ফেলানি
হঠাৎ বাজারে হুলস্থূল লেগে গেল। একদল ছেলে হুড়মুড় করে তেড়ে এলো । জগুর চায়ের দোকানের গায়ে লেগে আছে মাছ মাংসের বাজারটা । ছেলেগুলো এসে বাজারের বাকি যে ক'টা হাঁস মুরগি পায়রা আছে, এখানে ওখানে আধা ঝুলানো ছাগলগুলোর উপর এমনভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ল যেন পচা আমের গায়ে মাছি পড়েছে। ওদের ভাবগতিক দেখলেই বোঝা যায় ওরা পয়সা দেবে না, হাঁস মুরগি ছাগলগুলোর উপর যেন ওদের মালিকানা রয়েছে। দে --বললে , দিতেই হবে। সবক'টা দোকানদার মনে মনে এদিনের লোকসানের হিসেব করলেও ওদেরকে হাসিমুখেই মাংসগুলো এগিয়ে দিল। 'জয় আই১অসম', 'প্রফুল্ল মহন্ত জিন্দাবাদ', 'অসম চুক্তি জিন্দাবাদ', রাজীব গান্ধী জিন্দাবাদ' 'ভৃগু ফুকন জিন্দাবাদ' 'প্রফুল্ল মহন্ত, ভৃগু ফুকন অমর রহে' ধ্বনি দিতে দিতে ওরা আলু পেঁয়াজ ডাল লেবু যা পারে তুলে নিতে থাকল। জগুর চায়ের দোকানের কাছে চলে এলো ছেলেগুলো । বৈয়াম খুলে যে ক'টা মুড়ির নাড়ু , চিঁড়ার নাড়ু বাকি ছিল তুলে নিয়ে চলে গেল। ওদের হাতে হাতে একজন গোল টেকো, দাড়িমুখের আর একজন অল্প লম্বাটে মুখের চশমা পরা মানুষের ছবি। মুহূর্তে বাজার খালি করে ছেলেগুলো বেরিয়ে গেল। ওদের দেখে মেয়ে মানুষ তিনটি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। ধীরে ধীরে উঠল। জগুও দোকান গোটালো । মুহূর্তের মধ্যে লোকে জমজমাট বাজারখানা জনহীন হয়ে পড়ল। গোটা বাজার মাঝরাত্তিরের মতো তৎক্ষণাৎ খালি হয়ে গেল। মিনতিরাও বাজার থেকে বেরিয়ে পড়ল।
কথা বলতে বলতে একটা হুলস্থূলুর শব্দে ওরা তিনজন চমকে উঠল। পথের এককোনেএকদল ছেলের সঙ্গে একটি মানুষের তর্ক বেঁধেছে । মানুষটিকে সে চিনতে পেল। কালীবুড়ি মুড়ির যে কয়টি বাঁধা গ্রাহকের বাড়িতে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তাদেরই একটি বাড়ির লোক। ছোট পরিবার, ছোট মেয়ে আর বৌ নিয়ে । তিনি শিক্ষক। মানুষটি রোজ বারান্দাতে বসে পত্র পত্রিকা বই পত্রে চোখ বুলাতে থাকেন। সে মুড়ির বস্তা নিয়ে ঢুকলে হাসি একটা দিয়ে রোজ একটাই কথা বলেন, “যা, দিদি ভেতরে আছেন।” মানুষটি একদিনই ওর সঙ্গে একটু বাড়িয়ে আলাপ করেছিলেন। কালীবুড়ি গোলমালে তার বাড়ি আর স্বামী হারানোর গল্প করেছিলেন। শুনে মানুষটি চটে লাল হয়ে গেছিল। সেই মানুষটির সঙ্গেই চ্যাংড়া ছেলে কয়েকটার তর্ক বেঁধেছে । লোকটিকে ওরা ঘিরে ফেলেছে ।
কিছুই বুঝতে না পেরে সে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পরেই শৌচ করবার মতো বসে কাপড় অল্প তুলে দিল। সে স্পষ্ট দেখতে পেল একটু মাংসের মতো কী যেন ঝুলে পড়েছে । আবার কাপড়টা নামিয়ে পা মেলে সে বস্তাতে বসে পড়ল।
