আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Monday, 5 May 2014

অধ্যায় ছয় (৬)

 




ফেলানি 
           
    খন চোখ মেলে তাকালো পাতলা প্লাস্টিকের মধ্যি দিয়ে এসে এক অদ্ভুত নীল রঙের আলো ওর চোখে ছ্যাঁত করে পড়ল ঔষধের গন্ধ লাগল নাকেকান ভরে উঠল কোঁকানো আর কান্নার শব্দেনীল আলোটা সহ্য হয়ে আসার পরে দেখতে পেল ও এক ক্যাম্প-খাটে শুয়ে আছেচারদিকে মাটিতে বালিতে, বস্তাতে বিছানাতে পড়ে আছে মানুষই মানুষপ্রায় সবারই মাথায় হাতে পায়ে আঘাতের চিহ্নসে উঠে বসলতারপরেই চীৎকার দিয়ে উঠল, মণি! মণি!সাদা কাপড়ে এক মহিলা এসে কাছে এলো
          “কী হলো? চেঁচাচ্ছ কেন?
          “ছেলেটা, আমার ছেলেটা, মণি...
          মহিলাটি চলে গেলসে এবারে দাঁড়ালোমণি এসে ঢুকল
         “ মা আমি ভাত খেয়ে এলাম
         “কই?সে ছেলের মুখের দিকে তাকালো
      “ঐ ওখানেছেলে যেদিকটাতে আঙুল দিয়ে দেখালো, সে দেখল ওদিকেও নীল প্লাস্টিকের ছাদে তৈরি আরো বেশ কিছু ঘরঘরগুলোতে প্রচুর মানুষঔষধের গন্ধ ভেদ করে ওর নাকে এসে লাগল পায়খানা আর পেচ্ছাবের গন্ধপেটটা যেন গুলিয়ে উঠলপেটে হাত দিয়ে ওর খেয়াল হলো পেটেরটি একেবারেই নড়াচড়া করে নিকাছে দাঁড়ানো মণির হাতে ধরে সে জিজ্ঞেস করল , মণি, বাবার কিছু...ভাত খেয়ে হাসি খুশি ওর মুখখানা মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেলখানিক পরে ওর মুখের দুটো ধার বেয়ে জল নেমে এলোসে ছেলেকে কাছে টেনে নিলো

   সামান্য দূরে একটা হুলস্থূলু শুনে সে মাথা তুলে তাকালোজন মেয়েমানুষে কজন জোয়ান ছেলেকে গলা চড়িয়ে গালিগালাজ করছেবেগুনি রঙের ব্লাউজ, বেগুনি পাড়ের চাদর আর মুগার মেখলা পরা এক শ্যাম বর্ণের মহিলা বেশি করে কথা কাটাকাটি করছেছেলেগুলোও সমানে তর্ক করছেমেয়েমানুষটি কিছু বলতে বলতে মালতীর দিকেই আসছিলমানুষটির ওর দিকে আসার ভঙ্গিমাটা দেখলে মনে হয় যেন উলু খাগড়ার বন পোড়ানোর জন্যে লাগানো একটুকরো আগুন পাক খেতে খেতে ওর দিকে ধেয়ে আসছেসে হেসে ফেললমেয়েমানুষটি এসে ওর হাত ধরে ছেলেগুলোকে ধমকে দিয়ে বলছে, ওর কেন কোনও চিকিৎসা করানো হয় নি? ওকে কেন এভাবে ফেলে রেখে দেয়া হয়েছে?
মণি মায়ের গেয়ে লেপ্টে ধরে রেখেছেমহিলাটি ওর হাত ছেড়ে পাশে আর যারা কোঁকাচ্ছিল গোঙাচ্ছিল তাদের দেখিয়ে বলল, কী দোষ এই মানুষগুলোর?
      সাদা কোট পরা একটি ছেলে রাগে গজ গজ করতে করতে ওর দিকে ধেয়ে এলোআরো কজন সাদা কোট পরা ছেলে এসে মেয়েমানুষটিকে ঘিরে ফেললমেয়েমানুষটি মালতীর শাঁখা পরা হাতখানা তুলে ধরল, এই এরই জন্যে ওকে ফেলে রাখা হয়েছেসাদা কোট পরা ছেলেদের একজন চড়া গলায় মহিলাটিকে গালি দিয়ে বলল, এদের প্রতি আপনার এতো দরদ কিসের শুনি, দেখি?
মেয়েমানুষটিও গলা চড়ালো, মানুষ বলেই এদের প্রতি আমার দরদ
         “এই ঘাস ফড়িঙের দলগুলোকে, যারা আমাদের খেতের ধান খেয়ে শেষ করে ফেলল, এদের আপনি মানুষ বলছেন?
    
