আমার চেতনার রঙে রাঙানো এই খেলা ঘরে:

~0~0~! আপনাকে স্বাগতম !~0~0~

*******************************************************************************************************

Sunday, 4 May 2014

অধ্যায় তিন (৩)


ফেলানি


        মানুষটা অল্প বিছানাতে পড়েছে, গায়ে গা লাগিয়ে ছেলে মণি বাবার মাথার চুলগুলো বিলিয়ে দিচ্ছিলমালতী হাতে একটা চিরুনি নিয়ে বাইরের উঠোনে গিয়ে মুড়ো নিয়ে বসলঝলমল করে ফোটা লাল গোলাপ গাছে পড়ন্ত বেলার আলো এসে পড়াতে ফুলগুলোকে আরো বেশি লাল করে তুলেছেসে চুল মেলে সেদিকে অল্প তাকিয়ে রইলখুলে দেয়া চুলের গাছা মাটি ছুঁয়েছে গিয়েসে নারকেলের অল্প তেল হাতে ঢেলে নিলোচুলের গাছা সামনে টেনে নিয়ে এসে হাতের তালুতে অল্প অল্প করে মাখতে শুরু করলমায়ের সোনাতে বাঁধানো শাঁখা কগাছার থেকে কিটিং কিটিং করে শব্দ একটা হচ্ছে শাঁখাগুলো ছুঁয়ে দেখলআজ তার মাকে ভীষণ মনে পড়লসব সময় যেমন ভাবে , আজো ভাবতে শুরু করল, তার মা না জানি কেমন ছিল ! কোনও যুক্তি নেই, শাঁখা কগাছার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সে মনে মনে মায়ের একখানা ছবি আঁকবার চেষ্টা করলমা ফরসা ছিলচোখজোড়া ছোট ছোট হাসলে প্রায় বুজে আসেহাতপাগুলো ভরাটকী পরিয়ে সে মায়ের ছবিখানা দেখে? শাঁখা কগাছাতে সে হাত বুলিয়ে দেখতে থাকেএকখানা লাল রঙের সোনালি পাড় দেয়া শাড়ি পরে হাসলে চোখ বুজে আসা এক মেয়েমানুষ তার সামনে এসে দাঁড়ান বটেলাল শাড়িতে যেন তাঁকে কোথাও মানায় নারোজকার মতো সে শেষ অব্দি লাল দখনাপরা এক মেয়ে মানুষকে দেখতে পায়মানুষটির সারা গা লাল তাতে হলদে সবুজে ফুলের কাজ করা এক হাত পাড়ের দখনাটিতেই যেন সবচেবেশি মানাবেশাঁখার জোড়াগুলো সে সামান্য সময়ের জন্যে ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসে, মিহি নারকেল তেলের গন্ধএ যেন সে যে তেল মাখছে তার গন্ধ নয় এ তার মায়ের গায়ের গন্ধকোনও যুক্তি নেই, কোনও কারণ নেই, সে শাঁখাগুলোতে মায়ের গন্ধ পায়মশলা হলদি তেল, কাপড় ভেজাবার জন্যে করে রাখা সাবানের জল, উঠোন লেপার জন্যে নেয়া গোবরের জল, ধুয়ে থুয়ে রাখা মাছ, কাটা লাইশাক, বাটা সরিষা---হাতের শাঁখা কগাছাতে যা কিছুর গন্ধই লাগুক সে তাতেই মায়ের গন্ধটিই ঠিক খুঁজে পায় যেনঅযৌক্তিক , অকারণমায়ের কথা ভাবলেই তার বুকটা ভারি হয়ে আসে
   