Assam from agitation to accordChallenge to India's unity: Assam students' agitation and government
মিনতি , জোনের মা আর সে বাজার সেরে ঘরে ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হলো। আজ তিনজনেই মুড়ির সঙ্গে মোড়াও নিয়ে এসেছিল। দুজোড়া দুজোড়া করে মোড়া সহজেই বিক্রি হয়ে গেল। তিনজনেই মোড়াতে আলাদা আলাদা ডিজাইন তুলেছিল। তিনজনেই ওরা চা খাবার জন্যে জগুর দোকানে বসলগে'। লাল চায়ের সঙ্গে নারকেলের সন্দেশ দুটো দুটো নিয়ে তিনজনেহাত পা মেলে বসল। মালতী মণির জন্যে সন্দেশ একটা নিতে গিয়ে দেখে বৈয়াম খালি ।
“কি রে দোকানি, সব সন্দেশ বিক্রি করে ফেললি?”
“আজকাল ও বেশি করে তৈরি করে দেয় , তবু ফুরিয়ে যায়।”
“ওর শরীর ভালো আছে?” জোনের মা-ই পয়সা ক'টা দিল। মানুষটি পয়সাগুলো দিতে বড় ভালোবাসে । পয়সা দিয়ে ও রোজ বলে, “ মাথার উপর মরদ থাকা মেয়ে মানুষ আমি...।” ঠিকই তো ।জোনের মায়েরই মাথার উপর মরদ আছে, নিজের একটি চালা আছে।
জোনের মায়ের প্রশ্নে জগু চুপ করে রইল।
“ বৌয়ের কথা জিজ্ঞেস করছে, বল না কেন?” মিনতির প্রশ্নটিও জগু এড়িয়ে যেতে চাইছে।
“তোর নিজের চেহারাটা দিনে দিনে ভালো হয়ে আসছে।”
“ সে আর করেটা কী? বৌ সারাটা দিন ,সারাটা রাত খেটে ঐ জিনিসগুলো বানায়। সে ওগুলো নিয়ে বাজারে আসে, আর বসে বসে চা বিলোয়।”
“পয়সা ক'টা গুনে, চাল ডালটা বাড়ি নিয়ে যায় আর রামুর দোকানে বসে তাস খেলে।”
“বাড়ি গিয়ে বৌ পেটায়।”
জোনের মা আর মিনতির ওকে চেপে ধরা মালতী বহুবার দেখেছে। মুচকি হেসে সে ওদের ঠাট্টা ইয়ার্কি দেখছিল।
হঠাৎ জগু ফোঁসে উঠল, “ওর কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবি না। নোংরা বেমারি মেয়েমানুষটাকে আমি বলেই ঘরে রেখেছি । অন্যে হলে সেই কবে লাঠিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দিত।”
“নোংরা বেমারি?” মালতীর মুখের থেকে শব্দগুলো আপনাতেই বেরিয়ে এলো।
হঠাৎ বাজারে হুলস্থূল লেগে গেল। একদল ছেলে হুড়মুড় করে তেড়ে এলো । জগুর চায়ের দোকানের গায়ে লেগে আছে মাছ মাংসের বাজারটা । ছেলেগুলো এসে বাজারের বাকি যে ক'টা হাঁস মুরগি পায়রা আছে, এখানে ওখানে আধা ঝুলানো ছাগলগুলোর উপর এমনভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ল যেন পচা আমের গায়ে মাছি পড়েছে। ওদের ভাবগতিক দেখলেই বোঝা যায় ওরা পয়সা দেবে না, হাঁস মুরগি ছাগলগুলোর উপর যেন ওদের মালিকানা রয়েছে। দে --বললে , দিতেই হবে। সবক'টা দোকানদার মনে মনে এদিনের লোকসানের হিসেব করলেও ওদেরকে হাসিমুখেই মাংসগুলো এগিয়ে দিল। 