    
     আরেকজন বলল, আপনার মতো মানুষের জন্যেই আজ অসমিয়া মানুষের এই দুর্দশা
         “ তোমাদের বিপ্লবের নেতাগুলো সিংহাসনে বসবেসারা দেশটাকে লুটেপুটে খাবেতোমরা না বিপ্লবের জন্যে ব্লেকআউট করোঅসমে চিরদিনের জন্যে ব্লেকআউট হবে, বুঝেছ? চিরদিনের জন্যে ব্লেকআউট !মেয়েমানুষটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল আর কথাগুলো বলছিল
     
   একজন হাত তুলে মহিলাটিকে তেড়ে এলোমহিলাটিও তেড়ে গেল, কী করবে? মেরে ফেলবে? আমার মত মেয়ে মানুষ একটাকে মারা আর পিঁপড়ে একটাকে মারা একই কথাঐ মানুষটার মাথা কেটে রাস্তাতে ফেলে দিতে চাইছিলেযারা অসমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় তোমাদের নাজিবাহিনীতাদেরই মাথা কেটে রাজপথে ফেলে দিতে চাইছে!মেয়ে মানুষটি আঙুল ঝেড়ে বলছিল, তোমাদের নেতা নিজে রাজা হয়ে রাজভোগ করবার খেলা খেলছে
 
মেয়েমানুষটি আর সাদা কাপড় গায়ে ছেলেগুলোর আশেপাশে বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয়ে গেছেমানুষের ভিড় ঠেলে একটি লোক প্রায় দৌড় দিয়ে মালতীর কাছে এসে দাঁড়াল
        “মণির মা, তুই এখানে কী করে? মণি , লম্বোদর, এই মানুষগুলো...এক শ্বাসে মানুষটি ওর থেকে পুরো মহাভারতখানা জেনে নিতে চাইলমালতীরা পা কাঁপছিল, দাঁড়াতে পারছিল নাএ যে বীরেন বৈশ্যপাট মুগার ব্যবসা করেমণির বাবার কাছে প্রায়ই মুখে একরাশ লজ্জা নিয়ে এসে ও এটা ওটা চেয়ে হাত পাতেবাড়ির পাশের সেই মানুষটিকে পেয়ে মালতীর শোক যেন উথলে উঠলমণির বাবা, মামণির মা, দিদাদাদু...এক এক শ্বাসে ঐ মহাভারতই জানতে চাইলমণি মামণির বাবার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ালো , জেঠামশাই, পাপুরা কোথায়?
       মুগার মেখলা পরা শ্যাম বর্ণের মহিলাটির সঙ্গে যে সাদা কোটের ছেলেগুলো কথা কাটাকাটি করছিল তাদের একজন এসে মণির মা আর মামণির বাবার কাছে দাঁড়ালোইনি...ছেলেগুলো ওর হাতের শাখাগুলো দেখছিলমামণির বাবা মালতীকে ধমক দিয়ে বলল, বলছিলাম কিনা আমি, এগুলোই তোকে মারবে ! কোচের বাড়ি বৌ হয়ে তুই এই বাঙালিদের সঙ্গে পড়ে আছিস ! খোল এই শনিগুলো!
সে শাখাগুলো নাকের কাছে নিয়ে গেলএকটা দূর স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়া নারকেল তেলের গন্ধ এখনো রয়েছে এতেপরম মমতায় সে শাখাগুলো গাল লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
       মামণির বাবা সাদা কোট পরা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, এ কোচের বাড়ির বৌএর স্বামী সাত পুরুষের নির্ভেজাল অসমিয়াহায় ! হায়! নিজের জন্মভূমিতে আজ আমাদেরই মেয়ে বৌদের এ কী অবস্থা হলো!
সাদা কোট পরা আরো একটি ছেলে এসে ওর কাছে দাঁড়ালোএকজন ওর পেটটা পরীক্ষা করল, বেবির অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে নাআপনি কী জাত?
 