        গায়ে মৌজাদারের বংশের রক্ত থাকাটাই পাপ ছিল , সে কি আর নিজের অর্জিত পাপ ? বাপ তারা গাছে ভরা ডোবাতে পড়ে থাকবার পর বাচ্চা মেয়েকে ঘরে রাখতে ভয় করতবাপ মরার পর বাচ্চাটিকে বুঝি ধানের ডুলিতে পুরো সাতদিন সাতরাত ঢেকে রেখেছিলরত্নমালাকে দেখে যেমন কিনারাম মাহুতের ডর ভয় মিলিয়ে গেছিল, তার মাকে দেখেও ক্ষিতীশ কারিগরের তেমনি হয়েছিলশিলিগুড়ি শহরের সাত জায়গাতে গুঁতো খেয়ে বড় হওয়া ছেলে, এমনিতেও ডর ভয় কম। । হাতের বিদ্যে আছে, যেখানে সেখানে ভাত একমুঠো জোগাড় করতে পারবেএই ছোট্ট গাঁয়ে কম দিনে ওঁর ব্যবসা বেড়েছিলহাতে সোনাতে বাঁধানো শাঁখা পরিয়ে , শিলিগুড়ির লাল বেনারসিতে সাজিয়ে, চিনির রসে রসগোল্লা দেয়ার মতো বড় আলতো করে মিঠাইর কারিগর যুতিমালাকে হাফ ওয়ালের ঘরটাতে এনে ঢুকিয়েছিলগাঁয়ের লোকে প্রাণ জুড়িয়ে খেয়েছিল আমির্তি, মুখে দিলেই গলে যায় এমনটি ছানায় তৈরি আমির্তি কিনারামেদের সমাজের সব নিয়মই সে মেনেছিলমেয়ের বাড়ির নেমন্তন্ন খাওয়াবার সমস্ত খরচই সে দিয়েছিলশিলিগুড়ির থেকে ক্ষিতীশের আত্মীয় পরিজন যারা এসেছিল তারা সবাই তার ব্যবসাপাতি, বাড়িঘর দেখে কপাল চাপড়েছিলদেশ-বাড়ির মেয়ে বিয়ে করলে সে ঘড়ি সাইকেল, রেডিও ছেড়েও সোনা আর নগদ টাকাও পেতএখন আর ঘরে কিসের দুটো পয়সা আসবে ? উলটে বরং গেলবৌভাতের দিন শিলিগুড়ির থেকে মিঠাই কারিগরের ভাগ্নি ভাতিজী যারা এসেছিল তারা যখন ময়ূরপঙ্খী রঙের বেনারসি পরিয়ে কনেকে বাহারি খোঁপা বেঁধে দিল, তাতে খৈয়ের মালা পরিয়ে কপালে লাল চন্দনের তিলকে সাজিয়ে দিল , তখন তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল মিঠাই কারিগরের মনটি ঠিক কোথায় এক মুঠো মচমচে ভুজিয়ার মতো হয়ে পড়েছিলহাতে নিয়ে একটু চেপে দিলেই বেশ সহজে ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়
সে মাটিতে নারকেল তেলের কৌটাটা রাখতে চাইল , পারল নাপেটটা অল্প নিচের দিকে নেমে গেছেসামান্য একটু ব্যথা যেন এই এলো, এই গেলকোলের উপর তেলের বোতলটা রেখে সে পরম মমতায় শাঁখা কগাছা গালে লাগিয়ে বসে রইলচারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতাবাতাসে চড় চড় করে কলাপাতাগুলোর নড়বার শব্দও এমন কি স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এ যেন কলাপাতার শব্দ নয়, কালবৈশাখীর বাপের বাড়ি যাবার পথে প্রমত্ত বাঁশঝাড়ের বুক কাঁপানো শব্দ এবাড়িগুলোতে তালা, প্রায় মানুষই চলে গেছেঅসমিয়া, বাঙালি, বিহারি, বড়ো প্রায় সব বাড়িরই পুরুষ মানুষগুলো কোথাও থাকলেও পরিবারগুলো নেইবাঙালিদের পুরুষমানুষেরাও নেইমালতী পাশের শিবানীদের বাড়ির দিকে তাকালোপথের মোড়ে ওদের ফার্মাসি রয়েছে, শিবানীর বাবা আর বড় দাদা আছে বাকি পরিবারটি চলে গেছেকোচ বিহারের মাসির বাড়ি গেছেবাঁ পাশের সুভাষ মাস্টারের বাড়ির উঠোন এ সময়ে সাইকেলে ভরে থাকেমাস্টার , কী করছ হে লম্বোদর?বলে ডাক একটা দিয়ে যায়মণির বাবাও চেঁচিয়ে কখনো জিজ্ঞেস করে, ট্যুশন চলছে কি না?আজ থমথমে নীরবতামাস্টারও নিজের পরিবারকে আলিপুরদোয়ারে পিসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেসামনের রতি সাহার বাড়িতে বুড়োবুড়ি দুজন আছেনছেলে বৌরাও আছেসমস্যা হয়েছে এই বুড়ো বুড়িকে নিয়েদুজনেরই বাতের ব্যথাদুজনেই হাড় মাস এক করে , রক্ত জল করে বানানো ভিটে বাড়ি ছেড়ে যাবেন না এমনিতেও মরবার বয়স হয়েছেকেউ মারলেও মরা, এমনিতেও মরাপেছনটায় বীরেন বৈশ্যের বাড়ি, পাট মুগার কাপড়ের ব্যবসা করেঅবস্থা বেশি ভালো নয়, ছেলে মেয়েও পাঁচটাপ্রায়ই মানুষটি মণির বাবার কাছে এসে হাত পাতেবহু বছরের পুরোনো মানুষ এরাযদিও রতি সাহাদের মতো নয়সাহারা ধান পাটের খেত খামারে, গুয়া তাম্বুলের গাছে, গরু গোয়ালে ভরা গৃহস্থ
 