'জয় আই১অসম', 'প্রফুল্ল মহন্ত জিন্দাবাদ', 'অসম চুক্তি জিন্দাবাদ', রাজীব গান্ধী জিন্দাবাদ' 'ভৃগু ফুকন জিন্দাবাদ' 'প্রফুল্ল মহন্ত, ভৃগু ফুকন অমর রহে' ধ্বনি দিতে দিতে ওরা আলু পেঁয়াজ ডাল লেবু যা পারে তুলে নিতে থাকল। জগুর চায়ের দোকানের কাছে চলে এলো ছেলেগুলো । বৈয়াম খুলে যে ক'টা মুড়ির নাড়ু , চিঁড়ার নাড়ু বাকি ছিল তুলে নিয়ে চলে গেল। ওদের হাতে হাতে একজন গোল টেকো, দাড়িমুখের আর একজন অল্প লম্বাটে মুখের চশমা পরা মানুষের ছবি। মুহূর্তে বাজার খালি করে ছেলেগুলো বেরিয়ে গেল। ওদের দেখে মেয়ে মানুষ তিনটি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। ধীরে ধীরে উঠল। জগুও দোকান গোটালো । মুহূর্তের মধ্যে লোকে জমজমাট বাজারখানা জনহীন হয়ে পড়ল। গোটা বাজার মাঝরাত্তিরের মতো তৎক্ষণাৎ খালি হয়ে গেল। মিনতিরাও বাজার থেকে বেরিয়ে পড়ল।
পুরো শহর যেন দেওয়ালিতে মেতেছে। সাধারণত মিনতি বা জোনের মায়েরা সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি চলে আসে । প্রায়ই বিকেল থাকতে এসে পৌঁছে যায়। কিছু কেনাকাটার থাকলেই দেরি হয়। আজই ঐ পোড়ামুখোগুলোর জন্যে ভয়ে সিঁটকে থাকতেই অন্ধকার হয়ে এলো । শহরে চারদিকে বাজি ফুটছে, বাড়ি বাড়ি প্রদীপ জ্বলছে, বহু জায়গাতে ভোজের আয়োজন। মাঘের বিহু, দেওয়ালি, পুজো সব উৎসব যেন একসঙ্গে পালন করে ফেলছে এই শহর। বাজারে শোনা শব্দগুলো বাজি, মাংস, ভাত, মদের সঙ্গে চারদিকে ছিটকে বেড়াচ্ছে 'অসম চুক্তি জিন্দাবাদ', 'প্রফুল্ল মহন্ত অমর হোন', 'ভৃগু ফুকন অমর রহে,' 'রাজীব গান্ধী জিন্দাবাদ, 'জয় আই অসম'। এরই মাঝে ওরা ক'জন বাড়ি ফিরছে। হঠাৎই মিনতি একটি কাগজে পা ফেলল, মড়মড় করে উঠল বড় কাজগটি। চারদিকের আলোর রোশনাইতে বড়মাপের কাগজের ছবিটি দেখতে সামান্যও অসুবিধে হলো না । সেই গোল,দাড়িমুখো, টেকো মানুষটির ছবি। মিনতি 'আহ!' বলে লাফ দিয়ে উঠল। সে যেন নিজের ছেলেটির গায়েই পা দিয়ে ফেলেছে । হাঁটু ভেঙে কাগজখানা তুলতে গিয়ে সে পরম ভক্তিতে চোখ মুদে প্রণাম একটাও করে ফেলল। তারপর হাত দিয়ে কাগজখানা সমান করে আলতো করে হাতে তুলে নিলো। মুখে ওর একটা লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়েছে । চোখজোড়া কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়েছে, অথচ ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়েছে একটা চাপা হাসি। সে এখন ওর কথা বলবে । বাকি দুজন বুঝে ফেলল।
“ এই মানুষটি ওর ভগবান ছিল। সে আমাকে বলেছিল, এই মানুষটিই অসম থেকে সব বিদেশি তাড়াবে। এখানে রামরাজ্য হবে । আর সে আমাকে প্রায়ই বলত সেই নতুন দেশে ওর আমার একখানা সংসার হবে ।”
দুজনে চুপচাপ ওর কথা শুনছিল। কলেজে পড়া আন্দোলনের লিডার সেই ফিল্মের হিরোর মতো দেখতে ছেলেটির থেকে সে বহু কথা শিখেছিল।
“ সে তোকে বলেছিল গোলমাল হবে বলে?”