 মালতীর চোখের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেল রত্নমালা হাতিরউপরে বসে বডো কিনারাম, গলায় কামরাঙাহার পরে মৌজাদারের মেয়ে রত্নমালাপেরিয়ে গেল ডর-ভয়শূন্য শিলিগুড়ির জোয়ান ক্ষিতীশ, যেখানেই যায় সেখানেই এক রাজহাঁসের মতো ঝিলমিল করতে করতে মা যুতিমালাতাকে খাইয়ে পরিয়ে করে বড় করলেন যিনি সেই রতন কাকা আর বিন্দু কাকিমাও পেরিয়ে গেলেন একে একে---কার কথা বলে সে? না কি তাকে সিঁদুর পরিয়ে যে নিয়ে এলো সেই লম্বোদরের কথাই বলে
  
       সে অপলক চোখে ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলছেলেটিও ওর মুখের দিকে তাকালোছেলেটি একটু অবাকই হলোপৃথিবীর সবচাইতে সহজ প্রশ্নটির জবাব দিতে গিয়ে মেয়েমানুষটি কেমনটি যেন করছে মালতী চুপ রইলশুধুমাত্র মুখের ভেতরে একবার ছেলেটির প্রশ্নটিকেই বিড়বিড়িয়ে গেল, কী জাত?মামণির বাবা আর ছেলেটি একটাই শব্দ শুনতে পেল , জাতবৈশ্য ধড়ফড়িয়ে উঠল , স্ত্রীর কিছু একটা হয়েছে শুনলে মানুষটা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ত, কোথাকার মানুষ কইবা আছেএখানে ওর ভালোবাসার স্ত্রীর এই দশা
         
           সেই মহিলাটি এবারে সাদা কোটের ছেলেদের বললেন , আপনারা ওথ অব হিপক্রেটিকছুঁড়ে ফেলুনমালতীর হাতের শাখা কগাছা দেখিয়ে বলল, আপনাদের কাছে এই মানুষটির থেকে ঐ ধাতুর জিনিসগুলো বেশি বড়

একটি ছেলে মহিলাটিকে ধাক্কা দিয়ে দিল, আপনি এখান থেকে চলে যান, যান! নইলে আরো অপমানিত হবেনমহিলাটির সঙ্গের লোকেরা তাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে চলে গেল
          হুলস্থুলুতে যে ছেলেটি ওকে পরীক্ষা করছিল তার গায়েই ঢলে পড়ল ফেলানি
        “পেসেন্ট বড় উইকএকজন ওকে একটা ইঞ্জেকশন দিলতারপরে বৈশ্য আর ছেলে দুটোতে মিলে ওকে একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে অন্য এক শিবিরে নিয়ে গেলসেখানেই বৈশ্যও রয়েছে সপরিবারেচোখ মেলে ও মামণির মাকে দেখে জড়িয়ে ধরলমামণির মাও ওকে জড়িয়ে ধরল , আমার কপালে আগুন লেগেছে গো! পাঁচটা পোলাপানের দুটো আছেবাকিরা যে কৈ গেল কিচ্ছু বলতে পারি নামণি আস্তে জিজ্ঞেস করল , পাপু কৈ?জবাবে মামণির মায়ের আরেক প্রস্থ কান্নামালতী ধীরে ধীরে বলল, মণির বাবা...ওর স্বর ভেঙ্গে পড়েছেমামণির বাবা এসে অবশ্যি ওকে একটা খবর দিলযাদের যাদের পরিবারের লোক হারিয়েছে কাল মিলিটারি তাদের নিয়ে গ্রামে যাবেমামণির বাবা যাবে হারানো ছেলে মেয়ের খোঁজে; আরো অনেকেই যারা পরিজনকে হারিয়েছে তারা সব্বাই যাবেফেলানিও যাবে কি না জানতে চেয়ে মানুষটি দাঁড়ালো
          “এই শরীরে তুই পারবি বুঝি...?
          “মানুষটার জন্যে...?
          পথে যদি কিছু একটা...
         “কিছু হবে না দাদাপেটেরটি নড়াচড়া বন্ধ করেছেভগবান যদি রাখেন থাকবেনা রাখলে নেইআমার শুধু মানুষটা...
     “ তুই আবার গিয়ে কী করবি? বাদ দে! আমিই খবর করে আসি গেআসলে সে ওকে বলতে চাইছিল মিলিটারি শুধু মরা মানুষকে শনাক্ত করতেই ওদের গাঁয়ে নিয়ে যেতে চাইছেগ্রামে পচতে শুরু করা শবদেহগুলো স্তূপের মতো জড়ো করে রেখেছেওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারল নাশুধু মাত্র অস্পষ্ট স্বরে বলল, যাবি না হয় মনটা শান্তি পাবেকথাটা বলেই পর মুহূর্তে আবারো বলল , দাঁড়া তো দেখি! রাতটা পোহাক তো আগে



8 comments:

Smritikona said...