 কারো কাশির শব্দ শুনে সে মাথা তুলে তাকালমামণির বাবা ,মানে বীরেন বৈশ্য এসেছেনমানুষটা এসেই ওর শাঁখাগুলোর দিকে কটমট করে তাকালেন
  
       “তুই এখনো এগুলো খুলিস নি?
সে মাথা নত করেকেউ বলল বলেই কি সে এগুলো খুলতে পারে? কেউ কি বুঝবে তার মায়ের গন্ধটার কথা?
      “মরবি! এই কটির জন্যেই মরবি! যখন আসবে হাতিতে গুঁড়িয়ে নিয়ে যাবার মতো নিয়ে যাবে
      
      কী হলো?মণির বাবা উঠে এসেছেমালতী চা করবার জন্যে উঠে গেলভেতর থেকে সে কান পেতে মণির আর মামণির বাবার কথা শুনে গেলওরা সেই একই কথা গুণগুণাচ্ছেমামণির বাবা আবারো সেই একটা করে গামছা পতাকার মতো দুই ঘরে উড়িয়ে রাখার কথা বলছেমণির বাবা মানা করছে, এতো দিন এক সঙ্গে থাকলাম আজ খারাপ দিন এলো বলেই...মণির বাবার স্বর কান্নার মতো শোনাচ্ছেসে মামণির বাবার হাতটা চেপে ধরেছে, ওকে কী করে বাড়িতে নিয়ে যাই? পুল নেই, রাস্তার হাল এমনটাঠেলা ধাক্কার চোটে বেটা মানুষের শরীরেরই হাড়ে মাংসে এক হয়ে যায় আর ওকে এই শরীরে...মালতী চায়ের কাপগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলকিছু পরোয়া করে না যে মানুষটা সেই সমর্থ মানুষটা আজ কেমন কেঁদে গলে যাচ্ছেরতি সাহা এসেছে , সঙ্গে সাহার মাবুড়ি হাতে করে এক কাঁদি কলা নিয়ে এসেছেবুড়িকে দেখেই মালতী দিদাবলে এগিয়ে গেলবুড়ি ওকে ভীষণ আদর করেবুড়ি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলতাঁর হাতে শুধু ছাল আর হাড়ছাল ঝুলে পড়েছেসাদা আঁকি বুঁকিতে ভরা ছালে কালো কালো ফুট ফুট দাগ পড়েছেপাটি একটাতে বসে সে বুড়ির সঙ্গে কলকলিয়ে বাংলাতে কথা বলতে শুরু করেছে বুড়ির সঙ্গে সে এমন করে বাংলাতে কথা বললে লম্বোদর বেশ আমোদ পেয়ে তাকিয়ে থাকেসেও তার দরঙ্গীয় ধাঁচে দুএকটা বাঙলা বাক্য বলবার চেষ্টা করেমেয়ে মানুষ দুটিতে হেসে অস্থির হয়ে পড়েমালতী আজ বুড়িকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করছেষাট ইংরাজির গোলমালের সময় মা কেমন করে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে রতন ঘোষের আধপোড়া ভিটেতে মরে গেছিলসে কথা আজ সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলবহুবার শুনেছেকখনো বা বুড়ি তুলেছে, কখনো বা সে নিজে তুলেছে কথাটা লম্বোদর অল্প চুন নিতে এসে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল নাআবারো মাথা নুয়ে চলে গেলমালতী বুড়ির কোঁচকানো মুখখানার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলবলিরেখাতে ভরা একটি মুখ, মাথার চুল পুরো সাদা, ভুরু দুটোও সাদা হয়ে গেছেসাদা চুলের সিঁথিতে উজ্জ্বল লাল সিঁদুর, কপালে বিশাল বড় সিঁদুরের ফোঁটাসমগ্র কান জুড়ে মিনা করা এক ময়ূর পাখিলতিতে ঝুটির সঙ্গে মাথা আর কান জুড়ে পেখম তোলা লেজখানানাকে একটা ছোট্ট নাকফুলবুড়ি কথা বলবার বেলা হাত নাড়িয়ে অঙ্গী ভঙ্গি করে কথা বলেহাত নাড়ালে হাতের পলা আর শাঁখা কগাছার থেকে একটা শব্দ হয়মালতী যেন এই রোদ পড়ে মাঝে মাঝে ঝিলমিলিয়ে ওঠা বুড়ির কানের পেখম তোলা ময়ূরটা, নড়ে ওঠা লালে সাদায় পলা আর শাঁখা কগাছা, কপালের সিঁদুরের ফোটার যাদুতে বাঁধা পড়েছেসে সব ভুলে গেছেগোলমাল , মণির বাবা, মণি এমন কি মাঝে মাঝেই ব্যথায় রাইজাই করা নিজের শরীরটিকেওময়ূরটি, শাঁখার জোড়া , ফোঁটাটা নাড়া চাড়া করছেতারই মাঝে মাঝে তার মা তার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে
  “
        বুড়ির শাঁখাগুলো একবার নিচে নামছে আরেকবার উপরে উঠছে, মাঝে মাঝে ডানে বাঁয়ে দুলছে... গ্রামটির থকে শহরে ফুটবল খেলবে বলে বাসে করে দলটিকে নিয়ে যাচ্ছিল সুভাষ মাষ্টারবাসে রোজ যেমন উঠে তেমনি মানুষ উঠেছিলসেই ছেলেগুলোও কোনও একটাতে উঠেছিলহঠাৎই মাষ্টার দেখল কোথাও যেন শব্দ একটা হয়েছেনা হবার মতো কিছু একটা হয়েছেতাঁর কানে এসে পড়ল গোটা কয় শব্দ, এক পিস করেও ভাগে পড়বে নাশব্দ নয়, যেন গলানো সিসেমাষ্টার তৎক্ষণাৎ বাসটা থামিয়ে নিজের ছাত্রদের থেকে চারটাকে নামিয়ে দিলেভাগে এক পিস করেওনা পড়ার কথা যারা সরবে বলছিল তারা হায়ার করা প্লেয়ারমাষ্টার নিজের গাঁয়ের থেকে নিয়ে আসা নিজের ছাত্র কয়েকজনকে নামিয়ে দিয়ে ভাবল তাঁর নিজের শরীরটা বা ভাগে কপিস করে পড়বে? ছেলেগুলো গ্রামে ফিরে গেলভাষা আন্দোলনের গরম বাতাসের সামনে ফুলকি পড়ল, চারদিকে ধোঁয়া দেখা দিতে শুরু করলবাসের থেকে নামিয়ে দেয়া গাঁয়ের ছেলেরা বেশ করে পাথর লাঠি নিয়ে টাউনে যাবে বলে বেরুলভাগে এক পিস করেও পড়বে নাবলে আশংকা করেছিল যারা সেই হায়ার করা প্লেয়ার, অচেনা ছেলেদের দলও এগিয়ে গেলবেলা চারটার থেকে হাতাহাতি, মারামারি, পাথর ছোঁড়াছুঁড়িচারদিকে ঢিল ছুটে আসবার মতো গুজব রটলহায়ার করা প্লেয়ারের দলটি রাতে ট্রাকে উঠে আসা বন্দুকধারীতে রূপান্তরিত হয়ে গেলএক ধার থেকে গাঁয়ের পর গাঁ জ্বলল
       বুড়ির চোখের জল কপালের ফোঁটার আকৃতি পাল্টে দিয়েছে...মালতীর মায়ের মালতীর মতো অবস্থা তখনপেট নামছেজলও ভাঙছেগ্রামের লোক গাঁওবুড়া হরেন দাসের বিশাল মরাপাটের খেতের মাঝে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে বসেছেগাঁওবুড়া থেকে শুরু করে গাঁয়ের মাতব্বর লোকেরা ট্রাকে যারা উঠে এসেছে সেই সব লোকেদের দলকে পাটখেতের মাঝে লুকোনো মানুষগুলোনামগন্ধ পেতে দেন নিওঁরা চিঁড়া মুড়ি, নারকেল যা পারেন লুকিয়ে লুকিয়ে এই লুকোনো লোকজনকে দিয়ে পাঠিয়েছেনএমন কি পুকুরে বাসন কোশন ফেলে রাখতে, পাট খেতে ট্রাঙ্ক লুকোতে সাহায্য করেছেনহায়ার করা প্লেয়ারগুলো বাড়তে বাড়তে তিন চার ট্রাক হয়ে গেছে, হাতে হাতে লাঠি, বল্লম, পেট্রল , কেরোসিনগাঁওবুড়া, শইকিয়া, বরা, হাজরিকারা কাঁপতে কাঁপতে দেখছেন চতুর্দিকে আগুনএ আগুন পাটখেতের ভেতর থেকেও মানুষগুলো দেখছেসেখানে এই বুড়িও ছিলআগুনে লাল করে ফেলা আকাশের দিকে বুড়ি তাকিয়ে ছিল
এবারে নাকের জলে নাকফুলটাও ভিজে গেছে...মালতীর মায়ের থেকে থেকে ব্যথা উঠছিলতাকে বিছানার নীচে রেখে ক্ষিতীশ কারিগর একটু বাইরে গেছিল পরিস্থিতি দেখবে বলেসঙ্গে সম্পর্কিত ভাই রতনদুজনেই দেখেছিল এক লরি বন্দুকধারী মুখ বাঁধা মানুষ, হাতে হাতে অস্ত্ররতন ঝোপ জঙ্গলের মধ্যি দিয়ে পাট ক্ষেতের মাঝের জায়গা করে বসা মানুষগুলোর কাছে গিয়ে পৌঁছুলোলরি আসবার খবর  পেয়ে পাট খেতে না আসতে পেরে কেউ বা উপরে আগাছা আবর্জনা দিয়ে গর্তের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে, কেউ বা জঙ্গলে লুকিয়েছেশুধু লুকোবার চেষ্টা করেনি ক্ষিতীশসে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছেবাড়িতে যে মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছে তার কী করে সে? এক বালতি জল তুলতে না দিয়ে , ভালোর থেকে ভালোটা এনে খেতে দিয়ে রেখেছে যাকে সেই ঘরের মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছেদরকারের সময় লাগবে বলে টাকা পয়সা কিছু গুটিয়ে রেখেছিলএখন সে পয়সাতে কী করে? সে হনহন করে রাস্তা দিয়ে হাঁটা দিলকিছু একটা করতেই হবেসেই তাকে শেষ দেখা গেছেকেউ জানতে পেল না তার কী হলোঘরে যে মেয়ে মানুষটি কোঁকাচ্ছিল সে ছ্যাঁচড়ে ছ্যাঁচড়ে রতনের বাড়ি অব্দি এসেছিল
        বুড়ির মুখের ভাঁজ আরো আঁকা বাঁকা হয়েছেমালতী প্রায়ই যেমন শুনতে পায়, তেমনি জলে একটা ঝপাং করে শব্দ শুনতে পেলমায়ের কথা উঠলেই সে শেষে ওই শব্দটি শুনতে পায়হাতের শাঁখা কগাছা গালে লাগিয়ে সে বসে রইলওর শরীরটা যেন কেমন করেছেকেউ ওকে ডাক একটা দিয়ে গেলগাঁ ছেড়ে যাওয়ার পথে কেউ হবে বুঝি বামাকে ডেকে নিয়ে যেতে বুড়ির ছেলে এলোবুড়ির ছেলের থেকেই জানতে পেল পাটখেতের মাঝে জায়গা করা হয়েছেনারকেল চিঁড়া মুড়ি গোটানো হয়েছেজায়গায় জায়গায় গর্ত করে আগাছা আবর্জনাতে ঢেকে রাখা হয়েছেগেলবারের গণ্ডগোলের সময় বহু মানুষ এই গর্তে ঢুকেই প্রাণ বাঁচিয়েছিলমানুষগুলো বারে বারে গেলবারের গণ্ডগোলের কথা পাড়ছে
        
          আগুন দেয়া দলটি রাতে আগুন দিয়ে সকাল থেকে আর আসে নিহাতে বন্দুক এক দুটোই ছিল পুকুরের বাসনপত্র, ঝোপঝাড়ে রাখা বাক্সপত্রে হাত দেয় নিপাটখেতের ভেতরের মানুষগুলো কিছু রাত থাকতেই বেরিয়ে বাড়ি ঘরে ফিরে এসেছিলআগুন নিভিয়েছিলপুকুর থেকে বাসনপত্র তুলেছিলঘুরে ঘুরে মিঠাই কারিগরের কথা উঠছিলকেউ একজন ক্ষিতীশ নিখোঁজ হবার পরদিন কুকুরে টানাটানি করে শতচ্ছিন্ন করা রক্তমাখা সার্ট একখানার কথা বলছে

   
         ভীষণচাপা গলাতে বলাবলি হচ্ছিল এ গাঁয়ে ওরা আসবেই এখানেই বিয়ে হয়েছিল রত্নমালার মেয়ে যুতিমালারযুতিমালা এখানেই মিঠাইর কারিগরের গৃহিণী হয়েছিলএখানেই আছে যুতিমালার মেয়েমৌজাদারের বাড়ির একটি ছেলে আন্দোলনের বড় লিডারগুয়াহাটির থেকে সমস্ত নেতাগুলো এলে ওখানে থাকেবহু কথা উঠছেগেলবারের গণ্ডগোলের বেলা লোকগুলোর হাতে যে বন্দুক ছিল সে বুঝি ঐ মৌজাদারেরই বাড়ির বন্দুকপ্রথম রাতে এ গাঁয়ে এ জন্যেই আক্রমণ হয়নি যে বন্দুকটি অন্য গাঁয়ে গেছিলমিঠাই কারিগরকে বুঝি পেছন থেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে গুলি করেছিলঅনেক কথা উঠছে, আগা নেই গোড়া নেই, জাতে জাতে কথাঘুরে ঘুরে কথাগুলো এসে ঐ এক জায়গাতেই জড়ো হয়এবারে আর বন্দুক একটা নয়, হাতে হাতে বন্দুকমৌজাদারের বাড়ির নেতাটি বুঝি এবারে এই গ্রামটিকেউপড়ে ফেলে তবে ছাড়বেগুয়াহাটির দুজন বড় লিডার এসে শহরের হাইস্কুলের ফিল্ডে সভা করে গেছে বুঝিসভাতে অসমিয়া মানুষকে ওরা দয়া মায়া, আদর স্নেহ ইত্যাদি ভুলে যেতে বলে গেছেবলে গেছে মানবতা, মানুষ এই শব্দগুলো ভুলে নিজেদের কঠিন করে তুলতেকেউ একজন গুয়াহাটির নেতা বুঝি মৌজাদারের বাড়িতেই আছেওর হাতে বুঝি এমন বন্দুক রয়েছে যেটি ঘুরালেই পাখি মারবার মতো মানুষ মারেএকই ধরণের কথাগুলোকে ফেনানো হচ্ছেশোনা কথাটাকে বলছে নিজের চোখে দেখা,    চোখে দেখা কথাটাকে বলছে নিজেরই কথামাথা মুণ্ডু নেই, দাড়ি কমা নেই, লম্বা লম্বা ভাষণ
      
     সবাই লম্বোদরের উঠোনের থেকে দেখতে পেল গাঁওবুড়া পরিবার নিয়ে, জিনিসপত্র সহ যাবার জন্যে বেরিয়েছেনসবাই উঠে রাস্তা অব্দি গেলসবারই গলা শুকিয়ে গেছেনিজের পাটখেতে যিনি সবাইকে জায়গা করে দিয়ে আশ্রয় দেন, যিনি লরিতে আসা লোকগুলোর একা একা মুখোমুখি হন , ঘর বাড়ি পোড়া মানুষগুলোকে নিজের বাঁশঝাড়ের থেকে বাঁশ দিয়ে যিনি অভয় দেন সেই মানুষটি আজ পরিবার নিয়ে যাবার জন্যে বেরিয়েছেন! লম্বোদরদের মুখে রা নেইতাঁর মুখখানা ভয় আর আতঙ্কেসাদা হয়ে গেছেলম্বোদরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আগুনে যখন পোড়ায় লাকড়ি , বাঁশ, খের কিচ্ছু মানে নাহাভাতে মানুষ হয়ে আগুনের সঙ্গে কী যুদ্ধ করবি?বৃদ্ধ মানুষটির স্বরটা বসে গেছে , এ আগুন কারো ভালোর জন্যে জ্বলে নি কোনও সাধারণ মানুষের সাধ্য নেই একে বাধা দেয়, সব্বাইকে পুড়িয়ে ছাই করবেএবারে বৃদ্ধ লাঠিটা ধরে বসে পড়লেন, আমার কুকুরটা কোনও কাজের নয়, শুধু পড়ে পড়ে খায়ওর উপরেই পিতৃপুরুষের ভিটেমাটির ভার দিয়ে যাবার জন্যে বেরিয়েছিবুড়ো বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছেন,যমে মানুষে টানাটানির দিনে আর পাপ বাড়াব না
 
           দৃঢ়চেতা মানুষটিপা ফেলতে গিয়ে কাঁপছেনদেখে সব্বাই স্তম্ভিত হয়ে গেলনিমেষে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো কাল ভোরেই সবাই এই গ্রাম ছাড়বেনেবে, মালতীকে পাঁজাকোলা করে হলেও নিয়ে যাবেআজ রাত্রিটা শুধু পার হোক

4 comments:

Uddipana Goswami said...

i see you have used the axamiya 'ya' in the bengali script :-) reminds me of so many instances where - just as the people of assam have taken from the bengalis - bengalis of assam have also adopted so many idioms and idiosyncracies of the other communities of assam. this give and take is true of every community living in assam. and yet, we had the assam movement, and yet, we continue to hear of ethnic cleansings. novels like 'phelani' help us go beyond our petty search for narrow, exclusivist identities and i am glad you have taken up the task of translating it.

Sushanta Kar said...

Oho! You anticipated I might have write, 'আসামী(!)' Ha Ha Ha ! Thanks for your stirring words.It will make others to follow the novel. If propagated well I hope this novel will be considered as one of the best classic in the Indian literary history!

indira mukerjee (ইন্দিরা মুখার্জি) said...

really true!! darun lagche ...Plz carry on.. We are with you...

Sushanta Kar said...

I will! The journey of Phelani has started from the chapter Four! It's terrible. Your words give me enough strength to keep going!