“বলেছিল। দিদি জামাইবাবু অফিসে বেরিয়ে যাবার পর প্রায়ই সে এসে আমার বাক্সে বন্ধুক লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিল।”
“ তুই জিজ্ঞেস করিসনি ওগুলো দিয়ে কী করবে?”
“ করেছিলাম। সে বলেছিল অসমের সব শত্রু খতম করবে ।”
কথা বলতে বলতে একটা হুলস্থূলুর শব্দে ওরা তিনজন চমকে উঠল। পথের এককোনেএকদল ছেলের সঙ্গে একটি মানুষের তর্ক বেঁধেছে । মানুষটিকে সে চিনতে পেল। কালীবুড়ি মুড়ির যে কয়টি বাঁধা গ্রাহকের বাড়িতে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তাদেরই একটি বাড়ির লোক। ছোট পরিবার, ছোট মেয়ে আর বৌ নিয়ে । তিনি শিক্ষক। মানুষটি রোজ বারান্দাতে বসে পত্র পত্রিকা বই পত্রে চোখ বুলাতে থাকেন। সে মুড়ির বস্তা নিয়ে ঢুকলে হাসি একটা দিয়ে রোজ একটাই কথা বলেন, “যা, দিদি ভেতরে আছেন।” মানুষটি একদিনই ওর সঙ্গে একটু বাড়িয়ে আলাপ করেছিলেন। কালীবুড়ি গোলমালে তার বাড়ি আর স্বামী হারানোর গল্প করেছিলেন। শুনে মানুষটি চটে লাল হয়ে গেছিল। সেই মানুষটির সঙ্গেই চ্যাংড়া ছেলে কয়েকটার তর্ক বেঁধেছে । লোকটিকে ওরা ঘিরে ফেলেছে ।
“উঠিয়ে নিন আপনার ভবিষ্যৎ বাণী।”
“ না উঠাব না, একশ বার উঠাব না। এই চুক্তিতে কোনও সোনা ফলবে না।”
“ কেন ফলবে না? আপনার মতো দেশদ্রোহী এরকম বলবেনই।”
“ তোমাদের লিডার টাকার পাহাড় জমাবে আর অসমকে শ্মশানপুরী করে তুলবে।”
“ ও মুরগি একটা না দেবে না দিক, তাই বলে আমদের নেতার নামে কথা শোনাবে কেন?”
“ মার একে।”
“ দে দুই চড় কষে।”
“ প্রফেসর হয়েছে।”
“ প্রফুল্ল মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী হয়ে টাকা খাবে! এমন পোড়া মুখ! দে ভেঙ্গে দাঁতগুলো। অমন কথা বলে যে ওর মুখ চেপ্টা করে দে।”
ছেলেগুলো মানুষটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজন মহিলা আর একটি মেয়ে আর্তনাদ করে উঠল। জটলার মধ্যি থেকে ভেসে আসছে কোঁকানোর শব্দ । কোঁকানোর শব্দটি একবার বড় হয় , একবার খাটো।
মালতী পা চালাতে না পেরে দাঁড়িয়ে গেছিল। চোখে ধোঁয়াশা দেখতে শুরু করেছে । পাগুলো কাঁপছে । সে যেন কলাপাতাতে ঠাসা একটা পুকুরে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে । দু দুটো জোক ওর দুই চোখকে যেন সেলাই করে জুড়ে ফেলছে । সামান্য নড়াচড়া করলেই একদল ছেলে কলাগাছগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেবে ।চতুর্দিকে মাংস পোড়ার গন্ধ । সে একটুও নড়াচড়া না করে রাস্তার কাছেই বসে পড়ল।
“ কী হলো হে ওর?” বলে জোনের মা তার শক্তি সমর্থ শরীরে মালতীর নড়বড়ে শরীরটাকে তুলে ধরল, “ ধর , একে ধর। গৃহস্থ ঘরের বৌ, সোয়ামীর আদরে দিন কাটিয়েছে। কপাল পুড়ে আজ বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে ।”
“ জল একটু যদি ছিটিয়ে দিতে পারা যেত।”
“ জলের কথা বাদ দে, আগে রিজার্ভ পাই গে'। চারদিকে কেমন হাল্লা চীৎকার হচ্ছে দেখছিস না, কখন বা কী বা হয় !”
ওকে মাঝে ধরে ওরা বস্তির দিকে এগুলো। ওর দেহের ভারের বেশিটাই নিয়েছে জোনের মা । শহর থেকে যতই দূরে চলে এসেছে ততই হুলস্থূলগুলো কমে আসছে । রিজার্ভের এলাকা পেয়ে যেন ওদের বুক থেকে পাথর নামল। এই এলাকা শান্ত । কোথাও বা দু একটা পাখির ডাক। জঙ্গলের মধ্যি দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ঝির ঝির শব্দ। চেনা শব্দ চারদিকে ।
“ শরীরটা ভাল লাগছে মণির মা?” মিনতি ওর মুখে খানিক জল ছিটিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল।”
“ আজ ঐ বদমাশগুলোর জন্যে অনেক দেরি হয়ে গেল। তোর হয়তো খিদে পেয়েছে ।”
জোনের মা বাড়ির জন্যে কেনা ব্রেডের আদ্ধেকটা ওর দিকে এগিয়ে দিল। ব্রেডের টুকরো ও হাতে নিয়েছে । কিন্তু মুখে দেয় নি । খানিকক্ষণ জোনের মা আর মিনতির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সামান্য হাসবার চেষ্টা করে বলল, “কিচ্ছু হয় নি। মাথাটা অল্প খারাপ লাগছিল।” এবারে সে কাউকে না ধরে হাঁটা দিল।
বস্তিতে ঢুকেই দেখল শহরের সমান নাহলেও এখানেও ধূমধাম হয়ে গেছে। সবারই বাড়ির সামনে ছোট হলেও একটা করে মোম জ্বলেছে । খাবারের আয়োজন হচ্ছে । ভাঙুয়ার ছেলে সবার আগে । সবার ঘরে ঘরে মোম জ্বলাতে বলে বেড়াচ্ছে । তার পেছনে পেছনে একই বয়সের আর কতকগুলো ছেলে । ছেলেগুলো কালীবুড়ির উঠোনে এসে পড়েছে, মুরগি লাগে। ভেতরে মণি কাঁপছে । সে বাজারবারে মাকে বলে কয়ে টাকায় একটা করে মুরগি বাচ্চা আনিয়েছিল। তুলো দিয়ে সাজানো যেন বাচ্চাগুলো । তারই দুটো মরে গেছে, তিনটা সামান্য বড় হয়েছে। ভাঙুয়ার ছেলে আর তার দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুরগি , ছাগল খুঁজছে দেখে সেই বিকেলে এসেই সে বাচ্চাগুলোকে ঘরে ঢুকিয়ে রেখেছে। পরের শুক্রবারের কালী পুজোর জন্যে ভোগের জন্যে কেউ এক জোড়া কালো পায়রা দিয়ে গেছিল। ওদের দেখে কালীবুড়ি সেগুলোই ওদের দিয়ে দিল। পায়রা পেয়ে নিজেদের ভাষাতে কথা বলতে বলতে ছেলেগুলো চলে গেল। কালীবুড়ির উঠোন থেকেই ড্রাইভারণী হাতের ইশারাতে ওদের ডেকে নিয়ে গেল। ছেলেগুলোর সঙ্গে ড্রাইভারণীর হাসি তামাসা ভালোই শোনা গেল। ড্রাইভারণী ওদের চা মিষ্টি খাওয়াচ্ছে । আধঘণ্টাখানিক পরে যখন ওরা ওখান থেকে বেরিয়ে গেল ওদের পা তখন আর সোজা চলছে না । জন্মের থেকে চেনে বলেই বোধহয় নেশা বেশি চড়তে দেয়নি । কালীবুড়ি আর মালতী বাতি নিভিয়ে ড্রাইভারণী আর ছেলেদের কীর্তি দেখতে থাকল। ছেলেগুলো চলে গেলে বুড়ি ওকে ফিসফিসিয়ে বলল, “ এই মহিলার থেকে সাবধানে থাকবি। এ বড়ো সাংঘাতিক মেয়েমানুষ!”
“কেন ?” ওর স্বরও বসে গেছে।
“ ও, যে পার্টির শক্তি বেশি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করে রাখে। সব বাজে কাজের সিদ্ধান্ত ওর ঘরে বসে ঠিক হয়। ওর নিজের বলতে আছেটা কী? তুই মোট কথা সাবধানে থাকবি।”
রোগা পটকা এক মহিলা বাড়িতে ঢুকল। কাছে এলে সে চিনতে পারল জগুর বৌ । মানুষটি আরো শুকিয়ে গেছে ।
“ আয় বস।” কালীবুড়ি পিড়ি পেতে দিল। সে লক্ষ্য করল মহিলা বসবার আগে কাপড়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কী যেন ঠেলে দিল।
“ বসব না বেশিক্ষণ, ঘরে ছেলে চেঁচাচ্ছে। ভাত লাগে । ওদের ভাত খাইয়ে নারকেল কোরাতে হবে । চিঁড়ার নাড়ু, মুড়ির নাড়ু বানিয়েছি।” এইটুকুন বলতেই ও হাঁপিয়ে উঠছিল। খানিক শ্বাস নিলো। এতো দুর্বল মহিলাটি । বসতে যেন ওর বেশ অসুবিধে হচ্ছে । একবার পা মেলে বসে, একবার কুঁচকে। একবার সোজা হয় তো আরেকবার ঝুঁকে ।
“ তোমার হাতের সন্দেশ খাই , কী যে ভালো। আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
“ তুই আর কোন কাজটা না শিখবি , শুনি?” কালীবুড়ি হেসে ফেলল।
“ হবে, শিখিয়ে দেব। কীইবা আর কঠিন কাজ, সামান্য খাটা খাটুনি। মহিলাটি এবারে পা মেলে বসেছে । বড় করে শ্বাস একটা নিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, “ মণির মা, ওদের বাবাকে বাজারে দেখেছিলি আজ? এতো হুলস্থূল হচ্ছে। এখনো ঘরে আসে নি।”
“ দেখেছিলাম। আমাদের সঙ্গেইতো দোকান বন্ধ করল। ফেরেনি এখনো?”
মহিলাটি ঘোপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। কাউকে কিছু না বলে সে চলে যাবার জন্যে পা বাড়াল।
“ তোমার কী অসুখ হয়েছিল , বলছিল জোনের মা। এখন কেমন?” জগুর বৌ দাঁড়িয়ে পড়ল।
“ কই আর ভালো হবে এসব অসুখ?” সে বুঝতে পারল মানুষটির বুক ভার হয়ে এসেছে। শুকনো এই দেহে রয়েছে অনেক কথা । “ ঔষধ খেলে কি আর অসুখ ভালো হয় ?”
যেতে গিয়ে সে গেল না, দাঁড়িয়ে রইল। কী যেন একটা বলতে চাইছে । ওর স্বর খাটো হয়ে এসেছে। “ দোকান বন্ধ করে মানুষটাকে কোনদিকে যেতে দেখলি?” চাপা স্বরটিতে যেন অনেক রাগ, শোক আর অভিমান জমা হয়ে আছে। রোগা পটকা মানুষটি অল্প অল্প কাঁপছিল দাঁড়িয়ে । এক গ্লাস জল খেতে পেলে যেন রক্ষে পায়।
“ চলো , আমার ঘরে বসবে।” সে এমনি করে বলে দেখল। মহিলা এমন ভাবে ঘুরে এলো যেন এই কথাটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সে পেতে দেয়া বস্তাতে বসতে গিয়ে আবারো মানুষটি কাপড়ের উপর দিয়ে যেন কী একটা ভেতরে ঠেলে দিল।
“ কি করলে?” হঠাৎ ওর মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়েই এলো।
“এটাই তো আমার অসুখ, আমার ভাগ্য।”
কিছুই বুঝতে না পেরে সে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পরেই শৌচ করবার মতো বসে কাপড় অল্প তুলে দিল। সে স্পষ্ট দেখতে পেল একটু মাংসের মতো কী যেন ঝুলে পড়েছে । আবার কাপড়টা নামিয়ে পা মেলে সে বস্তাতে বসে পড়ল।
“ দেখলি মণির মা, মেয়েমানুষের জ্বালা।”
“ ডাক্তারকে দেখিয়েছিস।” নিজের অজান্তেই সে মহিলাটিকে তুই বলে বলতে শুরু করে দিল।
“ প্রথমদিকে অসুবিধে দেখে সেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল।”
“কোথাকার ডাক্তার?”
“ কোথাকার আবার, সরকারিহাসপাতালের ।”
“ কী বলল, ডাক্তার?”
“ এই অসুখের কোনও ঔষধ নেই।”
“ ঔষধ নেই? কেন হয় এই অসুখ?”
“ ডাক্তার আমাকে খুব করে গালি দিল।”
“ কিসের জন্যে?”
“তিনবার শরীর খসাবার জন্যে। এমনিতেই পেটে পাঁচটা ছেলে ধরেছি । তার উপর আবার তিনবার গা খসিয়েছি । সে জন্যেই এই অসুখে পেল।”
“কোনও চিকিৎসা নেই বুঝি?” সে মহিলাটিকে দুই টুকরো ব্রেড আর এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল। বিনা আপত্তিতেই ব্রেড টুকরো মুখে দিল সে । মালতী দুটো মুড়িও এগিয়ে দিল।
“ যন্তর দিয়ে জরায়ুটা ভেতরে ঠেলে দিয়েছিল। আবার বেরিয়ে এলো । ডাক্তার বলেছিল, মশলা বাটবে না, জলের কল মারবে না, ভারী জিনিস তুলবে না, নারকেল কোরাবে না। বল মণির মা, এইগুলো না করলে আমাদের চলবে? দিনে আমি বিশ ত্রিশটা নারকেল কোরাই, কোরানো নারকেল পাটাতে বাটি। এ নইলে ভাত দুমুঠো আসবে কী করে?
সে জগুর বৌয়ের শুকনো পিঠে হাত রাখল। তার নিজের কথা বলবার ইচ্ছে হলো । সেই মানুষটির কথা , সেগুন পাতার মতো ছড়ানো হাত যার, সেই ভোৎকা গন্ধের মানুষটার কথা, মুণ্ডহীন ধড়গুলোর কথা, চোখ খসে পরা পিশাচগুলোর কথা ।
“বড় জ্বালা, বেঁচে থাকার বড় জ্বালা।” সে কালীবুড়ির কথাগুলোই আওড়ালো ।
“দেহের জ্বালা সইতে পারি, কিন্তু মনের জ্বালা সইতে পারা বড় কঠিন রে মণির মা।”
“তোর মাথার উপর ছেলে মানুষ আছে, ছেলে মেয়ে আছে। দুবেলা দুমুঠো খেতে পাচ্ছিস। কিসের জ্বালা তোর? আমার মতো তো আর সব পুড়ে শেষ হয় নি।”
“তোর মানুষটা তোর মনে আছে। তাকে মনে নিয়ে সব করতে পারিস। আমার মতো জ্যান্ত স্বামী...।” কী একটা বলতে গিয়ে রোগা মানুষটি কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো।
“ কী করে জগু তোকে?”
“ কী করবে? নিজের বিছানাতে সুখ না পেলে পুরুষ মানুষ কী করে?”
“ জগুর জন্যে তুই এতো করিস আর সে অন্য মেয়ে মানুষ...”
সে বাজার থেকে বাইরে বাইরে মাঠ দিয়ে এসে কই ঢুকে জানিস? ঐ ড্রাইভারণীর ওখানে। রুগ্ন মেয়েমানুষটির হাতের হাড়মাস বেরিয়ে গেছে, শিরা ধমনির রেখাগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ে। সেই হাতে মাটিতে আঘাত করতে করতে বলে যায়, “ আমি যখন নারকেল কোরাই, পরদিনের বাজারের জন্যে পাতাতে সেগুলো বেটে সন্দেশ নাড়ু বানাতে থাকি আমার মানুষটি তখন রেণ্ডীর ওখানে গিয়ে মৌজ করে। গোটা দিনের রোজগার ওর হাতে দিয়ে আমার ঘরে এসে লাঠি হাঁকায় । ভাত ভাত করে বাচ্চাগুলো কাঁদতে থাকে আর ও ওদের ধরে ধরে পেটায়।” মহিলাটি আবারো শৌচ করবার মতো বসে এবারে কাপড়টা একটু বেশিই তুলে দিল। গোটা একটুকরা মাংস ঝুলে দুলতে থাকল, এই অবস্থাতে কি আমার শরীরে আর কোনও কষ্ট সইতে পারে? বল্ আমি এখন কী করি?” শুকনো মহিলাটি থরথর করে কাঁপছে।
“ সে আস্তে করে ওর পিঠে হাত রাখল। জগুর বৌর চোখজোড়াতে এক ফোটাও জল নেই। জ্যেষ্ঠ মাসের ফেটে চৌচির ধান খেতের থেকে তুলে আনা দু টুকরো শুকনো মাটির দলার মতো ওর চোখজোড়া তাকিয়ে আছে।
বাইরে তখন ভাঙুয়া বুড়োর ছেলে আর ওর সঙ্গীদের চুক্তি সম্পন্ন হবার খানাপিনা পুর দমে চলছে। গান বাজছে। ওদের হাসির শব্দে গাছের কাকগুলোও ভয়ে ওদের বাসা থেকে বেরিয়ে কা কা করতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে বিকট সম্মিলিত কণ্ঠে বেজে উঠছে জয়ের নিনাদ। জয় জয় আর জয়।
জগুর বৌ যাবার জন্যে উঠতে উঠতে এক হাতে জরায়ুটা ভেতর দিকে ঠেলে দিল। মালতীর মুখে কোনও কথা নেই। বহুদিন বৃষ্টি না পড়া মাঠের দু দলা মাটির মতো চোখজোড়া যেন শুকনো খড়ের আবর্জনার মতো সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল।
ওর সামনে সামনেও দাঁড়িয়ে রইল আরো একজন বৃষ্টি না পড়া মাটির মতো শুকনো মানুষ।
টীকাঃ
১) আই—মা; জয় আই অসম অর্থ জয় মা অসম।
২) অসম চুক্তি- ১৯৮৫র ১৫ আগস্ট রাজীব গান্ধী নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এবং প্রফুল্ল মহন্ত, ভৃগু ফুকন নেতৃত্বাধীন সারা অসম ছাত্র সংস্থার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি
Assam from agitation to accord
No comments:
Post a Comment