আজ তোমার সাথে সরাসরি কথা বলার পর থেকে নিউক্যাসেলের আকাশ থেকে যেমন স্নো ঝরেছে তেমনি আমার মনে তৃপ্তিরেণু সারা দিন ঝুর ঝুর করে ঝরেছে।
আচ্ছা একটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ফেলানি বইটার আকার কত পাতা বা কত ফর্মা?
এই পর্ব দেখলাম। ঠিকই আছে, ভালো ভাবেই পড়তে পেরেছি।

Sushanta Kar said...

ধন্যবাদ দাদা! উপন্যাসটার এইতো সবে শুরু। এ যদি চলচ্চিত্র হতো তবে আরো দু'এক অধ্যায় পর থেকে নাম দেখাতে শুরু করত। এতো মাত্র প্রাককথন চলছে। লড়াইটা সবে শুরু। আগে আগে আরো আছে। মোট ৩৮টা অধ্যায় এর!

সুশান্ত বর্মন said...

মনোযোগ দিয়ে পড়তে বাধ্য হলাম। গল্পের প্লটটাই এমন যে কাহিনী ছেড়ে ওঠা কঠিন। সম্পূর্ণ বইটা পেলে সমস্ত কাজ ফেলে এক বসাতে শেষ করতে হতো। আর আপনি বাংলার স্যার। আপনার অনুবাদের ত্রুটি ধরার ধৃষ্টতা আমি কি দেখাতে পারি? ছোট ছোট বাক্য পাঠের গতিকে বাড়িয়ে তোলে। আপনার সফলতা ঠিক এখানেই।
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য অপেক্ষা করছি।

Sushanta Kar said...

সুশান্ত, আপনার কম্প্যুটার সমস্যার সমাধান হলো তাহলে! অনেকদিন ধরে মিস করছিলাম! ছোট ছোট বাক্যের কথাটা দারুণ ধরেছেনতো। ওটা আমি ভাবিই নি। আর কী যে বলেন, আপনিও কি নন মাষ্টার মশাই। বলবেন, বলবেন! ওটা ধৃষ্টতা হবে কেন? আমরা প্রত্যকে প্রতিজন পাশের ব্যক্তি থেকে শিখি। অনেকে এই সত্যকে লুকিয়ে বরং জীবনে চলার পথ বন্ধুর করে ফেলে। ভালো আছেন তো? আপনি যে লেখা দেবার কথা বলছেন আমার মনে আছে!

সুশান্ত বর্মন said...

আমার কম্পিউটার ঠিক হওয়া বলতে যা বোঝায় তা হয়নি। পাপি লিনাক্স দিয়ে ঠেকার কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। আর মানসিকভাবে খুব সমস্যার মধ্যে দিনানিপাত করছি। সুস্থির হয়ে বসে যে একটু চিন্তা করবো, তার ফুসরত পাচ্ছি না।
আপনার লেখাতে কিছু বানান ভুল চোখে পড়ল। ওয়ার্ড ফাইল পাঠিয়ে দিলে চিহ্নিত করে দিতে পারি।

Sushanta Kar said...

আবারো ধন্যবাদ! আমিও এতো ব্যস্ততাতে কাল কাটাচ্ছে যে এ সপ্তাহের কিছু লিখতে পারিনি। আপানাকে ওয়ার্ড ফাইল পাঠাচ্ছি। আপনি নিম্নরেখ দিয়ে চিহ্নিত করে শুদ্ধ বানান পাশে বন্ধনীতে লিখে দেবেন।

নীল নক্ষত্র said...

ফেলানি এত ধীর গতিতে চললে ট্রেন মিস করবে যে!

Sushanta Kar said...

শীতের কুয়াশাতে পথ না দেখতে পেলে ট্রেন নিজেও লেট করে। সুতরাং মিস করবে না। তবে বুঝতে পারছি দেরিটা বড্ড বেশি হয়ে গেছে!