজের গন্ধ এসে লাগল। ঠিক পুঁজ নয়, পচা রক্ত –পুঁজ এক সঙ্গে বেরুলে যেমন গন্ধ করে। এই গন্ধ বস্তির সব মেয়ে মানুষের চেনা।
     “তুই ওষুধপাতি কিছু খাচ্ছিস?”
    “না।”
    “কী করে?”
    “পেটে ব্যথা হয়।”
    “আর?”
    “ মরা রক্ত আর পুঁজ বেরুতে থাকে।”
    “কাল আমার সঙ্গে সরকারি হাসপাতালে যাবি। দিদি জানে কি না?”
    “জানে।”
    রত্না আবার কাঁদছে। মিনতি পরম মমতায় তাকে জড়িয়ে ধরল। এ যেন রত্না নয় । রক্তে লাল কালু। কালুর মতো সেও মিনতির আরও কাছে চেপে আসছে।
     “একটা কথা তুই কি জানিস? তাকে ওই লবণের গর্তে, তার হাতের আঙটিটা..., হীরার আংটিটা নবীন নিজে দেখেছে।” লম্বা ফর্সা একটা আঙুলের হীরের আংটিতে রোদ পড়ে ঠিকরে বেরুলো, সেই আলো ওদের চোখে ছ্যাঁত করে গিয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সেই আলোর দ্যুতি মাংস আর লবণ ঢেলে রাখা গর্তে মিশে গেল।
     রত্নার পিঠে হাত রাখতে গিয়ে গন্ধটা আরও কাছে থেকে টের পেল সে। জগুর বৌয়ের গা থেকেও শুর শুরুতে ঠিক এমনি গন্ধ বেরুতো।
     “শোন রত্না , তুই বড় কম বয়সে ষাঁড়ের গুঁতো খেলি। সাবধান, ওদের দেমাকের সামনে পরতে গলে যাবি না। তোর আরও অনেক দিন আছে।
     “আমি মরে যাবো, আমি জানি। আমার আর মরবার বেশিদিন নেই। গেল অমাবস্যাতে মা মরেছিল, আসছে অমাবস্যাতে আমি...। আমি মরবো, মরবোই আমি।”
     “মরাটা এতো সহজ কথা নয় রত্না। আমাকে দেখতো, আমি ক’বার মরতে চেয়েছিলাম জানিস? এই দেখ, মরতে চেয়েও আমি মরি নি।”
     “আজকাল নবীনদার সঙ্গে...”
    “তোকে কে বলেছে?”
    “ ও ভালো মানুষ।”
    “আছে রে রত্না, হৃদয় থাকা মানুষও আছে সংসারে।”
    রত্না চুপ করে রইল।
    “আমার ঘেন্না ধরে গেছে , বুঝলি রত্না ঘেন্নাতে ধরে গেছে আমাকে। আমিও বা কী পেয়েছিলাম? তোরই বা কী হলো?”
    “ওদের অনেক জোর।” রত্নার চোখে স্পষ্ট ক্রোধ।
     “ঠিকই বলেছিস তুই। ভীষণ দেমাক ওদের, ভীষণ শক্তি, বন্ধুক বোমার শক্তি, টাকার জোর, আলু-বেগুনের জোর।”
     “এতো জোর হলো কী করে ওদের?”
    “সবাই মিলে ওদের এতো জোর দিয়েছে, বুঝলি? আসলে ভয়, বুঝলি? সবাই ওদের ভয় করে।”
    চোখের সামনে হীরের আংটির দ্যুতি লবণ ঢালা মাংসের গর্তে পড়ে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে--- দেখতে দেখতে ওরা দু’জন বসে রইল।
    “কাল বেরুবি আমার সঙ্গে।”
    মিনতি বেরিয়ে এলো। রত্নার বাবা আসছে, “আমার যদি একটা ছেলে থাকত আজ...আমার একটা ছেলে।” স্ত্রী মারা যাবার পর ছেলের জন্যে বুড়োর হা পিত্যেশও বেড়ে গেছে। সবাই বলাবলি করে বুড়োর মাথাটা একেবারে গেছে।
    “ভাত দে বলছি না?” পেছন থেকে রত্নাকে একটা ধাক্কা দিল।
    চুলোতে আগুন ধরিয়ে বিড়বিড়িয়ে উঠল রত্না, “এরও দেমাক বড়।”
    বুড়ো বকেই চলেছে, “আমার যদি একটা ছেলে থাকত আজ...ছেলেটা মাছ, ...।দুধ.. যদি থাকত আমার একটা ছেলে।”
    কিচ্ছুটি না বলে রত্না ভাত রাঁধতে লেগে রইল।    

No comments: